#তারে_আমি_চোখে_দেখিনি
#পর্বঃ১৫
#লেখিকা_সাম্মী_ইয়াসমিন
[ অনুমতি ছাড়া কপি করা সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ ]
ছাঁদে আড্ডার আসর বসিয়েছে তিন ভাই মিলে। আঁধার রাতে খোলা আকাশের নিচে চেয়ার পেতে বসেছে তারা। মাথার ওপর দাড়িয়ে থাকা চাঁদটা তীর্যক ভাবে কিরণ দিচ্ছে। ভরা পূর্ণিমার আলোয় ঝলমল করছে চারিদিক। সামনের টি টেবিল থেকে কফির কাপটা হাতে নিয়ে তাতে ছোট্ট একটা চুমুক দেয় অর্পন। চুমুক দিতেই আবেশে চোখ বন্ধ করে ফেলে। সারাদিনের ধকল কাটিয়ে গরম গরম ধোঁয়া ওঠা কফি যেনো ওষুধের মতো কাজ করছে অর্পনের শরীরে। চোখ দুটো বন্ধ করে তৃপ্তির জানান দেয় অর্পন । সেদিকে তাকিয়ে চোখ মুখ কুঁচকে ফেলে অঙ্কন। তার জীবনে ভাইয়ের মতো কফি খোর সে আর দুটো দেখেনি। কি পায় এই তিক্ত স্বাদ যুক্ত কফিতে? অঙ্কনের মতে এর চেয়ে নিমের পাতার রস খাওয়া ঢের ভালো। কথাগুলো ভাবতে ভাবতেই নিজের হাতে রাখা জুসের গ্লাস থেকে কিছুটা জুস পেটের মধ্যে চালান করে দেয়। ফের বিরক্তি নিয়ে তাকায় অর্পনের দিকে।
দুই ভাইয়ের গতিবিধি আড়চোখে পর্যবেক্ষন করে গলা খাঁকারি দেয় সাগর। দুই ভাইয়ের মনোযোগ নিজের দিকে আসতেই অর্পনকে উদ্দেশ্য করে গম্ভীর কন্ঠে জিজ্ঞেস করে,
—“বোবার অভিনয় শেষ হলে এবার মুখ খোল। কি অঘটন ঘটিয়ে এসেছিস?”
ভাইয়ের কথায় বিরক্তিতে মুখ দিয়ে “চ” এর মতো শব্দ করে অর্পন। কিছুটা বিরক্তি নিয়ে বলে,
—“নিজের ভাইয়ের প্রতি কি তোমার একটুও ভরসা নেই? তোমার ভাই কি আর পাঁচটা বখাটে ছেলেদের মতো যে যেখানে সেখানে অঘটন ঘটাবে?”
বাম পায়ের ওপর ডান পা তুলে আরাম করে বসে সাগর। কিছুটা স্বস্তির কন্ঠে বলে,
—“যাক, তাও ভালো। বিয়ে তো করিস নি। এটাই অনেক।”
অদ্ভুত চোখে তাকায় অর্পন সাগরের দিকে। অঙ্কন জুসের গ্লাসে মাত্রই চুমুক দিয়েছিলো। হঠাৎ বড় ভাইয়ের এমন বেফাঁস কথা শুনতেই জুস নাকে মুখে উঠে যায়। বিষম খেয়ে অনবরত কাশতে থাকে। অর্পনও বোকার মতো তাকিয়ে আছে। নিজেকে সামলে অঙ্কনের পিঠে হালকা চাপড় দিতে দিতে সাগরকে উদ্দেশ্য করে বলে,
—“পাগল হয়ে গেছো ভাই?”
—“এখনো হইনি, তবে হয়ে যেতাম। মেয়েটাকে যে অবস্থায় নিয়ে এসেছিস, আমি তো ভাবলাম বিয়ে করে ফেলেছিস। আর বাল্যবিবাহ করার অপরাধে গ্রামবাসী তোদের পিটিয়ে শায়েস্তা করেছে।”
কথাগুলো বলেই উচ্চ শব্দে হাসতে থাকে সাগর। সাগরের হাসি দেখে কিছুটা অবাক হয় অর্পন। পরক্ষণেই মুগ্ধ চোখে তাকিয়ে থাকে কিছুক্ষণ। অবাকের চুড়ান্তে পৌঁছে গেছে অঙ্কনও। নিজের কাশি ভুলে সাগরের প্রাণখোলা হাসি দেখতে ব্যাস্ত হয়ে পড়ে। আজ অনেক বছর পর সাগরকে মন খুলে হাসতে দেখছে। সাগর শেষ বার কবে মন খুলে হেসেছে সেটা মনেই পড়ছে না অঙ্কনের। ভালোবাসায় ধোঁকা পাওয়ার পর থেকে সাগরের জীবনের সব হাসি, সব আনন্দ বিষাদে রুপ নিয়েছে। বদলে গেছে পুরো মানুষটাই।
আজ অনেকদিন পর পুরনো ভাইয়ের একটা ঝলক দেখে বড্ড অবাক হয়েছে অঙ্কন আর অর্পন। বিষ্ময় সামলাতে না পেরে অর্পন বলেই ফলে,
—“অনেক বছর পর তোমাকে মন খুলে হাসতে দেখছি ভাই। হঠাৎ এই পরিবর্তন কিভাবে?”
হাসি থেমে যায় সাগরের। তবে চোখে মুখে কোনো বিষাদের ছায়া এখনো ছড়িয়ে পড়েনি। আজ যেনো বেশ ভালো মেজাজে আছে সাগর। চেয়ারের সাথে গা এলিয়ে দিয়ে নিকষ কালো আকাশের দিকে তাকিয়ে বলে,
—“আজ হঠাৎই নতুন করে বাঁচতে ইচ্ছে করছে অর্পন। মনে হচ্ছে বাঁচার জন্য নতুন করে কারণ খুঁজে পেয়েছি। ব্যার্থ জীবনকে সার্থক করার একটা ছোট্ট প্রয়াশ চালাতে ইচ্ছে করছে। মনে হচ্ছে জীবনটা আবার সাজাই। নতুন রুপে, নতুন ভাবে।”
বড় ভাইয়ের সকল কথা চুপচাপ শুনছিলো অঙ্কন। সাগরের কথা শেষ হতেই অঙ্কন উচ্ছ্বসিত কন্ঠে বলে,
—“তোমার কি কাউকে পছন্দ হয়েছে ভাইয়া? তুমি নতুন কাউকে নিয়ে মুভ অন করতে চাইছো?”
উদাসীন ভঙ্গিতে বসে দৃষ্টি আকাশে নিবদ্ধ রেখেই সাগর বলে,
—“সমস্যা তো এখানেই অঙ্কন। ইচ্ছে তো করছে নতুন করে বাঁচতে। তবে সেটা নতুন কারো সাথে নয়, পুরনো তাকে নিয়েই।”
—“কিন্তু তার তো বিয়ে হয়ে গেছে।”
—“বেহায়া মন যে মানছে না।”
এই পর্যায়ে চুপ হয়ে যায় অঙ্কন। সাগরকে কেমন যেনো ছন্নছাড়া এলোমেলো লাগছে তার কাছে। প্রচন্ড ঘৃণার দেয়াল ভেঙে কাঙ্ক্ষিত জিনিস ফিরে পাওয়ার বাসনা সাগরের চোখে স্পষ্ট ফুটে উঠেছে। এখন কথা না বাড়ানোই শ্রেয়। পরে তার বাসনা যদি ভয়ানক জেদের রুপ নেয়, তাহলে ভেঙে যাবে একটি সুন্দর সংসার। সেটা কারো জন্যই শুভ হবে না।
নিশ্চুপ হয়ে যায় পরিবেশ। কারো মুখে কোনো কথা নেই। অর্পনও চুপ হয়ে গেছে। সারাদিনের ধকল, শরীরে পাওয়া আঘাত, ব্যথার ওষুধ সব মিলিয়ে শরীরটা নিস্তেজ হয়ে আসছে অর্পনের। শরীর বলছে একটু বিশ্রামের প্রয়োজন। চোখ বলছে একটু ঘুমের প্রয়োজন। কিন্তু মুখ ফুটে সেটা বলতে ইচ্ছা করছে না অর্পনের। এতো বছর পর সাগর আগের রুপে ধরা দিয়েছে। নিজের মনের কথা, ইচ্ছা ভাইদের সামনে পেশ করছে। ভাইয়ের খুশির জন্য না হয় শরীরের ওপর আর একটু জোর খাটানো যাক।
দৃষ্টি আকাশের দিকে নিবদ্ধ রেখেই সাগর অর্পনকে উদ্দেশ্য করে বলে,
—“প্রাপ্তিকে নিয়ে তোর অনুভূতি কি অর্পন?”
চকিত ভঙ্গিতে মাথা তুলে তাকায় অর্পন। দৃষ্টি নিবদ্ধ করে সাগরের মুখদ্বয়ে। কাজের চাপে প্রাপ্তির কথা প্রায় ভুলতেই বসেছিলেনো। হঠাৎ প্রাপ্তির নাম কর্ণকুহর হতেই ঠোটের কোণে সূক্ষ্ম হাসি ফুটে ওঠে অর্পনের। মুচকি হেসে জবাব দেয়,
—“অনুভূতির সঠিক ব্যখ্যা আমি জানি না। তবে প্রাপ্তি আমার সবটা জুড়ে।”
আকাশ থেকে দৃষ্টি সরিয়ে সম্মুখে দৃষ্টি নিক্ষেপ করে সাগর।
কিছুটা ঝুকে এসে সতর্ক কন্ঠে জিজ্ঞেস করে,
—“ভালোবাসিস?”
—“হয়তো হ্যা।”
অর্পনের সহজ স্বীকারোক্তি শুনে ফের চুপ হয়ে যায় সবাই। নিরবতায় কাটে কিছু সময়। নিরবতা ভেঙে আগ্রহী কন্ঠে অঙ্কন জিজ্ঞেস করে,
—“আচ্ছা ভাইয়া, এক বাক্যে মেয়েটাকে কি বলে সম্বোধন করবে?”
—“সুন্দরী। সে আমার নজরে বিশ্বের শ্রেষ্ঠ সুন্দরী নারী।”
ভ্রু কুঁচকে তাকায় সাগর। দুই হাত একসাথে মুঠো করে ধরে সামনের দিকে ঝুকে বসে। বোঝার ভঙ্গিতে বলে,
—“হুম, এর মানে তুই তার চেহারায় আটকে গেছিস।”
—“ঠিক তা না, আবার হতেও পারে। তবে আমি আটকে গেছি তার চোখে। তার চোখ আমাকে থমকে দিয়েছে।
হেসে ফেলে সাগর। রসিকতা করে বলে,
—“হ্যা, সেই চোখ, যে চোখে দৃষ্টি নেই।”
সাগরের কথা শেষ হতেই একপলক তার দিকে তাকায় অর্পন। তারপর চেয়ারে শরীর এলিয়ে দিয়ে আয়েশ করে বসে। বিমোহিত কন্ঠে বলে,
—“মানলাম দৃষ্টি নেই, তবে আছে এক রাশ মায়া। তার দৃষ্টিহীন ওই চোখে পেয়েছি এক আকাশ সমান মুগ্ধতা। পেয়েছি আমার মানসিক শান্তি।”
সোজা হয়ে বসে সাগর। দুই হাত বুকে আড়াআড়ি ভাবে ভাজ করে বসে বলে,
—“বুঝেছি, ভাই আমার প্রেমে উন্মাদ হয়ে গেছে। তবে এই প্রেম স্বার্থকতা পাবে তো? যদি হারিয়ে ফেলিস?”
ছ্যাত করে ওঠে অর্পনের বুকের ভেতর। হৃদপিণ্ডের ধুকপুকানি কয়েকশো গুণ বেরে গেছে। হারানোর কথা তো অর্পন কখনো ভাবেনি। ভাবতেই পারে না। কেনো হারাবে সে? প্রাপ্তি যে তার। একান্তই নিজের। তাহলে হারানোর প্রশ্ন আসছে কেনো? একটা শুকনো ঢোক গিলে নিজেকে সামলে নেয় অর্পন। চোখ মুখ কঠিন করে জবাব দেয়,
—“তোমার মতো বোকামি আমি করবো না ভাই। যদি এমন পরিস্থিতি কখনো আসে, তাহলে তুলে নিয়ে আসবো তাকে। পায়ে শেকল পড়িয়ে নিজের কাছে বেঁধে রাখবো। তবুও হারাতে দেবো না।”
মুচকি হাসে সাগর। অঙ্কনের দিকে একপলক তাকিয়ে অর্পনকে উদ্দেশ্য করে বলে,
—“বিয়ের কথা চলছে তার বাড়িতে। আজ পাত্র পক্ষ দেখতে এসেছিলো তাকে। কথা কতদূর এগিয়েছে জানি না। তবে খবরটা তোর গুপ্তচর সুজন দিয়েছে আমাকে। তোকে ফোনে পায়নি তাই হসপিটালে এসে আমাকে জানিয়ে গেছে।”
চমকে ওঠে অর্পন। প্রাপ্তির বিয়ের কথা চলছে তার বাসায় কথাটা কর্ণকুহর পৌঁছাতেই বুকের ভেতর মোচড় দিয়ে ওঠে অর্পনের। হারানোর ভয় জেকে বসেছে মনে। দায়িত্ব পালন করতে গিয়ে কি ভালোবাসা হারাতে বসেছে? কথাগুলো ভাবতেই লাফিয়ে উঠে দাঁড়ায় অর্পন। শরীরের ব্যথার পরোয়া না করে কোথাও যাওয়ার জন্য পা বাড়ায়।
বিচলিত হয়ে উঠে দাঁড়ায় অঙ্কন। বুঝতে পারছে না, তার ভাই এতো রাতে কোথায় যাচ্ছে? সাগর ব্যপারটা বুঝতে পেরে অর্পনের হাত ধরে থামায়। বোঝানোর ভঙ্গিতে বলে,
—“এটা কোনো সময় হলো কারো বাসায় যাওয়ার? পাগলামি করিস না অর্পন। অনেক রাত হয়েছে। কাল সকালে গিয়ে দেখা করিস। তাছাড়া পাত্র পক্ষ শুধু দেখতে এসেছিলো, বিয়ে করে নিয়ে যায়নি। হাতে সময় আছে তোর।”
মন না মানলেও বড় ভাইয়ের আদেশ শুনে দমে যায় অর্পন। ইচ্ছার বিরুদ্ধে গিয়ে নিজেকে আটকায়। রাত টুকু কাটুক, কালকে সব সামলে নেবে।
অর্পনকে থামতে দেখে স্বস্তির নিঃশ্বাস ছাড়ে সাগর। হাত ধরে টেনে নিজের পাশে বসিয়ে বলে,
—“এবার বকুল নামের মেয়েটার বিষয়ে বিস্তারিত বল। কিভাবে হলো তোদের এই অবস্থা?”
চেহারা যথা সম্ভব গম্ভীর করে দুই ভাইকে সবটা বিস্তারিত বলতে থাকে অর্পন। তার এই দুই ভাই তার সবচেয়ে কাছের। ওদের সবকিছু জানিয়ে রাখা জরুরি।
_________________
মাঝ রাতে হঠাৎ করেই ঘুম ভেঙে যায় দীপ্তির। ঘুম ঘুম চোখে দেয়াল ঘরির দিকে তাকিয়ে দেখে রাত আড়াইটা বাজে। পাশে ফিরতেই চোখের ঘুম উড়ে যায় তার। পাশে সজীব নেই। এতো রাতে কোথায় গেলো? বিছানা থেকে উঠে বাথরুম চেক করে দেখে সেখানে নেই। ভ্রু কুঁচকে বেলকনির দিকে এগিয়ে যায়। সেখানেও সজীব নেই। সজীবের খোঁজ করতে ঘর থেকে বের হয় দীপ্তি। কিছুদূর গিয়ে কদম থেমে যায় তার। কারো চাপা কন্ঠের আওয়াজ হালকা শোনা যাচ্ছে। মনে হচ্ছে কেউ চাপা স্বরে কান্না করছে আর কথা বলছে।
কৌতুহল দমাতে না পেরে সেই শব্দ অনুসরণ করে এগিয়ে যায় দীপ্তি। বারান্দার শেষ প্রান্তে এসে পা জোড়া থমকে যায় তার। আশ্চর্য হয়ে তাকিয়ে থাকে বারান্দার শেষ প্রান্তের ঘরের দড়জার দিকে। বিয়ে হয়ে আসার পর থেকে পুরো বাড়ি জুড়ে দীপ্তি চলাফেরা করলেও এই রুমে আসা নিষিদ্ধ। এটা নাকি তার শ্বাশুড়ি মায়ের বিশেষ ঘর। এই ঘরে শুধু দীপ্তি কেনো, কারোরই যাওয়ার অনুমতি নেই। বিয়ের নয় বছর ধরে এই ঘরের দড়জায় সবসময় তালা ঝুলতে দেখেছে দীপ্তি। তাহলে আজ দড়জায় তালা নেই কেনো? কেউ কি ভেতরে আছে? দীপ্তির কি একবার দেখা উচিত?
ভাবনার মাঝেই দীপ্তির কানে আসে চাপা কান্নার সেই আওয়াজ। এবার দীপ্তি স্পষ্ট শুনতে পায় আওয়াজটা। যেটা এই নিষিদ্ধ ঘরের ভেতর থেকেই আসছে। দীপ্তির কৌতুহল আরো বেরে যায়। গভীর রহস্য সমাধানের জন্য মনটা আনচান করে ওঠে। কথায় আছে নিষিদ্ধ জিনিসের প্রতি মানুষের আকর্ষন বেশি। দীপ্তিও তার ব্যাতিক্রম নয়। যবে থেকে এই ঘরে প্রবেশ সকলের জন্য নিষিদ্ধ করা হয়েছে তবে থেকেই দীপ্তির কৌতুহল অনেক বেরে গেছে।
মন আনচান করে জানার আগ্রহে। কি আছে এই ঘরে? কি এমন মূল্যবান সম্পদ লুকিয়ে রেখেছে যে সেখানে কেউ প্রবেশ করতে পারবে না? আজ যখন ঘরের দরজা খোলা পেয়েছে তখন ভেতর গিয়ে দেখেই ছাড়বে দীপ্তি। এ যেনো দীপ্তির জেদে পরিণত হয়েছে।
মনে মনে সিদ্ধান্ত নিয়ে চারিদিকে একবার নজর বুলিয়ে নেয় দীপ্তি। একটু ভয় ভয় লাগছে ঠিকই। কারণ এই ঘরটা বহু বছর ধরে বন্ধ পড়ে আছে। কারো যাতায়াত নেই এই রহস্যময় ঘরে। আজ হঠাৎ কে প্রবেশ করলো এই নিষিদ্ধ জায়গায়? তার ওপর ভেতর থেকে ভেসে আসছে কারো চাপা কন্ঠে কান্নার আওয়াজ। মধ্যে রাতে নিশ্চুপ পরিবেশে শুধু কান্নার আওয়াজটা ব্যাতিত আর কোনো শব্দ নেই। এ যেনো গা হিম করা পরিবেশ।
বুকের ওপর একটা হাত রেখে ধীর পায়ে এগিয়ে যায় দীপ্তি। দড়জার কাছাকাছি আসতেই গায়ে কাটা দিয়ে ওঠে তার। সম্পুর্ন ভুতুড়ে একটা পরিবেশ তৈরি হয়েছে চারিদিকে। মনের ভয়কে দূরে ঠেলে কাঁপা কাঁপা হাতটা দড়জায় রাখে দীপ্তি। দড়জায় হাত রাখতেই আশ্চর্য ভাবে ভেতর থেকে আসা কান্না আওয়াজ থেমে যায়। নিশ্চুপ হয়ে যায় ভেতরের পরিবেশ। কারো নিশ্বাসের শব্দও আসছে না ভেতর থেকে।
ভয় আরো জেঁকে বসে দীপ্তির মনে। তবে কি ভেতরের ব্যাক্তি তার উপস্থিতি টের পেয়ে গেছে? কিন্তু কিভাবে? দীপ্তি তো কোনো আওয়াজ করেনি। শুকনো একটা ঢোক গিলে দড়জা সজোরে ধাক্কা দেয় দীপ্তি। সাথে সাথে ক্যাচ ক্যাচ আওয়াজ তুলে দড়জার অর্ধেক খুলে যায়। ভেতরে দীপ্তি নজর বুলাবে তার আগেই কেউ টান মেরে দিপ্তিকে কয়েক কদম পিছিয়ে নিয়ে আসে।
পেছনে তাকাতেই দেখতে পায় সজীব তাকে সরিয়ে নিয়ে এসেছে। সজীব এক হাতে দীপ্তির বাহু ধরে অন্য হাতে দড়জা টান মেরে আটকে দেয়। তবে বাহির থেকে লক করে না। সজীবের এহেন কাজে আশ্চর্য হয়ে যায় দীপ্তি। মুখ খুলে কিছু বলতে যাবে তখন সজীব রক্ত লাল চোখে দীপ্তির দিকে তাকায়। সজীবের এমন নজর দেখে ভয়ে কেঁপে ওঠে দীপ্তি। বিয়ের পর থেকে সজীবকে ভীষণ সহজ সরল, শান্ত স্বভাবেই থাকতে দেখেছে। আজ হঠাৎ সজীবের এমন হিংস্র রুপ দেখে ভয়ে জমে যায় দীপ্তি।
আর এক মুহুর্ত এখানে না দাড়িয়ে দীপ্তিকে টানতে টানতে নিজের রুমে নিয়ে যায় সজীব। দীপ্তিও ভয়ে আর একটা টু শব্দও করে না। কৌতুহলের বশে না জানি আজ কি অন্যায় করে ফেললো। সজীবের এমন হিংস্র চেহারা দেখে ভয়ে বুক কাঁপছে দীপ্তির। এই চেহারা তো সজীব আগে কখনো দেখায়নি। তবে আজ কেনো? না বুঝে কোনো বড় অন্যায় করে ফেলেনি তো দীপ্তি? এর পরিণতি কি খুব খারাপ হবে?
চলবে?
#তারে_আমি_চোখে_দেখিনি
#পর্বঃ১৬
#লেখিকা_সাম্মী_ইয়াসমিন
সকাল সকাল প্রাপ্তিকে না পেয়ে পাগল প্রায় বাসার মানুষ। দিলারা বেগম সকালে ডাকতে এসে দেখেন সুপ্তি বেঘোরে ঘুমাচ্ছে কিন্তু প্রাপ্তি নেই। ব্যাস্ত পায়ে পুরো রুমে খুঁজে যখন প্রাপ্তিকে পান না তখন চেচিয়ে বাড়ি মাথায় তুলে নেন। পুরো বাড়ির কোথাও যখন প্রাপ্তির অস্তিত্ব পাওয়া যায় না তখন ভয় জেকে বসে দিলারা বেগমের মনে। ভয় ভয় কন্ঠে মারুফ সাহেবকে বলেন,
—“হ্যা গো, মেয়ে আমার বিয়ের বিষয়টা নিয়ে মন খারাপ করে কোথাও চলে গেলো না তো? কত অপমানিত হয়েছে আমার মেয়েটা।”
স্ত্রীর কথা শুনে চিন্তিত হয়ে পড়েন মারুফ সাহেব। প্রাপ্তি যে বিয়ের বিষয়টা নিয়ে নিজের বাবার ওপর নারাজ সেটা মারুফ সাহেব বেশ বুঝতে পারছেন। তাই তার চিন্তা বেশি হচ্ছে। বাড়ির পরিস্থিতি সামাল দিতে কামরুল রহমান অভয় দিয়ে বলেন,
—“এসব কি বোকার মতো কথা বলছো বৌ মা। দুই দিন পরে এসে বাড়ি ছাড়বে কেনো দিদিভাই? তেমন হলে সেদিনই সে যেতো। এমন কিছুই নয়। তুমি বেশি চিন্তা করছো।”
এরই মাঝে সুপ্তি ফোন আর পার্সটা হাতে নিয়ে বের হয়। তাড়াহুড়ো পায়ে নিচে এসে বলে,
—“আমি দেখছি আপি কোথায় গেছে। চেনা জানা কোথাও গিয়ে বসে আছে হয়তো। তোমরা চিন্তা করো না আমি নিয়ে আসছি তাকে।”
এটুকু বলেই দৌড়ে বাসা থেকে বেরিয়ে যায় সুপ্তি। না জানি কোথায় গিয়ে বসে আছে তার বোন। সুপ্তি সময় মতো পৌঁছাতে পারবে তো?
_________________
খাবার টেবিলে নাস্তা করতে বসেছে সাগর, অর্পন আর অঙ্কন। তাদের খাবার পরিবেশন করছেন শাহিনা বেগম। একমাত্র ছেলে সাগরের সাথে তিনি এই বাসায় একাই থাকেন। বিয়ের পাঁচ বছরের মাথায় স্বামীকে হারিয়ে যখন তিনি দিশেহারা হয়ে পড়েন তখন তার দূর্বলতার সুযোগ নিয়ে তাকে বাড়ি ছাড়া করে তার জায়েরা। ছোট্ট সাগরকে বুকে নিয়ে ফিরে আসেন তার ভাই সুভাষ সাহেবের কাছে। একমাত্র বোনের এমন করুন দশা দেখে ভেঙে পড়েন সুভাষ সাহেব। দুবছর বোন আর ভাগিনাকে নিজের কাছে রাখেন। তারপর ছোট্ট সাগরের ভবিষ্যতের কথা চিন্তা করে সাগরের নামে এই বাড়িটা লিখে দেন। তারপর থেকে শাহিনা বেগম সাগরকে নিয়ে এই বাসাতেই থাকেন। যদিও সুভাষ সাহেব তাকে আসতে দিতে চান নি। সারাজীবন বোনকে তিনি নিজের কাছেই রাখতে প্রস্তুত ছিলেন কিন্তু শাহিনা বেগম থাকেন নি। এভাবে ভাইয়ের বাড়ি সারাজীবন থাকলে লোকের অনেক কটু কথা শুনতে হবে। যার প্রভাব তার ছোট্ট ছেলেটার ওপর পড়বে। তাই তিনি ছেলেকে নিয়ে একা এই বাড়িতে থাকেন। তবে আলাদা থাকলেও ওদের তিনজনকে সমান ভালোবাসে সবাই। সুভাষ সাহেব তার দুই ছেলেকে যতটা ভালোবাসা দিয়ে বড় করেছেন, সাগরকেও সমান সমান ভালোবাসা দিয়েছেন। শাহিনা বেগমও ওদের তিনজনকে নিজের সন্তানের মতো ভালোবাসেন।
সবার প্লেটে খাবার তুলে দিয়ে শাহিনা বেগম অর্পনের কাছে আসেন। ধীরে সুস্থে অর্পনের মাথায় স্নেহের হাত বুলিয়ে দিয়ে বলেন,
—“এতো আঘাত কিভাবে লাগলো বাপ? কোথায় গেছিলি?”
তারপর কিছু একটা ভাবতেই তাকান সাগরের দিকে। প্রশ্নবোধক চাহনি দিয়ে সাগরকে জিজ্ঞেস করেন,
—“চিন্তার কোনো কারণ নেই তো বাবু? ওর আঘাত কি বেশি গুরুতর?”
মায়ের চিন্তিত মুখ দেখে বিচলিত হয়ে পড়ে সাগর। চিন্তা করলে তার মায়ের ব্লাড প্রেশার বেড়ে অসুস্থ্য হয়ে পড়েন। মাকে চিন্তা মুক্ত করতে সাগর অভয় দিয়ে বলে,
—“চিন্তা করো না মা। তেমন গুরুতর কিছু না। কয়েকদিনের মধ্যে সব ঠিক হয়ে যাবে।”
এই পর্যায়ে স্বস্তির নিঃশ্বাস ছাড়েন শাহিনা বেগম। এই তিন ছেলেই তার অতি আদরের। ওদের কারো কিছু হলে নিজেকে ঠিক রাখতে পারেন না শাহিনা বেগম। আর কোনো কথা না বাড়িয়ে সবাই খাওয়ায় মনোযোগ দেয়। খেয়ে যার যার নিজ গন্তব্যে চলে যাবে সবাই। একেবারে তৈরি হয়েই খেতে এসেছে তিনজন।
অর্পন মাত্রই দুই লোকমা খাবার খেয়েছে এমন সময় বিকট শব্দে তার ফোন বেজে ওঠে। খাওয়া রেখে বাম হাত দিয়ে প্যান্টের পকেট থেকে ফোনটা বের করে অর্পন। তাকিয়ে দেখে সুজন ফোন দিয়েছে। নামটা চোখের সামনে আসতেই এক মুহুর্ত অপেক্ষা করে না অর্পন। তড়িৎ গতিতে ফোন রিসিভ করে। ফোনটা কানে ধরতেই সুজন হাঁপাতে হাঁপাতে বলে,
—“গোলমাল হয়ে গেছে স্যার। গতকাল ম্যডামকে বিয়ের জন্য দেখতে এসেছিলো পাত্রপক্ষ।”
—“জানি সেটা। চিন্তা করো না, আমি সামলে নেবো সব।”
তৎক্ষনাৎ অর্পনের শান্ত কন্ঠে জবাব শুনে ভ্রু কুঁচকে যায় সুজনের। মাথা চুলকে ভাবে অর্পন কিভাবে জানলো? সে তো অর্পনকে খবরটা জানায়নি। মাথা চুলকাতে চুলকাতে দ্বিধা মিশ্রিত কন্ঠে বলে,
—“কিন্তু স্যার প্রাপ্তি ম্যাডামকে যে সকাল থেকে খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না সেটা কিভাবে জানলেন? আমি তো বলিনি।”
প্রাপ্তিকে খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না কথাটা কর্ণকুহরে পৌঁছাতেই তড়িৎ গতিতে উঠে দাঁড়ায় অর্পন। কন্ঠে বিস্ময় নিয়ে বলে,
—“কিহ্! খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না মানে টা কি? কোথায় গেছে?”
—“জানি না স্যার। আমার আজ ঘুম থেকে উঠতে একটু দেরি হয়েছে। এই মাত্র এসে পৌঁছেছি। এসেই দেখছি তার বাসার সবাই পাগলের মতো ম্যাডামকে খুঁজে যাচ্ছে।”
সুজন কথা শেষ করতেই কপালে চিন্তার ভাজ পড়ে অর্পনের। কোথায় যেতে পারে প্রাপ্তি? কোনো বিপদ হলো নাতো? চুপচাপ চেয়ারে বসে পড়ে গভীর চিন্তায় ডুবে যায় অর্পন। ডাইনিং টেবিলে উপস্থিত সবাই কৌতুহল নিয়ে তাকিয়ে আছে। সবার চোখেই প্রশ্নের ছাপ দৃশ্যমান। অর্পনের উচ্চ কন্ঠ শুনে এটুকু বুঝতে পেরেছে যে কিছু একটা হয়েছে। কিন্তু কি? কিছু জিজ্ঞেস করতে শাহিনা বেগম যেই মুখ খুলবেন তখন হুট করেই অর্পন উঠে দাঁড়ায়। ফোনটা পকেটে পুরে কোনোমতে হাতটা ধুয়ে হন্তদন্ত ভঙ্গিতে পা ঘোরার। সবার উদ্দেশ্যে তাড়াহুড়ো কন্ঠে বলে,
—“আমি আসছি। একটা জরুরি কাজ আছে। অঙ্কন এখান থেকে সোজা বাড়ি যাবি। গিয়ে বাবা মাকে ছোট্ট করে আপডেট জানাবি। আর অবশ্যই আমার সাথে হওয়া সেই ঘটনা স্কিপ করে যাবি। বাবা মা শুনলে টেনশন করবে। সবটা সামলে নিস, সন্ধ্যায় দেখা হচ্ছে নুহাশ কাকুর বাসায়।”
ব্যাস্ত কন্ঠে এটুকু বলেই হনহনিয়ে বেরিয়ে যায় অর্পন। বাহিরে এসেই একটা রিক্সা নিয়ে গন্তব্যের উদ্দেশে রওনা হয়। অর্পনের বিশ্বাস, প্রাপ্তিকে সে ওখানেই পাবে।
————-
আধাঘন্টার মধ্যে গন্তব্যে পৌঁছে যায় অর্পন। ভাড়া মিটিয়ে হন্তদন্ত ভঙ্গিতে পা বাড়ায় নদীর পাড়ের দিকে। অর্পনের বিশ্বাস প্রাপ্তি সেখানেই আছে। তবুও বুকের ধুকপুকানি কমছে না। যদি প্রাপ্তি এখানে না থাকে, তাহলে কোথায় খুঁজবে ওকে? মনে হাজারও সংশয় নিয়ে দ্রুত পায়ে এগিয়ে যায় অর্পন। মিনিট দুইয়েক হাঁটার পর চলন্ত পায়ের গতি থামিয়ে দেয়। বুক ফুলিয়ে এক বুক শ্বাস টেনে আবার তা ছেড়ে দেয়। অর্পনের ধারণা অনুযায়ী প্রাপ্তি সেই নদীর পাড়ের বেঞ্চেই বসে আছে। নদীর দিকে তাকিয়ে হাতের গোলাপ ফুলটার থেকে একটা একটা করে পাপড়ি ছিঁড়ে ফেলে দিচ্ছে।
কয়েক সেকেন্ড চুপচাপ দাড়িয়ে থেকে ধীর গতিতে পা বাড়ায় অর্পন। নিঃশব্দে এগিয়ে গিয়ে প্রাপ্তির ডান পাশে একহাত দুরত্ব রেখে বসে। বায়ে সামান্য ঘুরে বসে পূর্ণ দৃষ্টিতে তাকায় প্রাপ্তির মুখের দিকে। যেনো মুখ দেখেই প্রাপ্তির মনে কি চলছে সেটা বোঝার চেষ্টা করে। প্রেয়সীর মনের অব্যাক্ত কথা পড়ে নিতে প্রাণপন চেষ্টা চালায় অর্পন। মুখে কোনো কথা বলে না।
প্রাপ্তির এতোক্ষণ ধরে চলতে থাকা হাত হঠাৎ করেই ক্ষনিকের জন্য থেমে যায়। চোখ বন্ধ করে নিশ্বাস টেনে আস্তে আস্তে ছেড়ে দেয়। কিছু বুঝতে পারার ভঙ্গিতে মৃদু হাসে প্রাপ্তি। ফের নিজের কাজে মনোযোগ দিয়ে ঠান্ডা গলায় বলে,
—“আপনি এখানে কেনো অফিস? আপনার তো এখানে আসার কথা নয়। আমাকে খুঁজতে খুঁজতে সুপ্তির এখানে আসার কথা। সুপ্তির জায়গায় আপনি কি করছেন?”
প্রাপ্তির কথা শুনে আশ্চর্য হয়ে যায় অর্পন। বিস্ময় তার চোখে মুখে সর্বত্র ছড়িয়ে পড়েছে। অর্পন ভেবে পাচ্ছে না যে প্রাপ্তি এটা বুঝলো কিভাবে ওর পাশে অর্পন বসে আছে? এতটা নিশ্চিতার সাথে অফিসার বলে সম্বোধন করলো কিভাবে? কন্ঠে বিস্ময় নিয়ে অর্পন জিজ্ঞেস করে,
—“এখানে যে আমিই আছি সেটা বুঝলে কিভাবে? অন্য কেউ তো হতে পারতো?”
অর্পনের কথা শুনে এবার শব্দ করে হেসে ফেলে প্রাপ্তি। হাসির চোটে শরীর থেকে থেকে কাঁপছে। সেই হাসির দিকে মুগ্ধ নয়নে তাকিয়ে থাকে অর্পন। প্রাপ্তিকে আগে কখনো এভাবে হাসতে দেখেনি। তাই হয়তো এই বিশেষ জিনিসটা এতোদিন নজরের আড়ালে ছিলো। কাছ থেকে প্রাণ খোলা হাসি দেখে আজ সেই বিশেষ জিনিসটা নজরে পড়লো। প্রাপ্তি হাসলে তার গালের দুই পাশে ছোট্ট দুটো টোল পড়ে। খুব বেশি গভীর গর্ত নয় তবে অল্পতেই মনোমুগ্ধকর।
অর্পন খেয়াল করে ওর বুকের ভেতর টিপটিপ করছে। খুবই সুক্ষ্ম ভাবে ছোট ছোট আঘাতে বিট করছে তার হৃদয়। প্রাপ্তির পরের কথা শুনে অর্পনের বুকের টিপটিপানি আরো হাজার গুণ বেড়ে যায়। এবার অর্পনের বুক টিপটিপ করে নয় বরং ধুকপুক ধুকপুক আওয়াজ করছে। প্রাপ্তি হাস্যরত কন্ঠে বলে,
—“আপনাকে আমি অনুভব করতে পারি অফিসার। আপনার পারফিউমের স্মেল আমার পরিচিত। তাই বুঝতে ভূল হয় না। আপনি আমার থেকে দশ হাত দূরে থাকলেও অনুভবে আপনার উপস্থিতির জানান পাই।”
ধীরে ধীরে ডান হাতটা তুলে বুকের বা পাশটা চেপে ধরে অর্পন। এই ধুকপুকানি থামানো দরকার। কিন্তু বেহায়া মন তো তার মতোই চলছে। অর্পনের বেহাল দশা দেখেও তার কথা শুনছে না। নিজেকে স্বাভাবিক করতে প্রাপ্তির থেকে চোখ সরিয়ে নেয় অর্পন। নদীর বুকে প্রবাহমান ছোট ছোট ঢেউয়ের দিকে তাকিয়ে একটা লম্বা নিঃশ্বাস ছাড়ে। দৃষ্টি সেদিকে রেখেই বলে,
—“শুনলাম পাত্র পক্ষ দেখতে এসেছিলো তোমাকে?”
ভ্রু কুঁচকে যায় প্রাপ্তির। অর্পনের এই প্রশ্নটা প্রাপ্তির কাছে বেশ খাপছাড়া লাগছে। সন্দিহান কন্ঠে প্রাপ্তি বলে,
—“আপনি জানলেন কীভাবে? জাসুস লাগিয়ে রেখেছেন আমার পেছনে?”
প্রাপ্তির কথায় অর্পনের কোনো ভাবান্তর দেখা যায় না। সে নিজের মতো গম্ভীর কন্ঠে বলতে থাকে,
—“শোনো প্রাপ্তি। আমার কথা মন দিয়ে শোনো। পাত্র পক্ষের সাথে তোমার পরিবারের কি কথা হয়েছে সেটা জানি না কিন্তু এতটুকু বলবো, বিয়ে নিয়ে এতো তাড়াহুড়ো করো না। একটা ভূল সিদ্ধান্ত সারাজীবনের জন্য আফসোসের কারণ হয়ে দাঁড়াবে। আর তাছাড়া কি দরকার বিদেশি ছেলেকে বিয়ে করার। দেশে কি ছেলের অভাব পড়েছে? আশেপাশে তাকিয়ে দেখো কত ভালো ছেলে আছে। আরে নিজের ভালো তো পাগলেও বোঝে, সেখানে তুমি তো সম্পুর্ন সুস্থ মানুষ। তাহলে তুমি বোকামি করছো কিভাবে?”
কথাগুলো বলেই থেমে যায় অর্পন। প্রাপ্তিকে নিশ্চুপ দেখে কপাল কুঁচকে ফেলে। মেয়েটা কোনো কথা বলছে না কেনো? এতোক্ষণ তো বেশ মন খুলে হাসছিলো, হঠাৎ মুখের হাসি গায়েব হয়ে গেলো কেনো? অর্পন কিছু বলতে মুখ খুলবে তার আগে প্রাপ্তি বলে,
—“আপনার বলা কি শেষ? তাহলে এবার আমি বলি?”
অর্পন মুখে কিছু না বলে নিশ্চুপ থাকে। মনে মনে ভয় হচ্ছে অর্পনের। প্রাপ্তি বিয়েতে রাজি হয়ে যায়নি তো? তাই কি সে চুপ করে ছিলো? অর্পনকে চুপ থাকতে দেখে এবার প্রাপ্তি বলতে শুরু করে,
—“আমার পেছনে যখন জাসুস লাগিয়েছেন তাহলে ভালো কাউকে কাজে লাগান। অন্তত আধা আধুরা কথা বলে সব খিচুড়ি যেনো বানিয়ে না দেয়। আপনার জাসুসের দেয়া তথ্য গুলো পুরোপুরি সত্য নয়। হ্যা আমার বাসায় পাত্র পক্ষ এসেছিলো তবে তারা আমার জন্য নয়, সুপ্তির জন্য।”
প্রাপ্তির কথা শুনে ভ্রু কুঁচকে যায় অর্পনের। তড়িৎগতিতে মাথা ঘুরিয়ে প্রাপ্তির দিকে তাকায়। ভ্রু কুঁচকে রেখেই বলে,
—“সুপ্তির জন্য মানে? তুমি তো সুপ্তির বড়। তোমাকে রেখে সুপ্তির জন্য সম্বন্ধ আসে কিভাবে?”
—“কারণ আমি যে অন্ধ। কেউ জেনে বুঝে একটা অন্ধ মেয়েকে বিয়ে করবে কেনো? নিজের হাতে নিজের জীবন নিশ্চয়ই কেউ বরবাদ করতে চাইবে না।”
—“এই কথা কি পাত্র পক্ষের কেউ বলেছে।”
প্রাপ্তি মুখে কিছু না বলে মাথা উপর নিচ নাড়িয়ে হ্যা বোঝায়। প্রাপ্তির হ্যা সম্বোধন দেখে রেগে যায় অর্পন। ভেতরে ভেতরে ক্ষোভে ফেটে পড়ে। ইচ্ছে করছে পত্র সহ তার পুরো পরিবারকে মেরে নদীতে ভাসিয়ে দিতে। কতো বড় সাহস! তার প্রাপ্তিকে অন্ধ বলে খোঁটা দেয়, অপমান করে!
এমন সময় হঠাৎ শুকনো পাতার খসখস আওয়াজ কানে আসে অর্পনের। আওয়াজ অনুসরণ করে সামনে তাকায় অর্পন। ঝোপের আড়ালে কেউ একজন আছে। কোনো মানুষের অস্তিত্ব বোঝা যাচ্ছে। তবে কি প্রাপ্তিকে কেউ ফলো করছে? অর্পন যদি দেরি করে আসতো তাহলে কি প্রাপ্তির কোনো বিপদ হতো? একটা ঢোক গিলে নিজেকে শক্ত করে অর্পন। বিচক্ষণ চোখে চারিদিকে একবার নজর বুলিয়ে নেয়।
ঝোপের পেছনটা বাদে আর কোনো দিকে সন্দেহ জনক কিছু নজরে পড়ে না অর্পনের। এর মানে কেউ হামলা করার উদ্দেশ্য নয় বরং প্রাপ্তির ওপর নজর রাখতে লোক পাঠিয়েছে। তবে বিষয়টা হালকা ভাবে নিলে চলবে না, সর্বোচ্চ সতর্ক থাকতে হবে।
অর্পনকে চুপ থাকতে দেখে প্রাপ্তি বলে,
—“চুপ করে আছেন যে অফিসার? আমার কথা কি হজম করতে কষ্ট হচ্ছে? আচ্ছা একটা কথা বলুন তো, আমার বিয়ে নিয়ে আপনার এতো মাথা ব্যাথা কেনো? আপনার এতো কিসের চিন্তা?”
প্রাপ্তির কথা শুনে ঘুরে তাকায় অর্পন। মুখের গম্ভীর ভাব লুকিয়ে হালকা হেসে বলে,
—“কারণ ছাড়া এতো কিছু অবশ্যই করছি না।”
কথাটা বলেই বুক ফুলিয়ে দম নেয় অর্পন। পূর্ণ দৃষ্টিতে প্রাপ্তির মুখের দিকে তাকিয়ে আশাভরা কন্ঠে বলে,
—“যদি কখনো এক বুক ভালোবাসা নিয়ে তোমার সামনে হাজির হই তাহলে কি করবে?”
—“ফিরিয়ে দেবো।”
প্রাপ্তির অকপটে জবাব শুনে কপাল কুঁচকে তাকায় অর্পন। কন্ঠ পূর্বের চেয়েও বেশি গম্ভীর করে বলে,
—“মানে?”
—“মানেটা খুবই সহজ। কোনো পুরুষই চাইবে না একটা অন্ধ মেয়েকে নিয়ে পুরো জীবন কাটাতে। অন্ধের প্রতি মানুষের করুনা আসে, ভালোবাসা নয়। আর কি প্রমান আছে যে আপনি ভালোবাসা নিয়েই আমার কাছে আসবেন। অন্ধদের কেউ ভালোবাসে না অফিসার। তাদের সাথে বড়জোর কিছুদিন ভালোবাসার অভিনয় করে। তারপর ঘনিষ্ঠ হয়, নিজের চাহিদা পূরণ হতেই ছুড়ে ফেলে দেয়। যদি আমার সাথে এমনই হয়? কি গ্যারান্টি আছে? এমন ভবিষ্যৎ আমি চাই না।”
রাগে চোয়াল শক্ত হয়ে যায় অর্পনের। চোখের সাদা অংশ লাল রঙে পাল্টে গেছে। কপালের রগ ফুলে ফেঁপে উঠছে। রাগ সামাল দিতে দুই হাত শক্ত করে মুষ্টি বদ্ধ করে অর্পন। শক্তি দিয়ে মুষ্টি বদ্ধ করায় জীম করা পেশি ফুলে উঠেছে। গুলি লাগা বাহুতে টান লেগে ফের রক্ত ঝরতে শুরু করেছে। টপটপ করে রক্ত চুইয়ে চুইয়ে পড়ছে হাত থেকে। কপালের ছোট্ট ব্যন্ডেজের তুলো রক্তে লাল রং ধারণ করেছে। প্রাপ্তি কি তবে অর্পনকে চরিত্রহীন ভাবছে? কথাটা যেনো অর্পনের বুকে তীরের মতো বিধছে।
দূর থেকে দাড়িয়ে সবটা দেখছিলো সুপ্তি। বেশ কিছুক্ষণ আগেই এসে পৌঁছেছে। দূর থেকেই দুজনের কথোপকথন শুনে সেখানেই দাড়িয়ে পড়েছে। সবটা দূর থেকেই শুনে যাচ্ছে। কিন্তু এতোক্ষণ সবকিছু স্বাভাবিক থাকলেও এখন কিচ্ছু স্বাভাবিক নেই। অর্পনের চেহারার এমন পরিবর্তন দেখে ভয় পেয়ে যায় সুপ্তি। এরপর অর্পনের হাতের বাহু থেকে রক্ত পড়তে দেখে আর দাড়িয়ে থাকতে পারে না। তড়িঘড়ি করে পা বাড়ায় সামনের দিকে। সোজা সামনে এসে দাড়িয়ে ভয়ার্ত কন্ঠে বলে,
—“আপনার হাত আর কপাল থেকে রক্ত পড়ছে কেনো স্যার? আপনি এতো আঘাত পেয়েছেন কিভাবে?”
সুপ্তির কথা শুনে ভ্রু কুঁচকে যায় প্রাপ্তির। অর্পন শরীরে আঘাত পেয়েছে সেটা তো প্রাপ্তি টের পায়নি। বিচলিত কন্ঠে প্রাপ্তি বলে,
—“আঘাত মানে? কিসের আঘাত? কিসের রক্ত? কার কি হয়েছে? অফিসার?”
বলতে বলতেই হাতটা অর্পনের দিকে বাড়িয়ে দেয় প্রাপ্তি। বেখেয়ালি বসত হাতটা সোজা ক্ষত স্থান ছুঁতেই ব্যথায় হালকা আর্তনাদ করে ওঠে অর্পন। কিন্তু সেটা কয়েক সেকেন্ডের জন্য। সেকেন্ডেই দাঁতে দাঁত চেপে ব্যথাটা হজম করে নিয়ে উঠে দাঁড়ায়। তাড়া দিয়ে বলে,
—“তোমাদের বাসায় পৌঁছে দিয়ে আসছি, চলো।”
—“আপনার কি হয়েছে বললেন না যে? আঘাত পেলেন কিভাবে?”
—“সেটা তোমার না জানলেও চলবে। এখন চলো।”
প্রাপ্তি বাঁধা দিয়ে বলে,
—“আপনাকে কষ্ট করতে হবে না। আমরা চলে যেতে পারবো।”
অর্পনের রাগ এখনে আকাশ ছুঁয়ে আছে। কিছুতেই রাগ সামাল দিতে পারছে না। তার ওপর প্রাপ্তির মুখে না শুনে রাগটা যেনো আরো কয়েকশো গুন বেড়ে গেলো। রাগে ভয়ঙ্কর ভাবে হুঙ্কার দিয়ে বলে,
—“একদম মুখে মুখে তর্ক করবে না। আমি যেটা বলেছি সেটাই হবে। তোমাদের আমার সাথেই যেতে হবে। কোনো রকম দ্বিমত করলে সোজা তুলে নিয়ে যাবো।”
অর্পনের হুঙ্কার শুনে দৃশ্যমান রুপে কেঁপে ওঠে দুই বোন। আর কোনো কথা না বাড়িয়ে অর্পনের সাথে চলে যায়।
ওরা তিনজন চলে যেতেই ঝোপের আড়াল থেকে বেরিয়ে আসে কেউ। ঢিলে ঢালা প্যান্টের পকেট থেকে বাটন ফোন বের করে ডায়াল করে একটা নাম্বারে। রিসিভ হতেই লোকটা সতর্ক কন্ঠে বলে,
—“বস! ওরা তো চইলা গেলো গা। এইহানে তো অন্য ব্যপার ঘটতাছে। এই পুলিশ ব্যডায় তো অন্ধ মাইয়াডার লগে প্রেম ভালোবাসা বিনিময় করতাছে।”
ওপর থেকে কোনো আওয়াজ শুনতে পাওয়া যায় না। কয়েক সেকেন্ড পর বিকট আওয়াজে ভাঙচুরের শব্দ শোনা যায়। শব্দটা এতোই তীব্র ছিলো যে সাথে সাথে লোকটা ফোন কেটে দেয়। একটা ঢোক গিলে বিড়বিড় করে বলে,
—“বস রাইগা গেলো ক্যা? মাইয়াডার লগে এইবার পুলিশ ব্যাডারও বিপদ আইতাছে মনে হইতাছে।”
চলবে?