তারে আমি চোখে দেখিনি পর্ব-০৯

0
96

#তারে_আমি_চোখে_দেখিনি
#পর্বঃ০৯
#লেখিকা_সাম্মী_ইয়াসমিন

সকাল সকাল সিলেটের উদ্দেশ্যে বেরিয়ে গেছে অর্পন৷ গাড়ি সে নিজে ড্রাইভ করছে আজ। ড্রাইভের ফাঁকে ফাঁকে এক হাত দিয়ে চুল গুলো পেছনে ঠেলে দিচ্ছে। জানালা খোলা থাকায় সিল্কি চুল গুলো পুরো কপাল জুড়ে বিচরণ করছে অর্পনের। এরই মাঝে হঠাৎ অর্পনের ফোন বেজে ওঠে। ফোনটা হাতে নিয়ে দেখে তারই থানার একজন কনস্টেবল ফোন করেছে, তার নাম সুজন। লোকটাকে অর্পন প্রাপ্তির বাসার সামনে থেকে প্রাপ্তির খেয়াল রাখতে বলেছে। যেহেতু অর্পন আজ সারাদিন ওখানে থাকবে না এবং তার কাজ শেষ করে বাসায় ফিরতে ফিরতে আজ রাত পেরিয়ে হয়তো সকাল হয়ে যাবে। তাই অর্পনের অনুপস্থিতিতে প্রাপ্তির যাতে কোনো বিপদ না হয় তাই একজন কনস্টেবলকে রেখে গেছে প্রাপ্তির বাসার সামনে। যাতে কোনো কিছু হলেই অর্পন সাথে সাথে জানতে পারে।

তবে এই সকাল সকাল সুজনের ফোন দেখে ভ্রু কুঁচকে যায় অর্পনের। সকালেই তো তাকে কাজে লাগিয়ে দিয়ে আসলো আর এখনই ফোন। হঠাৎ করে অর্পনের মাথায় একটা প্রশ্ন ধাক্কা দেয়, “প্রাপ্তির কোনো বিপদ হলো না তো?” সাথে সাথে কলটা রিসিভ করে অর্পন কানে ধরে। বুকের ভেতর কেমন যেনো ধুকপুক করছে। কোনো এক অজানা ভয় কাজ করছে অর্পনের মধ্যে। প্রাপ্তিকে নিয়ে আজকাল অর্পনের চিন্তার শেষ নেই। ফোনটা রিসিভ করতেই ওপাশ থেকে শোনা যায় সুজনের কন্ঠ,

—“স্যার আপনাকে একটা খবর দেয়ার ছিলো।”

অর্পনের বুকের ধুকপুকানি যেনো আরো বেড়ে গেলো। সন্দিহান কন্ঠে অর্পন জিজ্ঞেস করে,

—“কি হয়েছে সুজন? একটু আগেই তো তোমাকে ওখানে রেখে আসলাম। এরই মধ্যে কার কি হলো? প্রাপ্তি ঠিক আছে তো? ওর কিছু হয়নি তো?”

—“ম্যাডাম ঠিকই আছে স্যার, কারো কিছু হয়নি। আমি তো অন্য খবর দিতে ফোন ফোন করলাম।”

ড্রাইভ করতে করতে কথা বলছিলো অর্পন কিন্তু এই পর্যায়ে এসে গাড়ি থামিয়ে দেয়। মাথার মধ্যে এখন চিন্তা কাজ করছে তাই এই অবস্থায় গাড়ি চালাতে গেলে কোনো দুর্ঘটনা ঘটতে পারে। গাড়িটা থামিয়ে অর্পন স্বাভাবিক গলায় প্রশ্ন করে,

—“কি বলতে চাইছো ক্লিয়ার করে বলো। কথা টেনে বড় করার প্রয়োজন নেই।”

—“স্যার আপনার শ্বশুর মশাই! থুক্কু, মানে প্রাপ্তি ম্যাডামের বাবা এই মাত্র বাসা থেকে বের হলেন। তার হাতে একটা বড় বাজারের ব্যাগ। মনে হয় তিনি বাজার করতে যাচ্ছেন।”

সুজনের কথা শুনে কিছুক্ষণের জন্য বোকা বনে যায় অর্পন। সুজনের গুরুত্বপূর্ণ কথা কি বোঝার চেষ্টা করে। কয়েক সেকেন্ড বোকার মতো তাকিয়ে থেকে বলে ওঠে,

—“তুমি এই খবর দিতে আমাকে ফোন করেছো?”

—“জ্বি স্যার! আপনি তো বলেছেন এখানে থেকে বাড়ির ওপর নজর রাখতে আর কখন কি হয় সেই খবর জানাতে। আমি আমার কাজ খুব ভালো ভাবে করছি স্যার।”

সুজনের কথা শুনে পুরো বাকরুদ্ধ অর্পন। একহাতে ফোন কানে ধরে অন্য হাত দিয়ে কপাল চেপে ধরে। তার থানায় এমন গর্ধব টাইপ পুলিশ কিভাবে জায়গা পেলো সেটা ভেবে হতাশ অর্পন। মানে, এরা চাকরি পায় কিভাবে? তাও আবার পুলিশের চাকরি। হতাশ কন্ঠে অর্পন বলে,

—“লাইক সিরিয়াসলি সুজন! তুমি এজন্য ফোন দিয়েছো? আমি তোমাকে প্রাপ্তির ওপর নজর রাখতে বলেছি। বাসায় সবার ওপর নজর রাখতে বলিনি। এখন বাসার কেউ টয়লেটে গেলে সেটাও কি আমাকে ফোন করে জানাবে? এই তুমি পুলিশের চাকরি পেলে কিভাবে?”

শেষের কথাটা অর্পন ধমকের সুরেই বলে। এদিকে অর্পনের ধমক শুনে কিছুটা ঘাবড়ে যায় সুজন। সে ঠিক কি ভূল করলো সেটা বুঝতে পারছে না। কিন্তু অর্পন যখন রেগে গেছে তাহলে নিশ্চয়ই কোনো ভূল করেছে সে। বোকার মতো মাথা চুলকে সুজন বলে,

—“সরি স্যার, আমি ভেবেছিলাম সব খবর দিতে বলেছেন। এই ভূল আর হবে না।”

একটা লম্বা নিঃশ্বাস নিয়ে নিজেকে সামলে অর্পন বলে,

—“আমার কথা মন দিয়ে শোনো সুজন। প্রাপ্তির ওপর হামলা হয়েছে অন্য কারো ওপর হয়নি। প্রাণ সংশয় প্রাপ্তির আছে অন্য কারোর নয়। তাই নজর প্রাপ্তির ওপর রাখবে। ওর কোনো বিপদ হলে সাথে সাথে আমাকে ফোন করে জানাবে। এটুকুই তোমার কাজ, বুঝতে পেরেছো?”

—“জ্বি স্যার।”

—“গুড, নিজের কাজ করো। রাখছি।”

কথাগুলো বলেই ফোনটা কেটে দেয় অর্পন। লম্বা একটা শ্বাস নিয়ে পাশে তাকিয়ে দেখে রহিম মিটিমিটি হাসছে। রহিমের এই চাপা হাসির কোনো মানে খুঁজে পাচ্ছে না অর্পন। ভ্রু কুঁচকে কৌতুহলী কন্ঠে জিজ্ঞেস করে,

—“আপনি হাসছেন কেনো রহিম সাহেব? আমি হাসার মতো কি বলেছি?”

—“স্যার, আপনি প্রাপ্তি মেয়েটাকে নিয়ে একটু বেশিই চিন্তা করছেন না? মানে এর আগেও আপনি বেশ কিছু কেস হ্যান্ডেল করেছেন। তাতে অনেক মেয়েদের সাথে পরিচয় হয়েছে কিন্তু প্রাপ্তির বেলায় আপনার আচরণে ভিন্নতা দেখতে পাচ্ছি। যদিও কারণটা খুবই জটিল কিন্তু আমি সব বুঝতে পেরেছি।”

রহিমের কথায় অপ্রস্তুত হয়ে যায় অর্পন। গলা খাঁকারি দিয়ে গম্ভীর কন্ঠে বলে,

—“বাজে বকা বন্ধ করে লোকেশন দেখুন। এবার কোনদিকে যাবো?”

বলতে বলতেই গাড়ি স্টার্ট দেয় অর্পন। রহিমও আর কথা না বাড়িয়ে হাতে থাকা ফোনে লোকেশন দেখে বলতে থাকে। অর্পন যে খুব সাবধানে বিষয়টা এড়িয়ে যাচ্ছে সেটা রহিম বেশ বুঝতে পারছে। তবে এই মুহুর্তে বিষয়টা নিয়ে টানাটানি ঠিক হবে না তাই চুপ হয়ে যায়।

______________

মারুফ সাহেব বাজার করে বাড়ি ফেরার পথে এলাকার ঘটকের সাথে দেখা হয়। ঘটক মূলত নিজে থেকেই মারুফ সাহেবর কাছে এসেছে। কয়েকদিন ধরে চেষ্টা করছে মারুফ সাহেবের সাথে কথা বলতে কিন্তু সুযোগ হয়ে উঠছে না। আজ বাজারে পেয়ে যেনো আকাশের চাঁদ হাতে পেয়ে গেছে। তাড়াহুড়ো পায়ে মারুফ সাহেবের কাছে এসে উচ্ছ্বসিত কন্ঠে বলে,

—“আপনাকে কবে থেকে খুজে যাচ্ছি মারুফ ভাই কিন্তু আপনাকে তো আজকাল পাওয়াই যায় না। অবশেষে দেখা পেলাম।”

ঘটকের আওয়াজ শুনে দাড়িয়ে যান মারুফ সাহেব। পরিচিত ব্যক্তিকে দেখে মুখে হাসি ফুটিয়ে বলেন,

—“ঘটক সাহেব যে, তা আমাকে কেনো খোঁজা হচ্ছিল শুনি?”

—“আসলে হাতে একটা ভালো সম্বন্ধ আছে ভাই। ছেলে আমেরিকা থাকে। বড় একটা কোম্পানিতে চাকরি করে। মোটা টাকা বেতন পায়। ছেলের মায়ের সাথে আমার ভালো পরিচয় তাই আমাকে বলেছে ভালো একটা মেয়ে খুঁজে দিতে। কথাটা শুনতেই আমার আপনার মেয়ের কথা মাথায় আসলো। এখন আমরা সবাই জানি আপনার মেয়েগুলো একদম হিরের টুকরো। এতো ভালো শিক্ষা দিয়ে বড় করেছেন যে সবাই ওদের প্রশংসা করে। তাছাড়া ছেলেও অনেক ভালো। তাই ভাবলাম সম্পর্ক জুড়ে দিলে মন্দ হয় না। তাছাড়া আপনার মেয়েও তো বড় হয়ে গেছে, আজ না হোক কাল বিয়ে তো দিতেই হবে।”

ঘটকের কথা শুনে ভাবনায় পড়ে যান মারুফ সাহেব। সত্যি বলতে প্রাপ্তিকে নিয়ে মারুফ সাহেবের আকাশ সমান চিন্তা। মেয়ের একটা কমতি তাকে সবার থেকে পিছিয়ে রেখেছে। সব বাবা মায়ের মতো মারুফ সাহেবও চান তার মেয়েদের ভালো একটা ছেলের সাথে বিয়ে দিতে। মেয়েটা তার সুখে থাকুক। কিন্তু প্রাপ্তি কি বিষয়টা সহজ ভাবে নিবে? ভাবনা চিন্তা শেষ করে মারুফ সাহেব ধীর কন্ঠে বলেন,

—“আপনি তো জানেন ভাই আমার পরিবারের কথা। এমনকি এলাকার সবাই জানে আমার প্রাপ্তির কথা। এই অবস্থায়……. ”

মারুফ সাহেবকে থামিয়ে দিয়ে ঘটক বলে,

—“ওসব চিন্তা করতে হবে না মারুফ ভাই। প্রাপ্তি মামনিকে নিয়ে কোনো সমস্যা হবে না। আমি সব তাদের বুঝিয়ে বলবো। আপনি অনুমতি দিলে তাদের নিয়ে আসতে পারি। তাছাড়া ভালো ছেলে হাতছাড়া করা বোকামি হবে।”

—“বেশ নিয়ে আসুন তাহলে। তবে আমার একবার বাড়ি গিয়ে সবার সাথে কথা বলতে হবে। আমার বাবা এখনো জীবিত আছেন তাই তার মতামত আমার কাছে বেশি গুরুত্বপূর্ণ। ”

মারুফ সাহেবের কথা শুনে ঘটক হেসে বলে,

—“সমস্যা নেই ভাই। আপনি চাচার সাথে কথা বলেন। সবার মতামত নিয়ে আমাকে একটা ফোন করে জানিয়ে দেবেন। তবে একটু তাড়াতাড়ি।”

—“জ্বি!”

কথাগুলো বলেই সেখান থেকে চলে আসেন মারুফ সাহেব। মাথার মধ্যে চলছে হাজার চিন্তা। প্রাপ্তি কি বিয়ের বিষয়টা সহজ ভাবে নেবে? ও আবার দীপ্তির মতো নিজের বাবাকে ভূল বুঝবে না তো? সন্তানের ভালোর কথা চিন্তা করে এক মেয়ের সাথে সম্পর্ক নষ্ট হয়ে গেছে মারুফ সাহেবের। তিনি চান না প্রাপ্তি আর সুপ্তির সাথেও তার সম্পর্ক নষ্ট হোক।

_______________

বিকেলে ক্লান্ত শরীর নিয়ে বাড়ি ফেরে সজীব। আজ অনেক দৌড়াদৌড়ি করতে হয়েছে। এই ব্যস্ততা কবে শেষ হবে কে জানে! শান্তিতে একটু শ্বাসও নিতে পারছে না সজীব। ক্লান্ত পায়ে রুমে ঢুকে দেখে দীপ্তি রেডি হয়ে বসে আছে। দীপ্তিকে এই সময় বাহিরের পোশাকে দেখে ভ্রু কুচকে যায় সজীবের। কৌতুহলী কন্ঠে বলে,

—“কোথাও গিয়েছিলে দীপ্তি?”

—“নাহ্, তবে যাবো। তোমার জন্যই অপেক্ষা করছিলাম।”

সজীব ভ্রু কুঁচকে রেখেই বলে,

—“মানে? কোথায় যাবে?”

—“কোথায় আবার? ডক্টরের কাছে। তুমি ডক্টর দাসকে এক্ষুনি ফোন করে বলো আমরা আসছি। তোমার কোনো বাহানা আমি শুনবো না সজীব। আমি যাবো মানে যাবো তাও আজই এবং এক্ষুনি।”

দীপ্তির একরোখা কথা শুনে দীর্ঘ শ্বাস ছাড়ে সজীব। বিগত কয়েক বছর ধরে এসবই হয়ে আসছে। বিয়ের এতো বছরেও বাচ্চা না হওয়ায় দীপ্তি নিজেকে দায়ী করে। যত দিন যাচ্ছে বাচ্চার জন্য দীপ্তির পাগলামি যেনো বেড়েই চলেছ । সজীবের মনে জেকে বসেছে অজানা ভয়। এমন চলতে থাকলে মেয়েটা যদি মানসিক ভারসাম্য হারিয়ে ফেলে। দীপ্তির দিকে অপরাধী চোখে তাকায় সজীব। একটা দীর্ঘ শ্বাস নিয়ে বলে,

—“পাঁচ মিনিট সময় দাও, আমি ফ্রেশ হয়ে আসছি। তাছাড়া ডক্টর দাসকে ফোন করে জানতে হবে আজ কোন হসপিটালে আছেন তিনি। তার থেকে জেনে তারপর যাচ্ছি।”

দীপ্তি কিছু না বলে আবার চুপচাপ বসে পড়ে। সে যে নিঃশব্দে সজীবকে ফ্রেশ হয়ে আসতে বললো সেটা বুঝতে আর সজীবের বাকি নেই। তাই অগত্যাই শরীরের সব ক্লান্তি ভূলে ফোন হাতে নিয়ে ডক্টরের নাম্বারে ডায়াল করে। তার থেকে লোকেশন জেনে নিয়ে ফ্রেশ হয়ে এসে দিপ্তিকে নিয়ে বেরিয়ে পড়ে।

_________________

বিছানায় আধশোয়া হয়ে বসে আছে প্রাপ্তি। কানে হেডফোন লাগিয়ে ফোনে গান শুনছে। সেই দুর্ঘটনার কথা জানার পর থেকে দিলারা বেগম প্রাপ্তিকে রুমের বাহিরে বের হতে দেয়নি। যদি আবার কিছু হয়ে যায় সেই ভয়ে। তাছাড়া প্রাপ্তির শরীরের ক্ষতগুলো এখনো পুরোপুরি ঠিক হয়নি। বিশেষ করে হাটুর আঘাতটা তুলনামূলক বেশিই হওয়ায় ওখনো ব্যথা আছে। এজন্য সামান্য খুড়িয়ে হাটতে হয় প্রাপ্তিকে। এদিকে সারাদিন বাসায় থেকে বিরক্ত হয়ে গেছে প্রাপ্তি। ভার্সিটি না থাকলে বিকেলে সেই নদীর পাড়ে গিয়ে বসে থাকে। জায়গাটাতে অদ্ভুত এক প্রশান্তি পায় প্রাপ্তি। ঘরের দম বন্ধ করা বন্দী পরিবেশে শ্বাস নিতেও কষ্ট হচ্ছে প্রাপ্তির।

কিছুক্ষণ কানে হেডফোন গুঁজে বিরক্ত হয়ে শুয়ে থাকে প্রাপ্তি। ভালো না লাগায় উঠে বসে। গলাটা শুকিয়ে গেছে, একটু পানি খাওয়া প্রয়োজন। কান থেকে হেডফোনটা খুলে ফেলে ধীর কন্ঠে কয়েকবার সুপ্তিকে ডাকে। দিলারা বেগম প্রাপ্তির ওপর নজর রাখার জন্য সুপ্তিকে রেখে গেছিলেন। কিন্তু সুপ্তির কোনো সাড়া না পাওয়ায় প্রাপ্তি এটুকু বুঝে গেছে যে সুপ্তি এই রুমে নেই। এখন সে কোথায় গেছে সেটাও প্রাপ্তি বেশ বুঝতে পারছে। নিশ্চই এখন ছাঁদে গিয়ে লাইভে বক্তৃতা দিচ্ছে। সে তো আবার সেলিব্রিটি। তার তো হাজারো ফ্যান ফলোয়ার। তাদেরকেও যে সময় দিতে হয় সুপ্তির।

মুচকি হেসে উঠে দাঁড়ায় প্রাপ্তি। কয়েক কদম এগিয়ে এসে হাত সামনে দিয়ে হাতড়ে হাতড়ে পানির জগ খুজতে থাকে। হাতড়ে সামনে জগটা পেয়েও যায়। এক হাতে জগ নিয়ে অন্য হাত দিয়ে গ্লাস খুঁজতে থাকে। কিন্তু গ্লাস খুঁজে পাচ্ছে না। হাত এদিক সেদিক দিয়ে হাতড়ানোর সময় ভূলবসত হাতের ধাক্কা লেগে গ্লাসটা টেবিল থেকে গড়িয়ে নিচে পড়ে যায়।

কাচের গ্লাসটা ফ্লোরে পড়ে নিমেষেই ভেঙে চুর্ণবিচুর্ণ হয়ে চারিদিকে ছড়িয়ে পড়ে। এদিকে গ্লাস ভাঙার ঝনঝন আওয়াজ শুনে চমকে এক কদম পিছিয়ে যায় প্রাপ্তি। কাচের টুকরো পায়ের নিচে পড়ায় চাপ লেগে খচ করে পায়ের তলায় বিধে যায় সেটা। হাত ফসকে জগটা পড়ে পুরো ফ্লোরে পানি ছড়িয়ে পড়ে। প্রাপ্তি পা ধরে ফ্লোরে বসে ব্যথায় আর্তনাদ করে ওঠে।

রান্নাঘরে সন্ধ্যায় খাওয়ার জন্য নাস্তা বানাচ্ছিলেন দিলারা বেগম। ড্রয়িংরুমে বসে পেপার পড়ছিলেন মারুফ সাহেব আর কামরুল রহমান। তখন প্রাপ্তির রুম থেকে ভাঙচুরের আওয়াজ শুনে চমকে ওঠে সবাই। মারুফ সাহেব খবরের কাগজ রেখে দৌড়ে চলে যান দোতলায়। পেছন পেছন যায় দিলারা বেগম আর কামরুল রহমান।

প্রাপ্তির রুমে ঢুকতেই মারুফ সাহেব দেখেন পুরো ফ্লোরে পানি ছড়িয়ে আছে আর পানির সাথে রক্ত মিশে পুরোটা লাল হয়ে আছে। সামনে প্রাপ্তি পা ধরে বসে কাতরাচ্ছে। এই দৃশ্য দেখে দিলারা বেগম আর নিজেকে সামলাতে পারেন না। হাউমাউ করে কাঁদতে শুরু করে দেন। কামরুল রহমান হতভম্ব হয়ে লাঠি ভর দিয়ে দাড়িয়ে আছেন। কি থেকে কি হয়ে গেলো তিনি কিছুই বুঝতে পারছেন না। মারুফ সাহেব দৌড়ে এসে মেয়েকে বুকে আগলে নেন। কোনোমতে কোলে তুলে বিছানায় বসিয়ে পায়ের কাছে বসে পড়েন। ব্যথায় প্রাপ্তির চোখ থেকে ঝরঝর করে পানি পড়ছে। পুরো মুখ নীল বর্ণ ধারণ করেছে।

এদিকে মায়ের কান্না শুনে সুপ্তিও নিচে চলে এসেছে। এসেই বোনের অবস্থা দেখে হতভম্ব হয়ে যায়। মাত্র কিছুক্ষণ হয়েছে সে ছাঁদে গেছে আর এসেই দেখছে এইসব। মারুফ সাহেব দিলারা বেগমকে প্রাপ্তির কাছে বসিয়ে দিয়ে ফোন নিয়ে তার পরিচিত ডক্টরকে ফোন করেন। কাঁচের টুকরো অনেক গভীর ভাবে ঢুকে গেছে তাই সেটাতে হাত দেয়ার সাহস করতে পারছেন না তিনি। তাছাড়া সবচেয়ে বড় কথা মেয়ের শরীরে তিনি আঘাত করতে পারছেন না। মেয়ের কষ্টে তার যে বুক কাঁপছে।

মিনিট দশেক পরেই বাসার গেটের সামনে একটা অটো এসে থামে। অটো থেকে বেরিয়ে আসে একজন মধ্যে বয়স্ক পুরুষ। সুজন পাশের দোকানে দাড়িয়ে চা খাচ্ছিলো। প্রাপ্তিতের বাসায় একজন লোককে ঢুকতে দেখে ভ্রু কুঁচকে তাকিয়ে থাকে। লোকটা আসলে কে সেটাই বোঝার চেষ্টা করছে সুজন। তারপর হাতে ডাক্তারের সরঞ্জাম দেখে বুঝতে পারে এটা কোনো ডক্টরই হবে। কিন্তু ডক্টর কেনো? কারো কি কিছু হয়েছে? কথাটা কি অর্পনকে জানানো উচিত? ভাবনায় পড়ে যায় সুজন। অর্পনকে জানবে কি জানাবে না ভাবতে থাকে। একবার ভাবে ফোন দিয়েই ফেলি। পরোক্ষনে ভাবে যদি স্যার রেগে যায়। তবে না জানালে স্যার যদি আবার রেগে যায়। তাই ভয়কে এক সাইডে রেখে ফোন করেই ফেলে। কিন্তু অর্পন ফোন রিসিভ করে না। বাজতে বাজতে কেটে যায় ফোন। সুজন আর দ্বিতীয়বার ফোন করার সাহস করে না। দেখতে থাকে কি হয়।

কিছুক্ষণ পর দেখে মারুফ সাহেব প্রাপ্তিকে কোলে নিয়ে বাসার বাহিরে বের হচ্ছেন বিষয়টা সুজনের কাছে বেশ গোলমেলে লাগে। ভালো করে লক্ষ্য করতেই নজরে পড়ে প্রাপ্তির ব্যথাতুর মুখ। এটা দেখে সুজন নিশ্চিত যে প্রাপ্তির কিছু একটা হয়েছে। মনের সব ভয় যেনো নিমেষেই গায়েব হয়ে যায়। ফোনটা আবার বের করে ডায়াল করে অর্পনের নম্বরে কিন্তু অর্পন ফোন তুলছে না। ক্রমাগত ফোন করেই যাচ্ছে সুজন কিন্তু অর্পনের কোনো উত্তর নেই। চিন্তায় পড়ে যায় সুজন। ওদিকে স্যারের আবার কোনো বিপদ হলো না তো!

চলবে?