তুমি আমার প্রেয়সী পর্ব-২৪

0
1817

#তুমি_আমার_প্রেয়সী
#পর্ব_২৪
#তাসনিম_জাহান_রিয়া

আমরা একটা সুন্দর জায়গায় ঘুরতে এসেছি। আমি একটা পাহাড়ের ওপর দাঁড়িয়ে আছি। যেদিকে তাকাই সেদিকেই শুধু সবুজ আর সবুজ। কী সুন্দর মৃদু বাতাস বইছে। প্রাকৃতিক বাতাস। আমি যখন প্রকৃতি দেখতে ব্যস্ত তখন পিছন থেকে কেউ আমাকে ধাক্কা মারে। আমি যখন পড়ে যেতে নেই পিছন থেকে একটা হাত আমাকে আঁকড়ে ধরে। কিন্তু শেষ রক্ষা আর হলো না তাকে নিয়েই আমি পাহাড়ের থেকে পড়ে গেলাম।

ধপ করে চোখ খুলে ফেললাম। তাড়াতাড়ি শোয়া থেকে ওঠে বসলাম। টেবিল ল্যাম্পটা জ্বালিয়ে এক গ্লাস পানি খেয়ে নিলাম। গলা শুকিয়ে যাচ্ছে বার বার। সারা শরীর ঘামে ভিজে গেছে। হাতের উল্টো পিঠ দিয়ে কপালে জমে থাকা বিন্দু বিন্দু পানি কণা মুছে নিলাম। বুক ধুকপুক করছে। হার্ট স্বাভাবিকের থেকেও দ্রুত গতিতে বিট করছে। শরীর ভয়ানক ভাবে কাঁপছে।

রুমের এসি অন করে আবার শুয়ে পড়লাম। কিন্তু কিছুতেই চোখে ঘুম ধরা দিচ্ছে না। চোখ বন্ধ করলেই তখনকার স্বপ্নটা চোখের সামনে ভেসে ওঠছে। না এভাবে ঘুমানো সম্ভব না। বিছানা থেকে নেমে বেলকনিতে চলে গেলাম। বেলকনিতে রাখা দোলনায় বসে পড়লাম। আমার ঠিক সামনেই মিদু। মিদুর দিকে তাকিয়ে ভাবতে লাগলাম।

এ কেমন স্বপ্ন দেখলাম? কে আমাকে ধাক্কা দিল কেই বা আমাকে আঁকড়ে ধরল? এই স্বপ্ন যদি সত্যি হয় তাহলে। না না এটা কি করে সত্যি হবে। আমার সাথে কার শত্রুতা আছে যে আমাকে মেরে ফেলার জন্য পাহাড় থেকে ধাক্কা দিয়ে ফেলে দিবে।

এসব ভাবতে ভাবতে যে কখন সকাল হয়ে গেছে খেয়ালই করি নাই। সারা রাত কাটল নির্ঘুম আর ছটফট করতে করতে। ওয়াশরুম চলে গেলাম ফ্রেশ হতে। ফ্রেশ হয়ে ওয়াশরুম থেকে বের হয়েই আমি অবাক হয়ে যায়। কারণ আমার রুমে অহি আর বন্যা বসে আছে। অহি ঘুমের জন্য ঢুলছে। ঘড়ির দিকে তাকিয়ে দেখি মাত্র সকাল ৫ টা বেজে ৩০ মিনিট। আমি বন্যাকে উদ্দেশ্য করে বলি,

এই কাক ভোরে কোনো ফক্কিনিও কারো বাসায় ভিক্ষা চাইতে আসে না। আর তুই এতো সকালে আমাদের বাসায়।

বন্যা কণার কথা শুনে তেলে বেগুনে জ্বলে ওঠে। কণার দিকে তাকিয়ে চোখ পাকিয়ে বলে,

তুই আমাকে ফক্কিনির থেকেও নিম্নশ্রেণীর সাথে তুলনা করলি।

অহি আমি কী একবারও এই কথা বলছি? কথায় আছে না, সবার মাঝে পড়ল কথা যার কথা তার গায়ে লাগে।

অহি মাথা নেড়ে সম্মতি জানায়। এতে জেনো বন্যার রাগ আরও এক ধাপ বেড়ে যায়।

তো তোদের বাসার খাবার দাবার সব শেষ হয়ে গেছে নাকি যে এতো সকালে আমাদের বাসায় খেতে চলে এসেছিস? খাবার খে…..

আর কিছু বলার আগেই বড় আম্মু আমার কান টেনে ধরে।

আহ ….. বড় আম্মু লাগছে। কানটা ছাড় প্লিজ।

ছাড়ব না। আগে বল আরও বন্যার পিছনে লাগবি? কতদিন পরে মেয়েটা আমাদের বাসায় আসছে। আর তুই মেয়েটাকে খোটা দিচ্ছিস।

বড় আম্মু আরো একটু জুরে কানে ধরে টান দেও। ফাজিল মাইয়া আমাকে ফক্কিনি বলে।

বড় আব্বু ডাক দেওয়ায় বড় আম্মু আমার কান ছেড়ে দিয়ে চলে যায়। যাওয়ার আগে আমাদের তিনজনকে উদ্দেশ্য করে বলে দিয়ে গেছে নাস্তা করে নিতে। বড় আম্মু আমার রুমে আসছিল আমাদের তিনজনের জন্য নাস্তা নিয়ে।

এমনিতে তো তোকে টানা হেচড়া করেও আমাদের বাসায় আনা যায় না। আর আজকে এত সকালে আমাদের বাসায়। ব্যাপার কী?

সাজার জন্য আসছি। তুই তো জানিস আমার সাজতে অনেক সময় লাগে। মিরা ( বন্যার ভাইয়ের মেয়ে) আমি সাজতে গেলেই শুধু ডিস্টার্ভ করে তাই তোদের বাসায় চলে এসেছি।

অনুষ্ঠান শুরু হবে সাড়ে ১০ টা থেকে। আমাদের সবাইকে ১০ টার মাঝে থাকতে বলছে। আর এখন বাজে সাড়ে ৫ টা। আমাদের বাসা থেকে ভার্সিটি যেতে সময় লাগে ২০ মিনিট। তোর ৪ ঘন্টা ১০ মিনিট সময় লাগব সাঁজতে।

আজকে স্পেশাল সাঁজ দিতে হবে না। যতই হোক আজকে আমার ক্রাশ আসবে। উপ উনার সাথে দুইটা সেলফি নিতেই হবে।

ছিঃ তোদের না বয়ফ্রেন্ড আছে। বয়ফ্রেন্ড থাকতে অন্য ছেলেদের ওপর নজর দিস। লজ্জা করে না। আমি আজকেই সাফাত ভাইয়া আর নোমান ভাইয়াকে বলব।

কণা প্লিজ সাফাতকে বলিস না। দেখ আমি নিজের ইচ্ছায় আসতে চাইনি। এই সয়তান মাইয়া আমারে ঘুম থেকে টেনে তুলে নিয়ে আসছে। আমার সাদের ঘুমটা বিসর্জন দিয়ে এখানে বসে থাকতে হচ্ছে। দেখ এখনো কেমন ঘুমে ঢুলছি?

সারা রাত জেগে সাফাত ভাইয়ার সাথে কথা বললে তো সকালে ঘুম তো ছাড়তেই চাইবে না।

বন্যা আমার দিকে শকুনের দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে। বন্যার এমন দৃষ্টি দেখে আমি থতমত খেয়ে যাই। বন্যা সিআইডির মত প্রশ্ন করে।

আমরা না হয় সারা রাত জেগে বয়ফ্রেন্ডের সাথে কথা বলি। তুমি কার সাথে কথা বলিস। তুমি আমাদের থেকে লুকিয়ে তলে তলে টেম্পু চালাও।

আরে তেমন কিছু না।

দেখ মিথ্যা বলে লাভ নেই। তোর চোখ বলে দিচ্ছে তুই রাত জেগে ছিলি। চোখ জোড়া কেমন কেমন লাল হয়ে আছে।

অহি বেসুরো গলায় গান গাওয়া শুরু করে।

তুমি তলে তলে টেম্পু চালাও
আমি করলে হরতাল
আমি করলে হরতাল
বুনু আমি করলে হরতাল

থাম থাম মেরি মা। ( তারপর ওদেরকে স্বপ্নের কথাটা খুলে বললাম।)

বাল তুই একটা স্বপ্নের জন্য রাত জেগে ছিলি?

বন্যা এসব বিচ্ছিরি ভাষা আমার সামনে বলতে না করছি না।

বাল কত সুন্দর ভাষা। বাঙালি হয়েও যদি তুমি বাল না বলো তাহলে তুমি কোন বালের বাঙালি। বা…

আর কিছু বলার আগেই বন্যার মুখে খাবার ঢুকিয়ে দিলাম। একবার যখন এই টেপ রেকর্ডার চালু হয়ছে মুখে খাবার না ঢুকলে বন্ধ হবে না। আমরা তিন জন একসাথে নাস্তা করে নিলাম। নাস্তা শেষে কিছুক্ষণ আড্ডা দিয়ে তিনজন সাঁজতে বসে গেলাম।

____________________

গত এক ঘন্টা ধরে আমি আর অহি বন্যার জন্য অপেক্ষা করছি। কিন্তু এই মেয়ের সাজ শেষ হওয়ার কোনো নাম গন্ধও নেই। আমরা তিনজন এক রকম করে সেজেছি। আমি আর অহি হালকা মেকআপ করছি আর এই মেয়ে ভারি মেকআপ করতে গিয়ে সময় নষ্ট করছে। আমরা তিনজনেই নীল রঙের জর্জেট শাড়ি পড়ছি। হাতে নীল রঙের কাঁচের চুড়ি পড়ছি। ঠোঁটে খয়েরি রঙের লিপস্টিক। হালকা মেকআপ করছি। খোলা চুলে দুইটা লাল গোলাপ গুজে দিয়েছি। কানে নীল পাথরের লম্বা ইয়ার রিং পড়ছি। আমাদের আরো ১৫ মিনিট ওয়েট করিয়ে বন্যার সাজ কম্পলিট হলো। অতঃপর তিন বান্ধবী ভার্সিটির উদ্দেশ্যে বাসা থেকে বের হলাম।

৫৭

বন্যা, অহি আর কণা ভার্সিটির গেইট দিয়ে প্রবেশ করছে। সবার দৃষ্টি তাদের দিকে বিশেষ করে কণার দিকে। কণাকে হুর পরির থেকেও কোনো অংশে কম লাগছে না। কণাকে দেখে অনেক ছেলে বুকের বাম পাশে হাত দিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। কিন্তু সেদিকে কণার কোনো খেয়াল নেই সে তো তার বান্ধবীদের সাথে গল্পে মত্ত্ব।

____________________

আমি, অহি আর বন্যা দাঁড়িয়ে কথা বলছিলাম। তখন হুট করে ছোঁয়া এসে আমার হাত ধরে কান্না শুরু করে দিল।

কণাকে আমাকে প্লিজ তুমি ক্ষমা করে দেও। আমি তোমার সাথে অনেক অন্যায় করেছি। আমি তোমার সাথে অন্যায় করে এখন অনুশোচনায় ভুগছি। তুমি হয়তো ভাবছ এতো বছর যার ভিতর অনুশোচনা জাগেনি আর আজকে অনুশোচনা জেগে ওঠলো বা কয়েক দিনে আমি কী করে চেইন্জ হয়ে গেলাম? ভাইয়া আমার চোখ খুলে দিয়েছে। আমি সত্যিই অনুতপ্ত। প্লিজ আমাকে ক্ষমা করে দেও।

আমি তোমাকে ক্ষমা করতে পারব না। তুমি আভিয়ান ভাইয়ার সাথে প্লেন করে আমার ক্ষতি করার জন্য ক্ষমা চাওয়ার নাটক করছ না তার কী গ্যারান্টি আছে?

কণা আমি কোনো নাটক করছি না। আমি সত্যিই অনুতপ্ত তাই তোমার কাছে কাছে ক্ষমা চাইছি। আমি জানি তোমার সাথে যা অন্যায় করেছি তা ক্ষমার অযোগ্য। তার শাস্তিও আমি পেয়েছি। তোমার সাথে অন্যায় করেছি বলেই হয়তো আল্লাহ শাস্তি হিসেবে আমার এত কঠিন একটা অসুখ হয়েছে।

মানে?

কণা আমার ব্রেইন ক্যান্সার হয়ছে। আমি আর মাত্র ৫ মাস বাঁচব। কণা এই অপরাধবোধ নিয়ে আমি মরতে চাই না। আমি তোমার দুইটা পায়ে পড়ছি। প্লিজ আমাকে ক্ষমা করে দেও।

বলতে বলতে ছোঁয়া আমার পা জড়িয়ে ধরে। সবাই আমাদের দিকে অদ্ভুত ভাবে তাকিয়ে আছে। যা দেখে আমার আনইজি লাগছে। ছোঁয়া তো তার শাস্তি পেয়েছে। আল্লাহ তার কুকর্মের শাস্তি দিয়েছে। ছোঁয়া তো মন থেকে ক্ষমা চাইছে। আমি ক্ষমা করে দিতেই পারি।

৫৮

হাতে ফুলের ডালা নিয়ে দাঁড়িয়ে আছি আদিয়াত আয়মানকে ওয়েলকাম করার জন্য। আমার এভাবে দাঁড়িয়ে থাকার একটুও ইচ্ছে ছিল না। তখন ছোঁয়াকে ক্ষমা করে দেওয়ার পর ছোঁয়া চলে যায়। ছোঁয়া চলে যাওয়ার পরেই সিনিয়র কিছু ভাইয়ারা এসে আমাদের তিনজনের হাতে ফুলের ডালা ধরিয়ে দেয় আদিয়াত আয়মানকে ওয়েলকাম করার জন্য। অহি আর বন্যা খুশি হলেও আমার একটু ভালো লাগে নি।

ইতিমধ্যে ভিসি জানিয়ে দিয়েছে আদিয়াত আয়মান কিছুক্ষণের মাঝে চলে আসবে। ফুলের ডালা নিয়ে এভাবে দাঁড়িয়ে আছি। নিজেকে দেখে কামলা কামলা ফিলিংস আসছে। ভার্সিটির গেইটের সামনে তিন তিনটা কালো গাড়ি থামে। সামনের এবং পিছনের গাড়ি থেকে কালো পোশার দাড়ি কিছু বডিগার্ড বের হয়ে মাঝখানের গাড়িটির ডোর খোলে দেয়। গাড়ির ভিতর থেকে বের হয়ে আসে একজন সুদর্শন পুরুষ।

চলবে……