#তরঙ্গিনী পর্ব-২৫
#আরশিয়া_জান্নাত
আমরা মেয়েরা এক বিশেষ মাটিতে গড়া। আমাদের মনে যেমন সাগরসম মমতা থাকে, তেমনি নিষ্ঠুরভাবে ছুঁড়ে ফেলার মতো মনোবলও থাকে। আমরা যাকে ভালোবাসি তাকে যেমন মাথায় তুলে যত্নে রাখতে পারি, তেমনি ঘৃণায় মাথা থেকে ফেলে চূর্ণবিচূর্ণ করতে পারি। আমাদের মন প্রয়োজন অনুসারে বদলাতে পারে। অল্পতে কেঁদে বুক ভাসানো এই জাতিটাকে অনেকেই দূর্বল ভেবে ভ্রমে থাকে। সৃষ্টিকর্তা চোখের পানির মাধ্যমে এমন এক নির্যাস বের করে দেন, যা মনের অশান্তি লাঘব করে মনকে প্রশান্তি দেয়। হয়তো এজন্যই পুরুষদের তুলনায় মেয়েদের হার্ট বেশিদিন সুস্থ থাকে! তাই আমি ব্যক্তিগতভাবে কান্নাকে শক্তির আধার ভাবি।
রেবা তার প্রেম মুছেছে চোখের উষ্ণ জলে। প্রতিটা অশ্রুবর্জনে তার ভেতরের সবটা ধুয়েমুছে গেছে। এই মনে তৌকিরের জন্য যেটুকু অবশিষ্ট ছিল তাও নিষিদ্ধতার বেড়িতে ধুলোবালিতে ম্লান হয়ে যাচ্ছে। রেবা ওদিকে পা মাড়ায় না, এখন সেই মানুষটার একটা বিশেষ বৃত্ত গড়ে উঠেছে, তার স্ত্রী সন্তান তাকে কেন্দ্র করেই বেঁচে আছে।সেই বৃত্তকে দূর থেকে দেখার ইচ্ছে পোষণ করাও রেবার জন্য পাপ। এতে মানুষ ওকে গিরগিটি বললেও কিচ্ছু যায় আসেনা। তার স্নিগ্ধ অনুভূতি যদি কারো কাছে অযাচিত যন্ত্রণা হিসেবে পরিগনিত হয়, তবে সেই অনুভূতি মুছে ফেলতে দোষ নেই। বরং জিইয়ে রাখা নির্লজ্জতা, চরিত্রহীনতার পরিচয় বহন করে যা সে চায় না।
তাছাড়া এখন সে আরাফকে নিয়েই ভাবতে চায়। সঠিক মানুষের কদর দিতে চায়। ওর সাথেই যখন ভাগ্যের ডোর লেখা, তবে ওকে নিয়েই মগ্ন থাকাই শ্রেয়।
সানজেনা আরাফকে পছন্দ করে, হয়তো ভালোবাসে। তবে তার বোঝা উচিত আরাফ আর একা নেই। সে এখন অন্য একজনের স্বামী। সে এখনো যদি আরাফকে মুগ্ধ করার চেষ্টা করে কিংবা তার মনের প্রতিফলন দেখিয়ে আকর্ষণ টানার চেষ্টা করে এটাকে আর যাই হোক শুদ্ধতম ভালোবাসা বলা যায় না। যে ভালোবাসা অন্যকে দুঃখ দেয়, অন্যের জীবন অনিশ্চয়তায় ফেলে দেয় সে এবং তাকে যারা বৈধতা দিতে চায় কেউই সঠিক পথের পথিক নয়। তাই প্রতিটা সম্পর্কের একটা নির্দিষ্ট সীমারেখা থাকা আবশ্যক। সামাজিক মূল্যবোধ আমাদের তেমনটাই শিক্ষা দেয়।
সময়ের সাথে এগিয়ে যাওয়াই বুদ্ধিমান মানুষের কাজ। মনের সব সাধ পূরণ করতে নেই! সব অনুভূতি পুষে রাখতে নেই, কিছু সাধ আহ্লাদ উড়িয়ে দিতে হয় হাওয়ায়। এইসব অপূর্ণতার জন্যই জীবন সুন্দর বৈচিত্র্যময়!
ঘুম ভাঙতেই রেবা দেখে আরাফ ওর দিকে চেয়ে আছে, ওর দিনটা শুরু হয় এমন একটা মানুষকে দেখে যে তার জীবনে আশীর্বাদ হয়ে এসেছে। মহানুভব রব তাকে যেন প্রতিটা ব্যথার প্রশমনকারী হিসেবে পাঠিয়েছেন। তার ভালোবাসার শীতল পরশে রেবা বেঁচে থাকার তীব্র বাসনা পায়। এই মানুষটা না এলে রেবা কি পারতো অতীত ভুলে এগিয়ে যেতে?
সুপ্রভাত
রেবা আড়মোড়া ভেঙে বলল, আপনি এতো ভোরে উঠে বসে আছেন যে? ভালোমতো ঘুম হয়নি?
ঘুম যা হয়েছে আমার জন্য এনাফ। তাছাড়া এমন সুন্দর দৃশ্য ফেলে দুচোখ বন্ধ করে রাখা আমার কাছে অহেতুক মনে হয়েছে।
তাই না? এতো কথা শিখেছেন কোথায় বলুন তো?
শিখিনি ম্যাম। আপনার সামনে এলে স্বয়ংক্রিয়ভাবে বেরিয়ে আসে।
ইশ কি লজিক জনাবের!
এই রেবা,,
জ্বি?
আপনি এতো সুন্দর কেন?
হুমায়ুন আহমেদ কি বলেছেন জানেন?
সুন্দর বলে কিছু হয় না,আপনি যাকে যত বেশি ভালোবাসবেন,তাকে তত বেশি সুন্দর মনে হবে।
আপনিও না,,, একটুও আবেগ নেই না?
আমি আবেগহীন?
অবশ্যই। এই শান্ত নিবিড় ক্ষণে বরের মুখে এই লাইনটা শুনলে যে মেয়ে এভাবে উক্তি বলে সে আবেগহীনই বটে। আমার কাছে তো সে নির্মম!!
আমি যে নির্মম আজ বুঝলেন? এ তো বহু আগের জানা কথা!
আরাফ রেবাকে বুকের মাঝে চেপে বলল,নির্মম মনে প্রেম জাগলে বেশি ভালোবাসা পাওয়া যায়। সেটা বুঝি বলেই আরো বেশি ভালোবাসি।
রেবা কৃত্রিম রাগ দেখিয়ে বলল, ছাড়ুন তো। নির্মম আবেগহীন আরো কত কি আমি না? ছাড়ুন আমাকে।
এই রেবা। এইই
কি হয়েছে?
হবার সুযোগ পেলে তো হতো,
মানে?
আরাফ রেবার গলায় নাক ঘষে বললো, আপনার মন গলেনি রেবা? সবাইকে বলার সুযোগ দিন না আরাফের মেয়ে হয়েছে!
রেবা আরাফের চুলে হাত গলিয়ে বলল, নাম কিন্তু আমি রাখবো, মেয়ে হলে আয়াত আর ছেলে হলে আরহাম।
আরাফ প্রফুল্ল স্বরে চোখ বড় বড় করে বলল, নামও ভেবে ফেলেছেন, তার মানে আপনি সম্মতি দিচ্ছেন!
রেবা চোখ নামিয়ে মাথা নাড়লো।
আরাফ ওর চোখের পাতায় চুমু দিয়ে বলল, থ্যাঙ্কস এ লট!
🌸🌸🌸🌸🌸🌸🌸🌸🌸
মা তোমরা একটা বড় ভুল করেছ। তোমাদের আরো ভেবেচিন্তে সিদ্ধান্ত নেওয়া উচিত ছিল।
রুহির কথায় ওর মা চাচীরা সবাই হাতের কাজ ফেলে জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলো।
কোন সিদ্ধান্তের কথা বলছিস?
রুহি কিচেনের কেবিনেটের উপর বসে আপেলে কামড় দিয়ে বলল, তোমাদের উচিত ছিল একই বাড়ির দুই ছেলে দেখে একই দিনে দুই মেয়ে কে বিয়ে দেওয়া। মানিক জোড়কে আলাদা করে দুই প্রান্তে ফেলা ঠিক হয় নি। তোমাদের আরো ভাবা উচিত ছিল,,
ছোট চাচী বলল, এখনো বেশি দেরি হয়নি, তুই বললে ফাহিমের ছোট ভাইকে দেখি?
মেঝ চাচী বলল, হ্যাঁ এটা করা যায়, কি বলো বড় ভাবী? আমাদের আসলেই আরেকটু ভাবা উচিত ছিল। একবারেই দুটোকে দিতাম খরচাও বাঁচতো তুই আর ক’টা দিন আগে বলতে পারলি না?
রুহি নাক তুলে বলল, নাহ ঐ ছেলে কে আমি বিয়ে করবো না।
সেজ চাচী– কেন কি সমস্যা? ছেলে তো ভালোই আইটি সেক্টরে জব করে।
রুহি অসহায় ভঙ্গিতে বলল, তোমরাও না এসেছিলাম তোমাদের আটকাতে উল্টো তোমরাই আটকে দিলে। ধুরর ভাল্লাগেনা।
এই রুহি শোন, পালাচ্ছিস কেন? ভাইজান কে কি বলবো কথাটা এগোতে?
রুহি আর এক মুহূর্তও দাঁড়ালো না। সবাই একযোগে হাসতে লাগলো।
রেহানা বলল, মেয়েটা আসলেই একা হয়ে গেছে, সারাক্ষণ দুটো একসঙ্গে থাকতো তো। মায়া পড়ছে না।
সেজ চাচি–পিঠোপিঠি বোন হলে এই এক কষ্ট।
মেঝ চাচি– কবির ভাই আসবে কবে?
রেহানা—শুনেছি তো এ বছরের শেষদিকে আসবে, তোদের ভাইজান তো বলছে এবার আসলেই রুহির ব্যাপারে কথা বলবে।
ছোট চাচী– কবির ভাই তো বলতে গেলে আমাদের পরিবারের মানুষ। ভাইজানের পরাণের দোস্ত। আশা করি ওখানে রুহি সুখেই থাকবে।
রেহানা– হুম কারিয়ানের জন্য রুহিকে ওরাই তো পছন্দ করেছে। বন্ধুত্বকে আত্মীয়তায় রুপান্তর করার সুযোগ তোদের ভাইজান হাতছাড়া করতে চায় না। আগে দেখি ছেলেমেয়ে কি বলে। ওদের পছন্দই আসল।
মেঝ চাচী– এটা ঠিক বলেছ ভাবী। কারিয়ানকে রুহির পছন্দ হয় কিনা সেটা সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ।
বাকিসব পরে দেখা যাবে।
রেবাকে সিলেট রেখে দু’দিন পরে আরাফ ব্যাক করলো ঢাকায়। রেবাকে ছাড়া বাসায় তার একদম মন বসছেনা, রাতে রুমে বসে টিভিতে এটাসেটা দেখে সময় পার করার বৃথা চেষ্টা করা তার রোজকার রুটিন হয়ে গেছে। চ্যানেল ঘোরাতে ঘোরাতে হঠাৎ রেবার কল পেয়েই ঠোঁটের কোণে হাসি ফুটে উঠে তার। আরাফ কল রিসিভ করে বলল, আলহামদুলিল্লাহ লম্বা হায়াৎ আপনার! আপনার কথাই ভাবছিলাম
কেমন আছেন? কি করছিলেন?
ভালো নেই একটুও, আপনাকে অনেক মিস করছি। আপনি ভালো আছেন?
হু
রেবা?
জ্বি!
কিছু হয়েছে? কন্ঠ এমন শোনাচ্ছে যে?
না, এমনি মন খারাপ লাগছে,,
কেন?
জানিনা
এই বলবেন না আমাকে?
আপনার জন্য খারাপ লাগছে,,,
হায়ইইইই আমিতো উড়ে যাচ্ছি!
জানতাম এমন কিছুই বলবেন, তাই বলতে চাই না।
এটা আপনার অন্যায়। খুশি হলে প্রকাশ করতে পারবোনা?
আপনি কি রুমে আছেন?
হুম কেন?
ক্যামেরা অন করুন আপনাকে দেখবো।
আরাফ হেসে বলল, আমায় দেখতে ইচ্ছে করছে বুঝি?
রেবা আড়ষ্ট কন্ঠে বলল, আপনি না চাইলে থাক।
আরাফ ক্যামেরা অন করে রেবার দিকে তাকালো। রেবা ভিডিও কলে অস্বস্তিবোধ করলেও আজ আরাফের দিকে তাকিয়ে রইলো।
রেবা?
হুম
এভাবে চেয়েই থাকবেন। কিছু বলবেন না?
আপনাকে আমি অনেক ভালোবাসি,,,
আমিও আপনাকে অনেক ভালোবাসি। এই রেবা আমি কি আপনাকে নিতে আসবো? বেড়ানো শেষ হয়েছে আপনার?
চলে আসুন, আপনাকে ছাড়া ভালো লাগছেনা। ঘুমও হচ্ছেনা ঠিকঠাক। কোথায় ভেবেছিলাম ক’টা দিন ঘুমিয়ে উঠবো। কি জাদু করেছেন বলুন তো?
আরাফ কিছুক্ষণ চুপ থেকে বলল, আমি কিছুদিনের মধ্যেই আসছি। আপনি নিশ্চিন্তে ঘুমিয়ে পড়ুন কেমন? মন খারাপ করবেন না,, সবার সঙ্গে সময়টা উপভোগ করুন।
আচ্ছা। রাতে ঠিকমতো খেয়ে ঘুমাবেন। টেনশন করবেন না। রাখছি।
নিজের যত্ন নিবেন।
আরাফ ফোন রেখেই ব্যাগ গোছালো। তখনই রওয়ানা দিলো সিলেটের উদ্দেশ্যে।
রেহানা হেসে বলল, তোমার ছেলে তোমার মতোই হয়েছে। বৌ’টা একটু বাপের বাড়ি গিয়ে শান্তি পেলো না। যাচ্ছে নিয়ে আসতে।
এমনভাবে বলছো যেন তুমি এমন নও? চিঠি লিখে কে বলতো এসে নিয়ে যাও, ও বাড়িতে মন টিকছে না? ঐ চিঠি পেয়েই তো ছুটতাম তোমায় আনতে,,,
তো কি করবো তোমার যত্নাদি করতে করতে এমন অভ্যাস হয়েছে বাপের বাড়ি গেলেও মন পড়ে থাকতো এদিকে, তুমি খেয়েছ কি না, ঠিকঠাক ঘুমাচ্ছ কি না। চিন্তাতেই তো আধসের হয়ে যেতাম।
এখন ভিন্নভাবে প্রকাশ করলেও অর্থ কিন্তু ঐ একটাই!
রেহানা হেসে বলল, ওদের সংসার সবসময় এমনি করে ভালোবাসায় পরিপূর্ণ থাকুক।
আমিন।
।
।
রেবা ঘুমের মাঝেই টের পেলো কেউ একজন ওকে পেছন থেকে জড়িয়ে রেখেছে। প্রথমে ভাবলো তার মা হয়তো। ঘুমের চোখেই কোমড়ে জড়ানো হাত ধরে বুঝলো আরাফের হাত এটা। ও কি স্বপ্নে এতোটাই বিভোর যে আরাফের স্পর্শ স্পষ্ট টের পাচ্ছে?
আরাফ ওকে আরো গভীর করে জড়িয়ে ধরে কানের কাছে ফিসফিস করে বলল, এটা স্বপ্ন নয় সত্যি।
রেবা চমকে লাফিয়ে উঠে, তাকিয়ে দেখে সত্যিই আরাফ এসেছে!
আপনি এখানে? কখন এলেন?
আরাফ হেসে বলল, আপনার কি মনে হয় আমার বৌটার মনমরা গলা শোনার পরও আমি ওখানে চুপচাপ বসে থাকতে পারতাম?
তাই বলে নাইটে জার্নি করে এলেন?
হু!
আপনিও না!
আমিও না কি?
বড্ড উন্মাদ!
আপনারই,,
জানিতো।
সারপ্রাইজ টা কেমন লাগলো?
আবেগে কাঁপুনী ধরানো,
তাই বুঝি?
রেবা ওকে জড়িয়ে গালে কপালে চুমু খেয়ে বলল, কত্ত মিস করেছি আপনাকে জানেন? উফফ এতোক্ষণে দেহতে প্রাণ ফিরল যেন।
আপনি আরো আগে বললেই পারতেন আমি চলে আসতাম।
ভেবেছিলাম সবসময় তো আসবো না। ক’টা দিন বেড়িয়ে নেই।
আচ্ছা। তা ৫দিনেই বেড়ানো শেষ?
হুম।
আমি ভাবতাম আমিই বৌ পাগল। এখন দেখছি আপনিও দারুণ বরপাগল।
রেবা কোনো জবাব দিলোনা, আরাফের বুকে মুখ গুজে নিরব হয়ে রইলো।
আরাফ মুচকি হেসে রেবাকে জড়িয়ে রাখলো। ভালোবাসা এতো প্রশান্তিময় কেন??
চলবে,,,
#তরঙ্গিনী পর্ব-২৬
#আরশিয়া_জান্নাত
ব্রেকফাস্ট খেতে বসে রেবার মা বলল, তোর জ্বর কমেছে? কেমন লাগছে এখন?
আরাফ অবাক হয়ে বলল, রেবা আপনার জ্বর ছিল নাকি? বলেন নি তো!
রেবা অপ্রস্তুত গলায় বলল, সামান্য জ্বর ছিল বলে আপনাকে চিন্তায় ফেলতে চাই নি।
রেবার ভাবী বলল, ভাইয়া আসল ঘটনা হলো রেবা আপনাকে চোখে হারায়, আপনি না থাকায় জ্বরে পড়ে গেছে। এখন আপনি এসেছেন ওর জ্বরও গায়েব।
রেবা লাজে রক্তিম হয়ে বলল, ভাবী তুমিও না কি যে বলো!
আরাফ কৃত্রিম হাসি দিলেও মনে মনে ভীষণ রাগ করলো। রেবা তাকে জানালো না কিভাবে!
খাওয়া শেষে রেবা তার ভাবীকে বলল, ভাবী ভাইয়ার বাইকের চাবিটা দাও তো।
রুমা হেসে বলল, নে ধর, তোর জন্যই রেখে গেছে।
থ্যাঙ্কস
রেবা আগে থেকেই রুমাকে বলেছিল এবার আরাফ আসলে ওরা বাইকে করে বেড়াতে যাবে। রেবা প্রফুল্ল মনে রুমে গিয়ে দেখে আরাফ ফোনে কার সঙ্গে কলে কথা বলছে। কথা বলা শেষেই আরাফ বলল, তৈরী হয়ে নিন।
আমিও এটাই বলতে এসেছিলাম তৈরী হয়ে নিন। কিন্তু আপনি বললেন কেন? কোথায় যাবেন?
আরাফ রেবার দিকে না তাকিয়ে বলল, ডাক্তারের কাছে। ২মিনিটে রেডি হন। আমি অপেক্ষা করছি।
রেবা হাতে থাকা বাইকে চাবি আড়াল করে বলল, আচ্ছা।
রেবা চুপচাপ রেডি হয়ে আরাফের পেছনে গেল।
রুমা হেলমেট নিয়ে এসে বলল, রেবা এটা নিতেই ভুলে যাচ্ছিস যে!
আরাফ পিছু ফিরে দেখলো রুমার হাতে হেলমেট। জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে রেবার দিকে তাকাতেই রুমা বলল, রেবার শখ হয়েছে আপনার সঙ্গে বাইকে চড়ার, তাই ওর ভাইয়া বাইক রেখে গেছে। নিন ওকে নিয়ে বেড়িয়ে আসুন।
আরাফ হেলমেট নিয়ে বলল, থ্যাঙ্কস ভাবী।
বাইকের সামনে এসে আরাফ রেবার দিকে তাকালো, রেবা চাবি বাড়িয়ে দিলো। আরাফ বাইকে বসে রেবাকে বলল, ভালোমতো ধরে বসুন। রেবা আরাফের থমথমে মুখ দেখে মিইয়ে পড়েছে যেন। উনি এতো রেগে গেলেন কেন?
আরাফ প্রথমে ডাক্তারের চেম্বারে গেল, ওখান থেকে বের হয়ে রেস্টুরেন্টে লাঞ্চ করলো।
আরাফ আপনি কি আমার উপর রেগে আছেন?
আপনি কি করেছেন যে আমি রাগ করবো?
রেবা মাথা নীচু করে বলল, আপনি সবসময় অনেক প্রেশারে থাকেন, আর সত্যি বলছি বেশি জ্বর ছিল না। এসব মাঝেমধ্য হয়,,
আরাফ জাস্ট চোখ মেলে ওর দিকে তাকালো, ঐ দৃষ্টি স্বাভাবিক ছিল না। রাগ নাকি অভিমান রেবা বুঝেনি, সে শুধু বুঝেছে এটা ভীষণ আলাদা। এরচেয়ে আরাফ যদি ওকে বকাও দিতো ওর এতো খারাপ লাগতো না। আরাফ দুহাত ভাঁজ করে বুকের উপর রেখে চেয়ারে হেলান দিয়ে বলল, আচ্ছা জ্বরটা স্বাভাবিক ছিল। এতোই স্বাভাবিক আপনি পুরো ২টা দিন বিছানায় পড়েছিলেন, খাবারটাও মুখে নিতে পারেন নি। একা উঠে দাঁড়াতেও পারেন নি। এটা এতোটাই সাধারণ জ্বর ছিল যে আমাকে বলার প্রয়োজনবোধ হয় নি!
রেবা আপনি জানেন এখন ডেঙ্গুর প্রকোপ বেড়েছে, তারপরও জ্বরকে তোয়াক্কা না করে বসেছিলেন? আপনি হয়তো ভুলে গেছেন বা জানেন না আপনার প্রতিটা বিষয় আমার জন্য কতোটা গুরুত্বপূর্ণ। নাকি জানেন বলেই এই অবহেলা?
আপনি ভুল বুঝছেন,,
আচ্ছা ভুল বুঝেছি! মানলাম। আমরা কি এখনো এতোটা আপন হতে পারিনি যাতে আপনি বলতে পারেন চলুন বাইকে করে বেড়াতে যাই? আমাকে সব কিছু অন্যদের থেকে জানতে হয় কেন?
আমি বলতেই এসেছিলাম, কিন্তু আপনার মুড দেখে সাহস হয় নি বলার। আর আপনিও তো শুনতে চান নি,,
আরাফ নিজের চুল ঠেলে পেছনে ব্রাশ করলো। দু’হাতে মুখ মুছে পানির গ্লাস থেকে পানি খেয়ে গলা ভেজালো। মাথা ঠান্ডা করতে রেবার দিকে মন দিয়ে তাকালো। রেবা তখনো মাথা নীচু করে রেখেছে। অপরাধী বাচ্চা মেয়ের মতো মুখ করে বসে আছে যেন। এতো কিউট লাগছিল দেখতে,,
আরাফের রাগ পড়ে গেল মুহূর্তেই। নাহ এই মেয়ের উপর রাগ করে থাকা ওর পক্ষে সম্ভব না। ও যদি এখন কেঁদে ফেলে ওর চেয়ে বেশি কষ্ট আরাফের হবে। আরাফ মৃদুস্বরে ডাকলো, রেবা!
রেবা মাথা তুলে বলল, জ্বি?
আমার ভীষণ কষ্ট হয় আপনি আমার থেকে কিছু লুকালে। আর কখনো এমন করবেন না প্লিজ।
স্যরি আরাফ। আর কখনো এই ভুল হবে না।
কোথায় যাওয়ার ইচ্ছে?
আজকে আর কিভাবে? বেলা তো ফুরিয়ে এলো,
কোথায় যাবেন শুনি?
আপনি জানেন আমাদের এখানে সব স্পটই পানি কেন্দ্রীয়। আর আমার পানিতেই যত আকর্ষণ। এই ভরা বর্ষায় ঘোরার জায়গার অভাব আছে এখানে?
আচ্ছা তাহলে কাল প্রিপারেশন নিয়ে আসবো কেমন? আজ চলুন এমনিই ঘুরি।
বেশ তবে চলুন আপনাকে দেখাই আমাদের সিলেট শহরটা।
আরাফ রেবার উচ্ছাস দেখে পুলকিত হলো। দুই কপোত-কপোতী মুক্ত বিহঙ্গের ন্যায় ঘুরে বেড়ালো উদ্দেশ্যহীনভাবে শহরের অলিতে গলিতে। সাথে স্ট্রিট ফুড তো আছেই,,,
।
।
রাতে রেবার গা কাঁপিয়ে জ্বর আসে। রেবা জ্বরের ঘোরে প্রলাপ বকতে থাকে, আরাফ আমি মরে গেলে আপনি ভালো দেখে আরেকটা বিয়ে করে ফেলবেন। একা থাকার চিন্তা করবেন না। আমি আপনার জন্য ওপারে অপেক্ষা করবো,আপনি অনেক ভালো আরাফ। আমার অনেক যত্ন করেন।
রেবা আপনি এসব কথা বলা বন্ধ করবেন?
রেবা উঠে বসে বলল, একটু ভেজা কাপড়টা দিন তো।
আমাকে বলুন কি করতে হবে?
রেবা ওর হাত থেকে কাপড় নিয়ে বলল, মানুষের জ্বর হলে কপাল পুড়ে যায়, কিন্তু আমার পায়ের পাতা জ্বালাপোড়া করে।
রেবা বেশি করে পানি দিয়ে পায়ের পাতা মুছলো।
আরাফ দেখে বলল, দিন আমি করে দিচ্ছি।
নাহ! আপনি আমার পা ছুঁবেন কেন? পাপী বানাবেন না,,
কে বলেছে পা ছুলে পাপী হয়?
আপনি আমার স্বামী, পরম শ্রদ্ধাভাজন মানুষ। গুরুজনও বটে। আপনি এ কাজ করতে হবেনা।
আরাফ রেবার কথা শুনে হেসে ফেলল বলল, বোকা মেয়ে অসুস্থ মানুষের সেবায় কোনো পাপ নেই। আমি বুঝেছি কি করতে হবে,
রেবা মাথার যন্ত্রণায় বালিশে মাথা চেপে শুয়ে পড়লো। এই বিছানা পর্যন্ত তার অসহ্য লাগছে, বালিশটাও মনে হচ্ছে পাথর। জ্বর মানেই এতো অসহনীয় উষ্ণতা কেন? এতো গরম লাগছে,,,
আরাফ ওয়াশ রুম থেকে বোলে করে পানি আনলো, টাওয়েল ভিজিয়ে রেবার পা মুছে দিলো। মেয়েটার পা থেকে আসলেই অনেক গরম হাওয়া বের হচ্ছে। অন্য ভেজা কাপড় দিয়ে মুখ, গলা, হাত পা মুছে দিলো। রেবার কাছে মনে হলো এর মতো শান্তি আর কিছুতেই নেই। এতো আরাম লাগছিল ওর, ও ঘুমের রেশে চোখ বন্ধ করেই বলল, আপনাকে অনেক ধন্যবাদ, আমার ভীষণ আরাম লাগছে।
এসব না বলে ঘুমানোর চেষ্টা করুন। মেডিসিনটা কাজ দিবে।
যতক্ষণ না শরীরের উষ্ণতা কমলো আরাফ এভাবেই স্পঞ্জ করে গেল।
মাঝরাতে জ্বর পড়তেই আরাফ ওর মাথার কাছে আধশোয়া হয়ে বসে রইলো। রেবাকে মুমূর্ষ দেখতে ওর একদম ভালো লাগছেনা। জ্বরে মুখটা এইটুকুন হয়ে গেছে যেন, এতো মায়া লাগছে!! আরাফ রেবার হাতটা মুঠোয় নিয়ে বলল, হে আল্লাহ আপনি ওকে সুস্থ করে দিন। ওর কষ্ট লাঘব করে দিন, ওকে শেফা দান করুন!
ভোরের দিকে যখন রেবার ঘুম ভাঙে দেখে আরাফ ওর পাশেই আধশোয়া হয়ে ঘুমাচ্ছে। মানুষটাও না পারে বটে! একটু ঠিক করে শান্তিতে শুবে না? নিশ্চয়ই সারারাত এভাবেই শিয়রে বসে ছিল।
রেবা উঠে বালিশ ঠিক করে তাকে ঠিক করে শুইয়ে দিলো। আরাফ তখন গভীর ঘুমে মগ্ন। রেবা ওর গালে কপালে চুমু খেয়ে বুকে মাথা রেখে বলল, আপনি এতো ভালো কেন আরাফ? আপনাকে যত দেখি, যত জানি ততোই কৃতজ্ঞতায় আমার মাথা নুইয়ে আসে। আমার জন্য দোআ করবেন প্লিজ। আমি যেন আপনাকে আপনার মতোই যত্ন করতে পারি।
আরাফ ওকে জড়িয়ে বলল, আপনি আমাকে একটু শান্তিতে ঘুমাতেও দিবেন না? কান্নাকাটি করে আমার বুক ভাসাচ্ছেন কেন?
রেবা ওর বুকে আঙুল ঘুরিয়ে বলল, এটা আমার প্রপার্টি, এখানে আমি যা খুশি করবো আপনার কি?
ওহ তাই না? তাহলে জ্বরের ঘোরে এর মালিকানা বদল করার কথা বললেন কেন? আপনার কি ধারণা আপনি না থাকলেই এখানে অন্য কেউ চলে আসবে, এতো সহজ?
কঠিন বুঝি?
উল্টো প্রশ্ন না।
শুনুন, ওটা জ্বরের তীব্রতায় বলেছি। আমি জ্বরে পড়লে কত কি বলি। তবে একটা কথা কি আমি না থাকলে আপনি ছন্নছাড়া হবেন না, ভালোভাবে বেঁচে থাকবেন। সুস্থ স্বাভাবিক জীবনযাপন করবেন। কেমন?
রেবা! তখন কিছু বলিনি, কিন্তু এখন এসব বলে মাথা গরম করলে খবর আছে। আমার রাগ দেখেননি কিন্তু,,
রেগে গেলে কি করেন? গায়ে হাত তুলেন নাকি গালি দেন?
গায়ে হাত তুললে বা গালি দিলেই বুঝি রাগ প্রকাশ পায়? আর কোনো উপায় নেই?
রেবা গতকালকের কথা মনে পড়তেই বলল, আপনার রাগ প্রকাশের ছিটেফোঁটা দেখেই তো আমি শেষ, আসল ডোজ পেলে বোধহয় ফুড়ুৎ।
এই তো বুদ্ধিমতি! তাই আমার রাগ উঠানোর চেষ্টা করবেন না। এসব বলা আমার পছন্দ না। ভবিষ্যত আমরা কেউ দেখিনি। যা হবে ভালোর জন্যই হবে। ওটাকে আল্লাহর উপর ছেড়ে দিয়ে বর্তমানে বাঁচুন, উপভোগ করুন। মনে রাখবেন নিয়্যত আরমানে বরকত। মনে যা নিয়্যত থাকবে তাই ঘটবে। সো বি পজিটিভ।
আচ্ছা।
আরাফ রেবার গায়ে মাথায় হাত দিয়ে চেক করে বলল, জ্বরতো নেই, এখন কেমন লাগছে? মাথা ব্যথা সেরেছে?
হুম। এতো যত্ন পেলে এসব আর থাকে?
তাই নাকি?
হুম ঠিক তাই। আপনাকে অসংখ্য ধন্যবাদ।
আর কতবার বলবো এমন ধন্যবাদ আমার লাগবেনা? অন্যভাবে শোধ করবেন।
করবোনা শোধ। সব জমা থাকুক, ঋণ থাকুক আপনার কাছে। কিছু ঋণ পরিশোধ করতে নেই।
এটা চিটিং
এভ্রিথিং ইজ ফেয়ার ইন লাভ এন্ড ওয়্যার!
চলবে,,,,