তারে আমি চোখে দেখিনি পর্ব-২৭

0
159

#তারে_আমি_চোখে_দেখিনি
#পর্বঃ২৭(প্রথম অংশ)
#লেখিকা_সাম্মী_ইয়াসমিন

সময়টা দুপুর পেরিয়ে বিকেল। রোদের উত্তাপ কমে গেছে কিছুটা। বিকেলের স্নিগ্ধ শীতল হাওয়া ছুয়ে দিচ্ছে মন, হৃদয়। শেষ বিকেলের একটুকরো আলো এসে সাগরের মুখের ওপর তীর্যক ভাবে প্রতিফলন ঘটাচ্ছে। উজ্জ্বলতা বাড়িয়ে দিচ্ছে চেহারার। যেনো শত মানুষের ভীড়ে, প্রকৃতি নিদিষ্ট একজন মানুষকে লক্ষ্য করে হাসছে। তার সৌন্দর্যের বর্ণনা দিচ্ছে চুপিসারে। সেই অপার্থিব সৌন্দর্যের দিকে একধ্যানে চেয়ে আছে দীপ্তি। চোখ সরাতে পারছে না। পুরনো ক্ষতটা আবার নতুন করে নাড়াচাড়া দিয়ে উঠেছে। সেই সাথে বাড়ছে হৃদয়ের ব্যাকুলতা। নির্বাক চোখ দুটো শোনাচ্ছে একটা না পাওয়া গল্প। ব্যর্থতার গল্প। সে কি শুনতে পাচ্ছে সেই গল্প? বুঝতে পারছে সামনে বসে থাকা মেয়েটার ব্যাকুলতা। উপলব্ধি করতে পারছে মেয়েটার হৃদয়ের জর্জরিত ব্যথা? হয়তো না! তাই তো নিশ্চুপ, নির্বিকার হাতের ফাইলের দিকে মনোযোগ দিয়ে তাকিয়ে আছে। সামনের মানুষটার প্রতি তার বিন্দুমাত্র আগ্রহ নেই।

মনে মনে কথাগুলো ভেবেই দীর্ঘশ্বাস ছাড়ে দীপ্তি। এটা তার নিজের কর্মফল। ভোগ তো করতেই হবে। ভাগ্যের এই নির্মম পরিস্থিতি সে নিজের হাতে ডেকে এনেছে। বরং সাগর যে এতকিছুর পরও তার সাথে দেখা করতে এসেছে সেটাই অনেক। ভাবনার মাঝেই দীপ্তির মাথায় আরো একটা ভাবনা বাসা বাঁধে। তাদের বিচ্ছেদের তো নয় বছর হয়ে গেছে। নয়টা বছর অল্প সময় নয়। বেশ লম্বা সময় অতিক্রম করে আজ সামনাসামনি বসেছে দুজন। এই দীর্ঘ সময়ের মাঝে দীপ্তির মতো সাগরের জীবনেও হয়তো পরিবর্তন এসেছে। সেও নিশ্চয়ই বিয়ে করেছে। বাচ্চাও হয়েছে নিশ্চয়ই। কেমন দেখতে সাগরের বৌ? সুন্দরী কি? দীপ্তির চেয়েও সুন্দরী? আর বাচ্চা? সে কার মতো দেখতে হয়েছে? সাগরের মতো নাকি তার বৌয়ের মতো? প্রশ্নগুলো মন মস্তিষ্কে জেকে বসেছে দীপ্তির। উত্তর জানার জন্য হাসফাস করছে। কিভাবে জানবে উত্তর গুলো?

হঠাৎ ওয়েটারের কথায় ভাবনা থেকে বেরিয়ে আসে দীপ্তি। সহসা তাকায় সেদিকে। সাগরও ফাইল থেকে দৃষ্টি সরিয়ে সামনে তাকিয়েছে। ওয়েটার নিজের হাতের ট্রে থেকে দুটো কফি, দুটো বার্গার আর দুটো পাস্তা নামিয়ে রাখে। হেসে প্রশ্ন করে,

—“আর কিছু লাগবে স্যার, ম্যাম?”

—“আর কিছু লাগবে না।”

গম্ভীর কন্ঠে কথাটা বলে পকেট থেকে কিছু টাকা বের করে এগিয়ে দেয় সাগর। ওয়েটার বকশিস নিয়ে হাসিমুখে প্রস্থান করে। কফির কাপটা হাতে নিয়ে ফের ফাইলে চোখ রাখে সাগর।

এদিকে দীপ্তি হাসফাস করছে। প্রশ্নগুলো তার মন মস্তিষ্ক চিবিয়ে চিবিয়ে খাচ্ছে। উত্তর না পাওয়া পর্যন্ত শান্তি পাচ্ছে না। এলোমেলো দৃষ্টিতে তাকিয়ে ক্ষীণ কন্ঠে দীপ্তি বলে,

—“কিছু প্রশ্ন করি?”

—“হুম।”

ছোট্ট করে উত্তর দেয় সাগর। দীপ্তি যেনো সাহস পায়। কিছুটা এগিয়ে এসে ধীর কন্ঠে বলে,

—“আপনার বৌয়ের বিষয়ে তো কিছু বলেন না। দেখা করাবেন না তার সাথে?”

প্রাপ্তির মেডিক্যাল ফাইলগুলো দেখতে দেখতে মাত্রই কফির কাপে চুমুক দিয়েছিল সাগর। দীপ্তিই সেগুলো নিয়ে এসেছে সাগরকে দেখাতে। সাগর সেগুলোই মনোযোগ দিয়ে দেখছিলো। হঠাৎ দীপ্তির এহেন কথা শুনে ভড়কে যায়। বিষম খেতে গিয়ে নিজেকে সামলে নেয়। সপ্তপর্ণে মুখের কফি টুকু গিলে শান্ত চোখে তাকায় দীপ্তির দিকে। ফের ফাইলের দিকে তাকিয়ে বলে,

—“সময় হলেই দেখা করাবো।”

—“আপনার বৌ নিশ্চয়ই অনেক সুন্দরী তাই না?”

—“হুম, অনেক বেশি।”

বুকের ভেতর মোচড় দিয়ে ওঠে দীপ্তির। বুকের ব্যথাটা তীব্র থেকে আরো তীব্র রুপ ধারণ করছে। প্রচন্ড কষ্ট হচ্ছে। একটা ঢোক গিলে বুকের ব্যথাটা হজম করে নেয় দীপ্তি। সাগর ফাইলের দিকেই তাকিয়ে আছে। আস্তে ধীরে দীপ্তি ফের প্রশ্ন করে,

—“আর বাচ্চা? বাচ্চাও আছে নিশ্চয়ই?”

—“হুম, দুই বাচ্চার বাবা আমি। একটা ছেলে আর একটা মেয়ে।”

বুকের ওপরের জামার অংশ এক হাতে খামচে ধরে দীপ্তি মাথা নিচু করে নেয়। বড্ড জ্বলছে সেখানে। দম বন্ধ হয়ে আসছে। সে কি সাগরের সুখ সয্য করতে পারছে না? কিন্তু কেনো? এতোটা স্বার্থপর কিভাবে হলো দীপ্তি? এরপর বাকি জীবন সে বাঁচবে কিভাবে? বুকের ভেতর এতো এতো কষ্ট পুষে রেখে, এতো এতো ব্যথা নিয়ে কি আদৌ বেচে থাকা সম্ভব? কখনোই সম্ভব নয়।

হাতের ফাইলটা টেবিলের ওপর সপ্তপর্ণে রাখে সাগর। তাকিয়ে দেখে দীপ্তি এখনো কিছুই মুখে তোলেনি। পাস্তার প্লেটটা ধীরে দীপ্তির দিকে ঠেলে দেয় সাগর। ঠান্ডা কন্ঠে বলে,

—“প্রথমে তুমি কিছু খেয়ে নাও। চোখ মুখ শুকিয়ে গেছে তোমার। প্রাপ্তিকে নিয়ে চিন্তা করো না। রিপোর্ট গুলো আমি নিয়ে যাচ্ছি। সবটা ক্লিয়ার হয়ে তোমাকে জানাবো।”

এটুকু বলেই চুপ হয়ে যায় সাগর। কয়েক পল নিরবতা পালন করে ধীর কন্ঠে বলে,

—“নিজের খেয়াল রাখো। নিজেকে সুস্থ রাখো। তুমি নিজেই যদি অসুস্থ হয়ে পড়ো তাহলে প্রাপ্তির দেখাশোনা করবে কিভাবে? ওকে সুস্থ করে তুলতে আগে তোমার সুস্থ থাকতে হবে।”

কোনো প্রতিউত্তর দেয় না দীপ্তি। নির্মিশেষ তাকিয়ে থাকে সাগরের দিকে। বয়স বাড়ার সাথে সাথে সাগরের চেহারার মাধূূর্য যেনো আরো বেড়ে গেছে। সত্যি কি বেড়ে গেছে? নাকি সবটাই দীপ্তির কল্পনা, ভালোলাগা আর ভালোবাসা মাত্র!

—————————–

হসপিটালের ছোট্ট বেডে জ্ঞানহীন অবস্থায় শুয়ে আছে সুপ্তি। তার পাশেই একটা ছোট টুলে বসে আছে অর্পন। ফোনে কারো সাথে কথা বলছে। সুপ্তির অপর পাশে টানটান হয়ে দাড়িয়ে আছে অঙ্কন। একদৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে সুপ্তির দিকে। সুপ্তির ফেলা ধীর গতির নিশ্বাসের গণনা করছে যেনো। চোখ মুখ দেখে বোঝা যাচ্ছে না তার ভেতরের অবস্থা। নিরব, নির্বিকার হয়ে ঠায় দাঁড়িয়ে আছে। কোনো নড়াচড়া নেই।

ধীরে ধীরে চোখ মেলে তাকায় সুপ্তি। চোখ খুলেই উপরের দিকে একধ্যানে তাকিয়ে থাকে। চমকে ওঠে অঙ্কন। অস্ফুট স্বরে ডাকে,

—“ভাই।”

কান থেকে ফোন নামায় অর্পন। কিছুটা এগিয়ে এসে বসে। সুপ্তি হতবাক হয়ে শুয়ে আছে। কোথায় আছে, কি করছে কিছুই বুঝতে পারছে না। মস্তিষ্ক যেনো অচল হয়ে গেছে। এরপর ধীরে ধীরে মনে পড়ে পূর্বের সব ঘটনা। আচম্বিতে উঠে বসে পড়ে সুপ্তি। ভয়ে থরথর করে কাঁপতে শুরু করে। ব্যপারটা বুঝতে পেরেই অর্পন ভরসা দিয়ে বলে,

—“ভয় নেই, তুমি এখন নিরাপদ।”

অর্পনকে দেখে স্বাভাবিক হয় সুপ্তি। যেনো দেহে প্রাণ ফিরে পেয়েছে। রয়েসয়ে প্রশ্ন করে অর্পন,

—“এখন কেমন ফিল করেছো?”

—“বেটার।”

—“এবার বলো, তোমাকে তুলে নিয়ে গেছিলো কারা? তুমি কি তাদের চেনো?”

—“কাউকে চিনি না। কারো মুখই তো দেখতে পারিনি। সবাই মুখে মাস্ক পড়ে ছিলো।”

একটু থামে অর্পন। সুপ্তির দিকে শান্ত চোখে তাকিয়ে বলে,

—“ওরা কি তোমার সাথে খারাপ কিছু করেছে বা কোনো প্রকার আঘাত?”

মাথা নাড়িয়ে ফেলে সুপ্তি। ডানে বামে মাথা নাড়িয়ে না বোঝায়। অর্পন ফের প্রশ্ন করে,

—“কাউকেই দেখোনি? বা কোনো কথা? তোমার সাথে তাদের কি শত্রুতা?”

—“ওরা আমাকে নিতে এসেছিলো না। ওরা তো ছোট আপিকে নিতে এসেছিলো। ভুল করে আমাকে নিয়ে গেছিলো। জ্ঞান ফেরার পারেও আমি অজ্ঞান হওয়ার অভিনয় করছিলাম। তখন ওদের কথাগুলো শুনে ফেলি।”

সুপ্তির কথা শুনে ভ্রু কুঁচকে ফেলে অর্পন। প্রাপ্তিকে কি*ড*ন্যা*প করতে এসেছিলো শুনে কিছুটা বিচলিত হয়ে পড়ে। তবে চেহারায় সেটা প্রকাশ করে না। চোয়াল শক্ত করে গম্ভীর কন্ঠে বলে,

—“আর কিছু শুনেছো?”

—“হ্যা, তারা একজন ব্যক্তিকে বস বলে সম্বোধন করছিলো। মনে হয় সেই বসই বলেছিলো আপিকে তুলে নিয়ে যেতে। কিন্তু তারা ভুল করে আমাকে নিয়ে যায়। এজন্য সেই বস তার লোকগুলোকে ভীষণ বকছিলো। তারপর বেশ কয়েকটা গুলির আওয়াজও শুনি। ভয় পেয়ে গেছিলাম খুব। ভেবেছিলাম আজ মনে হয় আমার মৃত্যু অবধারিত। কিন্তু আমাকে অবাক করে দিয়ে সেই বস তার লোকদের বললো আমাকে ফিরিয়ে দিয়ে আসতে। কোনো ক্ষতি না করেই ফিরিয়ে দিয়ে আসার কথা শুনে বেশ অবাক হয়েছিলাম আমি। এমনকি সে তার লোকদের এটাও বলে দিচ্ছিলো যেনো আমার কোনো ক্ষতি না হয়। আর সবচেয়ে আশ্চর্যের বিষয় কি জানেন? বস নামক লোকটার কন্ঠটা আমার ভীষণ পরিচিত লাগছিলো। বার বার মনে হচ্ছিল এই কন্ঠ আমি এর আগেও শুনেছি। কিন্তু ওটা কার কন্ঠ সেটা কিছুতেই বুঝতে পারছিলাম না।”

সুপ্তির সমস্ত কথা মনোযোগ দিয়ে শোনে অর্পন। একটা কথা শুনে স্বস্তি পায় যে ওরা সুপ্তির কোনো ক্ষতি করেনি। সুপ্তির কোনো প্রকার ক্ষতি হলে অর্পন প্রাপ্তির সামনে দাঁড়াতে পারতো না। সে যে প্রাপ্তিকে কথা দিয়েছিলো, অক্ষত অবস্থায় ফিরিয়ে নিয়ে আসবে সুপ্তিকে।

এদিকে অঙ্কন সুপ্তির উল্টো দিকে চুপচাপ দাড়িয়ে আছে। মোটা ভ্রু জোড়া পুরোপুরি কুঁচকে রেখেছে। সুপ্তির কথা শুনে ভাবনায় পড়ে যায় অঙ্কন। কোনো অপরাধী সুপ্তির প্রতি এতো দয়া দেখালো কেনো? কোনো রকম ক্ষতি না করে তাকে ফিরিয়ে দিতে চাইছিলো। এমনকি বিশেষ ভাবে সুপ্তির সুরক্ষাও নিশ্চিত করছিলো। এর কারণ কি? কোনো ভাবে অ*প*হ*র*ণ কারী সুপ্তির প্রেমে পড়ে যায়নি তো? মনে মনে এতদম নিশ্চিত হয়ে যায় অঙ্কন, নিশ্চয়ই অপরাধীদের বস সুপ্তির প্রেমে পড়ে গেছে। সেই জন্য এতো দরদ দেখিয়ে ছেড়ে দিয়েছে। কথাগুলো ভাবতেই কোঁচকানো ভ্রু জোড়া আরো কুঁচকে যায় অঙ্কনের। চোখ, মুখ, অন্তর, কলিজা সব যেনো নিমেষেই বিতৃষ্ণায় ভরে ওঠে।

———————–

ড্রয়িংরুমে সোফায় প্রাপ্তিকে ঘিরে বসে আছে সবাই। চিন্তায় চোখমুখ শুকিয়ে গেছে সবার। অনেকটা সময় পেরিয়ে গেছে। সকাল পেরিয়ে সন্ধ্যা হয়ে গেছে। অথচ সুপ্তির কোনো খবর পাওয়া যায়নি। ড্রয়িংরুমের এদিক থেকে ওদিক ব্যস্ত পায়ে পায়চারি করছেন মারুফ সাহেব। অস্থিরতা ক্রমশ গ্রাস করে নিচ্ছে তাকে। কিছুতেই শান্তি পাচ্ছেন না। সময় যত গড়াচ্ছে, ভয়টা ধীরে ধীরে বৃদ্ধি পাচ্ছে।

হঠাৎ করেই কলিং বেলের আওয়াজ শুনে পায়চারি থামিয়ে দেন মারুফ সাহেব। সবাই একসাথে তাকায় বাড়ির সদর দরজার দিকে। মারুফ সাহেব হন্তদন্ত পায়ে এগিয়ে যান দড়জার দিকে। দড়জা খুলতেই দেহে যেনো প্রাণ ফিরে আসে তার। আদরের ছোট মেয়েকে চোখের সামনে দেখে খুশিতে আবেগপ্রবণ হয়ে পড়েন। দুই হাতে জাপ্টে ধরে বুকে জড়িয়ে নেন মেয়েকে। এবার যেনো একটু শান্তি লাগছে।

বাবা মেয়ের দিক থেকে চোখ সরিয়ে সামনে তাকায় অর্পন। প্রথমেই নজরে আসে প্রাপ্তির কান্নারত বিধ্বস্ত চেহারা। নজর থমকে যায় অর্পনের। বুকের ভেতর অদ্ভুত একটা পীড়া অনুভব করে। এই মেয়েটার কান্না দেখলে অর্পনের বুকটা প্রচন্ড জ্বলে। সুক্ষ্ম ব্যথায় জর্জরিত হয় হৃদপিণ্ড।

সুপ্তির কান্নার আওয়াজ শুনে প্রাপ্তি বুঝতে পেরে যায় তার বোনের আগমন। সহসা উঠে এগিয়ে যায় বোনের দিকে। কয়েক কদম যেতেই সুপ্তি হাওয়ার বেগে ছুটে আসে প্রাপ্তির কাছে। বোনকে জাপ্টে ধরে কেঁদে ফেলে সুপ্তি। পরম আবেশে মুখ গুজে নেয় বোনের বুকে। এক হাতে নিজের চোখের পানি মুছে অন্য হাত সুপ্তির মাথায় রাখে প্রাপ্তি। ভরসার সহিত বোনকে সামলানোর চেষ্টা করে।

হঠাৎ করেই হাতটা থেমে যায় প্রাপ্তির। নাসিকাপথে প্রবেশ করে একটা পরিচিত মিষ্টি সুবাস। তৎক্ষনাৎ মস্তিষ্ক জানান দেয় অর্পনের উপস্থিতির। নিজেকে সামলে নেয় প্রাপ্তি৷ শ্রদ্ধা ভরা কন্ঠে বলে,

—“ধন্যবাদ অফিসার। আমার বোনকে ফিরিয়ে আনার জন্য। আপনার কাছে যে ঋনি হয়ে গেলাম।”

এতোক্ষণে সকলের টনক নড়ে। এখানে যে অন্য আরো একজন ব্যক্তির উপস্থিতি আছে সেটা কেউ খেয়ালই করেনি। তার ওপর অর্পনের পরিবারের সাথে এই পরিবারের একটা সম্পর্কের বন্ধনে আবদ্ধ হওয়ার কথা হচ্ছে। মারুফ সাহেব এগিয়ে এসে বলেন,

—“কিছু মনে করো না বাবা। আসলে মেয়ের চিন্তায় আমার পুরো পৃথিবী হেলে গেছিলো। তুমি ভেতরে এসো, বসো।”

ধীর পায়ে এগিয়ে যায় অর্পন। কোনো বাক্য ব্যায় না করে চুপচাপ সোফায় গিয়ে বসে। চেহারায় সেই চীরচেনা গুরুগম্ভীর ভাব ভেবেছিলো সুপ্তিকে পৌঁছে দিয়েই চলে যাবে সে। থানায় আসামি গুলোকে নিয়ে গেছে বাকি অফিসাররা। সেখানে যাওয়া খুব জরুরি। তবে বেহায়া মন সায় দিলো না। দায়িত্ব কর্তব্যের বিরুদ্ধে গিয়ে বললো, “আর একটু থেকে যা। তাহলে প্রাপ্তিকে আর একটু দেখতে পাবি।” বেহায়া মনের উস্কানীতে আর একটু থেকে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নেয় অর্পনের প্রেমিক সত্তা। হোকনা সামান্য দেরি। বিনিময়ে পুরো রাত নির্ঘুম কাটিয়ে কাজ করবে। ক্ষতি কি তাতে?

—————————

ঘড়িতে রাত এখন এগারোটা। একটু আগে বাসায় ফিরেছে সজীব। এসেই ওয়াশরুমে চলে গেছে। লম্বা একটা শাওয়ার নিয়ে তারপর বের হয় সে। আজকাল মাথাটা স্বাভাবিকের তুলনায় একটু বেশিই গরম থাকে। লোকগুলোর কাজে ভুল। বড় একট ডিল ক্যান্সেল। তার মায়ের আগ বাড়িয়ে করা কিছু বোকামি। সব মিলিয়ে নিজের মেজাজ ঠিক রাখতে হিমসিম খাচ্ছে সজীব। সামনে একটা বড় অর্ডার পাওয়ার কথা। মেয়েগুলোকে যার হাতে তুলে দিতে যাচ্ছে তিনি উপহার স্বরুপ চেয়ে নিয়েছে বারোজন মেয়ে। মেয়েগুলোকে তার হাতে তুলে দিলে তবেই সে ডিলটা কনফার্ম করবে। তাই মেয়েগুলোকে ঠিক মতো পৌঁছে দেয়া বিশেষ দরকার। এই ডিলটা ক্যান্সেল হয়ে গেলে সজীব বিশাল বড় একটা লসের সম্মুখীন হবে। এই ঘাটতি কাটিয়ে ওঠা কঠিন হয়ে পড়বে তার জন্য। তাই যে করেই হোক, এবার সব কাজ ঠিকঠাক মতো করতে হবে। কোনো ভুল হওয়া চলবে না। হাতে আর মাত্র কিছুদিন বাকি।

শাওয়ারের নিচে দাড়িয়ে মাথায় পুরো ছকটা কষে নেয় সজীব। কিভাবে কি করবে সব পরিকল্পনা করা শেষ। এখন শুধু বাস্তবায়ন করা বাকি।

কাঁধে টাওয়াল ঝুলিয়ে হাত দিয়ে মাথা ঝাড়তে ঝাড়তে বেরিয়ে আসে সজীব। বেরিয়েই সবার আগে চোখ যায় দীপ্তির দিকে। সে খাবার নিয়ে সোফায় বসে আছে। সেদিক থেকে চোখ সরিয়ে সজীব বলে,

—“খেয়ে এসেছি আমি। এগুলো নিয়ে যাও।”

—“কিন্তু, তোমার জন্য আমি না খেয়ে অপেক্ষা করছিলাম।”

মিথ্যে বলে দীপ্তি। সবই সজীবের মন রাখতে অভিনয়। সজীবের মুখে সুপ্তিকে অ*প*হ*র*ণ করার কথা শুনে প্রথমে অস্থির হয়ে উঠেছিলো দীপ্তি। বিবেগ বুদ্ধির কার্যকারিতা কমে গেছিলো। কিন্তু পরক্ষনেই নিজেকে সামলে নিয়েছে দীপ্তি। সে বুঝে গেছে তাড়াহুড়ো করলে চলবে না। এখনো অনেক প্রশ্নের উত্তর জানা বাকি। প্রমান জোগার করা বাকি। তার জন্য সজীবের কাছে থেকে ওর গতিবিধির ওপর লক্ষ্য রাখতে হবে। ওকে বুঝতে দেয়া চলবে না যে দীপ্তি সত্যিটা জেনে গেছে। দিপ্তি দেখতে চায় সজীব আর কি কি অপরাধ করেছে। মনে মনে কথাগুলো ভেবেই নিজেকে স্বাভাবিক করে নেয় দীপ্তি। করুন চোখে তাকায় সজীবের দিকে। যেনো সজীবের খেয়ে বাড়িতে আসার জন্য সে ভীষণ কষ্ট পেয়েছে।

চলবে?

#তারে_আমি_চোখে_দেখিনি
#পর্বঃ২৭(দ্বিতীয় অংশ)
#লেখিকা_সাম্মী_ইয়াসমিন

সজীবের দিকে করুন দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে দীপ্তি। এখনই কেঁদে দেবে দেবে ভাব। দীপ্তির করুন মুখশ্রী সজীবের ভেতরটা নাড়িয়ে দেয়। বুকের বা পাশে একটা সুক্ষ্ম ব্যথা অনুভব করে। যেনো তার পুরো দুনিয়াই কেঁপে উঠেছে। শান্ত চোখে তাকায় দীপ্তির দিকে। কয়েক মুহুর্তের জন্য নিজেকেই ভুলে যায়। হাতের টাওয়াল টা চেয়ারের ওপর রেখে দীপ্তির পাশে এসে বসে। খাবারের প্লেটটা হাতে তুলে নিয়ে এক লোকমা ভাত মেখে দীপ্তির মুখের সামনে ধরে। ঠান্ডা কন্ঠে বলে,

—“আর কখনো এভাবে না খেয়ে থাকবে না। আমার বাড়ি ফেরার কোনো নির্দিষ্ট সময় নেই। কাজের চাপ বেড়ে গেছে। আমার জন্য অপেক্ষা না করে সময় মতো খেয়ে নিবে। মনে থাকবে?”

ধীর গতিতে উপর নিচ মাথা নাড়ে দীপ্তি। অনিচ্ছা থাকার সত্বেও সজীবের হাতে খেতে থাকে। খাবারের লোকমা মুখে নিতেই ভেতরটা বিষিয়ে ওঠে দীপ্তির। যেনো খাবার নয় বি*ষ খাচ্ছে। তিক্ততায় ভরে ওঠে তার দেহ, মন সহ পুরো সত্তা। ভরা পেটে কি আর কোনো কিছু রুচি সমেত খাওয়া যায়? অরুচিতে পেট গুলিয়ে আছে দীপ্তির। খাওয়া থেকে বাঁচতে ইনিয়ে বিনিয়ে বলে,

—“সুপ্তিকে কেউ অ*প*হ*র*ণ করে নিয়ে গেছিলো, জানো?”

সহসা হাত থেমে যায় সজীবের। দৃষ্টি হয় এলোমেলো। যেনো কোনো কিছু লুকানোর আপ্রাণ চেষ্টা করছে। এলোমেলো দৃষ্টিতে তাকিয়ে বলে,

—“কখন? কিভাবে? এখন সুপ্তি কোথায়?”

—“বাড়ি ফিরে এসেছে। আজকেই ঘটনাটা ঘটেছে!”

—“আমাকে আগে কেনো বলোনি?”

মনটা বিষিয়ে ওঠে দীপ্তর। চোখে মুখে ভর করে একরাশ ঘৃণা। সজীবের এই মিথ্যে, এই নিখুঁত অভিনয় দেখে মনের কোণে এক বিন্দু ভালোলাগাও অবশিষ্ট নেই দীপ্তির। সেই সাথে বেশ অবাকও হয়। মানুষ এতটা নিখুঁত অভিনয় কিভাবে করতে পারে? ধরা পড়ে না কেনো? কিভাবে চলে দুটো রুপ নিয়ে? দুটো রুপ সামলাতে গিয়ে তারা হিমসিম খায় না? ভুল করে বসে না? কেনো? পাপীরা এতোটা ক্ষমতাবান কেনো? ভেতরের ঘৃণা বিতৃষ্ণা ভেতরই দাফন করে চোখ মুখ স্বাভাবিক করে রাখে দীপ্তি। ধীর কন্ঠে বলে,

—“তোমার কি কোনোকিছু শোনার মত সময় আছে? আজকাল তো তুমি মহা ব্যাস্ত।”

সজীব আর কোনো উত্তর দেয় না। খাবারের প্লেটটা টি টেবিলের ওপর রেখে সোজা ওয়াশরুমে চলে যায়। সজীব সামনে থেকে চলে যেতেই তাচ্ছিল্য হাসে দীপ্তি। ধরা পড়ার ভয়ে মুখ লুকিয়ে পালাচ্ছে! কাপুরুষ একটা!

—————————

কানে ফোন চেপে ধরে কথা বলতে বলতে দোতলার সিড়ি বেয়ে নিচে নেমে আসেন দিদার সাহেব। কথা বলতে ছাঁদে গিয়েছিলেন তিনি। নিচে নামতেই সুপ্তিকে দেখে পায়ের গতি থেমে যায় তার। স্তব্ধ হয়ে যান কয়েক সেকেন্ডের জন্য। পরক্ষনেই বুঝতে পারেন, নিচে আসতে একটু বেশি দেরি করে ফেলেছেন।

সোফায় বসে প্রাপ্তির দিকে অপালক দৃষ্টিতে তাকিয়ে ছিলো অর্পন। হঠাৎ সিঁড়ির দিকে চোখ যেতেই ভ্রু কুঁচকে যায়। দিদার সাহেবকে এখানে দেখে অর্পন আশ্চর্য হয়েছে বেশ। সহসা উঠে দাড়িয়ে স্যালুট করে সম্মান জানায় দিদার সাহেবকে। চোখে মুখে তার একরাশ কৌতুহল।

দিদার সাহেব চোখের ইশারায় কিছু একটা বোঝায় অর্পনকে। এমন সময় সুপ্তি মাথা তুলে তাকায়। দৌড়ে গিয়ে দিদার সাহেবর পাশে দাঁড়ায়। এক হাত জড়িয়ে ধরে করুন কন্ঠে বলে,

—“ওখানে আরো অনেক মেয়ে ছিলো মামা। মেয়েগুলো সব নেশায় বুদ হয়ে ছিলো। হুঁশ জ্ঞানে ছিলো না কেউ। ওরা নিশ্চয়ই নারী পা*চা*র*কারী। মেয়েগুলোকে নিশ্চয়ই বেঁচে দেয়ার উদ্দেশ্য নিয়ে গেছে। ও, মামা তুমি তো পুলিশ! বাচিয়ে নাও না মেয়েগুলোকে। প্লিজ মামা!”

করুন স্বরে বায়না করতে থাকে সুপ্তি। দিদার সাহেব আলতো করে সুপ্তির মাথায় হাত বুলিয়ে দেন। অর্পনের দিকে তাকিয়ে চোখ দিয়ে কিছু ইশারা করেন। অর্পন যেনো বুঝে যায় ইশারা। বুক টানটান করে দাঁড়িয়ে গম্ভীর কন্ঠে বলে,

—“মোট চারজনকে ধরেছি স্যার! বাকিরাও ধরা পরবে। আপনি নিশ্চিন্ত থাকুন।”

দিদার সাহেব স্বস্তি পান। আলতো করে সুপ্তিকে এক হাতে জড়িয়ে নিয়ে বলেন,

—“সব ঠিক হয়ে যাবে। অর্পন সব সামলে নেবে। এখন তোমার বিশ্রামের প্রয়োজন মামনি। তুমি ঘরে গিয়ে বিশ্রাম নাও কেমন। আমি আজ এখানেই আছি।”

মাথা উপর নিচ নাড়িয়ে সম্মতি জানায় সুপ্তি। ধীর পায়ে হেঁটে সোজা নিজের ঘরে চলে যায়। সুপ্তি চলে যেতেই উঠে দাঁড়ায় অর্পন। মারুফ সাহেবকে উদ্দেশ্য করে বলে,

—“এখন আমাকে যেতে হবে আঙ্কেল। অনেক রাত হয়ে গেছে।”

ঘড়ির দিকে তাকান মারুফ সাহেব। রাত এগারোটা পার হয়ে গেছে। এর বেশি ছেলেটাকে আটকে রাখা ঠিক হবে না। তাছাড়া রাতেই প্রাপ্তি আর অর্পনের বিয়ের বিষয়ে আলোচনা করতে বসবেন মারুফ সাহেব। তাই অর্পনকে আর জোর করেন না। হাসি মুখে বিদায় জানান।

প্রাপ্তির দিকে একনজর তাকিয়ে বাইরের দিকে পা বাড়ায় অর্পন। বাড়ির মেইন গেট পেরিয়ে লম্বা লম্বা পায়ে গাড়ির কাছে এসে দাড়ায়। এক টানে গাড়ির দড়জা খুলতেই পেছন থেকে ভেসে আসে একটা চিকন মিষ্টি সুর,

—“ধন্যবাদ অফিসার। আমার খালি হাত ভরিয়ে দেয়ার জন্য। আপনি আমাকে শূন্য হাতে ফিরিয়ে দেন নি। ঋনি হয়ে গেলাম আপনার কাছে।”

পেছন ঘুরে তাকায় অর্পন। তার থেকে দুই তিন হাত দূরে দাঁড়িয়ে আছে প্রাপ্তি। চোখে মুখে কৃতজ্ঞতা বোধ স্পষ্ট ভেসে উঠেছে। আলতো হাসে অর্পন। উদাসীন কন্ঠে বলে,

—“তবে আমি তো ন্যায় বিচার পেলাম না। আমি তোমার হাত ভরিয়ে দিলাম, বিনিময়ে এবারও আমাকে শূন্য হাতে ফিরতে হচ্ছে। তুমি মানুষটা ভারি নিষ্ঠুর!”

—“এই নিষ্ঠুরতার আপনার ভালোর জন্যই।”

—“এতো ভালো তো আমি চাইনি। আমি তো খারাপটাই চেয়েছিলাম।”

মুখের খেই হারিয়ে ফেলে প্রাপ্তি। কথা বাড়ানোর জন্য কোনো বাক্য খুজে পায় না। প্রাপ্তি তর্ক করতে জানে না। তর্কে গেলে সে অল্পতেই হার মেনে নেয়। এটাই তার বৈশিষ্ট্য। হাজার আঘাত করলেও সে নিশ্চুপ থাকে। কোনো প্রতিউত্তর দেয় না।

প্রাপ্তিকে চুপ হয়ে যেতে দেখে এক কদম এগিয়ে আসে অর্পন। মাথাটা হালকা ঝুকিয়ে প্রাপ্তির মুখোমুখি হয়ে দাঁড়ায়। ক্ষীন কন্ঠে ফিসফিস করে বলে,

—“এখনো সময় আছে, ভেবে দেখো মেয়ে। সময় ফুরিয়ে গেলে এই ধামাকা অফারটা মিস করে ফেলবে।”

হতভম্ব হয়ে যায় প্রাপ্তি। অর্পনের কথা তার কাছে লাগামছাড়া, এলোমেলো মনে হচ্ছে। পুলিশেরাও কি এমন লাগামহীন হয়? জানা নেই প্রাপ্তির। তবে অর্পনের এমন ফিসফিস কন্ঠের আওয়াজ প্রাপ্তির অন্তরাত্মা নাড়িয়ে দেয়। এক মুঠো ভালোলাগার শীতল স্পর্শ ছুয়ে দেয় প্রাপ্তিকে। শিহরণ জাগে মনে। ভালোলাগারা আরো একবার ঘুম থেকে জেগে ওঠে। পুলকিত করে হৃদয়।

আলতো হাসে অর্পন। পকেটে দুই হাত গুজে সোজা হয়ে দাঁড়ায়। দৃষ্টি প্রাপ্তির দিকে রেখেই এক কদম পিছিয়ে যায়। ভরাট কন্ঠে বলে,

—“বাড়ি যাও এখন। ভাবার জন্য অনেকটা সময় আছে। আমি আবার তোমার মতো নিষ্ঠুর নই। ভরপুর সময় দিলাম। প্রয়োজন ভেদে সময়সীমা আরো বাড়ানো হবে।”

কথাগুলো বলেই পকেটে হাত গুজে নিষ্পলক তাকিয়ে থাকে অর্পন। যেনো প্রাপ্তির যাওয়ার অপেক্ষায় আছে। প্রাপ্তি বাসার ভেতরে প্রবেশ না করা পর্যন্ত সে এক পাও নড়বে না। ব্যপারটা বুঝতে পারে প্রাপ্তি। আলগোছে পেছন ঘুরে এগিয়ে যায় বাড়ির দিকে। কদম গুনে গুনে বাড়ির সদর দরজায় পা রাখে। প্রাপ্তি বাসার ভেতরে চলে যেতেই অর্পন গাড়িতে গিয়ে বসে। ঘাড় ঘুরিয়ে বাড়ির সদর দরজার দিকে একপলক তাকিয়ে গাড়ি স্টার্ট দেয়।

——————————

কামরুল সাহেবের ঘরে আলোচনা সভা বসেছে। আলোচনার মূল বিষয় হলো অর্পন আর প্রাপ্তির বিয়ে। মারুফ সাহেব আর দিলারা বেগম অর্পনকে বেশ পছন্দ করেছেন প্রাপ্তির জন্য। ছেলে দেখতে সুদর্শন। ভালো চাকরি করে। পারিবারিক অবস্থাও ভালো। আর সবচেয়ে বড় কথা, ছেলে নিজে প্রাপ্তিকে পছন্দ করেছে নিজের জীবনসঙ্গী হিসেবে। আর কি চাই। এমন ছেলে কি মারুফ সাহেব আর দুটো খুঁজে পাবে? কখনোই নয়। বরং অর্পনই প্রাপ্তির জন্য সবচেয়ে যোগ্য পাত্র। নিজের সমস্ত মনোভাব পেশ করে নিশ্চিন্তে বসে আছেন মারুফ সাহেব। দিদার সাহেব সবটাই মনোযোগ দিয়ে শুনলেন।

কামরুল সাহেবের চেহারা থমথমে। বিনা বাক্যে চুপচাপ বসে আছেন তিনি। গভীর মনোযোগ দিয়ে কিছু একটা ভাবছেন। নিরবতা ভঙ্গ করে দিদার সাহেব ভরাট কন্ঠে বলেন,

—“অর্পন ছেলে হিসেবে দুর্দান্ত। ছেলেটার ব্যক্তিত্ব খুবই চমৎকার। বেশ পছন্দের একজন মানুষ সে আমার কাছে। সে কখনো তার দায়িত্ব নিয়ে হেলাফেলা করে না। দায়িত্ব নিলে, সেটা শেষ নিশ্বাস পর্যন্ত পালন করে। আমার থেকে যদি সিদ্ধান্ত চাওয়া হয় তাহলে আমি একবাক্যে হ্যা বলে দেবো। কারণ অর্পনের ওপর আমি চোখ বন্ধ করে ভরসা করতে পারি।”

নিজের বক্তব্য শেষ করে সবার দিকে তাকান দিদার সাহেব। মারুফ সাহেব আর দিলারা বেগমের চেহারায় চমৎকার হাসি। তারা বেশ খুশি হয়েছেন। কিন্তু কামরুল সাহেবের থমথমে মুখ দেখে কিছুটা সংকোচ বোধে ভুগছেন তিনজন। যতই হোক, বাড়ির প্রধান তিনি। তার সিদ্ধান্তই সবার প্রথম জরুরি। মারুফ সাহেব আশাভরা চোখে তাকান তার বাবার দিকে। তিনি খুব করে চাইছেন তার বাবা যেনো রাজি হয়ে যায়। আর কোনো অমত না করে। এবার প্রাপ্তির বিয়ে তিনি দিয়েই ছাড়বেন। কিন্তু বাঁধ সাধলেন কামরুল সাহেব। এতোক্ষণের থমথমে পরিবেশ ভেঙে গম্ভীর কন্ঠে বলেন,

—“কিন্তু এই বিয়েতে আমি সহমত পোষণ করতে পারছি না।”

—“কিন্তু কেনো চাচা? অর্পন অনেক ভালো ছেলে। আমি পারসোনালি ওকে চিনি।”

দিদার সাহেবের কথায় শান্ত চোখে তাকান কামরুল সাহেব। ধীর কন্ঠে বলেন,

—“মানলাম সে ভালো ছেলে। কিন্তু আমি এজন্য অমত করছি না যে ছেলের দিক থেকে কোনো সমস্যা আছে। বরং আমি অমত করছি এইজন্য যে, প্রাপ্তি একজনকে পছন্দ করে। এখানে যত ভালো ছেলেই হোক না কেনো তার সাথে বিয়ের বিষয় আগানো উচিত হবে না। আমি শুধু এটুকু চাই, মনে একজনকে রেখে অন্য কারো সাথে সংসার করার ঘটনার পুনরাবৃত্তি না হোক।”

শেষের কথাটা তিনি মারুফ সাহেবের দিকে তাকিয়ে বলেন। বাবার পরোক্ষভাবে করা ইশারা বুঝতে পেরে মাথা নিচু করে ফেলেন মারুফ সাহেব। মুখটা শুকিয়ে যায় তার। মনের মধ্যে অপরাধবোধ আবারো সজাগ হয়ে ওঠে। বুকে চিনচিন ব্যথা শুরু হয়। আহ্, এ কি নিদারুণ কষ্ট। যা দেখা যায় না, ছোঁয়া যায় না, শুধু অসহনীয় ব্যথা অনুভব করা যায়।

———————–

এলোমেলো হাওয়া বইছে চারিধারে। গগন সীমায় নিকষ কালো মেঘের দেখা মিলছে। পুঞ্জ পুঞ্জ মেঘের দল হামাগুড়ি দিয়ে পুরো আকাশময় ঘুরে বেড়াচ্ছে। কখনো কখনো একে অপরের সাথে সংঘর্ষ হচ্ছে। সৃষ্টি হচ্ছে ভয়ানক বজ্র শব্দ। কেঁপে উঠছে পৃথিবী। সেই সাথে বইছে দমকা হাওয়া। উড়িয়ে দিয়ে যাচ্ছে জানালার সোনালী রঙের পর্দা।

খোলা জানালার সামনে দাড়িয়ে দমকা হাওয়ার দাপট অনুভব করছে প্রাপ্তি। বাইরের প্রকৃতির মতোই তার মনের মধ্যে হচ্ছে উথাল-পাতাল ঝড়। অর্পন বাসার উদ্দেশ্যে বেরিয়েছে একটু আগে। আনুমানিক আধাঘন্টা হবে। কে জানে, এখনো বাসায় পৌঁছাতে পেরেছে কি না। যদি ঝড় বৃষ্টির কবলে পড়ে? কি হবে তখন? চিন্তায় মাথা ফেটে যাচ্ছে প্রাপ্তির। এমন গভীর চিন্তার সময় পর্দার দাপাদাপি বেশ বিরক্ত করছে প্রাপ্তিকে। অবলীলায় তারা চোখ মুখ ছুয়ে যাচ্ছে। বিরক্তের মাত্রা ধীরে ধীরে আরও বাড়িয়ে দিচ্ছে। অধৈর্য হয়ে দু কদম পিছিয়ে যায় প্রাপ্তি। টেবিল থেকে হাতড়ে ফোনটা হাতে নিয়ে এগিয়ে যায় সুপ্তির কাছে। সুপ্তি কোলবালিশ জড়িয়ে ধরে ঘুমিয়ে আছে। নেশার ওষুধের কারণে চোখের পাতায় গাঢ় ঘুম ভর করেছে সুপ্তির।

প্রাপ্তির যেনো সেদিকে কোনো হেলদোল নেই। এখন মাথায় শুধুমাত্র অর্পনের চিন্তা ঘুরপাক খাচ্ছে। অর্পনের নিরাপত্তা নিয়ে চিন্তিত সে। পায়ে পায়ে সুপ্তির কাছে এগিয়ে গিয়ে পাশে বসে। সুপ্তির হাত ধরে ঝাকিয়ে বলে,

—“সুপ্তি! এই সুপ্তি। ওঠ তো একবার।”

ঘুম ঘুম চোখে কপাল কুঁচকে তাকায় সুপ্তি। বিরক্তিকর কন্ঠে বলে,

—“এতো রাতে ডাকছো কেনো আপি? ঘুমোতে দাও প্লিজ।”

—“আমি কি তোকে ঘুমোতে বারন করেছি? অফিসারের নাম্বারে ডায়াল করে দিয়ে তারপর ঘুমা।”

আলসেমি ভেঙে উঠে বসে সুপ্তি। পিটপিট করে তাকিয়ে বলে,

—“অফিসার মানে অর্পন ভাইয়া?”

—“হুম।”

সুপ্তি আর কথা বাড়ায় না। কল লিস্ট থেকে অর্পনের নাম্বার বের করে ডায়াল করে। ফোনটা প্রাপ্তির হাতে ধরিয়ে দিয়ে আবার কোলবালিশ জড়িয়ে ধরে ঘুমিয়ে পড়ে। ফোনটা কানে চেপে ধরে উঠে দাঁড়ায় প্রাপ্তি। আলগোছে পা বাড়িয়ে জানালার কাছে গিয়ে দাঁড়ায়। বাতাসের ঝাপটায় পানির ফোটা চোখে মুখে পড়তেই প্রাপ্তি বুঝতে পারে ইতিমধ্যে গুড়িগুড়ি বৃষ্টি শুরু হয়েছে। ফোনটা কানে চেপে অধির আগ্রহে অপেক্ষা করে প্রাপ্তি। দুইবার রিং বাজতেই রিসিভ হয় ফোন। ওপাশ থেকে শোনা যায় অর্পনের উদ্বিগ্ন কন্ঠস্বর,

—“এতো রাতে ফোন দিলে যে! কিছু কি হয়েছে? এই মাত্রই তো আসলাম।”

—“আপনি ঠিকভাবে বাসায় পৌঁছে গেছেন কি না সেটা জানতে ফোন দিয়েছি।”

প্রাপ্তির সহজ জবাব শুনে কথা থেমে যায় অর্পনের। সেই সাথে কিছুটা অবাকও হয়। বাইরে তাকিয়ে একবার আবহাওয়া পর্যবেক্ষন করে নেয়। বৃষ্টি শুরু হয়ে গেছে। আলতো হাসে অর্পন। দুষ্টুমি সুরে বলে,

—“কেনো? চিন্তা হচ্ছিলো আমার জন্য?”

—“হওয়াটা কি স্বাভাবিক নয়? আপনি আমাদের বাড়ি থেকে একটু আগে বেরিয়েছেন। এরই মাঝে বৃষ্টি শুরু হয়েছে। আজ আমাদের যে উপকারটা আপনি করেছেন, তার জন্য আপনার ভালো মন্দ খোঁজ নেয়াটা জরুরি ছিলো।”

—“শুধুই কি দায়িত্ববোধ থেকে এই মাঝরাতে ফোন?”

জবাব দেয় না প্রাপ্তি। চুপ হয়ে যায়। মনে মনে কথা বলতে থাকে। সে বলতে চায়, এটা দায়িত্ববোধ নয়। এটা ভালোবাসা। প্রিয় মানুষের জন্য চিন্তা। আপনার চিন্তা আমাকে দিশেহারা করে দিয়েছে অর্পন। কিন্তু মুখ ফুটে প্রাপ্তি কিচ্ছু বলে না। কোনো একটা জড়তা কাজ করছে ভেতরে।

অর্পন যেনো বুঝে নেয় সব। প্রাপ্তির নির্বাক শ্বাস প্রশ্বাস বলে দেয় তার এক একটা না বলা কথা। ধীর পায়ে বেলকনিতে গিয়ে দাঁড়ায় অর্পন। রেলিংয়ের ওপর হাত রেখে ঠান্ডা কন্ঠে বলে,

—“বাসায় চলে এসেছি মিনিট পাঁচেক হবে। সুস্থ ভাবেই এসেছি। চিন্তা করো না।”

কথাগুলো শুনে স্বস্তির নিঃশ্বাস ছাড়ে প্রাপ্তি। ফোনটা কানে চেপে ধরে ঠায় দাঁড়িয়ে রয়। নির্বাক, নিশ্চুপ, নিরবে, নিভৃতে। কয়েক সেকেন্ড নিরবতায় কাটে। নিরবতা ভেঙে কথা বলে অর্পন। তার কন্ঠ স্বর আঁধার রাতের চেয়েও গভীর, শীতল, স্নিগ্ধ,

—“ঘুমিয়ে পড়ো এখন। বেশি চিন্তা করো না। কারণ তোমার ভবিষ্যৎ এই আমার সাথেই জুড়ে আছে। এতে কোনো সন্দেহ নেই।”

একটু দম নিয়ে অর্পন ফের বলে,

—“একটা কথা মনে রেখো মেয়ে! প্রেম, ভালোলাগা, ভালোবাসা সবার জন্য হলেও প্রাপ্তি সবার জন্য নয়। কারণ প্রাপ্তি শুধু মাত্র অর্পনের জন্য।”

চলবে?