তুমি আমি দুজনে পর্ব-৩৯+৪০

0
733

#তুমি_আমি_দুজনে
#লেখিকা_হুমাইরা_হাসান
পর্ব- ৩৯

বাড়িতে ফেরার পর থেকে টুনিকে খুঁজে পাচ্ছে না তুরা, সেসময় কাজের ফাঁকে অতটা গুরুত্ব দেয়নি, কিন্তু বিকেল হয়ে গেলো এখনও টুনিটা তার কাছে আসল নাহ। এমনিতে তো তার কাছেই চিপকে থাকে সবসময়। আশেপাশে না পেয়ে তুরা আহানের ঘরের দিকে গেলো। আহান ফিরেছে ঘন্টা দুয়েক আগে তবে তুরা ওর সামনেই যায়নি। রাইমার ঘরে বসে ছিলো ঘাপটি মেরে।
গুঁটি গুঁটি পায়ে এগিয়ে দরজার সামনে দাঁড়াল, বুকের ভেতর অসহনীয় ধুকপুকানি শুরু হয়েছে, আহানের মুখটা দেখলেও তার লজ্জা লাগছে।
দরজা সামান্য ফাঁক করে ঘরে ঢুকল ভেতরে তো আহান নেই! তবে সেদিকে মাথা না ঘামিয়ে তুরা টুনিকে খুঁজতে লাগল।
ঘরের ভেতর উলোট পালোট করে ফেলেছে,অবশেষে ফ্লোরে শুয়ে খাটের নিচে উঁকি দিতে লাগলে আহান বারান্দা থেকে ল্যাপটপ টা হাতে ঘরে ঢুকল, পুরো ঘরের অবস্থা বেহাল, তুরাকে ফ্লোরে শুয়ে থাকতে দেখে বলল

-ফ্লোয়ে শুয়ে কি করছ তুমি?

হঠাৎ আহানের গলা শুনে তুরা ধড়ফড়িয়ে উঠতে গেলে খাটের কাঠের সাথে ধুপ করে গুতা লেগে ব্যথায় মুখ কুচকে নিচেই পরে রইল। সব রাগ গিয়ে পরল আহানের উপর, এই লোকটার এখনই আসতে হলো! ব’জ্জাত লোক,মাথাটা ফেটে যাচ্ছে

তুরাকে সটান উপুড় হয়ে নিচে শুয়ে থাকতে দেখে আহান এগিয়ে এসে সামনে বুকে দুহাত গুঁজে দাঁড়ালো। তুরা ঘাড় ঘুরিয়ে আহানকে দেখে আবারও অন্যদিকে মুখ ফিরিয়ে নিলো। আহান হাত বাড়িয়ে তুরার বাহু ধরে ওকে দাঁড় করালো, তারপর মাথাটা এপাশ ওপাশ করে দেখলো কোথায় লেগেছে।

-নিচে শুয়ে কি করছিলে তুমি?

প্রশ্নটা শুনে তুরার মন খারাপ হয়ে গেলো, মুখ ছোট করে বলল

-আমার টুনিকে খুঁজে পাচ্ছিনা

আহান কোনো উত্তর না করায় তুরা ঘাড় উচিয়ে তাকাল লম্বা চওড়া মানুষটার গম্ভীর চেহানা পানে,মুহূর্ত খানেক নিশ্চুপ থেকে ভার গলায় বলল

-তোমার আজাইরা বিড়াল টাকে বলো আমাকে ফলো করা বন্ধ করতে, ওর জ্বালায় আজকাল কাজ করেও আমি শান্তি পাইনা।

বলেই সরে গিয়ে টেবিলে ল্যাপটপ রাখতে গেলেই তুরার চোখ গেলো আহান দাঁড়িয়ে থাকা স্থানটাই, এতক্ষণ তাহলে এখানেই ছিলো পাঁজিটা,তুরা চোখ গরম করে টুনির দিকে তাকাল, কিন্তু তাতে তার কি সে তো ছোট্ট লেজটা গুটিয়ে হাত টা মুখের কাছে নিয়ে চাটছে। দু’হাতে কোলে তুলে নিলো তুরা খিটমিট করে বলল

-সমস্যা কি তোর, সুযোগ পেলেই এই জল্লাদ লোকটার কাছে এসে বসে থাকিস কেনো।

টুনি কি বুঝল ওই জানে,তবে তুরার কথায় তার কোনো কান নেই৷ সে তো অপলক চেয়ে আছে আহানের দিকে। তুরার কোল থেকেই ম্যাও করে ডেকে উঠলো আহানের দিকে চেয়ে,আহান ফাইল গুলো রাখতে রাখতে টুনির দিকে তাকিয়ে বলল

-তোমার বোন তো সুযোগ পেয়ে আমার মান সম্মান লুটে নিয়েছে,এখন তুমিও পরেছ পেছনে। দুজন মিলে আমাকে খেয়ে ফেলবে কোনদিন।

-আপনার মতো জল্লাদ লোকটাকে খেতে আমার বয়েই গেছে, আমিতো আইসক্রিম খাবো লাল টুকটুকে রঙের

আহানের কথা শুনে কোনো দিক না ভেবেই তুরা ফট করে বলে উঠলো। আহান তীক্ষ্ণ চাহনিতে তুরার দিকে তাকালেই চুপ হয়ে গেলো।

-কি বললে, আমি জল্লাদ?

মাজায় হাত রেখে বলল আহান, তুরা আহানের এমন ধীম গলায় খানিকটা ভড়কে গেলো, আমতাআমতা করে দুকদম পিছিয়ে খাটের সাথে ঘেঁষে দাঁড়িয়ে বলল

-ক্ কই না তো!

-কালকেও অনেক কিছু বলছিলা, আমি ব’জ্জাত,জল্লাদ আর কি যেন ও হ্যাঁ উগান্ডা! আমি উগান্ডা?

-নাহ,না তোহ। আপনি তো ভালো,খুব ভালো

জড়তা ভরা গলায় বলল তুরা, এসব কখন বলেছিল সে? তাও আহানের সামনেই,কাল কি বলেছিল কিচ্ছুটি মনে নেই তার। টুনিকে দু’হাতে চেপে খাটের পাশ ঘেঁষে দাঁড়াল। আহান এগিয়ে এসে একদম নাক বরাবর দাঁড়িয়ে বলল

-খুব বার বেড়েছে তোমার। কাকে কি বলো তুমি? আমি কে হই তোমার?

জবাবে তুরা ফ্যালফ্যাল করে চেয়ে থাকলে আহান শক্ত গলায় বলল

-কি হলো বলছ না কেনো আমি কে হই তোমার?

-স্ স্বামী..

-এক্সাক্টলি! তো নিজের হাসব্যান্ডকে ভয় পাওনা?

বলেই তুরার একদম কাছাকাছি এগিয়ে আসলে তুরা তাল সামলাতে না পেরে খাটে পরে যেতে নিলে এক হাতে টুনিকে আরেক হাতে আহানের টি-শার্ট খামচে ধরে থপ করে বিছানার উপর পরে গেলো, সাথে আহানও ও ওর দুপাশে হাত রেখে ঝুকে পরেছে।
তুরা রেগে তাকাল আহানের দিকে, কেমন জামাই এটা? আবার বলে আমি তোমার হাসব্যান্ড! পরে গেলো বাচাতে পারল তো না উল্টো নিজেই ঝুকে আছে।

-আমি পরে গেলাম ধরলেন না কেনো আমাকে

আহান তুরার উপর থেকে নিচ পর্যন্ত একবার চোখ বুলালো। আহানের এরূপ দৃষ্টিতে তুরা ভড়কে গেলো। থতমত খেয়ে কিছু বলতে নিবে তখনই দরজার বেল বেজে উঠলে এক হাত দিয়ে ধাক্কা দিয়ে আহানকে সরিয়ে উঠে দৌড়ে বেড়িয়ে গেলো।
আহান চিত হয়ে শুয়ে পরল বিছানায়,তুরার ভড়কে যাওয়া চেহারা টা দেখতে ইদানীং অনেক বেশি ভালো লাগে, তাই কারণে অকারণে তুরাকে ভীষণ অস্বস্তিতে ফেলে দেয়। মাথার নিচে দুহাত দিয়ে এসব ভাবতেই বুকের উপর কিছু একটার ভার অনুভব করতেই ভ্রু কুচকে মাথা উচু করে তাকাতেই দেখল টুনি সামনের দুহাতে আহানের বুকের উপর ভর দিয়ে ম্যাও করে উঠলেই আহান ছিটকে সরে এসে বলল

-সমস্যা কি তোমার,আমাকে এত ভালো লাগে? গাল টিপে আলু ভর্তা করে দেবো আজাইরা বিড়াল

~

ড্রয়িং রুমে বসে চায়ে শেষ চুমুক দিলো রায়হান আজাদ। চায়ের কাপটা সামনে রেখে বলল

-তাইলে আসি মা

-এখনই চলে যাবেন আংকেল,আরেকটু থাকুন। বাবা মাও কেও বাসায় নেই তারা যদি জানতে পারে আপনি এভাবে এসেই চলে গেলেন খুব কষ্ট পাবেন

রায়হান গোলগাল মুখ খানা ছড়িয়ে হেসে উঠে বললেন

-আবারও আসব মা, আজকে যেতে হবে। ইনসাফ আসুক আমি আবারও আসব

বলেই উঠে দাড়ালো, পাশেই প্রেমা মুখ কালো করে বসে আছে। মূলত প্রেমাকে নিতেই এসেছেন রায়হান। তার বোনের বাড়িতে যাবেন ময়মনসিংহ, তাই প্রেমাকে নিতে এসেছে। প্রেমা বার কয়েক নাকচ করলেও তিনি প্রেমাকে সাথে নিয়ে তবেই যাবে। রায়হান উঠে দাঁড়ালে প্রেমা মুখ কালো করেই সুটকেস টা নিয়ে দাঁড়ালো। আহানের সাথে আরও কিছু কথা বলে রায়হান বেরোলে প্রেমাও প্রচণ্ড অনিচ্ছা সত্ত্বেও হাঁটা ধরলো

-আপু

তুরার ডাকে হাঁটা থামিয়ে দাঁড়াল প্রেমা। তুরা চোখ মুখে মেকি আবেগ দেখিয়ে বলল

-আহারে,আমিতো ভেবেছিলাম তুমি আরও মাস খানেক থাকবে আপু। ইস,কি আর করার বলো। সে যেতেই হচ্ছে। তবে তোমার যখন ইচ্ছে করবে চলে আসবে কেমন? উনিতো রাইমা আপু আর তোমার মধ্যে পার্থক্য করেন না একই রকম ভালোবাসেন দু বোনকে।

বোন!শুনেই প্রেমার মেজাজ তুঙ্গে চড়ে গেলো, শেষে কি না আহানের বোন। এক আঙ্গুল তুলে তুরার মুখের সামনে ধরে কিছু বলবে তার আগেই তুরা প্রেমার হাত ধরে কাঁদো কাঁদো মুখ করে বলল

-থাক আপু, আর কিছু বলোনা। তুমি চলে যাচ্ছ ভেবেই তো আমার কান্না পাচ্ছে

প্রেমা বিড়বিড় করে ষ্টুপিড বলে গজগজ করে বেড়িয়ে গেলে তুরা ওর যাওয়ার পানে তাকিয়ে ফিক করে হেসে দিলো। বেশ হয়েছে,পেত্নী টা ঘাড় থেকে নেমেছে।

কৃষ্ণকায় আকাশে থালার মতো রূপালি চাঁদটা জ্বলজ্বল করছে, তার চারিপাশ জুড়ে টিমটিমে তারার আলো। যা অদ্ভুত এক আলোড়ন তৈরি করেছে পরিবেশটাতে। গ্রীষ্ম পেরিয়ে বর্ষার আহ্বান জানিয়ে দমকা বাতাসে থেকে থেকে ভেসে আসছে নানান ফুলের সুবাস। পরিবেশের বুকে দাম্ভিকতার সহিত স্বচ্ছ নির্মল উৎফুল্লতা উপচে পরেছে।
তুরা রাইমার ঘরের বারান্দার দরজায় হেলান দিয়ে নির্নিমেষ তাকিয়ে আছে আবকাশ পানে। ঘ্রাণেন্দ্রিয় টেনে টেনে সুবাস নিচ্ছে ঠিক নিচেই অবস্থিত বাগানটার নানান ফুলের।
রাত সাড়ে এগারোটা। টেবিলে রাতের খাবার বেড়ে রেখে রাইমার ঘরে এসে পড়তে বসেছিল তুরা,সামনেই পরীক্ষা। তবে পড়া টা তো নিতান্তই বাহানা,সে তো পালিয়ে বেড়াচ্ছে আহানের থেকে। বিকেলের পরে সামনেও যায়নি,পালিয়ে পালিয়ে বেড়াচ্ছে।
তুরার চোখ জোড়া বাগানের দিক থেকে নড়েচড়ে গিয়ে পরল অদূরবর্তীই একটা ফ্লাটের দিকে। যেটার রাইমার ঘর থেকে উত্তরের দিকটাতে। বিল্ডিং টা এদিক থেকে বিপরীতে মুখ করে দাঁড়িয়ে থাকলেও বড় আকৃতির জানালা গুলোর মুখ এদিকটাতেই। খোলা জানালা ভেদ করে তুরার সূক্ষ্ম দৃষ্টি অস্পষ্টতা ভরা এক দৃশ্যতে তাকাতেই কপালে ভাঁজ পরলো। ভ্রু যুগল কিঞ্চিৎ কুচলে তাকালেই ভ্যাবাচেকা খেয়ে গেলো, তড়িৎ গতিতে নাক মুখ কুচকে বলে উঠলো

-ছিহ্

গা গুলিয়ে উঠল তুরার, নির্লজ্জতার একটা সীমা আছে, এভাবে জানালা খোলা মেলা রেখে এসব কেও করে! এসব দেখেও তুরার চোখ কেঁপে উঠলো, নাশকতার ও একটা সীমাবদ্ধতা থাকা উচিত। দ্রুত চোখ ফিরিয়ে অন্যদিকে ঘুরিয়ে বলল

-ছিছিছি,,আস্তাগফিরুল্লাহ্। এসব মানুষ কি লাজ লজ্জা শরমের মাথা খেয়েছে। এসব দেখে আমার ভোলা ভালা মনটাও অপবিত্র হয়ে যাবে।

-কি করছো এখানে?

ভরাট কণ্ঠস্বর শুনে তুরা ধড়ফড়িয়ে তাকাল পেছনে৷ দরজায় গুতা লাগলেও সেটা সামলে তাকাল বুকে হাত গুঁজে দাঁড়িয়ে থাকা আহানের দিকে। তীক্ষ্ণতেজী চোখের দিকে তাকিয়ে সূক্ষ্ম ঢোক গিলল, আহান বিরক্তি নিয়ে তুরার পায়ের দিকে তাকিয়ে বলল

-চুপচাপ থাকতে পারো না,এত ছটফট করো কেনো। দেখি কোথায় লেগেছে?

-না না,লাগেনি লাগেনি আমার..

আহান শুষ্ক মুখে তুরার চোখে তাকাল, শান্ত স্বরে বলল

-ঘরে যাওনি কেনো এখনও, এখানে কি করছিলে

তুরা চমকিত হয়ে বলল

-ক্ কিছুনা তো আমি কিছুই দেখছিলাম নাহ।

তুরার এমন হড়বড়ানো দেখে আহান সন্দিহান দৃষ্টিতে তাকালো। সামনে এগোতে এগোতে বলল

-কি দেখছিলে তুমি এখানে, আমাকে দেখে চমকে সরে এলে?

তুরার চোখ জোড়া অক্ষিকোটরের বাইরে আসার উপক্রম, আহানের সামনে এসে দাঁড়িয়ে বলল

-কই, কিছুই দেখছিলাম না আমি, কিছুই তো দেখিনি। চলুন ঘরে যাবো।

-না আমি এখানেই থাকব এখন, তুমি ঘরে যাও

তাজ্জব বনে গেলো তুরা, এই লোকটা এখন এখানে কেনো বসবে,নজর একটু এদিক থেকে ওদিক গেলেই মান সম্মান যাবে। আহানের আরও সামনে এসে দু হাত ছড়িয়ে বলল

-নাহ,আমি আপনাকে কিছুতেই এখানে থাকতে দেবো নাহ। কিছুতেই না।চলুন শিগগির ঘরে চলুন

আহান বিরক্তিতে ভ্রু উচালো। চিরাচরিত কণ্ঠে বলল

-পাগল হয়ে গিয়েছ তুমি? কি যা তা বলছো। সরো আমাকে দেখতে দাও?

তুরা উদ্বেগিত হয়ে আহানকে আটকাতে গেলো। লাফিয়ে আহানের পায়ের উপর উঠে পরল। আহানের শার্ট খামচে বলল

-আপনাকে আমার দোহায়, প্লিজ কিচ্ছু দেখবেন নাহ। না তো আমি মরে গেলে অকালে বিধবা হবেন

কাঁদো কাঁদো মুখ করে বলা তুরার কথা শুনে আহান বিরক্তিতে ধীরস্থির গলা শাসিয়ে বলল

-কি যা তা বলছ,ষ্টুপিড।

বলেই তুরার অভিব্যক্তির প্রতীক্ষা না করে কোলে তুলে নিলো। আকস্মিক শূন্যে ভেসে উঠায় তুরা চেঁচিয়ে উঠলে আহান চাপা স্বরে ধমকে বলল

-শাট আপ,চেঁচাচ্ছ কেনো,লোকজন শুনলে কি ভাববে?

তুরা অবোধের মতো মুখ করে বলল

-কি ভাববে? আর কে ভাববে বাড়িতে তো কেও নেই!

আহানে নিজের ঘরে নিয়ে আস্তে করে নামিয়ে দিলো তুরাকে বিছানায়। তুরার পায়ের কাছে সালোয়ার টা সামান্য তুলতে গেলেই তুরা থতমত খেয়ে বলল

-ক কি করছেন আপনি!

-আদর করছি ইডিয়ট!

দাঁতে দাঁত খিঁচিয়ে বলে, তুরার পা টা এদিক ওদিক ঘুরিয়ে দেখল ব্যথা পেয়েছে কি না।
কিন্তু তুরা আহানের কাজের মর্মার্থ না বুঝে অহেতুক ভীত হয়ে এক টানে পা তুলে খাট থেকে নেমে যেতে গেলেই আহান তার বলিষ্ঠ হাতের এক টানে তুরাকে নিজের উরুর উপর বসালো। এক হাতে কোমর ঝাপটে ধরলো। তুরা আহানের বাহুবন্ধনীতে আবদ্ধিত হয়ে বাকরুদ্ধ হয়ে থরথর করে কাঁপতে লাগলে আহান তুরার কোমরে রাখা হাতটা আরও চেপে ধরলো। তুরা তুতলিয়ে বলল

-ছ’ছাড়ুন না আমাকে, সুরসুরি লাগে আমার

সেদিকে ধ্যান দিলো না আহান, নিজের উষ্ণ তপ্ত শ্বাসের আলিঙ্গনে জর্জরিত করে দিলো তুরাকে। তুরা ভীতিসঞ্চারিত হয়ে বলল

-আমাকে ছাড়ুন, নাইলে কিন্তু আমি চেঁচাবো

-চেঁচাও, তোমার চেঁচামেচি দেওয়ালের বাইরে গেলে ব্যাপারটা তোমার জন্যেই লজ্জাজনক হবে

নির্লিপ্ত ভঙ্গিতে বলল আহান। তুরা হতভম্ব হয়ে চাইল খানিকক্ষণ। আহানের কথার মর্মার্থ ঠাওর করতে না পেরে ভ্রু যুগল ললাটে স্পর্শ করিয়ে বলল

-কেনো লজ্জাজনক হবে?

-ওরা ভাববে আমরাও সামনের ফ্ল্যাটের কাপলদের প্রসেসিং শুরু করে দিয়েছি

কথাটা কর্ণকুহরে পৌঁছাতেই অনড় হয়ে গেলো তুরা, স্তব্ধ হয়ে গেলো সমস্ত কায়া! বিস্ময়ে চোখ বড় বড় হয়ে গেলো। তার মানে আহান আগেই দেখেছে!? বিস্মিত নয়নে আহানের দিকে তাকাতেই দেখল ঠোঁট বাকিয়ে হাসছে আহান, ডান হাতের তর্জনী উঠিয়ে তুরার মুখে উপচে পরা এলোমেলো চুল গুলো সরিয়ে বলল

-এবার বলো, চেঁচামেচির প্রসেসিং শুধু করবো?

জড়ানো কণ্ঠ আহানের, মোহাগ্রস্থ ভরা কণ্ঠে কেঁপে উঠলো তুরার হৃদগহ্বর। আহানের বুকে মৃদু ধাক্কা দিয়ে সরে যেতে নিলে আহান তুরাকে কোলে নিয়েই শুয়ে পরলো বিছানায়। ওকে চেপে ধরে নাকে নাক ঘষে বলল

-উহু,এক চুল নড়বে নাহ। আমার ধৈর্যের বাধ ভেঙোনা সামলাতে পারবে নাহ। নিজেও ঘুমাও আমাকেও ঘুমাতে দাও

বলে মাথার স্থান পরিবর্তন করে এনে রাখল তুরার পেটের উপর। দুহাতে জড়িয়ে ধরলো তুরার মেদহীন বাকানো কোমড়। প্রগাঢ় স্পর্শে অস্থির করে তুলল তুরাকে,কিন্তু নিজে স্থির শান্ত হয়ে চোখ বুজে রইলো তুরার পেটের উপর মাথা রেখেই
.
.
.
চলবে ইনশাআল্লাহ

#Humu_♥

#তুমি_আমি_দুজনে
#লেখিকা_হুমাইরা_হাসান
পর্ব- ৪০

রিকশা থেকে নেমে দাঁড়ালো হসপিটালের সামনে।
ভাড়া চুকিয়ে এক হাতে ব্যাগ আরেক হাতে ফলমূলের ঝুড়ি টা নিয়ে সামনের দিকে হাঁটা ধরলো।

-তুই সিউর এই হসপিটালেই?

-হ্যাঁ, প্রথম দিন তো ও এই হসপিটালের কথায় বলেছিলো। তার পর থেকে তো ফোনটাই ধরেনাই গাধা টা।

ভ্রু কুচকে কাঠ কাঠ গলায় বলল ফারিহা,দেখেই বোঝা যাচ্ছে সাদমানের উপর ভীষণ রাগান্বিত, এই দুইদিনে কম করেও পঞ্চাশ ষাট বার কল করেছে, বারবারই ফোন সুইচড অফ।

-আহ এভাবে বলিস না, হয়তো এতসব ঝামেলার চাপে ফোন চার্জ করার সময় হয়নি তাই বন্ধ

প্রত্যুত্তর করলো না ফারিহা, রিসিপশনে গিয়ে অ্যাসিস্ট্যান্স এর সাথে কথা বলে তুরাকে ইশারা করে সামনের দিকে এগোতে লাগলো।
কেবিনের দরজা টা খুলতেই সামনে পরলো সাদা শুভ্র বেডে শুয়ে মাঝবয়েসী রূগ্ন মহিলা, তার পাশেই চেয়ারটাতে হেলান দিয়ে ঘুমে ঢুলছে সাদমান। নিঃশব্দে এগিয়ে গেলো তুরা আর ফারিহা। সাদমানের পিঠ বরাবর দুম করে একটা কি ল বসিয়ে দিলো ফারিহা, আকস্মিক আক্রমণে নিভু নিভু ঘুম ভেঙে ধড়ফড়িয়ে উঠলো সাদমান, তার সামনে তুরা আর ফারিহাকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে ভুত দেখার মতো চমকিত হয়ে বলল

-ত তুই,তুমি। মানে তোমরা এখানে?

উসকোখুসকো চুল,লাল টকটকে চোখ যা প্রায় কোটরে বসে যাওয়া। গায়ের শার্ট টাও কুচকানো।
বিস্ফোরিত চাহনিতে তাকিয়ে আছে তুরা আর ফারিহার দিকে। উচ্চস্বরে কিছু বলতে গেলেও পাশে শুয়ে থাকা মায়ের দিকে তাকিয়ে থেমে গিয়ে ফিসফিস করে বলল

-তোমরা দুজন? এখানে? কি করে

তুরা কিছু বলবে তার আগেই ফারিহা এগিয়ে গিয়ে দুম করে আরেকটা চা পড় বসিয়ে দিলো সাদমানের বাহুতে, চাপা স্বরে বলল

-ইতর,বদমাশ টিনম্যানের বাচ্চা তোকে কতবার ফোন দিয়েছি বল, ধরিস নি কেনো বেদ্দপ

তুরা সাদমানের সামনে দাঁড়িয়ে ফারিহাকে থামিয়ে বলল

-আরে থাম, কি করছিস আন্টি জেগে যাবে তো

-আমাকে থামাচ্ছিস,এই গদ্ধপ টাকে বল আগে, এই দুইদিনে কতবার ফোন দিয়েছি কোনো আইডিয়া আছে?চিন্তা হয়না আমাদের!

দাঁত চেপে ক্ষিপ্ত স্বরে বলল ফারিহা। সাদমান ফারিহার কথা শুনে মুখ ছোট করে বলল

-আসলে ফোনে চার্জ ছিলো না

-কেনো ছিলো নাহ, তোকে বলেছিলাম না সব আপডেট আমাকে বলতে তাও কেনো বলিস নি তুই?

এ পর্যায়ে সাদমান ফারিহার কথার উত্তর করলো নাহ, নিরবতা ভাঙলো তুরার প্রশ্নে

-এখন কেমন আছেন আন্টি?

-এখন আগের চেয়ে বেটার, ডক্টর বলেছে আরও কিছুদিন অবজারভেশনে রাখতে হবে

সাদমানের কথার সাথে সাথে নড়েচড়ে উঠলো বেডে শুয়ে থাকা মানুষটা, দেবে যাওয়া চোখের পাতা খুলে টিপটিপ করে তাকালো। মুখ থেকে মৃদু শব্দ করলেই সাদমান এগিয়ে গিয়ে ধরলো, শান্ত গলায় বলল

-উঠে বসবে মা?

মৃদু মাথা দুলিয়ে সম্মতি দিলেন ভদ্রমহিলা। বেশ জীর্ণ শীর্ণ রূগ্ন শরীর, সামনের ঢেউ খেলা চুলে পাক ধরেছে বেশ অনেকটা। উজ্জ্বল শ্যামলা গড়নের মহিলাটির চেহারার সাদমানের মুখাবয়বের সাথে অনেকটাই মিলে যায়। ভার হয়ে আসা চোখের পাতা খুলে পুরোপুরি তাকানোর চেষ্টা করলে পাশ থেকে চশমা টা তুলে চোখে পরিয়ে দিলো সাদমান। ঘোলাটে দৃষ্টি স্পষ্ট হতেই চোখের সামনে দৃশ্যমান হলো দুটো কৌতুহল ভরা মেয়েলী চেহারা।

-আসসালামু আলাইকুম আন্টি, কেমন আছেন?

ঠোঁট নাড়িয়ে খুব শান্ত স্বরে সালামের উত্তর দেওয়ার সাথে সাথে ফারিহা আবারও বলল

-আমি ফারিহা আর ও তুরা, আমরা সাদমানের ফ্রেন্ড

সামান্য হাসলো মহিলা, কুচকে আসা গালের চামড়া মৃদু প্রসারিত হলো। নমনীয় ভাষায় বলল

-আমি তোমাদের আজ প্রথম দেখলেও চিনতে পেরেছি, সাদমান তোমাদের কথা অনেক বলেছে। কতবার বললাম তোমাদের বাড়িতে নিতে কানেই নেয়না

ফারিহার মেজাজে উস্কানি লেগে গেলো সাদমানের মায়ের কথায়। এগিয়ে গিয়ে একগাদা ফলমূল আর হেলথ ড্রিংকস এর ঝুড়িটা টেবিলের উপরে রেখে পাশে বসে খিটমিট করে বলল

-ও বাড়িতে কি নিবে এত কিছু যে হয়ে গেছে। জানানোর প্রয়োজন টুকু বোধ করেনি। আজ দুদিন ধরে ফোন উঠাই নাহ। আজ কত খোঁজ করে করে খুঁজে এসেছি এখানে

একদমে হড়বড়িয়ে বলল ফারিহা, তুরা এগিয়ে গিয়ে চোখের ইশারায় ফারিহাকে থামতে বলে। তবুও যেনো তাতে রা নেই ফারিহার ও তো পারলে সাদমানকে এখন ছাদ থেকেই ধাক্কা দিয়ে ফেলে দেয়।

-এখন কেমন আছেন আন্টি? হঠাৎ এতটা অসুস্থতা কি করে হলো?

তুরার প্রশ্নে ভদ্রমহিলা ক্লান্তির প্রশ্বাস ফেলল। ম্লান কণ্ঠে বলল

-হঠাৎ আর কই মা, অসুস্থতা তো লেগেই আছে। আমার জন্যেই তো সব ঝামেলা, আমি না..

-মা তোমার ওষুধ খাবার সময় হয়েছে

মায়ের কথা সম্পূর্ণ না করতেই সাদমান থামিয়ে দিলো। তার চোখ মুখ দেখে স্পষ্ট যে ওষুধ খাওয়ার নামে সে মায়ের কথাটা বন্ধ করলো। মহিলা আলতো হেসে বলে উঠল

-আর কত ওষুধ খাবো বাবা, আমার জন্যে তোর জীবনটা ক্ষয় হচ্ছে। এভাবে কতদিন আমার জন্যে এত ঝামেলা সহ্য করবি

সাদমানের চোখে মুখে অস্বস্তি, দেখেই বোঝা যাচ্ছে মায়ের এহেন কথায় সে বিরক্ত, আর তার চেয়েও বেশি বিব্রত তুরা আর ফারিহার সামনে এসব বলায়। তুরা এক পলক চাইল দুজনের পানে, যেনো তাতেই অনেকটা বুঝে গেলো,এগিয়ে বসে হাতের উপর হাত রেখে বলল

-এভাবে কেনো বলছেন আন্টি, সাদমান আপনার জন্যে করবে না তো কার জন্যে করবে,আপনিই তো সব ওর

-আর কতই বা করবে গো মা, ওর বাবা মারা গেছে তখন ছেলে আমার সবেমাত্র মাধ্যমিক পরীক্ষা দিয়েছে। তারপর থেকে আমিও প্রায় শয্যাশায়ী, এতদিন ধরে নিজের উপর চাপ দিয়ে সবটা সামলাচ্ছে ও একা।

সাদমান ট্যাবলেট টা মায়ের হাতে ধরিয়ে পানির গ্লাস টা এগিয়ে দিলো। ওষুধ খাওয়া হলে পানির গ্লাস টা হাতে নিতে নিতে বলল

-এসব বাদ দাও মা,কতবার বলেছি এগুলো বলবে নাহ

সাদমানের কথার সাথে তুরাও বলল

-ও ঠিকই বলেছে আন্টি। আপনি এতটা চিন্তা করবেন নাহ। শুধু দোয়া করবেন যাতে সাদমান আরও অনেক বছর আপনাকে আগলে রাখতে পারে, আপনিই তো ওর সব।

-একদম ই তাই, আর এইটাও বেশি বেশি দোয়া করবেন যাতে ওর মাথার গোবর গুলো কমে বুদ্ধি সুদ্ধি হয়

ফারিহার কথা শুনে হেসে উঠলো সাদমানের মা। মেয়েটা ভারি চঞ্চল এটা সেও জানে। তুরা আর ফারিহা আরও বেশ খানিকটা সময় বসে গল্প করলো৷ ঘড়ির কাটায় তিনটা পেরোলে সাদমানের মাকে বিদায় জানিয়ে বেরোলো কেবিন থেকে সাদমান ওদের এগিয়ে দিতে আসলে ফারিহা দাঁড়িয়ে বলল

-আমাদের সাথে আসতে হবে না হাত পা সবই ঠিক আছে, মায়ের দেখাশোনা কর আর গোসল কর। দেখে তো মনে হয়না দুইদিনে গোসল করেছিস, ছি ছি, তোর গায়ের দুর্গন্ধের জন্য ভার্সিটিতে টিকতে পারিনা আমি

ফারিহার অহেতুক কৌতুক শুনে সাদমান মুখ কুচকে তাকালো। পাশ থেকে তুরা পিঠের উপর চাপড় বসালেই মেকি হেসে বলল

-আ’ম জোওকিং

বলে এবার মুখভঙ্গি স্বাভাবিক করলো। সাদমানের দিকে তাকিয়ে বলল

-আন্টিকে তো আরও কিছুদিন রাখতে হবে এখানে, টাকা আছে তোর কাছে?

হাসি হাসি করে রাখা মুখ খানা চুপসে গেলো সাদমানের, তবুও ভঙ্গিমা অপরিবর্তনীয় রেখে বলল

-হ্যাঁ আছে তো, তোর এসব নিয়ে ভাবতে হবে না

-মুখটা বন্ধ কর বেদ্দপ। আমি ভাববো না তো কি তোর গার্লফ্রেন্ড আছে যে সে ভাববে

বলেই ব্যাগ থেকে কতগুলো টাকা বের করে সাদমানের সামনে ধরে বলল

-এই টাকা গুলো রাখ, তোর কাজে লাগবে

মুহুর্তেই মুখ জুড়ে কালো আধার নামলো সাদমানের। চোখ শক্ত করে গম্ভীর গলায় বলল

-টাকা টা নিজের কাছেই রাখ ফারিহা,মায়ের চিকিৎসা আমি নিজেই করাতে পারব

ফারিহা আগেই জানতো সাদমান কিছুতেই টাকাটা নিতে চাইবে না। ওর মতো ব্যক্তিত্বের মানুষের কাছে এটাই কাঙ্ক্ষিত ছিলো। তবুও জেদ ধরে বলল

-এখন এসব বলার সময় না সাদমান, আন্টির জন্য টাকা গুলো যখন তখন লাগতে পারে। তোর টিউশনিও তো বন্ধ আছে কোথায় পাবি তুই?

-সেটা আমি বুঝে নেবো বললাম তো, তোকে ভাবতে হবে না

এবার পাশ থেকে তুরা সাদমানকে উদ্দেশ্য করে বলল

-টাকা গুলো তুমি রাখো সাদমান, বিপদের সময় লাগতেও পারে। আর আমরা কি এতই পর যে আমাদের এতটুকু সাহায্য করতে দেবে না? আন্টিতো আমাদেরও মায়ের মতোই

সাদমান তুরার কথার প্রত্যুত্তর করবে তার আগেই ফারিহা স্পষ্টভাবে বলল

-আমাদের টাকা দেওয়াতে তোর নিজেকে ছোট মনে হচ্ছে তাই তো? ঠিকাছে তোর যখন এতই সমস্যা তাহলে তুই ধার হিসেবে নে। আন্টি সুস্থ হয়ে গেলে আমাকে শোধ করে দিস,কেমন?

বলেই সাদমানের কোনো জবাব না শুনে ওর হাতে টাকা গুলো গুঁজে দিয়ে তুরার হাত ধরে হাঁটা ধরলো, সাদমান ওদের যাওয়ার পানে তাকিয়ে নিজের হাতে দিয়ে যাওয়া টাকা গুলোর দিকে তাকালো। টাকাগুলোর আসলেই ভীষণ দরকার ছিলো তার। মায়ের একদিনের কেবিন ভাড়া এখনো বাকি তার উপর আরও দুটো দিন রাখতে হবে। মনে মনে আল্লাহর কাছে শুকরিয়া করলো, সেই পাঠিয়েছে সাহায্য কারো মাধ্যমে,তবে সাদমান টাকা টা অবশ্যই ফেরত দিয়ে দেবে,আর তা খুব শীঘ্রই।

~

হসপিটাল থেকে বেরিয়ে ফারিহা আর তুরা নিজেদের গন্তব্য উদ্দেশ্যে রওনা দিয়েছে, বাস থেকে নেমে রিকশার উদ্দেশ্যে দাঁড়িয়ে আছে তুরা। আজকে বাসটা স্টপের অনেক আগে থামিয়েছে,এখান থেকে অন্যপথে যাবে, অগত্যা উপায়হীন হয়ে তুরার নেমে যেতে হলো। এখান থেকে রিকশা নিয়ে গেলে বাড়ি পৌঁছাতেও প্রায় আধ ঘন্টা। বেশ অনেক্ষণ দাঁড়িয়ে থেকেও রিকশার দেখা না পেয়ে সামনের দিকে এগোতে লাগলো তুরা।
হাত ঘড়িতে সময় দেখে নিলো। ঘড়ির ছোট কাটা চারের ঘর ছুঁইছুঁই। অনেকটাই দেরি হয়ে গেছে আহান নিশ্চিত বকবে তুরাকে। যদিও তুরা আজ আহানকে বলে এসেছে সাদমানের মা কে দেখতে আসার কথা।আহান নিজেই তুরাকে সাথে নিয়ে আসতে চেয়েছিলো কিন্তু আহানকে দেখলে ফারিহা সাদমান দুজনের বিভ্রান্ত হয়ে যাবে বলে তুরা নিষেধ করেছিলো, কিন্তু তবুও প্রয়োজনের তুলনায় অনেকটা দেরি করে ফেলেছে। আহান নিশ্চয় অনেক্ষণ আগেই বাড়ি ফিরেছে।
হাঁটার গতি বাড়িয়ে দিলো তুরা, যতদূর চোখ যায় কোনো অটো বা রিকশার নাম গন্ধ টুকুও নেই। কেমন একটা সুনসান জাগায় নামিয়ে দিয়েছে বাসটা। এদিক তো লোকজনের কলরব ও নেই বললেই চলে।
এক হাতে ব্যাগের হাতা চেপে ধরে দ্রুত পায়ে আগাচ্ছে তুরা ঠিক তখনই একটা গলার স্বর পেছন থেকে শুনলে পা দুটো থেমে গেলো

-এই যে সুন্দরী

ফিরে তাকাতেই কুণ্ঠিত মনে ভ্রু যুগল কুচকে ললাট স্পর্শ করলো তুরার। এই ছেলেটা? এখানে এভাবে? হুট করে বুকের ভেতর অজানা ভয় জেঁকে ধরলো তুরার। ব্যাগের হাতা টা আরও জোরে চেপে ধরে উল্টো ঘুরে আবারও হাঁটা শুরু করতে নিলে আবারও একই রকম গলা কর্ণকুহরে আসলো

-পালাচ্ছ কেনো, দাঁড়াও। সেদিন সাহায্য করলাম তোমাকে ধন্যবাদ টা তো বলে যাও!

ঘুরে দাঁড়ালো তুরা, চোখ মুখ শক্ত করে ঝাঝালো গলায় বলল

-কি সমস্যা!

-সমস্যা তো আমার না,সমস্যা তোমার। আমিতো কথাই বলতে চাচ্ছি তুমিই পালচ্ছ

বলতে বলতে এগিয়ে এলো ছেলেটি, সেদিনকার মতই গায়ে জড়ানো জার্সির মতো টি-শার্ট আর গলায় ঝুলানো চেইন। তবে আজ একা নাহ সাথে আরও একটা ছেলে আছে, দুজনকেই একই ধাচের মনে হলো তুরার। তবে ওরা যেমনই হোক তুরার মোটেও ভালো ঠেকছে না। বিকেল গড়াচ্ছে জনমানবশূন্য এই চিকন রাস্তাটা কেমন খাঁ খাঁ করে উঠলো যেনো৷ মনে মনে ভীতশঙ্কিত হলেও চোখে মুখে প্রগাঢ় ক্রোধ এনে বলল

-আপনাদের সাথে কথা বলতে আমি মোটেও ইন্টারেস্টেড নই

ফিচেল হাসি দিলো ছেলেটা, তার সাথে হলুদাভ দাঁত গুলো কেমন চিকচিক করে উঠলো, গলার চেইন টা ঘুরাতে ঘুরাতে তুরার সামনে এগিয়ে এসে বলল

-কিন্তু তোমার উপর আমাদের খুব ইন্টারেস্ট

বলেই তুরার একদম সামনা-সামনি দাঁড়িয়ে বলল

-চলো না আজকে আমাদের সাথে, খুব ফূ’র্তি করবো

গা গুলিয়ে আসলো তুরার এহেন জঘন্য বাক্য শ্রবণ হতেই, ঘাড়ের পেছনে ঠান্ডা হয়ে আসলো অপ্রতিভ বিপদের আভাসে। আশেপাশে চোখ বুলিয়ে কোনো মানুষ খোঁজার চেষ্টা করলেও কারো টিকি টিও চক্ষুগোচর হলো নাহ

-এদিক ওদিকে কি খোঁজো ডার্লিং, এখানে আমরা ছাড়া তোমাকে আদর সোহাগ করার কেও নাই

পাশে দাঁড়ানো ছেলেটার কথা শুনতেই তুরার মাথা ঘুরে উঠলো, শরীর ঘামছে,গা গুলাচ্ছে। থরথর করে কাঁপতে থাকা পা একেবারে বিবশ হয়ে গেছে। এক চুল নড়ার শক্তিও যেনো হারিয়ে গেছে। তবুও মনোবল হারালো না তুরা, ফোস করে নিঃশ্বাস টেনে নিয়েই ছুট লাগালো , পায়ের উপর সর্বোচ্চ শক্তি চাপিয়ে উল্টো পথে দৌড় শুরু করলো

-ভাই মেয়ে তো পালাচ্ছে,

-পালিয়ে যাবে কোথায়, সেদিন বাসের ভিতরে আমাকে ধাক্কা দিয়ে পালিয়ে গেছে, আজ কিছুতেই ছাড়বো নাহ। ধর ওকে

বলে ওরা দুজন ও ছুটা শুরু করলো তুরার পেছনে। তুরা কাধের ব্যাগটা খামচে ধরে প্রাণপণে দৌড়াচ্ছে, মাথায় শুধু এটুকুই আছে যে এখান থেকে দৌড়ে পালাতে পারলে সে বাঁচবে, নিজের সম্মান বাঁচবে। দৌড়াতে দৌড়াতে হাপিয়ে গেলো তুরা, হাটুতে ভর করে চারপাশে তাকালো। তখনই পেছন থেকে ওদের আসার শব্দ হতেই কোনো কিছু ঠাওর করতে পারার আগেই আবারও ছুটা শুরু করলো

~

বারান্দায় বিরতিহীন পায়চারি করছে আর বারবার গেইটের দিকে তাকাচ্ছে আহান। দুপুর গড়িয়ে বিকেল পেরিয়েছে, অথচ এখনো তুরার ফেরার নাম নেই, বলে তো ছিলো বিকেলের মধ্যেই বাড়ি ফিরবে তাহলে এখনো আসলো না কেনো। চিন্তায় উৎকণ্ঠায় আহানের নাভিশ্বাস উঠার জো। এক দন্ড স্থির বসতে পারছে নাহ,কোথায় আছে,কি করছে, এত দেরি কেনো হচ্ছে, কোনো বিপদ হলো না তো?
বিপদের নামটা মাথায় আসতেই সকল চিন্তা গুলো ধড়ফড়িয়ে দুশ্চিন্তায় পরিণত হলো।কোনো বিপদ হলো না তো রাস্তায়?
আর দুদন্ড দাঁড়ালো না আহান,গাড়ির চাবিটা নিয়েই বেরিয়ে পরলো। দ্রুত গতিতে গাড়ি চালিয়ে এসে থামলো সিটি হসপিটালের সামনে। ভাগ্যবশত আহান গাড়ি থেকে নেমে ভেতরে ঢোকার পথেই দেখা হলো সাদমানের সাথে। হাত ভর্তি ওষুধের প্যাকেট নিয়ে ঢুকছিলো। আহানকে দেখেই হতভম্বিত হয়ে গেলো সাদমান। আহান স্যার? এখানে?
সাদমানকে দেখে আহান এগিয়ে গেলো ওর কাছে,কোনো প্রকার জড়তা ছাড়াই সরাসরি জিজ্ঞাসা করলো

-তুরা কোথায় সাদমান, ও কি এখনো এখানেই আছে?

প্রসারিত ললাটে অসংখ্য ভাঁজ পরলো সাদমানের,৷ চমকিত হয়ে বলল

-তুরা তো দুই ঘন্টার ও আগে বেরিয়ে গেছে স্যার, কেনো বাড়ি ফেরেনি ও?

তড়িৎ গতিতে সারা বদনে ঠান্ডা জোয়ার বইয়ে গেলো আহানের, দুশ্চিন্তার পাল্লা ক্রমান্বয়ে ভারি হচ্ছে, অস্থিরচিত্তে ঘনঘন শব্দে বলল

-তুরা এখনো ফেরেনি সাদমান। ও কোথায়? তুরা কোথায়?

সাদমান আহানের প্রশ্নের উত্তর না পেয়ে তৎক্ষনাৎ পকেট থেকে ফোন বের করে কারো নম্বরে ডায়েল করে কানে ধরলো। তিনবার বাজার পর চতুর্থ বারে কলটা রিসিভড হতেই সাদমান সোজাসাপটা প্রশ্ন ছুড়লো

-তুরা কি তোর সাথে আছে ফারিহা?

ওপাশ থেকে কি উত্তর আসলো আহানের কান অব্দি সেটা পৌঁছায়নি তবে সাদমানের নিশ্চুপ অবস্থা দেখে অস্থির হয়ে বলল

-কি বলল ফারিহা? তুরা কি ওর সাথেই আছে?

-ফারিহার সাথে নেই ও।তুরা নাকি আরও এক ঘন্টা আগে বাসার দিকে গেছিলো

সাদমানের কথায় আহানের সারা শরীর উত্তপ্ত রক্তের স্রোত বয়ে গেলো, আরও এক ঘন্টা আগে বাড়ির দিকে গেলে ফিরলো না কেনো ও, কোথায় গেছে তুরা! ঘাড়ের পেছনে হাত দিয়ে এদিক ওদিক তাকালো, ফোস করে নিঃশ্বাস টেনে নিয়ে নিজে নিজেই বিড়বিড়ালো

-কিছুই হয়নি, ও ঠিক আছে, আমি খুঁজে বের করব,এক্ষুনি খুঁজে বের করব আমি

বলেই দৌড়ে গাড়ির সামনে গিয়ে উঠে বসলো,স্টিয়ারিং ঘুরিয়ে ঝড়ের চেয়ে তীব্র বেগে ছুটিয়ে নিলো গাড়িটা,ধুলো উড়িয়ে দৃষ্টির বাহিরে চলে গেলো মুহুর্তেই
.
.
.
চলবে ইনশাআল্লাহ

#Humu_♥️