তার শহরের মায়া পর্ব-১৬

0
998

#তার_শহরের_মায়া 😍
#পার্ট_১৬
#Writer_Liza_moni

অনু আসার পর থেকেই যে রুমে ঢুকলি আর বের হওয়ার নাম নেই তোর। খাবার ও খাস নি। আমি তোর এই ছেলে মানুষি নিয়ে কই যে যাই,,, বলতে বলতে মা অনুর রুমের দরজা ঠেলে ভেতরে এসে দেখেন অনু ঘুমিয়ে আছে।

দেখছো মেয়ের কান্ড। খাবার না খেয়েই ঘুমিয়ে পড়ছে। আমার এই ছোট মেয়েটার যে কি হলো?

মা অনুর মাথার পাশে বসে অনুর মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে লাগলো। মায়ের হাতের ছোঁয়ায় অনু নড়েচড়ে উঠলো।এক হাত মায়ের কোলের উপর রেখে আর ও গভীর ঘুমে তলিয়ে যায়।

মা অনুর মুখের দিকে তাকিয়ে রইলেন। কেমন ফেকাসে হয়ে আছে। শরীরের যত্ন নেয়নি মেয়েটা। দিন দিন ছোট হচ্ছে। আগে থেকে ও শুকিয়ে গেছে। এমনিতেই চিকন ছিল।দেখেই বোঝা যাচ্ছে অনেক দিন পর শান্তিতে ঘুমাচ্ছে। ঘুমাচ্ছে যখন ঘুমাক। উঠে না হয় খাবার খেয়ে নিবে।

মা আর অনু কে জাগলো না। আস্তে করে তিনি উঠে চলে এলেন অনুর রুম থেকে।
.
.
বিকেল সাড়ে চারটায় অনুর ঘুম ভাঙল। শোয়া থেকে উঠে আড়মোরা ভেঙ্গে বিছানা থেকে নেমে টেবিলের উপর থেকে মোবাইলটা হাতে নিয়ে সময় দেখে নিলো।

এত সময় ধরে ঘুমিয়েছি।অনু হাই তুলে ওয়াস রুমের দিকে যেতে যেতে বলল উমমম আবারো ঘুম পাচ্ছে।

ওয়াস রুম থেকে বের হয়ে মুখ মুছে নিল।ড্রেসিং টেবিলের সামনে বসে এলোমেলো চুল গুলো কে আঁচড়ে ঝুটি বেঁধে নিয়ে ওড়না গলায় ঝুলিয়ে রুম থেকে বের হয়ে মাকে ডাকতে লাগলো।

ক্ষিদা পেয়েছে। সারাদিন ভাত খাওয়া হয়নি। নিচে কোথাও মাকে দেখতে না পেয়ে ছাদে চলে গেল অনু। ছাদে গিয়ে দেখে পাশের বাড়ির কিছু আন্টির সাথে বসে গল্প করছেন তিনি।

অনু তাদের দিকে এগিয়ে যায়। সেখানে গিয়ে তূর্যর মাকে দেখে ভ্রু কুঁচকালো। ভদ্রতা বজায় রাখার জন্য সবাই কে মুচকি হেসে সালাম দিয়ে মায়ের পাশে গিয়ে বসলো।

তূর্যর মা মুচকি হেসে সালাম নিয়ে বললেন কেমন আছো অনুমা?

আলহামদুলিল্লাহ আন্টি। আপনি?

আলহামদুলিল্লাহ।

আপনি কখন আসলেন আন্টি?

এই তো আধা ঘন্টা আগে। তুমি ঘুমিয়ে ছিলে বলেই তো দেখতে পাওনি।

হুম। জুঁই কেমন আছে?

ভালো আছে।

ওকে আনেননি কেন?

ও প্রাইভেটে গেছে তো তাই।আর আমি কিছুক্ষণ পর চলেই যাব।

সেকি আজ থেকে যান। আগামীকাল যাইয়েন।
এমন সময় ছাদের দরজা মেলার আওয়াজ পেয়ে অনু সে দিকে তাকিয়ে তার বড় ফুফু কে দেখে উঠে গিয়ে মুচকি হেসে জড়িয়ে ধরলো।

কী রে মা কেমন আছিস?

বিন্দাস আছি। কখন আসছো তুমি? আমার সাথে দেখা না করেই তোমার হিটলার বাবার বাড়িতে গেছিলা তাই না?

তুই আবার আমার বাবাকে হিটলার বললি?

১০০ বার বলমু।ঐ বেটা একটা হিটলার। আচ্ছা আগে বলো তোমার কী খবর ফুফু মনি?

আমি তো দুই দিন পর মেয়ে বিয়ে দিবো। শ্বাশুড়ি হয়ে যাবো। আমার খবর ভালোই।

মানে তানিশা কে বিয়ে দিয়ে দিবা এত তাড়াতাড়ি? মেয়েটা মাত্র ইন্টার ফার্স্ট ইয়ারে পড়ে।

দিন কাল ভালো না মা। কখন কোন অঘটন ঘটে কে বলতে পারে?

তূর্যর সাথেই বিয়েটা ঠিক হয়েছে অনু। তোর আন্টি তো তার জন্যই আসছেন।চার তারিখে বিয়ের তারিখ পড়েছে।

মায়ের কথায় অনু ভ্রু কুঁচকে সবার দিকে তাকিয়ে বললো তোমরা সিরিয়াস?
তানিশার এখন ও কি বিয়ের বয়স হয়েছে?১৮ বছর হয়েছে ওর?এত ছোট একটা মেয়ে?তিশা আপু জানলে কিন্তু তানিশারে ওর কাছে নিয়ে চলে যাবে।

কে বলছে তানিশার এখন ও বিয়ের বয়স হয়নি?ওর এখন ১৮ বছর ৪ মাস চলছে।

তাই বলে ওর পড়াশোনা শেষ না করতেই বিয়ে?

বিয়ের পর যদি তানিশা পড়তে চায় তাহলে আমরা ওকে পড়াবো। আমাদের কোনো সমস্যা নেই।

শোনো অনু মেয়ে ছোট থাকতে বিয়ে দিয়ে দিলেই ভালো। সংসারে অশান্তি সৃষ্টি হবে না।সবার কথা মেনে চলবে।ঘাড় ত্যাড়ামি করবে না।

কেন পড়াশোনা শেষ করে বিয়ে করলে কি সমস্যা?তার সাথে বিয়ে হবে সেই লোক টা যদি ভালো না হয়?যদি কিছু বছর পর সংসার ভেঙ্গে যায় তখন কী করবে?

তাই বলে কি তোমার মত বয়স্ক হয়ে বিয়ে করবে নাকি?

পাশের বাড়ির আন্টিটার কথা শুনে অনু তাচ্ছিল্য হাসলো।অনুর মা ঐ মহিলা কে কিছু বলতে যাবেন তার আগেই অনু বলে উঠলো

সিরিয়াসলি আন্টি? আমাকে কি দেখতে বয়স্ক মনে হয়? আমি তো জানি যে দেখে সেই আমাকে ইন্টারের স্টুডেন্ট ভেবে বসে থাকে।২৩ বছরে পড়লাম মাত্র। আর আমাকে বয়স্ক মহিলার মত লাগে তাই না?
আপুর বিয়ের সময় যখন এখানে ছিলাম আপনার ভাইয়ের একটা মেয়েকে দেখে ছিলাম। তার বয়স তো ২৬ হবে। এখন ও বিয়ে দেয়নি। তাকে কী দেখতে কোচি খুকির মত লাগে? আগে নিজের পরিবারের দিকে তাকাবেন তার পর অন্যের মেয়েকে নিয়ে সমালোচনা করতে আসবেন।বড় বিধায় বেশি কিছু বলিনি।

অনু মায়ের দিকে তাকিয়ে বললো আমার ক্ষিদা লাগছে।নিচে আসো খেতে দাও। নিজের হাতে খাইতে পারুম না। তুমি খাইয়ে দিবা আসো।

অনুর মা অনুর দিকে মুচকি হেসে তাকালেন। মনে মনে বললেন এই তো আমার সেই প্রতিবাদি আগের অনু। তিনি নিচে চলে গেলেন।

অনু যাওয়ার সময় বড় ফুফুর উদ্দেশ্যে বললো তানিশা কে নিজের পায়ে দাঁড়াতে দাও। পায়ের গোড়ালি ভেঙ্গে দিও না। জীবনে কিছু একটা করতে দাও ওরে। না হলে পরে দোষারোপ তোমাকেই শুনতে হবে।

অনু আর কিছু না বলে নিচে চলে গেল।খালি পেটে অনেক বকে ফেলছি। এখন খাইতে হবে পেট ভরে।

অনুর কথায় কান দিলেন না বড় ফুফু। তূর্যর মতন একজন ভালো ছেলের সাথে বিয়েটা তিনি ভাঙ্গতে চান না।

তূর্যর মায়ের কাছে অনুকে অনেক ভালো লাগে। মেয়েটা খুব গুছিয়ে কথা বলতে পারে। তিনি চেয়েছিলেন তূর্যর সাথে অনুকেই বিয়ে দিতে। কিন্তু অনুর আব্বু আম্মু রাজী না।মাহিরের ফুফাতো ভাইয়ের কাছে তারা তাদের ছোট মেয়েকে বিয়ে দিবেন না। আত্মীয়র সাথে সম্পর্ক করবেন না।আর অনু কে দেখে মনে হয় না ও চাকরি করা ছাড়া বিয়ে করবে।

তানিশার কথা অনুর বাবাই বলেছেন তূর্যর মাকে।আর তানিশা কে দেখার পর তূর্যর মা খুশিই হয়েছেন। নিজের মতো করে গড়ে নিতে পারবেন তানিশা কে।
.
.

.

দেখতে দেখতে তূর্যর গাঁয়ে হলুদের দিন চলে এলো। অথচ তূর্য এখন ও পড়ে পড়ে ঘুমাচ্ছে। গতকাল রাতেই ঢাকা থেকে বাড়িতে আসে সে।মা ইমোশনাল ব্ল্যাকমেইল করে তূর্য কে বাড়িতে আসতে বাধ্য করেন। সারা রাত জার্নি করায় এখন ঘুমের জন্য চোখ মেলে তাকাতেই পারছে না।কার সাথে বিয়ে হচ্ছে সেটা ও তার মাথায় নেই।

সকাল ১০ টার দিকে মাহির আর তনু ,
মাহিরের মা বাবা এসে পৌঁছায় তূর্যদের বাড়িতে।
.
ফুফু মনি তূর্য কোথায়?তার বিয়ে তাকেই তো দেখতে পাচ্ছি না।

ওর রুমে গিয়ে দেখে আয় পড়ে পড়ে ঘুমাচ্ছে।

মাহির তূর্যর রুমে এসে দেখে তূর্য হবে ঘুম থেকে উঠে মুখ টাকে মলিন করে বসে আছে।

কীরে ভাই এই ভাবে বসে আছিস যে?

তূর্য মাহিরের দিকে তাকিয়ে বললো আমার বোধ হয় আর মন ভাঙ্গা মানুষটাকে পাওয়া হবে না। তাকে খোঁজার আগেই মা বিয়ে করিয়ে দিচ্ছে।

মন ভাঙ্গা মানুষ মানে? তুই কি কোনো ভাবে অনুর কথা বলছিস?ভ্রু কুঁচকে জিজ্ঞেস করল মাহির।

তূর্য মাহিরের দিকে চোখ বড় বড় করে তাকিয়ে বললো অনু যে মন ভাঙ্গা মানুষ তুই কি ভাবে জানিস?

তূর্যর কথায় মাহির থতমত খেয়ে গেল। না মানে আমাকে তনু বলেছে ও নাকি কাকে ভালোবাসাতো সে নাকি ওরে ধোঁকা দিছে।

তূর্য তাচ্ছিল্য হাসলো। তার পর মুখটাকে গম্ভীর করে মাহফিলের চোখের দিকে তাকিয়ে বললো

আমি সেদিন দেখে ছিলাম।প্রিয় মানুষটাকে হারিয়ে মেয়েটা দম বন্ধ হয়ে যাওয়ার মতো চিৎকার করে কান্না করে ছিল।দেখে ছিলাম আমি তার সেই প্রিয় মানুষটা তাকে কতটা কষ্ট দিয়েছিল। তার প্রিয় মানুষটা যখন সদ্য বিয়ে করা বউ কে নিয়ে সুখের রাজ্যে পাড়ি জমিয়ে ছিল মেয়েটার তখন কলিজা থেকে রক্ত চুয়ে চুয়ে পড়ছিল। দেখেছিলাম আমি কী এক অসহ্য যন্ত্রণায় কাতরাচ্ছিল মেয়েটা। তার প্রিয় মানুষটা তাকে ধোঁকা দিয়েছিল। কত সুন্দর করে অভিনয় করে ছিল তার সাথে।

তূর্যর কথা গুলো শুনে মাহির যেন আকাশ থেকে পড়ল।

তূর্য মুচকি হেসে বললো জানিস মেয়েটাকে দেখে বুঝাই যেতো না যদি ওকে খুঁটিয়ে না দেখতাম যে মেয়েটার মনে কী ঝড় বয়ে গেছে।

আমি দেখতাম। তার প্রিয় মানুষটা আর তার নতুন বউটা যখন খুব কাছাকাছি এসে হাতে হাত ধরে কথা বলতো মেয়েটা একদৃষ্টে সেই দিকে তাকিয়ে থাকতো। চোখ থেকে তার অঝোরে পানি গড়িয়ে পড়তে ও দেখেছি আমি।মাঝ রাতে ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদতে ও দেখেছি আমি।

তার প্রিয় মানুষটা কে জানিস?

মাহির মাথা নিচু করে বিছানার চাদরের দিকে তাকিয়ে আছে।

তার প্রিয় মানুষটা তুই।
আচ্ছা মাহির তোর কি একটু ও বিবেকে বাঁধেনি? তিন টা বছর মেয়েটার সাথে সম্পর্ক রেখে ও তার প্রতি কী তোর একটুও কষ্ট হয়নি?

মাহির কিছু বলছে না। তূর্য যে সেদিনের সব কথা শুনেছে তা খুব ভালো করেই বুঝতে পারছে মাহির।

সেদিন রাতে ও আমি ছাদে ছিলাম।অনু আমাকে দেখতে পায়নি।
তোর বউ ভাতের দিন যখন তুই ছাদে গিয়েছিলি আমার খটকা লাগে। ছাদের দরজার পাশে দাঁড়িয়ে আমি তোদের সব কথা শুনেছি। আমার ভাই যে এতটা জঘন্য হতে পারে সেদিন অনুর কান্না না দেখলে বুঝতে পারতাম না।
জানিস তনু ভাবির খুব বেশি আদরের বোন মে অনু।সে যদি কোনো দিন জানতে পারে তার এতো আদরের ছোট বোনের সাথে তুই এতো বড় একটা অন্যায় করেছিস । উনি কী তোকে কোনো দিন ক্ষমা করবেন?
কোনো দিন তুই ওনার বিশ্বাস অর্জন করতে পারবি?পারবি কোনো দিন তার ভালোবাসা পেতে?
সংসারে যখন ভালোবাসা, বিশ্বাস, সম্মান কিছুই থাকবে না তখন কী সেই সংসার টিকবে?

ঘৃনা, অবিশ্বাস, ভালোবাসাহীন সম্পর্ক কী কখনো টিকেছে?তনু ভাবির মা আমাকে কি বলে ছিল জানিস?

অনুর যদি সামান্য গা গরম হতো বা জ্বর আসবে আসবে ভাব হতো তনু ভাবির নামাজে দাঁড়িয়ে মোনাজাতে আল্লাহর কাছে কান্না করতো। বোনের অসুখ আসার আগেই ভালো হওয়ার জন্য তিনি মরিয়া হয়ে উঠতেন।

তার এমন আদরের বোনের সাথে তুই যে এত বড় একটা জঘন্য কাজ করেছিস সেটা যদি সে জানে তোর সাথে থাকবে বলে তুই মনে করিস?

মাহির অপরাধী কন্ঠে বললো আমি জানতাম না তনু অনুর বোন।তনু কে আমি ভালোবেসে ফেলেছি।ওরে হারানোর ভয় জাগে আমার মনে। আমি জানি আমি ভুল করেছি। এমন ভুল আর কোনো দিন হবে না রে।

হাহা হা তিন টা বছর তার সাথে সম্পর্ক রেখে তোর বিন্দু মাত্র মায়া টুকু জন্ম নেয়নি সেই তুই এই কয়েক মাসে তনু ভাবিকে ভালো বেসে ফেলেছিস? বিশ্বাস করতে কষ্ট হচ্ছে ভাই।
.
এমন সময় তনু তূর্যর রুমের দরজায় টোকা দেয়।মাহিরের ভয়ে গলা শুকিয়ে গেছে।

কী গো সেই কখন তূর্য ভাইয়া কে ডাকতে আসছো এখন ও বের হচ্ছো না কেন?

মাহির গিয়ে দরজা খুলে দিয়ে বললো
কখন আসছো তুমি এখানে?

এই মাত্র আসছি।কেন বলো তো?

না এমনিতেই। তূর্য রেডি হয়ে আসুক।চলো আমার সাথে। মাহির তনুকে নিয়ে চলে গেল।

দরজার দিকে তাকিয়ে তূর্য মুচকি হাসলো।মাহিরের চোখে আজ সে সত্যিই তনু কে হারানোর ভয় দেখেছে। কিন্তু প্রকৃতির নিয়ম যে বড় কঠিন।অন্যায়ের শাস্তি যে প্রকৃতি মাহির কে দিবে।

চলবে,,,, 🍁