তুমি ছুঁয়ে দিলে এ মন পর্ব-২৩

0
127

#তুমি_ছুঁয়ে_দিলে_এ_মন

পর্ব ২৩

#জান্নাতুল_মাওয়া_লিজা

রাহুল চৌধুরীর বলা কথাগুলো আর আহনাফ ত্রিশার সামনে ব্যক্ত করলো না, ঢোক গিলে যেনো গলধ:করন করলো। ত্রিশার সামনে পরীক্ষা আর এসব বলে চাপ বাড়ানোর কোনো মানে হয় না! আহনাফ চেপে যেতে চাইলো। ক্ষাণিকক্ষণ চুপ থেকে বললো, ” বাড়ির জমির ব্যাপারে কথা বলার জন্য কল দিয়েছিলো রাহুল চাচা”

ত্রিশা উল্টো কোনো প্রশ্ন করলো না, তবে স্পষ্টই বুঝতে পারলো, কিছু একটা নিশ্চয়ই ঘটেছে। নইলে আহনাফ এভাবে মিইয়ে গেলো কেনো? মুহূর্তেই মুখশ্রী পাংশুবর্ণ ধারণ করলো।

আহনাফ স্তব্ধ হয়ে ঠাঁই দাঁড়িয়ে চিন্তা করতে লাগলো, কোনোদিন তো সে বিভাকে এমন বলেনি যে, সে তাকে পছন্দ করে! সে যতটা সম্ভব মেয়েটা থেকে দূরে থাকতো, তাহলে কেনো মেয়েটা ওকে বিপদে ফেলার জন্য এধরনের কর্ম করলো?

সব দোষ ওর মা বাবাকে দিতে ইচ্ছে করলো।
মা বাবা শুরুতেই যদি বিষয়টাকে মূলউৎপাটন করে দিতো তাহলে এতকিছু হতো না। শুরুতেই যদি রাহুল চৌধুরীর দেওয়া বিয়ের প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করতো তারা তাহলে হয়তো মেয়েটা আগেই নিজেকে গুটিয়ে নিতো।

তবে এই মেয়ে কোনোদিনই সুবিধার ছিলোনা। নিজের নাক কেটে পরের যাত্রা ভঙ্গ করাই এর স্বভাব। বিভার প্রতি আহনাফের ঘৃণা চলে এলো।

রাহুল চৌধুরীর সাথে কথা বলার পাঁচ মিনিটের মধ্যেই আবার শায়লা কল দিলো। এক বিপদ যেনো আরেক বিপদের লেজে পাড়া দিয়ে দিয়ে আসে।

শংঙ্কা যেনো উগরে পড়ছে শায়লার কথায়।
” রোলার ক্রেন নিয়ে বাড়ি ভাঙ্গতে এসেছে ওরা, জলদি বাড়ি আয়”
বলেই শায়লা কেঁদে উঠলো।

এতক্ষণ দুর্বৃত্তদের থ্রেটে যতটা শংঙ্কিত হয়েছে আহনাফ, এখন রোলার ক্রেনের কথা শুনে মগজে র’ক্ত ফুটতে থাকলো। এখনি সব গুঁড়িয়ে ফেলবে করে সিদ্ধান্ত নিয়ে নিলো।

দশ শতক জমির উপর দাঁড়িয়ে থাকা বড় দ্বীতল বাড়িটা ভাঙ্গার জন্য যতকিছু প্রয়োজন তার সব যোগাড় যন্তর শেষ করে নিয়েছে দুর্বৃত্তরা। যে এই সবের মূল ইন্ধনদাতা তার নাম মালেক ব্যাপারি। মালেক ব্যাপারি ও তার চার পুত্র সরকার দলীয় স’ন্ত্রাসী। তারা নিজেদের কাগজপত্র বৈধ আর আহনাফদের টা অবৈধ বলে দাবী করে আসছে।

আহনাফ বাড়ি এসেই দেখে মালেক ব্যাপারির ছেলেরা ওসব যন্ত্রপাতি রেখে ভয় দেখিয়ে ঘুমাতে চলে গিয়েছে। এ রাতটুকুই শুধু ওদের সময়।
পরের দিন সকালেই গুঁড়িয়ে দিবে ওদের এত স্মৃতির বাড়ি?
শায়লা অনবরত কেঁদেই চলছে। আহনাফকে আবার একবার অনুনয় করে বললো, ” বাবা, একবার রাহুল৷ চৌধুরীর কাছে বলে দেখ! ”

কিন্তু আহনাফ যাকে ক্ষাণিকক্ষণ আগেই নিজের অহম দেখিয়েছে তার কাছে আবার কিভাবে অনুনয় করে?

“মা বাবা কি তাহলে চাইছে বিভাকে আমি বিয়ে করি?” আহনাফের মস্তিষ্কে এধরনের প্রশ্নও কড়াঘাত করলো।

রাত বারোটা, মা-বাবাকে কিছু না বলেই আহনাফ আবার বাইক হাঁকিয়ে গেলো থানায়। আজ কিছু একটা করবেই সে।
কিন্তু এই মগের মুল্লুক দেশে তার অভিযোগ শুনে কোনো পুলিশই কোনো প্রতিক্রিয়া জানালো না। ঘন্টাখানেক অপেক্ষা করিয়ে বসিয়ে রাখলো।

এর আগেও এমন হয়েছিলো, আশফিক কেউ বহুবার পুলিশ বসিয়ে রেখেছিলো, কিন্তু কোনো সমাধা দিতে পারেনি।
এ জায়গা ও জায়গায় বহুবার কল দিলো সে। কিন্তু ঐ মালেক ব্যাপারির বিরুদ্ধে লড়ার সাহস যেনো কারোরই নেই!
আহনাফ বার বার একই কথা বলে রিকুয়েষ্ট দায়িত্বরত পুলিশ অফিসারকে। বরং এস আই কিছু টাকা পয়সা ঘু’ষ দিয়ে মালেক ব্যাপারি ও তার ছেলেদেরকে আপাতত থামাতে বললো।

আহনাফের চোখ কপালে উঠলো,
” মালেক ব্যাপারীকে ঘুষ?”

আইন পেশায় নিয়োজিত থানার পুলিশদের মুখে এরকম বে আইনি কথাবার্তা শুনে আহনাফ নিজের প্রতি নিজের নিয়ন্ত্রন হারালো। তর্কাতর্কির এক পর্যায়ে মেজাজ হারিয়ে দায়িত্বরত এস আই কে সে সরকারের তেলবাজ চামচা, অর্থলোভী ও বা’স্টার্ড বলে গা’লি দিয়ে দিয়ে বসলো।
সাথে সাথে সেই এস আই ক্ষে’পে এলো আহনাফের উপর৷ আহনাফ যদিও হাত উঠালো না, তবে এস আই এর ক্ষে’পে আসাকে প্রতিরোধ করতে গেলো। তবে নাটকীয়িভাবে অন্যান্য পুলিশ, কনস্টেবলরা ওকে আটকে নিলো, এই বলে যে, সে নাকি এস আই এর গায়ে হাত তুলেছে।

সাথে সাথে ফোন কেড়ে নিয়ে আহনাফকে গারদে আটকে ফেলা হলো।
.
.

রাত গভীর হচ্ছে। চরম বিপদের এই রাতে নিজেদের একমাত্র ছেলেরও কোনো খবর নেই। শত সহস্রবার কল করেও কোনো খোঁজ নেই। বিশাল, রাতুল সহ আরো কয়েকজন বন্ধুকেউ কল দিলো আশফিক। হার্টে দুই দুবার বাইপাস করা হয়েছিলো। অতিরিক্ত উদ্বেগে তার শারীরিক ক্ষতির সম্ভাবনা আছে। এদিকে বুকে ব্যথাও শুরু হয়ে গিয়েছে তার। শায়লা আর অহনা বাবার এ হাল দেখে ফুঁপিয়ে কান্না শুরু করলো।

ঠিক সে সময়ই নাটকীয় ভাবে প্রবেশ ঘটলো রাহুল চৌধুরীর। এত রাতে নিজেই ড্রাইভ করে চলে এসেছে সে।

আশফিকের এ অবস্থা দেখে নিয়ে গেলো সেই হসপিটালে, যেখানে বিভাও এডমিট আছে।

সে রাতটা ত্রিশারও নির্ঘুম কাটলো। সারারাত কয়েকবার আহনাফকে কলও দিলো অবস্থা জানার জন্য, কিন্তু ফোন তো অফ! উপায় না পেয়ে শায়লাকে কল দিলো। সে ফোনও কেউ রিসিভ করলো না। আহনাফের বন্ধুদের কল দিলো।
তারা সকাল না হলে কিছুই জানাতে পারবে না বলে জানালো ত্রিশাকে।

ভেতরে ভেতরে পুড়তে লাগলো ত্রিশা।

রাহুল চৌধুরী সেদিন নিজের সর্বোচ্চ দিয়ে করলো আশফিককে বাঁচাতে। নিজে যত যা প্রয়োজন সব করলো।

পরদিন সকালে আহনাফকে থানা থেকে ছাড়িয়েও নিয়ে এলো। এবং মালেক ব্যাপারিকেও সে বাড়ি ভাঙ্গতে বাঁধা দিলো।

একরাতেই সবকিছু যেমন ধ্বংস হতে ধরেছিলো, রাহুল চৌধুরীর হাতের যাদুর ছোঁয়ায় সবকিছু আবার ঠিকও হয়ে গেলো। এই যাদু ক্ষমতার বৈ আর কিছু নয়।

” রাহুল চৌধুরী নিরহংকার ও নিরেট ভালো মানুষ”

আশফিক একথা বহুবার বলেছে আহনাফকে।
আশফিক ও শায়লাকে ঋণি করে পুনরায় আবার রাহুল চৌধুরী তাদেরকে আহনাফ ও বিভার বিয়ের ব্যাপারে চিন্তা করার প্রস্তাব দিলো।

আশফিক ও শায়লা দুজনেই আহনাফের মুখপানে চাইলো।

” বাবা নিরেট ভালো হলেই যে মেয়েও হবে, একথার কোনো ভিত্তি নেই। আমি মেয়েটার মতো স্বার্থপর আর ক্রিমিনাল মেয়ে দেখি নাই! সারা জীবন জেলে পঁচে ম’রতে হলেও আমি বিভাকে বিয়ে করবো না, আর যদি আমার সিদ্ধান্ত মানতে তোমাদের কষ্ট হয়, আমাকে ত্যাজ্য করে দিতে পারো”

এই বলে দ্রুতপায়ে হাঁটা দিলো সে।

শায়লা কাঁদতে কাঁদতে ভেঙ্গে পড়লো।
.
.

ঘর সুদ্ধ কাগজ পত্র ছোঁড়াছুড়ি করছে বিভা।
ক্রোধে সে যেনো উন্মত্ত। জীবনে একাধিকবার অপমানিত হয়েছে সে আহনাফের কাছে। এখন আর নয়!

“আহনাফ ত্রিশাকে ছাড়বে না, তাহলে ত্রিশা ছাড়বে আহনাফকে, ওকে ছাড়তেই যে হবে!”

এক দুষ্ট বুদ্ধি বিভার মাথায় খেলে গেলো।
সে দ্রুত ফোন করলো সেই মেয়েকে, যে তাকে আহনাফ থেকে দূরে থাকার থ্রেট দিয়েছিলো।

মেয়েটার নাম আরোহী।

মেয়েটার গোটা পরিবারই সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডে জড়িত।

আরোহী বিভার ফোন পেয়ে প্রথমে রাগান্বিত হলো।
কিন্তু বিভা বুঝিয়ে বললো,

” দেখ আরোহী, আমরা দুজনে অযথাই আহনাফ স্যারকে নিয়ে নিজেদের মধ্যে মিস আন্ডারস্ট্যান্ডিং করেছি, ঝগড়া করলাম আমরা, আর আহনাফকে পেলো কে? ত্রিশা! ”

আরোহী বলে উঠলো,

” হ্যাঁ, রে ডুড! ঐ ত্রিশাকে পাইলে আমি তো এক্কেবারে জানে খতম করে দিমু?”

বিভা শান্ত স্বরে বললো,

” জানে খতম করলে তো সে ও ম’রবে, আর তুই ও ফেঁসে যাবি, মধ্য থেকে আহনাফও উধাউ, লাভের মধ্যে শুধু লস আর লস”

আরোহী বলে উঠলো,

” তাহলে উপায়?”

ধূর্ত বিভা বলে উঠলো,

” শোন! চল আমরা ত্রিশাকে এমন একটা কন্ডিশনে ফেলে দেই যাতে ও বাধ্য হয়ে আহনাফকে বিয়ে করতে মানা করে দেয়”

আরোহী হাসতে হাসতে বললো,

” এইটাও সম্ভব নাকি? হাউ পসেবল?”

বিভা কূট হাসি হেসে বললো,

” এই দুনিয়ায় সবই সম্ভব, মানুষের দ্বারা কোনো কিছুই অসম্ভব না রে! আমাদের সবকিছু চলবে নির্দিষ্ট প্ল্যান মোতাবেক, ত্রিশাকে আগে সরাবো আমরা, তারপর আহনাফ তোর আর আমার থেকে যাকে বেছে নেয়, আমরা মেনে নিবো, কোনো কনফ্লিক্ট করবো না, তার চুক্তি আমরা একটা স্ট্যাম্পে সিগনেচার করবো, আচ্ছা?”

আরোহী তব্দা খাওয়া স্বরে বললো,

” হাউ ক্লেভার ইউ আর বিভা, তবে কিভাবে এসব হবে, আমি খুব এক্সাইটেড”

বিভা হা হা হাসির স্বরে বললো,

” আগামীকাল আমার বাসায় আয়, আমরা দুজনে মিলে এসবের একটা মাস্টার প্ল্যান করবো, কেমন?”

(চলবে)