তুমি ছুঁয়ে দিলে এ মন পর্ব-২০

0
130

#তুমি_ছুঁয়ে_দিলে_এ_মন

পর্ব ২০

#জান্নাতুল_মাওয়া_লিজা

জহিরের থ্রেট শুনে ত্রিশা নিজের উপর নিয়ন্ত্রণ হারালো। মাটিতে লুটিয়ে পড়লো ওর দুর্বল শরীর। জহির ওকে আড়কোলা করে টেনে টেনে প্রাইভেট কারে ঢুকিয়ে নিলো।
গাড়ি ছুটে চললো রেইনবো টাওয়ারে।
.
.

ঘরোয়া আয়োজনে ত্রিশার বিয়ে হচ্ছে। বঁধু বেশে ত্রিশা সিঁড়ি বেয়ে নিচে নেমে আসছে একা একাই। ত্রিশা ব্যতিত আর কারো নিচে নামা বারন! একান্ত গোপনীয় ভাবে সব কাজ সম্পন্ন হবে। সারা বাড়িতে পাহাড়া বসানো হয়েছে। বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে সি সি ক্যামেরা গুলোও। আত্মীয় স্বজন কাউকে জানানো হয়নি। ত্রিশার গায়ে পা পর্যন্ত লম্বা সাদা গাউন, মাথায় সাদা শিফনের ওড়না, চুলে সাদা স্টোনের সজ্জা, হাতে ব্রাইডাল দস্তানা, গলায় ডায়মন্ড নেকলেস, হাতে শ্বেত স্বর্ণের তৈরি একটা ঘড়ি, মুখে হালকা মেইক আপে যেনো এক সাদা পরীর ন্যায়! পুরোদস্তুর এক আমেরিকান ব্রাইড।

পাত্রের বাবা- মা সহ পাত্র এবং একদল শ্বেতাঙ্গ বসে আছে, সাথে জহির শেখ ও তার আরো কয়েকজন তেলবাজ চামচা। সবাই ইংরেজীতে নিজেদের মধ্যে আলোচনা করছে।

তার মধ্যে একজন পাগলের ন্যায় বকে উঠল,

” পাপাহ, পাপাহ এটা তোমার ব্রাইড, নাকি আমার ব্রাইড? হ্যালো, সুইট ব্রাইড, হ্যালো সুইট ব্রাইড”

বলে লাফাতে শুরু করলো হাফপ্যান্ট পড়া সেই গ্রুম তথা পাত্র!

ত্রিশার হাসি চাপিয়ে রাখতে কষ্ট হচ্ছিলো ত্রিশ বছর বয়সী এ পাগল বাচ্চার কান্ডকীর্তি দেখে।
ত্রিশা নিজের হাতের ঘড়ির দিকে তাকালো।
রাত বারোটা। মুখে হাসি থাকলেও ভেতরে ভেতরে তীব্র উত্তেজনা কাউকেই প্রকাশ করছে না সে। ভেতরটা ফেটে যাচ্ছে যেনো ওর!

ওদিকে ” হ্যালো সুইট ব্রাইড, হ্যালো সুইট ব্রাইড ” বলা আর বন্ধই করছে না সে পাত্র।

তাই তাকে থামাতে ত্রিশা সেই গ্রুমের কাছে এসে আস্তে করে বলে উঠলো, ” হ্যালো কিটি, হ্যালো!”

কিটি অতি খুশি হয়ে ত্রিশার হাত ধরে লাফাতে লাগলো, ” তুমি আমার ব্রাইড, তুমি আমার ব্রাইড, লাভ ইউ সুইট ব্রাইড, লাভ ইউ সুইট ব্রাইড!”

ত্রিশা মৃদু হাসলো। বুক ভরে নি:স্বাস নিয়ে নিজেকে স্বাভাবিক করার চেষ্ঠা করলো।

গোটা অনুষ্ঠান এমনভাবে করা হয়েছে যেনো, এটা বিয়ের অনুষ্ঠান পরে, আর জহির শেখের বিজনেজ প্যাক্ট সাইন করার অনুষ্ঠান আগে।

জহিরের চামচারা সবাই ল্যাপটপ হাতে বসে ছিলো। ত্রিশা টিভিতে দেখেছিলো বিভিন্ন ক্যাসিনোতে মানুষরা যেভাবে স্ক্রিনের দিকে তাকিয়ে থাকে এই ফরেনার গুলো সেভাবেই কিছু একোটা দেখছে এবং করছে।

কিটি তথা সেই পাত্র আবার চেঁচিয়ে উঠলো,

” বলো না পাপাহ, এটা তোমার ব্রাইড নাকি আমার? বলো না বলো না?”

কিটির বাবা আব্রাহাম রাসেল। সে একজন মিক্সড ব্লাডেড। মানে তার বাবা বাঙ্গালী আর মা আমেরিকান। আর কিটির মা হলো সেই জুয়েলার্সের দোকান আন্টি তথা পান্নার চাচাতো বোন। একথা ইন্দু ত্রিশাকে জানিয়েছিলো একবার।

আব্রাহাম তার মাথার বাদামী চুলগুলো সামান্য চুলকে তার ছেলেকে হেসে বলে উঠলো, ” এটা তোমার ব্রাইড, মাই প্রিন্স”

শুনে কিটি নামক সেই জোকার আবার লাফিয়ে উঠলো ব্যাঙের ন্যায়।

কিটির মা বলে উঠলো,
“আজ হাত পা বড্ড বেশি কাঁপছে কিটির!”

শুনে আব্রাহাম চেঁচিয়ে উঠলো,
” মনে হয় আজ মেডিসিন টা দাওনি তুমি ওকে”

কিটির মা তার ব্যাগে মেডিসিন খুঁজা শুরু করলো।
ত্রিশা স্পষ্ট দেখতে পেলো, ঔষধটির নাম, ‘ন্যালট্রেক্সোন’!
সে তার ক্যামিস্ট্রি বইতে পড়েছিলো, এ ঔষধটি তীব্র মাদকাসক্ত ব্যক্তিদের নিরাময় চিকিৎসায় ব্যবহৃত হয়।

বর, কন্যাকে একপাশে রেখে তাদের বাবারা নিজেদের ব্যবসায়ীক চুক্তি ডিল করতে লেগে গেলো। পরে সাইন, তার আগে এক দফা আলোচনা।

ত্রিশাকে পাশেই বসালো। ত্রিশা আবার ঘড়ির দিকে তাকালো। ঘড়ির ডায়ালে হাত বুলিয়ে কিছু একটা সেট করে নিলো সে।

হঠাৎ ই আব্রাহামের হাতে ছোটো একটা আর্মস দেখে ত্রিশার কলিজা কেঁপে উঠলো। তার পরো মুখে হাসি অক্ষূণ্য রাখার নির্দেশ আছে তার উপর । তাই সে হেসেই চললো।

আব্রাহাম, অন্যান্য শ্বেতাঙ্গ ও জহির শেখের গোটা কথোপকথন চলছিলো ইংরেজীতে।
আমেরিকান প্রোনানসিয়েশন তার বোধগম্য না হলেও, জহিরের কথাগুলো ত্রিশা স্পষ্ট বুঝতে পেলো।
” আই এম এগ্রি টু কিপ মাই ডটার মর্টেজ টু গেট দ্যা ডিল…”

আর আব্রাহাম বলে উঠলো, ” আই শ্যাল কিল হার ইফ ইউ ডু সামথিং রং” শুনে জহির মৃদু হাসলো।

হাসিমুখে ত্রিশাও তার কপালে জমা ঘামগুলো মুছতে লাগলো আর ঘড়ি দেখতে লাগলো।
ঘড়ির কাঁটার ডায়ালের মতোও তার হৃদপিন্ড ক্ষণে ক্ষণে প্রকম্পিত হচ্ছে।
রাত সাড়ে বারোটা থেকে পৌঁনে একটা, তারপর ঠিক একটা, একটা এক, একটা দুই, একটা তিন….বাজতেই গোটা বাড়িতে এলার্ম বেজে উঠলো।
একগাদা বুটের ঠকঠক শব্দে রেইনবো টাওয়ারের
সিঁড়িগুলো প্রকম্পিত হলো।

ববিতা চেঁচিয়ে উঠলো,

” জহির খোকা রে, খোকা, গোটা বাড়ি পুলিশ ঘিরে ধরেছে রে!”

দ্রুত একদল পুলিশ খিড়কি দিয়ে প্রবেশ করে জহির, আব্রাহাম সহ আরো বাকি শেতাঙ্গদের ঝটিকা বেগে এরেস্ট করে নিয়ে গেলো। আব্রাহামের হাতের আর্মস টাও তড়িৎ বেগে শ্যুট করে নিচে ফেলে দিলো এক সাদা পোশাকের অফিসার। পুলিশেরা সাথে নিলো কিটি ও তার মা কেও।

ববিতা মূর্ছা গেলো।

ইন্দু ও বিন্দু বিলাপ শুরু করলো। বড্ড ইচ্ছে ছিলো আমেরিকার সিটিজেনশিপ নেবে। লাক্সারিয়াস লাইফ স্পেন্ড করবে। কিন্তু পেলো?… কাঁচকলা!

ড্রয়িং রুমে অবস্থিত বিশাল টিভি মনিটর ছেড়ে দিলো পাভেল আর নয়ন।

কনকচাপা নিচে নেমে এসে মেয়েকে জড়িয়ে ধরলো।

এক মুক্তির আলিঙ্গনে আলিঙ্গনাবদ্ধ হলো মা ও মেয়ে। দুজনেই হাসিমুখে কেঁদে উঠলো।

পাভেল ও নয়ন এসে ওদের টিভির স্ক্রিন দেখতে ঈশারা করলো।

রিপোর্টার লাইভ নিউজ করছে, বাড়ির নিচে দাঁড়িয়ে থেকে,

” গোয়েন্দা বাহিনীর প্রখর নজরদারিতে পুলিশের কাছে ধরা পড়লো এশিয়ান ড্রাগ পাচারকারী আমেরিকান এক চক্র! চক্রের প্রধান আব্রাহাম রাসেল ও তার বাঙ্গালী পার্টনার জহির শেখ পুলিশের কাছে লাল হাতে ধরা পড়েছে। জহির শেখ- তার স্ত্রী কনকচাপার অন্যপক্ষের কণ্যা ত্রিশাকে মর্টেজ রেখে আব্রাহামের ব্যাবসার হিস্যা পাওয়ার ডিল সাইন করা অবস্থায় ধরা পড়েছে।
দ্বাদশ শ্রেণিতে অধ্যয়নরত ত্রিশা ও তার মা কনিকচাপা নিজে পিবি আই এর কাছে এক অভিযোগ দায়ের করে। আর পুলিশের কাছে পুরো ঘটনা বর্ণনা করেছে স্বয়ং জহির শেখের স্ত্রী কনকচাপা, ও জহির শেখের দুই ভগ্নীপতি পাভেল ও নয়ন। পাভেল, নয়নসহ কনকচাপার ব্যাপক অর্থপ্রাপ্তির সম্ভাবনা স্বত্ত্বেও তারা তা নাকচ করে পিবি আই এর কাছে লুকিয়ে অভিযোগ নামা দায়ের করে ও স্বাক্ষী হয়। এ কথা উল্লেখ্য যে, জহির শেখে নামে একাধিক বিবাহ ও নারী কেলেঙ্কারির অভিযোগ আছে। বিধবা কনকচাপাকে সুস্থ স্বামী সংসার প্রাপ্তির আশ্বাস দিয়ে এক কণ্যা সহ বিয়ে করেছিলো জহির শেখ। আর সেদিককার সেই কণ্যা ত্রিশাকে মর্টেজ রেখেই সে তার ব্যাবসা শুরু করতে যাচ্ছিলো। যেনো ব্যাবসার কোথাও কোনো সমস্যা হলে কিলার ও মাদক ডিলার আব্রাহাম ত্রিশাকেই শ্যুট করে তার বদলা নিতে পারে। এভাবেই আব্রাহাম ও জহির গ্রেফতার হওয়ার মাধ্যমে এদেশে সাঙ্গ হলো এক মাদক মাফিয়া ডনের উত্থানের সমাপ্তি। মূলত শুরু হওয়ার আগেই সমাপ্ত! জহিরের ফাঁদে পড়ে কনকচাপা কিভাবে ত্রিশাকে আব্রাহামের ছেলের সাথে বিয়েতে রাজী করিয়েছিলো, তার প্রতিবেদন দেখতে পেতে আমাদের নিউজ চ্যানেলে চোখ রাখুন..”

প্রতিবেদন দেখে কনকচাপা ত্রিশাকে জড়িয়ে আবারো কেঁদে উঠলো।
এমন সময় সেখানে আগমন ঘটলো আহনাফ ও তার বন্ধুদের গোটা একটা টিমের সাথে সেই পিবি আই ( পুলিশ ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশন) এর সিনিয়র অফিসার সেই বন্ধু।
যার কাছেই কমপ্লেইন করে আজ আব্রাহাম ও জহির ধরা পড়েছে।

ত্রিশার বান্ধবি ত্রিনা, স্নিগ্ধা, ঊষা ও রাত্রি ও এ বাড়িতেই ছিলো। ত্রিশাকে সাজাতে এসেছিলো ওরা। ওরাও বাইরে বেরিয়ে এসে ত্রিশাকে জড়িয়ে ধরলো।

জহির ঘুনাক্ষরেও বুঝতে পারেনি যে, ভুলাভালা কনকচাপা, আর পাভেল নয়ন মিলে আহনাফের সাথে মিলিতভাবে এভাবে তাকে ধরিয়ে দিতে পারবে। তার প্রধান উদ্দেশ্য ছিলো ত্রিশাকে বিয়ের নামে বন্ধক রেখে তার ব্যবসায়িক উদ্দ্যেশ্যে হাসিল করা। সে জানতো যে আব্রাহামের ছেলে কিটি পুরোই মানসিক ভারসাম্যহীন হয়েছিলো ড্রাগ নেওয়ার ফলে। সে এটাও জানতো যে, ত্রিশাকে আব্রাহাম তার যেকোনো স্বার্থের ব্যাঘাত ঘটলেই মে’রে ফেলবে, তাই সে ইচ্ছাকৃতভাবে ত্রিশাকেই বন্ধক বা জিম্মি রাখতে চাচ্ছিলো আব্রাহামের নিকট। পাভেল, নয়ন ও কনকচাপা তিনজনই জহিরের কথামতো ত্রিশাকে হ্যারেজ বা অপমানিত ও ভিডিও ভাইরালের ভয় দেখায় একমাত্র জহিরের বিশ্বাস অর্জনের জন্য।

কিন্তু পিবি আই কে রিপোর্ট করার সাহস তাদের দেয় একমাত্র আহনাফ। কারন আহনাফ কলেজের সিসি টিভি ফুটেজে এটা দেখেছিলো যে, জহির কিভাবে ত্রিশাকে দমন পীড়ন করে বিয়ের জন্য রাজী হতে বলছিলো। সাথে এও বুঝতে পারে যে, কনকচাপা এক পা এগিয়েই আছে জহিরের শাস্তির উদ্দ্যেশ্যে শুধু একটা অবলম্বন পেলেই সে পুলিশকে জহিরের নামে রিপোর্ট করে দেবে। এক্ষেত্রে কনকচাপাকে পূর্ণ সহযোগিতা করে আহনাফের সেই পিবি আই বন্ধু বিশাল। কনকচাপাকে দেওয়া বিভিন্ন থ্রেটের অডিও সে বিশাল কে শেয়ার করে, সাথে কলেজে ত্রিশাকে দেওয়া জহিরের থ্রেট,

” এই শোন মেয়ে, আজ যা দেখাইলাম, তা যাস্ট একটা ডেমো। এর পর যা দেখামু তা হইলো আসল। এরপর তোর মায়ের লিংক ভাইরাল হইবো, এখন তুই ক, তুই যাবি নাকি যাবি না, ঐখানে গিয়া তুই হাসিমুখে ঐ প্রতিবন্ধি পোলারেই বিয়া করবি, করবি করবি, বল, নইলে আমি সবাইরে মা’ইরা ফালাইমু, তোরে, তোর মায়েরে আর তোর নয়ন, পাভেল আংকেলরে, হা হা হা!”

আর ত্রিশার বান্ধবীদের হাতে পাঠিয়ে দেওয়া একটা গোপন ক্যামেরা যা ত্রিশার হাতঘড়িতে সেট করা হয়েছিলো তা এক বিরাট এভিডেন্স হিসেবে কাজ করে।

আহনাফ সেখানে আসতেই ত্রিশা দৌড়ে তার গিয়ে নিজেকে নিয়ন্ত্রন করতে অক্ষম হয়ে আহনাফকে জড়িয়ে ধরে। নিজের অজান্তেই বলে উঠে, ” লাভ ইউ ডিয়ার”

(চলবে)