#জোৎস্না_রাতে_তুমি_আর_আমি — [৯]
লেখনীতে;- #রুদ্রিকা_বেদী
.
দ্যূতি আজ কোনো রকম খুরিয়ে খুরিয়ে অফিসে এসেছে। পায়ের ব্যথা আগের থেকে কমেছে অনেকটাই। এখন শুধু হাঁটতেই বা পায়ে প্রেশার দিলে যন্ত্রণা করছে কিন্তু তাও সহ্য করা যায়।
আরুশ অফিসে আসেনি এখনো। কোথায় কোন মিটিংয়ের জন্য গিয়েছে। দ্যূতি নিজের ডেস্কে বসে ফোন স্ক্রল করছে। আজও অফিসে তাকে দিয়ে করানো মতো কাজ নেই। মিস্টার খান তার পায়ের অবস্থা দেখে তাকে বসে থাকারই কাজ দিয়েছে। দ্যূতি ফোন দেখছে,মাঝে সাঝে আশেপাশে তাকিয়ে দেখছে, অফিসে কি ঘটছে। সবাই সবার মতো কাজে ব্যস্ত। কেউ কারো সঙ্গে কোনো কথা বলছে না। দ্যূতির নিজের মধ্যেই কেমন যেন হতে লাগলো। মনে মনে বিড়বিড় করে বলল,
__”একটু সাবধানে চললে আজকে আর এই অবস্থা হতো না গাধী! এখন বসে থাক!”
.
আরুশকে অফিসের গেট দিয়ে ঢুকতে দেখে সবাই চুপ হয়ে গেলো। আগে অফিসে যাও ফিসফিসানি চলছিল তাও বন্ধ হয়ে গেল এক সেকেন্ডের মধ্যে। দ্যূতির ডেস্ক একদম কোণায় হওয়ায় দ্যূতি বুঝতে পারল না কি হলো সবার মাঝে! দ্যূতি হালকা উঁচু হয়ে দেখার চেষ্টা করল। আরুশকে ভিরতে আসতে দেখে ওরই মুখ একদম চুপসে গেল। ডেস্কের উপর থেকে জলদি একটা ফাইল নিয়ে তাতে মুখ গুঁজে নিলো। আরুশ যাতে ওকে দেখলে মনে করে, দ্যূতি অনেক কাজ করছে।
আরুশ এসে দাঁড়ালো একদম মাঝখানে। সবাই চোখ তুলে ওর দিকে তাকালো। সচরাচর ও সোজা কেবিনে চলে যায়। নিচে তেমন দাঁড়ায় না। আরুশের পিছনে পিছনে শিহাবও ঢুকেছে। তার মুখে চওড়া হাসি। এটাও সচরাচর দেখা যায় না।
আরুশ সবার দিকে চোখ বুলিয়ে একদম কোণায় দ্যূতির উপর যেয়ে চোখ আটকালো। দ্যূতি এখনো চোখ তুলে তাকাইনি ওর দিকে। আরুশের মুখে একটা মুচকি হাসি ফুটে উঠল। পিছনে ইশারা করে শিহাবকে সামনে ডাকল। শিহাব আরুশের ইশারা পেতেই ওর মুখোমুখি এসে দাঁড়ালো।
আরুশ শিহাবের কাঁধে হাত রেখে মুখটা কানের কাছে নিয়ে গেলো ওর। শিহাব মনোযোগ দিয়ে আরুশ কথা শুনে মাথা নাড়ালো। সবার চিন্তা যেন বেড়েই চলছে। দ্যূতি আড়চোখে একবার তাকাল। আরুশ তখন ওর দিকেই তাকিয়েছিল। দুজনের চোখে চোখ পরতেই দ্যূতি চোখ সরিয়ে নিলো।
__”শোনেন! সবার উদ্দেশ্যে একটা নির্দেশনা আছে!”
শিহাব সামনে ফিরে সবাইকে উদ্দেশ্য করে বলল। আরুশ নিজের প্যান্টের পকেটে হাত রেখে দাঁড়িয়েছে। দ্যূতি না চাইতেও মুখ তুলে সোজাসুজি তাকালো। শিহাব নিজের হাসি সামলিয়ে বলল,
__”এই সপ্তাহে আমরা ট্রিপে যাবো!”
এই কথাটা সবার কানে যেতেই অফিসের শান্তি পরিবেশ হঠাৎই অশান্তি হয়ে উঠলো। সবার মাঝে
চাপা উত্তেজনা। ফিসফিসানি শুরু হয়ে গেলো।
দ্যূতি ভ্রু কুঁচকে তাকালো। হঠাৎ ট্রিপ কেন?
__”এবং এটি বাধ্যতামূলক! সবার যেতেই হবে!”
এই কথাটা দ্যূতির কানে যেতেই ওর কপালে হাত উঠে আসলো। ও মনে মনে ভেবেই নিয়েছিল,ও যাবে না কিন্তু সেই রাস্তাও বন্ধ করে দিলো। হতাশা গ্রস্থ হয়ে বাকি কথা শোনার মনই হারিয়ে ফেলল দ্যূতি।
__”স্যার কোথায় যাবো?”
অফিসের একটি অতি উৎসাহিত হয়ে জিজ্ঞেস করল। এইবার শিহাব কোনো উত্তর দিলো না। আরুশ দুই কদম এগিয়ে এসে গভীর কন্ঠে বলল,
__”কক্সবাজার!”
আরুশের কথা শুনে যেন সবাই মহাখুশি। আরুশ বাঁকা হেসে দ্যূতির দিকে তাকালো। দ্যূতি নিরাশ চোখ দেখে বুঝতে পারল দ্যূতির ওখানে যাওয়ার কোনো মন নেই! কিন্তু কিছু করার নেই! প্রপোজ করতে হলে যেতেই হবে……
.
__”সুইটহার্ট!”
পিউ রাতের শোয়ার জন্য বিছানা তৈরি করছিল তখন পিছন থেকে আদ্র এসে ওকে জড়িয়ে ধরল নিজের সঙ্গে। পিউ চুপ করে দাঁড়িয়ে গেল। এইটা আদ্রর প্রত্যেক দিনের অভ্যাস। আদ্র পিউয়ের ঘাড়ে মুখ গুজে দিল।
__”বর মশাই! দরজা খোলা,একটু সাবধানে!”
আদ্র মুখ তুলে তাকালো পিউয়ের দিকে। ভ্রু কুঁচকে জিজ্ঞেস করল,
__”তো? দরজা খোলা তো কি হবে?”
পিউ আদ্রর দিকে ফিরে দাঁড়ালো। মুখ টিপে হেসে বলল,
__”আপনি ভুলে যাচ্ছেন, আপনার বড়ো একটি ছেলে আছে! যে কিনা আপনার মতো বিচ্ছু, দুরন্ত! যখন তখন এই রুমে চলে আসতে পারে!”
আদ্র পিউয়ের কথা শুনে হতাশ মুখ নিয়ে একবার দরজার পানে তাকালো। সত্যিই তার ছেলের এই ঘরে চলে আসার কোনো টাইম টেবিল নেই। আদ্র পিউয়ের নিষ্পাপ মুখটির দিকে তাকিয়ে দরজার কাছে চলে গেলো। দরজা বন্ধ করে ফিরে আসলো। পিউ হাসতে হাসতে বলল,
__”কাজ কি আদৌও হবে? দরজায় যদি একবার ধাক্কা পরে তাহলে না খুলে উপায় থাকবে?”
কথাটা বলতে বলতে দরজায় ধাক্কার শব্দ ভেসে আসলো সাথে আসলো,
__”মাম্মি, বাবা! দ’জা খলো…!”
পিউ অট্টহাসিতে পেটে পরল। আদ্র তাড়াতাড়ি যেয়ে দরজা খুলে দিলো। দরজা খুলতেই শুভ্র এক লাফে আদ্রর কোলে উঠল।
__”বাবা! এখনো ঘুমাও নি কেন? রাত হয়ে গেছে বাচ্চাদের এতো রাত পর্যন্ত জাগতে হয় না!”
আদ্র শুভ্রর চুল ঠিক করতে করতে বলল।
__”অ্যামার ঘুম আছছিল না! আমি তুমাদের সাতে ঘুমাবু!” নিজের বাচ্চা বাচ্চা গলায় বলল। পিউ আদ্র আর শুভ্রর কাছে যেয়ে দাঁড়ালো। ছেলেকে কোলে নিতে নিতে বলল,
__”অ! আমার বাবাটা! আমাদের কাছে ঘুমাবে! চলো তোমাকে ঘুম পারিয়ে দিই ।”
বলে শুভ্রকে বিছানার কাছে নিয়ে যাচ্ছে পিউ।
__”কিন্তু……?”
তখনই আদ্র বলে উঠলো। পিউ সঙ্গে সঙ্গে চোখ পাকিয়ে তাকালো ওর দিকে। আদ্রর সব রোমান্টিক মুডে তার বড়ো গুণধর পুত্র স্বযত্নে একবাতলি পানি ঢেলে দিয়েছে……..
.
আরুশ সুইমিং পুলের ধারে আর্মচেয়ারে বসে আছে। হাতে রয়েছে লাল রংয়ের গোলাম। আরুশের চোখ মুখে এক অন্যরকমের হাসি। তিন দিন পর সবাই কক্সবাজার যাচ্ছে। আরুশ খুব ভালো করে জানতো যদি এই ট্রিপটি বাধ্যতামূলক না করতো তাহলে দ্যূতি কখনোই যেতো না।
হঠাৎ আরুশের ফোন ভাইব্রেটিং হলো। আরুশ ফোন টি তুলে দেখলো,আদ্র মেসেজ দিয়েছে।
__”everything is okay?”
আরুশের মুখে হাসি ফুটে উঠল। আরুশ ম্যাসেজের কোনো উত্তর দিলো না। ডাইরেক্ট কল করল আদ্রকে। দুই বার রিং হতেই আদ্র কল রিসিভ করল,
__”হ্যালো ভাইয়া!”
__”আরুশ বলো!”
__”সব ঠিক আছে! আজই আমি বলে দিয়েছি। তিন দিন পর যাবো!”
__”শুনলাম! দ্যূতি তোমার আপুকে ফোন করেছিল! তোমার নামে যা যা কথা শুনালো, সেগুলো আর বলার মতো না!”
__”যেমন?” আগ্রহ নিয়ে জিজ্ঞেস করল আরুশ।
__”শুনতে চাও?” গলার স্বর অতি খাদে নামিয়ে বলল আদ্র।
__”হুঁ!” ছোট করে বলল।
__”মহিষ! ছাগল! গাধা! পাগল! সাপ! ইত্যাদি ইত্যাদি! আমার আর মনে নেই! তোমার মধ্যেই আমার শালিকা চিড়িয়াখানার অর্ধেক পশু পাখি দেখতে পায়!”
দুইজনই একই সঙ্গে হেসে উঠল।
__”যাক! তাও ভালো কিছুতো দেখতে পাই!”
__”তুমি বেজায় প্রেমে পরেছ ভাই! নাহলে এই কথা বলা সম্ভব হতো না তোমার দ্বারা!”
আরুশ কোনো উত্তর দিলো না। সে যে কতোটা গভীর প্রেমে পরেছে তা যদি মুখে ব্যক্ত করতে পারতো তাহলে তার অর্ধেক অনুভূতির ভার কম হতো…….
__”সাবধানে প্রপোজ করো আরুশ! শ্যালিকার গ্যারান্টি আমি নিতে পারছি না! আমার বউয়ের বোন তো!”
__”চিন্তা করো না! আপুর মতোই তো বউ চেয়েছিলাম! একটু তো প্যারা খেতে হবে!”
__”ওই প্যারাটা আসা করি ছয় বছরের জন্য না হয়! এর থেকে বেশী আমি কিছু চাইতে পারছি না তোমার জন্য!”
আরুশ মুচকি হাসলো। সে যে ছয় দিন অপেক্ষা করতে পারছে না দ্যূতিকে নিজের করে নিতে,ছয় বছর হলে তো কথাই নেই! ……..
চলবে……