তিক্ততার সম্পর্ক পর্ব-৪৭

0
2244

#তিক্ততার_সম্পর্ক
লেখনীতেঃ তাহমিনা তমা
পর্বঃ ৪৭

ইমা সারাদিনে কাজে মন বসাতে পারলো না ইয়াদ তাকে কী সারপ্রাইজ দেবে সেটা ভেবে। ইয়াদ রাত আটটায় বাসায় চলে আসলো এক গাদা শপিং নিয়ে, ইমা হা করে তাকিয়ে আছে শুধু।

ইমা বিরক্ত গলায় বললো, এটাই কী সারপ্রাইজ ?

ইয়াদ বোকার মতো হাসি দিয়ে বললো, হ্যাঁ এটাই তোমার সারপ্রাইজ। তুমি তো শপিং করতে পছন্দ করো না তাই আমি তোমার জন্য শপিং করে নিয়ে এসেছি।

ইমা শপিং ব্যাগের কাছে গিয়ে বললো, হাসিটা আপনার উপর একদমই মানায়নি। দ্রুত ফ্রেশ হয়ে আসুন আমি আপনার খাবার দিচ্ছি।

কথাটা শোনার সাথে সাথে ইয়াদ হাসি বন্ধ করে দিলো আর বললো, আজকে বাইরে খাবো।

ইমা ইয়াদের দিকে তাকিয়ে বললো, আচ্ছা বাইরে খাবেন, তাহলে আমি যে খাবারগুলো রান্না করলাম সেগুলো ফেলে দিবো ?

ইয়াদ বুঝতে পারলো ইমার একদমই পছন্দ হয়নি ইয়াদের সারপ্রাইজ তাই চটে গেছে।

ওয়াশরুমে যেতে যেতে বললো, এখানে একটা নীল শাড়ি আছে সেটা পড়ে রেডি হয়ে নাও।

ইমাকে কিছু বলার সুযোগ না দিয়ে ইয়াদ ওয়াশরুমে ঢুকে গেলো। ইমা একটা একটা প্যাকেট খুলছে আর অবাক হচ্ছে।

একটা লেডিস কোট উঁচু করে ধরে ভ্রু কুঁচকে বললো, বাংলাদেশে আবার এতো শীত পড়তে শুরু করলো কবে থেকে ? আর এই গরমের দিনে এমন শীতের পোশাক আনার মানে কী ? লোকটা নিশ্চিত পাগল হয়ে গেছে।

অবশেষে নীল শাড়ীটা পেয়ে গেলো। শাড়ীটা দেখে ইয়াদের পছন্দের প্রশংসা না করে পারলো না ইমা। তবে শাড়ীটা অনেক বেশি পাতলা, সেটা খেয়াল করে ইমার রাগ হলো।

উল্টে পাল্টে দেখে বললো, এটা পরে আমি বাইরে যাবো খেতে ?

ইয়াদ ওয়াশরুম থেকে বের হয়ে ইমার কথাটা শুনতে পেলো আর টাওয়েল দিয়ে মাথা মুছতে মুছতে বললো, যেটা করতে বলেছি সেটা করো বাকিটা আমি বুঝে নিবো। আর হ্যাঁ হিজাব পড়বে না, চুল খোঁপা করবে। একটা বেলি ফুলের মালা আছে দেখো। সেটা দিবে আর যা যা আছে ব্যাগে সব দিয়ে সাজবে।

ইমা সন্দেহের চোখে তাকিয়ে বললো, ব্যাপার কী বলুন তো ?

ইয়াদ থতমত খেয়ে বললো, বললাম তো বাইরে যাবো খেতে।

ইয়াদ ড্রেসিং টেবিলের সামনে দাঁড়িয়ে চুল মুছতে লাগলো আর ইমা সেদিকে তাকিয়ে বললো, আপনি এখন আবার শাওয়ার নিয়েছেন কেনো ?

ইয়াদ চুল ব্রাশ করতে করতে বললো, তোমার শপিং করতে করতে ঘাম ছুটে গিয়েছিলো আমার।

আপনাকে কে বলেছে আমার জন্য এমন উদ্ভট পোশাক নিয়ে আসতে।

সময় হলে ঠিক বুঝতে পারবে কেনো এনেছি। এখন বকবক না করে রেডি হয়ে নাও। আমি পাশের রুমে যাচ্ছি রেডি হতে।

ইমা কিছু বলার আগেই ইয়াদ বের হয়ে গেলো। ইমাও বক বক করে রেডি হতে লাগলো। নীল শাড়ি, খোপা করা চুলে সাদা বেলি ফুলের মালা, মুখে হালকা মেকআপ, চোখে গাড়ো কাজল, ঠোঁটে হালকা গোলাপি লিপস্টিক, ডায়মন্ডের সিম্পল জুয়েলারি। পুরোপুরি রেডি হয়ে ইমা আয়নায় নিজেকে দেখতে লাগলো। কখনো এভাবে সাজা হয়নি ইমার তাই নিজেকে নিজেই চিনতে পারছে না। ইমার ফোনে ম্যাসেজের আওয়াজ আসতেই ইমা পাশে থেকে ফোনটা হাতে নিয়ে দেখে ইয়াদের ম্যাসেজ।

নিচে আসো আমি গাড়িতেই আছি।

ইমা মুচকি হেঁসে নিজেকে আর একবার আয়নায় দেখে বের হয়ে গেলো রুম থেকে। এভাবে সেজে বাইরে আসতেই ইমার অস্বস্তি হচ্ছিলো কিন্তু বাইরে এসে বেশ অবাক হলো। একজন সার্ভেন্টও নেই আশেপাশে। বাড়ি থেকে বের হয়ে আরো অবাক হলো বাইরে কোনো গার্ডও দেখা যাচ্ছে না। সামনে তাকিয়ে ইমার চোখ আটকে গেলো। নীল পাঞ্জাবির সাথে কালো জিন্স প্যান্ট, গায়ের সাথে একদম ফিট হয়ে গেছে পাঞ্জাবি, হাতা কনুই পর্যন্ত গুটিয়ে রাখা, চুলগুলো বরাবরের মতো জেল দিয়ে সেট করা, ঠোঁটের কোণে মুচকি হাসি। যে হাসিতে বার বার ঘায়েল হয় ইমা। ছোট খাটো একটা ঢোক গিললো। এদিকে ইয়াদ মুগ্ধ হয়ে তাকিয়ে দেখছে নিজের ভালোবাসাকে।

ইয়াদ মনে মনে বললো, আজ তোমার সেদিনের সব প্রশ্নের উত্তর দেবো আমি।

ইমা ধীর পায়ে এগিয়ে এসে বললো, চলুন।

ইয়াদ ইমার জন্য গাড়ির দরজা খোলে দিলে ইমা আস্তে করে উঠে বসলো। ইয়াদ দরজা আঁটকে দিয়ে নিজে ড্রাইভিং সীটে গিয়ে বসে পড়লো।

ইমার দিকে তাকিয়ে একবার মুচকি হেঁসে বললো, ইউ আর লুকিং হট।

ইমার কান দিয়ে গরম ধোঁয়া বের হচ্ছে ইয়াদের কথা শুনে। ইমা যতটা সম্ভব নিজেকে ঢাকার চেষ্টা করেছে শাড়িটা দিয়ে৷ কিন্তু শাড়ীটা একটু বেশি পাতলা মনে হচ্ছে ইমার কাছে। ইমা লজ্জায় মাথা নিচু করে ফেললো। ইমার এটুকু বিশ্বাস আছে ইয়াদ তাকে এই শাড়ীতে বাইরের মানুষের সামনে নিবে না আর সেই বিশ্বাস থেকেই শাড়ীটা পড়ে বের হয়েছে। এখন পর্যন্ত ইমাকে ইয়াদ ছাড়া কেউ দেখেনি। এতে ইমার বিশ্বাসটা আরো দৃঢ় হয়েছে।

ইমা বাইরে তাকিয়ে বললো, আমরা কোথায় যাচ্ছি এখন ?

ইয়াদ ইমার দিকে একবার তাকিয়ে বললো, লং ড্রাইভে যাচ্ছি।

না খেয়ে লং ড্রাইভে ?

ইয়াদ ব্যস্ত হয়ে বললো, কেনো তোমার ক্ষুধা পেয়েছে ?

না আমারও তো আপনার সাথে রাত এগারোটা বারোটায় খাওয়ার অভ্যেস হয়ে গেছে।

ইয়াদ ছোট ছোট চোখে তাকিয়ে বললো, মিথ্যা কেনো বলছো ? আমি তো এখন দশটার আগেই বাসায় চলে আসি।

ইমা দাঁত বের করা হাসি দিয়ে বললো, সেটা তো মাঝে মাঝে।

উল্টো কেনো বলছো তুমি ? মাঝে মাঝে একটু বেশি রাত হয়ে যায় আর প্রায় তো তাড়াতাড়ি চলে আসি এখন।

তার মানে আমি মিথ্যা বলছি ?

মিথ্যা না তুমি একটু উল্টো বলছো ?

এটা নিয়ে দুজনের ঝগড়া শুরু হয়ে গেলো আর শেষমেষ ইয়াদ সরি বলে নিজের দোষ মেনে নিলো সবটা। ইমা তো বিশ্ব জয় করা খুশি হলো। ইয়াদ ইমাকে নিয়ে শহর থেকে অনেকটা দূরে চলে এসেছে। একটা বড় বীজের সামনে এসে গাড়ি থামলো ইয়াদ। ইমাকে গাড়িতে বসতে বলে নিজে নেমে গেলো আর একটু পর আইসক্রিম নিয়ে ফিরে এলো। ইয়াদ ধীরে ধীরে ড্রাইভ করছে আর ইমার সাথে আইসক্রিম খাচ্ছে। সেদিনের মতো আজও একটা আইসক্রিম দুজনে শেয়ার করে খাচ্ছে। অনেকটা সময় এভাবে ঘুরাঘুরি করার পর ইমার এবার বেশ ক্ষুধা লাগতে শুরু করেছে।

আপনি কী আজকে না খাইয়ে রাখার জন্য বাইরে নিয়ে এসেছেন ?

ইয়াদ ঘড়ি দেখে বললো, আর একটু ওয়েট করো প্লিজ।

ইমা আর কিছু বললো না। ইয়াদ ফার্ম হাউসের দিকে যেতে লাগলো। ইমার কাছে জায়গাটা বেশ নির্জন মনে হচ্ছে। ইয়াদ গাড়ি থামিয়ে ইমাকে নামতে বললো।

ইমা ভয়ে ভয়ে আসে পাশে তাকিয়ে বললো, আমরা এখানে কেনো এসেছি ?

আজ রাতে আমরা এখানেই থাকবো।

ইমা ভয়ে একটু উঁচু গলায় বললো, আমরা এখানে কেনো থাকতে যাবো ?

ইয়াদ দুষ্টুমি করে বললো, তুমি কী ভূতের ভয় পাচ্ছো নাকি ?

ইমা আমতা আমতা করে বললো, ভয় কেনো পাবো আর ভূতে বিশ্বাস করি না আমি।

ইয়াদ ইমার কানের কাছে ফিসফিস করে বললো, ভূত না থাকলেও জ্বীন কিন্তু আছে আর জ্বীনে তো অবশ্যই বিশ্বাস করো তাই না ?

ইমা ভয়ে ভয়ে বললো, হ্যাঁ জ্বীনে বিশ্বাস করি তো কী হয়েছে ? জ্বিনের কী খেয়ে দেয়ে কাজ নেই আমাকে ভয় দেখাতে আসবে ?

তাহলে ভয় পাচ্ছো কেনো আসো।

ইমা ধীরে ধীরে গাড়ি থেকে নেমে বললো, এখানে আমরা ছাড়া আর কে কে আছে ?

ইয়াদ সামনের দিকে এগিয়ে যেতে যেতে বললো, দারোয়ান আর কেয়ারটেকার থাকে সবসময় তবে আজ কেউ নেই। আমি আজকের জন্য সবাইকে ছুটি দিয়ে দিয়েছি।

ইমা অবাক হয়ে বললো, কিন্তু কেনো ?

ইয়াদ ফিসফিস করে বললো, আজ এখানে শুধু আমি আর তুমি থাকবো তাই।

ইমা কেঁপে উঠলো ইয়াদের এমন হিম শীতল ভয়েসে। ইয়াদের হাত শক্ত করে আঁকড়ে ধরে ভেতরে যেতে লাগলো ইমা। ভেতরে গিয়ে আরো ভয় পেলো কারণ মাঝে মাঝে মোমবাতি জ্বলছে আর কোনো আলো নেই। ইমার এবার একটু বেশি ভয় করতে শুরু করেছে। ইয়াদের হাত এমনভাবে ধরে আছে যাতে হাত ছাড়লেই ইমাকে কেউ টেনে নিয়ে চলে যাবে।

ইমা এবার তোতলাতে তোতলাতে বললো, এটা কার বাড়ি আর এখানে আলো নেই ?

এটা আমাদের ফার্ম হাউস আর আলো আছে তবে আজ এদিকটায় কী যেনো প্রবলেম হয়েছে তাই অফ করে রেখেছে আর জেনারেটর নষ্ট হয়ে গেছে ঠিক করানো হয়নি।

ইমা বিরক্ত হয়ে বললো, সব আজই হতে হলো আর আমাদের আজই এখানে থাকতে হবে ?

ইয়াদ ইমার অবস্থা দেখে শুধু মজা নিচ্ছে।

ইয়াদ হাসি চেপে বললো, চলো ডিনার করে নেই।

এখানে ডিনার আসবে কোথা থেকে ?

ইয়াদ কিছু না বলে ইমাকে ডাইনিং টেবিলে নিয়ে গেলে ইমার চোখ বড় বড় হয়ে গেলো। মোমবাতি আর ইমার পছন্দের হরেক রকম খাবারে টেবিল পরিপূর্ণ সাজানো।

আজ এখানেই ক্যান্ডেল লাইট ডিনার করবো আমরা আর এটাই তোমার সারপ্রাইজ।

ইমা অবাক হয়ে বললো, এসব এখানে এভাবে ?

ইয়াদ চেয়ার টেনে ইমাকে বসিয়ে দিলো আর বললো, কথা বাদ দিয়ে খাওয়া শুরু করে দাও।

দুজনেই খেতে শুরু করলো। মাঝে মাঝে একে অপরের দিকে তাকাচ্ছে। মোমবাতির আলোয় দুজনকেই অসম্ভব সুন্দর লাগছে। হঠাৎ পায়ে শীতল স্পর্শে ইমা কেঁপে উঠলো আর হাত থেকে চামচটা প্লেটে পড়ে গেলো। একটু সময় লাগলেও ইমা বুঝতে পারলো এটা ইয়াদের স্পর্শ। ইয়াদের দিকে না তাকিয়ে চামচ তুলে আবার খেতে লাগলো। বেশ ধীরে খাওয়া শেষ করলো দুজনে। ইয়াদ বারবার নিজের ঘড়ি দেখছে আর ইমা মাথা নিচু করে খাবার খাচ্ছে। এখনো অনেকটা সময় বাকি, ইয়াদ কী করবে ভেবে পাচ্ছে না ? খাওয়া শেষে ইয়াদ ইমাকে একটা রুমে নিয়ে গেলো। ইমার এতক্ষণ ভয় না করলেও এখন আবার ভয় করছে এই আধো আলো আধো অন্ধকারে।

তুমি একটু এই রুমে থাকো আমি আসছি।

ইমা ইয়াদের হাত টেনে ধরে প্রায় চিৎকার করে বললো, আপনি কোথায় যাচ্ছেন ? আমি এখানে কিছুতেই একা থাকতে পারবো না।

ইয়াদ মজা করে বললো, তার মানে তুমি ভয় পাচ্ছো ?

হাত ছেড়ে দিলো ইয়াদের আর আমতা আমতা করে বলল, ভয় কেনো পাবো অচেনা জায়গা তাই বলছিলাম আর কী ?

ইয়াদ বরাবরের মতো হাসি চেপে বললো, ফোনটা ভুলে গাড়িতে ফেলে এসেছি সেটা নিয়ে এখনই আসছি তুমি কোথাও যেও না এখানেই থাকো।

ইমা মনে মনে বললো, কোথাও যাওয়ার সাহস থাকলে তো যাবো।

ইয়াদ বের হয়ে গেলে ইমা পা গুটিয়ে বসে বিভিন্ন সূরা পড়তে লাগলো। এখন ইমার বেশ রাগ লাগছে ইয়াদের উপর। সারপ্রাইজের নাম করে ভয় দেখাতে এখানে নিয়ে এসেছে। হঠাৎ ইমা অনুভব করলো তার ওয়াশরুমে যাওয়া প্রয়োজন কিন্তু ভয়ে বেড থেকে পা নামাতেই পারছে না। মনে হচ্ছে নিচে পা রাখলে বেডের নিচ থেকে কেউ পা টেনে নিয়ে যাবে। ইমা মনে মনে ইয়াদকে বাজে কিছু গালি দিতে লাগলো। একটু পর আসছি বলে ইয়াদ প্রায় আধ ঘণ্টা পর রুমে এলো। এদিকে ইমার ভয়ে প্রাণ যায় যায় অবস্থা।

ইয়াদকে দেখে রেগে বললো, এই আপনার একটু সময়।

ইয়াদ মাথা চুলকে বললো, একটা কল এসেছিলো তাই কথা বলে তারপর আসলাম, চলো।

কোথায় যাবো এখন আবার ?

গেলেই দেখতে পাবে চলো তো ?

ইমা বেড থেকে নেমে বললো, আগে আমি ওয়াশরুমে যাবো, আপনি দরজার বাইরে দাঁড়িয়ে থাকুন চুপচাপ।

ইয়াদকে কিছু বলার সুযোগ না দিয়ে ইমা ওয়াশরুমে চলে গেলো। ইয়াদ ওয়াশরুমের দরজার বাইরে দাঁড়িয়ে রইলো। ইমা ওয়াশরুমে যাওয়ার সাথে সাথে লাইট জ্বলে উঠলো।

বের হয়ে বললো, এই লাইট আসলো কীভাবে ?

ঠিক হয়ে গেছে হয়তো তাই চলে এসেছে।

ওহ্ চলুন কোথায় যেনো যেতে হবে। যে ভয় পেয়েছি আজ আর ঘুম আসবে বলে মনে হচ্ছে না।

পরের কথাটা ইমা বিড়বিড় করে বললো ইয়াদ শুনেও না শোনার ভান করে রইলো আর ইমার পিছনে গিয়ে চোখ বেঁধে দিলো।

আরে আরে এটা কী করছেন ?

ইয়াদ লো ভয়েসে বললো, সারপ্রাইজ,,,

ইমা আর কিছু বললো না ইয়াদ হুট করে ইমাকে কোলে তোলে হাটা শুরু করলো। ইমা প্রথমে চমকে গেলেও পরে ইয়াদের গলা জড়িয়ে ধরলো। ইয়াদ মুচকি হেঁসে সামনে আগাতে লাগলো। ইমা কিছু না বলে চুপচাপ ইয়াদের গায়ের গন্ধ নিচ্ছে বুকে মাথা ঠেকিয়ে। ইমাকে নামিয়ে দিয়ে সোজা ইমার পেছনে দাঁড়ালো ইয়াদ। আসতে করে চোখের বাঁধন খুলে দিলো।

কানের কাছে ফিসফিস করে বললো, হ্যাপি ম্যারেজ অ্যানিভার্সারি মিসেস আবরার হামিদ ইয়াদ। আজ আমাদের বিবাহিত জীবনের এক বছর পূরণ হলো। যদিও এই এক বছরে সুখের স্মৃতি খুব একটা পাইনি আমরা।

ইমা পেছনে ঘুরে ইয়াদের দিকে তাকালো অবাক চোখে। ইমা একদমই ভুলে গিয়েছিলো আজ তাদের ম্যারেজ অ্যানিভার্সারি।

ইয়াদ ইমার গাল ধরে সামনের দিকে ঘুরিয়ে বললো, আমাকে নয় সামনে দেখো।

ইমা সামনে তাকিয়ে আরো বেশী অবাক হলো। তার সামনে অসংখ্য মোমবাতি দিয়ে লেখা হ্যাপি ম্যারেজ অ্যানিভার্সারি মাই লাভ।

অসংখ্য মোমবাতির আলোয় অন্ধকার হারিয়ে যেনো হারিয়ে গেছে।

ইমা সামনে দেখতে ব্যস্ত তখনই ইয়াদ ইমার কানে ফিসফিস করে বললো, আই লাভ ইউ ইমা, আমি তোমাকে অনেক অনেক ভালোবাসি।

ইমা আবার ঘুরে তাকাতে চাইলে ইয়াদ বাঁধা দিলো আর পেছন থেকে ইমাকে জড়িয়ে ধরলো। ইমার খোলা পেটে ইয়াদের হাত পড়তেই ইমা কেঁপে উঠলো। এর আগে ইয়াদ কখনো তাকে এতোটা গভীরভাবে স্পর্শ করেনি। ইমার মনে হচ্ছে তার প্রতিটা রক্তকণাও ইয়াদের স্পর্শ অনুভব করেছে।

ইয়াদ লো ভয়েসে বলতে লাগলো, তুমি সেদিন জানতে চেয়েছিলে না আমার জীবনে তোমার গুরুত্ব কতটা বা আমি তোমাকে ভালোবাসি কিনা। জীবনে প্রথম বার আবরার হামিদ ইয়াদ কোনো মেয়ের চোখের মায়ায় আটকা পড়েছিলো আর সেটা ছিলে তুমি। ঘন পাপড়িতে ঘেরা ভেজা ভেজা দুটি চোখ আমার দিকে তাকিয়ে ছিলো। সেই দৃষ্টি আজও ভুলতে পারিনি আমি, চোখ বন্ধ করলে স্পষ্ট দেখতে পাই। আমি একটা মেয়েকে নিয়ে ভাবছি সেটা বুঝতে পেরে নিজের উপর প্রচন্ড বিরক্ত ছিলাম সেদিন।

ইমার মনে পড়ে গেলো ইয়াদের সাথে তার প্রথম দেখা হওয়ার দিনের কথা।

ইয়াদের কথায় ইমার হুঁশ ফিরলো, আজও বের হতে পারিনি আমি সেই চোখের মায়াজাল থেকে। সেদিন সেই মায়াজাল কাটানোর উপায় খুঁজতে এসেছিলাম এই ছাদেই। কিন্তু তার ফল কী হয়েছিলো দেখবে ?

ইয়াদ এক হাত উঠিয়ে পাশে দেখলো। ইয়াদের ইশারা অনুযায়ী তাকিয়ে ইমা একটা ছবি দেখতে পেলো। ইমার চিনতে অসুবিধা হলো না অসমাপ্ত ছবির এই রং তুলিতে আঁকা চোখদুটো তারই। ইমা অবাক হয়ে তাকালো ইয়াদের দিকে। ইয়াদ ইমাকে ছেড়ে দিয়ে সামনে এগিয়ে ছবির কাছে গিয়ে দাঁড়ালো।

আকাশের দিকে তাকিয়ে বললো, ঐখানটায় সেদিন একটা পূর্ণ চাঁদ উঠেছিলো গাছের আড়ালে। তোমার চোখের মায়াজাল থেকে বের হতে, সেই চাঁদটা আমার ক্যানভাসে ফুটিয়ে তোলার চেষ্টা করেছিলাম। কিন্তু ঐ চাঁদ ফুটিয়ে তুলতে পারিনি আর বদলে নিজের অজান্তে এই নিরব পদ্মের মতো চোখ দুটো ফুটিয়ে তুলেছিলাম। তাই রেগে ছবিটা অসম্পূর্ণ রেখে বের হয়ে যাই। কেয়ারটেকার সব গুছিয়ে রাখার সময় ছবিটাও গুছিয়ে রেখে দিয়েছিলো। তুমি বলেছিলে না আমি তোমাকে ভালোবাসি কিনা ? আমি তো সেদিন থেকেই তোমাকে ভালোবাসতে শুরু করেছিলাম। তুমি বলেছিলে না আমার জীবনে তোমার গুরুত্ব কতটা ? আমার তো নিজের জীবনেরই গুরুত্ব ছিলো না নিজের কাছে। তবে নিজের জীবনের গুরুত্ব দিতে শুরু করেছি। শুধু তোমার হাত ধরে জীবনের সুখের কিছু স্মৃতি তৈরি করতে চাই বলে। এবার বুঝে নাও আমার জীবনে তোমার গুরুত্বটা।

ইমা ছলছল চোখে তাকিয়ে আছে ইয়াদের দিকে। এতগুলো দিন এক ছাদের নিচে থেকে, এক বেডে ঘুমিয়ে মাত্র কয়েক ইঞ্চি দুরত্বে থাকা মানুষটার মনের কথা বুঝতে পারেনি সে। এতোটা ভালোবাসে কখনো বুঝতেই দেয়নি। ইমা পুরনো ভাবনায় বিভোর তখনই ইয়াদ ইমার সামনে হাঁটু গেড়ে বসলো, হাতে বর্ষার কদম ফুল।

আমার বাকিটা জীবন তোমার হাতে হাত রেখে পারি দিতে চাই। হবে কী তুমি আমার জীবন চলার পথের সঙ্গী ?

ইমা টলমলে চোখে তাকিয়ে ছোট করে বললো, হুম।

ইমা ইয়াদের হাত থেকে ফুলগুলো নিতেই ইয়াদ পেছন থেকে এক গুচ্ছ রজনীগন্ধা বের করে সামনে ধরলো।

জীবনের সব #তিক্ততার_সম্পর্ক পেছনে ফেলে তোমার সাথে একটা মধুর সম্পর্ক গড়ে তুলতে চাই। যেখানে কোনো তিক্ততার ছায়া থাকবে না। তুমি কী আমার পাশে থাকবে ?

ইমা এবারও মুচকি হেঁসে বললো, হুম।

রজনীগন্ধার গুচ্ছ ইমা নিতেই ইয়াদ এক গুচ্ছ লাল টকটকে গোলাপ ইমার সামনে ধরলো।

আমি নিজেকে তোমার সামনে স্বচ্ছ কাঁচের মতো উপস্থাপন করতে চাই যার আড়ালে কিছুই থাকবে না। আর তোমাকেও নিজের সামনে স্বচ্ছ কাঁচের মতো দেখতে চাই। তুমি কী তাতে সাহায্য করবে আমাকে ?

ইমা ফুলগুলো নিয়ে বললো, হুম।

ইয়াদ এবার পকেট থেকে একটা ডায়মন্ড রিং বের করে ইমার সামনে ধরলো।

একটা ভালোবাসার খাঁচায় বন্দী রাখতে চাই তোমাকে, থাকবে সারাজীবন ?

ইমা হাত বাড়িয়ে দিয়ে বললো, হুম।

ইমার বা হাতের অনামিকা আঙ্গুলে রিংটা পড়িয়ে দিয়ে হাতের উল্টো পিঠে কিস করলো ইয়াদ।

ইয়াদ পিছনে তাকিয়ে কিছু খোঁজে একটা নীল পদ্ম ফুল ইমার দিকে বাড়িয়ে দিয়ে বললো, আই লাভ ইউ।

ইমা ফুলটা নিয়ে বললো, আই লাভ ইউ টু।

ইমা ফুলটা নিতেই ইয়াদ উঠে দাঁড়ালো। ইমা দু’হাতে ফুল নিয়ে ইয়াদকে জড়িয়ে ধরলো আর ইয়াদও ইমাকে জড়িয়ে ধরে মাথায় কিস করলো।

ভালোবাসার উপর ঘৃণা জন্ম নিয়েছিলো আমার মনে। আবার কখনো কোনো ধোঁকা সহ্য করার ক্ষমতা আমার নেই ইমা। ছেড়ে যেও না কখনো আমি বেঁচে থেকেও মরে যাবো।

ইমা কিছু না বলে শক্ত করে জড়িয়ে রইলো ইয়াদকে। কতটা সময় এভাবে ছিলো জানা নেই কারো। এই ছাঁদে একটা বড় দোলনা আছে, আজ সেটাকেও বেলুন দিয়ে সাজিয়ে রেখেছে ইয়াদ। ইমাকে কোলে তুলে দোলনায় বসিয়ে দিলো আর নিজেও পাশে বসলো।

ইমা হাতের ফুলের দিকে তাকিয়ে বললো, সবগুলো আমার পছন্দের ফুল আর শেষটা প্রিয় ফুল। আপনি এসবের কথা কী করে জানলেন ? আমার তো কোনো ডাইরি লেখার অভ্যাস নেই যে সেখান থেকে জানবেন।

ইয়াদ ইমার হাতের দিকে তাকিয়ে বললো, কথা একদিন বলেছিলো সবাই গল্প করার সময়। তুমি ছিলে না সেখানে।

ইমা ইয়াদের কাঁধে মাথা এলিয়ে দিলো আর বললো, দেখতে দেখতে এক বছর কীভাবে কেটে গেলো তাই না ?

ইয়াদ গম্ভীর গলায় বললো, গত এক বছরের প্রত্যেকটা দিন প্রত্যেকটা মুহূর্ত আমার মনে আছে। ভালো স্মৃতির সংখ্যা খুব বেশি নয়। আমাদের সম্পর্কটা আরো আগেই হয়তো স্বাভাবিক হয়ে যেতো যদি আমাদের জীবনটা এতো কমপ্লিকেটেড না হতো। এতোটা সময় লাগলো না হয়তো।

ইমা ইয়াদের দিকে মুখ তুলে তাকিয়ে বললো, পুরনো কথা ভেবে বর্তমান নষ্ট করার মানে হয় না।

ইয়াদ ইমার কপালে কিস করে বললো, হুম।

ইয়াদের কাঁধে মাথা রেখে অনেকটা সময় গল্প করলো দু’জনে। আকাশটা আজ মেঘলা ছিলো হঠাৎ করেই বিদ্যুৎ চমকে বৃষ্টি শুরু হয়ে গেলো। ইয়াদ ইমার হাত ধরে কোনোরকমে দৌড়ে চলে আসলো ছাঁদ থেকে। রুমে এসে ইমা ব্যস্ত হয়ে গেলো শাড়ীর আঁচলে ইয়াদের মাথা মুছে দিতে, আবার না জ্বর চলে আসে সেটা ভেবে। আর ইয়াদ মুগ্ধ হয়ে তাকিয়ে আছে ইমার দিকে। সারা মুখে গলায় বিন্দু বিন্দু বৃষ্টির পানি লাইটের আলোতে ডায়মন্ডের মতো চিক চিক করছে। ঠোঁটের উপর একটা পানির বিন্দু ইয়াদকে প্রচন্ড টানছে। ইয়াদ নিজেকে ধরে রাখতে পারলো না ডান হাতের তর্জনী আঙ্গুল দিয়ে আলতো করে ছুয়ে দিলো পানির ফোঁটা। ইমা কেঁপে উঠলো হঠাৎ ইয়াদের এমন স্পর্শে। ইয়াদের চোখে তাকিয়ে আরো বেশী শিহরিত হলো। কেমন নেশা ধরা চোখে তাকিয়ে আছে। ইমা ইয়াদের মাথা থেকে হাত সরিয়ে নিয়ে দূরে সরে যেতে চাইলো কিন্তু ইয়াদ হাত ধরে টেনে কাছে নিয়ে আসলো।

কানের কাছে ফিসফিস করে বললো, আজকে অন্তত দূরে সরে যেও না।

চলবে,,,,