#তরঙ্গিনী (পর্ব-১৫)
#আরশিয়া_জান্নাত
সূর্যের মৃদু আলো চোখে পড়তেই ঘুম ভাঙে আরাফের। বুকের উপর রেবাকে পেয়ে পরম শান্তিতে মন ভরে যায়। গতকাল রাতটা তার কাছে অসম্ভব সুন্দর স্বপ্নের চেয়ে কম ছিল না। রেবার মাথায় হাত বুলিয়ে কপালে চুমু খেয়ে বলে, আপনাকে অসংখ্য ধন্যবাদ রেবা! আমার সহস্র বছরের তৃষ্ণা মেটানোর জন্য।
রেবা আরো আদুরে হয়ে তার বুকে মিশে যায়। তার গলায় মুখ ডুবিয়ে বলে, আপনি সবসময় এতো ফর্মালিটিস মেইনটেইন করেন কেন বলুন তো?
আমার মনে হয় না এতে দোষের কিছু আছে, নূন্যতম ভদ্রতা দেখানোই যায়।
হুহ। কত ফিলোসফি আপনার!
আপনার ঘুমভাঙা গলাতো ভারি সুন্দর! কেমন মাতাল করা টাইপ।।
রেবা মুখ উচিয়ে আরাফের নাক টেনে বলল, আমার বরটার কাছে আমার সবকিছুই সুন্দর। সে আমার অসুন্দর কিছুই পায় না।
যা সুন্দর লাগে তাকে সুন্দর বলার সাহস আমার আছে। এতে লোকে যা ইচ্ছে বলুক,
বৌ পাগল বললেও সমস্যা নেই?
ঐটা বললে আরো প্রাউড ফিল করবো।
তাই বুঝি?
হুম ঠিক তাই।
রেবা উঠে চুল ঝেড়ে খোপা করতে লাগলো। আরাফ ওর হাত থামিয়ে পেছন থেকে জড়িয়ে ধরলো, চুলে নাক ডুবিয়ে নেশাতুর কন্ঠে বলল, আজকে না উঠলে হয় না?
অফিস যাবেন না?
আরাফ রেবার কাধে গাঢ় চুমু একে বলল, আমার তো ইচ্ছে করছে আর কোথাও না গিয়ে সারাদিন আপনার সংস্পর্শে থাকি।
রেবা আরাফের বুকে হেলান দিয়ে বলল, আরাফ আপনি আমায় তুমি করে সম্বোধন করতে পারেন।
নাহ। আমি আপনাকে আপনিই বলবো।
কেন?
আপনি করে বললে আপন-ই মনে হয়। আপনি আমার খুব বিশেষ মানুষ, এই বলে সম্বোধন করলে একটা সম্মান, একটা বিশেষত্ব প্রকাশ পায়। সবাই তো বৌকে তুমিই বলে আমি নাহয় আপনিই বললাম?
সবসময় ইউনিক হবার প্রচেষ্টা!
অবশ্যই। একটা জিনিস খেয়াল করেছেন?
কি?
আমি কিন্তু ঠিকই গেস করেছিলাম, আপনি স্বামীসোহাগী,,,,
রেবা মুখ ঢেকে বলল, আপনি একদম অসভ্য!
হাহ! বৌয়ের কাছে সভ্য হয়ে থাকলে বাবা হওয়া লাগবে না,,
রেবা শাওয়ারের জন্য কাপড় নিয়ে বলল, হুম ভালোই প্রস্তুতি নিয়ে রেখেছেন, সাত বাচ্চার বাবা হওয়া যার লক্ষ্য তার সঙ্গে এই নিয়ে তর্ক করার সাধ্যি আমার নেই!
এই রেবা ওয়েট।
কি?
একা শাওয়ারে যাবেন না,
মানে?
মানে হলো আমিও যাবো।
অসম্ভব! না,,
আরাফ ততক্ষণে ওর পাশ গলিয়ে ওয়াশরুমে ঢুকে দরজা বন্ধ করে দিয়েছে।
।
।
পাখির কলকাকলীর শব্দে চারপাশ চঞ্চল হয়ে উঠেছে। বিকেলের এই সময়টা রেবা পুকুর ঘাটে কাটালেও আজ বেলকনীতে বসে আছে। এখানে বসে দূরের মাঠে ছেলেদের খেলা দেখা যায়, সবাই কত হৈ চৈ করছে, কেউ বা বন্ধুদের সঙ্গে বসে আড্ডা দিচ্ছে। এসব দেখতে মন্দ লাগছে না। জীবন নিয়ে ভাবতে না চাইলেও মানুষের মানসপটে সবকিছুই উকিঝুকি মারে।
বিগত কয়েক মাসে তার জীবনটা কত সুন্দর রঙিন হয়েই না সেজেছে। আরাফ রেবাকে পাগলের মতো ভালোবাসে এতে রেবার কোনো সন্দেহ নেই। যেই মানুষটা প্রতিটি স্পর্শে আবেগাপ্লুত হয়ে চোখের জল ফেলতে পারে তার মনের কথা বুঝতে আর বাকি কি?
আরাফের মতো জীবনসঙ্গী পাওয়াটা রেবার কাছে অসম্ভব কল্পনা ব্যতীত কিছুই না। মাঝেমধ্যে জীবন আমাদের এতো দ্রুত এগিয়ে নেয় আমরা বুঝতে পারিনা হচ্ছেটা কি!
পুরুষ মানুষের যত্ন মারাত্মক রকমের সুন্দর। এই যত্ন যে পেয়েছে সেই জানে, তারা তাদের প্রিয় মানুষকে পরম যত্নে আগলে রাখতে কত কিই না করে। স্বামী হিসেবে, বাবা হিসেবে, ভাই হিসেবে একেকবার একেক সম্পর্কে তারা এমন সব দৃষ্টান্ত রেখে যায় যা আসলেই সংজ্ঞায়িত করার মতো না।
আবার মেয়েদের একটা বিশেষ যন্ত্র আছে, যা দ্বারা এরা খুব সহজেই টের পায় স্পর্শের উদ্দেশ্য। আসল কেয়ার কোনটা, আর লৌকিকতা কোনটা। গল্প উপন্যাস পড়ে বা নাটক সিনেমা দেখে আজকাল একটা ট্রেন্ড শো হয় হাত ধরে রাস্তা পার করা, বা’পাশে রাখা, খাওয়ার সময় মুছিয়ে দেওয়া, সময়ে সময়ে ফোনকরে খোঁজ নেওয়া সহ কত কি!
এসব দিয়ে যদি ভালোবাসা মাপা হয় তবে ধোঁকা খাওয়ার চান্স অনেক বেশি। কারণ প্রতারকরা মেয়েদের ফ্যান্টাসি অনুযায়ী খুব নিপুণ অভিনেতা হয়।
কোনটা সহজাত আর কোনটা কেবলই ইম্প্রেস করার উদ্দেশ্যে করা এইটুকু বোঝার মতো এডাল্ট রেবা হয়েছে। সেই অভিজ্ঞতার ঝুলি খুলে রেবা নানাভাবে আরাফকে ঝাঁকিয়ে দেখেছে।
বুঝেও না বোঝা, জেগেও ঘুমিয়ে থাকাসহ আরো কত কি! আরাফ সবসময় তাকে আলগোছে ছুঁয়েছে, হয়তো তার মনের মাঝে থাকা তীব্র আকাঙ্ক্ষা রুখে রেবাকে বুকে রেখেই শান্ত থেকেছে। রেবার সামনের চেয়ে পেছনেই বেশি যত্ন করেছে, খেয়াল রেখেছে। তার প্রতিটা পদক্ষেপ রেবার ভালো থাকাকে ঘিরে।
আরাফ রাগী মানুষ এটা সে ফেইস না করলেও অন্যন্য সবার কাছে শুনেছে তার রাগের নমুনা। রুহি বলে, ভাবী আসার পর থেকে ভাইয়ের সব রাগ নিভে গেছে।
অথচ পুরুষরা নিজের স্ত্রীর সামনে আসল রুপ দেখায়, একজন পুরুষের চারিত্রিক সার্টিফিকেট দেওয়ার একমাত্র মানুষ হলো তার স্ত্রী! এখন পর্যন্ত আরাফের মাঝে এমন কিছু রেবা দেখেনি যাতে খরাপ মানুষ বলা যায়।
এইসব অবজার্ভেশন যেমন তাকে মুগ্ধ হতে বাধ্য করেছে, তেমনি শঙ্কিত করেছে।
রেবার মন কি এ দোটানার মাঝে সহজে প্রেমে পড়তো? যে একবার ধোঁকা খায়, মানুষ চিনতে ভুল করে, সে সহজে কাউকে বিশ্বাস করতে পারেনা। বিপরীত লিঙ্গের প্রতি তীব্র বিদ্বেষ জন্মেই যায়। মনে হয় পৃথিবীর সবাই বুঝি সেই বিশেষ মানুষটার মতোই নির্মম ছদ্মবেশী! রেবাও তো এমনটাই ভাবতো। আরাফকে নিয়েও কম খারাপ ভাবেনি। নতুন নতুন বিয়ে হলে নতুন মানুষকে কতই না ভিন্ন মনে হয়, তার সান্নিধ্য স্বর্গীয় লাগে। একে অপরকে জানার তীব্র কৌতুহল থাকে। বছর যত যায় সব পুরনো হতে শুরু করে।
কিন্তু তার ভুল ভেঙেছে, আরাফকে সে যতোই দেখছে ততোই ভালোলাগা বাড়ছে। সে আরাফকে প্রথম কবুল করেছে সম্মানীয় ব্যক্তি হিসেবে। শ্রদ্ধার আসনে যে থাকে সে যেন তেন হয় না। মেয়েদের মনে এই আসন হাসিল করা সহজ নয়। এখন রেবা শুধু মন থেকে চায়, তার ধারণা ভুল প্রমাণ না হোক। আরাফ সবসময়ই এমন থাকুক।
চিন্তার রেশ ধরে কখন যে বিকেল গড়িয়ে সন্ধ্যা পেরিয়ে যাচ্ছে টেরই পেল না রেবা। ঘরে এসে আলো জ্বালিয়ে মাগরিবের নামায পড়ে কোরআন শরীফ খুলে বসলো। মনটাকে শান্ত করতে এর চেয়ে বড় পথ্য কি আর আছে?
অফিস থেকে ফিরে আরাফ রুমে না এসে স্টাডিতে ঢুকলো। কিসব কাগজপত্র ঘেটে কলে কথা বললো অনেকক্ষণ। রেবা চা নিয়ে যখন ঢুকলো দেখে আরাফ চোখ বুজে কপাল চেপে বসে আছে।
এজন্যই জনাব আজ রুমে যায় নি!
আরাফের যখন অফিসকেন্দ্রীক মনমেজাজ খারাপ থাকে সে ঘরে যায় না। স্টাডিতে বসে মাথা ঠান্ডা করে ফুরফুরে অবস্থায় রেবার মুখোমুখি হয়।
রেবা চায়ের কাপটা রেখে আরাফের কপালে হাত রাখলো, আরাফ চমকে বলল, আপনি এখানে?
রেবা তার চেয়ারের পেছনে দাঁড়িয়ে দুহাতে কপাল চেপে বলল, আমি আপনার সুখ দুঃখের সঙ্গী জানেন? আমাকে কেবল ভালো মেজাজটা দেখান, খারাপটা দেখানোতে সমস্যা কি?
আরাফ মৃদু হাসলো। হাসিমুখে রেবাকে কাছে টেনে বলল, রেবা জানেন আমার বাবা সারাদিন অফিসে বিজি থাকতো, বেশিরভাগ রাত করে বাসায় ফিরতো। আমরা তখন বাবার অপেক্ষায় অধীর আগ্রহে বসে থাকতে থাকতে ঘুমিয়ে পড়তাম। বাবা তো বড় ছেলে ছিলেন, চাচ্চুরাও হাল ধরার মতো হয়নি, তাই উনার উপর চাপ ছিল অনেক। সেই চাপের প্রভাব পড়তো আমার মায়ের উপর। আমি যতবার তার জন্য বহু কষ্টে জেগে থেকেছি ততবার দেখেছি বাবার খিটখিটে রুপ। বাবা অযথাই রাগ করতেন, বকা দিতেন। অবশ্য আমার মা ওসব তোয়াক্কা করতেন না, হয়তো বাবা পরবর্তীতে সেটা পুষিয়ে নিতে পারতো বলে। সকালে আমরা বাবার ফুরফুরে রূপ দেখে স্বস্তি পেতাম। ধীরে ধীরে বড় হয়ে বুঝলাম এসবে বাবার কোনো হাত নেই। আসলে বাইরের জগৎটা ভীষণ কঠিন। এখানে টিকে থাকতে অনেক চিন্তাভাবনা করতে হয়। নানান টেনশন মাথায় নিয়ে ঘুরতে হয়। আপনি খুব সফট হার্টেড তাই
আমি চাই না আপনাকে সেই প্রভাবটা দেখাতে। ঢাকায় সবাই আছেন বলে আমি অনায়াসে যতোটা গুছিয়ে চলতে পেরেছি এখানে একা হাতে সামলাতে ততোটাই হিমশিম খাচ্ছি। আমি পরিপক্ক নই এখনো শিখছি। আপনি অবশ্যই আমার সুখ দুঃখের সঙ্গী হবেন, তবে আমার খারাপ ব্যবহারের স্বীকার হবেন না। ইনশাআল্লাহ!
আমি তার গলা জড়িয়ে বললাম, স্বস্তির জায়গা ভেবে জিরিয়ে নিতে তো পারেন,
জিরোই তো! আপনি হয়তো জানেন না আপনাকে দেখে কতো দিন আমি শান্ত হয়েছি। আপনার আশেপাশে থেকে ক্লান্তি মুছেছি।
রেবা চুপচাপ তার বুকে মাথা রেখে বসে রইলো, যেন খুব মন দিয়ে আরাফের পার্লস রেট গুণছে।
আরাফ মনে মনে বলল, যে চাকরির অহঙ্কারে তৌকির আপনাকে চূর্ণবিচূর্ণ করেছে, সেই চাকরিটা না খাওয়া পর্যন্ত আমি স্থির হবো না রেবা। যদিও আমার তাকে থ্যাঙ্কস বলা উচিত। সে ছেড়ে গিয়েছিলো বলেই তো আমি আপনার মতো হীরেকে নিজের করতে পেরেছি। তবে এই প্রতিশোধটা হবে আপনার চোখের পানির জন্য। আপনাকে করা অপমানের জন্য!
চলবে,,,,
#তরঙ্গিনী পর্ব-১৬
#আরশিয়া_জান্নাত
ভালোবাসা খুব সুন্দর একটা অনুভূতির নাম। এর সংজ্ঞা একেক জনের কাছে একেকরকম হলেও অনুভূতিটা সবার একই সুতোয় গাঁথা। আরাফ রেবার মনে নিজের ভালোবাসার বীজ রোপন করে যত্নে পরিচর্যা করেছে। তাই রেবাও আরাফের রঙে রঙিন হয়ে আলোড়িত করছে চারপাশ। তার হৃদয়ের জমিনে জলছাপ হয়ে সবুজের সমারোহ গড়ে তুলেছে। সেখানে ফুলের সৌরভে সুরভিত হয়ে একঝাঁক প্রজাপতি উড়তে থাকে। আরাফ অনুভব করে; তীব্রভাবেই অনুভব করে কেন আদম আঃ পার্থিব সকল সুখ পেয়েও অসুখী ছিলেন, কেন ছিল তার এতো উদাসীনতা। নারীদের আল্লাহ সৃষ্টিই করেছেন পুরুষের পরিতৃপ্ততার আধার হিসেবে। পুরুষের রুক্ষ অন্তরে জীবনী দান করার তরঙ্গিনী হিসেবে। হ্যাঁ রেবা তার তরঙ্গিনী। যার প্রতিটি চরণে তার মনে কামিনী ফোঁটে, তার কোমল স্পর্শে সকল ক্লান্তি ক্লেশ ঘুচে যায়।
রেবা খুব ভালো মনের মেয়ে। শান্ত নদীর মতোই তার বিচরণ। নিরবে যখন আশেপাশে ঘুরে বেড়ায় তার অলঙ্কারের মৃদু শব্দে আরাফের মন ভালো হয়ে যায়, প্রাণ জুড়িয়ে যায়।
রেবা!
জ্বি
ভালো আছেন এখানে?
বেশ আছি।
শুধুই বেশ?
নাহ।
রেবা?
হুম
আমার সঙ্গে থাকতে ভালো লাগছে?
হ্যাঁ।
সবসময় এমন হু হা কেন? একটু বিস্তারিত বলা যায় না?
রেবা সবজি কাটা রেখে বলল, এই নিয়ে কয়বার কিচেনে এসে এইসব জিজ্ঞাসা করেছেন বলুন তো? আর কোনো কাজ নেই?
আমার ছুটির দিনে আপনি সারাদিন কিচেনে থাকবেন কেন?
সারাদিন কোথায়? দুপুরের রান্নাটা করতে এসেছি কেবল। আপনি আচ্ছা মানুষ তো!
আমিও আপনাকে হেল্প করি?
নাহ।
কেন?
আপনি কিচেনে থাকলে আজকে দুপুরে আর খাওয়া লাগবে না।
এমন বলেন কেন? আপনি কত লাকি ভাবুন, আপনার বর আপনাকে হেল্প করতে চায়।
জ্বি জ্বি আমি ভীষণ লাকি। এমন হেল্প করে আমার বর কি বলবো,
কি করেছি আমি?
নিজেই ভাবুন না!
আরাফ রেবাকে পেছন থেকে জড়িয়ে আদুরে গলায় বলল, আমার দোষ ছিল না সেটা। আপনার আশেপাশে থাকলেই আমার জ্ঞানবুদ্ধি লোপ পায়। নয়তো আমার রান্না যে খেয়েছে সেই বলেছে হাত বাধাই করে রাখার মতো রান্না করি!
হ্যাঁ জনাব তাই তো, একদম হাত বাধাই করে রাখার মতো রাঁধেন আপনি। হাহা
আরাফ নিবিড় হয়ে রেবার আঁচল গলিয়ে তার কোমল পেটে আলতো করে ছুঁয়ে বললো, এমন ঝনঝন করে হাসতে হয় আপনার?
রেবা হাসি থামিয়ে চুপ হয়ে গেল। আরাফের হাতের অবাধ্য বিচরণে শিহরিত হয়ে চোখ বন্ধ করে তার বুকে হেলান দিতেই আরাফ তার কাধে গলায় নাক ঘষে গভীর চুমু আঁকতে লাগলো। অনুনয়ের দৃষ্টিতে গাঢ় গলায় বলল, অনেক ভালোবাসি।
রেবার সারা শরীরে যেন বিদ্যুৎ খেলে গেল। সেই দৃষ্টি উপেক্ষা করার সাধ্যি রেবার নেই। এই মাতাল করা কন্ঠের আকুলভরা আহ্বান এড়ানো অসম্ভব। রেবা আবেগাপ্লুত হয়ে আরাফের বুকে মুখ লুকালো। আরাফ রেবার চিবুক তুলে কম্পিত অধর দখলে নেওয়ার সুযোগ হাতছাড়া করলো না। পরিস্থিতি নিজের অনুকূলে পেয়ে আলগোছে চুলা অফ করে রেবাকে কোলে তুলে নিলো। রেবা তার গলা জড়িয়ে অবনত চোখে লজ্জায় চিবুক নামিয়ে রাখে।
আরাফ তাকে বিছানায় শুইয়ে ধীর গলায় বলে, রেবা আপনার এই লাজুকতা একদম বুকে বিঁধে জানেন!
রেবা তার কলার চেপে কাছে টেনে বলে, আর আপনি যে আমায় দমবন্ধ করা টাইপ আদরে ভাসিয়ে নেন তার বেলা? আমি না কোনদিন এই অনুভূতির তীব্রতায় মরে যাই!
আরাফ ওর ঠোঁট চেপে বললো, এসব কি কথা হুম? এসব কথা আরেকবার বললে আমার চেয়ে খারাপ কেউ হবেনা।
রেবা তার বুকে লাভ বাইট দিয়ে বলল, এমনিতেও আপনার মতো খারাপ কেউ হবেনা।
তাই না?
হুমম ঠিক তাই।
বেশ তবে খারাপই সই। এমন খারাপ হতে আমার কোনো আপত্তি নেই। এখন থেকে আমি ভীষণ খারাপ হবো।
এই না,,, আরাফ রেবাকে আর কথা বলার সুযোগ দিলো না, গাঢ় আদরের ছাপ আঁকতে শুরু করলো গভীর আবেশে।
।
।
মিথিলা মাথা চেপে বসে আছে, রাগে তার মাথায় জাস্ট আগুন ধরে গেছে। তৌকির এতো নীচ হতে পারে এটা সে কল্পনাই করতে পারেনি। একটু আগেই তার তৌকিরের সাথে দেখা হয়েছে। তৌকিরকে দেখে মিথিলা না দেখার ভান করে চলে যাচ্ছিল কিন্তু তৌকির তাকে আটকে বললো, আরেহ মিথিলা যে! কেমন আছ?
জ্বি ভালো আপনি?
আমি বেশ আছি। তা তোমার বেস্ট ফ্রেন্ডের কি খবর? বিয়ে হয়েছে নাকি আইবুড়ি হয়ে বসে আছে আমার আশায়?
মিথিলা পরিহাসের হাসি হেসে বলল, খুব আনন্দ হচ্ছে তাই না? একটা মেয়ের এতোগুলি বছরের প্রেম পায়ে পিষে চলে যাওয়ায় ভীষণ মজা পেয়েছেন মনে হচ্ছে!
মজা না। তবে আফসোস হয় বুঝলে। মেয়েটা দেখতে খারাপ ছিল না, কিন্তু একদম ভেজিটেবল। আমাদের এজ গ্যাপ মাত্র ২বছরের। ছেলেরা ৮০ বছরেও জোয়ান থাকে, কিন্তু মেয়েরা,,
প্লিজ থামুন। আপনার এসব কথা শোনার সময় নেই আমার।
বাব্বাহ রেগে যাচ্ছ দেখি। যাই হোক ওকে দেখেশুনে ভালো লোকের সাথে বিয়ে দাও, অনেক টাকাওয়ালা মধ্যবয়স্ক লোক আছে। ও ওমন আধবুড়োকে স্যাটিসফাইড করলেও করতে পারে।
আপনি কিভাবে পারছেন এমন অশালীন ভাষায় কথা বলতে? নূর আপনাকে কত ভালোবেসেছে, আপনার জন্য কত ভালো ভালো প্রপোজাল রিজেক্ট করেছে। আর আপনি কি না সেই অপেক্ষাকে হেয় করে কথা বলছেন?
শোনো ওকে এতো ভালোও ভাবার দরকার নেই। ও যদি এতোই ভালো হতো তবে বেকার অবস্থায়ই বিয়ে করতো, তাছাড়া ওর বাপের তো টাকা ছিল। অনায়েসে মেয়ের জামাইকে বিজনেস ধরিয়ে দিতে পারতো। কিন্তু না ছেলের জব লাগবে, জব না থাকলে হবেনা।
আপনি কি ভাবছেন এসব বললে অন্যদের মতো আমিও সিম্প্যাথি শো করবো? চাকরীর অভাবে প্রেমিকের হাত ছেড়ে যাওয়ায় বিধ্বস্ত প্রেমিক আপনি! আহাগো কি দুঃখ আপনার না? অনেক মায়া লাগবে আপনার জন্য? মোটেও না।
আসল সত্যিটা হলো নূর আপনার জবের তোয়াক্কা করেনি, ইনফ্যাক্ট ও নিজে জব করেছে। আপনাকে কতবার বলেছে বাসায় আসুন পরিবার নিয়ে। বাকিটা ও সামলাবে। কিন্তু আপনি আপনার পরিবারকে ওর কথা বলার দুঃসাহস দেখাতে পারেন নি। কাপুরুষের মতো ভেজা বিড়াল সেজে ছিলেন।
Mind your language.
ইশ নিজের বেলা খুব লাগলো না? একটা কথা মাথায় রাখবেন ও আপনার বেলা যতোটা লয়্যাল ছিল আপনি ততোটা ছিলেন না। এটা আর কেউ না জানলেও আপনি জানেন। বিবেকর দংশনে মানুষ একদিন হলেও দংশিত হয়। যারা ঠকে তারা বোকা না, বরং যারা ঠকায় তারাই নির্বোধ। আর শুনুন আপনি গ্রুপে ওর নামে যেসব আজেবাজে কথা ছড়িয়েছিলেন, এতে ওর সাময়িক বদনাম রটেছিল ঠিকই। কিন্তু আপনিও সম্মানীয় হননি। প্রাক্তনকে নিয়ে যে কুৎসা রটায় সে আর যাই হোক ভদ্রলোকের কাতারে পড়েনা। এই কথাটা দেরীতে হলেও সবাই বুঝে। ও আপনাকে মাফ করবে কি না জানি না, তবে আমার বান্ধবীর চোখের পানির দায় আপনাকে অবশ্যই দিতে হবে। Be prepare for the revenge of nature…
তৌকির হাত মুষ্টিবদ্ধ করে রাগ কন্ট্রোল করলো। মেয়েটার ঝাঁজ আছে বলতে হয়, সে তাকে রেবার মতো ঠান্ডা ভেবে ভুল করেছে। কোথায় ভেবেছিল এখনো বুঝি ওকে বলবে, রেবার সঙ্গে কথা বলে একটু সান্ত্বনা দিতে মেয়েটা যেন মুভ অন করে। তা না কিসব শুনিয়ে গেল। আচ্ছা রেবার খবর নেওয়া উচিত। মেয়েটার কি হাল এখন?
ম্যাসেজের টোন বাজতেই ফোন হাতে নিয়ে দেখে তার স্ত্রী রাইসা একটা লম্বা লিস্ট পাঠিয়েছে। মেয়েটার চাহিদার শেষ নেই। রোজ একগাদা জিনিস লাগে। তৌকির খানিকটা রুক্ষ মেজাজেই সুপারশপে ঢোকে।
মিথিলা পানি খেয়ে দম নেয়। তৌকিরের সাথে এই প্রথম সে এতো রুড হয়ে কথা বলেছে। আগে সবসময় ভাইয়া বলে সম্মান করলেও এখন তাকে দেখতেও রুচিতে লাগে। যে প্রাক্তনের বেস্টফ্রেন্ডের সামনেই এভাবে বলে অন্যদের সামনে না জানি কিভাবে বলতো!
তাইতো শেষদিকে নূর চেনা পরিচিত সকল ব্যাচমেটদের থেকে আড়ালে চলে গিয়েছিল। তৌকির নূরের ক্লাসমেট থেকে শুরু ভার্সিটির সবার কাছে ওর নামে যা তা বলেছে। গার্লস গ্রুপেও কম গসিপ হয়নি। নূরকে গোল্ড ডিগার, মিচকা শয়তানসহ কত বিদঘুটে নিকনেইমেই না ডেকেছে সবাই! ঐদিনগুলোর কথা মিথিলা সহজে ভুলবে? ভালোই হয়েছে তৌকিরের মতো ফালতু ছেলের সাথে নূরের বিয়ে হয় নি। এই বদ নূরের কদর করতে পারতো না।
“তৌকির ব্যাটা তুই জানোসও না নূর কত ভালো একটা বর পাইছে, ওর বরের জুতার যোগ্যও তুই না।”
উফফ রাগের মাথায় বলাই হয়নাই নূরের কত ভালো জায়গায় বিয়ে হয়েছে। ওর কথিত মধ্যবয়স্ক জুটে নাই। বরং তৌকিরের চেয়ে অনেকগুণ সুদর্শন ছেলেই ওকে পাগলের মতো ভালোবাসে। ওর যত্ন করে। যে বা** সরকারী চাকরি করে মারেম্মা!! জমিনে পা-ই পড়েনা। আসলেই খালি কলসির ডগর ডগর বেশি।
মিথিলার বড় ছেলে মাহীন চিৎকার করে বলল,আম্মু দেখো তোমার মেয়ে আমার বেডে রং ফেলে দিছে। ওরে তুমি মারো।
মিথিলা বুকে ফু দিয়ে বলল,তোরা আমারে শান্তি দিবি না। দুইটা অজাত জন্ম দিছি আমি। ওহ আল্লাহ আমারে তুমি তুইলা নাও।
তুলি অস্পষ্ট ভাষায় বলল, আম্মু তুমিতো অনেক মোতা, লশি ছিলে দাবে,,,
মিথিলা কিড়মিড় করে মেয়েকে বললো, তোর বাপ মোটা, তোর চৌদ্ধগুষ্টি মোটা। আমি মোটা না।
হেহেহে
মিথিলা মেয়েকে কোলে তুলে আদর করে বলল, আমার মাটা কি সুন্দর হাসেগো, আমার কলিজার টুকরা টুনটুনি পাখি।
মাহীন গাল ফুলিয়ে বলল, তুমি বোনকেই ব ভালোবাসো,ও দোষ করলেও আদর করো।
নাহ বাবা, তুই তো আমার সাত রাজার ধন। আমার রাজা ছেলে। যা এখন দুজন গিয়ে খেলা কর, অনেক কাজ বাকি আমার।
।
পিহুর জন্য বেশ কিছু পাত্র দেখা হলেও মনমতো মিলছিল না। তবে এবার যে সমন্ধটা এলো তাতে সবাইই মোটামুটি আশাবাদী। সব ঠিকঠাক থাকলে বিয়ের ব্যাপারে কথাবার্তা ফাইনাল করা হবে। এসব নিয়ে বাড়িতে মোটামোটি হৈচৈ পড়ে গেছে। আরাফ অবশ্য বলেছে সময় নিয়ে আগে খোঁজখবর নেওয়া হোক তারপর যা হবার হবে। এখুনি তাড়াহুড়ো করতে হবেনা। তাছাড়া তার প্রজেক্টের কাজ এখনো শেষ হয়নি,ক’টা দিন বাদে হলেই ওর সুবিধা হয়।
অফিসে কাজের ফাকে ক্যালেন্ডারের দিকে চোখ পড়তেই মনে পড়ে তাদের বিয়ের এক বছর পূরণ হতে চলেছে। দেখতে দেখতে বছর গড়িয়ে গেল একসঙ্গে চলার! আচ্ছা রেবাকে কি সারপ্রাইজ দেওয়া যায়? রেবার কি মনে আছে এই বিশেষ দিনটার কথা??
চলবে,,,