তিক্ততার সম্পর্ক পর্ব-১৫

0
2320

#তিক্ততার_সম্পর্ক
লেখনীতেঃ তাহমিনা তমা
পর্বঃ ১৫

কফির মগ হাতে দাঁড়িয়ে আছে ইমা হঠাৎ ওয়াশরুমের দরজা খোলার শব্দে সেদিকে তাকালো। ইয়াদ শুধু প্যান্ট পরে খালি গায়ে টাওয়েল দিয়ে চুল মুছতে মুছতে বের হলো। ইয়াদকে খালি গায়ে দেখে ইমা কাঁপা-কাঁপি শুরু করে দিলো। এর আগে কখনো কোনো ছেলেকে এমন অবস্থায় দেখেনি তাই একটু বেশি অস্বস্তি হচ্ছে। ইমা ইয়াদের বুকের দিকে তাকিয়ে একটা লোমের অস্তিত্ব খোঁজে পেলো না।

ইমা বিড়বিড় করে বললো, শুনেছি যাদের বুক ভর্তি লোম থাকে তাদের নাকি বুক ভরা দয়ামায়া আর ভালোবাসা থাকে।আমি সবসময় চাইতাম আমার স্বামীর যেনো বুক ভর্তি লোম থাকে আর আমার জন্য থাকে বুক ভরা ভালোবাসা। আপনার বুকে লোম নেই বলেই হয়তো ভালোবাসা তো দূর আপনার একটু দয়ামায়াও নেই।

কথাটা আওড়াতেই ইমার চোখ থেকে টুপ করে এক বিন্দু পানি গড়িয়ে পড়লো। ইমা সাথে সাথে মুছে নিলো সেটা।

কাঁপা গলায় বললো, আ,,,আপনার কফি।

ইমার গলা শুনে ইয়াদ ভ্রু কুঁচকে তার দিকে তাকালো। ইমা দরজার সামনে দাঁড়িয়ে আছে আর হাতে ধোঁয়া উঠা কফির মগ। কপির মগ ইমার হাতে দেখতেই মুখে রাগের আভাস ফুটে উঠলো ইয়াদের, হাতে থাকা হেয়ার ব্রাশটা ড্রেসিংটেবিলের উপর ছুঁড়ে ফেলে দিলো।

রেগে বললো, তুমি ভাবলে কী করে আমি তোমার হাতের কফি খাবো ?

ইমা ভয়ে ভয়ে বললো, ই,,,ইয়ানা আপু আমার হাতে দিয়ে বললো আপনাকে দিতে,,,,,

ইয়াদ রেগে বললো, যার তার হাতের কফি এই আবরার হামিদ ইয়াদ খায় না। সেটা হয়তো তার বোন ভুলে গেছে তাই তোমার হাতে দিয়ে গেছে। দরকার হলে রাস্তার পাশের ফুটপাতের চায়ের দোকান থেকে সবচেয়ে অপ্রিয় জিনিস চা খেয়ে নিবো তবু তোমাদের মতো কোনো মেয়ের হাতের কফি খাবো না। কে বলতে পারে একদিন হয়তো এই কফির মগে বিষ মিশিয়ে খুন করতে পারো।

ইয়াদের কথায় ইমা বিস্ফুরিত চোখে তাকালো ইয়াদের দিকে। ইমার চোখে ভাসছে চরম বিষ্ময় সে কাউকে বিষ দিতে পারে, সেটা কেউ ভাবছে এটা যেনো ইমাকে বিস্ময়ের চরম পর্যায়ে নিয়ে গেলো। ইয়াদ লম্বা কদম ফেলে ইমার সামনে গিয়ে হাতের মগটা নিয়ে সজোরে আছাড় মারলো ফ্লোরে। মগ ভাঙার শব্দে ইমা ভয়ে চমকে উঠলো। কাঁপা-কাঁপি আগের থেকেও বেড়ে গেলো।

ইয়াদ দাঁতে দাঁত চেপে বললো, এই ভাঙা মগ আর পরে যাওয়া কফি নিজের হাতে পরিষ্কার করবে। তোমার হাতে কফির যোগ্যতা এতটুকুই বুঝতে পেরেছো মিসেস আবরার হামিদ ইয়াদ।

পরের কথাটা ইয়াদ তাচ্ছিল্যের সুরে বললো তারপর আবার গিয়ে ড্রেসিংটেবিলের সামনে দাঁড়িয়ে নিজের কাজ করতে লাগলো। ইমা কিছু সময় তার দিকে তাকিয়ে চোখের পানি মুছে ভাঙা মগের টুকরো কুড়াতে লাগলো।

হঠাৎ ইয়াদ বলে উঠলো, আর একটা কথা এই মগ ভাঙার কথা বা এই রুমের কথা যেনো বাইরে না যায় এমন কী আমার বোনের কানেও না। কথাটা মাথায় রেখো মিস ওহ্ সরি মিসেস।

ইমা মাথা নাড়িয়ে হ্যাঁ বুঝালো। অন্যমনস্ক হয়ে ভাঙা টুকরো তুলতে গেলে হাতে লেগে যায় আর ইমা আহ্ করে উঠে। ইয়াদ আগের মতো ভ্রু কুঁচকে তাকায় ইমার দিকে। ডান হাতের তর্জনী আঙ্গুল থেকে লাল রক্তের শ্রোত বয়ে যাচ্ছে। আঙ্গুলটা শক্ত করে চেপে ধরে আছে ইমা। ইয়াদ ইমার দিকে আগানোর জন্য পা বাড়াতে গিয়ে আবার থমকে গেলো। অন্যকারো যন্ত্রণাময় চিৎকার ইয়াদের শান্তির কারণ হয় তাহলে আজ এই মেয়ের হাতের সামান্য রক্ত কেনো এতো বিচলিত করছে ইয়াদের মনকে, সেটা ইয়াদ বুঝতে পারছে না। ইয়াদের মন আর মস্তিষ্কের যুদ্ধ চলছে এখন। মন বলছে অনেক রক্ত বের হচ্ছে গিয়ে সাহায্য কর আর মস্তিষ্ক বলছে এই মেয়ে তোর সামনে মরে যাক তাতে তোর কী ? মস্তিষ্কের কাছে আজ ইয়াদের মন হেরে গেলো কারণ জোরটা মস্তিষ্কের বেশি ছিলো।

আবার ড্রেসিংটেবিলের আয়নার দিকে তাকিয়ে গলায় বিরক্তি ভাব ফুটানোর চেষ্টা করে বললো, এখানে হাত ধরে বসে থেকে নাটক না করে ড্রয়ারে ফাস্টএইড বাক্স আছে ব্যান্ডেজ করে নিয়ে তারাতাড়ি নোংরাটা পরিষ্কার করো৷ অপরিষ্কার অপরিচ্ছন্নতা আমি একদম সয্য করতে পারি না।

ইমা ইয়াদের কথা মতো উঠে দিয়ে বেডের সাইড টেবিলের ড্রয়ার থেকে ফাস্টএইড বাক্স খুজে বের করে সোফায় বসে ব্যান্ডেজ করার চেষ্টা করতে লাগলো। তবে এক হাতে সুবিধা করতে পারছে না। ইয়াদ শার্টের বোতল লাগাচ্ছে আর আড়চোখে ইমার দিকে তাকাচ্ছে। ইমা বারবার চেষ্টা করেও কিছু করতে পারছে না। আঙ্গুলটা বেশ অনেকটা কেটেছে তাই ব্যাথা করছে। ইয়াদ দেখছে ইমা করতে পারছে না তাই বিরক্ত হয়ে নিজে যাওয়ার জন্য আগাতে গিয়েও আবার পিছিয়ে যাচ্ছে।

ভাইয়া ভাবি তোমাদের জন্য সবাই নিচে অপেক্ষা করছে তাড়াতাড়ি এসো।

ইয়ানার গলা শুনে ইয়াদ আর ইমা দরজার দিকে তাকালো। ইয়ানা দরজার সামনে এসে দাঁড়াতেই সোফায় ইমার দিকে চোখ গেলো।

ইমার হাতে রক্ত দেখে ব্যস্ত হয়ে বললো, ভাবি কী হয়েছে তোমার ?

রুমে ঢোকার জন্য পা বাড়াতেই ফ্লোরে ভাঙা মগ নজরে এলো তার।

ইয়ানা ফ্লোরে তাকিয়ে বললো, এটা কীভাবে ভাঙলো ?

ইমা কী বলবে বুঝতে পারছে না ? ইয়ানা একবার ইমার দিকে তাকাচ্ছে আবার ইয়াদের দিকে তাকাচ্ছে।

ইমা কিছু বলবে তার আগেই ইয়াদ বলে উঠলো, আমার হাত থেকে পরে গেছে আর সেটা তুলতে গিয়ে ইমার হাত কেটে গেছে।

ইয়াদ নির্লিপ্ত গলায় বললেও ইয়ানার সন্দেহ হচ্ছে তাই ইয়াদের দিকে ভ্রু কুঁচকে তাকালো। ইয়াদ ডোন্ট কেয়ার ভাব নিয়ে বেডে বসে শো পরতে লাগলো আর তা দেখে ইয়ানা ইমার দিকে এগিয়ে গিয়ে সোফায় বসে ইমার হাত ধরে দেখলো।

ইয়ানা আফসোসের গলায় বললো, ইস কতটা কেটে গেছে। তোমার কী দরকার ছিলো এটা তোলার একটা সার্ভেন্টকে বললেই হতো।

ইয়ানার কথা শুনে ইমা ইয়াদের দিকে তাকালো আর ইয়াদও ইমার দিকে আড়চোখে তাকালো। ইয়ানা মনোযোগ দিয়ে ইমার হাতে ব্যান্ডেজ করে দিতে লাগলো।

ইমা তা দেখে মনে মনে বললো, এতো ভালো বোনের এতো বাজে একটা ভাই কীভাবে সম্ভব ?

ইয়াদ মনে মনে বললো, আমার বোন পুরো আমার বিপরীত কারণ এই পৃথিবীর নির্মম সত্যি আর কুৎসিত চেহারা আমি ওকে দেখতে দেয়নি। সব খারাপ জিনিস ওর চোখের আড়ালে রেখেছি আর তাই এতো সুন্দর ওর মন। নারকেলের শক্ত খোলসটা যদি আমি হই তাহলে ভেতরের নরম অংশটা ইয়ানা। বাইরের পৃথিবীর সব খারাপ জিনিস থেকে শক্ত খোলসটা যেমন ভেতরের নরম অংশটা আড়ালে আগলে রাখে আমিও ইয়ানাকে খারাপ জিনিস থেকে আড়ালে আগলে রেখেছি। ইয়ানার সামনের খারাপ জিনিসের উপর কালো পর্দা দিয়ে রেখেছি। তবে সেটা সরাতে হবে খুব তাড়াতাড়ি কঠিন বাস্তবের সামনাসামনি হতে হবে ইয়ানাকে তার সময় এসে গেছে।

হয়ে গেছে ভাবি এবার নিচে চলো।

ইয়ানার গলার আওয়াজে ইয়াদ ইমা দুজনেরই ভাবনার ইতি ঘটে।

ইয়ানা ইমাকে সোফা থেকে উঠাতে উঠাতে বলে, ভাবি তুমি আমার সাথে চলো আর ভাইয়া তোর হয়ে গেলে তাড়াতাড়ি চলে আসিস।

ইয়াদ ছোট করে বলে, হুম।

ইমা যেতে যেতে বলে উঠে, কিন্তু নোংরাটা পরিষ্কার করা হলো না তো।

ইয়ানা তার উত্তরে বলে, তুমি চলো আমি সার্ভেন্ট পাঠিয়ে দিচ্ছি পরিষ্কার করার জন্য।

ইমার আর কিছু বললো না ইয়ানার সাথে যেতে লাগলো বাইরে এসে হঠাৎ ইয়ানা আবার বললো, ভাবি তুমি বয়সে আমার এক বছরের ছোট আর সম্পর্কে বড় তাই তোমাকে তুমি করে বলছি, তুমি কী রাগ করো এতে ?

ইমা ব্যস্ত হয়ে বললো, এমা না না তা কেনো হবে আপু ? আপনি আমাকে যা ইচ্ছে বলতে পারেন।

ইয়ানা ইনোসেন্ট ফেস করে বললো, আপু বলছো ঠিক আছে কিন্তু আপনি আপনি কেনো করছো নিজেকে বুড়ি বুড়ি মনে হয় তো।

ইমা ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে বললো, তাহলে কী বললো ?

ইয়ানা মুচকি হেঁসে বললো, আপু বলো প্রবলেম নেই কিন্তু আপনি বলা যাবে না তুমি করে বলতে হবে বুঝেছো ?

ইমাও মুচকি হেঁসে বললো, ঠিক আছে।

কথায় কথায় ডাইনিং টেবিলে পৌঁছে গেলো দুজনে। রুবিনা কবির, ইয়াসির হামিদ আর ইশান আগে থেকেই ছিলো টেবিলে।

ইশান ইমাকে দেখে হাসি মুখে বললো, গুড মর্নিং সুইট ভাবি।

ইমাও সৌজন্যমূলক হাসি দিয়ে বললো, গুড মর্নিং ভাইয়া।

ইশান মুখ গুমরা করে বললো, ভাবি আমি তোমার থেকে ছোট তাহলে আমাকে ভাইয়া কেনো বলছো ?
একটা মজার বিষয় দেখেছো ভাবি ? আপু তোমার থেকে একবছরের বড় আবার তুমি আমার থেকে এক বছরের বড় ব্যাপারটা ইন্টারেস্টিং না ?

ইমা ইশানের দিকে তাকিয়ে আছে। এক ভাইয়ের মুখ থেকে কথা বের করতে হলে মনে হয় বোম মারতে হবে আরেক ভাই বলতে শুরু করলে থামতে চায় না। ইমার কাছে সব আজব মনে হচ্ছে।

রুবিনা কবির ইশানকে ধমক দিয়ে বললো, তুমি এতো বেশি কথা বলো কেনো ইশান ? খাওয়ায় মন দাও চুপচাপ।

রুবিনা কবিরের ধমকে ইমা একটু ভয় পেয়ে গেলো কিন্তু রুবিনা সেটা স্থায়ী হতে দিলো না।

ইমার দিকে তাকিয়ে মুচকি হেঁসে বললো, গুড মর্নিং বৌমা।

ইমাও বললো, গুড মর্নিং।

রুবিনা আবার বললো, এখানে তোমার কোনো সমস্যা হচ্ছে না তো ? গতকাল একটু ঝামেলা ছিলো বুঝতেই পারছো তাই তোমার খোঁজ নেওয়ার সময় পাইনি।

ইমা মাথা নিচু করে বললো, না না আমার কোনো সমস্যা হচ্ছে না।

রুবিনা কবির বললো, ঠিক আছে কোনো সমস্যা হলে আমাকে বলবে আর শুনো ইয়াদ, ইয়ানা আর ইশান আমাকে মা বলে ডাকে তাই তুমিও মা বলেই ডেকো কেমন ?

ইমা মনে মনে বললো, আপনার বড় ছেলে আপনাকে মা বলে আর কই ডাকে আসছি পর থেকে তো রুবিনা কবির রুবিনা কবির বলে গলা শুকিয়ে ফেলেছে।

রুবিনার আচরণে তাকে খারাপ মনে হচ্ছে না ইমার কাছে তাই ইয়াদের এতো রাগের কারণ বুঝতে পারছে না। ইমাটা আসলেই বড্ড বোকা তাই বুঝতে পারছে না মানুষ নিজেকে যেমন দেখায় সবসময় সে তেমন হয় না। সবাই টুকটাক কথা বললেও ইয়াসির হামিদ বেশ বিরক্তি নিয়ে চুপচাপ খাচ্ছে। ইমার হাত কাটা কেনো জিজ্ঞেস করলে ইয়ানা সবটা খোলে বলে। সব শুনে রুবিনা চামচ এগিয়ে দেয় খাবার খাওয়ার জন্য। ইয়াদ রেডি হয়ে টেবিলে এসে বসতেই সবাই চুপ হয়ে গেলো আর ইমাও। রুবিনা মাঝে মাঝে ইমাকে জিজ্ঞেস করছে তার কোনো সমস্যা হচ্ছে কী না, কিছু লাগবে কী না। ইয়াদের এসব একদম সয্য হচ্ছে না। রুবিনা কবির ইমার প্রতি যতটা যত্নশীল ব্যবহার করছে ইমার প্রতি ইয়াদের রাগে ততটাই বৃদ্ধি পাচ্ছে। খাওয়া শেষে যে যার কাজে চলে গেলো। ইমা নিজের রুমে চলে গেলো। তার অনেকটা সময় পর ইয়ানা নক করলো।

ভাবি আসবো ?

ইমা বেডে বসে ছিলো উঠে দাঁড়িয়ে বললো, হ্যাঁ আপু আসো।

ইয়ানা রুমে ঢোকে বললো, বিরক্ত করলাম না তো ?

ইমা বললো, আরে না আপু, আমারও বোরিং লাগছিলো একা একা।

ইয়ানা বললো, চলো বেলকনিতে যাই।

ইমা বললো, রোদ লাগবে তো এখন।

ইয়ানা বাইরের দিকে তাকিয়ে বললো, আকাশ মেঘলা আজ চলো।

বেলকনি মানে মিনি ছাদে গিয়ে বসে দুজনেই চুপচাপ অনেক সময় পার করলো।

হঠাৎ ইয়ানা বললো, ভাবি আমি জানি মগটা তখন এমনই এমনই ভাঙেনি ওটা ভাইয়া ভেঙেছে।

ইয়ানার কথায় ইমা চমকে তার দিকে তাকালো ইয়ানাও ইমার দিকে তাকালে ইমা চোখ নামিয়ে নেয়।

ইয়ানা আবার বলে, আমি তোমাকে ভাইয়ার সম্পর্কে কিছু কথা বলতে চাই সেগুলো জানলে হয়তো তোমার জন্য সহজ হবে সম্পর্কটা স্বাভাবিক করতে আর তোমার জানাটাও প্রয়োজন।

চলবে,,,,