তরঙ্গিনী পর্ব-১৭+১৮

0
403

#তরঙ্গিনী (পর্ব-১৭)

#আরশিয়া জান্নাত

আরাফের ঘুমন্ত মুখের দিকে একদৃষ্টিতে চেয়ে আছে রেবা। ঘুমন্ত মানুষকে দেখার একটা বিশেষ আনন্দ আছে, তখন মানুষটাকে ভালোভাবে পর্যবেক্ষণ করা যায়। জাগ্রত মানুষটা যেমনই হোক না কেন, ঘুমন্ত সবাই নিষ্পাপ আর আদুরে হয়।
রেবা আরাফের কপালে আলতো করে হাত রাখলো, আরাফ ওর হাতটা টেনে বুকে নিয়ে চোখ বন্ধ রেখেই বলল, কি হয়েছে বলুন তো ? কি এতো পর্যবেক্ষণ করছেন?

আপনাকে দেখছি,

আরাফ মুচকি হাসল। চোখ মেলে বলল, আমার পরম সৌভাগ্য!

রেবা আরাফের হাতের উল্টোপিঠে চুমু দিয়ে বলল, আপনাকে অসংখ্য ধন্যবাদ আরাফ। আমায় এতো ভালোবাসার জন্য, এতো আদরযত্নে আগলে রাখার জন্য। আমার এই জীবন নিয়ে আর কোনো অভিযোগ নেই। আল্লাহ আপনায় সবকিছুর উত্তম প্রতিদান দান করুন!

আরাফ রেবার গালে হাত রেখে বলল, এভাবে বলছেন কেন হুম? এখনি স্কোর দিতে হবেনা, আমাদের দীর্ঘসফর বাকি। সবে তো এক বছর হলো!

রেবা ওর বুকে মাথা রেখে বলল, আপনার ভালোবাসায় সিক্ত হওয়া এক বছর!‌ শুনুন আজ কিন্তু আমাকে বেড়াতে নিয়ে যেতে হবে। আপনি তাড়াতাড়ি ফিরবেন,,

যথা আজ্ঞা মহারাণী!

কোন শাড়িটা পড়বো বলুন তো?

আমাকে জিজ্ঞাসা করবেন না, আমি সবচেয়ে পচাটা বলবো,,,

কেন?

যেটাই পড়বেন বেস্ট লাগবে, তাই।

ঢং

উহু ঢং না। সত্যিই। আচ্ছা রেবা শুনুন,

জ্বি?

আমার গিফট কোথায়?

কিসের গিফট?

ওমা ম্যারেজ এনিভার্সেরিতে কিছুই পাবোনা?

এই দিনে গিফট দিতে হয় বুঝি?

হয় না?

জানি না তো!

সত্যিই নেই?

মিথ্যে বলবো কেন?

আপনি আসলেই আনরোমান্টিক!

দুজন রোমান্টিক হলে ব্যালেন্স হবেনা।
আপনি ফ্রেশ হয়ে আসুন আমি ব্রেকফাস্ট রেডি করছি।

আরাফ মুখ ভার করে ড্রয়ার খুলল টিশার্ট নিতে, তখন দেখে সেখানে একগুচ্ছ লাল গোলাপ ফুল আর শপিং ব্যাগ। আরাফের ঠোঁটে হাসি ফুটে উঠলো, সব ঠিকই মাথায় থাকে, কিন্তু ভাব দেখাবে রসকসহীন! আমার মায়াবতী বৌ টা!

রেবা উঁকি দিয়ে দেখলো আরাফ আপনমনেই হাসছে, আমার বরটা কি সুন্দর করে হাসে, মাশাআল্লাহ!!

অনেকগুলো পার্সেল দেখে রেবা অবাক হয়ে বলে, এসব কে পাঠিয়েছে?

তাহেরা বলল, ভাবীসাহেবা এসব ঢাকা থেকে আসছে।

রেবা টোকেন দেখে বলল, বাসা থেকে পাঠিয়েছে দেখছি! এগুলো সব রুমে রাখার ব্যবস্থা করুন।

আচ্ছা।

রেবা বাসায় রুহিকে ফোন করতেই সবাই হামলে পড়লো, যেন কলের অপেক্ষাতেই ছিল সবাই।

রুহি গাল ফুলিয়ে বলল, ভাবী জানো কত করে বললাম হয় তোমাদের আসতে বলুক নাহয় আমরা যাই। কিন্তু কেউই রাজী হলোনা। কি সুন্দর একটা পার্টি করা যেত,,,

ছোট চাচী বললেন, আমাদের ছেলের মনে আছে তো? গিফট দিয়েছে?

মুহতাসিম বলল, ভাবী আমি আপনাদের নিয়ে একটা গান লিখেছি শুনবেন?

পিহু বলল, এরকম ফোনকলে গান শুনিয়ে হবেনা, আমরা সবাই একসঙ্গে বসে গান শুনবো। ভাবী শুনো তোমরা এলেই কিন্তু একটা বড় পার্টি হবে। আমরা সবাই তোমাদের ভীষণ মিস করছি।

মা-বাবা কোথায়?

তোমাদের এনিভার্সেরি উপলক্ষে এতিমখানায় খাবার নিয়ে গেছেন।

রেবা আপ্লুত হয়ে তাকিয়ে রইলো ফোনের স্ক্রিনে।
ওদের সবার কথায় রেবার জবাব দেওয়ার দরকার হলোনা। সকলেই কিছু না কিছু বলেই যাচ্ছে। রেবা হাসিমুখে দেখছে তার একদল আপন মানুষদের।


তৌকির অফিস থেকে ফিরতেই রাইসা ওর পাশে বসে বলল, কেমন গেল দিনটা?

ভালোই। কেন?

এমনিই। আচ্ছা শরবত খাবে?

সূর্য আজ কোনদিকে উঠলো! তুমি আমায় শরবত করে খাওয়াবে? মা কোথায়?

এভাবে বলো কেন? আমি পারিনা নাকি। তুমি মায়ের বানানো শরবত পছন্দ করে বলেই তো আমি বানাই না।

তাই নাকি?

হুম। আচ্ছা শুনো,

কি?

গয়না গড়াতে দিয়েছিলাম না? কাল আনার ডেট,, তুমি গিয়ে আনবে নাকি আমি যাবো?

কিন্তু এখন তো হাতে টাকা নেই, আর দুটো দিন পরে আনলে হয়না?

একদম ঢং করবানা, তোমার কাছে টাকা আছে আমি জানি। আমার বেলাই তোমার যত বাহানা।

এমন না রাইসা, ঐটা অন্য কাজের টাকা।

অন্য কাজ আবার কি? বৌ বাচ্চাকে বাদ দিয়ে কার কাজে খরচা করো?

ধুরর ভুল বুঝো খালি

তুমি আসলেই না ফুটো বালতি, বাইরে থেকে মনে হয় বাবাহ না জানি কত টাকার মালিক, অথচ ভেতরে একদম খালি। আমার বাবাও না কি দেখে যে পাগল হয়েছিল বুঝিনা। এরচেয়ে ফকির বিয়ে করলেও ভালো হতো, ঢাকার ফকিররাও এখন কোটিপতি হয়।

আহ সবসময় কানের কাছে একই রেকর্ড ছেড়ো না তো। অসহ্য লাগে।

হ্যাঁ এখন তো অসহ্য লাগবেই, এক বাচ্চার মা হয়ে গেছি না! ঘরের বৌকে তো আর পছন্দ হবে না। এখন অন্যদিকেই মন যাবে, শান্তি আসবে।

রাইসা তুমি কি পাগল? কিসের কথা কোথায় নিয়ে যাচ্ছ। আমি কি একবারো এটা বলেছি?

বলতে হবে কেন আমি কি ফিডার খাওয়া কচি খুকী? তুমি আজকাল কার আইডি খুঁজে বেড়াও আমি জানিনা ভাবছো? ১০বছরের প্রেম কি এতো সহজে ভোলা যায়?

বুঝোস তো ভোলা যায় না, তো এমন নাচোস ক্যান? তোরে কোনদিকে অসুখে রাখছি বল? টাকা ছাড়া আর চিনোস কি? এত খাই খাই করেও তোর মন ভরে না, এখন আবার বৌগিরি দেখাইতে আসোছ।

তুমি আমার সাথে এমন তুইতোকারি করছো কেন? চোরের মার বড় গলা!

তৌকির বিরক্তিতে উঠে গেল, রাইসার অহেতুক প্যানপ্যানানী শোনার চেয়ে রাস্তায় বসে থাকা বেশি শান্তিদায়ক।

বৌমা তুমিও না পরিস্থিতি বোঝো না। পুরুষমানুষ বাইরে থেকে আসলে একটু সময় দিতে হয়, তা না একেকদিন একেক ফর্দ খুলে বসো। ছেলেটাকে মানুষ মনে করো নাকি টাকার মেশিন?

আহ মা যা বুঝেন না তা নিয়ে কথা বলবেন না তো। এখনই যদি না জুড়াই কবে জুড়াবো? সময় কি আর সবসময় এক থাকবে?

অতিরিক্ত কোনোকিছুই ভালো না, মাথায় রাখিও।

আপনার মতো ভেবে চললে আজীবন গরিবী জীবনই লিড করতে হবে। আপনি এসবে না ঢুকে যান রান্নাটা সেড়ে নিন।

যাবেদা দীর্ঘশ্বাস ফেলে রান্নাঘরে গেল। এমন এক মেয়েকে ঘরের বৌ করে এনেছে, রূপের অহঙ্কারে জমিনে পা-ই পড়েনা। রান্না করলে চেহারা কালো হয়ে যাবে, কুটাবাছা করলে হাত নষ্ট হবে সহ কত বাহানা। পানির গ্লাসটাও নিজে নিয়ে খেতে চায় না। নবাবজাদীর হালে চলতে চায়। বছরের বেশিরভাগ সময় বাপের বাড়ীতেই পড়ে থাকে। বাপ মায়ের আশকারায় বদের হাড্ডী বনেছে বটে! তার হয়েছে যত জ্বালা, ছেলের মুখের দিকে চেয়ে এখানে পড়ে থাকে। এই বৌ তাকে রেধে খাওয়াবে এই ভরসা হয়না বলেই অন্য ছেলেদের কাছে থাকেন না তিনি।
আহারে পোলাডা কিছু মুখেও দিলো না, কই গিয়া বইয়া রইছে কে জানে!

তৌকির রাস্তার পাশে বসে পুরনো কনভার্সেশন ওপেন করে পড়তে থাকে, আজকাল রেবার কথা ভীষণ মনে পড়ে। মেয়েটা ওর কত কেয়ার করতো, ওর চোখের দিকে তাকিয়ে কথা বলতোনা কখনোই। মানুষ গফের পেছনে টাকা উড়ায়, অথচ সে একটা ভালো গিফট দিয়েছিল কি না মনে পড়েনা। মেয়েটা অল্পতেই তুষ্ট থাকতো, ফুটপাত থেকে এক গাছি সস্তা কাচের চুড়ি কিনে দিতেই কত আনন্দিত হয়েছিল। ওর সামনে দুহাত ভর্তি চুড়ি পড়ে ঝনঝন করে ঘুরিয়ে ফিরিয়ে কতবার দেখিয়েছে। এমন আনন্দিত মুখ রাইসাকে সোনার গহনা দিয়েও দেখতে পারেনি। আসলে বিয়ের পর জীবনসঙ্গীর চেহারার চেয়ে চারিত্রিক বৈশিষ্ট্যটাই বেশি ম্যাটার করে। তৌকির ধীরে ধীরে টের পায় রেবাকে দূরে সরিয়ে ভুল করেছে। কিন্তু ইগোর জন্য প্রকাশ করতে পারেনা।
কার কাছেই বা বলবে ও নিজেই তো সব পথ বন্ধ করেছে। অনলাইনে সুখী দম্পতি হবার কি দারুণ নাটকটাই না করে যায়। আজকাল রেবার মুখটা বড় চোখে ভাসে, কিন্তু কোনো ছবিই তার কাছে সংরক্ষিত নেই বলে চোখের দেখাও দেখতে পায়না। রাইসা ড্রাইভ থেকে পর্যন্ত সব ডিলেট করে দিয়েছে। ফেসবুকে আইডি খোঁজে কিন্তু পুরনো আইডি আর খুঁজে পায় না। মেয়েটা যেন সত্যিই হারিয়ে গেল দৃষ্টিসীমার বাইরে।

আচ্ছা মিথিলার কথাই কি সত্যি? আজ তার এই অশান্তি, সুখের সকল উপকরণ থাকা স্বত্ত্বেও অসুখী হওয়া। সব কি প্রকৃতিরই প্রতিশোধ? ও তো ঠিকি বলেছে, রেবার মতো লয়্যাল ও ছিল না। ঢাকায় থাকাকালীন কত মেয়ের সাথেই ও আলাপচারিতা করেছে, ক্যাম্পাসের মেয়েদের সাথেও কম সখ্যতা ছিল‌না। অথচ রেবা ছিল ঠিক এর বিপরীতে।হাতেগনা কিছু বান্ধবী ছাড়া কারো সাথেই মিশতে পারতো না।

পরক্ষণে মনে হয় ধুরর বেশিই ভাবছি, রেবা থাকলেও যে সুখী হতো এমন‌ নিশ্চয়তা নাই। এখন না পাওয়ায় ওরে অনেক কিছু মনে হচ্ছে।
রাইসা কোনোদিকে কম না, রুপে লাবণ্যে ওর তুলনা হয় না। ইনফ্যাক্ট ওর বেড পারফম্যান্স লা জবাব। রেবা কখনোই ওর ধারেকাছে যেতে পারতো না। ফিন্যান্সিয়ালী সুখে থাকতে চাওয়াটা দোষের না। আর বরের কাছে আবদার করবে না তো কার কাছে করবে?

মানুষ আসলেই সৌন্দর্যের পূজারী।সৌন্দর্যের সামনে সাত খুনও মাফ হয়ে যায়, এ আর তেমন কি!!
অথচ সে ভুলে যায় সবকিছুর সীমাবদ্ধতা আছে, অবৈধভাবে উপার্জিত কোনোকিছুই দীর্ঘস্থায়ী নয়।
_______________

বিকেলে আরাফের ফেরার কথা থাকলেও আরাফ এলো না। এদিকে রেবা সেজেগুজে রেডি হয়েছিল বেড়াতে যাবে বলে। বিকেল গড়িয়ে সন্ধ্যা হয়ে আসতেই রেবা আরাফকে কল করে। কিন্তু আরাফ রিসিভ করে না। না চাইতেও অভিমানে দু চোখ ভরে আসে তার। মানুষটা অন্তত বলতে পারতো কাজে আটকে গেছে, এমন অপেক্ষা করানোর মানে কি? রাত ৮টার পরও যখন আরাফ এলো না। তখন সাজ উঠিয়ে সবকিছু খুলে মন খারাপ করে বেলকনীতে বসে রইলো।
অনেক আশা করে অপেক্ষা করার পর যখন সেটা পূরণ হয় না কতোটা কষ্ট লাগে তা আসলে বলে প্রকাশ করার মতো না।
তখনই আরাফের গাড়ি ঢোকে, রেবা চোখমুখ মুছে আরাফের জন্য দাঁড়ায়।

দু’জন লোকের কাধে হাত রেখে আরাফকে দেখে রেবা আৎকে উঠে,এ কি হলো আপনার? পায়ে ব্যান্ডেজ কেন?

আরাফকে বেডে শুইয়ে তার ম্যানেজার বলল,ম্যাম প্লিজ প্যানিকড হবেন না। স্যার এখন ঠিক আছেন, আসলে আসবার সময় উনার একটা ছোটোখাটো এক্সিডেন্ট হয়।

মানে কি এসবের? উনার এক্সিডেন্ট হয়েছে এই খবরটা আমাকে জানানোর প্রয়োজনবোধ করেননি কেউ? আমি উনার ওয়াইফ এইটুকু রাইট তো আমার ছিলো নাকি?

আসলে ম্যাম স্যার চাইছিল না আপনাকে টেনশনে ফেলতে,, আপনি চিন্তা করবেন না ডক্টররা উনাকে দেখেছেন, কিছুদিন বেডরেস্ট নিলেই ঠিক হয়ে যাবেন ইনশাআল্লাহ

আরাফ ব্যস্ত স্বরে বলল,রেবা শান্ত হন প্লিজ, উনার কোনো দোষ নেই এখানে। ম্যানেজার সাহেব আপনারা যেতে পারেন। প্রয়োজন হলে আমি কল করবো।

তারা চলে যেতেই রেবা আর নিজেকে সামলাতে পারলো না, আরাফকে ধরেই কান্না করতে শুরু করলো। অভিযোগের স্বরে বললো,আপনি এমন কেন? আপনি আমাকে একটা খবরও দিলেন না, আমি কি না আপনার উপর রাগ করে বসেছিলাম। এতোবার কল করেছি কেউ ধরে বললো না আপনার এই হাল হয়েছে। আল্লাহ বাঁচিয়েছেন বড় কিছু হয় নি।

আহা রেবা আমি ঠিক আছি তো। বেশি কিছু হয়নি।শুধু পায়ে একটু ব্যথা পেয়েছি। এটা কিছুই না।

একদম মিথ্যে বলবেন না। দেখেই বোঝা যাচ্ছে অনেক ব্যথা পেয়েছেন। আমি এখুনি মাকে ফোন করে বিচার দিবো। আমার কোনো দাম নেই এখানে,,

রেবা শুনুন তো।

রেবা কাঁদতে কাঁদতে রুম থেকে বেরিয়ে গেল।

আরাফ পিঠ সোজা করে আপনমনেই বলল, পা দেখেই এমন করছেন, ভাগ্যিস পিঠেরটা দেখেননি।‌ নাহয় কি যে করতেন। আল্লাহ আসলেই আজকে অনেক বড় বিপদ থেকে উদ্ধার করেছেন, আমিতো ভেবেছিলাম শেষ, এই জীবনে আর দ্বিতীয়বার আপনার মুখ দেখা হবেনা। জীবনটা খুব ঠুনকো রেবা। এই জীবনের প্রতিটা মুহূর্ত অনেক দামি। কেউ জানেনা কখন কি হয়ে যায়।

চলবে,,,

#তরঙ্গিনী পর্ব-১৮

#আরশিয়া জান্নাত

মানুষ যখন বাস্তবতার তীব্রাঘাতে যন্ত্রণাময় পরিস্থিতির মুখোমুখি হয়, তখন সে ভাবে ওর সাথেই কেন এমন ঘটছে? বাকি সবাই তো ভালো আছে, সুখে আছে। সে কেন নেই?
তাই মানুষের জীবনে সঠিক মানুষটা আসা খুব জরুরী। সঠিক মানুষটাই পারে আমাদের জীবনের খারাপ ভালো উভয় পরিস্থিতিতে আমাদের পাশে শক্ত ঢাল হয়ে থাকতে। আমাদের হতাশা কমাতে। পুরো পৃথিবী যখন বিপরীতে, সেই মানুষটা পরম আপনজন হয়ে পক্ষে থাকে। তার কাছে ম্যাচিওর হতে হয় না, বয়স মেপে আচারণ করতে হয়না। সে বলবেনা এই বয়সে এমন ন্যাকামো কেন? যার সামনে গুছিয়ে থাকতে যেমন মানা নেই অগোছানো থাকতেও দ্বিধা নেই।এমন একজন মানুষ থাকা আবশ্যক যার সামনে পাগলামি করা যাবে, হাসা যাবে, কান্না করা যাবে।
এমন সঠিক মানুষ কয়জনে পায়? যারা পায় তারাও কি ঠিক কদর করতে জানে?

রেবার বয়স ২৫ পেরিয়ে ২৬ এ পড়েছে। এই বয়সের মেয়েরা এক অদ্ভুত সংকটে ভুগে। হুট করে যেন ভুলে যায় সে কোন ক্যাটাগরীতে আছে। তাকে তরুণী বলাটা কি কটাক্ষ? নাকি ঠিকই আছে? সাধারণত এদেশে বিয়ে বাচ্চা হলেই সকল নারী গণ-আন্টিতে পরিণত হয়ে যায়। তাকে আপু ডাকতেও অনেকের বিধে। রেবার যদি ১৮ তে বিয়ে হতো এতোদিনে সেও ২বাচ্চার মা হয়ে নিশ্চয়ই আন্টি উপাধী পেত।
বিয়ের আগে রেবা নিজেকে মেয়াদোত্তীর্ণ পাত্রী বলেই ভাবতে শুরু করেছিল। চারপাশের মানুষদের তাকে নিয়ে অত্যন্ত দুঃশ্চিন্তাই এর জন্য অনেকটা দায়ী। সবাই ধরেই নিয়েছিল ওর কপালে ভালো কেউ জুটবেনা। বয়স পেরিয়ে গেলে কেই বা বৌ করতে চায়?

অথচ আল্লাহর ইচ্ছায় সে এমন একজনকে জীবনসঙ্গী হিসেবে পেয়েছে যে তাকে রাণীর মতোই ট্রিট করে। তার মুগ্ধ দৃষ্টি দেখে রেবা ভুলেই যায় সে ষোড়শীর সদ্য ফোটা ফুল নেই। বয়সটা যেন নিছকই সংখ্যা। যা নিয়ে কারো মাথাব্যথা নেই। পরম অনুরাগে যার পানে চেয়ে সহস্র বছর পার করা যায় অনায়েসে। তাই দেরী হলেও ভুল মানুষটা না আসুক জীবনে।

মানুষকে আল্লাহ একদম ফেলনা করে সৃষ্টি করেননি। প্রত্যেকের মাঝে এমন এক গুণ বা বৈশিষ্ট্য দিয়ে রেখেছেন যেটা তাকে অনন্য করে তোলে, সেটা আর কেউ না দেখলেও যার সাথে ডোর বাধা তার চোখে ঠিকই পড়ে। এমন হয় বলেই তো অন্যদের চোখে যে অগ্রহণযোগ্য কোনো একজনের কাছে সেই সেরা।

রেবা খুব সাধারণ একটা মেয়ে, অথচ আরাফের চোখে সে সকল সৌন্দর্যের আধার! তার রূপের কাছে কারোই তুলনা হয় না। হয়তো সেজন্যই শরৎচন্দ্র বলেছিলেন,
“কপালের যেখানটায় বসন্তের দাগ ছিল; সবাই চোখ ফিরিয়ে নিত ঘেন্নায়! সেখানটায় চুমো খেয়ে বুঝিয়ে দিতে হয় ভালোবাসা জিনিসটা সবার জন্য আসেনি।”

সত্যিকারের ভালোবাসার চরম দূর্ভিক্ষের এই যুগে এমন একটা মানুষ পাওয়ার ভাগ্য যার হয়েছে সে নিশ্চয়ই ভাগ্যবতী/ভাগ্যবান।
এমন দূর্লভ মানুষটার উপর বিপদ আসলে কারো পক্ষেই স্থির থাকা সম্ভব না। আরাফের এমন মুমূর্ষ অবস্থায় দেখে রেবার মনের মাঝে কি কষ্ট হচ্ছে তা কি কেউ টের পাবে?

আরাফের এক্সিডেন্টের খবর শুনে তার বাবা-মা ছুটে আসেন পরদিন সকালেই। ছেলেকে এমন অবস্থায় দেখা কোনো মা-ই সহ্য করতে পারেনা।
রেহানা চৌধুরীও পারেননি। আরাফ মায়ের কান্না থামাতে বললেও তিনি থামলেন না। আক্ষেপের স্বরে বললেন, তোকে কত করে বলি সাবধানে থাকবি, দোআ পড়ে বের হবি। ড্রাইভারকে বলবি শান্ত হয়ে ড্রাইভ করতে, তাড়াহুড়ো না করতে। আমার কথা তোর মনেই থাকেনা।

মা এতো কাঁদছো কেন বলোতো? আমি ঠিক আছি তো।

একদম ঢং করবিনা, বৌমা আমাকে সব বলেছে। তুই কেমন আরাফ? এমন সিচুয়েশনেও আমাদের কাউকে খবর দিলিনা, এমনকি রেবাকেও না! আল্লাহ না করুন আজ যদি বড় কিছু হয়ে যেত? এমন আর কখনো করবিনা বাবা।

মা তুমি গিয়ে ওকে সামলাও। কাল রাত থেকে যে কাঁদতে শুরু করেছে, একটু পর পর থেমে আবার শুরু করে। ওকে কেউ বুঝাও আমি বেঁচে আছি তো।

ওর অভিমান তুই বুঝে উঠতে পারিস নি। আমার মেয়ের কান্না শুনেই তো ছুটে এসেছি আমি। নাহয় তোর মতো নিষ্ঠুর ছেলেকে দেখতে আসতো কে?

আমায় তুমি কত বকা দিচ্ছ মা? এমন অসুস্থ ছেলেকে কেউ এতো ঝাড়ে? কোথায় এসে আদর করবা তা না।

আদর করার মতো কি করেছিস?

আরাফের বাবা বললেন, আরাফ তোমার অন্যায়টা কিন্তু ছোট নয়। পরিবারের থেকে কোনোকিছু লুকানোর পরিণাম ভালো হয় না বাবা। তোমরা এখানে একা আছ, একে অপরের ভালোমন্দের দায়িত্বে নিয়োজিত আছ। এখন তুমি যদি তাকেই জানাতে নিষেধ করো কেমন হয় ব্যাপারটা বলো?

আমার ভুল হয়েছে বাবা। আমি এর জন্য সত্যিই লজ্জিত।

যাক যা হবার হয়েছে, এখন ভালোমতো রেস্ট করো। চিন্তার কিছু নেই।

রেবা দরজায় দাঁড়িয়ে বললো, মা আপনারা এতো জার্নি করে এসেছেন খেয়ে একটু রেস্ট নিন। আমি খাবার রেডি করেছি।

চলো রেহানা। আমার আসলেই অনেক খিদে পেয়েছে।

তুই আরাম কর বাবা। বৌমা তুই এখানে বস।

কিন্তু মা,,

কোনো কিন্তু না, ছেলে আমার হাড় ভাঙার চেয়ে বৌয়ের মান ভাঙানোর চিন্তায় অস্থির। আর রাগ করে থাকিস না মা।

রেবা মাথা নীচু করে ঝাপসা চোখে মেঝের দিকে তাকিয়ে রইলো। এখন পলক ফেললেই টুপ করে পানি বেরিয়ে পড়বে যেন। উনারা দুজন চলে গেলে রেবা আলগোছে চোখ মুছে বেডের কিনারায় গিয়ে বসে।

আরাফ সোজা হয়ে বসতে গেলেই ব্যথায় কুকড়ে উঠে। রেবা দ্রুত তার কাছে গিয়ে বলে, উঠতে চাইছেন‌ কেন? শুয়ে থাকুন‌না।

আরাফ রেবাকে কাছে টেনে বলে, এমন দূরে সরে আছেন কেন? আমার ভালো লাগছে না রেবা! আমি সরি তো,

রেবা আরাফের দু’হাতে কপাল ঠেকিয়ে কাঁদতে লাগলো। আরাফ ওর চোখের পানি আজলায় তুলে বললো, ওহহো চোখের পানির সাগর করে ফেলবেন দেখছি! আমি মরে যাইনি তো,,

রেবা রেগে বলল, আপনি অনেক খারাপ। যা তা মুখে আসে আপনার। এসব কি ধরনের কথা?

আরাফ রেবার গালে হাত রেখে বলল, রেবা আপনি এই প্রথমবার আমার কাছে বেড়াতে যাওয়ার আবদার করেছিলেন। আমি নিতে পারিনি। সেজন্য সরি।

আপনি সুস্থ হয়ে আমার পাশে থাকুন, ওতেই আমার চলবে। আর কোনো চাহিদা নেই আমার এই জীবন থেকে।

আরাফ মৃদু হেসে বলল, আপনি অল্পতেই তুষ্ট আমি জানি। তাই বলে আমি যে কিছুই করবো না তা তো হয় না।

রেবা আরাফের হাত নিজের মুঠোয় নিয়ে বলল, আপনাকে হারানোর ক্ষমতা আমার নেই আরাফ। আল্লাহ যেন আমাকে আপনার আগেই নিয়ে যান। আমি আপনাকে ছাড়া আর একটা মুহূর্তও কল্পনা করতে পারিনা।

রেবা! আপনার কি ধারণা আমি পারবো? আমায় বিরহের বোঝা দিতে এই নিয়্যত রাখেন!

রেবা আরাফের বুকে আলতো করে মাথা রেখে বলল, এতোকিছু আমি জানিনা, এতো কিছু ভাবতেও চাই না। আমি শুধু জানি আপনি আমার জন্য খুব মূল্যবান। আমি আমরণ আপনার বুকেই থাকতে চাই। এখানেই যেন আমার মরণ আসে।

রেবা প্লিজ এসব বলবেন না। মৃত্যু একটা চরম সত্যি। এটা থেকে পালানোর উপায় নেই। আসার সময় যে সিরিয়ালে আসি, যাওয়ার সময় যে সেই সিরিয়ালেই যাবো এমন নয়। এখানে যে কেউ আগে পরে যেতে পারে। তবে মনে রাখবেন এটা আমাদের স্বল্প সময়ের বিচ্ছেদ। আল্লাহ চাইলে মৃত্যুর পর আমরা ফের এক হবো।

রেবার চোখের উষ্ণ জলে আরাফের বুক ভিজে যায়। আরাফ আর থামায় না। তার বৌটা এতো কান্না করতে পারে!!!


আরাফের প্রতি রেবার যত্নের অন্ত নেই। সবসময় তার আশেপাশেই থাকে কখন কি লাগে। আরাফকে একদম চোখের আড়াল করেনা। দেড়মাস বেডরেস্টে থেকে আরাফ এখন অনেকটাই সুস্থ। রাজশাহীর কাজও প্রায় শেষ‌ হয়ে এসেছে। আর কিছুদিন পরই তারা ঢাকায় ব্যাক করবে। ওদিকে পিহুর বিয়ের কথা মোটামুটি ফাইনাল। ওরা গেলেই আংটিবদল করে বিয়ের ডেট ফিক্সড করবে।

রেবা আজকাল এই জায়গাটা নিয়ে ভাবে। ৫/৬ মাসের জন্য আসা এই শহরটার সৌন্দর্যের মায়ায় সে আটকে গেছে যেন। কটা দিন পর এখানে আর থাকা হবেনা। একদিকে আপনজনদের মাঝে ফিরে যাওয়ার যেমন উচ্ছাস, অপরদিকে এদিকের অজানা মায়ার টান। মনকে বুঝ দেয় ফের আসবে তো। এখানে আসতে তো আর মানা নেই। লতা, তাহেরা, রহিম চাচা-সবার জন্য কিছু জিনিস কিনে রেখেছে। যাওয়ার দিন সবাইকে দিবে বলে। আরাফ রেবার এসব দেখে খুশী হয়। মেয়েটার মনে সবার জন্য মমতা আছে, এই ব্যাপারটা তার ভীষণ ভালো লাগে।
আরাফ রেবার সামনে গিয়ে দাঁড়ায়, রেবা তখন কাপড় ভাঁজ করছিল। আরাফকে দেখে বলল কিছু বলবেন?

হুম

বলুন?

ভালোবাসি!

রেবা হেসে বলল, জানিতো।

আপনি বলবেন না?

এখন বললে তো মনে হবে ভালোবাসার পিঠে ভালোবাসি বলেছি!

তাহলে?

তাহলে আর কি?

বলবেন না?

বলবো তো।

বলুন?

রেবা আরাফের গলা জড়িয়ে বলল, আমিও আপনাকে অনেক ভালোবাসি।

আরাফ ওর কোমড় জড়িয়ে কাছে টেনে বলল, আমি আপনায় যত দেখি ততোই প্রেমে পড়ি। এই কঠিন অসুখ সারানোর উপায় কি বলুন তো?

সারাতে চান কেন? বয়ে চলুন। কিছু অসুখ স্বাস্থ্যের জন্য ভালো।

তাই বুঝি?

জ্বি ঠিক তাই।

একটা কথা বলি?

হুম?

আমরা কি পরবর্তী প্ল্যান করতে পারি?

কোন প্ল্যান?

আই মিন ফ্যামিলি প্ল্যানিং,,,

৭টা?

নাহ নাহ। বলেছি না ২টা হলেই চলবে!

ভেবে বলছেন তো? পরে আবার বলবেন না আমার জন্য ইচ্ছে পূরণ হয় নি।

আরাফ রেবার গালে চুমু খেয়ে বলল,না বলবো না। রাজী আছেন?

রেবা চিন্তার ভঙ্গি করে গালে আঙুল দিয়ে বলল, সময় দিন ভেবে জানাচ্ছি।

আচ্ছা। সমস্যা নেই, ভেবে জানান।

আরাফ ল্যাপটপটা নিতে টেবিলের সামনে দাঁড়াতেই রেবা তাকে পেছন থেকে জড়িয়ে ধরে বলে, আপনি এতো ভালো কেন আরাফ? আপনাকে আমি কোথায় রাখি বলুন তো?

আরাফ হেসে বলল, যেখানে রাখলে আর কেউ থাকার জায়গা পাবেনা সেখানে রাখুন।

রেবা নিজের বুকের বা’পাশে তাক করে বলল এদিকটায়?

হুমম

আচ্ছা,,,

চলবে,,,,