তিক্ততার সম্পর্ক পর্ব-৩৯+৪০

0
2010

#তিক্ততার_সম্পর্ক
লেখনীতেঃ তাহমিনা তমা
পর্বঃ ৩৯

নির্জন রাস্তায় পাশাপাশি হাঁটছে ইয়ানা আর রেহান। ইয়ানার দৃষ্টি সামনে থাকলেও রেহানের দৃষ্টি ইয়ানার দিকে। রাস্তাটা একটু বেশি নির্জন, দুপাশে লম্বা লম্বা গাছ মাঝে পিচঢালা কালো কুচকুচে রাস্তা। বেশ কিছু সময় পরপর একটা দুটো গাড়ি শাঁ করে চলে যাচ্ছে পাশ কাটিয়ে। রেহানের গাড়ি রেখে অনেকটা পথ হেঁটে চলে এসেছে তারা।

ইয়ানা, কাউকে ভালোবাসো তুমি ?

হঠাৎ রেহানের এমন কথা শুনে ইয়ানা থমকে দাঁড়ালো। তবে কী রেহান বুঝে গেলো ইয়ানা অন্যকাউকে ভালোবাসে। কিন্তু ইয়ানা তো সেটা কাউকে জানাতে চায় না। রেহান ইয়ানাকে থমকে যেতে দেখে বাঁকা হাসলো।

কী চাও সেটা বুঝতে শেখো ইয়ানা ? মরীচিকার পিছনে ছুটে জীবনের মূল্যবান সময়গুলো নষ্ট করো না। জানো তো, আমাদের জীবন বড্ড বেশি ছোট আবার অনেক বড়। জীবনটা তোমার কাছে ছোট মনে হবে নাকি বড়, সেটা তোমার জীবনের কিছু গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্তের উপর নির্ভর করবে। জীবনটা যদি সুখের হয়, তাহলে মনে হবে খুব তাড়াতাড়ি চলে গেলো সময়গুলো। আর যদি কিছু ভুল সিদ্ধান্ত নিয়ে দুঃখগুলো দু’হাতে আপন করে নাও, তাহলে মনে হবে জীবনের সময়টা থেমে আছে সামনে আগাতেই চাইছে না। জীবনটা তোমার, তাই সিদ্ধান্তটাও তোমাকেই নিতে হবে।

ইয়ানা আবার চলতে শুরু করে বললো, আপনার কেনো মনে হলো আমি কাউকে ভালোবাসি ?

রেহান সামনে তাকিয়ে কষ্ট চেপে হাসি মুখে বললো, ইয়ানা একটা দুটো দিন নয় অনেকগুলো বছর ধরে তোমাকে ভালোবাসি। ভালোবাসার মানুষের না বলা কথাগুলো যদি তার চোখের ভাষায় বুঝতে না পারি, তাহলে কেমন ভালবাসলাম বলো ?

ইয়ানা চুপ করে গেলো রেহানের কথা শুনে। রেহানের বলা সাধারণ কথাগুলো ইয়ানার মনে নাড়া দিয়ে উঠলো।

ইয়ানা তোমাকে আমি অনেক ভালোবাসি। আর ভালোবাসলেই পেতে হবে এমন কোনো আইন নেই। ভালোবাসাটা মনের ব্যাপার আর ভালোবাসার মানুষটাকে পাওয়া ভাগ্যের ব্যাপার। সবসময় মন আর ভাগ্য সাথ দেয় না। তোমার সিদ্ধান্ত যাই হোক আমি বিনাবাক্যে মেনে নিবো। তবে সিদ্ধান্ত নেওয়ার আগে একটু ভেবে নিও। এই সিদ্ধান্তটার উপর তোমার পরবর্তী পুরো জীবনটার সুখ দুঃখ নির্ভর করছে। তবে তোমার সিদ্ধান্তটা যদি আমার পক্ষে হয় আমি কোনোদিন তোমার কাছে জানতে চাইবো না তুমি কাকে ভালোবেসেছিলে। তবে বলতে চাইলে বাধা দিবো না। আর যদি আমার বিপক্ষে হয় বিনা বাক্যে তোমার থেকে অনেক দূরে চলে যাবো।

ইয়ানা উত্তরে কিছুই বললো না। রেহানও চুপ করে হাঁটতে লাগলো। রেহানের খুব ইচ্ছে করছে ইয়ানার হাতটা ধরে হাঁটতে কিন্তু সেই অধিকার সে এখনো পায়নি আর কোনোদিন পাবে কিনা সেটাও জানে না সে। আরো বেশ কিছু সময় হাঁটার পর উল্টো ফিরে গাড়ির দিকে হাঁটতে লাগলো। গাড়ির কাছে আসলে বাসার উদ্দেশ্যে রওনা হলো দুজনেই। রাস্তায় রেহান ইয়ানাকে আইসক্রিম, ফুসকা, চকলেট আরো অনেক কিছু খাওয়ালো। তারপর বাসায় নামিয়ে নিজের গন্তব্যে চলে গেলো। রাতে ইয়াদ বাসায় ফিরলে ইয়ানা নিজের সিদ্ধান্ত জানিয়ে দিলো ইয়াদকে। অনেক ভেবে দেখেছে ইয়ানা, আর নিজের বাকি জীবনটা কেমন হবে সেটাও ঠিক করে নিয়েছে। সত্যি তো ভালোবাসলেই তাকে পেতে হবে এমন কোনো আইন তো নেই।

৩৮.
আরমানের সামনে দাঁড়িয়ে আছে ইয়ানা। আরমান ভ্রু কুঁচকে তাকিয়ে আছে ইয়ানার দিকে আর ইয়ানার দৃষ্টি ফ্লোরে সীমাবদ্ধ।

এতোদিন ভার্সিটি আসোনি কেনো ?

ইয়ানা মলিন গলায় বললো, শুধু এক্সাম দিবো আর ক্লাস করবো না।

আরমান ভ্রু কুঁচকে বললো, কেনো ক্লাস করবে না কেনো ?

ইয়ানা নিজের ব্যাগ থেকে বিয়ের কার্ড বের করে আরমানের দিকে এগিয়ে দিলো। আরমান কিছু সময় ভ্রু কুঁচকে তাকিয়ে থেকে কার্ডটা হাতে নিয়ে খুলে পড়তে লাগলো। কনের জায়গায় ইয়ানার নাম থেকে অবিশ্বাসের চোখে ইয়ানার দিকে তাকালো। ইয়ানার আচরণে আরমানের মনে হয়েছিলো মেয়েটা তাকে পছন্দ করে। কিন্তু হঠাৎ বিয়ের কার্ড হাতে ধরিয়ে দেওয়ায় একটু বেশি অবাক হলো আরমান। তবে সাথে সাথে নিজেকে সামলে কঠিন রুপ ধারণ করলো।

বিয়ে কী পৃথিবীতে তোমার প্রথম হচ্ছে ? আরো অনেক মেয়ে আছে বিয়ের পর পড়াশোনা করছে, জবও করছে।

পড়াশোনা বাদ দিবো তা তো বলিনি স্যার ? ঠিক সময়ে এক্সাম দিয়ে যাবো। আর মাস্টার্সে এসে কেউই রেগুলার ক্লাস করে না খুব একটা। সে যাই হোক স্যার, বিয়েতে চলে আসবেন কিন্তু।

আরমানকে কিছু বলার সুযোগ না দিয়ে ইয়ানা বের হয়ে আসলো। মূলত বিয়ের কার্ড দিতে এসেছিলো আরমানকে আর ফ্রেন্ডদের। আরমানকে দিতে গেলে জেরার মুখে পরতে হয়। আরমান অবাক চোখে তাকিয়ে আছে ইয়ানার যাওয়ার পথে আর ইয়ানা চোখের পানি মুছতে ব্যস্ত। আরমানকে নিজের বিয়ের কার্ড দিয়ে এলো সে, ভাবতেই বুকের ভেতরটা জ্বলে পুড়ে যাচ্ছে ইয়ানার। হ্যাঁ সে রেহানকেই বিয়ে করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। যার মনে তাকে নিয়ে ভালোবাসা তো দূর কোনো ভালোলাগার ফিলিংসটাও নেই তার সাথে জীবন জড়ানোর চাইতে, যে তাকে বুক ভড়া ভালোবাসায় আগলে রাখবে তাকে বেছে নেওয়া ঠিক মনে করেছে ইয়ানা। ইয়ানার চিন্তার মাঝেই তার ফোন বেজে উঠলো। ফোনটা হাতে নিয়ে দেখলো রেহানের নাম্বার। চোখের পানি মুছে গলাটা স্বাভাবিক করে ফোন রিসিভ করে কানে ধরলো। রেহানের সাথে আজ শপিংয়ে যাবে, বিয়ের বেশি দিন বাকি নেই আর।

৩৯.
গ্রামের মেঠো রাস্তা দিয়ে ইয়াদের গাড়িটা এগিয়ে যাচ্ছে হেলেদুলে। রাস্তার করুন অবস্থায় ঝাঁকিতে ইয়াদ ইমার অবস্থাও করুন। বৃষ্টির জন্য রাস্তা আরো বেশী খারাপ হয়ে গেছে। ইয়ানার বিয়ের পনেরো দিন বাকি তাই ইয়াদ ইমাকে গ্রামে নিয়ে এসেছে। সকাল সকাল ব্রেকফাস্ট করে বেড়িয়ে পরেছে এখন বাজে বেলা দশটা। আজ অবশ্য বৃষ্টি নেই, সকাল বেলাতেই সূর্যি মামা নিজের আধিপত্য বিস্তার করে চলেছে।

গাড়ির জানলা দিয়ে আশেপাশে তাকিয়ে ইমা বললো, আর কতক্ষণ লাগবে ?

ইয়াদ ভ্রু কুঁচকে তাকিয়ে বললো, এখানে থেকেছো তুমি, কত সময় লাগবে তুমি ভালো জানো আর এখন জিজ্ঞেস করছো আমাকে ?

ইমা মলিন হেঁসে বললো, বেশ কয়েক বছর হয়ে গেছে এখান থেকে চলে গেছি। অনেক কিছু চেঞ্জ হয়ে গেছে এখন। লাস্ট যখন এসেছিলাম তখন কী আর এসব হুঁশ ছিলো ?

ইয়াদ আর কথা না বাড়িয়ে গাড়ি চালানোয় মনোযোগ দিলো। আরো বেশ কিছুটা সময় পর কাংখিত জায়গায় পৌঁছে গেলো তারা। টিনের বাউন্ডারি দেওয়া বাড়িটায় টিনের গেইট। গাড়ি থেকে নেমে ইয়াদ এদিক ওদিক তাকিয়ে দেখতে লাগলো কেউ আছে কিনা।

ইমা ইয়াদের দিকে তাকিয়ে বিরক্ত হয়ে টিনের গেইটে শব্দ করে বললো, কেউ আছেন ?

ভেতর থেকে কেউ বলে উঠলো, কেডায় ডাকে, কারে চাই ?

এক মাঝারি বয়সী মহিলা গেইট খুলে বাইরে এলো, দেখে অনেকটা ইমার মণির বয়সী লাগছে। মহিলা বাইরে এসে ইমাকে দেখে চুপ মেরে গেলো আর ভালো করে পরখ করতে লাগলো ইমাকে। এদিকে ইয়াদ বিরক্তি নিয়ে তাকিয়ে আছে মহিলার দিকে। মলিন একটা সুতি শাড়ী তার গায়ে।

ইমা একটু গলা পরিষ্কার করে বললো, আমরা একটু ভেতরে যেতাম।

মহিলা গাল ভড়া হাসি দিয়ে বললো, তোমার বাড়িতে তুমি যাওয়ার জন্য, আমার অনুমতি কেনো নিচ্ছো মা ?

মহিলার কথা শুনে ইমা আর ইয়াদ দুজনেই অবাক হয়ে গেলো। মহিলা তার সাথে যেতে বললে ইয়াদ আর ইমা তাকে অনুসরণ করে সামনে আগাতে লাগলো।

ইমা কৌতুহল নিয়ে বললো, আপনি আমাকে চেনেন ?

মহিলা হেসে বললো, ওমা মা বাড়ির মেয়েকে চিনবো না, এটা কেমন কথা ?

কিন্তু আপনি তো আমাকে আগে দেখেননি।

মহিলা হাসি মুখে বললো, আমি জুলেখা বেগম। এই বাড়িতেই থাকি আমি আর আমার উনি। তাই এই বাড়ির সবকিছুই আমরা জানি। তৌহিদুর ভাই বলে গিয়েছেন আপনি কখনো আসলে যাতে আদর আপ্যায়নের কোনো ত্রুটি না থাকে আপনার।

ইমা অবাক হয়ে বললো, উনি কীভাবে জানলেন আমরা এখানে আসবো ?

তা তো বলতে পারবো না, তবে তৌহিদুর ভাই মাঝে মাঝেই এখানে আসে আর আপনার কথা বলে যায়। এই তো দুদিন আগেও এসেছিলো তখনও বলে গেছেন। আপনারা চলুন হাতমুখ ধুয়ে একটু বিশ্রাম নিয়ে নিন।

আমি মায়ের কাছে যাবো একটু।

বাড়ি থেকে একটু দূরে কবরস্থানে কবর দেওয়া হয়েছে ইমার মার আর নানুকে। ইমার বাবা আর নানার কবরও এই একই কবরস্থানে। ইয়াদ ইমার মায়ের কবরটা চেনে তাই ইমাকে নিয়ে বের হয়ে এলো বাড়ি থেকে। একটু হেঁটে পৌঁছে গেলো কবরস্থানে। ইমা ভেতরে গেলো না বাইরে দাঁড়িয়ে তাকিয়ে রইলো কবরটার দিকে। অনায়াসে তাহেরার কবরটা আলাদা করা যায় কারণ কবরটা বাঁধিয়ে দেওয়া হয়েছে আর কবরের উপর অসংখ্য বেলি ফুল ফুটে আছে। দেখে মনে হচ্ছে মাঝে মাঝে কেউ পরিষ্কার করে। নাহলে জঙ্গলে ঢেকে যেতো এই কয়েক মাসে। তাহেরার পাশেই ইমার নানুর কবরটাও আছে। ইমা ইমরুলের কবর চেনে না তাই দেখতে পারলো না, আর চিনিয়ে দেওয়ার মতো কেউও বেঁচে নেই এখন। ইয়াদ ভেতরে গিয়ে কবর জিয়ারত করলো আর ইমা বাইরে থেকে। ইমার চোখের বাঁধ ভেঙে গেছে আজ আবার ইচ্ছে করছে দৌড়ে গিয়ে কবরটা জড়িয়ে ধরে চিৎকার করে কাঁদতে কিন্তু পারছে না। তাই বাইরে দাঁড়িয়েই অশ্রু বিসর্জন দিয়ে যাচ্ছে। কবর জিয়ারত শেষে ইমা আসতে চাইছিলো না তাই জোর করে ইয়াদ নিয়ে এলো। বাড়িতে এসে ইয়াদ আর ইমার চোখ কপালে। এইটুকু সময়ের মধ্যে জুলেখা বেগম অনেক ব্যবস্থা করে ফেলেছে। এখনো লান্সের সময় হয়নি তাই ইয়াদ আর ইমা হালকা খাবার খেয়ে জুলেখার দেখানো রুমে গেলো রেস্ট নিতে। সেখানে গিয়ে ইমা বুঝতে পারলো জুলেখা বেগম কীভাবে তাকে চিনতে পারছে। এই রুমে তৌহিদুর, তাহেরা, ইমা আর তাহের সবারই অনেক ছবি আছে। ইমা রুমটা ভালো করে দেখে বেডে শুয়ে পড়লো আর ইয়াদ উল্টো দিকের বারান্দায় গিয়ে বসলো। দখিনা বাতাস এসে গায়ে লাগছে তার, ঠিক করেছে একটু রেস্ট নিয়ে আবার ফিরে যাবে। অনেক সময় পর রুমে এসে দেখে ইমা ঘুমিয়ে আছে, দুপুরের গরমে ফ্যানের বাতাসেও বিন্দু বিন্দু ঘামের অস্তিত্ব দেখতে পাচ্ছে ইমার সারা মুখে। যা ইমার সৌন্দর্য আরো বেড়ে গেছে অনেক গুণ। বাইরে প্রচুর রোদ, তাই ইয়াদও গিয়ে ইমার পাশে শুয়ে পড়লো। কখন ঘুমিয়ে পড়েছে টেরই পায়নি। গরমে ইমার ঘুম ভেঙে গেলে পাশে তাকিয়ে চমকে গেলো। ইয়াদ ঘুমিয়ে আছে চুপটি করে তবে ঘেমে অবস্থা খারাপ। ইমা সারা রুমে চোখ বুলিয়ে ড্রেসিং টেবিলের পাশে হাত-পা দেখতে পেয়ে উঠে গিয়ে নিয়ে আসলো আর ইয়াদকে বাতাস করতে লাগলো। অনেকটা পথ ড্রাইভ করেছে তাই হয়তো ইয়াদ ক্লান্ত হয়ে গেছে। হঠাৎ বাইরে তৌহিদুর আর তাহেরের গলা শুনে চমকে উঠলো ইমা।

৪০.
ভার্সিটি শেষে আজ তাড়াতাড়ি বাসায় চলে এলো ইশান। ইয়ানা আজ বাসায় একা তাই তাড়াতাড়ি চলে এসেছে। গাড়ি পার্ক করে এসে কলিং বেল বাজিয়ে দাঁড়িয়ে রইলো বাইরে। প্রায় পাঁচ মিনিট পর দরজা খোলে গেলে সামনে তাকিয়ে বুকটা ধক করে উঠলো ইশানের। তার সামনে কথা দাড়িয়ে আছে ভ্রু কুঁচকে। আগের থেকেও আরো বেশী মায়াবতী হয়ে গেছে সে।

ইশান জোরপূর্বক হাসি দিয়ে বললো, কেমন আছেন মিস কথা ?

আলহামদুলিল্লাহ ভালোই ছিলাম এতোক্ষণ, তবে এখন আর হয়তো ভালো থাকা হবে না।

ইশান ভেতরে এসে নিজের রুমের দিকে যেতে যেতে বললো, নিশ্চিন্ত থাকুন কেউ বিরক্ত করবে না আজ।

কথা বেশ অবাক হলো ইশানের আচরণে। আগের ইশান আর এই ইশানের মধ্যে আকাশ পাতাল ব্যবধান। কথা যেনো নিজের চোখকে বিশ্বাস করতে পারছে না। মাত্র কয়েক মাসের ব্যবধানে ইশানের এতো পরিবর্তন ? কথার মনে প্রশ্ন আসছে ইশান সত্যি তাকে ভালোবাসতো নাকি,,,,?

চলবে,,,

#তিক্ততার_সম্পর্ক
লেখনীতেঃ তাহমিনা তমা
পর্বঃ ৪০

কথা মেইন ডোরের সামনে দাঁড়িয়ে ইশানের যাওয়ার দিকে তাকিয়ে আছে। চোখে খেলছে হাজারো প্রশ্ন।

কী হলো কথা এখানে দাঁড়িয়ে আছো কেনো ?

কথার উত্তর না পেয়ে ইয়ানা কথার দৃষ্টি অনুসরণ করে তাকালে ইশানকে নিজের রুমে চলে যেতে দেখলো আর তা দেখে দীর্ঘ শ্বাস ছাড়লো।

কথা ওখানে দাঁড়িয়ে না থেকে এদিকে আসো।

ইয়ানা গলা উঁচু করে কথাটা বললে কথা ঘুরে তাকায় ইয়ানার দিকে।

কথা ইশানের রুমের দিকে তাকিয়ে ইয়ানার দিকে এগিয়ে যেতে যেতে বললো, ইয়ানা আপু এটা কোন ইশান ভাইয়া ? উনি তো একদমই এমন ছিলেন না।

ইয়ানা দীর্ঘ শ্বাস ছেড়ে বললো, পরিস্থিতি মানুষকে একদমই পাল্টে দেয় কথা। তবে আমি চাই ইশান আগের মতো হয়ে যাক। ওকে এমন রুপে মানায় না, ও হাসি মুখটাই ভালো লাগে।

কথা কৌতুহল নিয়ে জিজ্ঞেস করে, ইশান ভাইয়া হঠাৎ এমন হলো কীভাবে ?

ইয়ানা মুখটা মলিন করে কথাকে সব খুলে বললো এই কয়েক মাসে কী কী হয়ে গেছে। সব শুনে কথার চোখের বাঁধ ভেঙে গেছে। এই মানুষগুলো কত কষ্ট সহ্য করে গেছে। ইয়ানা আবার অন্য টপিক নিয়ে কথা বলছে তবে কথার ভাবনায় এখনো ইশান। সত্যি তাকে এভাবে একদম মানায় না। তাকে আগের রুপেই মানায়।

৪১.
ইমা তৌহিদুর আর তাহেরের গলা শুনে বেড থেকে নেমে বাইরের উদ্দেশ্যে পা বাড়ালো। ধীর পায়ে বাইরে বের হয়ে ইমার চোখ কপালে। উঠান ভর্তি বাজার আর সেগুলো তৌহিদুর বুঝিয়ে দিচ্ছে জুলেখা বেগমকে।

তৌহিদুর হাসি মুখে বললো, বুঝলে জুলেখা আমার মেয়ে আর মেয়ে জামাই প্রথম এসেছে এভাবে। কোনো কিছুর যাতে কমতি না থাকে। এখানে সব নিয়ে এসেছি আর কিছু প্রয়োজন হলে বলো আবার গিয়ে নিয়ে আসছি।

জুলেখা সব দেখে বললো, না ভাইজান আর কিছুর দরকার নাই আমি এখনই রান্না শুরু কইরা দিতাছি। মানিকের মাইরে খবর দিছি এখনই চইলা আইবো। ওই আইলে পিঠা বানানোও শুরু কইরা দিমু।

তৌহিদুর রুমের দিকে এগোতে এগোতে বললো, হ্যাঁ তাড়াতাড়ি করো, জামাই ঘুম থেকে উঠার আগে সব রেডি করে ফেলো।

ইমাকে দেখে তৌহিদুর থেমে গেলো। তাহের ইমাকে এখনো দেখেনি। সে পুকুরের তাজা মাছ দেখতে ব্যস্ত। জুলেখার স্বামী জমির মিয়া পুকুর থেকে তাজা রুই মাছ ধরে এনেছে, ইমা আর ইয়াদের জন্য। তৌহিদুর আর তাহের যাবতীয় বাজার আর গরুর মাংস নিয়ে এসেছে৷ সাথে বাড়ির দেশি মুরগী জবাই করা হয়েছে।

তৌহিদুর আদর মাখা গলায় হাসি মুখে বললো, কেমন আছিস মা ?

ইমার বুকে যেনো প্রশান্তির বাতাস বয়ে গেলো তৌহিদুরের মুখে মা ডাক শুনে। মনে হচ্ছে নিজের বাবাই তাকে মা বলে ডেকেছে।

ইমা থতমত খেয়ে বললো, আসসালামু আলাইকুম।

ওয়ালাইকুম আসসালাম, বললি না যে কেমন আছিস মা ?

ইমা আগের মতোই থতমত খেয়ে বললো, আলহামদুলিল্লাহ ভালো আছি, আপনারা কেমন আছেন ?

তৌহিদুর মুখ ভরে হাসি দিয়ে বললো, তোকে দেখে একদম ভালো হয়ে গেছি রে মা। তা জামাই কেমন আছে ?

সেও ভালো আছেন।

ঠিক আছে তুইও গিয়ে একটু রেস্ট নিয়ে নে, রান্না হয়ে গেলে সবাই একসাথে খেয়ে নিবো।

তৌহিদুর কথাটা বলে নিজের রুমের দিকে যেতে গেলে ইমা পেছন থেকে ভাঙা গলায় বললো, বাবা ?

ইমার ভাঙা গলায় বাবা ডাকটা যেনো তৌহিদুরের কানে বারবার প্রতিধ্বনি হতে লাগলো। সে নিজের কানকে বিশ্বাস করতে পারছে না। যে ডাকটা শোনার জন্য এতোগুলা বছর ধরে সে ভেতরে ভেতরে তড়পাচ্ছিলো সেই ডাকটা সে শুনতে পেলো ? তৌহিদুর ভাবলো সে ভুল শুনেছে তাই ঘুরে তাকালো ইমার দিকে।

মা তুই কিছু বললি আমাকে।

ইমা আমতা আমতা করে বললো, হ্যাঁ বাবা আমি বলছিলাম তোমরা হঠাৎ এখানে কীভাবে ?

ইমার বাকি কথাটা তৌহিদুরের কানে যায়নি সে শুধু শুনেছে বাবা ডাকটা। চোখ থেকে টপটপ পানি পরতে লাগলো তার। কষ্টের নয় সুখের পানি, পরম আনন্দের পানি এটা।

চোখ মুছে বললো, আর একবার বাবা বলবি ?

ইমার চোখেও পানি চলে এসেছে। ইমা দৌড়ে গিয়ে তৌহিদুরের বুকে আছড়ে পড়লো।

ফুপিয়ে কাঁদতে কাঁদতে বললো, আমাকে মাফ করে দাও বাবা। না বুঝে তোমাকে অনেক কষ্ট দিয়ে ফেলেছি। তুমি মাফ না করলে সারাজীবন পাপের বোঝা মাথায় নিয়ে ঘুরতে হবে আমাকে।

তৌহিদুর ইমার মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে বললো, বাবা কখনো তার মেয়ের উপর রাগ করে না রে মা। বাবাদের কাছে মেয়ে হচ্ছে তার আরেক মা। আমি তোর উপর একটুও রেগে নেই। একটু অভিমান ছিলো তুই বাবা বলে জড়িয়ে ধরার সাথে সাথে সেই অভিমান টুকুনও মুছে গেছে।

ইমা মাথা তুলে তৌহিদুরের দিকে তাকিয়ে বললো, সত্যি তো রেগে নেই ?

তৌহিদুর মেয়ের কপালে চুমু খেয়ে বললো, হ্যাঁ রে মা একদম ঠিক।

এতোক্ষণ বাবা আর বোনের দিকে তাকিয়ে ছিলো তাহের। চোখে পানি চলে এসেছে তার।

ঝটপট চোখের পানি মুছে বললো, আমিও কিন্তু আছি এখানে সেটা ভুলে যেও না দু’জনে।

তৌহিদুর এক হাত বাড়িয়ে দিলে তাহেরও গিয়ে বাবা আর বোনকে একসাথে জড়িয়ে ধরলো। তৌহিদুরের বুকটা আজ ভরে গেছে৷ আজ তার দুই সন্তানকেই পেয়ে গেছে। আজ তৌহিদুরের নিজেকে সৌভাগ্যবান মনে হচ্ছে। অনেক সময় পার হয়ে গেলে সবাই নিজেকে সামলে নিয়ে সরে দাঁড়ালো।

ইমা বললো, তোমরা এখানে কীভাবে, বললে না তো ?

তাহের বললো, তোরা আসার পর সাথে সাথে জমির কাকা, বাবাকে কল করে জানিয়েছে। বাবা এক মুহূর্ত না দাঁড়িয়ে আমাকে নিয়ে চলে আসলো। তুই আর দুলাভাই প্রথম এভাবে আসলি আমরা না আসলে হয় নাকি।

ইমা ছোট করে বললো, ওহ্ তা এতো তাড়াতাড়ি চলে আসলি কীভাবে ?

তাহের হেঁসে বললো, আর বলিস না গাড়িকে আজ রকেটের মতো চালিয়ে এসেছি। অন্য সময় এতো স্প্রিডে ড্রাইভ করলে বাবা বকে দেয় আর আজ বলছিলো আরো একটু তাড়াতাড়ি চালাতে।

ইমা অবাক হয়ে বললো, বাবা এমনটা কেউ করে, কোনো দুর্ঘটনা ঘটে গেলে কী হতো ?

তৌহিদুর হাসি মুখে বললো, কিছু হবে না রে মা।

তাহের এদিক ওদিক তাকিয়ে বললো, তো আপু দুলাভাই কোথায় ?

ইমা রুমের দিকে তাকিয়ে বললো, ঘুমিয়ে পড়েছে।

তৌহিদুর বললো, তুইও গিয়ে একটু রেস্ট নে, লান্সের সময় হয়ে গেছে প্রায়।

না বাবা, তুমি যে কাজ করতে বলেছো জুলেখা চাচিকে, সে একা পারবে না আমি গিয়ে একটু হেল্প করি।

তৌহিদুর ব্যস্ত গলায় বললো, না তার দরকার নেই। জুলেখা একাই সব করে নিবে আর মানিকের মাকে নাকি আসতে বলেছে।

ইমা রান্নাঘরের দিকে যেতে যেতে বললো, সমস্যা নেই আমি গিয়ে হেল্প করছি।

ঠিক আছে যা, তবে সাবধানে কাজ করিস এখানে কিন্তু মাটির চুলোয় রান্না করে জুলেখা।

ইমা মাথা নাড়িয়ে ঠিক আছে বুঝিয়ে চলে গেলো রান্নাঘরের দিকে আর তার পিছু পিছু তাহের গিয়ে একটা টুলে বসলো রান্নাঘরের বাইরে। জুলেখা না করলেও ইমা জোর করে হেল্প করতে লাগলো জুলেখাকে।

তাহের বললো, আপু বিকেলে গ্রাম দেখতে বের হবো কিন্তু। দুলাভাই তো আগে গ্রাম দেখেনি।

ইমা সবজি কাটতে কাটতে বললো, কিন্তু তোর দুলাভাই তো বলেছে রোদ একটু কমে এলেই ঢাকার উদ্দেশ্যে রওনা হবে।

কী বলছিস, আজ কিছুতেই যাওয়া হবে না। আগামীকাল বিকেলে যেতে পারবি। বাবা তোদের জন্য দুদিনের ছুটি নিয়ে এসেছে।

ইমা চিন্তিত হয়ে বললো, ঠিক আছে তোর ভাইয়াকে বলে দেখছি কী বলে।

বলা বলির কিছু নেই আগামীকালের আগে যাওয়ার কথা বলে লাভ নেই।

গল্প করতে করতে রান্নাবান্না শেষ হয়ে গেলো। এদিকে ইয়াদের ঘুম ভাঙলে চোখ বন্ধ করেই পাশে হাতড়ে ইমাকে খুঁজে না পেয়ে ফট করে তাকালো। সারারুমেও ইমাকে না পেয়ে উঠে বসলো। তখনই দরজা খোলে ইমা রুমে এলো।

ইমা ইয়াদকে বসে থাকতে দেখে বললো, আপনার ঘুম ভেঙে গেছে ? আবার কী শাওয়ার নিবেন ?

ইয়াদ চোখ কচলে বললো, বাসায় গিয়ে নেবো শাওয়ার। তুমি রেডি হয়ে নাও আমরা এখনই রওনা দেবো।

ইমা রুমের আলমারি খুলে শাড়ী বের করতে করতে বললো, আজ আমরা বাসায় যাচ্ছি না।

ইয়াদ বড়বড় চোখে তাকিয়ে বললো, ইমা আমি কিন্তু আগেই বলেছিলাম থাকার বায়না করা যাবে না। এখানে নেটওয়ার্ক প্রবলেম আমি অফিসের কাজগুলোও করতে পারবো না।

ইমা শাড়ী বের করে বললো, আমাকে বলে লাভ নেই বাবা আর তাহের এসেছে। তারা আজ কিছুতেই যেতে দিবে না।

ইয়াদ অবাক হয়ে তাকালো ইমার দিকে। কিছু সময় পর ইমার কথার মানে বুঝতে পারলো। এরা আবার কখন আসলো সেটা বুঝতে পারছে না ইয়াদ।

তারা কখন আসলো আর হঠাৎ ?

আমরা এসেছি শুনেই এসেছে আর আপনি যখন ঘুমিয়ে ছিলেন তখন এসেছে।

ইয়াদ থম মেরে বসে রইলো তা দেখে ইমা তারা দিয়ে বললো, কী হলো শাওয়ার নিবেন নাকি বলছেন না কেনো ?

ইয়াদ বিরক্ত হয়ে বললো, শাওয়ার নিয়ে পড়বো টা কী শুনি ?

কেনো, তাহেরের প্যান্ট আর পাঞ্জাবি পরে নিবেন। তাহের কিন্তু আপনার থেকে কম যায় না, ওরটা আপনার হয়ে যাবে আর নতুনগুলোই এনে দিচ্ছি, যেগুলো তাহের পড়েনি আগে।

ইয়াদের উত্তরের অপেক্ষা না করে ইমা বের হয়ে গেলো। তৌহিদুর প্রতি ঈদে তাহেরের জন্য নতুন ড্রেস কেনার সাথে ইমার জন্যও কিনতো। গ্রামে ঈদ করায় ইমার জন্য কেনা সব ড্রেস ইমার বরাদ্দকৃত রুমের আলমারিতেই সাজিয়ে রাখতো তাহেরা। ইমা সেই ড্রেসগুলোর মধ্যেই একটা শাড়ী বের করে নিয়ে গেছে শাওয়ার নেওয়ার জন্য। শাওয়ার শেষ করে এসে ইয়াদকে তাহেরের একটা নতুন প্যান্ট আর পাঞ্জাবি বের হাতে ধরিয়ে দিলো। ইয়াদও বাধ্য হয়ে শাওয়ার নিয়ে এলো। এখানে ওয়াশরুম বাইরে, রুমের সাথে না। তাহেরের প্যান্ট আর পাঞ্জাবি ভালো মতোই হয়ে গেছে ইয়াদের। লান্স করতে এসে ইয়াদের চোখ কপালে। টেবিল ভর্তি নানা আইটেমের খাবার সাজানো যার অনেকগুলোর নামও জানে না ইয়াদ।

ইমা ইয়াদের কানের কাছে ফিসফিস করে বললো, আপনার না আফসোস ছিলো, কখনো শশুর বাড়ির জামাই আদর পাবেন না। এবার বুঝবেন জামাই আদর কাকে বলে।

ইয়াদ অসহায় দৃষ্টিতে তাকালো ইমার দিকে আর তা দেখে ইমা দুষ্টু হাসলো। তখনই তৌহিদুর এসে বসলো একটা চেয়ার টেনে তার সাথেই তাহের।

কেমন আছো ইয়াদ বাবা ?

হঠাৎ প্রশ্ন করায় প্রথমে চমকে উঠলো ইয়াদ পরক্ষণে নিজেকে সামলে বললো, আসসালামু আলাইকুম আঙ্কেল ?

ওয়ালাইকুম আসসালাম।

আলহামদুলিল্লাহ আল্লাহ ভালো রেখেছেন আপনারা কেমন আছেন ?

আলহামদুলিল্লাহ আমরাও ভালো আছি। তো বাবা শুরু করো, সব কিন্তু গ্রামের টাটকা খাবার।

ইয়াদ জী বলতেই ইমা খাবার দিতে লাগলো সবাইকে। ইয়াদ একটা শেষ করে উঠার আগেই তৌহিদুর আরেকটা দিতে বলছে ইমাকে। আর ইমাও বাধ্য মেয়ের মতো বাবার কথা শুনছে। ইয়াদ বারবার না করে যাচ্ছে আর ইমা বাবার কথায় দিয়েই যাচ্ছে। ইয়াদ এবার কটমট করে তাকালো ইমার দিকে। তাতে ইমা ভয়ে ঢোক গিললো আর বাবাকে বুঝিয়ে বললো ইয়াদ আর পারবে না, সবাইকে দিয়ে ইমাও সাথে বসে পড়লো খেতে। সবার খাওয়া শেষে ইয়াদ রুমে গিয়ে ধপাস করে বেডে শুয়ে পড়লো। জামাই আদর কাকে বলে সত্যি আজ হাড়ে হাড়ে টের পেয়েছে ইয়াদ। ইমা সব গুছিয়ে রুমে এসে দেখে ইয়াদ চোখ বন্ধ করে শুয়ে আছে। ধীর পায়ে ইয়াদের দিকে এগিয়ে কাছে গিয়ে দাঁড়াতেই এক টানে ইয়াদ ইমাকে বেডে ফেলে দিলো। ইমার উপর উঠে দুহাত দুপাশে বেডের সাথে চেপে ধরে ফেললো।

ইয়াদ কড়া গলায় বললো, তখন এমন করেছিলে কেনো ? আমি না করার পরও দিয়েই যাচ্ছিলে।

ইমা আমতা আমতা করে বললো, বাবা দিতে বলছিলো, আমি কী করতাম ?

ইশ কী আমার বাপের বাধ্য মেয়ে এসেছেন। আমি জীবনেও এতো খাবার খায়নি আজ একসাথে যতটা খেয়েছি।

ইমা মুচকি হেঁসে বললো, একেই বলে জামাই আদর বুঝেছেন ? আপনার আর আফসোস করতে হবে না কখনো। চাইলেই এমন জামাই আদর পেয়ে যাবেন। একটু পর জুলেখা চাচি পিঠা বানাবে বিভিন্ন আইটেমের সেগুলোও খাবেন।

ইয়াদ ইমাকে ছেড়ে বেডে শুয়ে পড়ে বললো, ইম্পসিবল, যে খাবার খেয়েছি তাতে মনে হচ্ছে আগামী দুদিন আর খেতে হবে না। তবে একটা কথা না বলে পারছি না। তোমার জুলেখা চাচির রান্নার হাত অতুলনীয়।

৪২.
ইশান প্লেটের দিকে তাকিয়ে চুপচাপ খেয়ে যাচ্ছে আর কথা ইশানের দিকে তাকিয়ে খাচ্ছে। ইয়ানার খাওয়া আগে শেষ হয়ে গেলে সে নিজের রুমে চলে গেলো। টেবিলে রয়ে গেলো শুধু কথা আর ইশান। অন্য সময় হলে ইশানের বকবকানিতে কথা বিরক্ত হয়ে যেতো আর আজ ইশানের চুপ করে থাকায় কথা বিরক্ত হয়ে যাচ্ছে।

কথা বললে কী আপনাকে মৃত্যুদন্ড দেওয়া হবে ?

ইশানের দিকে তাকিয়ে কথা প্রশ্নটা করতেই ইশানের হাত থেমে গেলো। কথা প্রশ্নের উত্তর পাওয়ার জন্য ইশানের দিকে তাকিয়ে আছে তবে ইশানের দৃষ্টি আগের জায়গাতেই সীমাবদ্ধ।

ইশান শান্ত গলায় বললো, হয়তো মৃত্যুদন্ডের থেকেও কঠিন কোনো শাস্তি হবে।

এটুকু বলেই ইশান আবার খেতে লাগলো। কথা যদি ইশানের মনের ভেতরটা দেখতে পেতো তাহলে জানতে পারতো সামনে বসে থাকা মানুষটা তার সাথে কথা বলার জন্য কতটা ছটফট করছে প্রতিটা মুহূর্তে। অন্যদিকে কথা প্রচন্ড মিস করছে আগের ইশানের সেই দুষ্টুমিগুলো। এখন কথা বুঝতে পারছে সেই হাসিখুশি ইশানকে তার কতটা ভালো লাগে। কথা মনে মনে ঠিক করলো ইশানকে সে আবার আগের মতো করেই ছাড়বে। আনমনে খেতে গিয়ে হাতে মাছের কাটা ফোটে গেলো কথার।

আহ্,,,,,

কথার মৃদু চিৎকারে ইশান তাকালো কথার দিকে। কথা আঙুলের দিকে তাকিয়ে আছে, আঙ্গুলের ডগায় রক্ত বের হয়ে গেছে। ইশান উঠে গিয়ে কথার এঁটো আঙ্গুলটা মুখে পুরে নিলো।

কথা চমকে উঠে বললো, আরে আরে কী করছেন এটা আপনি ? ছিহ্ আমার এঁটো আঙ্গুল মুখে পুরলেন কেনো ?

ইশান ইশারায় কথাকে চুপ করতে বলে ঠোঁট দিয়ে কথার আঙ্গুল চেপে ধরে রেখেছে। ইশান হঠাৎ কথার আঙ্গুলটা শুষে নিলে কথা শিউরে উঠলো। এক দৃষ্টিতে তাকালো ইশানের দিকে, কথা সারা শরীর কাটা দিয়ে উঠেছে।

ইশান মুখ থেকে আঙ্গুল বের করে ধমক দিয়ে বললো, সাবধানে খাওয়া যায় না ? মাছের কাটা বাছতে পারো না বললেই হতো, আমি বেছে দিলাম। আর নাহলে চিকেন বা অন্যকিছু দিয়ে খেতে, যেটা পারো না সেটা করতে যাও কেনো ? এখন যদি হাতে না বিঁধে কাটা গলায় বিঁধে যেতো।

ইশানের ব্যস্ত গলায় শাসন দেখে কথা অবাক হয়ে তাকিয়ে আছে ইশানের দিকে। এটুকুর জন্য এতো শাসন ? এতক্ষণ জোর করে কথা বলানো যাচ্ছিলো না আর এখন কথা একটু আহ্ বলতেই নিজের খোলস ছেড়ে বেড়িয়ে এলো। কথা ইশানের চোখে নিজের জন্য অঢেল ভালোবাসা দেখতে পাচ্ছে। নিজেকে নিয়ে ইশানকে ভাবতে দেখছে।

আপনি কী সত্যি ভালোবাসেন এই শ্যামবর্ণ, আনস্মার্ট, গেয়ো মেয়েটাকে ?

কথার মুখে হঠাৎ এমন প্রশ্ন শুনে ইশানের হুঁশ ফিরে সে এতক্ষণ কী করছিলো। এবার না সরে আসতে পারছে আর না কথার পাশে থাকতে পারছে। আর প্রশ্নের উত্তরটা কী দেবে দু-টানায় পরে গেছে সে।

চলবে,,,,,,