তুমি আমার পর্ব-১৯

0
575

#তুমি_আমার
#পর্ব_১৯
#লেখনীতে_নাজিফা_সিরাত

খান বাড়ীতে বসে কফির কাপে চুমুক দিচ্ছেন মিঃ খান।মনে তার হাজারো ভাবনা।আর কয়েকদিন পরেই আবেশ সিরাতের বিয়ে।এবার ধুমধাম করে ঘরে বউ তুলবেন তিনি।এই সপ্তাহেই কার্ড চাপতে দিতে হবে নইলে দেরী হয়ে যাবে।কয়েকটা কার্ড উল্টে পাল্টে দেখছেন তিনি।কিন্তু পছন্দ করতে ব্যর্থ।আরু মিসেস খানও আছেন পছন্দ করায় কিন্তু কেউই খুঁজে পাচ্ছে না।অবশেষে একটি কার্ড পছন্দ করতে সক্ষম হলেন তারা।দারুন হবে এটি।পুরোটা একটি ফুলের মতো।কার্ড চয়েজের কাজে বিজি থাকায় আরুর কলেজ যাওয়া হয়নি আজ।তাছাড়া সিরাতহীন কলেজও ভালো লাগে না তার।তাই ইচ্ছে করেই কলেজে পা বাড়ায় নি।বাপ মেয়ে মিলে কথা বলছে তখন হাস্যজ্জ্বল মুখে ব্যাগপএ নিয়ে বাসায় ঢুকলেন রাবেয়া খান।উনাকে দেখে চোখ কপালে উঠলো আরুর।মহিলাটিকে কোনেকালেই পছন্দ নয় তার।আবেশের সাথে বিচ্ছিরি ঘটনা ঘটানোর পর থেকে তো একেবারেই।নয়।ওর বাবাও যে খুব একটা খুশি হয়েছেন তেমনটা নয়।সেটা উনার মুখ দেখেই স্পষ্ট।

“ভাইজান আমি চলে এসেছি।শুনলাম তুমি নাকি আবেশের আবার বিয়ে দিচ্ছ তাই আগে চলে এলাম।বিয়ে বাড়ী কত কাজ বলো তো”।তিনি সৌজন্য সূচক হা হু করলেন।আরু নিজের মনে নখ কাটতে ব্যস্ত।ভদ্রতাসূচক বললো,

“ফুপি ভালো আছো”?তিনি বললেন “হ্যাঁ।তবে এবার এক। আসিনি অশনিকে নিয়ে এসেছি”।উনার কথায় চোখ কপালে উঠলো আরুর।এই অশনি মেয়েটাকে আরও সহ্য হয় না তার।কিন্তু তবুও সহ্য করতে হবে বলে দীর্ঘশ্বাস ছাড়লো।অশনি হাতে থাকা ছোট ব্যাগটা ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে ভেতরে ঢুকছে পরনে সেই ছোট খাটো হাঁটু পর্যন্ত জামা।ওকে দেখে মিঃ খান অন্য দিক ফিরে তাকালেন।এসব পোশাক আশাক কোনোকালেই পছন্দ নয় তার।ভিতরে এসেই বললো,

“হাই মামু!হাই আরু কেমন আছো তোমরা”?মিঃ খান দুটো কথা বলে কেটে পরলেন।আরুও কিছুক্ষণ পর চলে গেলো।মিসেস খান ওদের যত্নে ব্যস্ত।আরু বুঝে উঠতে পারে এতকিছুর পর ওর মা কেমন করে ওকে সহ্য করছেন।

আবেশ এসে একটি পাহাড়ের সামনে গাড়ি থামালো।সিরাতের মুখ বন্ধই হচ্ছে না।গাড়ি গাড়ি থামান গাড়ি থামান বলে মুখে ফেনা তুলে ফেলছে।এক প্রকার অসহ্য হয়েই গাড়ি থামিয়ে চুপচাপ বসে আছে আবেশ।মূলত নিজের রাগটাকে দমানোর চেষ্টায় সে।সিরাত সেদিকে দৃষ্টিপাত না করেই বলছে,

“গাড়ির লক খুলুন আমাকে যেতে দিন।আমি নামবো!নামবো আমি”।চেঁচাচ্ছে সিরাত।এবার হাত পা ছোড়াছুড়ি করছে সে।গাড়ির গ্লাসে ঠুকা দিচ্ছে বার বার।যাতে ওর রাগ কমার বদলে আরও বেড়ে চলেছে।রেগে অগ্নিমূর্তি ধারণ করে সিরাতের দিকে তাকালো আবেশ।ওর চোখগুলো দেখে মারাত্মক ভয় পেলো সিরাত।কেমন লাল লাল চোখ যেকোনো সময় ভষ্ম করে দিতে পারে তাকে।তুতলিয়ে বললো,

“এএভাবে তাকাচ্ছেন কেন?যেতে দিন আ….বাকী কথা শেষ করার আগেই আবেশ একটানে নিজের কোলে বসিয়ে দিলো তাকে।সিরাত থমকালো চোখ বড় বড় করে তাকালো দুজনে একদম কাছাকাছি।দুজনের সামনে কয়েক ইঞ্চি দূরুত্ব।আবেশের গরম নিশ্বাস সিরাতের চোখে মুখে উপছে পরছে।এতে ভেতরে অন্যরকম শিহরণ জাগাচ্ছে তার।আবেশের চোখের দিকে তাকিয়ে গভীরতায় ডুবে যায় সে।সিরাতের কাঁপাকাঁপি শুরু হয়ে গেছে ইতিমধ্যে। এই প্রথম আবেচ এতটা কাছে এলো তার।ঠোঁটগুলো কাঁপছে যা আবেশকে আরো বেশি টানছে।ধীরে ধীরে নিজের মুখ এগিয়ে নিলো সিরাতের মুখের কাছে।সিরাত শার্ট খামছে ধরলো আবেশের।চোখ বন্ধ করে নিলো।আলতো করে ওর ঠোঁট ছুঁইয়ে দিতেই সারা শরীরে বিদ্যুৎ খেলে গেলো তার।হাত পা যেন অবশ হয়ে এলো।কান দিয়ে গরম শীষা বেরুতে লাগলো।আবেশ আবার অধরযুগল স্পর্শ করলো এবার আর স্পর্শ করে থেমে নেই ওতেই মগ্ন হয়ে পরলো।অনেক দিনের তৃষ্ণা মিটাতে ব্যস্ত সে।

সিরাতকে বুকের মাঝে মিশিয়ে সিটে হেলান দিয়ে বসে আছে আবেশ।সিরাত লজ্জায় মাথা তুলে তাকাতে পারছে না।তাই লজ্জা লুকানোর জন্য ওর প্রশ্বস্ত বুকই বেছে নিয়েছে।আজকে আবেশে পাগলামিতে শকড সিরাত।এসবও উনার দ্বারা পসিবল ভাবতেই আরো বেশি লজ্জা লাগছে।কাঁজলের সাথে এসব করে কি সাধ মিটেনি এখন ওর সাথে একই আচরণ।অনেক্ষণ চুপ থাকার পর আবেশ চোখ বন্ধ অবস্থায় বললো,

“তোমাকে একটা গল্প শুনাবো শুনবে”?সিরাত ওর বুক থেকে মাথা তুলে মুখের দিকে দৃষ্টিপাত করে বললো,”বাসায় যাবো আমাকে বাসায় পৌঁছে দিন।আনার সাথে এমনটা না করলেও পারতেন।আর ভাববেন না আমি আজকেই সব শেষ করে দিবো।টেনশন ফ্রী থাকুন আপনাকে কেউ দোষারোপ করবে না”।আবেশের রাগটা আবারও মাথাচাড়া দিতে লাগলো।দাঁতে দাঁত চেপে ওর গাল চেপে বললো,

“নিজেকে খুব মহান মনে হয় তোমার তাই না।একদম আমার কাছে মহান হওয়ার চেষ্টা করো না।চুপচাপ আমার কথা শুনো”।সিরাত ব্যাথায় নড়াচড়া করছে কিন্তু সেদিকে হুশ নেই আবেশের।বারবার তাকে ছেড়ে দেবে শুনতে শুনতে এবার অতিষ্ঠ সে।যদি আরু এসব না বলতো তাহলে এখনই সব সম্পর্ক ছিন্ন করে চলে যেত আবেশ কিন্তু না এখন আর সেটা পারবে না।বহু কষ্টে নিজেকে দমিয়ে নিলো সে।সিরাতকে ছেড়ে করুণ সুরে বললো,

“আমার গল্পটা আগে শুনো তারপর যা বলবে তাই হবে”।আবেশের এই অনুরোধ ফেলতে পারলো না সিরাত। মাথা দুলিয়ে হ্যাঁ জানালো।আবেশ ওকে ছেড়ে দিতে পাশের সিটে বসিয়ে দিলো। উৎসুক হয়ে তাকিয়ে রইলো আবেশের দিকে।আবেশ চোখ বন্ধ অবস্থায়ই বলা শুরু করলো,

“একটি ছেলে একদিন একটা মেয়েকে দেখে ভালো লাগলো।মেয়েটা যদিও তার পরিচিত তার বন্ধুর বোন।অন্যদিকে ছেলেটার বোনের বেস্টু সে।সেই সুবাধে মেয়েটা ওদের বাড়িতে অবাধে যাতাযাত করতো।ছেলেটিও বন্ধুর বাসায় যাওয়া আসা করতো।ছোট থেকে যে মেয়েটাকে দেখে এসেছে তাকে কখনও অন্যভাবে নজরে আসে নি তার।বেস্টুর বোন তারও বোন সেই নীতির উপর অনঢ় রইলো সে।কিন্তু বাধ সাধলো ছেলেটা জয়েনিংয়ের দিন।সবে পড়ালেখা শেষ হতেই কোনো প্রিপারেশন ছাড়া একটি জবের জন্য এপ্লাই করলো সে।কিন্তু ভাগ্যবশত চাকরিটা হয়ে গেলো।ছেলেটা ছুটলো নিজের বাসায়।জয়েনিংয়ের দিন সকালবেলা ছেলেটা যখন গাড়ি করে আসছিলো তখন জ্যামে আটকে থাকার দরুন চোখ আটকে যায় ফুটপাত ধরে কলেজ ব্যাগে খিলখিলিয়ে হাসা একটা বাচ্চা মেয়ের উপর।মেয়েটি আজও ছেলেটির বোনের সাথে ছিলো।কিন্তু চেহারা দেখে বুঝে গিয়েছিল এটা তার বেস্টুর কলিজার টুকরো।যতক্ষণ পর্যন্ত মেয়েটাকে দেখা যাচ্ছিলো ততক্ষণ পর্যন্ত ওর দিকে তাকিয়ে ছিলো।তারপর আনমনে হাসলো সে।নিজের কাজে নিজেই বোকা বনে গেলে।সেদিন তার ভাইয়ের কাছ থেকে ওর সম্পর্কে সব জেনে ক্লাসে লেট করে আসা হেবিট হওয়ায় শাস্তি দিয়েছে।ক্লাসে গিয়ে মেয়েটিকে দেখে মনে হলো এসব মিথ্যা।আর যাইহোক ছাএীর সাথে প্রেম করা যায় না।তাই ওর থেকে দূরে সরিয়ে রাখে নিজেকে।কখনও নিজের অনুভূতিগুলো সামনে আসতে দেয়নি সে।মেয়েটার গায়েও একদিন হাত তুলেছে কারণ সে ছেলে বন্ধুর পাল্লায় পরে দৌড়াদৌড়ি করছিলো যা মোটেও সহ্য হচ্ছিলো না তার।এরপর একদিন সেই মেয়েটা হারিয়ে গেলো।কোথায়ও তাকে খুজে পাওয়া যাচ্ছিলো না তখন ছেলেটার পাগল প্রায় অবস্থা।সারারাত এদিক সেদিক ঘুরে যখন মেয়েরাকে বিধ্বস্ত অবস্থায় দেখলো তখন নিজেকে সামলাতে পারলো না সে।মেয়েটাও সেদিন নিজে থেকে ওকে স্পর্শ করেছিলো এতটুকুই ছেলেটার প্রাপ্তি।এরপর ভাগ্যক্রমে কীভাবে ছেলেটার সাথে মেয়েটার জীবন জুড়ে গেলো।সেদিন সবথেকে খুশি হয়েছিলো সেই ছেলেটি।কিন্তু মেয়েটির অপমান চায় নি সে।তবুও নিয়তিকে মেনে নিয়েছে।ভেবেছিল ওই দিন মেয়েটিকে সবকথা বলবে কিন্তু মেয়েটির দিকে সেটা পারলো না সে।কারণ ততক্ষণে মেয়েটির মুখ দেখে ওর বিয়েতে নাকচ করায় মনটাকে ভেঙ্গে দিয়েছিল ।তারপর স্বামী হিসেবে জোর দেখিয়ে বলেছিল এক সপ্তাহ পর বাড়ি ফিরতে কিন্তু ফিরে নি।আবারও আশাহত হয় সে।সহজ সরল সবকিছু জটিল হয়ে যায়।অভিমানে অভিযোগে ছেলেটা নিজের মন মর্জি মতো চলতে থাকে মেয়েটিকে তার ইচ্ছে মতো চলতে দেয়।এরইমাঝে আবারও মেয়েটির জীবনে তার অবস্থান বুঝাতে চায়।অনুভূতিগুলেকে মূল্য দিয়ে তার প্রতি ভালোবাসা প্রকাশ করতে থাকে আবারও ফলাফল শূন্য।নিজের একদিনের আবদার রাখতে ব্যর্থ সে।তাও অন্য একটি ছেলের জন্য।এবার ছেলেটার রাগ হয়।খুব রাগ তাই নিজেকে ওর থেকে অনেক দূরে সরিয়ে নেয়।ইগনোর করে মেয়েটাকে।তখন তার কলেজে আসে তার একজন মেয়ে ফ্রেন্ড সবকিছু শুনে তার ভারাকান্ত বিষন্ন মন দেখে সঙ্গ দেয় যাতে ও কিছুটা স্বাভাবিক থাকে।কিন্তু তাতে মেয়েটার ভিতরে কি চলছে বুঝতে ব্যর্থ হয়।এরপর আবারও মেয়েটি ভুল বুঝে ছেলেটিকে।তার ফ্রেন্ডের চোখে কিছু ঢুকায় সেটা বার করছিলো তখন মেয়েটি অন্যকিছু ভেবে রেগে মেগে ছেলেটিকে কয়েকটি কথা শুনিয়ে বেড়িয়ে যায়।ছয়দিন নিখোঁজ থাকার পর মেয়েটার দেখা পায় সে।এই ছয়দিন খুব কষ্টে কাটে তার।কিন্তু মেয়েটা ত। আন্দাজও করতে পারে নি।এতদিন পর এসে মেয়েটা ছেলেটার কোনোকথা শুনে না।মেয়েটির একরোখা স্বভাবের কারণেই ছেলেটি কষ্ট পায় খুব বেশি কষ্ট পায়।আশা করি ছেলেটি আর মেয়েটি কে বুঝতে পেরেছো তুমি।”

সিরাত এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে আবেশের দিকে।এতদিন ও জেনেছে আবেশকে ভালোবাসে।কিন্তু আজকে কি শুনলো সে।ভাবতেও পারে নি আবেশ তাকে ভালোবাসবে।আর সেদিনের ঘটনাটা কিছুই ছিলো না।অথচ সেই বিষয়টাকে সে কতটা ঘোলা করেছে।কষ্ট দিয়েছে।শুধু নিজেক নয় তাকেও।ও তো ভেবেছে আবেশের জীবনে কাঁজল আছে তাই সরে যেতে চেয়েছিল কিন্তু কেউ নেই।ওই লোকটা শুধু তার।একমাএ তার অধিকার।যেটা ঘুণাক্ষরেও টের পায় নি।এখন সিরাত আবেশকে কি বলবে বুঝতে পারছে না সে।কি করে মুখ দেখাবে।হুহু করে কাঁদছে সিরাত।এ কান্না দুঃখের নয় এটা সুখের কান্না।

#চলবে