জোৎস্না রাতে তুমি আর আমি পর্ব-১০

0
19

#জোৎস্না_রাতে_তুমি_আর_আমি — [১০]
লেখনীতে;- #রুদ্রিকা_বেদী।

[ গল্প কপি করা সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ ❌]

“আমি যাবো না! কিন্তু! না যেয়েও তো উপায় নেই! ”

ঘর জুড়ে পায়চারি করতে করতে নিজের সঙ্গে বিড়বিড় করতে লাগলো দ্যূতি। চুলটুল সব এলোমেলো হয়ে রয়েছে। পরশু দিন যাবে অফিস থেকে ট্রিপে। আরুশও যাবে! দ্যূতি আরুশের আশেপাশে যতটা থাকতে চাইনা ততটাই যেন উপর ওয়ালা দায়িত্ব নিয়ে ওকে আরুশের সামনে দাঁড় করিয়ে দেয়। হঠাৎ দ্যূতির ফোন বেজে উঠল। দ্যূতি ধীর পায়ে খাটের কাছে গেল। ফোনের উপর উঁকি মারতেই সে দেখাতে পেলো,ঈশা কল করেছে।

‘ঈশানি ঈশা’ দ্যূতির ছোট বোন। দেখতে ভারি সুন্দর। গোল গোল চোখ,লম্বা মুখ। চিকন ওষ্ঠধর, এককথায় পরী। বোনের নামটা চোখের পর ভেসে উঠতেই দ্যূতির ঠোঁটে হাসি ফুটল। পিউয়ের উপর যদি কাউকে সব চেয়ে বেশী ভালোবাসে ও সেটা হচ্ছে ওর ঈশা।

“ হ্যালো! ”

দ্যূতি ফোন তুলে কল রিসিভ করল।

“ হ্যালো আপি! তুমি নাকি ট্রিপে যাচ্ছো? ”

ঈশা কোনো রকম ভনিতা ছাড়াই প্রশ্ন করল। দ্যূতির ভ্রু কুঁচকে আসলো। ও তো বলিনি তাহলে?

“ হ্যাঁ যাচ্ছি! কিন্তু তুই কিভাবে জানলি? ”

“ পিউ আপি বলেছে! ”

“ পিউ আপি? ” কথাটা বিশ্বাস হলো না এমন সুরে আবার জিজ্ঞেস করল।

“ কেন? আপি কি শুধু তোমার একার আমার না? আমার সাথেও পিউ আপির কথা হয়, তখন বলেছে! ”

“ আমি কি একবারও সেটা বলেছি! পিউ আপি তো আমাদের সবার, কিন্তু অধিকারটা একটু আমার বেশি! ”

“ বললেই হলো! ”

এই নিয়ে দুজনের মাঝে বেশ কিছুক্ষণ কথা হলো। কিছুক্ষণ পর ঈশা চিকন সুরে বলল,

“ আপি তোমাকে একটা বলার ছিল!”

“ বলে ফেলো! ” দ্যূতি খাটে বসতে বসতে বলল।

ফোনের অপর পাশে কিছুক্ষণ সবকিছু নিরব থাকলো। দ্যূতি পুনরায় বলে উঠলো,

“ ঈশা? ”

“ হ্যাঁ আছি! ”

“ আসলে আমি ভেবেছি কলেজের জন্য আমি ঢাকায় যাবো, ওখানের বেস্ট কলেজে পড়বো! ”

আমতা আমতা করে ঈশা বলল। দ্যূতি কথাটা শুনে কিছুক্ষণ নিরব থেকে বলল,

“ সেটা কিভাবে হয়? এখানে পড়বি মানে? থাকবি কোথায়? ”

“ কেন তোমার বাসায়! ”

“ আমার বাসায়? সম্ভব নয়! আমি কাজের জন্য বাইরে বাইরে থাকবো তুমি একা এই ঢাকা শহরে, না না আমি তোমাকে এখানে আসার পারমিশন দিতে পারছি না! তুমি ঢাকায় আসছ না! ”

দ্যূতি কাঠ কাঠ কন্ঠে নিজের সিদ্ধান্ত জানিয়ে দিলো। কলের অপর পাশে অনেকক্ষণ কোনো শব্দ আসলো না। দ্যূতি দীর্ঘ শ্বাস ছেড়ে কিছু বলতে যাবে তখনই ঈশা বলে উঠল,

“ মা আমাকে পারমিশন দিয়ে দিয়েছে! আমি ঢাকায় আসছি মানে আসছি! যদি দরকার পরে আমি পিউ আপির ওখানে থাকবো কিন্তু আমি ঢাকায় পড়বো…..”

বলেই কল কেটে দিলো ঈশা। দ্যূতি বিরক্ত হয়ে ফোনটা খাটের উপর ছুড়ে ফেলল। নিজের কপালে হাত দিয়ে দ্যূতি বলল,

“ আমাকে জ্বালানোর জন্যই এই পৃথিবীতে সবাই পয়দা হয়! ”
.
“ আমার বৌমার নাম দেবাদৃতা দ্যূতি! ইকোনমির স্টুডেন্ট, আমাদের অফিসে ইন্টার্নশিপ করছে! তাই তো? ”

তুহিন সাহেব ছেলের দিকে আড়চোখে তাকিয়ে মিটিমিটি করে হেসে বলল কথাগুলো। আরুশ বাবার কথা শুনে খাওয়ার মাঝ পথে থামিয়ে দিয়ে বাবার পানে তাকালো। তুহিন সাহেবের মুখে তখনো রহস্য ময় হাসি। আরুশ নিজের নিচের ঠোঁট ভিজিয়ে দিয়ে বলল,

“ তুমি কিভাবে জানলে? ”

তুহিন সাহেব কোনো উত্তর দিলেন না। আগের মতো খাওয়ায় মনোযোগ দিয়ে তাকিয়ে রইলেন। আরুশ কিছুক্ষণ চুপ থেকে বলল,

“ শিহাব বলেছে তাই তো? ”

“ হ্যাঁ! ও ছাড়া আমাকে আর কেই বা বলবে! আরো কিছু শুনেছি আমি!”

আরুশ ভ্রু কুঁচকে বাবার দিকে তাকাল। তুহিন সাহেব খাওয়া থামিয়ে ছেলের দিকে গাঢ় দৃষ্টি ফেলে বলল,

“ বৌমার উপর নজরদারি করানো হচ্ছে! বেচারী কোথায় যায়! কি করে,কি খায়,সব নজরে রাখার হুকুম রয়েছে! ”

বাবার কথা শুনে আরুশের চোয়াল শক্ত হয়ে উঠলো। দাঁতে দাঁত চেপে বলল,

“ শিহাবের বাচ্চা! কোনো কিছু পেটে থাকে না! ”

“ ছেলেটার কোনো দোষ নেই! তুই যেমন ওকে ভয়ে রাখিস আমিও ঠিক ভালোবেসে কথা গুলো জেনে নিয়েছি! ”

“ ভেরি ফানি! ”

আরুশ কটাক্ষ করে বলল। তুহিন সাহেব হো হো করে হেসে উঠলেন। আরুশ বাবার দিকে বিরক্ত মুখ নিয়ে বলল,

“ এতো কিছু যেহেতু জেনছ, তাহলে এটাও নিশ্চয় জেনছ যে আমরা পরশু দিন ট্রিপে যাচ্ছি! ”

তুহিন সাহেব হাসি থামিয়ে আরুশের দিকে তাকিয়ে বলল,

“ হ্যাঁ জানি তো! ট্রিপটা কি কারণে সেটাও জানি! এই ট্রিপের কারণে আমার ছেলে প্রথমবার অফিস বন্ধ দিয়েছে! সব জানি পুত্র… তুমি যে কম্পানির CEO আমি সেই কম্পানির চেয়ারম্যান! ”

আরুশও এবার হাসল। তুহিন সাহেব উঠে দাঁড়িয়ে ছেলে কাছে আসলেন। বাম হাতটি ছেলের মাথায় বুলিয়ে দিয়ে বললেন,

“ শুধুই কি প্রপোজ করবি নাকি এই ট্রিপ থেকেই বাড়িতে বউ আনবি? ”

আরুশ ঘাড় ঘুরিয়ে তুহিন সাহেবের দিকে ফিরে তাকালো। তুহিন সাহেব তার একটি ভ্রু উঁচু করে জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে ছেলের দিকে। আরুশের মুচকি হেসে বলল,

“ বুদ্ধিটা খারাপ না বাবা! ”

তুহিন সাহেব অবাক হয়ে বললেন,

“ এই যে আমার গুণধর পুত্র! আমি কিন্তু মজার করে বলেছি, সিরিয়াসলি নিয়ে নিও না! ”

আরুশ উঠে বাবার মুখোমুখি হয়ে দাঁড়িয়ে বাঁকা হেসে বলল,

“ অলরেডি সিরিয়াসলি নিয়ে নিয়েছি! ”

বলেই আরুশ উপরে চলে গেলো। তুহিন সাহেব ছেলের যাওয়ার দিকে বিস্মিত দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইল। আরুশ উপরে যেতেই তুহিন সাহেব মুখ উপরের পানে করে বলল,

“ তোমার এই গুণধর ছেলে কি খাইয়ে পয়দা করেছিলে নূর! কখন কি মাথায় চলে বোঝার উপায় নেই! ”
.
আজ ট্রিপে যাওয়ার দিন। মাঝের একদিন আরুশ সবাইকে তৈরি হওয়ার জন্য ছুটি দিয়েছিল। গাড়ি ছাড়বে আটটাই। এখন ঘড়িতে বাজে সাতটা। ঢাকা থেকে চার গাড়ি যাবে। সবাই আসা শুরু করে দিয়েছে। সবাই সবার পছন্দ মতো সিট বেছে নিলো। আরুশ চলে আসলেও দ্যূতি এখনো আসেনি। আরুশ গাড়িতে উঠে দুই সিটের এক সিটে যেয়ে বসল। শিহাব পিছন পিছন আরুশের পাশের সিটে বসতে যাবে,আরুশের তীক্ষ্ণ দৃষ্টি শিহাবকে আটকিয়ে দিলো। আরুশ চোখের ইশারা করে তার পিছনের সিটে বসতে বলল। শিহাবও হাসি হাসি মুখে পিছনের সিটে বসল। পিছনে পিছনে বসতে বসতে মনে মনে বিড়বিড় করে বলল,

“ থ্যাংকিউ ভাবিজান! তুমি ভাবিজান হতে পারলে তাই এই কেরামতি দেখিয়ে দিচ্ছ, হলে তো আমার বেতন দশ গুণ বেড়ে যাবে! ”

মনে মনে ভেবে খিল খিল করে হাসল শিহাব।
.
“ তুমি বেড়োবে কখন? ”

সুমনা দ্যূতির ঘরের দরজার মুখের কাছে এসে দাঁড়িয়ে বলল কথাটা। দ্যূতি ঘরের ভিতর সবসময়ের মতো তাড়াহুড়ো করে এদিক থেকে ওদিকে ছুটাছুটি করছে। সুমনার প্রশ্ন শুনে দ্যূতি দাঁড়িয়ে সুমনার দিকে তাকিয়ে বলল,

“ এই তো এক্ষুনি বেড়োব! কিন্তু আমি যে কানের দুল পরবো ভেবেছিলাম সেটা এখন আমি আর খুঁজে পাচ্ছি না,”

“ সেটা আমাকে বললেই হয়! আমি এখনের জন্য দিচ্ছি,ওটা পরে যাও! ”

“ কিন্তু….? ”

“ কিন্তু ফিন্তু কিছু না… দেরি করলে চাকরি যাবে! তুমি আসো আমি দুল দিচ্ছি! ”

বলে সুমন নিজের ঘরে চলে গেল। দ্যূতিও তাড়াহুড়ো করে সব কিছু নিয়ে গেলো রুম থেকে। দ্যূতি লিভিং রুমে আসতেই সুমনাও দুল বেরিয়ে আসলো ঘরের থেকে। দ্যূতির হাতে দিয়ে বলল,

“ তাড়াতাড়ি পরে নাও! আর যাও! আমি নিচে পাঠাও ডেকে রেখেছি। তুমি নেমেই মালপত্র দিয়ে বসে পরবে……”

“ থ্যাংকস ভাবি! ”

“ এবার যাও! ”

দ্যূতিকে তাড়া লাগিয়ে বলল। দ্যূতি হাসি মুখে বেরিয়ে গেলো। সুমনা দরজার কাছে যেয়ে বলল,

“ সাবধানে যেয়েও! ”
.
দ্যূতি এসে পৌঁছেছে সবে মাত্র। পাঠাও কার থেকে নিজের ল্যাগেজ নামিয়ে ভাড়া মিটিয়ে বাসের কাছে চলে গেলো। ওখানে দাঁড়িয়ে থাকা গাড়ির লোকের কাছে ব্যাগ পত্র দিয়ে সামনের গাড়িতে উঠল। গাড়িতে উঠে দ্যূতি সিটের জন্য চোখ বুলাতে থমকে গেলো। বাসে একটি মাত্রই সিট বাকি আছে যা আরুশের পাশে। দ্যূতি ঢোক গিলে সেদিকে তাকালো। আরুশ ওর দিকে মুচকি হেসে তাকিয়ে আছে। দ্যূতি কিছু না বলেই নেমে যাচ্ছিল তখনই পিছন থেকে একটা মেয়ের ডাক ভেসে আসলো,

“ কোথায় যাচ্ছ? ”

দ্যূতি পিছনে ঘুরে তাকালো। মিলি নিজের সিটের থেকে উঠে দাঁড়িয়ে ওর দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করছে। দ্যূতি আমতা আমতা করে ,

“ অন্য বাসে দেখতে যাচ্ছি সিট আছে কিনা? ”

“ না রে! সব শেষ, একটাই সিট আছে! ”

“ মানে? ” দ্যূতি হতাশার চরম পর্যায়ে চলে গেল। মিলি বুঝতে পেরে মাথা নাড়ালো। দ্যূতি আর কোনো উপায় না পেয়ে ধীর পায়ে উপরে উঠে এসে আরুশের সামনে যেয়ে দাঁড়ালো। দ্যূতি দাঁড়াতেই আরুশে ভ্রু জোড়া উঁচু করে তাকি বলল,

“ বসো! ”

“ আমি জানালার সাইডে বসবো! ”

দ্যূতি কি বলবে বুঝতে না পেরে মুখ ফসকে কথাটা বলে ফেললো। দ্যূতির কথাটা বলতেই আরুশ হেসে ফেলল আর সঙ্গে সঙ্গে উঠে দাঁড়িয়ে সরে আসলো। দ্যূতি চুপ করে জানালার সাইডে যেয়ে বসল। আরুশ তার পাশের সিটে বসল।

ঠিক আটটাই বাস চলা শুরু করল।
.

♪…হরিয়েপ্রাণ ভরিয়ে তৃষা হরিয়ে
মোরে আরো আরো আরো দাও প্রাণ।
তব ভুবনে তব ভবনে
মোরে আরো আরো আরো দাও স্থান॥…♪

গাড়ি চলতে শুরু করলেই সবাই মিলির কাছে আবদার করল গান ধরতে। মিলি সবার আবদার রাখতে গান ধরল। দ্যূতি তার গলার সুর শুনে মুগ্ধ নয়নে তাকিয়ে ছিলো পুরো গানের সময়টুকু।

মিলির গান শেষ হতেই পুরো বাসে করতালির শব্দে গমগম করতে শুরু করল। মিলির গান শেষ হতেই শিহাব নিজের সিট থেকে উঠে দাঁড়িয়ে বলল,

“ স্যার এবার আপনি একটা গান ধরেন! ”

শিহাবের কথা শুনেই ওর দিকে অগ্নি দৃষ্টিতে তাকালো। শিহাব মুহূর্তেই দমে গেল।

“ আপনি গান গাইতে পারেন? ”

পাশের থেকে প্রশ্ন আসতেই আরুশ দ্যূতির দিকে তাকালো। দ্যূতি নির্বাক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে।

“ হ্যাঁ স্যার খুব সুন্দর গান গাইতে পারে! স্যারের গলা সেই সুন্দর…! ”

শিহাব আবার বলল। এবার আর আরুশ ওর দিকে তাকালো। দ্যূতির দিকে আগের মতো চেয়ে আছে।

“ তাহলে একটা গান ধরেন! ”

দ্যূতির কি হলো দ্যূতি নিজেই বুঝতে পারল না। কোনো কিছু না ভেবেই বলে ফেলল কথাটা।

“ হ্যাঁ স্যার একটা গান ধরেন! ”

দ্যুতির সঙ্গে বাসের সবাই বলে উঠলো। আরুশ মুচকি হাসলো।

“ স্যার এই নেন! ”

আরুশের সামনে বাসের একজন গিটার নিয়ে এসে ধরল। আরুশ দ্যূতির দিকে তাকিয়ে গিটারটা হাতে নিয়ে গান ধরল,

♪…আমার মন তোর পাড়ায়, এসেছে তোরই আস্কারায়।

আমার মন তোর পাড়ায়, এসেছে তোরই আস্কারায়।

তোকে বলবো ভাবি, কিছু অল্প কথায়। তুই

স্বপ্নে ছিলি, ছিলি গল্প কথায়। আজ তোর

নামে , রাত নামে , দিন কেটে যায়। আমার মন

তোর পাড়ায়, এসেছে তোরই আস্কারায়। আমার

মন তোর পাড়ায়, এসেছে তোরই আস্কারায়। যেই

আমার হলি, অলি গোলির ভীড়ে, তোকে একলা

খোঁজার অজুহাত। এই মন বলেছে,

তোর মন গলেছে, হলো প্রেমীরই আজ শুরু আর।
তোকে বলবো ভাবি, কিছু চুপ কথাতে।…♪

দ্যূতির বুকটা কেঁপে উঠলো। গানের সঙ্গে যে সে হারিয়ে যাচ্ছে। আরুশ পুরো গানটা দ্যূতির দিকে তাকিয়ে গাইছে। দ্যূতিও আরুশের চোখের দৃষ্টি থেকে সরাতে পারল না। দ্যূতির মাঝে অপরিচিত এক অনুভূতি কাজ করতে শুরু করেছে। আরুশ গান থামাতেই পুরো বাসে আবার করতালির জোয়ার আসলো। কিন্তু আরুশের মন, দৃষ্টি দুটোই দ্যূতির উপরে…..

চলবে…….