তুমি আসবে বলে পর্ব-৩২+৩৩+৩৪

0
380

#তুমি_আসবে_বলে

#নুসাইবা_ইভানা

পর্ব-৩২

নীলু বারবার জ্ঞান হারাচ্ছে আরহার মৃ*ত্যু*তে সবচেয়ে বেশি কষ্টটা নীলুই পেয়েছে। সব হারিয়েও দু’জন মানুষ একে অপরের ছায়া হয়ে বেঁচে ছিলো, এতোগুলো বছর এক সাথে সুখ, দুঃখ ভাগ করে নিয়েছে নিজেদের মাঝে। আজ সেই মানুষটা পৃথিবীতে নেই এটা নীলু মেনে নিতেই পারছে না। ইমতিহান একদিকে নীলুর খেয়াল রাখছে অন্যদিকে মেঘের জন্য টেনশনে আছে, কি করছে? কোথায় গেলো?

আরহার ফ্রেন্ড নুর এসেছে, এই মূহুর্তে কোন কথা বলার সুযোগ নেই।নুরকে নীলুর পাশে বসিয়ে রেখে ইমতিহান মেঘকে খুঁজতে লাগলো।

সামিরাও ভিষণ কষ্ট পাচ্ছে অনেক কষ্টে নিজেকে বুঝিয়ে ছিলো ভালোবাসার মানুষটা যার সাথে ভালো থাকবে। তার কাছেই থাক। মেঘের ছবিটার দিকে তাকিয়ে বলে, আমি যে বড্ড লোভি, আমার আবার তোকে নিজের করে পাওয়ার স্বাদ জাগছে। আমি জানি এটা অন্যায়! তবে আমার কি দোষ বল, আমি তোকে ছেড়েই দিয়েছিলাম তবে ভাগ্য তোকে আবার একা করে দিলো। আমি কথা দিচ্ছি তোকে ভালোবাসবো অনেকটা ভালোবাসবো। এমন সময় সামিরার ফোনটা বেজে উঠলো, একটা আননোন নাম্বার থেকে কল এসেছে রিসিভ করবে কি করবে না ভাবতে ভাবতে ফোনটা রিং হতে হতে কেটে গেলো। সামিরা কল ব্যাক করতেই, মেঘ বললো,তুই ইমতিহান কে বলে দিস আমি আরহাকে নিয়েই ফিরবো। আমাকে নিয়ে টেনশন করতে না। সামিরা কিছু বলবে তার আগেই মেঘ কল কেটে দেয়ে।

সামিরা ফোনের দিকে তাকিয়ে বলে, কেনো পাগলামি করছিস মৃ*ত মানুষকে কোথা থেকে নিয়ে আসবি!

অনেক কাঠখড়া পুড়িয়ে অবশেষে আরহা তার মায়ের কবরের সামনে পৌঁছলো। ততক্ষণে সূর্য অস্ত যেয়ে চারপাশে আধারে ছেয়ে গেছে। দূর আকাশে তারাদের মিটিমিটি আলো আর চাঁদের আধো আলোতে চারপাশ আবছা আবছা দেখা যাচ্ছে। নিজের মায়ের কবর চিন্তে একটুও সময় লাগেনি আরহার। মুখ থেকে ওড়নাটা সরিয়ে নিলো, মাটিতে বসে পরে হাত দিয়ে কবরটা ছুঁয়ে দেখছে। চোখ দিয়ে গড়িয়ে পরছে অশ্রু আজ কোন ডর নেই আরহার, আর না আছে কোন ভয়, মনে হচ্ছে তার মা’তার পাশেই আছে খুব কাছে হয়তো তাকে স্পর্শ করা যাচ্ছে না তবে অনুভব করা যাচ্ছে। কাঁদতে কাঁদতে হঠাৎ মনে পরলো নীলু যখন তাকে খুঁজে পাবেনা তখন তো খুব টেনশন করবে। নিজের সাইড ব্যাগ থেকে ফোনটা বের করে অন করে কিন্তু ইমার্জেন্সি উঠে আছে নেট নেই একদম। এখন কি হবে। রাতের প্রায় আটটা বেজে গেছে এখনি কোথাও আশ্রয় নিতে হবে! তবে৷ কোথায় নেবো! এখান থেকে শহর তো ছয় ঘন্টার মতো রাস্তা। আরহার ছোট বেলার বান্ধুবী শিউলির কথা মনে পরলো, ওর বিয়ে তো এই কাছেই হয়েছিলো। আচ্ছা এতো বছর পর আমাকে দেখে চিনতে পারবে তো! শেষবারের মতো নিজের মায়ের কবরের উপর হাত রাখলো চোখের জলটুকু মুছে নিয়ে বললো, মা’তুমি বলেছিলেনা রাজকুমার আসবে! সে এসেছে মা’দেরিতে হলেও বুঝছে আমায়, তার চোখে আমি আমার জন্য ভালোবাসা দেখেছি। তুমি দোয়া করো আমাদের জন্য। হঠাৎ চাঁদের আলোতে আরেকটা আলো চোখে লাগলো, তার হাতে থাকা ডায়মন্ড রিংটা চাঁদের আলোতে চিকচিক করছে। কবর থেকে হাত সরিয়ে উঠে দাঁড়িয়ে হাতে থাকা রিংটায় চুমু খেলো। অন্ধাকারে হাঁটতে কিছুটা কষ্ট হচ্ছে মিনিট দশেক হাঁটার পরেই শিউলিদের বাড়ির সামনে এসে দাঁড়িয়ে পরলো। কি বলবে, কোথা থেকে শুরু করবে এসব ভাবতে ভাবতে পেছন থেকে এক পুরুষ কন্ঠে ভেসে এলো, কে এখানে?

আরহার গলা শুকিয়ে গেলো, ওড়না দিয়ে কোনমতে মুখটা ডেকে বলে, আমি শিউলির সই শিউলি কি আছে বাড়িতে!

– তা তোমার নাম কি মেয়ে, এই গ্রামের হগলরে তো আমার চেনা আছে তোমারে তো ঠিক চিনবার পারলাম না।

আপনি শিউলিকে ডেকে দিন ও আমাকে চিনতে পারবে।
– এই মাইয়া সত্যি কইরা কও কি মতলবে আইছো তোমারে তো আমাগো দিকের মনে হইতাছে না
এর মধ্যে বাড়ির বাইরে নিজের স্বামীর কথা শুনে শিউলি বেরিয়ে আসলো হারিকেন হাতে নিয়ে,নিজের স্বামীকে উদ্দেশ্য করে বলল, এই রাত বিরেতে কার সাথে কথা কন!
– দেহো কোন মাইয়া আইছে কয় তোমার নাকি সই লাগে। আমি কইলাম নাম কও এই তল্লাটের সবাইরে তো আমি চিনি।

শিউলি হারিকেন ধরলো আরহার সামনে। আরহা মুখের সামনে থেকে ওড়না সরিয়ে দিয়ে মৃদু স্বরে বললো কি চিনতে পেরেছিস তো!

শিউলি হারিকেন তার স্বামীর হাতে দিয়ে জড়িয়ে ধরে বলে, চিনবা আবার মেলাদিন পরে তোর লগে দেহা অইলো, তয় তুই আগের চেয়ে মেলা সুন্দরী অইছো।

ইউসুফ বলে, এইটা আবার তোমার কোন সই আগে তো কহনো দেখলাম না।
– সে অনেক কথা আগে ঘরে চলো পরে কইতাছি।

– চলো তয়, হের নামটা কি হেইটা তো কইবার পারো।
– ওই যে শারমিন চাচি আছিলোনা হের মাইয়া। এইবার চিনবার পারছো।
– হেরে না চুরি কইরা লইয়া গেলো ঢাকা শহরের মাইষেরা।

– সব কথা কি দুয়ারে দাঁড়াইয়া কইবা। আহো ঘরে

আরহাকে নিয়ে ঘরে আসলো কিরে তোর মুখটা এতো শুকনো কেনরে। তোর স্বামী কি বেশী ভালা না।
– আরে এতো পথ আসছি তো তাই তোর একটা কাপড় দে একটু হাত, মুখ ধুয়ে ফ্রেশ হই । শিউল একাটা সুতি শাড়ি এনে আরহাকে দিলো, আর ওয়াশরুম দেখিয়ে দিলো।

ইউসুফ,শিউলিকে বললো, এভাবে একটা মেয়েরে বাসায় থাকতে দেয়া ঠিক হইলো?এমনেই এই গ্রামের মোরলা এই মেয়ের উপর ক্ষ্যাপা।
– ঠিক বেঠিক বুঝিনা আমার সই আমি একবার কেনো একশোবার জায়গা দিমু। আপনি খাইয়া পোলার লগে শুইয়া পরেন। আমি আর সই আজকে একসাথে ঘুমাবো।

আরহা ফ্রেশ হয়ে এসে, শিউলিকে বললো, একটা ফোন করতাম।
– কিরে তোর সোয়ামীর লগে রাগ হইয়া আইসোসনি
– না তেমন কিছুনা। আগে বল ফোন করবো কি ভাবে?
– রাইতে আর পারবি না সকালে গঞ্জে গেলেই অইবো।
আরহা দীর্ঘ শ্বাস ফেলে বলে, সালমা মেয়েটা সব বুঝিয়ে বললেই হয়। না হলে সবাই টেনশন করবে।

– কিরে কি এতো চিন্তা করস!
-সে অনেক কথা আগে খেতে দে পরে সব বলছি! হ্যাঁরে সাবুর কি খবর!
– খবর বেশি ভালা না, তোর মামির তো ক্যান্সার হইছে, সাবুর ও শান্তি নাই জামাইটা ভালা পরে নাই।
– আর হারিছ!
– হারিছ ভালাই আছে তোর দুলাইভায়ের সাথে গঞ্জের দোকানে কাম করে, পোলাটা মেলা ভালা একেবারে তোর মামুর মতো।

মামার কথা মনে পরতেই আরহার চোখদিয়ে অশ্রু গড়িয়ে পরলো, তার মামা তাকে কত ভালোবাসতো, মামির চোখের আড়ালে লুকিয়ে লুকিয়ে চকলেক কিনে দিতো, খুব ইচ্ছে করছে এক পলক মামাকে দেখতে।
– জানিস তুই যাওয়ার পর সবাই তোর মামারে দোষ দিছে সেই নাকি তোরে বেঁচে দিছে। বিয়ের নাম করে তোকে নাকি কিনে নিয়ে গেছে।
– নারে তেমন কিছুই না। মা, যে সব সবসময় মারিয়া আন্টির কথা বলতো, তার ছেলের সাথেই আমার বিয়েটা হয়েছে। কোন পালিয়ে যাইনি ওই যে রমিজ মিয়ার সাথে বিয়েতে রাজি না হওয়ায় আমি আমাকে যেই মা*র মা*র*ছে সেই করণে আমি অসুস্থ হয়ে পরি আর তারা দ্রুত আমাকে নিয়ে ঢাকা চলে যায়।
– এহন তুই মেলা সুখে আছো তাই না
– হুম তোদের দোয়ায় ভালো আছি।খাবার খেয়ে দু’জনেই নিজেদের সুখ, দুঃখের কথা ভাগ করে নিচ্ছে কতদিন পর দুই বান্ধবী এক সাথে হয়েছে, কত কথাই না জমা রয়েছে আজ রাতে আর ঘুম হবে না দু’জনের আরহার বেশ ভালোই লাগছে এতোদিন পর নিজের গ্রামে এসে। এদিকে তার মৃত্যুর শোকে সবাই পাগল প্রায় সেদিকে বিন্দু মাত্র ধারণাও ণেই তার।

শিউলি আর আরহা কথা বলছে এমন সময় কে যেনো তাদের দরজা জোড়ে জোড়ে ধাক্কা দিচ্ছে……

#চলবে

#তুমি_আসবে_বলে

#নুসাইবা_ইভানা

পর্ব- ৩৩

ইমতিহান ঝড়ের গতিতে এসে নীলুকে জড়িয়ে ধরলো নীলু মাথায় চুমু খেয়ে বলে, মেঘ সত্যি বলেছিলো আরহা বেঁচে আছে। কথাটা কানে যেতে নীলু যেনো বাকরুদ্ধ হয়ে গেলো, কি রিয়েক্ট করবে ভুলে গেছে, নুর ও বোকারমতো ইমতিহানের মুখের দিকে তাকিয়ে রইলো, ইমতিহান নীলুকে বললো,যেই রিংটা মেঘ আরহাকে পড়িয়েছে ওটা কোন সাধারণ রিং নয়। সেটাতে একটা চিপ বসানো আছে, যার মাধ্যমে আরহার অবস্থান সম্পর্কে জানা যাবে। সেম এরকম একটা আমিও কিনেছে তোমার জন্য। নীলুর চেহারায় চমক দেখা গেলো।ইমতিহান নূরকে বললো তুই এক কাজ কর ওর জন্য খাবার নিয়ে আয়। নূর কাল বিলম্ব না করে খাবার আনতে চলে গেলো।
নীলু নিজেকে একটু শান্ত করে বললো, তুমি সত্যি বলছো, আমার আরহা বেঁচে আছে? তবে ওই মেয়ের শরীরে তো আরহার মত ড্রেস ছিলো। তুমি আমাকে সান্ত্বনা দেয়ার জন্য মিথ্যে বলছো না তো?
– না আমি বিন্দু পরিমাণ মিথ্যে বলছি না এটাই সত্যি, যে আমাদের আরহা বেঁচে আছে।
-আমাকে একটু ওর সাথে কথা বলিয়ে দাওনা।
– দেখো এখন তুমি কিছু খাবে ফ্রেশ হবে, তারপর কথা বলিয়ে দেবো।

– আমি তোমার সব কথা শুনবো তুমি শুধু একবার ওর আওয়াজটা শুনিয়ে দাও।

– দেখো মেঘ গেছে আরহাকে আনতে তারমানে আরহাকে নিয়েই ফিরবে।
-তুমি এতো শিউর কি ভাবে হচ্ছো হতেই পারে আংটিটা কেউ রাস্তায় পেয়েছে।
ইমতিহান নিজেও এখন কনফিউজড হয়ে গেলো, নীলুর কথায় যথেষ্ট যুক্তি আছে। তবুও নীলুকে বললো, আমি বলছি তো আরহা বেঁচে আছে, তাহলে বিশ্বাস করছো না কেনো?

– বিশ্বাস করতে তো আমারো ইচ্ছে করে তবে একবার
ওর আওয়াজ শুনতে পেলে হৃদয়ে শান্তি পেতাম। না হয় মনটা বড্ড অস্থির হয়ে বলে, তোকে মিথ্যে বলছে।

ইমতিহান নীলুকে জড়িয়ে নিয়ে বলে,দেখো আমাদের আরহা ঠিক আমাদের কাছে ফিরে আসবে, তুমি কিছু খেয়ে রেস্ট নাও।

প্রান্তর অবস্থা পাগল প্রায়, বেচারা সবচেয়ে বেশি ট্রাজেডির মধ্যে আছে, প্রথমে তো আরহার মৃত্যু শোক, তার উপরে হসপিটালে যেয়ে যখন জানতে পারে আরহার হ্যাসবেন্ড আছে মূহুর্তে প্রান্তর দুনিয়া উল্টে যায়। প্রান্ত ছেলেটা মিডিয়া পার্সন হয়েও খুব ভালো। স্ট্রং পার্সোনালিটির একজন মানুষ, প্রয়োজন ছাড়া কোন মডেল বা মেয়েদের সাথে তেমন কথা বলে না। আরহাকে প্রথম দেখায় ভালো লাগে, সেই ভালো লাগা ধীরো ধীরে ভালোবাসায় কনভার্ট হয়। আরহা রিসেন্টলি তোলা একটা ছবির দিকে তাকিয়ে আছে, হাত দিয়ে ছবির উপর আলতো করে ছুয়ে দিলো, ছবিটিতে বার কয়েক চুমু খেলো,বিরবির করে বললো,

তুমি আমার নও যেনেও আমি তোমার হই!

তোমাকে হৃদয়ের গহীনে ধারণ করে পাহাড় সমান বিরহ সই!

তবে কেনো এভাবে ছেড়ে গেলে? তুমি না হয় অন্য কারো হয়ে থাকতে!

আমি না হয় দূর থেকে তোমার ভালো থাকাটুকু দেখে
নিজের চক্ষু শীতল করতাম, হৃদয়ে প্রশান্তি অনুভব করতাম।

কেনো এভাবে হারিয়ে গেলে না ফেরার দেশে!

প্রান্ত হাতের উল্টো পিট দিয়ে চোখের পানি মুছে নিয়ে বলে, তোমাকে ভালো না বাসতে পারতাম, নিজের চোখে তোমার ভালো থাকাটা দেখতে তো পারতাম। এখন তো তাও হবে না। প্রান্তর মা এসে হাত রাখলেন ছেলের কাঁধে, মৃদৃ স্বরে বললেন, যে চলে গেছে সে আর ফিরে আসবে না বাবা। তবে যে বেঁচে আছে তাকে এসব মেনে নিয়ে সামনে এগিয়ে চলতে হবে। আমি বলছি না তুমি আরহাকে ভুলে যাও শুধু বলছি নিজেকে সামলে নাও। চাইলেই কাউকে ভুলা যায় না।তবে চাইলেই নতুন করে শুরু করা যায়।

প্রান্ত নিজের মা’কে জড়িয়ে ধরে বলে, পারছিনা আম্মু কিছুতেই এটা মেনে নিতে পারছি না। আমার আরহা আর নেই। সেই মধুর কন্ঠে আর শোনা হবে না। এটা কি ভাবে মেনে নেবো। আমি তো জোড় করে ওকে নিজের করে রাখতে চাইনা। আমি চাই, আমার ভালোবাসার মানুষটা ভালো থাক! কেনো এভাবে অবেলায় চলে গেলো। নিজেকে একটু সামলে নে বাবা যা হয়েছে তাতো আর ফিরিয়ে আনতে পারবো না। তোকে এভাবে কষ্ট পেতে দেখতে পারছি না। পারছিনা রিজেকে ঠিক রাকতে, বারবার সেই হাসি মুখটা আমার চোখের সামনে ভেসে উঠছে। আমি মানতেই পারছি না ওই হাসি মুখটা আর দেখতে পারবো না। আর কখনো আমাকে বলবে না আপনি আমার দিকে এভাবে তাকাবেন না আমার অস্বস্তি লাগে।

রাতের প্রায় শেষ প্রহর সামিরা অপেক্ষায় আছে মেঘ আসবে,সম্পূর্ণ তার হয়ে আর কোন পিছুটান থাকবে না। একটু সময় হবে মেঘকে সামলে নিতে তবে ভালোবাসার জন্য এতোটুকু করা যেতেই পারে। হালকা বাতাসে জানালার গোলাপি রঙের পর্দা গুলো উড়ছে, সামিরার কোলা চুলগুলো সাথে উড়উড়ি করছে, একদিকে আনন্দিত হচ্ছে অন্যদিকে কিছুটা মন খারাপ আরহার জন্য। আকাশের মিটিমিটি জ্বলতে থাকা তারাগুলোর দিকে তাকিয়ে বলে, কথায় আছে না, যা হয় ভালোর জন্যই হয়।

এতো জোড়ে জোড়ে দরজা ধাক্কানোর শব্দে ইউসুফের ঘুমও ভেঙে যায়। দরজার সামনে, আরহা,শিউলি আর ইউসুফ তিনজনে উপস্থিত হয়েছে, তবে সাহস করে কেউ দরজা খুলছে না। ইউসুফ বললো, কে দরজার ওপাশে
কেউ একজন বললো দরজাটা খুলুন প্লিজ, না হলে দরজা ভেঙ্গে ফেলতে বাধ্য হবো!

দরজার বাহিরের মানুষটির কন্ঠস্বর কর্ণগোচর হতেই আরহার হৃদপিণ্ড কেঁপে উঠল, মনে মনে বলছে আমি কি ভুল শুনছি, নাকি সত্যি সে এসেছে। দ্বিধা দ্বন্দ্ব ভুলে আরহা দ্রুত যেয়ে দরজা খুলে দিলো, হারিকেন হাতে পাশেই শিউলি দাঁড়িয়ে আছে। যার ফলে আরহার চেহারা স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে। সবাই কিছু বুঝে ওঠার আগেই মেঘ আরহার গালে ঠাসসসসসসস করে একটা থাপ্পড় বসিয়ে দিলো। আরহা গালে হাত দিয়ে বোকার মতো তাকিয়ে আছে, এই মূহুর্তে কি রিয়েক্ট করবে সেটাই হয়তো ভুলেগেছে।

ইউসুফ রাগ দেখিয়ে বললো,আপনার সাহস কি করে হয় আমার বাসার অতিথির গায়ে হাত তোলার।

মেঘ কোন কথার উত্তর না দিয়ে একটানে আরহাকে নিজের সাথে জড়িয়ে নেয়। এতোক্ষণে মেঘের অশান্ত হৃদয় কিছুটা হলেও শান্ত হয়েছে।

ইউসুফ সামনে এগোতেই শিউলি ইউসুফের হাত ধরে বলে, মনে হয় এটা ওর স্বামী।
– তুমি কি করে বুঝলে?
– ছয় বছর ধরে তোমার সাথে সংসার করি আর এতোটুকু বুঝবো না। দেখো ছেলেটার চোখে নিজের মানুষকে হারানোর ভয়, আর ভালোবাসা দু’টোই আছে।

– ইউসুফ শিউলির কানের কাছে মুখ এনে বলে আগে কহনো তো কইলা না তুমি চোহের ভাষা এতো ভালা বুঝো! দেহো তো আমার চক্ষুতে তোমার জন্য ভালোবাসা আছে নি।

– এখন কি এইসব বলার সময়! রাতবিরেত মেহমান আইছে হের থাহার ব্যবস্থা করতে অইবো। কিছু নাস্তা পানির ব্যবস্থা করবার অইবো।

শিউলি কাশি দিয়ে বলে, এহন কি দাঁড়াইয়া থাকবেন দুলাভাই নাকি একটু গরিবের ঘরে বইবেন।

শিউলির কথা শুনে মেঘ আরহাকে ছেড়ে দিলো। আরহা বুঝতেই পারছে না কি হচ্ছে। এদিকে বাম গালটা ভিষন জ্বলছে, আরহা রাগী দৃষ্টিতে মেঘের দিকে তাকালো।

আরহার দৃষ্টি উপেক্ষা করে মেঘ শিউলি কে বললো,কেনো আসবো,না যেখানে আমার বিবিজান সেখানেই আমি।তবে আপনাকে কি বলে সম্মোধন করবো?
– আরে দুলাভাই আপনার বিবিজান আমার ছোট বেলার সই। আমারে নাম ধইরা ডাকবেন,আমার নাম শিউলি,খর ইনি আমার স্বামী।

মেঘ শিউলি আর ইউসুফের সাথে কুশল বিনিময় করে।
শিউলি আরহাকে তাদের শোবার ঘর দেখিয়ে দিয়ে বলে, আমি আপনার জন্য একটু গুড় মুড়ি নিয়ে আসি।

– না সেসবের এখন দরকার নেই আমি খুব ক্লান্ত একটু বিশ্রাম নেবো।
শিউলি চলে যেতেই মেঘ দরজা বন্ধ করে আরহার পাশে এসে দাঁড়ালো, আরহা কিছু বলবে তার আগেই মেঘ আরহার কোমড়ে এক হাত রেখে নিজের কাছে টেনে নিলো, অপর হাতের এক আঙ্গুল আরহার ঠোঁটের উপর রেখে,আরহার চোখে চোখ রেখে শীতল কন্ঠে বললো……
অনেকটা কষ্টের পর তোমার কাছে আমি সান্ত্বনার বানী শুনতে চাই না!
শুধু তোমার কাছে একটু শান্তি চাই।
পেছনের ভুলগুলোকে ভুলে যেয়ে। নতুন ধারায় শুরু করতে চাই! যেখানে সম্পর্কের মূলভিত্তি হবে,বিশ্বাস, ভরসা,ভালোবাসা।

আমি চাই তুমি আমার মানসিক শান্তির কারণ হও!
তুমি কি হবে আমার বুড়ো বয়সের শান্তির কারণ। তবে মনে রেখে এ সম্পর্কে ছেড়ে যাওয়া বারণ।

অপলক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে আরহা মেঘের দিকে
অপেক্ষার ফল যে, এতো মিষ্টি হবে তা হয়তো জানা ছিলো না। আরহার।
এরকম একজন জীবন সঙ্গী সবাই চায়!
আরহা এখন মেঘকে কি উপহার দেবে অপেক্ষা নাকি উপেক্ষা? নাকি ভালোবাসা?

#চলবে

#তুমি_আসবে_বলে

#নুসাইবা_ইভানা

পর্ব-৩৪

আরহা মুগ্ধ নয়নে তাকিয়ে আছে মেঘের পানে, আচ্ছা এই চোখগুলোতে এতো আকুলতা কেনো? আরহা নিজের অভিমান ভুলে মেঘ কে জিজ্ঞেস করলো, আপনাকে এমন দেখাচ্ছে কেনো? মেঘের শরীরে হাত দিয়ে বলে আপনার জামাকাপড়ের এই অবস্থা কেনো? আপনার কোন বিপদ হয়নি তো! আরে চুপ করে আছেন কেনো বলুন!

মেঘ আরহাকে নিজের সাথে মিশিয়ে নিয়ে বলে,আমার কি হয়েছে জানতে চাও?আর একটু দেরি হলে আমাকে হয়তো আর জীবিত দেখতে না।
আরহা মেঘকে আর একটু শক্ত করে জড়িয়ে ধরে বলে, এসব কি ধরণের কথাবার্তা,এমন কথা কেনো বলছেন।
– আগে তুমি বলো এভাবে কেনো চলে এসেছো?তুমি কি আমাকে ভালোবাসো না।
– এ প্রশ্নের উত্তর দিলে আমার ভালোবাসার অপমান হবে।
– তাহলে চলে আসলে কেনো?
– আজ মায়ের মৃত্যু বার্ষিকী ছিলো তাই এসেছি
– একবার বলে তো আসতে পারতে। তুমি জানো যখন তোমার এক্সিডেন্টের খবর শুনলাম তখন আমার অবস্থা কি হয়েছিলো?
– আরহা বোকা বনে গেলো, কিসের এক্সিডেন্ট?
– তোমার গাড়িতে কে ছিলো তোমার ড্রেস পরা
– সালমা ছিলো আমি ওর ড্রেস পরেছিলাম আর ও আমার, সালমাকে নিয়ে আসতে চেয়েছিলাম তবে গাউছিয়া এসে চিন্তা করলাম নিজের গাড়ি নিয়ে গেলে বিপদ বেশি হতে পারে আর তাছাড়া এতোটা রাস্তা ড্রাইভিং করাও সম্ভব না। তাই ড্রাইভারকে কল করে,সালমাকে রেখে আমি বাসে চলে আসছি।

মেঘ আরহার কপালে চুমু খেয়ে বলে আর কখনো আমাকে না বলে কোথাও যাবে না।

– এটা বলুন আমার গাড়ির এক্সিডেন্ট হলো কি করে? আর সালমা মেয়েটার কি অবস্থা।

– মেঘ বেডের উপর শুয়ে পরলো শরীরটা বড্ড ক্লান্ত

আরহা মেঘের পাশে দাঁড়িয়ে বলে আরে বলুন কি হলো?

মেঘ এক হাত দিয়ে আরহাকে টেনে নিজের উপর ফেলে দিয়ে বলে, চুপ করে এখানে শুয়ে থাকো, অনেক জ্বালিয়েছো এবার একটু শান্তিতে থাকতে দাও।

আরহা হৃদযন্ত্রের ক্রিয়া বেসামাল হতে লাগলো,শ্বাস বেড়ে গেলো, কোন রকম কাঁপা কাঁপা গলায় বললো ছাড়ুন আমাকে!

মেঘ আরহাকে আরএকটু গভীর ভাবে নিজের সাথে জড়িয়ে নিয়ে বললো, এখন থেকে অভ্যাস করো, বিবিজান, এরপর থেকে সারাজীবন এই ভাবেই ঘুমতে হবে।

আরহা সরতে চাইছে, মেঘ নেশালো কন্ঠে বললো, তুমি চাও এর চেয়ে বেশি কিছু হোক। আমি কিন্তু এখনি সে-সব চাইছিনা। তবে তুমি চাইলে আপত্তি নেই জানেমান। এমনিতেও এতো সুন্দরী বউ কাছে থাকলে মনটা বারবার বেহায়া হতে চায়।

মেঘের কথা শুনে আরহার লজ্জায় মিইয়ে গেলো, কোন কথা না বলে মেঘের বুকের সাথে লেপ্টে শুয়ে থাকলো। মনে মনে একটাই প্রশ্ন আপনি আমাকে এতো ভালো কবে বাসলেন?আর এসব লাগামহীন কথাবার্তা কবে শিখলেন।

– এখন ঘুমাও সব প্রশ্নের উত্তর ঢাকা যেয়ে দিয়ে দেবো। আর হ্যাঁ লাগামহীন কথাবার্তা শিখতে হয় না। সুন্দরী বউ পাশে থাকলে অটোমেটিক মুখ থেকে লাগমহীন কথাবার্তা বের হয়ে যায়।

আরহা অস্ফুট স্বরে বললো, অসভ্য।
– নিজের হ্যাসবেন্ডকে অসভ্য বলছো, সমস্যা নেই বলতেই পারো কারণ তোমার সাথে অসভ্যতা না করলে কার সাথে করবো।

আরহার কান দিয়ে গরম ধোয়া বেড় হচ্ছে,চুপচাপ মেঘের সাথে লেপ্টে রইলো।কিছু সময় পর দু’জনেই ঘুমের রাজ্যে পারি জমালো।

মোয়াজ্জিনের মধুর কন্ঠে আজানের ধ্বনিতে ঘুম ভাঙলো হায়দার মিয়ার। ঘুম থেকে উঠে ওজু করে নামজ আদায় করতে মসজিদে গেলেন।

নামাজ শেষ করে হাঁটা দিলেন বোনের কবরের পাশে, এটা হায়দার মিয়ার নিত্যদিনের কাজ। ফজরের নামজ পরে কবর জিয়ারত করে তারপর বাসায় ফেরেন। কবর জিয়ারত শেষ করে আসার সময় হঠাৎ চোখ গেলো কবরের পাশে পরে থাকা একটা বস্তুর দিকে। হাত বাড়িয়ে সেটা উঠিয়ে নিলেন, এটা তো একটা নুপুর এটা এখানে কোথা থেকে আসলো।বেশ কিছু চিন্তা ভাবনা করতে করতে বাসায় গেলেন সোনিয়া বেগম এখন সয্যাশায়ী, সকালের নাস্তা হায়দার মিয়া নিজেই বানান। মাঝে মাঝে মেয়েটা যখন বাসায় থাকে তখন অবশ্য তার মেয়েটাই বানায়।

সোনিয়া বেগমকে উঠিয়ে ফ্রেশ করিয়ে দিয়ে, ভাত আর আলু সেদ্ধ করলেন, নিজে খেলেন সোনিয়া বেগম কে খাওয়ালেন। খাওয়া দাওয়া শেষ করে হায়দার মিয়া বললেন, হারিছ কোথায় ওরে তো দেখলাম না।
– কইতে পারিনা ঘুম থিকা উইঠা কই গেলো?
– তুমি তো জিঙাইবা নাকি! পোলাটা সকাল সকাল না খাইয়া লইয়া কই গেলো?
– এতো চিন্তা করোনের কিছু নাই। কই আর যাইবা আইয়া পরবো।

রোদের আলো চোখে পরতেই আরহার ঘুঘ ভেঙে গেলো রোদের তেজ দেখে বোঝাই যাচ্ছে অনেক বেলা হয়েছে। আরহা নড়াচড়া করতেই ঘুম জড়ানো কন্ঠে মেঘ বললো, ডিস্টার্ব করো না ঘুমোতে দাও!

– কোন ছেলের ঘুম জড়ানো কন্ঠ যে এতো মধুর হতে পারে আরহার জানা ছিলো না। আস্তে করে বললো, এটা শহর নয় গ্রাম আর ঘুমানো যাবে না উঠতে দিন আমাকে!
– না তুমি উঠলে আমার ঘুম ভেঙ্গে যাবে।
– আপনি এমনিতেও জেগে আছেন ছাড়ুন আমাকে
অনিচ্ছা সত্ত্বেও ছেড়ে দিলো, নিজেও উঠে বসলো

রাতে তো খেয়াল করেনি আরহার দিকে এবার আরহার দিকে এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে, বাসন্তী আর লাল খয়েরী রঙের প্রিন্টের সুতি শাড়ি গায়ে জড়ানো, চুলগুলো এলোমেলো, শাড়িটাও ঠিক নেই মেদহীন পেট’টা স্পষ্ট

আরহা মেঘকে এভাবে তাকিয়ে থাকতে দেখে বলে, এমন করে কি দেখছেন?
– আমার বউকে, আজ তাকে পিউর বাঙালী বধুদের মতো লাগছে। তবে তোমার পেটের ডান পাশের লাল তিলটার জন্য হট লাগছে।

মেঘের কথা শুনে আরহা সাথে সাথে ঘুরে দাঁড়ালো কাপড় টেনে টেনে ভালো ভাবে ঢেকে নিয়ে রুম থেকে বের হয়ে গেলো।

আরহাকে বের হতে দেখে শিউলি বলে, তোর মুখটা এমন লজ্জারাঙা কেনো!
– কি যে বলিস না তুই, দুলাভাই কোথায় আমার একটু শহরের দিকে যাবো।
– তোদের জন্য বাজার করতে গেলো প্রথম বার জামাই নিয়ে আমাদের বাড়িতে আসলি ভালোমন্দ খাওয়াতে হবে না।
– আচ্ছা শোন তোর দুলাভাইয়ের জন্য একটা লুঙ্গী আর গামছা দে।
– তুই দাঁড়া আমি নিয়ে আসছি।

নীলু বারবার ইমতিহানকে বলছে, এখনো তো কল দিলো না। তুমি একটু খোঁজ নিয়ে দেখো না। এরমধ্যেই নীলুর ফোনটা বেজে উঠলো, ইমতিহান ফোনটা রিসিভ করলো, ওপাশ থেকে প্রান্ত বললো, নীলিমা তোমাদের গ্রামের বাড়ি সিলেট এটাতো কখনো বলোনি! আর একটা জীবিত মেয়েকে মৃ*ত বানোনার কি খুব বেশি দরকার ছিলো!

কে আপনি আর এসব কি বলছেন, ইচ্ছে করে কোন শখে এসব করবে!
– আপনি কে আর কি বলছি বুঝতে না পারলে সংবাদ দেখুন সকাল ৮থেকে একি সংবাদ প্রচার হচ্ছে।

ইমতিহান কল কেটে দিয়ে টিভি অন করলো,
আজকের ব্রেকিং নিউজ, বিখ্যাত সঙ্গীত শিল্পী আদিয়াত নুজহাত আরহার মৃত্যুর খবরটি ভুল ছিলো,তিনি বেঁচে আছেন এবং সম্পূর্ণ সুস্থ আছেন। এবিষেয়ে নিশ্চিত করছেন মহানগর পুলিশ। বিস্তারিত জানতে সাথেই থাকুন!

নীলু ইমতিহানকে ধরে কেঁদে দিলো, তারমানে সত্যি সত্যি আমার আরহু বেঁচে আছে। তাহলে ওই মেয়েটা কে ছিলো?

আস্তে আস্তে সব জানতে পারবো আপাতত আরহা বেঁচে আছে আর আমি নিশ্চিত মেঘ ওর সাথেই আছে টেনশনের আর কিছুই নেই। নীলু মাথা নাড়িয়ে বললো হুম আর কোন চিন্তা নেই। তবুও ওকে এক নজর দেখতে পারলে শান্তি পেতাম।

সামিরা ফ্লাওয়ার বাস দিয়ে আঘাত করে টিভিটা ভেঙে ফেলে চিৎকার করে বলে, কেনো, কেনো বারবার আমার সাথে এমন হয়! কেনো পেয়ে হারানোর যন্ত্রণা আমাকে সহ্য করতে হয়। আমি যে তোকে ভালোবাসি মেঘ বড্ড বেশি ভালোবাসি কেনো তুই আমার ভালোবাসা দেখলি না। কেনো কেনো!

আরহা মেঘের জন্য লুঙ্গি আর গামছা নিয়ে রুমে আসলো।

মেঘ গামছা আর লুঙ্গি দেখে বলে এসব কি?

#চলবে

ভুলত্রুটি ক্ষমা সুন্দর দৃষ্টিতে দেখবেন।
হ্যাপি রিডিং 🥰