তুমি আসবে বলে পর্ব-৪৫

0
452

#তুমি_আসবে_বলে
#হুমাইরা_হাসান
পর্ব- ৪৫

সময়ের স্রোতে কেটে গেছে কয়েক মাস,,পালটেছে সময়,কাল,ঋতু। পালটেছে মানুষে মানুষে সম্পর্ক। পালকের চৌধুরী বাড়িতে বউ হয়ে আসার পূর্ণ হয়েছে ছয়টা মাস। আরাব আর আরশির সম্পর্কের ধাপ প্রেমিক-প্রেমিকার গন্ডি পেরিয়ে বাগদত্তার ধাপে গেছে। মেঘপালকের বিয়ের মাস খানেকের মাথায় ই আরাব নিজে আরশির বাবা মায়ের কাছে তাদের সম্পর্কের ব্যাপারে বলে। পরিবার পরিজন, সময় আর ছেলেমেয়েদের ভালো থাকার দিক বিবেচনা করে তারাও অমত করেনি। আরশি আর আরাবের আংটি বদল করে রেখেছে, আরাবের বাবা মা দেশে ফিরলেই বিয়ে হবে। বাকি রইলো রাফাত নিবিড় আদ্রিশ সহ সকলে,তাদের ও পড়াশোনার মেয়াদ ও অনার্স দ্বিতীয় বর্ষ পার হয়ে তৃতীয়তে উত্তীর্ণ হয়েছে।

-আফু,কোথায় যাচ্ছিস মা?

-একটু নিচে যাচ্ছি মামনী। শিমু হঠাৎ ফোন দিয়ে বললো এক্ষুনি যেতে

-এক্ষুণি? এই সাত সকালে আবার কি হলো?

-আমিও যানি নাহ,দেখি গিয়ে কি হয়েছে

বলেই সিড়ি বেয়ে নিচে নেমে এলো, আগের ঘরটাই যেখানে শিমু আর পালক থাকতো একসময়, এখন শিমু একা থাকলেও পালক মাঝে মধ্যেই এসে থাকে ওর সাথে।
কলিং বেল টা বাজানোর সাথে সাথেই দরজাটা খুলে গেলো, যেনো খোলার অপেক্ষাতেই ছিলো। দরজা খুলতেই শিমুর মুখ খানা সামনে আসলো।
চোখে মুখে দুশ্চিন্তা আর অস্থিরতার ছাপ,দরজাটা খুলেই করুন দৃষ্টিতে চেয়ে আছে।

-কি হয়েছে বল তো,সাত সকালে এমন জরুরি তলবের কারণ কি,আর মুখটা এমন বাংলার পঁচিশ কেনো করে রেখেছিস আজব?

তবুও কোনো হেলদোল নেই, সটান দরজায় দাঁড়িয়ে ক্রমাগত আঙুলের সাথে ওড়না পেচিয়ে যাচ্ছে, আর বারবার বাম পাশের দিকে তাকাচ্ছে।

-আরে হইছে টা কি, এভাবে সং এর মতো টান হয়ে দাঁড়িয়ে আছিস কেনো। দেখি সর তোহ

বলেই শিমুকে ধাক্কা দিয়ে সরিয়ে ঘরে ঢুকে বা দিকে তাকাতেই শিমুকে কিছু বলতে গিয়েও থেমে গেলাম।

-ধ্রুব ভাই আপনি?

সোফার উপর দুই পা তুলে আরামে কফির কাপে চুমুক দিচ্ছে আর টিভি দেখছে ধ্রুব ভাই। আমার ডাকেই পাশ ফিরে গাল প্রসারিত করে হেসে বললো

-পালক,,এসো এসো। বসো। ভালোই হয়েছে তুমি এসেছো অনেকদিন গল্প হয়না তোমার সাথে।

হতভম্ব দৃষ্টিতে তাকিয়ে এগিয়ে গিয়ে বসলাম ধ্রুব ভাইয়ের পাশে।

-পালকের জন্যেও এক কাপ কফি আনো যাও

ধ্রুবের কথায় শিমু চোখ মুখ আধার করে গটগট করে রান্নাঘরের দিকে চলে গেলো। আমি এখনো বোকা দৃষ্টিতে চেয়ে আছি, সবটা মাথার উপর দিয়েই যাচ্ছে। সাত সকালে ধ্রুব ভাই এখানে কি করছে, আর শিমুই বা মুখটা বোম মারা অবস্থায় কেনো করে রেখেছে। বেশ কিছুক্ষণ ভেবেও কোনো সুরাহা মিলাতে না পেরে ধ্রুব ভাইয়ের দিকে ফিরে বললাম

-কাহিনি টা কি ভাই, আপনিই বা এতো সকালে এখানে কি করছেন আর হেতিই বা মুখটা আমাবস্যা কেনো করে রেখেছে?

ধ্রুব ভাই আনমনেই টিভিতে খেলা দেখে যাচ্ছিলো। আমার কথা শুনে রিমোট দিয়ে টিভি বন্ধ করে কফির কাপে শেষ চুমুক দিয়ে বেশ আটসাট বেধে বসলেন,উনার এমন প্রস্তুতি নেওয়া দেখে আমি তিন চার দফায় অবাক হয়ে রইলাম।ধ্রুব ভাইয়ের মতো শান্ত স্বভাবের মানুষের মধ্যে এমন অস্থিরতা বেশ সুবিধার ঠেকছে নাহ

-কি ব্যপার বলুন তোহ ভাই, আপনাদের ভাব সাব আমার একদম ভালো লাগছে না, ঝেরে কাশুন তো একেবারে

-আর কি ঝেরে কাশবো বোন, তোমার এই বান্ধবীর পাল্লায় পরে আমার এজীবনে আর বিয়ে করা হবে নাহ মনে হয়।

ভাইয়ের কথা শুনে কিছুক্ষণ থ হয়ে রইলাম। ধ্রুব আর শিমুর সম্পর্ক টা সরাসরি প্রকাশিত না হলেও ওদের হাবভাব দেখে আমাদের আর আলাদা করে বলতে হয়নি কিছু,, তা বলে এমন লাগামহীন কথা বার্তার দলে যে ধ্রুব ভাই ও নাম লিখিয়েছেন তা আমার জানা ছিলো নাহ।

-মানেহ,কি বলছেন? বিয়ে কেনো হবে নাহ

-কি করে হবে বলো তোহ। মেঘ আমার বন্ধু হয়ে বিয়ে করে ছয়মাস পার করে দিলো, আরাব আমার ছোট ভাই হয়ে আংটি বদল করে ফেললো। আর আমি কি না সিনিয়র সিটিজেনের খাতায় নাম লিখাতে যাচ্ছি তবুও তোমার বান্ধবীর কোনো হেলদোল নেই।

তারপর এক মুহূর্ত দম নিয়ে বেশ অসহায় মুখ করে বললেন

-তোমার বান্ধবীই তো এখনো ঝেরে কাশলো নাহ।
এই যে দিন দিন বয়স বাড়ছে৷শেষে বুড়ো হয়ে গেলে ছেলেমেয়েদের সাথে ভা’ঙা হাড় নিয়ে ফুটবল খেলবো কি করে বলতো

পেছন থেকে খকখক কাশির শব্দে ঘুরে তাকিয়ে দেখি শিমু কফি হাতে দাঁড়িয়ে আছে, আমি মুখ টিপে হাসছি। আমি জানি, বেশ জানি এসবের নাটের গুরু হলো ওই চৌধুরীর বাচ্চা। এই ধরনের হিটলারি বুদ্ধি সব ওই ব্যবসায়ীর মাথা থেকেই বেরোই। এই কারণেই আজ ধ্রুব ভাই আটঘাট বেঁধে নেমেছেন

-শিমু,এদিক আই

শিমু আগের মতোই মুখটা পাঁচের মতো করে রেখে এগিয়ে এলো। আমার পাশে বসতেই বললাম

-কি হয়েছে বল তোহ, ধ্রুব ভাই কি বলছে এসব

বেশ বিরক্তি নিয়ে নাক মুখ কুচকে শিমু বললো

-এই লোক পাগল হয়ে গেছে, গত এক সপ্তাহ ধরে বিয়ে বিয়ে করে মাথা টা খারাপ করে দিয়েছে আমার, কাল রাতে ফোন বন্ধ করে রেখেছি বলে আজ সাত সকালে এসে হাজির হয়েছে, বিয়ে না করা অবদি নাকি এখান থেকে যাবে নাহ। এসে থেকে এটা দাও ওটা দাও বলে আমাকে জ্বা’লিয়ে মা’রছে তুই একটা কিছু কর না তোহ আমি পাগল হয়ে যাবো

-তুমি একদম চুপ থাকো, পালক তুমি কিছু করো বোন নাহ তো এই যে বসলাম আমি,এক চুল নড়ছি না বউ ছাড়া

-খাল কে’টে কুমির ডাকছিস তুই? ও দেবে তোকে সলিউশন, ও তো নিজেও স্বামী ছেড়ে বান্ধবীর কাছে এসে শুয়ে থাকে

চিরচেনা ভরাট কণ্ঠস্বর শুনে ঘাড় না ঘুরিয়েই বুঝতে পেরেছি কথাটি কে বলেছে।
ধ্রুব ভাই মেঘালয়কে দেখে উৎফুল্ল হয়ে বললো

-মেঘ, এতক্ষণে তোর ঘুম ভাঙলো, নিজে তো বিয়ে করে দিব্যি আছিস, আমি কি হাত পা গুটিয়ে বসে থাকবো?

-তাহলে হাত পা ছড়িয়ে শুয়ে থাক

বরাবরের মতোই দায়সারা উত্তর দিয়ে এসে বসলো আমার সামনে। ধ্রুব ভাই মেঘের এমন অযাচিত কথায় কপট রাগ দেখিয়ে বললেন

-আমি এদিক চিন্তায় মরছি আর তুই ইয়ারকি করছিস, সবসময় তোর এমন গাছারা ভাব দেখানো লাগে

-তো আর কি করবো। তুই যে বিয়ে করার জন্য এতো পাগল হয়ে যাবি আমি তো ভাবতেও পারিনি

-আচ্ছা? এমন পাগল ছয়মাস আগে তুই ও হয়েছিলি, আমি নিজে আংকেল কে তোর বিয়ের কথা বলেছিলাম। আর এবার আমার বেলায় তুই সাহায্যের প্রতিদান না দিয়ে উলটো গা বাচিয়ে বেরাচ্ছিস

-হেল্প? তুই? তুই আরও আমারে ফাঁ’সিয়ে দিয়েছিলি আব্বুর সামনে।

-আমি কখন ফাঁ’সিয়ে দিলাম

-অফ কোর্স, তুই ই তো…

-চুপপ! দুইজন ই চুপ। কই একটা সিদ্ধান্তে আসবে তা না দুজন মেয়েদের মতো ঝগড়া শুরু করেছে।
ধ’মক দিয়ে উনাদের থামিয়ে মেঘালয়ের দিকে ফিরে আবারও বললাম

-আর আপনি এখানে কেনো এসেছেন হ্যাঁ? ঝগড়া করতে? দিন দিন আল্ট্রা লেভেলের ঝগড়ুটে হচ্ছেন আপনি। সারাদিন তো আমার সাথে ঝগড়া করবেন ই এখানেও শুরু করেছেন

-নূর, তুমি আমায় এভাবে বলছো। সকাল বেলা ঘুম থেকে উঠে বউকে চোখের সামনে না দেখলে আমার একদম ভাল্লাগে নাহ, তা জেনেও তুমি চলে আসলে, আবার এখন আমাকেই বকছো!

-এহহ,ন্যাকা! বিয়ে করেও সাধ মেটেনি বউয়ের আঁচল ধরে ঘুরে বেড়াস আবার আমাকে বলছিস আমি বিয়ের জন্য পাগল হয়েছি

-অবশ্যই তাই। আর দশটা না পাঁচটা না একটা মাত্র বউ আমার, তার আঁচল ধরবো না তো কি তোর প্যান্ট ধরে ঘুরবো!

-এই তুই যা তো,তুই আরও ঝামেলা বাড়াচ্ছিস বের হ

-বউ ছাড়া এক চুল নড়ছি না আমি

বলেই পায়ের উপর পা তুলে আরও আরাম করে বসলো মেঘ। আমি আর শিমু টু শব্দ করার ও সুযোগ পাচ্ছি নাহ দুজনের ঝগড়ার মাঝে। এই লোকটা আমায় কোনদিন পাগল করে দেবে, যতক্ষণ বাড়ি থাকে আমায় এক চুল নড়তে দেবে নাহ। উনার এই নাক কা’টা স্বভাবের জন্য আমায় সবাই খোঁ’চা দেয়,তাও বেহায়া লোকটার কোনো গা নেই।
এবার আমি বেশ গম্ভীর মুখ করে বললাম

-শিমু, তুই কি বাড়িতে ধ্রুব ভাইয়ের ব্যাপার টা জানাতে চাস না?

শিমু বেশ অপ্রস্তুত হয়ে বললো

-ব্যপার টা তেমন নাহ। আমি মানে আমি কি করে বাড়িতে..

-কি করে মানে, যে করে হয় সেভাবে

ধ্রুব ভাইয়ের এমন অস্থিরতা দেখে মেঘালয় ভ্রুকুটি করে বললো

-তোর যখন এতোই পারা তুই ওকে নিয়ে পালিয়ে যেয়ে বিয়ে কর

-আইডিয়া টা খারাপ না,আমি এটাও ভেবেছিলাম। কিন্তু পালিয়ে সেই এখানেই তো আসতে হবে তাই আমি নিজেই চলে এসেছি।

ব্যস আবারও শুরু হলো মেঘ আর ধ্রুবের তর্ক। এ দুইজন দিন দিন বড় হচ্ছে নাকি ছোট আমি আদও বুঝতে পারিনাহ। আরও বেশ কিছুক্ষণ কথা বললাম চার জনে। সব শেষে ঠিক হলো কাল মেঘালয় নিজে ধ্রুবের সাথে যাবেন শিমুর মায়ের কাছে।
শিমুর জন্মের কয়েক মাস পরেই ওর বাবা মারা যায়, তারপর থেকেই ও নিজের নানাবাড়িতে মানুষ, ওর নানাবাড়ি আর আমার বাড়ি এক ই শহরে। পরিবার বলতে নিজের মা মামা মামি আর বয়স্ক নানা। তারা ধ্রুব ভাইকে অপছন্দ করবে বলে মনে হয়না। অপছন্দের কারণ ই নেই। গত কয়েক মাস ধরেই শিমুর আম্মু বিয়ের জন্য চাপ দিচ্ছিলো,এক এক সময় এক এক ছেলের সিভি পাঠিয়ে। এই জন্যেই ধ্রুব ভাইয়ের উৎকণ্ঠা আরও বেড়েছে, মোট কথা সে আর দেরি করতে চাইনাহ।

ধ্রুব ভাইকে কোনো মতে বুঝিয়ে তার ভার্সিটির উদ্দেশ্যে পাঠিয়ে আমি আর মেঘ ও উপরে চলে আসলাম। বেলা আটটা বেজে গেছে। ঘরে ঢুকেই আলমারি থেকে তোয়ালে টা বের করে উনার হাতে দিয়ে বললাম

-আপনি ফ্রেশ হয়ে আসুন আমি ব্রেকফাস্ট রেডি করছি।

বলেই দরজার দিকে আসতে নিলে উনি পেছন থেকে টেনে নিয়ে জড়িয়ে ধরলেন

-কি করছেন কি। দেরি হয়ে যাবে তো আপনার

-উহু,তোমায় আদর না করলে দেরি হয়ে যাবে

বলেই বা গালের সাথে গাল লাগিয়ে দাড়ির ঘষা দিয়ে দিলেন

-উফ ছাড়ুন তো কেও দেখলে কি ভাববে

-কেও দেখবে নাহ,আর দেখলে দেখুক আমার বউকে আমি আদর করবো তাতে লোকের কি

উনার সাথে কথায় আমি পারবো না আমি জানি। তাই চুপচাপ দাড়িয়ে রইলাম। মেঘালয় আগের মতোই ঘাড়ে মুখ গুজে দাঁড়িয়ে আছে। গলার মাঝে বেশ সময় নিয়ে গভীর ভাবে একটা চুমু দিয়ে ভারি হওয়া গলায় বললেন

-নূর!

কাঁপা কাঁপা কণ্ঠে অস্ফুটস্বরে জবাব দিয়ে বললাম

-হু

-মনে আছে? এইতো সেদিন তোমায় লাল টূকটুকে বউ করে আনলাম। রুচিতা আপু হাত ধরে তোমায় আমার ঘরে রেখে গেলো। আর আজ ঘরটাতে তাকিয়ে দেখো আশে পাশে সারা ঘর জুড়েই তুমি, তোমার অস্তিত্ব, তোমার ঘ্রাণে ভরা। মনে আছে? এইতো সেদিন জোৎস্না ভরা রাতটাই পেছন থেকে জড়িয়ে ধরেছিলাম বলে লজ্জায় মুখ লুকিয়েছিলে এই বুকটাতে,আর আজ দেখো এই বুকে শুধু তুমি,তোমার নাম,তোমার ঘ্রাণ রন্ধ্রে রন্ধ্রে মিশে আছে।
এইতো সেদিন তাইনাহ?

সত্যিই তো,এইতো সেদিন মেঘালয় নামক মানুষটা আমার জীবনে ঝড়ের মতো আসলো। আর আজ আমার সারা জীবন জুড়ে শুধু এই একটা মানুষের ই বসবাস। আনমনেই দু ফোটা অশ্রুবিন্দু ঝরে পরলো। নাহ, এ কান্না দুঃখের নয়। বরং সুখের! চরম সুখ আর প্রাপ্তির। এতো সুখ! এতো ভালোবাসা রেখেছিলো সৃষ্টিকর্তা আমার ভাগ্যে। এই নীলাভ চোখের লোকটার মুখের দিকে তাকালে তাতে আমার সারা দুনিয়াটা এস জড়ো হয়।
পেছন ঘরে দু’হাতে ঝাপটে ধরে বুকের মাঝে মিশে গেলাম। আমার সুখের অশ্রুবিন্দুতে সিক্ত হলো মেঘের প্রসস্থ বুকটা। আমায় পরম আবেশে আগলে নিয়ে বললো

-বারবার চাই, হাজার বার চাই, সারাজীবন চাই তোমায়। এই বুকটাই তোমায় আমৃত্যু জড়িয়ে রাখতে চাই নূর। তোমার নূরে সারাজীবন জ্ব’লতে চাই।
ভালোবাসি!

বুকের মাঝে অধরযুগল ছুয়ে বললাম
-ভালোবাসি

||

সেদিন আর ভার্সিটি যায়নি, ইদানিং শরীর টা খুব দুর্বল লাগে, একটুতেই হাফিয়ে যায়। খাওয়া দাওয়াতেও রুচি আসে নাহ। আজও দুপুরে খেতে বসে কেমন গা গুলিয়ে আসলো। আমি খেতে পারছিনা দেখে মামনী কত কি রান্না করলেন আমার পছন্দের তবুও তা গলা দিয়ে নামলো নাহ। দুপুরের দিক থেকেই শরীর টা বেশি খারাপ। আমার অসুস্থতার কথা শুনে আরশি, নিবিড় আর আদ্রিশ এসেছে। রাফাত তো সকাল থেকে আমার সাথেই। বিকেলের দিকটাই ছয়জন ঘরেই বসে আড্ডা দিচ্ছি

-আফু, কি অবস্থা করেছিস নিজের, খাওয়া দাওয়া তো সব লাটে তুলেছিস। এভাবে চললে তো কিছুদিন পর বাতাসের ধা’ক্কায় উড়ে যাবি

আদ্রিশের কথা শুনে রাফাত বললো

-একটুও খেয়াল রাখিস নাহ ইদানীং নিজের। তুই অসুস্থ হলে ভাল্লাগে না ভাই। গত এক সপ্তাহে আমায় নুডুলস ও রান্না করে খাওয়াস নি

-এটা কিন্তু রাফাইত্তা ভুল বলেনি,এমন ম’রা ম’রা চেহারায় মোটেও ভাল্লাগেনাহ তোকে।

আরশির কথা শেষ হতেই নিবিড় বললো
-তার চেয়ে বরং চল তোদের গ্রামের বাড়ি থেকে ঘুরে আসি সবাই৷ ঘুরাঘুরি করলে তোর শরীর টাও ভালো লাগবে আর মন ও চাঙ্গা হয়ে যাবে

-আফুর মন চাঙ্গা হবে নাকি তোর নিবিড়

আরশির খোঁচা দেওয়া কথায় শিমু ফিক করে হেসে দিলো। পাশ থেকে আদ্রিশ সুর টেনে বললো

-হ্যাঁ নিবিড়ের তো আবার ইদানীং সারা সারা মেহেকতা হে,বেহেকতা হে। ওপস থুক্কু..যারা যারা মেহেকতা হে,বেহেকতা হে

পুরোটা শেষ করার আগেই নিবিড় ঠা’স করে বসিয়ে দিলো একটা

-বেশি পকপক করিস তোরা সবগুলো। আর এই যে আরাবখোর, তোর ফটরফটর কমা নাহ তো তোকে চাঙ্গে তুইল্লা আ’ছাড় দিয়া বিয়ার শখ মিটাই দিম

আরশি মুখ কালো করতেই পাশ থেকে রাফাত বললো
-বিয়ে শুনে মনে পরলো আমাগো বলদ রাণীও নাকি বিয়াইবো। ক্যা রে বলদি? কিছু কস না ক্যা? নাকি বর পাওয়ার পি’নিকে আগেই লাটে উঠছোস।

বলেই এক খোঁচা মেরে দিলো শিমুকে।

-আউচ্চ,,উফ এভাবে খোঁচা’খুঁচি করিস ক্যান তোরা, আর এসব কি ভাষা। আমি কি বলবো,কিসের বিয়ে

-ওহ আচ্ছা? কিসের বিয়ে? ভালোই, তোগোই তো দিন রে, ছুটিয়ে পিরিতি করতাছোস এক একটা আবার জিগাইলেই কস ‘কিসের কি’
ভালোই, আজ সিঙ্গেল বলে

-দ্যাখ রাফাইত্তা, তুই যে আদ্রিইশার বইনের সাথে ইদানীং বেশি ভাই গিরি দেখাই বেরাইতাসোস তা যে আমরা দেখছি না তা ভুলেও ভাবিস নাহ

-কিসের ভাই গিরি, তোর বি’শ্রি মুখ দিয়ে বি’শ্রি কথা বলা বন্ধ কর ছেমড়ি

-ওহ আচ্ছা আমি বললেই বি’শ্রি? আর তুই যে আমিশার কলেজের সামনে বাইক নিয়ে দাঁড়িয়ে থাকিস,ওরে ফুসকা খাওয়াইতে নিয়ে যাস তার বেলায়। আমাগো তো কানাকড়ি ও খাওয়াইস নাহ, একদিন বাইকে তুললে তারও ভাড়া নিস

আরশির কথার পৃষ্ঠে আদ্রিশ রাফাতের পিঠে দুম করে একটা বসিয়ে বললো

-হ্যাঁ রে রাফাইত্তা, তোর কাছে আমি তিনশো টাকা পাই, তুই সেইডা না দিয়া আমারই বইন রে খাওয়াই বেরাইতাসোস, তোর কলিজা ডায় কতো বড়।

-আব্বে থাম৷ আমারে কিছু কওয়ার আগে নিজের টা ভাব। আমারে দিয়া যে রুচিতা আপুর ননদের নাম্বার টা কাটিং করলি সে বেলায়

ওরা নিজেদের ভেতরই গ্যাঞ্জাম করে যাচ্ছে, আমি কোনো রকম কথা ছাড়া চুপ করে আছি, শরীর টা আবারও খারাপ করছে। গা গুলিয়ে আসছে৷ নিয়ন্ত্রণের বাইরে যেতেই বিছানা ছেড়ে দৌড়ে গেলাম ওয়াসরুমে।

ঝিঁঝি পোকার ডাকে কানের ভেতরটা ধুম ধরে আসছে, মাথা ঘুরা টা কমলেও পুরোপুরি ঠিক হয়নি। বিকেলে ওদের গল্পের মাঝেই হঠাৎ শরীর খারাপ করতেই দৌড়ে ওয়াসরুমে গিয়ে বমি করে ভাসিয়েছি। মামনী অস্থির হয়ে উঠেছিলো আমার ওই অবস্থা দেখে, আমায় জোর করেই সকলে ডাক্তারের কাছে নিতে চেয়েছিলো, আমিই দেয়নি। আমার জিদের কাছে হার মেনেই সবগুলো বাধ্য হয়েছে আমায় বাড়ি রাখতে। আমার মাথায় তেল দিয়ে খাবার খাইয়ে ওষুধ খাইয়ে দিয়েছেন মামনী। শিমু আর আরশি মিলে পায়ে মালিশ করে দিয়েছে, পা টাও কেমন টনটনে হয়ে আছে।

সারা সন্ধ্যা থেকে রাতের দশটার পরে সবাই ফিরেছে আমার শরীরের অবস্থা ভালো দেখে। মামনী এতক্ষণ ছিলো, বাবা আসতেই উনিও নিচে গেলো। টিমটিমে আলোয় ঘড়ির দিকে তাকিয়ে দেখি রাত প্রায় এগারোটা। লোকটা এখানো ফিরলো নাহ? অন্য দিন তো নয়টার পরেই চলে আসে। এদিক ওদিক হাতরে ফোনটাও হাতের কাছে পেলাম নাহ। শরীরের দূর্বলতার কাছে হার মেনে বিছানায় ই পরে রইলাম
বেশ অনেকক্ষণ পর পেছন থেকে দুটো হাত পেটের মধ্যে দিয়ে জড়িয়ে ধরে কানের পেছনে মুখ এনে গাঢ় চুম্বন একে দিলো। ধীর কণ্ঠে জিগাসা করলাম

-এতো দেরি হলো কেনো আপনার?

উত্তরে লোকটা আরও জোরে ঝাপটে ধরলো। অসুস্থ শরীরে এভাবে চেপে ধরায় দম বন্ধ হয়ে আসছে,তবুও চুপ করেই রইলাম। মেঘ ঘনঘন নিঃশ্বাস ছেড়ে, কিছুক্ষণ পর বললেন

-তোমাকে ছাড়া থাকতে আমার এতটুকুও ইচ্ছে করছে নাহ নূর।

এবার নিজেকে ছাড়িয়ে পেছনে ঘুরলাম। সারা মুখে ক্লান্তির ছাপ স্পষ্ট। মৃদু সবুজ আলোতেও কপালে বিন্দু বিন্দু ঘামের ফোটা দেখা যাচ্ছে। ওড়নার আঁচল টা তুলে পরম যত্নে মুছে দিলাম আমার স্বামী নামক অত্যাধিক ভালোবাসার মানুষটার কপালের ঘাম। মলিন হওয়া মুখটাতে একহাত গালে রেখে জিজ্ঞাসা করলাম

-কি হয়েছে বলুন তো আমায়।

ফোস করে একটা নিঃশ্বাস ছেড়ে মাথার স্থান পরিবর্তন করে আমার বুকের মাঝে রাখলেন। ছোট বাচ্চাদের মতো দুহাতে জড়িয়ে বুকের মাঝে মুখ গুঁজে বললেন

-কানাডা যেতে হবে নূর। বিজনেস টেন্ডারের অনেক বড় একটা প্রজেক্ট, আমি অনেক চেষ্টা করেছিলাম যাতে দেশের বাইরে থাকা এমপ্লয়ি দের মাধ্যমেই কাজটা হয়ে যায়, কিন্তু অপোনেন্ট টিমের সিইও নিজে কাজটা হ্যান্ডেল করবেন। নাহ চাইতেও যেতে হবে আমায়।

আমি এক হাত উনার পিঠে রেখে আরেক হাতে মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে দিতে বললাম

-কবে যেতে হবে

-কালই, কাল সকাল ৮:১০ এ ফ্লাইট।

ভেতরটাতে উষ্ণ বাতাস বয়ে গেলো। নিজের অস্থিরতাকে দমিয়ে আবারও জিজ্ঞাসা করলাম

-কতদিন থাকতে হবে।

-জানিনা নূর, আদও কতদিন লাগবে আমার জানা নেই
.
.
.
চলবে ইনশাআল্লাহ

Humu_♥