#জ্বালাতে_রং_মশাল 🖤
#ইফা_আমহৃদ
পর্ব: ১৭
“আরুর বাচ্চা, তুই কি আসবি? না-কি উঠব? আমার ঘুম ভেঙ্গে উঠলে তোর খরব আছে।”
আমি মাথা নিচু করে দ্রুত পা চালালাম। কিন্তু দূর্বল শরীর ধীরে ধীরে এগোল। কাছাকাছি আসতেই অপূর্ব ভাই হাত ধরে টেনে নিলেন কাছে। আকস্মিক ঘটা ঘটনায় হুরমুড়িয়ে পড়লাম অপূর্ব ভাইয়ের বাহুডোরে। স্থির থাকলাম কয়েক সেকেন্ড। সরে আসতে নিলেই থমথমে গলায় বললেন, “কতক্ষণ লাগে আসতে? বা’রে গান বাজনায় মাথা ধরে থাকে। বাড়িতে এসে ঘুমাতে পারিনি। এখন মাথার চুলগুলো টেনে দিতে বলছি, তাতেও তোর ঘোরতর আপত্তি। কেন?”
বা’রে? তিনি বারে গিয়ে কী করেন? তিনি চাকরির ফাঁকে বারেই বা কখন যায়? আমি নতজানু হয়ে বললাম, “কোথায় ঘোর আপত্তি? বললাম তো, ‘টেনে দিছি’ আপনারই সহ্য হচ্ছে না।”
অপূর্ব ভাই বাহু ধরে আরেকটু কাছে এনে বললেন, “পিঁপড়াও তোর থেকে ভালো ছুটে। শুধু তুই ছুটতে পারিস না।
ড্যাবড্যাব করে তাকিয়ে থাকবি, না-কি কাজটা করবি?”
আমি নতজানু হয়েই হাত রাখলাম অপূর্ব ভাই মাথায়। তিনি সরে গেলেন। আমি উঠে বসলাম। মাথা রাখলেন কোলে। পুনরায় হাত দিয়ে চুল টেনে দিতে ব্যস্ত হলাম। তার দৃষ্টি সরাসরি আমার মুখশ্রী জুড়ে নিবদ্ধ। আমি হাসলাম সৌজন্য করে। শরীরটা কাঁপছে ক্রমাগত। হুট করে অপূর্ব ভাই তার শক্তপোক্ত হাতটা মাথায় ঠেকালেন। মাথা সরিয়ে নিলাম। ধমকে বললেন, “মাথা কাছে আন।”
আমি কাছে এনে নত হয়ে বসলাম। তীক্ষ্ণ দৃষ্টি তার। ঝাঁজালো গলায় বললেন, “তোর কি এই জীবনে আক্কেল হবে না আরু?”
“কেন আমি কি করেছি?”
“শরীর ঠান্ডা কেন তো?”
“একটু আগে শাওয়ার নিয়েছি।”
“রাতে আমাদের মাঝে কিছু হয়েছিল?”
থতমত খেয়ে গেলাম। কিছুটা অস্বস্তি ভর করল। হয়েছিল তো ঝগড়া। ওড়না দিয়ে দ্রুত কপাল মুছে নিলাম। ঠান্ডার মাঝেও গরমের আভাস। আমি ইচ্ছে করে শাওয়ার নিয়েছি। ধুলোকণার কারণে। রাতে ছাদের ঠান্ডা হাওয়াতে মাথাও ধরে ছিল। আমি মিনমিনে গলায় বললাম, “গরম লাগছিল যে।”
“এবার জ্বর আসলে কে দেখবে তোকে? যতটুকু টাকা আছে সেটুকুও শেষ করে ফেল। তারপরে আমাকে বিক্রি করে ফেল।”
চায়ের অর্ডার দিলেন গম্ভীর গলায়। আমি চা বানাতে ছুটলাম। চায়ের পানি চুলায় দিয়ে হাত গুঁজে বসলাম পাশে। কাশি দিলাম কয়েকবার। নাক বন্ধ হয়েছে। শ্বাস নিতে সমস্যা হচ্ছে। চিনি, চা-পাতা দিলাম। ফুটছে পানি। কাপে ঢেলে দ্রুত ঘরে চলে এলাম। অপূর্ব ভাই নেই। ওয়াশরুম থেকে পানির শব্দ শোনা যাচ্ছে। প্রিজ দিয়ে ঢাকা দিলাম। এগিয়ে পাশের সেন্টার টেবিলের উপর রাখলাম। অন্যটা আমি নিলাম। বিছানায় বসে ফুঁ দিয়ে খেলাম। মিনিট দশেক পর অপূর্ব ভাই বেরিয়ে এলেন। তখনও চা খাচ্ছি। হাত মুখ মুছে চায়ের কাপ নিয়েন। কাল রাতের মতো এক টানে শেষ করলেন কাপের চা’টুকু। অতঃপর আমার হাতের কাপ নিয়ে খেয়ে ফেললেন। বিরক্তিকর কণ্ঠে বললেন, “চা তো নয়, পানসে চিনি।”
বিছানায় শুয়ে চোখ বন্ধ করে নিলেন। আমি পাশেই বসে থাকলাম।
দুপুরের খাবার শেষ বেরিয়েছেন অপূর্ব ভাই। সবে বাড়িতে ফিরেছি আমি। আজ স্কুলে স্যার কিছু বলেনি। বরং গত কয়েকদিনের ক্লাসের নোটস্ কালেক্ট করে দিয়েছেন। জামা কাপড় ছেড়ে বিছানায় বসলাম। স্কুলে থাকা অবস্থায় তিনবার বমি করেছি। মাথা ধরে আছে। এই সময়ে এমন একটু আধটু হবে।
তার ময়লা হয়ে যাওয়া জামা কাপড় ডিটার্জেন্ট দিয়ে ভিজিয়ে রেখেছেন। নিশ্চয় আমাকে ধুতে হবে। একটু পর ধুয়ে দিবো।
আয়নার সামনে গিয়ে দাঁড়ালাম। পেটের দিকে তাকালাম। একটু ফুলেছে পেট। আচ্ছা বাচ্চা এত তাড়াতাড়ি নড়াচড়া করে না? পেটের কাছে জামা তুলে একটু মন ভরে দেখলাম। ফ্লাই কিস্ দিয়ে নিজে নিজে বললাম, “আরুর ছোটো প্রিন্সেস, শুনছ আমার কথা? কালকে রাতে তোমার পাপার কথা শুনেছ? আমি জানি না সে তোমার পাপা কি-না? তুমি পারবে না, তোমার মাকে ভালোবাসতে?”
___
ঢ্যাপ থেকে অবিরাম ধারায় জল পড়ছে। এঁটো বাসনগুলো সাবান দিয়ে ধুয়ে নিচ্ছি। আজ ভুনা খিচুড়ি আর চিংড়ির মাছের ভুনা করেছি। বাটিতে সাজিয়ে এঁটো বাসনগুলো ধুয়ে নিচ্ছি। খিছুড়িটা আগে মায়ের কাছে দেখেছিলাম। আজ মামুনি চিংড়ি মাছের ভুনা করেছে। খিচুড়ি রান্নার সময় আড়চোখে মামুনির চিংড়ি মাছের ভুনা দেখে নিয়েছিলাম। আর কি-বা করার? ব্যাস! রান্না শেষ। সময় তখন বারোটা ছাড়িয়েছে। বাড়ির আলো নেভানো। অপূর্ব ভাই এখনও ফিরে নি। কতক্ষণ লাগবে ফিরতে জানা নেই। মামুনি এলেন রান্নাঘরে। অবশিষ্ট তরকারি গরম করতে চুলোয় রাখলেন। আগুন জ্বালিয়ে দিলেন। একটু পর তুর ফোন সমেত ছুটে এলো। হাঁপাতে হাঁপাতে বলে, “মা, গ্রানি ফোন করেছে। তোমার সাথে কথা বলবে।”
ধুক করে উঠল বুকের ভেতরে। আজ কতদিন নানু-কে দেখা হয়না। সেই কবে গ্ৰামে গেছেন আর ফিরেন নি। কবে ফিরবে তা-ও জানা নেই। মামুনি তারকারি নাড়তে নাড়তে বললেন, “স্পিকারে দিয়ে এখানে রাখ।”
তুর স্পিকার অন করে রাখল তাকের উপরে। মামুনি নাড়তে নাড়তে বললেন, “আসসালামু আলাইকুম। কেমন আছেন আম্মা?”
নানু ওপাশ থেকে বললেন, “ওয়া আলাইকুমুস সালাম। ভালো আছি, তোমরা কেমন আছো? আম্মার খোঁজ খবর তো না-ও না?”
মামুনি থতমত খেলেন। নিশ্চুপ হয়ে গেলেন। মুখে বুলি নেই। আমতা-আমতা করে বলে, “ইদানীং চারপাশে যা ঘটছে, মনটা বিষিয়ে যাচ্ছে। আপনার খবর নেওয়া হচ্ছেনা।”
নানু চুপ থেকে বললেন, “মেয়েটাও তাই বলল। আরুর সাথে কথা বলব, কিন্তু ফোন দিতে বললেই রেখে দেয়। তুমি একটু ওর সাথে কথা বলিয়ে দিও তো। অপূর্বের সাথেও কথা হয়না। আগে রোজ ফোন করত। হঠাৎ করেই ফোন করে না।”
মামুনি আমার দিকে তাকালেন। আমি হাত চালালাম। ধোয়া শেষ। তড়িগড়ি করে বাসন সাজিয়ে রেখে বেরিয়ে আসার জন্য পা বাড়ালাম। নানু মা আমার সাথে কথা বলতে চাইছেন। আমারও ইচ্ছে করছে কিন্তু ঐযে উপায় নেই।
আমি ঘরে এসে বিছানায় বসলাম। বইখাতা এলোমেলো সবকিছু। আলতো করে শ্বাস নিলাম। গুছিয়ে একপাশে রেখে বিছানা গুছিয়ে নিলাম। দরজা খোলার আওয়াজ শ্রবণ হল। ঘাড় কাত করে একবার দৃষ্টি নিবদ্ধ করলাম। অপূর্ব ভাই হেলতে দুলতে ঘরে প্রবেশ করছেন। দরজার ছিটকিনি তুলে দিয়েছেন। তাকে দেখে স্বাভাবিক লাগছে না। কেমন নে’শাগ্ৰস্ত লাগছে। তিনি কাজে ছিলেন। চোখজোড়া ছোটো ছোটো। হয়ত ঘুমের কারণে ছোটো হয়ে এসেছে। দৃষ্টি সরিয়ে তাড়াহুড়ো করতে লাগলাম। হুট করে পেছন থেকে জড়িয়ে ধরল কেউ। মুখ গুঁজে দিলাম দিল গলায়। শিথিল হয়ে গেল দেহ। হাত থেকে খসে পড়ল বই। দৃষ্টি স্থির হয়ে গেল। তার স্পর্শগুলো স্বাভাবিক নেই। আমি কাঁপা কাঁপা গলায় বললাম, “কী করছেন?”
স্বাভাবিক গলায় বলে, “যেটা সবাই করে, কিন্তু আমি করিনি।”
আমি তাকে সরিয়ে দেওয়া চেষ্টা করলাম। কিন্তু বরাবর ব্যর্থ হচ্ছি। বিচলিত হয়ে গেলাম সরে আসার জন্য। থেমে থেমে বললাম, “রাত অনেক হয়েছে। এত দেরি করে ফিরলেন যে? আপনি বসুন। আমি খাবার নিয়ে আসছি।”
তাকে সরিয়ে আমি দ্রুত পা চালালাম রান্নাঘরে ছুটে যাওয়ার উদ্দেশ্যে। দরজা বন্ধ থাকার কারণে বের হওয়া সম্ভব হলনা। ছিটকিনি তুলার জন্য পা উঁচু করতেই হাত ধরে ফেললেন তিনি। নিজের দিকে ফিরিয়ে দরজার সাথে মিশিয়ে নিলেন। আবদ্ধ করলেন দু’হাতে মাঝে। তার চোখে চোখ রাখলাম। রক্তিম তার চোখের মণি। ঘোর লাগা দৃষ্টি। নে’ শা করে বাড়িতে এসেছেন তিনি। এই নে’ শা কা’ টানোর উপায় নেই জানা। কী করব এখন? থুতনি উঁচু করলেন। এলোমেলো চুলগুলো কানের ভেতরে গুঁজে দিলেন। ওষ্ঠদ্বয়ের স্পর্শ কপালে পেলাম। কোমরে হাত দিয়ে মিশিয়ে নিলেন নিজের সাথে। প্রথমবার কোনো পুরুষের সংস্পর্শে এসে অস্থিরতা ক্রমশ বাড়ছে। চোখজোড়া ভরে এসেছে। গাল গড়িয়ে টুস করে ঝরে পড়ল। আবেদনময়ী গলায় বললাম, “প্লীজ ছাড়ুন। আমি এখনও অনেক ছোটো।”
অবিলম্বে ভয়ংকর রুপে দেখলাম তার। চোখের মণিগুলো জ্বলজ্বল করে উঠল। ভয়ে সিঁথিয়ে গেলাম। হাতের বাঁধন আলগা করে ছুঁড়ে ফেললেন বিছানায়। মুখ থুবড়ে পড়লাম। দরজার সাথে হাত রেখে তীক্ষ্ণ গলায় বললেন, “যখন অন্য ছেলেদের সাথে বিছানায় শেয়ার করেছিলি তখন মনে ছিলনা তুই ছোটো, তোর বয়স হয়নি? যখন বিয়ে ছাড়াই বাচ্চার মা হলি, তখন মনে হয়নি তুই ছোটো। এখনও মা হওয়ার বয়স হয়নি। যখন তোকে অ্যাব’শ-র্ন করানোর কথা বললাম, তখন মনে হয়নি তুই ছোটো বাচ্চা সামলাতে পারবি না? আমাকে বিয়ে করার সময় তোর মনে হয়নি, তোর বয়স হয়নি? শুধু আমি কাছে আসলেই তোর মনে হয়, তুই ছোটো?”
[চলবে.. ইন শা আল্লাহ]