ঝলসে যাব জানি পর্ব-১৯

0
213

#ঝলসে_যাব_জানি
#Part_19
#ইয়াসমিন_খন্দকার

দূর্জয় রূপকথার পাশে গিয়ে দাঁড়িয়ে তার হাত শক্ত করে ধরে বলে,”আমি এই মেয়েটাকে বিয়ে করতে রাজি আছি।”

দূর্জয়ের কথা শুনে রূপকথা বিস্ফোরিত নয়নে তাকায় তার পানে। দূর্জয়ের থেকে হাত ছাড়িয়ে নেয়ার চেষ্টা করতে থাকে। দূর্জয় মৃদু স্বরে বলে,”তুমি শান্ত থাকো।”

অতঃপর উপজাতি দের কাবিলের সর্দারের উদ্দ্যেশ্যে বলে,”আপনারা বিয়ের ব্যবস্থা করুন। আমাদের এই বিয়েতে আপত্তি নেই।”

রূপকথা চিৎকার করে বলে ওঠে,”আমি মরে যাবো তবুও এই বিয়েটা করব না।”

দূর্জয় পুনরায় শান্ত স্বরে বলে,”বোকামি করো না রূপকথা। এখন এছাড়া আমাদের হাতে আর কোন রাস্তা নেই। এই কাবিলের এত গুলো লোকের সাথে আমরা পেরে উঠবো না। আর আমাদের পালানোরও কোন পথ নেই। কারণ এই এলাকাটা আমাদের কাছে একেবারেই অচেনা আর এনাদের সবার নখদর্পনে। তাই পালিয়েও বেশি দূর যেতে পারবো না। যদি প্রাণ নিয়ে বেঁচে ফিরতে চাই তাহলে এদের কথা শুনতেই হবে।”

রূপকথা তেতে উঠে বলে,”আপনার জীবনের মায়া থাকতে পারে..আমার নেই। আমি মরে যেতে রাজি কিন্তু এই বিয়েটা করতে নয়।”

“তুমি ভুল ভাবছ রূপকথা। আমি মরতে মোটেই ভয় পাই না। আমি তোমার নিরাপত্তার কথা ভেবেই এই বিয়েতে রাজি হয়েছি। কারণ তুমি আমার বন্ধু আহনাফের খুব প্রিয় একজন। যাকে বাঁচানোর জন্য সে নিজের প্রাণ কোরবানি দিয়েছে। আমি চাই না তার সেই কোরবানি বৃথা যাক। আশা করি তুমিও চাইবে না।”

রূপকথা এবার একটু নরম হয়। স্মিত স্বরে বলে,
“কিন্তু..আমি শুধু আর শুধু আহনাফকে ভালোবাসি। অন্য কাউকে বিয়ে করা আমার পক্ষে সম্ভব নয়। আপনাকে তো নয়ই।”

“এই বিয়েটার কোন মানে থাকবে না৷ আমিও কখনো তোমার কাছে স্বামীর অধিকার চাইবো না। এটা জাস্ট বিপদ থেকে বাঁচার জন্য একটা চুক্তি ব্যস!”

রূপকথা প্রতিত্তোরে কিছু বলে না।

কিছুক্ষণ পরেই কাবিলার লোকেরা লোকালয় থেকে কাজি ডেকে ইসলাম মতে তাদের বিয়ে সম্পন্ন করার ব্যবস্থা করে। রূপকথার হাত-পা কাপছিল। কাজি দূর্জয়কে কবুল বলতে বললে সে একটু সময় নিয়ে কবুল বলে৷ আর রূপকথা তো কিছু তেই কবুল বলতে রাজি ছিল না। প্রায় মিনিট পাচেক চুপ থাকায় কাবিলার মানুষগণ রেগে যায়। কাজিও বিরক্ত হয়ে বলে,”আর কতক্ষণ অপেক্ষা করবে? জলদি কবুল বলে দাও।”

রূপকথা উঠে দাঁড়িয়ে বলে,”আমি কবুল বলবো না৷ এই বিয়েটা আমি করবো না।”

শেষ মুহুর্তে এসে রূপকথার এমন কথা দূর্জয়কে অবাক করে দেয়। কি করতে চাইছে কি মেয়েটা। এদিকে কাবিলার সর্দার ভীষণ রেগে গিয়ে বলেন,”এক্ষুনি আগুন নিয়ে এসে এই মেয়েকে জ্বালিয়ে দেয়ার ব্যবস্থা করো। ন-ষ্টামি করার সময় আছে কিন্তু বিয়ের বেলায় নেই।”

সাথে সাথেই কয়েকজন হাতে মশাল নিয়ে এগিয়ে আসে। আবার কিছুজনের হাতে ছিল কেরোসিন। সেই কেরোসিন গুলো রূপকথার গায়ে ছিটিয়ে দেয়। দূর্জয় রূপকথাকে আগলানোর জন্য এগিয়ে আসে। তাকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরে কানে ফিসফিস করে বলে,”তুমি যদি এক্ষুনি কবুল না বলো তাহলে আমি সবার সামনে এমন কিছু করব যা তুমি ভাবতেও পারছ না!”

দূর্জয়ের এমন হুমকিতেও রূপকথা ভয় পায়না। সে যেন শপথ নিয়েছে মরে যাবে তাও কবুল বলবে না। দূর্জয় রূপকথার এমন ঘাড়ত্যাড়ামি দেখে বাধ্য হয়ে তাকে কোলে তুলে নেয়। অতঃপর তারদিকে মুখ এগিয়ে নিতে যাবে তখনই রূপকথা ভয়ে ভয়ে বলে ফেলে,”কবুল!”

কাজি বলে ওঠেন,”এই বিয়ে সম্পন্ন হলো।”

রূপকথার পুরো দুনিয়া যেন থমকে গেল। সে সাথে সাথেই গগণ বিদারক আহাজারি করে কাঁদতে লাগল। দূর্জয় রূপকথাকে নিচে নামিয়ে দিলো। রূপকথা চিৎকার করে বলতে লাগল,”এই বিয়ে আমি মানি না, মানি না এই বিয়ে..”

বলেই সে কাবিলা থেকে বেরিয়ে জঙ্গলের দিকে ছুটতে লাগল। দূর্জয়ও ছুটতে লাগলো তার পেছনে। কাবিলার কিছু লোক তাদের পেছনে যেতে নিতেই সর্দার বলল,”ওদের বিয়েটা হয়ে গেছে। এখন বাকিটা ওদের বুঝে নিতে দাও। আমাদের আর মাথা ঘামাতে হবে না এই ব্যাপারে।”

সর্দারের কথায় সবাই থেমে গেলো।

~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~
রূপকথা একটা বড় অশ্বত্থ গাছের নিচে বসে কাঁদতে লাগল। তার কান্নার গতি কিছুতেই কমছে না। মাথা থেকে কিছুতেই কাজির বলা কথাটা ঝেড়ে ফেলতে পারছে না। ঐ দূর্জয়ের সাথে এখন তার বিয়ে হয়েছে…দূর্জয় এখন তার স্বামী এটা মেনে নেওয়া তার জন্য কষ্টকর। এরইমধ্যে দূর্জয় এসে তার সামনে দাঁড়ায়। দূর্জয়কে দেখে তার চাপা ক্ষোপ বৃদ্ধি পায়। উঠে দাঁড়িয়ে দূর্জয়ের কলার চেপে ধরে বলে,”এসব কিছু আপনার প্ল্যান তাই না? আপনিই ষড়যন্ত্র করেছেন সব। কেন করলেন এমন? আমার আর সহ্য হচ্ছে না। নিজেকে শেষ করে দিতে মন চাইছে..”

“তুমি নিজেকে সামলাও। কিছু হয়নি।”

“এত কিছু হয়ে গেল আর আপনি বলছেন কিছু হয়নি!”

“আমি বা তুমি কেউই মন থেকে বিয়েটা করিনি। এটা আমাদের কাছে জীবন বাঁচানোর চুক্তি ছিল। এটাকে একটা দুঃস্বপ্ন ভেবে ভুলে যাও৷ এমনিতেও এখন থেকে আমাদের পথ সম্পূর্ণ আলাদা। তুমি চলবে তোমার পথে আর আমি আমার পথে। আমি কখনো তোমার পথে আসব না। সো রিল্যাক্স।”

রূপকথা অশ্বত্থ গাছের নিচেই বসে থাকে অনেকক্ষণ। দূর্জয় একপর্যায়ে বলে,”এখন যাওয়া যাক। শুধু ঢাকা ফেরা পর্যন্ত আমাকে সহ্য করে নাও। তারপর আমি আর কখনো তোমার সামনে আসব না। কথা দিলাম।”

রূপকথা এবার উঠে দাঁড়ায়। দূর্জয়ের দিকে তাকিয়ে বলে,”মনে থাকে যেন!”

~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~
পরের দিন….
বিয়ের পর আজ আমিয়া প্রথম ভার্সিটিতে এলো। সবাই তার দিকে আড়চোখে তাকাচ্ছে। ভার্সিটির সবাই জেনে গেছে যে তার সহিত প্রফেসর শুভ্রর বিয়ে হয়েছে। ব্যাপারটা এমন হট টপিকে পরিণত হয়েছে, যাকে বলে টক অফ দা টাউন।

আমিয়ার এসব একদম ভালো লাগছে না। সবাই তার দিকে অদ্ভুত ভাবে তাকাচ্ছে৷ এত সবকিছুর মাঝে আমিয়ার চোখ খুঁজছে রূপকথাকে। গতকাল থেকে মেয়েটার সাথে যোগাযোগ করার চেষ্টা করে ব্যর্থ হচ্ছে। মেয়েটা তার বৌভাতেও এলো না।

খুঁজতে খুঁজতে তার চোখ যায় ক্যাম্পাসের অদূরে থাকা কৃষ্ণচূড়া গাছটার দিকে। সেখানেই উদাস মনে দাঁড়িয়ে আছে রূপকথা। আমিয়া তাকে দেখেই তার দিকে এগোতে থাকে।

এদিকে রূপকথা সম্পূর্ণ নিজের খেয়ালে ব্যস্ত। মনে পড়ে যাচ্ছে গতকালকে দূর্জয়ের সাথে বলা শেষ কথা গুলো। দূর্জয়ের সাথে করে সিলেট থেকে ঢাকাগামী একটি বাসে করে সে ঢাকায় ফিরে আসে। বাস থেকে নেমেই দূর্জয় রূপকথাকে বলে,”যান..এই রাস্তাটা আপনার.আর এই রাস্তাটা আমার। দোয়া করব যেন এই দুটো রাস্তার গতিপথ এমন ভিন্ন দিকেই থাকে। কখনো এক না হয়।”

কথাটা বলেই সে চলে গিয়েছিল। একবারও ফিরে তাকায় নি। কথাটার মাঝে কি ছিল রূপকথা জানে না। কিন্তু সে কথাটা ভুলতে পারছে না। হতাশার সহিত দীর্ঘ শ্বাস ফেলে বলে,”আমি ভুলতে চাই গতকাল ঘটে যাওয়া সব ঘটনা। আমাদের পথ এমন আলাদাই থাকুক।”

রূপকথার ভাবনার মাঝেই আমিয়া তার সামনে এসে দাঁড়িয়ে বলে,”কিরে! কি ভাবছিস তুই?!”

রূপকথা থতমত খেয়ে বলে,”কিছু না।”

“কাল থেকে তোর কোন খোঁজ নেই। আমার বৌভাতেও এলি না। ব্যাপারটা কি বল তো।”

রূপকথা বলে,”একটু ব্যস্ত ছিলাম৷ তাই আরকি।”

“বুঝি না তোর এত কিসের ব্যস্ততা।”

এভাবেই টুকিটাকি কথা চলতে থাকে। কিন্তু রূপকথা কোনভাবেই দূর্জয়ের ভাবনা থেকে বের হতে পারছিল না। হতাশার সহিত দীর্ঘ শ্বাস ফেলে আমিয়াকে জিজ্ঞেস করে ফেলে,”আচ্ছা দূর্জয়কে তোর এত পছন্দ ছিল কেন? কি দেখেছিলি ওর মধ্যে?”

“এসব অতীতের কথা তুলিস না আর। আমার কষ্ট হয়।”

“বল না, আমায়।”

“লোকটার চোখের দিকে তাকালে মনে হতো তার চোখে বিষাদসিন্ধু লুকিয়ে রেখেছে। আমার আগ্রহ ছিল সেই বিষাদসিন্ধু সম্পর্কে জানার। কিন্তু পারলাম না..”

রূপকথা আমিয়ার কথা শুনে আনমনেই বলে,”ভাগ্যে যে অন্যকিছু ছিল!”

to be continue…..