তুমিময় মোহ পর্ব-০২

0
48

তুমিময়_মোহ [২]

ভোর সকালে ছোট ছেলের আগমনে আহসান মঞ্জিল যেন জীবন্ত হয়ে উঠলো। নাজিয়া বেগম কতশত রান্না করে টেবিল সাজিয়েছে।তাকে সাহায্য করেছে বড়ো বউ আনহা। আটটার দিকে একত্রে টেবিলে বসেছে সকলে নাস্তা খাবার জন্য। জাহিদ ও আনহার ছোট মেয়ের বয়স কেবল চার বছর। দেখতে ছোট পুতুলের ন্যায় সুন্দরী, এজন্য নাম রাখা হয়েছে পুতুল। অবশ্য পুরো নাম পায়েল আহসান পুতুল।
‘কেবল দু সপ্তাহ দেশের বাহিরে ছিলি। ওমনি শুকিয়ে কি অবস্থা হয়েছে দেখো।’
‘আম্মু আমি ডায়েটে নেই। কাজের চাপ বেশি পড়লে খাওয়ার ফুরসত মিলে না।’ স্বাভাবিক কণ্ঠে বলল জোহান।
‘বলতে হবে না। বাড়ির কর্তা। আপনাকে বলছি শুনেন। ছেলের জন্য মেয়ে দেখার ব্যবস্থা করুন।’ কপট রাগে বললেন তার স্বামী জাহাঙ্গীর আহসানকে। তিনি কিঞ্চিৎ পিঞ্চ মারার ভঙ্গিতে জানালো,
‘আগে ছেলেকে জিজ্ঞেস করো। দেখা গেল মেয়ে দেখতে গেলাম। মুখের উপর রিজেক্ট করে দিলো। মানসম্মান তখন আমার যাবে তার নয়।’
‘তোমরা নিশ্চয় চাও না আমি খাবার রেখে উঠে যাই।’ কাঠকাঠ কণ্ঠে বলল জোহান।
‘একি, একটা কথা বললেই ওমন ছ্যাঁত করে উঠার কি প্রয়োজন।’
‘ভাবি তোমার ছ্যাঁত-চ্যাঁত ভাষা বোঝার ক্ষমতা নেই আমার। কাইন্ডলি শুদ্ধ ভাষায় বোঝাবে?’
আহনা ভেংচি দিলো। যা দেখে জোহান মৃদু দীর্ঘশ্বাস ছাড়ল। নারীদের ন্যাকামো তার একদম অপছন্দ। এজন্য সে খুব করে সব ক্ষেত্রে নারীদের থেকে দুরত্ব বজায় রেখে চলে। অবশ্য তাদের বাড়িতেই রয়েছে ন্যাকামো রানীর বসবাস। বিড়বিড় করল জোহান,
‘ভাবি বলে এখনো আনইন্সটল করিনি।’
খাওয়া শেষে জোহান তড়িৎগতিতে বেড়িয়ে পড়লো জোহান। ড্রাইভারকে লোকেশন বলে দ্রুত গাড়ি চালাতে বলল।
_
বিয়ের তোরজোড়ে হঠাৎ ঝড়ের আঘাতে লণ্ডভণ্ড পরিবেশ। যার একমাত্র কারণ সামাইরা বাড়ি থেকে গায়েব! রাতভর তাকে হন্ন হয়ে খুঁজেছে ইমরান, মিরান সহ সামাইরার চাচা ও কাজিনরা। মেয়ের আচমকা গায়েব হবার পেছনে কারণ হিসেবে দায়ভার এসে পড়েছে রাধিকার উপর। অথচ, সে একাধিক বার বলেছে কিচ্ছুটি জানে না। তবুও সকলে এটা শুনতে নারাজ। হুমাইরা বানু বারেবারে গর্জে উঠছে রাধিকার উপর। বেচারা অসহায় হয়ে শুধু ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে আছে। অবশ্য এতে তার দোষ রয়েছে৷ সেই অধিক মাত্রায় জোর করেছিল পালাতে। খালিদ শেখ ভাবতেই পারছে না মেয়ের এরূপ দুঃসাহসিকতা। বাবা ভক্ত মেয়ে যে এভাবে সমাজে তাকে হেয় করবে জানা ছিল না তার। মুহূর্তেই ধারণা পাল্টে গেল। নীরব হয়ে এক কোণায় বসে ছিল সেই রাতের বেলায়। এখনো একই ভাবে তার আসন। পরিবর্তন হয়নি বিন্দুমাত্র। এখন ঘড়িতে দশটা বেজে পাঁচ মিনিট। সারারাত খোঁজাখোঁজি করেছে। না পেয়ে ইমরান ড্রইংরুমে উপস্থিত সকলের সামনে চ্যাঁচিয়ে উঠলো,
‘আঙ্কেল, আপনর মেয়ে আমার যেই সম্মান নষ্ট করেছে। যেভাবেই সে আপনার সামনে উপস্থিত হবে। সেভাবেই আমি তকে বিয়ে করব। এটা আমার এক কথা, এক জেদ!’ বলেই বাড়ি থেকে বেরিয়ে গেল। বরযাত্রী সকলে প্রস্থান করল ইমরানের প্রস্থানে।
মিরান হতাশ হয়ে গ্রুপে এই বিষয়টি জানিয়ে দিলো। তার একটি নির্দিষ্ট বন্ধুমহল রয়েছে গ্রুপ হিসেবে হোয়াটসঅ্যাপে। যেখানে তার সব ফ্রেন্ডস এড রয়েছে। পড়াশোনা কমপ্লিট হবার পর সবই চাকরি-বাকরিতে কাজে ব্যস্ত। এজন্য সবার সাথে যোগাযোগ সচল রাখার জন্য গ্রুপে এড রাখা। ভাবি গায়েব খবরটি গ্রুপে প্রচার করল। সবাই বিভিন্ন মন্তব্য করছে। সেও সমান তালে রিপ্লাই দিচ্ছে।
.
এগারোটা নাগাদ চেতনা ফিরে পেল সামাইরা। চোখ মেলে নিজেকে অচেনা রুমে আবিষ্কার করে হকচকিয়ে উঠে বসলো। খুব খেয়াল করে পর্যবেক্ষণ করছে সর্বত্র রুম। পরিপাটি গোছানো সাজানো একটি রুম। দেয়ালে প্রিন্ট করা কালো ও ব্লু রং মিক্স। রাত পুহিয়ে এখন সকাল। অচেতন অবস্থায় কয়েক ঘন্টা কাটিয়েছে মনে নেই তার। শুধু এতটুকু মনে আছে। সেই পুরুষ স্যরি বলার পরপরই তার নাকমুখে রোমাল দ্বারা চেপে ধরেছিল। ধড়ফড়িয়ে উঠেই কয়েক সেকেন্ডের মাঝে জ্ঞান হারালো। আর এখন চেতনা ফিরে পেয়ে নিজেকে অচেনা স্থানে পেলো। গায়ে জড়ানো বিয়ের লেহেঙ্গা। সামনে বড় ড্রেসিং টেবিল দেখে দ্রুত নেমে সামনে দাঁড়ালো। গহনা ও সাজসজ্জা একই রকম দেখে স্বস্থি পেলো।
দরজার নিকটে এসো কয়েকবার জোরে ধাক্কা দিয়ে বোঝা গেল বাহির থেকে লক করা। পেছনে তাকিয়ে এডজাস্ট ওয়াশরুম দেখতে পেয়ে চোখেমুখে পানির ঝাপটা দিলো। বের হয়ে বিছানায় বসে শান্তভাবে স্মরন করছে অপরিচিত ছেলেটির কথা। প্রথম তাকে বোঝালো, ফের কিডন্যাপ করল। এটা কেমন অদ্ভুত বিষয়!
বিয়ের রাতে বউ পলাতক বিষয়টি কতটা জঘন্যতম এটা সে বুঝতে পারছে। তবে সে তো ইচ্ছে করে পালায়নি। তাকে কিডন্যাপ করা হয়েছে। হঠাৎ দরজা খুলে দু’জন লোক ভেতরে প্রবেশ করল। সামাইরা ভয়ে লাফিয়ে উঠে দাঁড়ালো।
তাঁদের পরনে কালো শার্ট কালো জিন্স। কানে ব্লুটুথ ডিভাইস লাগানো। কিছুটা বডিগার্ডদের মতো বেশভূষা। তারা দু’জন দু পাশে দাঁড়াতেই একজন লোক ভেতরে প্রবেশ করল। একজন লোক একটি গদি এগিয়ে দিলো। এরপর দরজা বন্ধ করে বেরিয়ে এলো বাহিরে। সামাইরার অলরেডি ভয়ে গলা শুঁকিয়ে কাঠ হয়ে গেছে। জুরুরি ভিত্তিতে পানীয় প্রয়োজন। রাতে দুমুঠো সাদা পোলাও খেয়েছিল। এই জন্য তৃষ্ণাটা বেশি বৃদ্ধি পেল। এই প্রথম কোনো পুরুষের সঙ্গে একই কামরায় অবস্থান করছে। সামাইরা ভীতু নয়নে তাকালেও কিঞ্চিৎ পর্যবেক্ষণ করে ছেলেটিকে আপাদমস্তক। কালো স্যুজ থেকে শুরু করে শার্ট-প্যান্ট, কোট এবং-কি সানগ্লাস পর্যন্ত সব কালো। যেন ম্যাচিং করে এসেছে। ফর্সা আদল ও দেহে কালো রংটায় উজ্জ্বলতা বৃদ্ধি পেয়েছে তিনগুন। চুলগুলো সিল্কি জেল দ্বারা গোছানো। মুখশ্রীতে এক রাশ গম্ভীর ভাব। দু মিনিট অতিবাহিত হবার পূর্বেই ভারী কণ্ঠে বলল,
‘বোসো। তোমার সব ডাউট ক্লিয়ার করছি।’
কণ্ঠ শুনেই সামাইরা নিশ্চিত হলো এটাই কাল রাতের সেই অচেনা ছেলেটি। আপনি থেকে তুমি হবার ফলে সে অবাক হয় হালকা। এটা গুরুত্ব না দিয়ে তার কথায় গুরুত্ব প্রকাশ করল বসে দৃষ্টি নত রেখে। সে পায়ের উপর পা তুলে একটু নড়েচড়ে আয়েশ করে বসল। বলল,
‘জোহান আহসান। পরিবারের ছোট ছেলে। বড়ো ছেলের জন্য পুত্রবধূ নাতনি কমপ্লিট। ছোট ছেলের পুত্রবধূ হিসেবে তুমি সিলেক্টেড। নাউ, তোমাকে বিয়ের আসর থেকে কিডন্যাপ করেছি আমি।’ বলতে বলতে সানগ্লাস খুলে সামাইরার পানে তাকালো জোহান।
সামাইরা হতবাক। এরূপ কথা শুনে মুখ থেকে স্বর বের হতে কষ্ট হচ্ছে যেন। কয়েকটা শুঁকনো ঢোক গিলে নরম স্বরে জানালো,
‘আপনি অন্যায় করেছেন। এখনো সময় আছে আমাকে যেতে দিন প্লিজ। আমি কাউকে কিচ্ছু বলব না। আপনার নামও জানাব না।’
জোহান তাচ্ছিল্য হাসলো ঈষৎ। দৃঢ় গলায় বলল,
‘নো ওয়ে সামাইরা। যাবে তখন, যখন আমায় তুমি বিয়ে করবে। জোর একদমই করব না। যতদিন না বিয়েতে রাজি হচ্ছো। ততদিন আমার দায়িত্বে এখানে বন্দি থাকবে।’
‘আমায় অসহায়ত্বের সুযোগ নিবেন না। আমি বাড়ি ফিরতে চাই।’ করুণ গলায় বলল।
‘বাংলা কথা মেবি তুমি ঠিকঠাক বুঝতে পারছো না। ইংরেজিতে বোঝাবো?’ স্মিত হেসে রাগান্বিত আদলে শুধালো।
‘কিভাবে বললে আমায় যেতে দিবেন? আমি সত্যি যেতে চাই। আপনাকে বিয়ে করতে চাই না।’ বলতে বলতে গলা ধরে আসে সামাইরার।
জোহান পা নামিয়ে সানগ্লাসটা মনোযোগ ভাবে দেখতে দেখতে কাঠিন্য স্বরে জানায়,
‘ইমোশনাল ব্লাকমেইল কাজে দিবে না খুব একটা। চোখের পানি যেন গাল বেয়ে না ঝড়ে। হিংস্রতা দেখাতে ন্যানো সেকেন্ড দেরি হবে না।’
জোহানের ধামকি সরূপ কথনে ভয়ে বক্ষে ধুকধুক শব্দটা বাড়ে। সর্বাঙ্গ কাঁপছে। স্থির হয়ে বসতে কষ্ট হচ্ছে। কিছু যে বলবে সেটাও মুখ থেকে বের হতে চাচ্ছে না। তবে সে চেষ্টা করে বক্ষে সাহস সঞ্চয় করার। কিঞ্চিৎ করেও নেয়। ধীরে স্বরে ফের শুধালো,
‘আমি বিয়ে করতে চাই না আপনাকে। যেতো দিন….’
‘স্টপ!’ জোরে ধমক দিলো। মানুষদের কিছু কথনে পছন্দ অপছন্দতা থাকে। এই বিষয়টি জোহানের ক্ষেত্রে ভিন্ন নয়। না বাক্যের মতো এক কথা একবারের বেশি শোনার অভ্যাস তার নেই। এতে বিক্ষিপ্ত রাগ হয় তার। ফ্লোরের পানে দৃষ্টি রেখে কঠোর গলায় বলে,
‘আজ এ পর্যন্তই। ফিরে এসে তোমায় যেন স্বাভাবিক দেখি। নয়তো জোরজবরদস্তি করতে বাধ্য হবো। যেটা আমার একদমই ইচ্ছে নেই। নিজেকে যত দ্রুত স্বাভাবিক রাখবে, তোমার মঙ্গল হবে। অবনতি ডেকে এনো না। যে প্রশ্নগুলো মনে রয়েছে সেগুলো দমিয়ে রাখো। ধীরেধীরে উন্মোচন হবে।’ সানগ্লাস চোখে পড়ে উঠে দাঁড়ালো। হনহনিয়ে দরজার কাছে এসে ফের থামল। ঘাড় কিঞ্চিৎ বাঁকিয়ে ভারযুক্ত গলায় বলল,
‘তুমি আমায়। শব্দগুলো মস্তিষ্কে বন্দি রাখো ঠিক তোমার মতো।’ প্রস্থান করল। বিছানায় হাত ঠেস রেখে কান্নায় ভেঙ্গে পড়লো। এতক্ষণ অতি যন্ত্রণায় তা দমিয়ে রেখেছিল। এখন আর মানছে না।
রাগ-ক্ষোভে মাথার ওড়না টেনেটুনে খুলে মেঝেতে ছুড়ে ফেলে। নিজের মতো প্রশ্নের চক্রেও বন্দি সে। বের হবার উপায়ন্তর কি আদৌও রয়েছে?
.
চলবে?

®সুমাইয়া মনি