জ্বালাতে রং মশাল পর্ব-২৩ এবং শেষ পর্ব

0
765

#জ্বালাতে_রং_মশাল 🖤
#ইফা_আমহৃদ
পর্ব: ২৩ [অসমাপ্ত]

“আর লুকোচুরি নয়, সবার সবটা জানার সময় এসেছে।”
অপূর্ব ভাই চঞ্চল পায়ে এগিয়ে গেলেন সামনের দিকে। তার হাতের মুঠোয় আমার হাত থাকার ফলে আমিও বাধ্য হলাম তার সাথে সাথে যেতে। সিঁড়ি বেয়ে নামার সময় হাতে বেশ টান পড়ল। সেদিকে দৃষ্টিপাত না করে ছুটে গেল। মামা মামনি, আরু ড্রয়িং রুমে বসা ছিল। আমাকে এভাবে নিয়ে যাওয়া দেখে মামুনি এগিয়ে এলেন। হতবুদ্ধি হয়ে বললেন, “অপু, ওকে কোথায় নিয়ে যাচ্ছিস?”

মামা বলেন, “এই সময়ে এভাবে নিয়ে যাওয়া ঠিক নয়।”

অপূর্ব ভাই দাঁড়িয়ে বললেন, “তোমরাও এসো। কাজ আছে।”
অপূর্ব ভাই পুনরায় হাঁটা ধরল। সবাই পিছুপিছু এলো। আমাদের বাড়িতে গিয়ে থামল। ‘ফুফু ফুফা’ বলে চিৎকার করে ডাকল। বাবা মা নেমে এলো। পরক্ষণেই অপূর্ব ভাই তার হাতের রিপোর্টগুলো ছুড়ে ফেললেন সামনে। মা এগিয়ে এসে আমাকে ফিসফিস করে জিজ্ঞাসা করলেন, “কী হয়েছে আরু? তুই কী করেছিস?”

অপূর্ব ভাই আমাকে তার অন্যপাশে এনে বললেন, “কী হলেই আরু অঘটন ঘটিয়েছে। তোমরা একটু পজিটিভ দেখো। সব আরু করলে তোমরা কী করেছো? একটা মেয়ে অসুস্থতা ঝাচাই না করেই বলে দিলে সে প্রেগন্যান্ট। আমি তার সাথে ১৮+ কাজকর্ম করেছি। ও তো তোমার মেয়ে। একটু বিশ্বাস ওর প্রাপ্য নয়? আবার যেই তুর বলল, পিয়াসের কথা। ওমনি বিশ্বাস করে নিলে। পিয়াসের সাথে ও ঘনিষ্ঠ হয়েছে। আল্ট্রাস্নোগ্ৰাফি করে দেখলে না, কেন? পাড়া প্রতিবেশী জানলে সম্মান নষ্ট হয়ে যাবে তাই, ফুফি?”

মা মাথা নিচু করে আছে‌। মামুনি এসে বললেন, “মানে কী, কিছু বুঝলাম না।”

অপূর্ব ভাই থমথমে গলায় বললেন, “আরু প্রেগন্যান্ট নয় মা, ও ভয়াবহ রোগে আক্রান্ত।”

বাবা ছুটে এসে বললেন, “কী রোগ হয়েছে আমার মেয়ের?”

তাচ্ছিল্য করে বললেন, “তেমন ভয়াবহ কিছু নয়। শুধু পাকস্থলীতে টিউমার ধরা পড়েছে। মানে বেঁচে আছে এখন। টিউমার ধীরে ধীরে ক্যান্সারে পরিণত হয়, সেটা জানো? দীর্ঘ মেয়াদি হলে মানুষ বাঁচে না। কমতো সময় হলনা, তিন-চার মাস। রক্ত নেই বললেই চলে।”

মা এগিয়ে এসে বললেন, “কিট চেক করে দেখেছি পজেটিভ এসেছে।”

“একদাগ এসেছে কিটে। দুইদাগ মানে প্রেগন্যান্ট। এই যে আলট্রা টেস্ট। চেক করে দেখো।”
কেউ কিছু বলেনা। আমি দাঁড়িয়ে থাকলাম। দীর্ঘ নিঃশ্বাস ত্যাগ করলাম। শ্বাস নিলাম বুক ভরে। আমি কোনো ছেলের সাথে বিছানা শেয়ার করিনি। আমি পবিত্র। তাচ্ছিল্যের হাসি দিয়ে বললাম, “কতদিন আর আপনাদের বিরক্ত করতে পারব? মানে কতদিন বেঁচে আছি এই পৃথিবীতে অপূর্ব?”

তৎক্ষণাৎ ডাক্তার-কে ফোন করলেন অপূর্ব ভাই। আমাদের পারিবারিক ডাক্তার। প্রথমবারই রিসিভ করলেন। ফোন স্পিকারে দিয়ে সবার সামনে ধরলেন। ডাক্তার বলতে শুরু করলেন,

“রোগীর লক্ষণ অনুযায়ী ধরা যায় রোগী প্রেগন্যান্ট। কিন্তু আল্ট্রাস্নোগ্ৰাফিতে দেখা গেছে তিনি প্রেগন্যান্ট নয়। এজন্য আমি আপনাদের টেস্ট করতে বলেছিলাম। এবার আসা যাক, রোগীর পেটে বাচ্চা নেই কিন্তু প্রেগনেন্সি টেস্ট পজেটিভ আসলো কেন। এটা যে স্ট্রিপ দিয়ে টেস্ট করা হয় সেই স্ট্রিপ আসলে বাচ্চা ডিটেকটর না |

একজন মহিলা যখন বাচ্চা কনসিভ করে তার ৬ দিনের মধ্যে human chorionic gonadotropin (HCG) নামক একটি হরমোন নিঃসৃত হয় দেহ থেকে যা ইউরিন এর মাধ্যনে দেহ থেকে বের হয়। হরমনটি মূলত syncytiotrophoblast (প্লাসেন্টা অংশ) রক্ষার কাজে ব্যবহৃত হয়।

কিন্তু এই একই হরমোন অনেক টিউমার যেমন : Seminoma, choriocarcinoma, germ cell tumors, hydatidiform mole formation, teratoma with elements of choriocarcinoma, and islet cell tumor এর কারণেও নিঃসৃত হতে পারে। তখন তো প্রেগনেন্সি টেস্ট পজেটিভ দেখাবে। আসা করি বোঝাতে পেরেছি।”

ফোনের লাইন বিচ্ছিন্ন হয়ে হয়ে গেল। তবুও কারো মুখে বুলি নেই। মা এগিয়ে এসে ধরল আমাকে। আমি নিজেকে সরিয়ে নিলাম। একফোঁটা অশ্রু ডান গাল থেকে ঝরে পড়ল। এটা আমার আনন্দের অশ্রু। কোনো অপরাধ না করেও শাস্তি পেতে হল। মায়ের মুখপানে চেয়ে বললাম, “আমাকে জন্ম দিয়ে কোনো ভুল করোনি মা। বরং আমি তোমাদের ঘরে এসে ভুল করেছি।”

প্রচণ্ড হাসতে ইচ্ছে করছে। এই হাসির থামা নেই। হাসতে বসে পড়লাম মেঝেতে, তবুও থামছেনা। আমি কি কারো বিশ্বাস পাওয়া যোগ্য নই? কাঁদতে ইচ্ছে করল। মন খুলে ঢুকড়ে কেঁদে উঠলাম। আমি বাঁচতে চাইনা। একটুও চাইনা। হেঁচকি ওঠে গেল। হেঁচকি দিতে দিতে নাস্তানাবুদ অবস্থা হল। পরক্ষণেই কাশি শুরু হল। যেই-সেই কাশি না। থামার নাম নিচ্ছে না। মামুনি তুরকে পানি আনতে বলল। তুর পানি আনতে ছুটল। মা এসে ধরল। ছাড়িয়ে নিলাম। একঢোক পানি খেলাম। অন্য ঢোক মুখে নেওয়া আগেই ভেতরে থেকে পানিগুলো বেরিয়ে এলো। রক্ত বমি হল। মেঝে মেখে গেল। মাথা ঘুরছে প্রচণ্ড। শরীর ভার ছেড়ে দিয়েছে। হাঁপাতে হাঁপাতে মামুনির কাঁধে মাথা রাখলাম। ঘেমে গেছি। থেমে গেমে বললাম, “মামুনি আমাকে একটু ঘরে নিয়ে যাবে? শরীরটা প্রচণ্ড অস্থির লাগছে।”

মামুনি ধরে এগিয়ে গেলেন ঘরের দিকে। মাঝরাস্তায় সবকিছু আঁধারে নিমজ্জিত হয়ে গেল। ভারসাম্যহীন হয়ে পড়ে যেতে নিলাম। তখন দৃঢ় করে ধরল কেউ। একদম নিজের সাথে মিশিয়ে নিল। আমি তাকিয়ে কাউকে দেখতে পেলাম। সব অন্ধকার। কোলে তুলে নিল। হাঁটতে আরম্ভ করল। ধীরে ধীরে জ্ঞান হারালাম। যখন জ্ঞান ফিরল আমি অপূর্ব ভাইয়ের ঘরে শুয়ে আছি‌। ঘরে সবাই বসে আছে। আমি জানালা দিয়ে বাইরে তাকিয়ে বললাম, “আমাকে ঘরে একা ছেড়ে দাও।”

মা বললেন, “আরু, তোর অবস্থা ভালো নয়। ইমিডিয়েট ডাক্তার দেখাতে হবে।”

শক্ত গলায় বললাম, “আমি ডাক্তার দেখাবো না মা। তোমাদের আর ঝামেলা দিতে চাইনা।”

“কীসের ঝামেলা।”

“ঝামেলা আমি। ডাক্তার কাছে তো দূরের কথা, এই ঘর থেকে বের হবো না। আমাকে আর জোর করতে পারবে না। এতদিন তোমরা আমাকে মানসিক আঘাত দিয়ে যন্ত্র’নায় ছটফট করতে দেখেছ, এবার শারীরিক যন্ত্র’নায় দেখবে। তোমাদের সামনে তোমাদের মেয়ে ছটফট করতে করতে চলে যাবে, কিচ্ছু করতে পারবে না তোমরা‌। কিচ্ছু না। এখন যাও এখান থেকে।”

বিনা বাক্যে সবাই চলে গেল। অপূর্ব ভাই পাশে এসে দাঁড়ালেন। শরীর ঘেঁষে। হাত রাখলেন কাঁধে। বিনয়ী হয়ে বললেন, “কষ্ট পাস-না আরু, তোর কিচ্ছু হবেনা। এক মুহূর্তের জন্য হলেও তোকে বউ হিসেবে মেনেছি। এবার সারাজীবন আগলে রাখার দায়িত্ব আমার।”

তাচ্ছিল্যের হাসি দিয়ে বললাম, “এখন যেই ভেবেছ আমি ভা’র্সিন। ওমনি আমাকে বউ হিসেবে মেনেছ, নাহলে তো বাচ্চা হওয়ার পর ঠিকই ছেড়ে দিতে।”

অপূর্ব ভাই নির্বাক। তার ফোনটা নিয়ে নিলাম। ফুপির কাছে কল করলাম। তিনি ধরলেন। কেঁদে কেঁদে বললাম, “ফুফি তুমি আমাকে নিজের মেয়ের মতো ভাবো না? আমাকে তোমার কাছে রেখে দিবে আজীবনের জন্য?”

ওপাশ থেকে ফুপি বললেন, “কী হয়েছে আরুসোনা?”

“এসে বলব। আগে বল রাখবে?”

“হ্যাঁ।”

আমি খট করে ফোনটা রেখে দিলাম। অপূর্ব ভাইয়ের পাশে বসে ব্যাগ গোছাতে ব্যস্ত হলাম। থাকব না এখানে। অপূর্ব ভাইয়ের দিকে তাকালাম। জড়িয়ে ধরলাম গভীরভাবে। মিশে গেলাম তার সাথে। অতঃপর বললাম, “আমি ফুপির কাছে চলে যাচ্ছি। আর আসব না। ভালো থাকবেন। রাত করে বাড়ি ফিরবেন না। নে’শা করবেন না একদম। বাই‌!”

বলেই বেরিয়ে এলাম। রিকশায় চেপে বসলাম। বাইরে থেকে অপূর্ব ভাই-কে দেখা গেল। তিনি বারান্দায় দাঁড়িয়ে আছেন। তার পাশে বাবা এসে দাঁড়িয়েছেন। রিকশা এগিয়ে গেল সামনের দিকে।
_
বাবা অপূর্ব ভাইয়ের কাঁধে হাত রেখে বললেন, “চিন্তা করিস না অপু। আমার মেয়েটা শান্ত প্রকৃতির। রেগে গেলে ভয়ংকর। আমাদের কথা শুনে চিকিৎসা করবে না। আমার বোন ভালো পারবে ওকে রাজি করাতে। তারপরে আবার তোর হাতে তুলে দিবো। তুই ছাড়া আমার মেয়েটাকে কেউ ভালো বুঝবে না।”

অপূর্ব ভাই মাথা ঝাঁকিয়ে বললেন, “অপেক্ষায় থাকব।”

[অসমাপ্ত]
আসসালামু আলাইকুম। প্রথম অংশের সমাপ্তি এখানে। এইচএসসি পরীক্ষার পর পরই দ্বিতীয় অংশ লিখব। এছাড়া কিছু করার নেই আমার, পড়াশোনায় সময় দিতে পারি না।
দ্বিতীয় অংশে থাকবে টুইস্টে ভরপুর।