জ্বালাতে রং মশাল২ পর্ব-২৭

0
356

#জ্বালাতে_রং_মশাল২ 🖤
#ইফা_আমহৃদ
#পর্ব: ২৭

নেতা সাহেবের জন্য আজ বিরিয়ানি রান্না করেছে আরু। রান্না শেষে বিয়ের সময় দেওয়া গোলাপি রঙের শাড়িটা গায়ে জড়ালো। নিজের মতো কুঁচি করেছে। রান্নাঘর থেকে খাবারের থালা সাজিয়ে অপূর্ব ভাইদের বাড়ির উদ্দেশ্যে বের হল। মামা মামুনি তুর সবে খেতে বসেছে। মুচকি হেসে বলে, “মা ডাকছে। আমি আজ বিরিয়ানি করেছি। তোমাদের সাথে খাবে।”

“এটা বুঝি অপুর জন্য?” মামুনির কথায় খানিকটা লজ্জায় রাঙা হল আরু। মাথা দুলিয়ে বললাম, “উনি এসেছেন?”

“না। তুই ঘরে গিয়ে বস। আমরা তোদের বাড়ি যাই।” বলেই তারা অগ্রসর হলেন। তুর ছুটেছে অনেক আগেই।

পুনরায় পা বাড়াল। ঘর অন্ধকারে আবৃত। ধীরে ধীরে পা রাখল। সেন্টার টেবিলের উপর ট্রে রেখে বাতি জ্বালিয়ে দিল। আলোকিত হল ঘর। এলোমেলো বিছানা। সকালে বিছানা তুলে নি। কোমরে আঁচল গুঁজে ব্যস্ত হল ঘর গোছাতে। কম্বলগুলো ভাঁজ ঘর পরিষ্কার করল। পরিপাটি করে বারান্দায় গিয়ে দাঁড়াল। কিছুক্ষণের মাঝে গাড়ি সমেত প্রবেশ করলেন অপূর্ব। তাকে বলবে না, আমি জেনেছি তিনি নেতা হবেন। একদম ফুলের মালা দিয়ে বরণ করে জানাবো।

ঘরে প্রবেশ করলেন অপূর্ব। শার্ট খোলার পূর্বেই এগিয়ে গেল আরু। টেনে সাহায্য করল। কাবার্ড থেকে ট্রাউজার টি শার্ট বের করে হাতে দিল। আরুর চুলগুলো এলোমেলো করে অপূর্ব বলেঞ, “কী দরকার ছিল ঘর গোছানোর। সেই তো এখনই এলোমেলো করব।”

হাত ধরে আলতো কাঁধে মাথা রাখল আরু। মৃদু স্বরে বলে, “আমি আপনাকে খুব ভালোবাসি। খুব খুব খুবই। প্লীজ আমাকে এড়িয়ে যাবেন না। তখন তো বলেছিলেন, আমার পেটে অন্যকারো বাচ্চা ছিল। তাই মেনে নেননি। এখন তো নেই।”

কিছুক্ষণ নিরিবিলি থেকে বলে অপূর্ব, “আমি আভাকে খুব ভালোবাসতাম আরু। খুব! তোর খুবের চেয়েও খুব।”

হাতটা আলগা হয়ে গেল। চোখের জলের ধারা বইল। মুখের হাসি গায়েব হয়েছে‌। চিবুকে হাত রেখে কৌতুহলী হয়ে বলে, “তুর যে মেয়েটাকে দেখিয়েছিল, সে?”

“হম।” সংক্ষিপ্ত কণ্ঠে বাঁধ ভাঙল আরুর। ঠোঁটে ঠোঁট চেপে নিজেকে সংযত করার চেষ্টা করল। প্রস্থান করার নিমিত্তে অগ্ৰসর হতেই বলে, “তার হয়তো বিয়ে হয়ে গেছে।”

পা থেমে গেল। ঘাত কাত করে আরু বলে, “এর ভেতরে বিয়েও হয়ে গেছে?”

অপূর্ব উঠে গেল। ঘরে আলো নিভিয়ে দিল। বারান্দায় গেল উভয়ে। কিছু কিছু সত্যি অন্ধকারে লুকিয়ে থাকা উচিত।
“এর ভেতর কোথায়? আমি দেশে ফেরার আগে। বাবা তোদের মিথ্যা বলেছিল। আমি গু/ন্ডা/মি করতাম বলে দেশে ফিরিনি, আভার থেকে নিজেকে সামলে নিতে দেশে ফিরেছি। ইউকে থাকতে একটা মেয়ের উপর ভিশনভাবে আসক্ত হয়েছিলাম। মেয়েটির নাম আভা। তার মা বাংলাদেশি বাবা ভিনদেশী। আভার আমার সম্পর্ক হয় স্কুল লাইফ থেকে। মধুর সম্পর্ক আমাদের। এসম্পর্কে আমাদের পরিবারের মতামত ছিলনা, আভার মা রাজি ছিলেন। সব অভিযোগ আভার বাবার। অতিরিক্ত অর্থ আর প্রতিপত্তির কারণে আমার আভার সম্পর্ক ভেঙে দেন। ফরাসি ছেলের সাথে আভার বিয়ে ঠিক করেন। উপায়হীন হয়ে আমি আভা পালিয়ে আসি বাড়ি থেকে। যাত্রাপথে বাস দুর্ঘটনার কবলে পড়ি। আভার চেয়ে আমি বেশি আহত হয়েছিলাম। ইমারজেন্সি হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। ভাগ্যক্রমে আমরা দুজনেই বেঁচে যাই। তবে সড়োবড়ো দূর্ঘটনা তৈরি ছিল। রিপোর্টে আসে আমি কখনও বাবা হতে পারব না। মানসিক ভাবে ভেঙ্গে পড়েছিলাম। একেই আমাদের বিয়েতে আভার বাবা অসম্মত। তার উপর এইসব। রিপোর্ট ছড়াছড়ি হওয়ার পর আভার মাও বিয়েতে নাকোচ করে। আভা তখনও আমার সাথে আসতে রাজি ছিল। কিন্তু আমি পারিনি স্বার্থপর হতে। তাকে মাতৃত্বের স্বাদ ‘না-দেওয়ার’ অধিকার আমার নেই। তাই নিজেকে আড়াল করে দেখেছি। বাবা মা সহ্য করতে না পেরে দেশে ফিরেছেন।” অপূর্ব চোখের জল লুকিয়ে ফেলার প্রচেষ্টা করল। আরু পিছিয়ে অপূর্বর চিবুকে হাত ঠেকাল। গড়িয়ে পড়ল অশ্রুটুকু। কপালে কপাল ঠেকিয়ে বলে, “তাহলে মামা মামুনি কেন মেনেছিলেন, আমার গর্ভে আপনার সন্তান?”

“আমাকে ক্ষান্ত করতে। যাতে আমি রিপোর্টগুলো মিথ্যা ভেবে স্বাভাবিক হওয়ার চেষ্টা করি। তোর মতো বোকাসোকা মেয়ে কয়েকদিন আমার সাথে ছিল। অবিশ্বাস হওয়ার জায়গা নেই। তাদের আরও একটা ধারণা ছিল, প্রথমে মেনে না নিলেও পরবর্তীতে কিন্তু ঠিকই সংসার করতাম। কে চায়, তার ছেলে অসুস্থ থাকুক?” আরু অপূর্বর বুকে গুটিয়ে গেল। অপূর্ব তাকে বেষ্টিত করে নিল হৃৎপিণ্ডে। আরু সেখান থেকে আলতো করে বলে, “ধরেনিন না, আমি মা হতে পারব না। আপনি ঠিকই বাবা হতে পারবেন। একটু হলেও তো আমার প্রতি মায়া জন্মেছে আপনার। সেই মায়া থেকেই না-হয় আমাদের ছোটো একটা সংসার হোক।”

অপূর্ব হাতের জামা কাপড় গুলো উড়িয়ে ফেলে দিল। আরুর খোঁপা করা চুলগুলো খুলে দিল। মুখ গুজে দিল তার কম্পনহীন দেহে। পরক্ষণেই কম্পন অনুভূত হল। আরু আবেশে পল্লবজোড়া ঢেকে নিল‌। রেলিং-এর দু’পাশে হাত রেখে আরুকে আবদ্ধ করল দুহাতের মাঝে। রেলিং খামচে নিল আরু। অশ্রুগুলো শুকিয়ে গেছে কুয়াশায়। কাঁপা কাঁপা হাতটা অপূর্বর হাতের উপর রেখে থেকে-থেকে বলে, “আমি আপনাকে ভালোবাসি অপূর্ব ভাই, আপনার জীবনের কালো অতীতটা আমি আমার করে নিলাম। আমি বইব এই বোঝা।”
দ্বি মুহূর্তে উল্টো ঝাপ্টে ধরল অপূর্ব-কে। অপূর্ব দুহাতে আগলে নিল। মাথায় হাত বুলিয়ে বলে, “তোকে পেয়ে আমিও সামলে নিয়েছি নিজেকে। তুই যে আমার আরুপাখি। ভালোবাসি।”

আরু তার পায়ের পাতায় ভর দিল। কুয়াশা ব্যাঘাত ঘটাতে পারেনি দুটি চোখের। কুয়াশার স্থান ত্যাগ করে কাছাকাছি এলো একজোড়া অধর। মিলিত হল একসাথে। চলতে থাকল তাদের অমৃত পানের মহেন্দ্র ক্ষণ। অপূর্বর ময়লা দেহের যুক্ত হল কিশোরী মেয়ের মিষ্টি সুবাস। দূরাকাশের কুয়াশা তখন ঘন হয়ে পতিত হচ্ছে। বারান্দায় দেখা যাচ্ছেনা তাদের তৃষ্ণা মেটাতে।
____
আজ সোমবার। ২৪ তারিখ। সময় আটটা চুয়ান্ন। নির্বাচন সংগঠিত হয়েছে। আরু অন্যমনস্ক হয়ে মালা গাঁথছে। এই মালা দিয়ে বরণ করে নিবে নেতা সাহেবকে। অতঃপর সে নেতা সাহেব বলে সম্বোধন করবে। অপূর্বও বলেনি, সেও চমক দিতে চাইছে।
আরু এখন অপূর্ব ভাইয়ের সাথে থাকে। আজকাল শরীর তার বড্ড বেদনাদায়ক। মনে অশান্তি। পূর্বের মতো গাঁ গুলিয়ে উঠে। বমি হয়েছে বেশ কয়েকবার। চৌদ্দবার টেস্ট করেছে ফলাফল পজেটিভ। সে জানে এটা হতে পারেনা। গতকাল আল্ট্রাসাউন্ড করেছে। আজ বিকেল পাঁচটায় দেওয়ার কথা থাকতেও নির্বাচনের ঝামেলার কারণে বের হয়নি বাড়ি থেকে। মনে হয় ক্যান্সারের কোষ সম্পূর্ণ বিনা/শ হয়নি। তা পুনরায় দানা বাঁধছে। এলাকায় মাইক্রোফোন ব্যবহার করা হলো। ঘোষনা করছেন, “সুন্দরনগর এলাকার চেয়ারম্যান পদে বিজয়ী হয়েছে অপূর্ব আহসান।”

তিনবার একই কথা বলে শেষ হয়ে গেল। আরু অন্যমনস্ক হাত আঙুলে আঘাত করল। প্রচণ্ড ভয়ে আছে সে। পার হলো ঘন্টা খানেক। আরও একটা পরীক্ষা করতে ওয়াশরুমে গেল। ততক্ষণে বাড়ি ফিরেছে অপূর্ব। আজকের দিনটা সে পরিবারের সাথে ভাগাভাগি করতে চায়। বাবা মায়ের সাথে উৎযাপন সেরে ঘরে এলো। বারান্দা খুঁজে ওয়াশরুমের দরজা বাইরে হেলান দিয়ে দাড়িয়ে রইল। গলায় তার বিভিন্ন ফুলের মালা।
আরু বের হল। অপূর্ব-কে দেখে লুকিয়ে ফেলল কিট। মাথা হল নিচু। ঠোঁটে হাসি ফুটিয়ে নেয়। গেঁথে রাখা মালাটা অপূর্বকে পড়াতে চায়। তার হাত প্রচণ্ড কাঁপছে। অপূর্বর সন্দেহ হচ্ছে। মালাটা পড়িয়ে ধীর গলায় বলে, “শুভ কামনা নেতা সাহেব।”

অপূর্ব থমকে গেল। নামটা বেশ মনে ধরেছে। মালাটা ছুঁয়ে দিয়ে বলে, “ধন্যবাদ আরুপাখি।”

আরুর মাথা ঘুরছে। ছুটে গেল ওয়াশরুমে। দরজা খুলে ঢুকল ভেতরে। বমি করল। অপূর্ব দেখল। বিচলিত হয়ে গেল। আরুকে মাথায় পানি দিতে সাহায্য করল। বিছানায় বসিয়ে উত্তেজিত হয়ে বলে, “তাড়াতাড়ি তৈরি হ, আমরা এখন হাসপাতালে যাবো।”

কাঁচুমাচু করে আরু বলে, “আমি যাবো না।”

“তৈরি হতে বলেছি। নাহলে কোলে নিয়ে যাবো।”

আরু থতমত খেল। আচম্কা অপূর্ব-কে জড়িয়ে ধরে ডুকরে কেঁদে উঠে। অব্যক্ত স্বরে বলে, “আমি আর বাঁচবো না নেতা সাহেব।”

[চলবে.. ইন শা আল্লাহ]