জ্বালাতে রং মশাল পর্ব-১০

0
509

#জ্বালাতে_রং_মশাল 🖤
#ইফা_আমহৃদ
পর্ব: ১০

গ্লাস ধুয়ে কোক খাওয়া যায়? আশ্চর্য কথাবার্তা। শব্দ করে গ্লাসটা মাটিতে রাখলাম। কথা আছে না ‘ফাকা কলসি বাজে বেশি’ তেমনি গ্লাসটা শব্দে করল। তেজ দেখিয়ে ঘরে চলে এলাম। তুরের ঘরে গিয়ে বসে রইলাম। বিছানা গুছিয়ে শুতে গেলাম। উপরে গান বন্ধ হয়েছে আরও আগে। কিছুক্ষণ বিছানায় শুয়ে এপাশ ওপাশ করলাম। নিচে চ্যাঁচামেচি হচ্ছে। উঁকি দিলাম জানালা দিয়ে। সবাই চলে যাচ্ছে। এখন নিশ্চয় অপূর্ব ভাই ঘরে আসবেন। কপাল থেকে ঘাম ঝরতে লাগল। উপলব্ধি করলাম মাথার উপরে ফিলিং ফ্যান স্থির। সুইচ বোর্ড হাতরে ফ্যান চালু করলাম। হাত দিয়ে নোনা ঘামটুকু মুছে নিলাম। মাথা ধরেছে হঠাৎ। ভনভন করে ঘুরছে সবকিছু। ভূকম্পন অনুভূত হচ্ছে। আদৌ ভূকম্পন না-কি আরু কম্পন বোধগম্য হলনা। দ্রুত হাতে গ্ৰিল চেপে ধরলাম। ফুরফুরে লাগছে। নির্ঘাত প্রয়োজন ঘুমের। চোখজোড়া গ্ৰথণ করে মাথা চেপে শুয়ে রইলাম। পায়ের ধপাধপ শব্দ কর্ণপথে ধাক্কা দিল। অপূর্ব ভাই আসছেন। বুকের ভেতর ধুক করে উঠল। হাত পা ছড়িয়ে ঘুমে আচ্ছন্ন হওয়ার ন্যায় অভিনয় সাজালাম। একটু আওয়াজ তুলে বললেন, “কোক নিয়ে এসেছি। খেয়ে নে।”

আমি নিভু নিভু আবছা দৃষ্টিতে দেখলাম ‘কোকাকোলা’ লেখা প্লাস্টিকের বোতলে গায়ে। এটা সেই কোক নয়। ভ্রু কুঁচকালাম। অপূর্ব ভাই প্রবেশ করে অভয় দিয়ে বললেন, “ঢং করে লাভ নেই। চোখের পাতা টিপটিপ করছে। কোকটা খেয়ে নিস।
একা ঘুমাতে পারবি? না-হলে আমার ঘরে আয়।”

দৃঢ় গলায় বললাম, “পারব, একা ঘুমাতে। আপনার কোক আপনি নিয়ে খান।”

অপূর্ব ভাই নিলেন না। আমাকে একা রেখেই পায়ে শব্দ তুলে চলে গেলাম। মন খা’রা-পেরা জড়োসড়ো হল। একদম ভালো না তিনি!
মাথা ভার হওয়ার ফলস্রুতিস্বরুপ বালিশে মাথা ঠেকানোর সাথে সাথে ঘুমে ভেঙে এল চোখের পাতা।
পরদিন সকালে ঘুমের রেশের ইতি টেনে চোখ মেলতে অপূর্ব ভাইকে দৃষ্টিগোচর হল। আমার ঠিক সামনে ঘুমিয়ে আছেন তিনি। আমার পা তার পায়ের উপর রাখা‌। ভীত হলাম তৎক্ষণাৎ। বুকের ভেতরে ধুকপুকানি বাড়ছে। ‘অপূর্ব ভাই জানতে পারলে ড্রেনের নোংরা জলে পরিষ্কার করবে তোকে আরু’

আমি পা নামিয়ে ছুটে গেলাম বাইরে। জড়তা গুজে আসছে ক্রমশ। সেদিনের পর মাসখানেক অতিবাহিত হল। ভালোই যাচ্ছিল আমাদের জীবন। হঠাৎ একদিন তন্বি তার মা বাবা-কে নিয়ে হাজির হল আমাদের বাড়িতে। বিয়ের প্রস্তাব নিয়ে আসেন। তখন আনুমানিক সন্ধ্যা সাতটা কিংবা আটটা‌। আমি বই খাতা নিয়ে অপূর্ব ভাইয়ের বাড়িতে গেলাম। ড্রয়িং রুমে তন্বির পরিবার দেখে বিস্মিত হয়েছিলাম। অপূর্ব ভাইয়ের হাতে মুঠোফোন। তিনি কিছু রেকর্ড শোনাচ্ছেন। যেখানে স্পষ্ট শোনা যাচ্ছে, “দেখ তন্বি, তুমি আমার সাথে রিলেশনে যেতে চাইছ। ভালো কথা, কিন্তু সিরিয়াস নিতে পারবেনা। যখন তখন আমি ব্রেকআপ করে দিতে পারি।”

তন্বি তখন খুশি মনে বলে, “আচ্ছা হিরো।”

তন্বির বাবা মা আশাহত আর ক্ষোভ নিয়ে নত হয়ে চলে যায়। শুনেছিলাম, তন্বি-কে যথেষ্ট মে’রেছিল। কিন্তু আমাদের কিছু করার ছিলনা।
তার ঠিক দু’দিন পর একটা বড় ঘটনা ঘটল। আমার জীবন দুর্বিষহ হল। হঠাৎ করে শরীরটা ক্লান্ত হল। যার দরুন বিশ্রামে ছিলাম বেশ কয়েকদিন। বমি-বমি ভাব, বেশ কয়েকবার বমি, শরীরের অস্থিরতা, ক্ষুধা লাগে না। আমি ক্লান্ত শরীর নিয়ে ঘুমিয়ে ছিলাম। মা হঠাৎ ঘরে এলেন। গম্ভীর গলায় ডাকলেন। মায়ের কণ্ঠ শ্রবণ হতে ঘুমের ব্যাঘাত ঘটল। মা কখনও ঘুমের সময় ডাকে না। আমি উঠে বললাম, “কোনো সমস্যা হয়েছে মা? তুমি আমাকে ডাকলে?”

মা একটা কিট হাতে ধরিয়ে দিলেন। এপিঠ-ওপিঠ করে নজর বুলিয়ে নিলাম কিটে। মা তেমন কোনো জবাব দিলেন না। কীভাবে ব্যবহার করতে হবে, বলে দিলেন। মায়ের কথাটা গুরুত্ব দিয়ে ওয়াশরুমের দিকে এগিয়ে গেলাম। পেরিয়ে গেল কিছু সময়। আমি বেরিয়ে এলাম। কিট এগিয়ে দিলাম। মা নিলেন না। হতবুদ্ধি হয়ে তাকিয়ে আছেন সেদিকে। চোখ মুখে বিষন্নতার ছাপ। তার চোখের জল গড়িয়ে পড়ল। এক পর্যায়ে এসে ছিনিয়ে নিল। গভীর দৃষ্টিতে তাকিয়ে থেকে ছুঁড়ে ফেললেন দেয়ালের দিকে। ধাক্কা লেগে ফেরত এলো পায়ের কাছে। মাথায় হাত দিয়ে বসে পড়লেন বিছানায়। দু’হাতে মুখ আড়াল করে বললেন, “এবার পাড়া প্রতিবেশীদের কী জবাব দিবো আমি? সবাই ছিঃ! ছিঃ! করবে।”

আমি অবুঝ দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলাম। বোধগম্য হলনা। হঠাৎ সব ছেড়ে ছুড়ে মা’র-তে আরম্ভ করলেন। নিজের ভেতরে ফিরতেই চিৎকার করে উঠলাম। চোখের সমুদ্রের আভাস পেলাম। গাল গড়িয়ে অঝরো ধারায় ঝরছে। মামুনি তুর ছুটে এলো। আমাকে ছড়িয়ে নিতে নিতে বললে, “আপা কী করছ, এতবড় মেয়েকে মা’র-ছ কেন? যা বলার মুখে বলো।”

মা হাত পা ছড়িয়ে কেঁদে বললেন, “কী বলব, ওকে শেষ করে আমি শান্ত হবো। কী করেছে জানো?”

“কী?” কৌতুহল নিয়ে নিয়ে মামুনি।

“ও অন্তঃসত্ত্বা। কিটে দেখা যাচ্ছে স্পষ্ট। ঐযে কিট, দেখো।”

মামুনি কিট নিয়ে দেখলেন না। আমার দিকে তাকিয়ে আছেন। আমি নির্বাক। ‘অন্তঃসত্ত্বা’ মানে জানি আমি প্রেগন্যান্ট। অতএব কিটটা প্রেগন্যান্সি কিট ছিল। আমি প্রেগন্যান্ট কিন্তু কীভাবে? সাইন্সের ছাত্রী হিসেবে একটু জানা। এটা অসম্ভব ব্যাপার। দম বন্ধ হয়ে আসছে আমার। আমি ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে বললাম, “বিশ্বাস করো মামুনি, এমন কিছু না। আমি কখনও কোনো ছেলের সাথে ঘনিষ্ঠ হইনি।”

মা চিৎকার করে বললেন, “তাহলে অন্য কেউ কাজটা করে বাচ্চা তোর পেটে দিয়ে গেছে? ভাবী, ওকে আমার চোখের সামনে থেকে নিয়ে যাও। আমি ওরে শেষ করে ফেলব নাহলে।”

কেউ আমাকে বিশ্বাস করছে না। কী করলে বিশ্বাস করবে? মামুনি আমাকে আদরে জড়িয়ে নিয়ে বললেন, “ভালো করে মনে করে দেখ, কোন ছেলে তোর কাছে এসেছে?”

আমি ফট করে বললাম, “অপূর্ব ভাই। কিন্তু তিনি এতকাছে আসেনি।”

আমার বাক্য পুরোপুরি মামুনির কর্ণপথ পর্যন্ত পৌঁছায় কি-না জানা নেই। তিনি ভয়ংকর রেগে গেলেন। তুর-কে কড়া গলায় ফোন করতে বলেন অপূর্ব ভাই-কে। আমি একনাগাড়ে বুঝানোর চেষ্টা করলাম, কেউ বুঝল না। বাবা ও মামাকে অফিস থেকে বাড়িতে আসার জন্য কল করলেন। অপূর্ব ভাইয়ের আসার পূর্বেই বাবা ও মামা বাড়িতে এলেন। যখন অপূর্ব ভাই এলেন মামুনি জ’ম রুপে আক্রমণ করলেন। বেশ কয়েকটা চ’ড় দিলেন তাকে। অপূর্ব ভাই অহমকে-র মতো চেয়ে থাকলেন। সবকিছু তার ভাবনার থেকে দূরে অবস্থিত। অপূর্ব ভাই চিৎকার করে বললেন, “আশ্চর্য তো! মা’র-ছ কেন? কী করেছি আমি।”

“কী করেছিস, আরু প্রেগন্যান্ট। ওর সাথে কী করেছিস তুই?”

অপূর্ব ভাইয়ের বাকশক্তি খোয়া গেল। বিস্মিত তার দৃষ্টি। টেনে টেনে বললেন, “কীসব বলছ? আরু প্রেগন্যান্ট, কিন্তু কীভাবে? আমিই বা কী করেছি?”

“তুই না করলে কে করেছে? আরু তোর কথা বলছে।”

আমি ওড়না হাতের পেঁচিয়ে স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে রইলাম। আমাকে ঝাঁকিয়ে অপূর্ব ভাই ক্ষিপ্ত গলায় বললেন, “আমি করেছি? সত্যি কথা বল আরু। আমার কাছে, তুই আর তুর সমান। আমি কখনও তোদের আলাদা চোখে দেখিনি। বোন হোস। বোনের সাথে এইসব আমি কল্পনাও করতে পারিনা।”

আমি কাঁদো কাঁদো গলায় বললাম, “বিশ্বাস করেন অপূর্ব ভাই, আমি আপনার নাম বলিনি।”

“তাহলে ওরা বানিয়ে বলছে, ভালো সাজবি না একদম।”

আদো আদো স্বরে, “আপনি সেদিন আমাকে কোক খেতে দিয়েছিলেন।”

অপূর্ব ভাই ভয়ংকর রেগে গেলেন। হুংকার দিয়ে বললেন,
“একটু দিয়েছিলাম। তাছাড়া বি’য়ার খেলে কেউ মা’তাল হয়না। আমিই তো কখনও না।
আমি এর দায় কখনো নিবো না। অন্যের বাচ্চার দায় আমি কেন নিবো। আমার পরিবারের আমার উপর বিশ্বাস না থাকতে পারে, কিন্তু অপূর্ব আহসানের আছে।”

অপূর্ব ভাই আমাকে একাকিত্ব উপহার দিয়ে বিদায় নিলেন। তার কোনো দোষ নেই, দোষ আমারও নেই। অসহায় লাগছে নিয়েছে। কেন এমন হল আমার সাথে। মা-বাবা, মামা-মামনি, তুর ও অপূর্ব ভাই মুখ ফিরিয়ে নিলেন আমার থেকে। সপ্তাহ খানেকের মাঝে বদলে গেলাম চিরতরে। ঘর থেকে বাইরে পা রাখা নিষেধ বলে জানলাম। খাবারের থালা সাজিয়ে দিয়ে দিয়ে পরে এসে নিয়ে যায়। কোনো কথা হয়না। সমাজের চোখ থেকে আড়াল করার চেষ্টা করে। আমি আজও জানি না বাচ্চাটার বয়স কত মাস?
নিজের ঝামেলা হিসেবে মনে হল। হুট করে একটা ভয়ংকর কাজ করে বসলাম। সবাই-কে মুক্তি দেওয়ার কাজ। দেওয়ালে বেশ কয়েকবার মাথা ঠুকে দিলাম। অতিরিক্ত আঘা’তে মাথা ফেটে রক্ত বের হল।

[চলবে.. ইন শা আল্লাহ]