তুমিময় মোহ পর্ব-০৯ এবং শেষ পর্ব

0
55

তুমিময়_মোহ [৯]
অন্তিম পর্ব

পরপর আরো তিনদিন অতিবাহিত হয়। মিরান ওর পরিবারকে নিয়ে আজ সামাইরাদের বাড়িতে এসেছে কোনো এক উদ্দেশ্যে। সেখানে ওর সব বন্ধুদেরও আসতে বলা হয়েছে। জোহান বাদে বাকিরা উপস্থিত ছিল। কিছুক্ষণ বাদে জোহান সেখানে উপস্থিত হয়। তবে একা নয়। সঙ্গে সামাইরা ও রাধিকাকে নিয়ে। উপস্থিতবক্তা সকলে যেন বিস্ময় হতবিহ্বল। বিস্ফোরিত চোখে তাকিয়ে আছে তাঁদের পানে। সবার মনে প্রশ্ন। তাঁদের আকস্মিক কেন্দ্রবিন্দু এখন সামাইরা। মিরান সকলকে উপেক্ষা করে তাচ্ছিল্য হেসে বলে,
‘আমি জানতাম তুই বুদ্ধিতে চালাকচতুর। তবে এত তেজ সেটা অনুমান করেনি।’
জোহান ভ্রুক্ষেপহীন চাহনিতে তাকালো মিরারের পানে। তার চোখে দৃশ্যমান রাগ-ক্ষোভ, ঘৃণা। যা স্পষ্ট দেখছে জোহান। আদিলের কাছ থেকে ল্যাপটপটি নিয়ে হোয়াটসঅ্যাপে কল দিলো ইমরারের বর্তমান গর্ভবতী স্ত্রীকে। প্রথম রিং হতেই ভদ্রমহিলা রিসিভ করল। যেন সে অধিক আগ্রহ নিয়ে পূর্বেই অপেক্ষা করছিল তাঁদের জন্য। তিনি আমেরিকায় বসবাস করলেও, তার জন্ম হয়েছে বাংলাদেশে। এই সুত্রপাত ধরেই তিনিও বাংলা ভাষা স্পষ্ট ভাবে বলতে পারতো। জোহান এবার আদিলের হাতে তুলে দিলো ল্যাপটপ। আদিল ল্যাপটপটি এমন স্থানে রেখেছে যেখান থেকে সকলকে ঠিকভাবে দেখছেন সে। ইমরান প্রচুর ঘামছে। কাচুমাচু ভঙ্গিতে বারংবার ঢোক গিলছে। জোহান ল্যাপটপের পানে চেয়ে গুরুগম্ভীর গলায় শুধালো,
‘আপনি এক্সপ্লেইন করুন। সকলে উপস্থিত রয়েছে।’
তিনি নির্বোধ চোখে সবার পানে নজর বুলায়। ইমরানের পানে করুণ চোখে তাকিয়ে নজর সরিয়ে কোমল গলায় বলল,
‘আমি নিলীন। হুসাইন আহমাদের মেয়ে। তবে আমার আরেকটি পরিচয় আছে। ইমরান তালুকদারের স্ত্রী নিলীন তালুকদার।’
এবার যেন দ্বিতীয় বারের ন্যায় হতভম্ব হলো সকলে। ইমরানের ঘাম এবার কপাল ছুঁয়ে গাল বেয়ে নামছে ভয়ে। নিলীন বের বলল,
‘এক বছর আগে আমাদের কোম্পানির ইনভেস্টর হয়ে এসেছিল ইমরান। ভালোলাগা থেকে আমাদের মাঝে ভালোবাসা হয়। তারপর বিয়ে। কিন্তু হঠাৎ করেই বাংলাদেশে ছুটি কাটাতে যায় ইমরান। তখন থেকেই আমার সাথে সম্পর্ক বিচ্ছিন্ন তার। ভেবেছিলাম এত বছর পর নিজের দেশে ফিরেছে হয়তো ব্যস্ত। কিন্তু তেমনটা ছিল না। পুরোদমে আমায় ইগনোর করছে। পরে যখন আমার প্রেগন্যান্সির বিষয়টি জানাই ইগনোর আরো বৃদ্ধি পায়। আমি পুরোপুরি দমে যেতে শুরু করি। এই অসুস্থ অবস্থায় মম-ড্যাডকে বলতে পারছি না ইমরারের বিষয়। কারণ ওঁকে বিয়ে করার পুরো সিদ্ধান্ত ছিল আমার নিজের। তাঁদের বললে মুখ ফিরিয়ে নিতো না তবে আমায় স্নেহময় নয়নেও দেখতো না আগের মতো। এখনো তাঁদের কাছে গোপন।
পরশু আদিল নামের সে আমায় কল দেয়। অবশ্য ফেইক আইডি দিয়ে প্রথমে ইমরারের বিয়ের ছবি পাঠিয়েছিল। তারপর আস্তেধীরে জানতে পারি ইমরান বিয়ে করছে। এজন্য তার বাংলাদেশে যাবার মূল উদ্দেশ্য ছিল। আরেকটি ছিল। যখন থেকে আমি আমার সব প্রোপার্টি ছোট ভাইয়ের নামে উইল করে দিয়েছি। তখন থেকেই আমাকে ছাড়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে সে। ইমরান কেবল আমার না। সামাইরার জীবন নষ্ট করার জন্য বাংলাদেশে গিয়েছে। শুধুই আমার একার জীবন নষ্ট করেছে এমনটা নয়। এখানে আরো অনেক মেয়ে আছে ইমরানের শিকার। অনেক পরে তা আমি জানতে পারি। ভেবেছিলাম আমায় বিয়ে করে শুধরে যাবে৷ ভুল ছিলাম৷ ইমরান যেমন মেয়ে লোভী, তেমন টাকার লোভী একজন পুরুষ। আদিল আমায় আরো বলেছে। ছোট বেলায় ইমরান সামাইরাকে সে’ক্সু’য়া’লি হ্যারেজমেন্ট করতে চেয়েছিল। মেয়েটা অনেক বছর যাবত এই ঘটনাটি নিজের ভেতরে চাপিয়ে একা একা মেন্টালি সাপোর্ট দিয়েছে নিজেকে। খুবই স্টং মেয়ে সামাইরা। ভাগ্য ভালো জোহান ভাইয়ার জন্য সামাইরার জীবন নষ্ট হওয়া থেকে রক্ষা হয়েছে।’ নিলীন থামলো। সবাই এখনো স্তব্ধ হয়ে দাঁড়িয়ে আছে নিলীনের পানে। ইমরানের মা দপ করে বসে কান্না করতে শুরু করেছে ছেলের কুকর্ম শুনে। নিলীন কঠোর গলায় ফের বলল,
‘ইমরান শোনো। আমি ডিভোর্স লেটার পাঠানোর চেষ্টা করব যতদ্রুত সম্ভব। তোমার উপর থেকে মুভ অন শুরু করব। ভালো থেকো।’
এতটুকু বলেই দ্রুত ফোন রেখে দিলো নিলীন। আদিল ল্যাপটপ বন্ধ করে দিলো। এখন ড্রইংরুম জুড়ে পিনপতন নীরবতা বিরাজ করছে। ইমরানের ভেতরে অনুতপ্ত বোধের দেখা মিলল না। খুবই কঠিন ছিল তার মুখশ্রী।
জোহান হালকা কেশে বলল,
‘আশা করি আপনারা বুঝতে পেরেছেন সামাইরাকে কে কিডন্যাপ করেছে, আর কেন করেছি।’
কিছুই বলার থাকে না কারো। মিরান অনুতপ্ত বোধ নিয়ে দৃষ্টি নিচু রেখে দাঁড়িয়ে ছিল। ধীরে পায়ে এগিয়ে এসে ইমরানের সামনে দাঁড়ালো। ইমরানের নজর মিলছে না ছোট ভাইয়ের দিকে। মিরান শুধুই দেখছে তার ভাইকে। আচমকা সবাইকে অবাক করে সজোরে কষিয়ে চড় দিলো ইমরানের গালে। ইমরান রাগান্বিত চোখে দৃষ্টি উঁচু করল। ছোট ভাইয়ের চড়ে লজ্জা ও ক্ষোভ হলেও প্রকাশ করছে না। রাগে শরীর তিরতির করে কাপছে মিরারের। কাঠিন্য স্বরে বলল,
‘এই থাপ্পড়টি নিলীন ভাবির পক্ষ থেকে। আইডল মানতাম তোমাকে। হিরো ছিলে আমার জীবনের। বাবার পরে তুমিই ছিলে দ্বিতীয় ছায়া। অভিশপ্ত। তুমি অভিশপ্ত ছায়া। তোমার জন্য আমি আমার বাল্যকালের বন্ধুকে ঘৃণার চোখে দেখেছি। অনুতপ্ত আমি।’
বলতে বলতে জোহানের বুকে ঝাপিয়ে পড়লো মিরান। চোখ থেকে কয়েক ফোটা পানি পড়তে দেখা গেল। আদরে বুকে টেনে নিলো জোহান। ইমানুল সিকদার ছেলেকে ধাক্কা দিয়ে সেখান থেকে বের করে দিলো। জোরে চিল্লিয়ে গালাগালি করে ত্যাজ্যপুত্র করে দিলেন। ইমরান সেখানে থেকে প্রস্থান করলেন। তিনি মাফ চাইলের তার বন্ধুর কাছে।
বাল্যকালের বন্ধুর ছেলের কারণে যে আজ তাঁদের সম্পর্ক ভাঙতে বসেছে। খালিদ শেখ বন্ধুকে সান্ত্বনা দিয়ে জড়িয়ে ধরলেন।
হুমাইরা বাবু মেয়েকে বহু বছর পর বুকে আঁকড়ে ধরলেন। অভিমান, অভিযোগ ভুলে সামাইরা বাচ্চাদের মতো মায়ের বুকে পড়ে কাঁধছে।
তিনি ভুলে গেলেন সিয়ান কি ভাববে, দু’চোখে দেখার বিষয়। সব অতিক্রম করে এখন থেকে মেয়েকে ভালোবেসে আগলে রাখবেন ঠিক নিজের আপন মায়ের মতো।

এক মাস পর।

বক্স খাটযুক্ত বিছানাটি বেশ সুন্দর ভাবে বেলী, গোপাল ফুল দিয়ে সাজানো হয়েছে। মাথার উপর জ্বলছে হরেকরকম মচির বাতি।
গোলাপ ও বেলী ফুলের সুগন্ধে মাতোয়ারা পুরো রুম। লাল রঙের বেনারসি শাড়ি পরিহিত বিছানার মাঝখান বরাবর বসে আছে সামাইরা৷
আজ তার নতুন জীবনের সূচনা হয়েছে তারই প্রিয় মানুষটির সাথে। সে বক্ষে একরাশ ভালোবাসা, স্নিগ্ধ অনুভূতি নিয়ে অধিক অপেক্ষা করছে জোহানের জন্য৷ এই দিনের না ছিল অপেক্ষা, না ছিল তীব্র অনুভূতি। সব ভেতর থেকেই মরে গিয়েছিল। তবে আজ তা পূরণ হচ্ছে। না চাওয়া সব চাওয়া-পাওয়া পূর্ণতা পাবে। ভেবেই বুকে মোচড় দিয়ে উঠে। শিরদাঁড়া বেয়ে বয়ে যায় গরম এক বায়ু। মুখমন্ডল গরম হয়ে আসে লজ্জায়।
খট করে ঈষৎ শব্দ এলো। সামাইরার বক্ষে বের মোচড় দিলো। জোহান ফিরেছে রুমে বুঝতে পেরে শরীর যেন অব্যক্ত অনুভূতিতে গরম হয়ে আসছে ক্রমশে। জোহান তার প্রেয়সীর পানে স্নিগ্ধ দৃষ্টিতে তাকাল। ইমরানের প্রস্থানের পরপরই জোহান সামাইরাকে আপন করে নিয়েছে। বিয়ের প্রস্তাব রেখে আজ সে তার অর্ধাঙ্গিনী। এসব ভেবে এগিয়ে এলো বিছানার নিকট। শেরওয়ানির ওড়নাটা পাশে রেখে সামাইরার ডান হাত ধরলো। সামাইরা কেবল স্থির হয়ে রয়েছে। জোহান একটি ডায়মন্ডের আংটি পরিয়ে আলতোভাবে চুমু গেল। জোহানের ঠোঁটের স্পর্শে তীক্ষ্ণ অনুভূতিতে বাঁ হাতে বিছানার চাদর আঁকড়ে ধরলো। জোহান আলতোভাবে মাথার ঘোমটা সরালো। সামাইরার দৃষ্টি নিচু। তৎক্ষনাৎ ধীরে কণ্ঠে সালাম দিলো সামাইরা৷ জোহান মুচকি হেসে ঘাড়ের পেছনে হাত রেখে কাছে টেনে কানে কাছে ফিসফিস করে সালামের উত্তর দিলো। জোহানের গরম নিঃশ্বাসে সামাইরা চোখ খিঁচে বন্ধ করে নিলো। সরে এলো জোহান। কোমলভাবে বলল,
‘তুমি আমায় যেই মোহে আঁটকেছো। কেবল তুমিই উদ্ধার করতে পারবে।’
‘কিভাবে?’ অবুঝের মতো নিচু স্বরে সে জানতে চাইলো।
‘ভালোবাসার তুমিময় মোহতে আঁটকানো হৃদয় শুধুই ভালোবাসা দিয়েই মুক্ত করা যাবে।’
‘সত্যি?’ ফের সরু গলায় বলল।
‘উমম, ০%…’ ভাবলেশহীন সুরে শুধায়।
এবার কিঞ্চিৎ বাঁকা চোখে তাকালো সামাইরা। জোহান মুচকি হেসে দিতেই সামাইরা মৃদু হাসি প্রধান করল। দ্রুতই জোহান মিলিত করল তার ওষ্ঠদ্বয় দিয়ে সামাইরার ওষ্ঠ। তার সর্বোচ্চ ভালোবাসা উজাড় করে দিচ্ছে প্রেয়সীকে। তাঁদের ভালোবাসার মোহমায়া যেন এভাবেই অটুট থাকে চিরকাল।

সমাপ্ত।

®সুমাইয়া মনি