#জ্বালাতে_রং_মশাল২ 🖤
#ইফা_আমহৃদ
#পর্ব: ২৬
দ্বিতীয় বউ নিয়ে হাজির অপূর্ব। লাল টুকটুকে নববধূকে বরণ করতে ব্যস্ত সবাই। সবার মুখে উচ্চে পড়া খুশি। আড়ালে দাঁড়িয়ে অশ্রু বিসর্জন দিচ্ছে আরু। তার পেট বেলুনের মতো ফুলেছে। বাঁচবে না সে। তার অপূর্ব ভাই তাকে ভুলে গেছেন। দীর্ঘ কয়েকঘণ্টা ধরে ঘুমন্ত আরু দেখছে তার অপূর্ব ভাইকে হারিয়ে ফেলার দুঃস্বপ্ন। আঁকড়ে ধরেছে চাদর। বিছানায় কাতরাচ্ছে সে। অপূর্ব আরুর উদ্ভট আচরণ দেখে অস্তির হয়ে উঠল। কাঁধে হাত রেখে ডাকল কয়েকবার। আরুর চেতনা নেই। গালে কয়েকটা চপল মেরে ডাকল, “আরু, কী হয়েছে পাখি।”
‘অপূর্ব ভাই’ – বলে সে কাতরাচ্ছে। চোখ মেলে তাকাল একপর্যায়ে। অপূর্ব তার দিকে ঝুঁকে ছিল তখন। কাতর আরু ঝাপটে ধরল অপূর্ব-কে। দৃঢ় করে আবদ্ধ করে বলে, “আমি আপনাকে প্রচণ্ড ভালোবাসি অপূর্ব ভাই। প্লীজ আমাকে ছেড়ে যাবেন না।”
পিঠে হাত বুলিয়ে দিতে দিতে অপূর্ব সামলায়। আদুরে গলায় বলে, “আরুপাখি, তোকে ছেড়ে কোথায় যাবো। শান্ত হ তুই।”
অজস্র চুমুতে ভরিয়ে দিল তার অপূর্ব ভাইকে। অপূর্বর পিঠ ব্যথা করছে। আলগোছে বিছানায় ঠেস দেয়। আরুর হুশ ফিরল। দীর্ঘক্ষণ পর মাথা তুলে তাকায়। লজ্জায় কাবু হয়। অপূর্ব হেসে বলে, “পানি খাবি?” এসময় পানি খেলে শরীর ভালো লাগে।
আরু তার পেট চেপে ধরল। রাত পেরিয়ে সকাল হয়েছে। দীর্ঘ সময় ঘুমিয়েছে। ওয়াশরুমে যেতে হবে। ঠোঁট উল্টে বলে, “ওয়াশরুম যাবো।”
অপূর্ব আরুকে ধরে ওয়াশরুম অবধি নিয়ে যায়। অপূর্ব জিজ্ঞেস করে, “যেতে পারবি? নাকি সাথে যাবো?”
ভেংচি দিয়ে আরু ভেতর যায়। কিছুক্ষণ পর বেরিয়ে আসে। বিছানায় বসে। লাভ হলনা, পরপর তিনবার গেল। ভ্রু কুঁচকে বলে, “কেমো দিয়ে আমার ডায়াবেটিস হয়ে গেছে দেখছি।”
“এসময়ে একটু এমন হয়। এটা পার্শ্ব প্রতিক্রিয়া।” অপূর্বর কথা থামার পূর্বেই হাজির হয় মা মামুনি। আরুর মাথায় হাত রেখে বলে, “কেমন লাগছে তোর?”
মামুনি তাল মিলিয়ে বলেন, “কালরাত থেকে না খেয়ে আছিস। কী খাবি বল? করে দিচ্ছি।”
“এই যে পেট কত ফুলে আছে। একটুও ক্ষুধা লাগছে না। খাবো না।” বলেই আরু মুখ লুকিয়ে ফেলল কম্বলে। সবাই একে অপরের দিকে চাওয়াচাওয়ি করল। ভাব বিনিময় করে। মা যায় খাবার আনতে। আজ আরুর পছন্দের খিচুরি রান্না করেছেন তিনি।
পাঁচ সপ্তাহ পেরিয়ে গেল এভাবে। আরুর কেমো সম্পূর্ণ হয়েছে। সামনেই তার অপারেশন। পেট পূর্বের তুলনায় সংকুচিত হয়েছে। পার্শ্ব প্রতিক্রিয়া হিসেবে আরুর চুল পাতলা হয়েছে। অনেক পড়েছে। আরু সারাদিন শুয়ে থাকার দরুন সে জানে না।মা মামুনি কখনোবা অপূর্ব তাঁরাই চুল আঁচড়ে দেয়। ডাক্তারের সাথে পরামর্শ করে আরুর পিঠ পর্যন্ত লম্বা চুলগুলো কে/টে দিল। আরু তখন ঘুমিয়ে ছিল। খাওয়া দাওয়া ছাড়া বাকি সময় সে ঘুমিয়ে পার করে। একটু শীত শীত আমেজ। অপূর্ব টুপি দিয়ে আরুর চুলগুলো ঢেকে রাখল। চলে গেল তার কাজে। কেমো থেকে অপারেশন এবং যাবতীয় টাকা অপূর্ব নিজে বহন করবে। আলাদা হয়েছে, মানে সম্পূর্ণরুমে আলাদা।
সন্ধ্যার কিছু পরে ঘুম ভাঙল আরুর। হাউসি দিয়ে ঘুমের রেশ দূর করে। কপালে হাত রাখতেই অনুভব করে একটা গোটা। ধরলে ব্যথা করে। এটাও কেমোর জন্য। আজ মাথায় টুপি পড়িয়েছে। পেছনে চুলকাচ্ছে তার। টুপি পেছন থেকে হাত দিয়ে চুলকে দিল। কাঁটা কাটা বাঁধল হাতে। তার ছোটো চুলগুলো নেই যে। আরু মিনিট খানেকের মতো চুপ থাকে। হতভম্ব হয়। কম্বল সরিয়ে দ্রুত আয়নার সামনে যায়। দৃষ্টি স্থির হয়ে যায়। টাক দেখা যাচ্ছে। মাথায় হাত দিয়ে কেঁদে ফেলে। সাধের চুলগুলো নেই। উচ্চশব্দে কান্না। তুর ছুটে আসে। আরুকে কাঁদতে দেখে। সে নিজেও জানেনা কে করেছে। সে বলে, “আরু, তোর সিল্ক চুলগুলো কোথায়? কে করেছে এমন। একটুও ভালো লাগছে না।”
আরুর কান্নার গতি বেড়ে গেল। সবাই পৌঁছে গেল তার ঘরে। একাজ অপূর্ব ছাড়া কারো নয়, ইহা ভালো করেই সকলের জানা। তুর অপূর্বকে ফোন করল। কিছুক্ষণের মাঝে সেখানে পৌঁছে গেল অপূর্ব। কাঁদতে কাঁদতে আরুর চোখমুখে অবস্থা বেসামাল। মামা ব/কে দিলেন অপূর্ব-কে, “তুই মেয়েটার চুল কে/টেছিস কেন অপু?”
“আমি ডাক্তারের সাথে যোগাযোগ করেই এই কাজ করেছি।” অপূর্ব সাদামাটা জবাবে সবাই কিছু না বললেও আরু চ্যাঁচিয়ে বলে, “আমি এবার তোমাকে টাক বানাবো অপূর্ব ভাই।”
আরু উদ্বিগ্ন হয়ে ব্লে/ড খুঁজতে যায়। অপূর্ব তাকে পেছন থেকে ধরে বিছানায় বসায়। মাথার টুপি তুলে বলে, “তোকে সঙ্গ দিতে আমিও চুল তুলেছি। এবার তুই চামড়া তুলবি?”
আরু কাঁচুমাচু করে বসে থাকে। সে নিজের হাতে চুল ফেলতে চেয়েছিল। সেদিনের পর পেরিয়ে গেছে মাসখানেক। আরু এখন সুস্থ। শুয়ে-বসে তার দিন পার হচ্ছে। অপূর্বর দেখা পাওয়া যায়না আজকাল। আজ থেকে সে স্কুলে যাবে। অপূর্ব তাকে স্কুলে দিয়ে আসবে। একবার চেয়েছিল নতুন স্কুলে ভর্তি হবে এতে তার একবছর নষ্ট হবে। আরু বইখাতা গুছিয়ে স্কুলের বেশে পরিপাটি হয়। তুর এসে তাড়া দেয়। বহুদিন পর দু’জনে একসাথে স্কুলে যাবে। অপূর্ব নিচ থেকে ডেকে উঠে, “আরু-তুর। তোদের হল। তাড়াতাড়ি আয় আমার কাজ আছে।”
আরু রিপোর্টগুলো নিয়ে নেমে গেল নিচে। অপূর্ব ভাই চা খাচ্ছে। মুখ কালো করে অন্যদিকে তাকায়। অপূর্বর চুলগুলো অনেক বড় হয়েছে। বোঝাই যায়না যে চুল কামিয়ে ছিল। অথচ তার চুল কবে বড় হবে? সারাদিন মাথায় ওড়না চাপিয়ে ঢেকে রাখে মাথা।
বাইক এসে থামল বিদ্যালয়ের সামনে। আরু তুর নেমে সামনে হাঁটা দিল। অনেকদিন পর তার ফেরা। ছাত্র-ছাত্রীরা খেলছে মাঠে। ঘণ্টা দেয়নি। আরুকে নিয়ে অপূর্ব শিক্ষকমণ্ডলী কক্ষে প্রবেশ করল। স্যার ম্যামরা তাকে দেখা মাত্র উঠে দাঁড়াল। আরু আড়চোখে দেখল। অপূর্বকে এত সম্মান জানানোর কারণ তার অজানা। প্রধান শিক্ষক হাজির বলেন মিনিটের মাঝে। অপূর্বর ডানহাতে চুমু খেয়ে বললেন, “ভাই, আপনি কেন আসলেন? আমাদের ফোন করে বলতেন।”
“তার প্রয়োজন নেই। আমি আমার স্ত্রী আরুকে ভর্তি করতে এসেছি।” সবাই তখন আরুকে দেখছে। আরু একপাশে গুটিয়ে বসে আছে। অপূর্ব হাত বাড়িয়ে ডাকে, “কাছে আয়।”
আরু কাছে যায়। রিপোর্টগুলো এগিয়ে দেয়। অপূর্ব পেশ করে প্রধান শিক্ষকের কাছে। থমথমে গলায় বলে, “রিপোর্টে স্পষ্ট আছে, আরু ক্যান্সারের রোগী। আশা করি আরুকে গ্ৰহণ করতে সমস্যা হবেনা।”
প্রধান শিক্ষক পর্যবেক্ষণ করে বলেন, “আমাদেরই ভুল হয়েছে। আরুর ব্যপারে সঠিক তথ্য নিয়ে ব্যবস্থা নেওয়া উচিত ছিল।”
অপূর্ব মাঠের দিকে তাকাতেই দেখল তন্বি খেলছে। চুলে হাত বুলিয়ে বলে, “আপনাদের কে বলেছিল, আরু প্রেগন্যান্ট।”
চা নিয়ে হাজির হল দত্তরি। প্রধান শিক্ষক চা এগিয়ে দিয়ে বলেন, “তন্বি বলেছিল। ওরা বেস্টফ্রেন্ট ছিল, তাই আরু না-কি তন্বিকে বলেছে সে প্রেগন্যান্ট। পরে আরুর কাছে জানতে চাইলে চুপ করে থাকে। তাই আমরা ভেবেছি তন্বি সঠিক তথ্য দিয়েছে।”
অপূর্ব কিছু না বলে আরুর দিকে তাকাল। পা মিলিয়ে বেরিয়ে যায়। আরু তুর ক্লাসের দিকে অগ্রসর হল। ঘণ্টা বেজে গেছে। হাত নাড়িয়ে বলে, “তন্বিকে উচিত শিক্ষা দিতেই হবে।”
__
ব্যাগ কাঁধে নিয়ে বাড়ি ফিরছে আরু। হাওয়াই মিঠাই ভাগাভাগি করছে তুরের সাথে। দেয়ালের দিকে তাকাতেই দেখতে পেল অপূর্বর ছবি। হাত তুলে সবাইকে আশ্বাস দিচ্ছে এমন ছবি। আরু বুকে হাত দিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। পাশে লেখা ‘সুন্দরনগরের জনকল্যাণে রকেট মার্কা ভোট দিন।’ ভোটের সময় আগামী ২৬ তারিখ। আরু হতভম্ব হল। অপূর্ব ভোটে দাঁড়িয়েছে। এজন্যই তার বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক অপূর্বকে এত সম্মান দেখাল। অতি যত্নে কাগজটা তুলে নিল। বুকে জড়িয়ে বলে, “আমার নেতা সাহেব।”
[চলবে.. ইন শা আল্লাহ]