তারপর একদিন পর্ব-১২

0
10

#তারপর_একদিন
লেখনীতেঃ রিধিমা জান্নাত রূপা
পর্বঃ ১২
.
বিকেলের দিকে ওরা বেরুলো বাইরে। প্ল্যান ছিল, বাইরে একটু ঘোরাঘুরি করে ভালো কোন রেস্টুরেন্টে যাওয়া। কিন্তু, বিপত্তিটা যেন তখনই বাঁধাল। হুট করেই ওদের সামনে এসে পরল নীলার বাবা। সাথে অবশ্য শুভ ও নীলার ভাইয়েরাও ছিল। ওদের দেখেই ধরে ফেলল। সত্যি সত্যিই বিয়েটা হয়েছে কি-না, তা নিয়ে হুটপাট শুরু হলো রাস্তার মধ্যেই। ব্যাপারটা সামাল দিলো নির্ঝর। তাদের বুঝিয়ে নিয়ে গেল ওর ফ্ল্যাটে।
নির্ঝরের ফ্ল্যাটে, ড্রয়িং রুমে বসে একবার নীলাকে দেখে তো আরেকবার শুভকে দেখে নীলার বাবা। ব্যাপারটা সমঝোতায় আনতে নির্ঝর বুঝিয়ে বলতে যায় ওদের বিয়ের বিষয়ে। কিন্তু, নীলার বাবার এক কথা—শুভর মতো অকর্মা, বেয়াদব, উশৃংখল ছেলেকে নিজের জামাই বলে মেনে নিবেন না তিনি।

নীলা শুভর মামাতো বোন। একই বাড়িতে বসবাস তাদের। নীলা দাদু মারা যাবার আগে একমাত্র ছেলে এবং মেয়ের নামে নিজের গড়ে তোলা চার তালার বাড়িটা লিখে দিয়ে যায়। শুভর ছোট থেকে বেড়ে ওঠা সেই বাড়িতেই। ছোট থেকেই নীলার সাথে শুভর বেশ ভালো সম্পর্ক ছিল। বড় হবার সাথে সাথে তা প্রণয়নের সম্পর্কে রুপ নিতে সময় লাগে না। মামার সাথেও অনেক বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক ছিল শুভর। কিন্তু হঠাৎই ছেলেটা ওর মামার নজরে খারাপ হয়ে উঠল। হবে না-ই বা কেন, উড়তি বয়সের বন্ধুদের সাথে করা ভুলগুলো এক এক করে ওর মামার নজরেই পড়ত। এই তো, একবার কিছু ছেলেদের সাথে ঝামেলা থেকে মারামারি পর্যন্ত গড়িয়ে গেল। প্রথমে শুভ ও তার বন্ধুরা মাইল খেলেও পরবর্তীতে পাল্টা মাইর দিলো ছেলেগুলোকে। ঠিক তখনই ওর মামা কোথা থেকে যেন হাজির হলো সেখানে। একবার রাতের অন্ধকারে গলির রাস্তায় দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে সিগারেট খাচ্ছিল, তখনই সামনে পড়ল ওর মামা। এরপর একদিন ছাদে দাঁড়িয়ে নীলার হাত ধরে কোথাও ঘুরতে যাওয়ার কথা বলছিল, কিন্তু নীলা যেতে নারাজ! সেটাও দেখে ফেলে ওর মামা।
ভাগিনার সকল খারাপ দিকগুলো একের পর এক দেখে খারাপ ধারণা তৈরি হয় লোকটার মাঝে। এরপর যখন নিজের মেয়ের সঙ্গে সম্পর্কের কথা জানতে পারেন, তখন থেকে আরও সহ্য করতে পারেন না তিনি শুভকে।

নীলার বাবা বেশ চোটপাট করলেন শুভ ও নীলার উপর। এই বিয়েও মানেন না—বলে সাফ সাফ জানিয়ে নিলেন। তবে সামাল দেওয়ার চেষ্টা করল নির্ঝর। ভদ্রলোকটাকে বুঝিয়ে শুনিয়ে শুভর ভালো দিকগুলো উপস্থাপন করার চেষ্টা করল। সাথে সায় জানাল নীলা ও শুভর ভাইয়েরা। অনেকটা সময় পর নীলার বাবা ওদের মেনে নেবার চেষ্টা করলেন। তবে এটাও জানালেন—এখন ওরা আলাদা থাকবে। যতদিন না নীলার পড়াশোনা শেষ হয়, এবং শুভ ভালো কেন জব না পায়। মেনে নেওয়া হলো ওনার কথা। শুভ ও নীলাকেও বুঝিয়ে শুনিয়ে বাসায় নিয়ে যাবার জন্য রাজি করানো হলো।

শুভ, নীলাকে নিয়ে রাতেই চলে গেল সবাই। ওরা চলে যাবার পর প্রচন্ড মন খারাপ নিয়ে অশ্রুসিক্ত চোখে বসে রইল সিতারা। নীলার সাথে বেশ সুন্দর একটা সম্পর্ক গড়ে উঠেছিল ওর, সেটা গাড়ো হবার আগেই চলে গেল। তা নিয়েই মেয়েটার ভীষণ মন খারাপ।
একরাশ মন খারাপ নিয়ে খাটে বসে ছিল সিতারা। শুভদের এগিয়ে দিয়ে এসে নির্ঝর রুমে ঢুকে। রুমে ঢুকতেই সোজা নজর যায় নিশ্চুপে বসে থাকা সিতারার পানে। কপালে ভাঁজ ফেলে বলে উঠে, “কি ব্যাপার, এখনও ফ্রেশ না হয়ে এভাবে বসে আছো কেন?”

মাথা তুলে তাকায় সিতারা। বলে উঠে, “ভালো লাগছে না!”

ততক্ষণে এগিয়ে এসেছে নির্ঝর। সিতারার কপালে, গালে হাত রাখতে রাখতে বলে, “শরীর খারাপ লাগছে? কই, জ্বর টরও তো নেই।”

“আমার মন খারাপ, আপনি সেটা বুঝতে পারছেন না?”

“কি হয়েছে? একটু আগেই তো সব ঠিকঠাক ছিল, হঠাৎ মন খারাপ কেন?”

“আপনি বললেই তো নীলা আপুরা আরও দু’দিন থাকত। আপনি যেতে দিলেন কেন?”

“ওহ্ আচ্ছা, এই ব্যাপার!”

মুচকি হেসে বলে নির্ঝর। বসল মেয়েটার পাশে। অশ্রুসিক্ত চাহনিতে ওর পানে তাকিয়ে সিতারা একনাগাড়ে বলল, “আপনি… আপনি তো সারাদিন অফিসে থাকেন। সারাদিন একা বাসায় আমার কেমন লাগে, সেটা জানেন? দম বন্ধ হয়ে আসে আমার। সারাক্ষণ মনে হয়—এই বুঝি অন্ধকার এসে জড়িয়ে নেবে আমাকে, তলিয়ে নিয়ে যাবে কোথাও।একরাশ ভীতি নিয়ে আমি চেয়ে থাকি দরজার পানে, এই বুঝি আপনি এলেন। অথচ আপনি… নীলা আপুরা আসায় আমি কতটা খুশি হয়েছিলাম। ভেবেছিলাম, কিছুদিন আর আমাকে একা থাকতে হবে না। কিন্তু আপনি তাদের আটকালেন না।”

কেঁদেই ফেলল মেয়েটা। নির্ঝর বেশ বুঝল বউয়ের অভিমান নিয়ে করা অভিযোগগুলো। বাহু জড়িয়ে টেনে নিলো কাছে। অপর হাতে সিতারার গালের অশ্রুগুলো মুছে দিয়ে বলল, “দেখলেই তো কেমন পরিস্থিতি ছিল, যেতেই হতো ওদের। এটা নিয়ে মন খারাপ করলে চলবে? আবার আসবে তো বোকা!”

বাহুতে আলতো করে মাথা এলিয়ে দিলো সিতারা। নির্ঝর মুচকি হেসে ওকে বুকে টেনে নিলো। ছেলেটার বুকে মুখ গুঁজেই ও নাক টানল। সামান্য সময় নিয়ে নিজের কান্না আটকে বলল, “কাল থেকে সেই তো আপনি আমাকে একা ফেলে অফিসে যাবেন।”

“অফিসে না গেলে বউকে খাওয়াব কি?”

“খাওয়াতে হবে না, শুধু আমার কাছে থাকলেই চলবে।”

সিতারার বাচ্চামো কথায় হেসে উঠল নির্ঝর। বলল, “আচ্ছা বেশ! এবার উঠো, ফ্রেশ হয়ে শাড়ি টাড়ি পাল্টে নেও।”

“না।”

“না মানে? উঠবে না?”

“উঁহু! এভাবেই ভালো লাগছে।”

“কিন্তু, আমারও তো ফ্রেশ হতে হবে।”

“না, লাগবে না ফ্রেশ হওয়া। এভাবেই থাকুন।”

সুপ্ত নিশ্বাস ছাড়ল নির্ঝর। আস্তে বলে বলল, “দিনকে দিন তোমার জিদ’টা একটু বেশিই হয়ে যাচ্ছে, সিতারা।”

“আর আপনার লাভ হচ্ছে।”

.
এর পরের দিনগুলো খুব দ্রুতই চলে যেতে থাকল। কেটে গেল আরও কয়েকটা দিন। অফিসে অবসর পেলেই নির্ঝর সিতারাকে কল করে। বাসায় একা থাকা মেয়েটার সময় কাটাতে অনেকটা সময় নিয়ে ফোনালাপ চালিয়ে যায়। আজকে অফিসে কাজের চাপ একটু বেশিই ছিল ওর। তাই সকাল থেকে একবারও কল দিতে পারে নি। লাঞ্চ করার সময়ে গিয়ে সময় হতেই মোবাইল বের করতে চাইল সিতারাকে কল দিতে। এর আগেই বেজে উঠল ওর মোবাইল। সিতারার নাম্বার দেখে মুচকি হেসে কল রিসিভ করল নির্ঝর। ‘হ্যালো!’ বলতেই ভেসে এলো সিতারার কণ্ঠস্বর, “অফিসে কাজ শেষ হয়েছে আপনার?”

নির্ঝর বুঝল, সারাদিনে মেয়েটাকে কল দেয় নি বলে রাগ করেছে। বলল, “সারাদিন কল দেই নি বলে রাগ করেছ?”

“উঁহু! আপনি বাসায় আসবেন কখন?”

“বিকাল হবে তো।”

“শুনুন না, আজকে একটু তাড়াতাড়ি আসতে পারবেন!”

“কেন, কি হয়েছে?”

“তেমন কিছু না। আপনি আজকে তাড়াতাড়ি বাসায় আসুন।”

“সিতারা, কিছু হয়েছে তোমার? একা ভয় করছে? বলো আমাকে।”

“আপনি তাড়াতাড়ি আসুন, তাহলেই বুঝতে পারবেন। রাখছি আমি।”

বলেই কল কাটল সিতারা। এদিকে উদ্বিগ্ন হয়ে উঠল নির্ঝর। ছেলেটার মনে একটা কথায় উঁকি দিতে থাকল—সিতারার কিছু হলো না তো। মানসপটে ভেসে উঠল লিফটে আটকে যাবার পর সিতারার সেই নাজেহাল অবস্থা। চট করে উঠে দাঁড়াল নির্ঝর। এক্ষুনি বেরুতে হবে। পরে মেয়েটার কিছু হলে নিজেকে কিছুতেই ক্ষমা করতে পারবে না।

.
দ্রুত পায়ে লিফট থেকে বেড়িয়ে নিজের ফ্ল্যাটের সামনে এসে দাঁড়াল নির্ঝর। দরজা খোলার জন্য চাবি নিতে পকেটে হাত রাখতেই কিঞ্চিৎ অবাক হলো। চাবি নেই। মনে পড়ল, আজ সকালে তাড়াহুড়ায় ফ্ল্যাটের চাবি নিতেই ভুলে গেছে। এখন? কলিং বেল দিলে কি দরজা খুলবে সিতারা? নাকি ভেতরে কোন খারাপ কিছু হয়েছে মেয়েটার? নানান বাজে চিন্তা মাথায় ঘুরপাক খাচ্ছে নির্ঝরের। চাইছে না ও ভাবতে, তবুও। চিন্তায় মাথা ধরে এসেছে মুহুর্তেই। পর পর দু’বার বেল বাজিয়ে এক হাতে মাথা চেপে দাঁড়িয়ে রইল ছেলেটা। দরজা খুলল না। ফের উদ্বিগ্ন হলো নির্ঝর। আবারও পর পর কয়েকবার বেল বাজাল। সহসায় দরজা না খুলতে অস্থির হতে সময় নিলো না ও। আরও একবার কলিং বেল বাজানোর জন্য হাত দিতেই এবার খট করে দরজা খুলে গেল। সামনে দাঁড়িয়ে আছে সিতারা। ওকে দেখেই মুচকি হাসল। কিন্তু নির্ঝর… নির্ঝর হাসতে পারল না। সিতারাকে ঠিকঠাক সামনে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখলেও ওর অস্থির ভাবটা কমে নি। এগিয়ে এসে চট করেই সিতারার বাহু চেপে ধরল। অপর হাতটা ওর গালে রেখে অস্থির কণ্ঠে বলে উঠল, “সিতারা! এ্যাই মেয়ে, ঠিক আছো তো তুমি? কিছু হয় নি তো তোমার?”

“কি হয়েছে আপনার? আপনি ঠিক আছেন তো?”

অস্থির নির্ঝরকে দেখে ফিরতি প্রশ্ন সিতারার। ছেলেটা কিঞ্চিৎ ধমকে বলল, “তোমাকে জিজ্ঞেস করেছি আমি। ঠিক আছো তো?”

“আমার আবার কি হবে, ঠিক আছি তো। কিন্তু, আপনি এমন করছেন কেন?”

আটকে রাখা শ্বাসটা যেন এতক্ষণে ছেড়ে দিলো নির্ঝর। হঠাৎই মেয়েটাকে নিয়ে বাজে ভাবনায় যেমন অস্থির হয়ে উঠেছিল, তেমনি মেয়েটার মুখে—ঠিক আছি! শুনে শান্ত হয়ে গেল ছেলেটা। নিজেকে সামাল দিয়ে সিতারাকে টেনে বুকে চেপে ধরল। আস্তে করে বলল, “এভাবে হঠাৎ কল দিয়ে আসতে বললে কেন! জানে, আমি কতটা ভয় পেয়ে গিয়েছিলাম?”

“শুনুন, আপনি…”

নির্ঝরকে ছাড়ানোর চেষ্টা সিতারার। ছেলেটা ছাড়ে না, বরং হাতের বাঁধন দৃঢ় হয়। বলে, “তোমার কিছু হয়ে গেলে আমার কি হতো, সিতারা?”

“শুনুন তো আমার কথা! ছাড়ুন না…”

“আমি.. আমি যে নিজেকে কিছুতেই ক্ষমা করতে পারতাম না। তুমি আর কখনোই এমন করবে না। নয়ত আমার থেকে খারাপ আর কেউ হবে না।”

“আপনি ছাড়ুন তো…”

হঠাৎ পুরুষালী গলা খাঁকারিতে সিতারা থেমে গিয়ে সর্বোচ্চ শক্তিতে নির্ঝরকে ঠেলে সরিয়ে দিলো। কাঁপা কাঁপা হাতে মাথায় কাপড় দিতে ব্যস্ত হয়ে উঠল। নির্ঝরও হতভম্ব। অবাকের ন্যায় একবার সিতারার দিকে তাকিয়ে, গলা খাঁকারি দেওয়া মানুষটার দিকে তাকাল। ডাইনিং রুমে দাঁড়িয়ে আছেন ওর বাবা, এহসান তালুকদার। বাবাকে দেখে আরেক দফা অবাক হলো নির্ঝর। অবাকের ন্যায় সুধাল, “বাবা, তুমি?”
.
.
চলবে…