তুমিময় মোহ পর্ব-০৮

0
46

তুমিময়_মোহ [৮]

পর পর তিনদিন অতিবাহিত হয়। এর মাঝে আহিল ও আরমান সামাইরার কলেজে গিয়ে খবরা-খবর নিয়েছিল। লামিমও তার কাজ সম্পূর্ণ করেছে কল লিস্ট উদ্ধার করে। তবে এমন কোনো সুরাহা মেলেনি সেসবে। আজ রাধিকা লাস্ট বার যাবে ইমরানের সঙ্গে দেখা করতে। এর আগের দিন সে সম্পূর্ণভাবে জেনেছে ইমরান বিবাহিত। আমেরিকায় তার বউ রয়েছে। যাকে ফেলে দ্বিতীয় বিয়ের উদ্দেশ্যে বাংলাদেশে এসেছে। আজ প্রমাণ জোগাড় করবে দেখে ফোনের রেকর্ডিং আগে থেকে চালু করে রেখেছে।
‘আজকে কোথায় যাবে রাধিকা?’ বিরক্ত জড়িত কণ্ঠে প্রশ্নটি ছুড়লো সে।
রাধিকা আমতা আমতা ভাব কাটিয়ে বলল,
‘পরিচিত বান্ধবী আছে আমার, নাম মিম। ওর সাথে আমিই সামাইরাকে পরিচয় করিয়ে দিয়েছিলাম। হতে পারে ওখানে আছে ও।’
‘চলো তবে যাওয়া যাক।’
রিকশায় পাশাপাশি বসে যাচ্ছিল তারা। মাঝেমধ্যে ইমরান ইচ্ছে করে তার বাহু রাধিকার বাহুর সাথে স্পর্শ করাচ্ছে। যেটা একদম বাজে লাগছে রাধিকার। আপাতত সহ্য করা ছাড়া উপায় নেই তার। দশ মিনিট পর সেই বাড়ির নিকট এসে পৌঁছালো। পাঁচতলা বাড়ির দুই তলার ফ্ল্যাটে থাকে মিমরা। ইমরানকে সঙ্গে নিয়ে দুই তলায় পৌঁছে কলিংবেল বাজালো। মিনিট দুয়েক পর দরজা খুলে দিলো মিম নিজেই। হাসিমুখে বলল,
‘কিরে কেমন আছিস রাধিকা?’
মিমের প্রশ্নে হেসে জবাব দেয়,
‘ভালো। ভেতরে যেতে বলবি না?’
‘হ্যাঁ, আয়।’ বলতে বলতে দরজার কাছ থেকে সরে দাঁড়ালো। তৎক্ষনাৎ ইমরানের উপর নজর পড়লে মলিন হেসে প্রশ্ন করে,
‘ওনি কে?’
‘হবু দুলাভাই। একটা কাজে তোর কাছে এসেছি আমরা।’ সৌজন্যবোধ বজায় রেখে বলল সে।
‘ওহ! ভেতরে আসুন দুলাভাই।’ সসম্মানে আহ্বান জানালো মিম তাঁদের। ইমরান কু নজরে আপাদমস্তক মেপে নিয়েছে মিমকে। তারা ভেতরে যেতেই ইমরান চারপাশে নজর বুলাতে লাগলো। তার এরূপ উদ্বেগ চাহনি দেখে মিম ইতস্তত বোধ নিয়ে জানালো,
‘বসুন। আমি চা নিয়ে আসছি। খেতে খেতে গল্প হবে।’
বলে রান্নাঘরের দিকে অগ্রসর হলো মিম। রাধিকা সেকেন্ড কয়েক যেতেই ধীরে ধীরে জানালো,
‘দুলাভাই আপনি এখানে বসুন। আমি বরং রান্নাঘরটা চেক করে আসছি।’
‘হ্যাঁ, তাই যাও। আমিও বরং রুমগুলো উঁকিঝুঁকি দিয়ে দেখি।’ তিনিও ধীরে কণ্ঠে জানালো।
‘আচ্ছা তাই করুন।’ উৎসাহিত কণ্ঠে বলে উঠে গেল রান্নাঘরে। মিমকে আস্তে-ধীরে সব খুলে বলল। এডজাস্ট দুইটি রুম। রান্নাঘর সহ মোট তিনটি রুম। রুম দুটি ভালো করে পর্যবেক্ষণ করল ইমরান। সামাইরাকে পেল না। আগের স্থানে এসে বসতেই তারা রান্না ঘর থেকে বেরিয়ে এলো। ইমরানের হাতে চা তুলে দিয়ে মিম অন্য পাশের সোফায় বসল। হাসিমুখে বলল,
‘সামাইরা ভাগ্যবতী, আপনার মতো হাসবেন্ড পেয়েও হারালো।’
ইমরান খুশি হয়ে মৃদু হাসি প্রধান করল। তার মানে ক্ষোভিত চোখে তাকিয়ে চায়ে চুমুক দিলো রাধিকা। সে তো জানে সামাইরা ভাগ্যবতী ছিল না।
‘তুমি মিমকে বলেছো?’
‘হ্যাঁ।’
‘মিম। সামাইরাকে যদি কোথাও পাও আমাদের জানাবে।’
‘অবশ্যই ভাইয়া।’
আরো কিছুক্ষণ সময় অতিবাহিত করে বেরিয়ে এলো এ বাড়ি থেকে। রিকশায় উঠে রাধিকা তাকে বিদায় দিয়ে চলে গেল। ইমরান অন্য একটি রিকশা নিয়ে বারের উদ্দেশ্যে রওয়ানা হয়। রিকশার সামনেই আহিল এসে বাইক থামায়। রাাধিকা রিকশা থেমে নেমে আহিলের বাইকের পেছনে উঠে বসলো। এই কয়দিনে তাদের মাঝে খুব ভালো সম্পর্ক পড়ে উঠেছে। আগে থেকেই মেসেজে বলেছিল সে তাদের ফলো করে বাড়ির নিচে ওয়েট করছে। বাইক চালাতে চালাতে আহিল রাধিকাকে প্রশ্ন করল,
‘আজ কোনো ক্লু পেলে?’
‘ভাইয়া ওয়াশরুমে যাবার পর মেয়েটা কল করেছিল তখন নাম্বারটি তুলে নিয়েছি। আর আগে থেকেই রেকর্ডিং চালু ছিল।’
‘আমাকে সেন্ড করবে।’
‘আচ্ছা।’
‘চলো কফি খেতে যাই।’
‘চলেন।’
_
‘আত কত মেয়েটাকে নিয়ে কটুক্তি করবে? তুমি না সামাইরার মা?’ খালিদ শেখ কথাটা বললেন অসহায় স্বরে।
দুপুরের আহার সেরে কেবল বিছানায় বিশ্রাম নিচ্ছিলেন। মেয়ে হারানোর বেদনায় আহার কি আর গলা দিয়ে নামে? যতটুকু সম্ভব খেয়েছে কেবল খুদা মিটানোর জন্য। তখনই তার অর্ধাঙ্গিনী এসে সামাইরার বিষয়ে উল্টোপাল্টা কথন বলতে লাগল। তিনি চটে একথা ছুড়ে দিলেন।
‘মেয়ে পালাতে পারবে আর আমি বললেই দোষ?’ তিনি ক্ষেপে বললেন।
‘তোমার সাথে পাড়াপ্রতিবেশিদের কোনো পার্থক্য আমি দেখছি না।’
‘দেখো না। আমি তাদের মতোই।’ ব্যঙ্গাত্মক করে তিনিও বললেন কথাটা। খালিদ শেখ আর কথা বাড়ালেন না। চুপ হয়ে রইলেন। হুমাইরা বানু নৈঃশব্দে নিশ্বাস নিলেন। খালিদ শেখ যতটা ভালোবাসে সামাইরাকে তার চেয়েও কয়েকগুণ সে সামাইরাকে তিনি ভালোবাসে। আপাতত এই কথাগুলো তিনি চ্যাঁচিয়ে বলছেন যাতে সিয়াম বুঝতে পারে সামাইরার চেয়ে তাকে বেশি ভালোবাসে। যেই প্রভাব সামাইরার উপর পড়েছে। সেটা যে সিয়ামের উপর না পড়ে। সামাইরার মতো সিয়াম যেন তাকে ভুল না বুঝে।
অপরপ্রান্তে রোজকার মায়ের এরূপ কথন শুনে বিরক্ত। সে সামাইরাকে বড়ো বোন হিসেবে যথেষ্ট সন্মান ও ভালোবাসে। শুধু প্রতিবাদ করতে পারছে না।
.
চারদেয়ালে বন্দি বসবাস এখন যেন অভ্যাস হয়ে গেছে। সারাদিন বই পড়ে সময় অতিবাহিত করছে সামাইরা। কখনো কখনো আবার ঘুমিয়ে সময় কাটাচ্ছে। এসব মনিটরে পর্যবেক্ষণ করছে জোহান। এছাড়া উপায় নেই তাঁকে মুক্তি করার সে তা ঠের বুঝতে পারে।
রাতে জোহান ও আহিল একত্রে কফিশপে বসে কথা বলছিল। অনাকাঙ্ক্ষিত ভাবে সেখানে লামিম উপস্থিত হয়। তাদের সঙ্গে বেশকিছুক্ষণ আড্ডা দিয়ে আগেভাগে চলে যায় লামিম।
‘মেয়েটিকে তুই কল দিবি হোয়াটসঅ্যাপে। ইমরানের বিষয় সব ডিটেইলস জেনে আমাকে বলবি।’
‘মেয়েটা বলবে সব?’
‘ইমরানের বিয়ের ছবি নিশ্চয় তোর কাছে আছে?’
‘আছে।’
‘সেটা প্রথমে পাঠাবি তাকে। এরপর সে নিজ থেকেই তোর সাথে যোগাযোগ করবে। অবশ্যই ফেইক এ্যাকাউন্ট থেকে পাঠাবি।’
‘ওকে।’
‘আমি বাসায় যাচ্ছি।’
‘সামাইরার বাসায়?’
জোহান মৃদু হেসে উত্তর না দিয়ে চলে গেল। আহিল বুঝতে পারলো। সেখানে বসে রাধিকার সঙ্গে চ্যাটিং করতে ব্যস্ত হয়ে পড়ল সে।

বাড়িতে ফিরে সামইরাকে ছাদে নিয়ে আসে জোহান। একা রুমে বদ্ধ থাকার ফলে ঘুরাফিরা করার জন্য নিয়ে এসেছে। তাদের মধ্যকার সম্পর্ক এখন বন্ধুত্ব দিয়ে শুরু হয়েছে। সামাইরা অন্যপাশে দাঁড়িয়ে রেলিঙের উপর হাত রেখে দ্বিধাবোধ নিয়ে প্রশ্ন করে,
‘এই বাড়ি কি আপনার?’
‘হ্যাঁ।’
‘এখানে আপনার পরিবারের কারোর আশা যাওয়া নেই?’
‘নাহ।’
‘তাঁরা কোথায় থাকে?’
‘ধানমন্ডি।’
‘আপনি কি তাঁদের সঙ্গে থাকেন নাকি এখানে একা থাকছেন?’
এই প্রশ্ন শুনে জোহান ঘুরে তাকালো। সামাইরা কিঞ্চিৎ লজ্জা পেয়ে কথা ঘুরিয়ে বলল,
‘এমনি জানতে চেয়েছি। ওইরকম কিছু না।’
জোহান সামনের দিকে দৃষ্টি শূন্যে রেখে জানালো,
‘হবু বউ রেখে নিশ্চয় কোনো পুরুষ বাড়িতে একা থাকবে না।’
ফের লজ্জা পেয়ে গেল সে। অন্যপাশে এসে দাঁড়াল। আকাশের পানে মুখ তুলে তাকালো। পেছন থেকে সামাইরার পানে চেয়ে এগিয়ে এসে জড়িয়ে ধরলো। হঠাৎ করেই বিদ্যুৎস্পৃষ্টের মতো চমকে উঠে সরে যেতে নিলে শক্ত ভাবে ধরে দাঁড়ায় জোহান। পিছনে অনুভব করে, তার পিঠের সঙ্গে জোহানের বুকের স্পর্শে শরীর ও কান গরম হয়ে গেল তার। বদনখানি যেন তিরতির করে কাঁপছে। সামাইরার কাঁধে জোহান থুতনি রেখে নরম কণ্ঠে শুধালো,
‘মোহময় মায়ায় অবদ্ধ আমি। তোমায় ভালোবাসি। কিভাবে একা বাড়িতে থাকব?’
নিরুত্তর সে। এ কয়দিনে কয়েকবার সে ভালোবাসা প্রকাশ করেছে তার কর্মে নয়তো মুখে। সামাইরার বক্ষে অব্যক্ত অনুভূতি হাতছানি দিয়েছে শতশতবার। যা দমে ছিল এতকাল। সে শুধু প্রতিত্তোরে চুপ থেকেছে। কিইবা বলবে সে? সেভাবেই দাঁড়িয়ে নম্রস্বরে জানাল,
‘প্রথম দেখায় ভালোবাসা কিভাবে হয় জানি না।’
ম্নান হেসে তাকালো জোহান। সেদিন কিভাবে দেখা হয়েছিল তা বলেছে জোহান। আজ সেই কথার ছন্দ ধরে প্রশ্ন ছুড়লো সে। জোহান কোমলভাবে তারদিকে পুরোপুরি ঘুরে বলল,
‘লাভ এট ফাস্ট সাউডে বিশ্বাসী ছিলাম না। তোমায় দেখে আমি বাঁধ্য হয়েছি বিশ্বাস করতে। একটি ছোট্ট বৃক্ষ যেমন মাটির সাথে ধীরে ধীরে বড়ো হয়ে চারদিক শিকড়সমেত জায়গা করে নেয়। তেমন তুমিও আমার হৃদয়ে কিঞ্চিৎ বীজ থেকে শিকড়যুক্ত গড়ে উঠা বিশাল ভালোবাসা।’ জোহান থামলো। সামাইরার শরীরে এখন যেন অসাড় হয়ে আসছে জোহানের গরম নিশ্বাসে। দ্রিমদ্রিম করছে স্পন্দন। ওঠানামা নিশ্বাস যেন এই বুঝি টের পেল জোহান। এই ভেবে দ্রুত নিজেকে উন্মুক্ত করে নিলো তার থেকে। সরে এলো কয়েক হাত দূরে। জোহানের কপাল কুঁচকে এলো। স্থির সামাইরার পানে তাকিয়ে বোঝার চেষ্টা করছে তার ভাবমূর্তি। ততক্ষণে সামাইরা নিজেকে ধাতস্থ করে জানালো,
‘নিচে যাব। ঘুম পাচ্ছে।’
এতটুকু বলার পর জোহান তেমন বিদ্রোহ করল না। নিজের অনুভূতিকে দমিয়ে রাখল। মেনে নিলো তার কথা। দু’জনে নেমে এলো নিচে।
.
.
#চলবে?

®সুমাইয়া মনি