তুমি আসবে বলে পর্ব-৩৯+৪০

0
369

#তুমি_আসবে_বলে
#হুমাইরা_হাসান
পর্ব: ৩৯-৪০

-আজব তোহ, এভাবে শ’কুনের মতো চেয়ে আছিস ক্যান সবগুলো।

-কেনো আমরা কি তাকাতেও পারবো নাহ নাকি।

-কেনো তাকাবি,আর এভাবে ফিক্সড লুক দিয়ে তাকিয়ে থাকার কি আছে, এসে থেকেই দেখছি

-তুই কি দেখছিস,দেখছি তো আমরা।

নিবিড়ের কথায় বিরক্ত হয়ে উত্তর দিলাম

-হ্যাঁ তো সবগুলো এভাবে চো’রের মতো করে তাকিয়ে আছিস কেনো, আমার কি পাখনা গজিয়েছে নাকি শিং উঠেছে।

আদ্রিশ, বিজ্ঞদের মতো গলা খাঁকারি দিয়ে বললো।

-গজায়ও নি ওঠেও নি, ফুটেছে

-কিসব বলছিস, মাথার তার কইটা গেছে? কি ফুটেছে?

রাফাত ওর বিশ্রি রিয়েকশন দিয়ে ঢং করে বললো

-ফুল ফুটেছে ফুল,, প্রেমের ফুল। আশেপাশে কেমন প্রেম প্রেমের কড়া গন্ধ পাচ্ছি।

রাফাতের কথায় বেশ অপ্রস্তুত বনে গেলাম, ওরা যে কি উদ্দেশ্য করছে তা ঠিক বুঝতে পেরেছি। তখন গাড়ি থেকে দৌড়ে এসে ঘরে ঢুকেই দেখি ফ্লোরে বিছানা পেতে পাঁচটা ত্যাড়া বাকা হয়ে শুয়ে আছে, আমি এসে ব্যাগটা রেখে ওদের কাছে যাওয়ার পর থেকে শুরু হয়েছে, এক এক টা এক এক রকম চোখে চেয়ে আছে, যেনো চিড়িয়াখানার নতুন প্রাণী দেখছে, ওরা এসব বলবে জানলে কখনো জিজ্ঞাসা করতাম না। বেয়াদব গুলো আমাকে আচ্ছা জ্বা’লানো জ্বা’লাচ্ছে।
হাতে ভর দিয়ে বসা থেকে উঠে দাঁড়িয়ে বললাম

-এই যে নিচে পপকর্ণ আর কোল্ড ড্রিংকস এর মেলা বসিয়েছিস আমি ঘর থেকে আসতে আসতে যদি পরিষ্কার না হয় তবে আমি তোদের চোখে সরিষা ফুল ফোটাব মনে রাখিস।

বলেই গটগট করে ঘরের মধ্যে আসলাম, ওরা যে এখন কিছুক্ষণ নিজেদের মধ্যে চাওয়াচাওয়ি করে ফুসুরফাসুর করবে তা আমি জানি। সবগুলো প্ল্যান করে শুরু করেছে আমাকে জ্বা’লাবে বলে, ওদের কি চিনি না আমি।

ওয়াসরুমে ঢুকে ফ্রেশ হয়ে চেঞ্জ করে এসে বসতেই ফোনটা বেজে উঠলো, এখানে এসে পৌঁছেই তো আব্বুকে ফোন করে জানিয়েছি,এখন আবার কে?
ফোনটা হাতে নিতেই মৃদু হেসে রিসিভ করলাম,ওপাশ থেকে চিকন কণ্ঠে চেঁচিয়ে উঠলো

-আপুউউউ,,আমি খুব রাগ করেছি তোমার উপর খুব। তুমি এতদিন পরে আসলে অথচ আমার সাথে দেখা না করেই চলে গেলে,আর দুটো দিন থাকলে কি হতো।

-আরে পাগলী তুই তো বাড়িতে ছিলিস না, আর আমার পরীক্ষা আছে বলেই চলে আসতে হলো, না তো তোর সাথে দেখা না করে কি আমি আসতে পারি বল।

-তাহলে তুমি যেদিন আসলে সেদিন ই আমাকে ফোন করে কেনো বললে নাহ, আমি সেদিনই চলে আসতাম

-তুই এতদিন পরে ঘুরতে গিয়েছিস বলেই বলিনি। আর আমি তো আবারও যাবো পরীক্ষা শেষ হলে।

আমি হাজার বোঝানো সত্ত্বেও জেদ ধরেছে সারা আমি কেনো ওর সাথে দেখা করে আসলাম নাহ।
মেয়েটা এমনি ভীষণ ছটফটে আর চঞ্চল, প্রচুর কথা বলে। আমি বলে পাগল। নিজের মায়ের পেটের বোন না হলেও নিজের ছোট বোনের চেয়ে কোনো অংশে কম ভালোবাসি নাহ। জন্মের আগেই বাবাকে হারিয়েছে মেয়েটা, পাঁচ বছর বয়সে খালাও একটা অ্যাক্সিডেন্টে পরপারে চলে যায়, সেই থেকেই ও আমাদের সাথে, একসাথে ভাই বোনের মতোই বড় হয়েছি। না মা বাবা কখনো ওকে আমাদের চেয়ে কম চোখে দেখেছে আর না আমি আর ভাইয়া ওকে কখনও নিজেদের চেয়ে কম ভালোবেসেছি। সবে মাত্র এসএসসি পরীক্ষা দিয়েছে সারা, ছোট মামা নাকি সাথে নিয়ে গেছে নানির বাড়ি কিছুদিন ঘুরিয়ে আনতে, তাই আমিও বাড়ি গিয়ে জানাইনি। একবার জানালে ছুটে আসতো পাগলীটা। ভাইয়া আর আমার অবর্তমানে সারাই বাড়ির সব। তাই আব্বু আম্মুও ওকে চোখে হারাই। বাড়ি থেকে বাইরে খুব কম ই যাওয়া হয় বলে আমিও চাইনি ওর ভ্যাকেশন শেষ করতে।
সারার সাথে আরও কিছুক্ষণ কথা বলে ফোন রেখে বাইরে পা বাড়ালাম।

-আফুউ

বলেই দৌড়ে এলো আমার কাছে, আমি দু হাত বাড়িয়ে কোলে তুলে নিলাম মিষ্টিকে

-তুমি তোতায় চিলে আফু, আমি তোমায় থুজেচি।

-আমি বাড়িতে গিয়েছিলাম এঞ্জেল

গাল দু’টো টেনে হামি দিয়ে বললাম।
মিষ্টিকে কোলে নিয়েই বসার ঘরের দিকে তাকিয়ে দেখি রুচি আপুও বসেছে ওদের আড্ডায়, তিয়াস ভাইয়া রুচি আপুকে নিয়ে খুলনাতে গেছিলো তাদের গ্রামের বাড়িতে, হয়তো কাল এসেছে। আপু দেখেই গিয়ে বললাম

-আরে রুচি আপু, কবে আসলে?

আপু আমার দিকে চেয়ে হাসি মুখে বললেন

-আফু, আই আই বস। আজ সকালেই এসেছি। এসেই মিষ্টি বাইনা ধরেছে আফুর কাছে চলো চলো করে তাইতো নিয়ে আসলাম।

-বেশ করেছো। ভীষণ মিস করেছি তোমায় এইকদিন

-হ্যাঁ থাক, আর বাহানা বানাতে হবে নাহ আমায় মিস করার আর সময় কই। শুনলাম আজকাল তোর দিন মেঘে মেঘেই কেটে যায়

আপুর খোঁচা দেওয়া ইঙ্গিত বুঝতে আমার এতটুকুও অসুবিধে হয়নি, লজ্জায় কিছু বলতেও পারছি নাহ, এসব এই আপদ গুলোর তা কাজ বেশ জানা আমার, দেখো কেমন চোরের মতো হাসি দিচ্ছে এক একটা।

-এভাবে বলতে পারলে, আমি কি ফোন দিয়ে কথা বলিনি তোমার সাথে। আমি তোমাকে আর মিষ্টি কে কতো মিস করেছি জানো।

-থাক থাক। আমাকে মিস করতে হবে নাহ, যাকে করা দরকার তাকেই কর, শুনলাম আজকাল মানুষ মাঝরাতেও এক শহর থেকে অন্য শহরে ছুটে যায় কারো টানে

আপুর কথার সাথে তাল মিলিয়ে নিবিড় বললো

-শুধু তাই নাকি, আরও কতো কি..

-তুই চুপ করবি নাকি আমি ঝাটা আনবো বল। তোরা সব কয়টা বেশি বার বেড়েছিস।

আমার ধমক শুনে আরশি বললো

-ওমাহ,বার বাড়ার কি আছে আমরা তো সত্যিই বলছি।

-ওহ আচ্ছা! তাই নাকি।। তুমি কোন দেশের ধোয়া তুলসীপাতা শুনি, সকাল থেকে তোরে পপঞ্চাশ বার ফুসুরফাসুর করতে দেখেছি ফোনে।

আমার কথায় আরশি বেশ লাজুক লাজুক মুখ করে বলে

-আসলে উনি আজকে একটু শহরের বাইরে গেছে তো তাই খোঁজ নিচ্ছিলাম আরকি।

আরশির এভাবে লজ্জা পাওয়া দেখে আদ্রিশ বললো

-ভাই তুই আর লজ্জা পাইস না প্লিজ। তোরে লিপস্টিক মাখা বান্দরের মতো লাগতাছে, আমারতো এখন আরাব ভাইরে নিয়ে টেনশন হচ্ছে, ভাই ভুল জায়গায় ল্যান্ড করে ফেললো না তো?

-আমারও মনে হয় জানিস, ভাই মনে হয় ভুলে আরশিরে প্রপোজ কইরালাইছে, না তো এই বিন্দির চুন্নি মার্কা হাসি দেখেও কেও কুয়াতে ঝা’প দেওয়ার মতো কাজ টা করবে নাহ।

বলেই হাহা করে হেসে উঠলো, রাফাত আর আদ্রিয়ানের এমন কথা শুনে আমি আর রুচিতা আপুও না পেরে হেসে দিলাম।
আরশি এবার প্রচন্ড ক্ষেপে গেছে, আশেপাশে দেখে একটা পানির বোতল হাতে নিয়েই ধুপধাপ পে’টানো শুরু করলো।

-এই যাহহ, ভুল সময়ে এসে গেলাম নাকি।

পুরুষালি কণ্ঠস্বরে পিছু ফিরে দেখি ধ্রুব ভাই বেশ হতভম্ব দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে ।

-আরে ধ্রুব, এদিকে আই
রুচিতা আপুর ডাকে এদিক ওদিক বিহ্বলিত হয়ে দেখে এগিয়ে এলো।
রুচি আপু এক গাল হেসে আবারও বললো

-এদের এসব ধরিস নাহ, এরা এমন ই। তা তুই কখন এলি

-এইতো এদিক দিয়ে যাচ্ছিলাম, ভাবলাম মেঘের সাথে দেখা করে যায়। উপরের দিকেই যাচ্ছিলাম এখানে হট্টগোল শুনে আসলাম আরকি।।

নিবিড় উচ্ছ্বসিত হয়ে বললো।
-বেশ করেছো, ট্যুর থেকে ফিরে কারোর ই তেমন দেখা হয়নি। আজকে বেশ আড্ডা দেওয়া হবে

-ভাই এগুলো কি আইসক্রিম!

রাফাতের কথা শুনে ধ্রুব ভাই হাতের ব্যাগ গুলো রেখে সামান্য হেসে বললো

-হ্যাঁ, আসছিলাম যখন ভাবলাম আইসক্রিম নিয়ে আসি তোমাদের জন্য।

আরশি খপ করে আইসক্রিম গুলো হাতে নিয়ে বললো,
-ওহ ভাইয়া, কি করে যে থ্যাংকিউ বলবো একদম মন মতো কাজ টা করেছেন এটাই দরকার ছিল

-এখানে একদম নোংরা করবি নাহ, আমি দিচ্ছি সবাইকে

বলেই আরশির হাত থেকে ব্যাগ টা নিয়ে রান্নাঘরের দিকে গেলো শিমু, ধ্রুব কিছুক্ষণ শিমুর যাওয়ার পানে চেয়ে আবারও ওদের সাথে আড্ডায় যোগ দিলো।

_________________

-মেঘ তুমি কি কিছু বলতে চাও? এতো ইতস্তত করছো কেনো, বলো কি বলার আছে তোমার।

রমজান চৌধুরীর কথায় মেঘ সামান্য নড়েচড়ে বসলো। এই দিয়ে নয়বার হলো, যতবার ই বলার প্রস্তুতি নিচ্ছে ততবারই থমকে যাচ্ছে। আজকে সে বিকেলে অফিস থেকে ফিরে, বাবাকে ডেকেছিলো কিছু জরুরি কথা বলবে বলে। কিন্তু যতবারই বলতে যাচ্ছে, কোনো ভাবে আটকে যাচ্ছে কথা।
এবার বেশ নিজেকে শক্ত করে কেঁশে উঠে বললো।

-বাবা আমি আসলে,কিছু গুরুত্বপূর্ণ কথা বলতে চাই।

-হ্যাঁ তোমার কথা শোনার জন্যই তো বসে আছি আধ ঘন্টা ধরে, তুমি তো এদিক ওদিক ফিরেই দেখছি একদিন পার করে দেবে, সত্যি করে বলো তোহ এমন হাসফাস করছো কেনো। কোনো অকাজ ঘটাও নি তো?

-আরে কিসব বলছো বাবা, অকাজ কিসের,কি অকাজ ঘটাবো।

-তাহলে বলতে এতো কেনো বাঁধছে,ফটাফট বলে ফেলো তোহ

-ও সারাদিন ধরেও বলতে পারবে নাহ আংকেল, আমি বলছি

মেঘ চোখ তুলে তাকিয়েই দেখে ধ্রুব দাঁড়িয়ে আছে,

-আরে ধ্রুব এসো বাবা এসো। দেখো আমার এই গুণধর ছেলেটা পুরো আধ ঘন্টা বসিয়ে রেখেছে কিছু বলবে বলে, এখনো বলতে পারছে নাহ। তুমি বলো তোহ কি হয়েছে, গোপনে বিয়ে টিয়ে করে ফেলেছে নাকি

নিজের বাবার এমন অযৌক্তিক কথা বার্তা শুনে মেঘ বলে

-উফ বাবা, কি বলছো। বিয়ে কেনো করতে যাবো।

-তোমার মুখ দেখে তো তাই ই মনে হচ্ছে।

এবার ধ্রুব এসে পাশে বসে বলে

-পুরোটা তেমন না হলেও অনেকটা সেইরকম ই বলা যায়।।

ধ্রুবের কথা শুনে মেঘ রাগী দৃষ্টিতে তাকায়। রমজান চৌধুরী বেশ জোরে বলে উঠলো

-বলো কিহ। আমার এই রসকষহীন ছেলেটা তাও আবার বিয়ে। ধুর, ওর দ্বারা এসব হবে নাহ। ও শুধু পারবে অফিস সামলাতে আর গম্ভীর মুখ করে থাকতে, আমার ছেলেটা এতো কাঠখোট্টা কি করে হলো আমিও বুঝিনা জানো। ওর বয়সে তো আমি বিয়ে করে ফেলেছিলাম

-তো আমায় বলতে কই দিচ্ছো, কথায় তো বলতে দিচ্ছো না বিয়ে কিভাবে করবো

বেশ উত্তেজিত হয়ে বলে উঠলো মেঘ। পরক্ষণেই নিজের অস্থিরতা বুঝতে পেরে দমে গেলো। রমজান চৌধুরী ছেলের দিকে কিছুক্ষণ নিঃশব্দে চেয়ে রইলেন। মেঘ বরাবর স্পষ্টভাষী কখনো কথা বলতে এমন দ্বিধাবোধ করে নাহ

-আংকেল মেঘ আপনায় এ বিষয়েই কিছু বলতে চাই।

মেঘ বেশ অপ্রস্তুত বোধ করছে, কথা ছিলো ধ্রুব নিজেই বলবে তার বাবাকে,এখানে এসে মেঘকেই ফাঁসিয়ে দিলো। প্রসঙ্গ হলো পালক আর তার বিয়ে নিয়ে, নিজের বাবার কাছে এভাবে বিয়ের কথা বলতে বেশ লজ্জা লাগছে মেঘের,কিভাবে কি বলবে কিছুতেই ভেবে পাচ্ছে না। আড়চোখে ধ্রুবের দিকে তাকাতেই ধ্রুব চোখ সরিয়ে নেয়।

-ওর দিকে তাকিয়ে আছো কেনো? কি বলবে আমায় বলো

বাবার কথায় ধীর কণ্ঠে মেঘ বললো

-কিছু না বাবা

এবার ধ্রুব ফট করে বলে ফেললো

-মিথ্যা বলছিস কেনো,তুই না বিয়ে করবি?

ধ্রুবের হাটে হাঁড়ি ভা’ঙার মতো কাজ দেখে মেঘ পারছে না ঠা’স ঠা’স করে দুটো ঘা ব’সিয়ে দিতে। লজ্জায় চোখ তুলে তাকাতে পারছে না বাবার দিকে।
ছেলের এভাবে লজ্জা পাওয়া দেখে, মুখ টিপে হাসলেন রমজান চৌধুরী। সে ইচ্ছে করেই ব্যপার টা এতো ঘাটছে। নিলাশা চৌধুরী অনেক আগেই তাকে সবটা বলেছে। পালক কে তো তাদের শুরু থেকেই ভীষণ পছন্দ। নিজেদের পছন্দ করা মেয়েকেই ছেলে মন দিয়ে বসেছে জেনেই আনন্দে আত্মহারা তিনি। নিজের উচ্ছ্বাস টুকু দমিয়ে রেখে বেশ গম্ভীর মুখ করে বললো

-সে তো গাধা টাকে কবে থেকেই বলছি বিয়ের কথা, প্রতিবারই তো বিয়ে করবে না বলে এড়িয়ে যায়। আজ হঠাৎ এ কথা? মেয়ে ঠিক করে ফেলেছো বুঝি?

ধ্রুব হরবর করে উগড়ে বললো

-হ্যাঁ হ্যাঁ, শুধু ঠিক নাহ মেঘ তো এক পায়ে খাড়া, এখন শুধু আপনাদের কাজী ডাকার পালা।

ধ্রুবের এমন কান্ডে মেঘ পারছে না ওকে ধা’ক্কা দিয়ে ছাদ থেকে ফে’লে দিতে, বাঁদর টা ইজ্জতের ফালুদা বানাচ্ছে।

রমজান চৌধুরী গম্ভীর মুখটা বজায় রেখে ধ্রুব কে বললো

-মেয়ে কি তোমাদের চেনা জানা নাকি?

-চেনা জানা মানে, ওদের প্রেম কাহিনির শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত জানি৷ শুধু আমিই কেনো আরও অনেকেই

-সাট আপ! কি যা তা শুরু করেছিস, আরেকটা ওয়ার্ড বললে খবর করে রাখবো

মেঘের ধমকের পৃষ্ঠে রমজান চৌধুরী জোর গলায় বলে

-তুমি চুপ করো, খবর তো তোমার আমি করবো, তুমিও যে প্রেম করেছো এটাই তো খবর হয়ে যাবে। এইরকম কাঠখোট্টা রসকষহীন ছেলেটার প্রেমে পরে কোন মেয়ের কপাল পু’ড়লো শুনতে হবে তো।

এবার ধ্রুব ও সায় দিয়ে বললো

-সেই তো। আমিতো কবে থেকেই বলছি বাড়িতে বলতে, ওই আজকে না কালকে বলে বলে দিন পার করছে।

-ওর মতো খা’টাস ছেলে এর চেয়ে বেশি কিছু করতেও পারবে নাহ

-বাবা, কিসব বলছো৷ আপন বাপ হয়ে নিজের ছেলেকেই যা তা বলছো।

-কিসের যা তা, আমি সত্যিই বলছি। তুমি মুখটা বন্ধ রাখো।
তা ধ্রুব মেয়েটা কে, আমরা কি দেখেছি

-শুধু কি দেখেছেন, বরং মেঘের চেয়েও অনেক বেশি দেখেছেন। সে তো আপনার ই বাড়ির লোক।

-সে কি! কার কথা বলছো

-পালক। মেঘ পালককে ভালোবাসে আংকেল, ও পালককেই বিয়ে করতে চাই।

-পালক? আমাদের পালক!

এবার মেঘ মৃদু স্বরে সম্মতি দিয়ে বললো

-হ্যাঁ

-মাশ-আল্লাহ মাশ-আল্লাহ। যাক জীবনে পড়াশোনা বাদেও একটা কাজের কাজ করলি। এই না হলে আমার ছেলে। খাঁটি সোনা ধরেছিস একেবারে

বলেই মেঘের পিঠ চাপরে আবারও বললো।

-আমি যত দ্রুত সম্ভব পালকের বাড়িতে যাবো। আমি নিজে গিয়ে ওর বাবার কাছে ওকে চাইবো।

মেঘ প্রশান্তির হাসি হাসলো। যেনো বুক থেকে অনেক বড় একটা পাথর নেমে গেলো। এখন শুধু তার প্রিয়তমাকে সারাজীবনের জন্য নিজের করে পাওয়ার অপেক্ষা।

_____________________

-এহেম এহেম

মৃদু কাশির শব্দে,পিছু ফিরে তাকালো শিমু। বাদামি রঙের শার্টের সাথে ডিপ অফ হোয়াইট রঙের প্যান্ট পরনের লোকটা ঠিক তার সামনে দাঁড়িয়ে।

-আপনি!

-জ্বিহ আমি, কেনো আশা করেননি?

-না মানে,হঠাৎ এইখানে?

-এই রাস্তা দিয়েই ফিরছিলাম। রাস্তায় তোমাকে একা দাঁড়িয়ে থাকতে দেখেই আসলাম। চলো ড্রপ করে দেই।

ধ্রুবের প্রশ্নের খানিক ভ্যাবাচেকা খেয়ে, শিমু বললো,

-পালক তো আমায় এখানে অপেক্ষা করতে বললো। ও আসলে ওর সাথেই যাবো।

-তাহলে আমার সাথে যাবে না বলছো

-আসলে..
পুরোটা বলার আগেই ফোন বেজে ওঠে শিমুর। ফোন ধরে কানে নিতেই ওপাশ থেকে কিছু একটা শুনে আচ্ছা বলে ফোন রেখে দিলো।

-অ্যানি প্রবলেম?

ধ্রুবের প্রশ্নে মাথা নাড়িয়ে শিমু বললো

-পালক ফোন করেছিলো। ওর নাকি আরও সময় লাগবে আসতে, আমায় বাড়ি ফিরে যেতে বললো।

-এবার নিশ্চয় আমার সাথে ফিরতে আপত্তি নেই?

ধ্রুবের কথায় হালকা হেসেই মাথা নাড়িয়ে সম্মতি জানালো শিমু। গাড়িতে উঠে বসতেই স্টার্ট করে এগিয়ে নিলো ধ্রুব।
ধ্রুবের গাড়িটা চক্ষুর আড়ালে যেতেই আড়াল থেকে বেরিয়ে আসলো পালক।
তখন এদিকে আসার পথেই ধ্রুবকে শিমুর সাথে দেখে দাঁড়িয়ে গেছিলো। বেশ কিছুদিন ধরেই এদের কথপোকথন বেশ খেয়াল করছে পালক। এদের লাজুক লাজুক চাহনির ভাষা বুঝতে খুব অসুবিধে হয়নি তার। শিমুকে সে হাড়ে হাড়ে চেনে, ওর ভেতরেও যে অজানা অনুভূতির জন্ম হয়েছে তা ওকে হাবভাবেই স্পষ্ট। ধ্রুবকে শিমুর না বলার সময় পালক ইচ্ছে করেই ফোন করে মিথ্যা টা বলেছে যাতে দুটিতে একসাথে থাকতে পারে। ধ্রুবকে শিমুর পাশে কিন্তু মন্দ লাগে নাহ!

এসব ভাবতে ভাবতেই একটা রিকশা ডেকে উঠে বসলো। মনটা কেমন বিষন্নতায় ছেয়ে আছে,, সেই যে লোকটা তাকে কাল বাড়িতে আনলো তার পর আর তার সুরত খানা দেখবার সৌভাগ্য মেলেনি। অফিসওয়ালা তার অফিস নিয়েই ব্যস্ত। লোকটা আসলেই সিরিয়াস চৌধুরী। এই যে একটা দিন পুরোটা পার হয়ে গেলো পালক কতটা মিস করেছে তাকে সে কি জানে নাহ? ভীষণ খ’বিস ভীষণ। হুটহাট কাছে এসে, পাগলামি করে তো অভ্যাস করে দিয়েছে পালকের। এখনতো মেঘালয় বিরক্ত না করলে ভাল্লাগে নাহ তার।

বাড়ি এসে ফ্রেশ হয়ে বসে আছে বারান্দায়, হাতে সেই উপহারের পাঠানো পুতুলটা। শিমু এখনো ফেরেনি। সে কার সাথে আছে সে ব্যাপার নিয়ে সে মোটেও চিন্তিত নয়, বরং খুশিই।

তার তো মন খারাপ অন্য কিছু নিয়ে। মেঘালয় নামক অনুভূতিটা তাকে ভীষণ পীড়া দিচ্ছে, লোকটা একটা বার তার সাথে দেখাও করলোনা। আনমনে উপরের ব্যালকনির দিকে তাকিয়ে আছে পালক। একটা বার ও কি আসবে না, এতটা সময় না দেখে আছে, কিছুতেই শান্তি লাগছে না পালকের।
বেশ দশ মিনিট অতিবাহিত হওয়ার পর পালকের অপেক্ষার অবসান ঘটিয়ে আগমন ঘটলো মেঘের। কালো রঙের ট্রাউজারের ওপর সবুজ রঙের টি-শার্ট পরা, ভেজা চুলগুলো তোয়ালের সাহায্যে মুছতে মুছতে বারান্দায় এসে দাঁড়ালো।
মেঘকে দেখতেই পালকের ভেতরটায় শান্তি জুড়ে গেলো, যেনো দম বন্ধ করা পরিস্থিতি থেকে মুক্তি পেলো।

মেঘালয়ের চোখটা সামান্য দূরেই ব্যালকনিতে গেলেই দেখলো, পালক দোলনায় বসা অবস্থায় তার দিকেই চেয়ে আছে। মাথা মুছা থামিয়ে তোয়ালে টা ডিভানে ফেলে দু হাতে রেলিঙে ভর দিয়ে দাঁড়ালো পালকের দিকে তাকিয়ে, ঠোঁট বাকিয়ে সামান্য হেসে, ভ্রু উচিয়ে ইশারা করলো।
হুট করেই পালকের ভীষণ অভিমান হলো। এতক্ষণে লোকটা একবারও তার সামনে আসলো নাহ। কাল তো খুব করে বলছিলো তাকে ছাড়া থাকতে পারবে নাহ, সব মিথ্যা, খুব খারাপ,খুব খারাপ লোকটা।
থপ করে হাতের পুতুল টা ফেলে ঘরের ভেতরে চলে গেলো।
মেঘালয় ভ্রুকুটি করে তাকালো। কি হলো! এভাবে চলে গেলো কেনো।

পালক এসে উপুড় হয়ে বিছানায় শুয়ে পরলো। থাকবে না সে লোকটার সামনে। ভীষণ নি’ষ্ঠুর লোক। কাল থেকে আজ পর্যন্ত একটা বার খোঁজ করলো নাহ,কিসের এতো ব্যস্ততা যে একটু দেখা পর্যন্ত যাইনা তাকে। পালকের ভাবনার মাঝেই ফোনটা বেজে উঠলো। হাতে নিয়ে দেখে “সিরিয়াস চৌধুরী” নামটা স্ক্রিনে জ্বলজ্বল করছে। সারাদিন গুম হয়ে থেকে এখন ন্যাকা,হুহ! ধরবো নাহ। বলেই খট করে কেটে দিলো পালক।
সেকেন্ডের ভেতরেই আবারও বেজে উঠলো, কি একটা ভেবে ফোনটা রিসিভ করে কানে ধরলে, চিরচেনা গম্ভীর সুরে বললো

-বারান্দায় আসো

এতোক্ষণ কই ছিলো, তখন মনে হয়নি?এখন বারান্দায় না বসলে তো তাও মনে হতো নাহ৷ মুখ বাকিয়ে পালক চরচরে কণ্ঠে উত্তর দিলো

-পারবোনা।

ফোস করে একটা শ্বাস ছাড়ার শব্দ হলো। আবারও বললো

-বারান্দায় আসতে বলেছি

সাথে সাথেই পালক আবারও বললো
-পারবো নাহ

-আই ইউল আস্ক ইউ ফর দ্যা লাস্ট টাইম, বারান্দায় আসো।

-পারবো নাহ।

বলতেই ওপাশ থেকে আর কোনো শব্দ শোনা গেলো নাহ, কান থেকে নামিয়ে দেখি লাইন কেটে দিয়েছে, জানতাম লোকটা একটা খ’বিস ছাড়া কিছুই নাহ,কেনো একটু ভালো করে বললে কি হতো, নাহ সবসময়ই উনার ধ’মকা ধ’মকি , হুহ আমার কি আমিও যাবো নাহ।
বলে আবারও ধপ করে উপুড় হয়ে বিছানায় শুয়ে পরলো পালক।

যাবো না কিছুতেই,লোকটা খুব খারাপ,কাল থেকে আমার একটুও খোঁজ নেইনি,একবার সামনেও আসেনি,উনি কি বোঝেন না আমি কতটা মিস করছিলাম উনাকে,এখন আমি কেনো যাবো,কিছুতেই নাহ। ধ’মক দিলেও নাহ।।উনার ধ’মকে আমি মোটেও ভয় পাইনা

“সত্যিই ভয় পাওনা?”

পাশ থেকে কারো গলা শুনে বড় সরো ধাক্কা লাগলো,কিন্ত দরজা তো লাগানো,কে আসবে,ধ্যাত আমার মনের ভুল। ওভাবেই উপুড় হয়েই শুয়ে রইলাম।। বেশ কিছুক্ষণ নিঃশব্দে থাকার পর হঠাৎ পাশে কারো উপস্তিতি অনুভব করে মাথা তুলে তাকাতেই চোখ দু’টো ছানাবড়া হয়ে গেলো, ছিটকে দূরে সরে গেলাম। পরপর দু তিনবার পলক ঝাপটা দিলাম, স্বপ্ন দেখছি না তো? নিজের হাতেই নিজে চিমটি কাটলাম,নাহ ব্যাথাও তো লাগছে তার মানে স্বপ্ন দেখছি নাহ, তাহলে?

“বললে তো ভয় পাও না,তাহকে ফেস টা এমন কেনো করে রেখেছো যেনো আমি খে’য়েই ফেলবো তোমাকে”

পালকের এমন আতংকিত চেহারা দেখে সামান্য ভ্রু কুচকালো মেঘ, আবারও দায়সারা ভাবে মাথার নিচে দু হাত রেখে আরাম করে সটান হয়ে শুয়ে রইলো।

আমি প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করতেও অপারগ, হতভম্ব দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছি, স্পষ্ট মনে আছে দরজা টা ভেতর থেকে লক করেছিলাম। ঢুকলো কি করে লোকটা।
পালকের ভাবনার মাঝেই মেঘ পালকের দিকে তাকালো, শুকনো ঢক গিললো পালক,লোকটা এখানে কি করে আসলো আপাতত না জানলেও চলবে,কিন্তু এখন তার পালানো উচিত, ধীরে ধীরে দু কদম পিছালো, পা বাড়িয়ে যে দৌড় দিতে নিবে তখনি
.
.
.
চলবে ইনশাআল্লাহ