তুমি ছুঁয়ে দিলে এ মন পর্ব-০৪

0
34

#তুমি_ছুঁয়ে_দিলে_এ_মন

পর্ব :৪

#জান্নাতুল_মাওয়া_লিজা

বখাটেরা চলে যেতেই আহনাফ তৃষার কাছে এসে একটা ধমক দিয়ে বললো,

” মেয়ে তুমি তো আচ্ছা বোকা! এই পথে এতো রাতে একা কেউ আসে? আমি আর দুই মিনিট পরে এলেই তো এরা তোমাকে আস্ত চি’বিয়ে খেতো?”

তৃষা কাঁদো কাঁদো হয়ে বললো,

” স্যার বিশ্বাস করেন আমি জানতাম না যে, এই রাস্তায় নরখা’দকরা থাকে!”

ওর কথায় আহনাফ হাসবে নাকি কাঁদবে ভেবে পেলো না। সত্যিই এই মেয়ে এতো বোকা কেনো? কিচ্ছু বুঝে না, জানে না এই দুনিয়া সম্পর্কে? আস্ত চি’বিয়ে খেতো এটা ও কোন অর্থে বলেছে সেটা ত্রিশার সামান্যও বোধগম্য হয়নি। ওর মতো বোকা মেয়ে আহনাফ নিজের জন্মে আর দেখেনি।

নিজের একটা গার্লফ্রেন্ড ছিলো, তাও দুনিয়ার বজ্জাত। তুখোড় সুন্দরী ছিলো মেয়েটা, তবে বদ একটা! হাজার ছেলের সাথে উঠতো বসতো। কিছু জিজ্ঞেস করলেই বলতো ওগুলো তো আমার ভাই ব্রাদার। তারপর এরকমই একটা ভাই ব্রাদার পেয়ে সে কিনা অবশেষে ধোঁকা দিয়ে বিয়েই করে ফেললো। আর আহনাফ ছিলো তৃষার মতোই ভুলা ভালা এক মেয়ের সন্ধানে। যাক! এই ভুলা ভালা মেয়েটার সাথে আরেকটু সময় অতিবাহিত করার সুযোগ আহনাফ পেয়ে গেলো এই রাতে।

আহনাফ কথা না বাড়িয়ে তৃষাকে দ্রুত তার বাইকে উঠে বসতে আদেশ করলো। তৃষা বাইকে উঠার ক্ষেত্রেও তার আরো বোকামির পরিচয় দিলো। আহনাফ বাইকেই বসে ছিলো। তবে তৃষা বুঝতে পারছিলো না যে কিভাবে উঠে বসবে। সে একবার একপাশে বসে তো আরেকবার আরেকপাশে বসে। আহনাফ তৃষাকে বুঝিয়ে বললো,

“প্যাডেলে পা দিয়ে উপরে উঠে বসে আমার কাঁধে হাত রাখো, আর যেদিকে ইচ্ছে সেদিকেই বসো, সমস্যা নেই, ইচ্ছে হলে ডানদিকে পা দাও আর না হয় বাম দিকে। আর আমি ধীরেই চালাবো, ভয়ের কোনো কারন নাই”

ত্রিশা উঠতেই বাইক ছুটতে শুরু করলো। এত বেগে সে জীবনেও চড়ে নি। সে শুধু সি এন জি আর অটোরিক্সাতেই চড়েছে বড়জোর। ত্রিশা ভয়ে ভয়ে দুই হাত দিয়েই আহনাফের বুক বরাবর জড়িয়ে ধরলো। মেয়েটার গোটা শরীরের ভার যেনো আহনাফের উপর লুটিয়ে পড়ছিলো। আর খোলা চুলগুলো উড়ে আহনাফের ঘাড়, কাঁধ ছুঁয়ে মুখ পর্যন্ত চলে আসছিলো। ওর চুলের ঘ্রানটা অদ্ভূত! একেবারে প্রাকৃতিক ঘ্রাণ। অন্য মেয়েদের চুলে যেমন শ্যাম্পুর ক্যামিক্যাল যুক্ত ঘ্রান, এই মেয়েটার তা নয়! কোঁকড়ানো হলেও এত মসৃণ চুলগুলো!

আহনাফের কানে গান বেজে উঠলো, ” ওগো তোমার চুলের গন্ধে পাগল হবো, মাতাল হয়ে, উন্মাদনায় হাঁটবো গোটা বিশ্ব,ওগো ও হৃদয় হরণকারী, তুমি নারী নাকি পরি….

আহনাফের হৃদপিন্ডের গতি যেনো স্তিমিত হয়ে আসছিলো। সে নিজের উপর কি তবে নিয়ন্ত্রণ হারাতে শুরু করেছে? মেয়েটার স্পর্শ যেনো তাকে স্বর্গীয় হাওয়ায় ভাসিয়ে নিয়ে যাচ্ছিলো। এ অনুভূতি কোনো কামনার অনুভূতি নয় বরং কোনো শুদ্ধ ভালোবাসাময় অনুভূতি।

তৃষা বার বার বলছিলো যে তাদের বাড়ি পান্থ কানাই রোড। আহনাফ নিজেও চেনে বাড়িটা। কিন্তু কেনো যেনো সব গুলিয়ে ফেলে দশ মিনিটের পথ ঘুরে ঘুরে আধ ঘন্টা লাগিয়ে দিলো। এতক্ষণ সময় পুরোটা জুড়েই তৃষা আহনাফকে পেছন থেকে জড়িয়ে ধরে রইলো।

আহনাফ মনে মনে ভাবলো, ” আচ্ছা মেয়েটার কি কোনো অনুভূতিই নেই? থাকার কি কথা নয়?”

কলেজ ও ভার্সিটি লাইফে ওকে পছন্দ করে এরকম মেয়ের অভাব ছিলো না। সবাই ওকে পছন্দ করতো কারন সে দেখতেও যেমন স্মার্ট ও সুদর্শন তেমনি মেধাবীও। নায়ক হওয়ার অফার ও পেয়েছিলো। আর এই কলেজে চাকরি হওয়ার পর তো মেয়েরা যেনো ওকে আস্ত গলধ:করন করে।

বাসার সামনে নামতে নামতে রাত একটা বেজে গেলো। ত্রিশা বাইক থেকে নেমে ভয়ে আহনাফ কে বিদায় না জানিয়েই বাড়ির গেইটের দিকে দৌড় দিলো। আহনাফও চুপিসারে ত্রিশার পেছনে পেছনে গেলো। বাড়ির সবাই তখন ঘুমাচ্ছিলো। দাঁড়োয়ানও কি কারনে যেনো ছুটিতে গিয়েছে। তাই উপায় না পেয়ে তৃষা ভেতর বাড়ির কলিং বেলে চাপ দিলো। পাঁচ ছয়বার চাপ দেওয়ার পর তৃষার সৎ দাদী অর্থাৎ জামিল শেখের মা ববিতা শেখ ভেতর থেকে বেরিয়ে এলো। আহনাফ গেটের বাইরেই দাঁড়িয়ে ছিলো। দুরু দুরু বুকে ত্রিশা ভেতরে প্রবেশ করলো। এত রাতে বাড়ি এসে কলিং বেল টিপে বাড়িসুদ্ধ মানুষকে জাগিয়ে তোলার জন্য ববিতা অগ্নিশর্মা হয়ে গেলো। সে তৃষাকে প্রথমেই জিজ্ঞেস করলো,

” ওমা! এত রাতে ফুলবানু নতুন ড্রেস পড়ে এসেছে যে?”

বোকা তৃষা ভাবলো যে, ওর দাদী হয়তো খুশি হয়ে এসব বলছে। তাই হাসিমুখে বললো,

” দাদী আমার বান্ধবী রাত্রি আমাকে ড্রেস টা গিফট করেছে, সুন্দর না?”

ববিতা রেগে গিয়ে একটা থাপ্পড় দিয়ে বললো,

” তোর বান্ধবী না বান্ধব তা বুঝাচ্ছি দাঁড়া, এত রাত্রে এই বাড়িতে তুমি ঢুকতে পারবে না, আর আমার অনুমতি ছাড়া যদি তোর মা ঢুকায় তবে তোর মাকেও আজই এই বাড়িছাড়া করবো।”

ত্রিশার মা কনকচাপা দোতালার বারান্দা থেকে পুরো ঘটনা নির্বাক্যে দেখছিলো। এতক্ষণ সে নিজের দুই বাচ্চা নিয়ে ঘুমাচ্ছিলো। জামিলের সাথে বিয়ের পর কনকচাপার দুইটা ছেলের জন্ম হয়। আর আগের সংসারের ত্রিশা তো আছেই।

ববিতা এবারে গজগজ করে বলতে লাগলো,

” আমার ছেলে টাকা পয়সা খরচা করে একটা খারাপ মেয়ে পালতেছে, হুদাই! যত ভালোই করো না কেনো? মা*গীর মেয়ে তো মা*গীই হয়!”

আরো অনেক নোংরা নোংরা কথা ববিতা বলতে লাগলো।

দাদীর কথা শুনে আর চড় খেয়ে ত্রিশা বাড়ির নিচের গেইটের সামনে দাঁড়িয়ে কাঁদতে শুরু করলো। কিন্তু কনকচাপার যেনো এসব কথার প্রতি কোনো বোধ নেই।

অপরদিকে আহনাফ তখনো মূল গেইট থেকে সরে নি। সে তখনো ঠাই দাঁড়িয়ে থেকে গোটা ঘটনাই পর্যবেক্ষণ করছিলো। ত্রিশার দাদীর উপর ওর যতটা না রাগ হলো তার চেয়ে বেশি রাগ হলো তার ত্রিশা আর তার মায়ের উপর। এভাবে কেউ নির্বাক্যে অত্যাচার সহ্য করে? আহনাফের ইচ্ছে হলো ভেতরে গিয়ে ওর দাদীকে ইচ্ছামতো শাসাতে, সাথে ওর মা কেউ। কিন্তু বহু কষ্টে নিজেকে দমন করে রাখলো সে। এমন সময় অন্য একজন লোকের আগমন ঘটলো। সে ত্রিশার ফুপা। এই বাড়িটা মূলত ববিতা শেখের। বাড়িতে জামিল শেখ ছাড়াও তার দুই বোন তাদের জামাই সহ থাকে। সৎ ফুপুদ্বয় ত্রিশাকে একদম দেখতে না পেলেও তাদের ঘরজামাই দ্বয়ের নিকট ত্রিশা ভীষণই প্রিয়।
তারা ত্রিশাকে নিজেদের দলেরই একজন ভেবে থাকে। কারন এ বাড়িতে ত্রিশা যেমন পরগাছা হয়ে থাকে তার ফুপাদ্বয়ও পরগাছা হয়ে থাকে। তো এবার যে ফুপা ত্রিশাকে বাঁচাতে আসলো তার নাম পাভেল। পাভেল ত্রিশার হয়ে ববিতাকে বললো,

” আম্মা, আপনি শুধুশুধু এতো রাতে গন্ডগোল করে নিজের ব্লাড প্রেশার বাড়াচ্ছেন, ভাইজান নিজেই ত্রিশাকে ঐ বিয়েবাড়িতে যেতে এবং এক রাত থেকে আসার অনুমতি দিয়েছিলেন, ও বরঞ্চ না থেকে রাতেই চলে এসেছে, এতে শুধুশুধু উত্তেজিত হবেন না প্লিজ”

এসব বলতেই ববিতা ম্লান মুখে শুধালো,

” তাই নাকি? খোকা(জামিল) যদি অনুমতি দিয়ে থাকে তাহলে তো আর কোনো কথাই নেই, ত্রিশা তাহলে ঘরে গিয়ে শুয়ে পড়ো গিয়ে”

বলেই ববিতা গেইট খুলে দিয়ে গটগট করে হেঁটে ভেতরে চলে গেলো৷

ওদিকে আহনাফ ও নিশ্চিন্ত হয়ে বাড়ি চলে গেলো।

আহনাফ এতক্ষণে ভুলেই গিয়েছিলো যে কেনো বাইরে বেরিয়েছিলো।
এতক্ষণ পরে মনে পড়লো যে, একটা জরুরি কাগজ ফটোকপি করতে বের হয়েছিলো। মনে মনে বলতে লাগলো,” এতক্ষণে দোকানদার ঘুমিয়ে সারা। শীট! আজ আর কাজটা করা হলো না। তাও ভালো, মেয়েটাকে বাঁচাতে পেরেছিলো। একেবারে ঠিক সময়ে এসেছিলো বলে!”

ত্রিশা নিজের রুমে যেতেই ওর মা কনকচাঁপা এলো রুমে। টলতে টলতে বলতে লাগলো,

” এতো রাতে থেকে এলেই পারতি? তোর বাবা তো রাতে থাকার অনুমতি দিয়েই দিয়েছিলো। জীবনে কোনোদিন কারো বিয়ে দেখিসনি….”

বলতেই ত্রিশা তার মাকে থামিয়ে বললো, ” কেনো তোমার বিয়ে তো দেখেছিই!”

এই এক কথাতেই কনকচাপা চুপ।

মিনিটব্যাপী স্তব্ধ হয়ে ঠাঁই দাঁড়িয়ে রইলো কনকচাপা। ত্রিশা তো সত্যি কথাই বলেছে। নিজের মায়ের বিয়েই তো তাকে দেখতে হয়েছে। ত্রিশার বয়স তখন মাত্র সাত। ঢাক, ঢোল পিটিয়ে শানাই বাজিয়ে হাজার লোক দাওয়াত করে সে বিয়ে হয়েছিলো। বিশিষ্ট সুদখোর ব্যবসায়ী জহির শেখের সাথে বিয়ে বলে কথা! গয়নায় সারা শরীর মুড়িয়ে নিয়ে গিয়েছিলো কনকচাপা কে। অন্য বিয়েতে মেয়েপক্ষ যৌতুক দেয়, আর এই বিয়েতে কনকচাপার বাপ ভাইকে যৌতুক দিয়েছে জহির শেখ। আরো কত ইতিহাস! সবটা জানেনা ত্রিশা। তাইতো মা’কে এত সহজেই ভুল বুঝে সে।

কনকচাপা তখনো দাঁড়িয়ে। মেয়ে তার কথা শিখেছে এখন! আগে তো এসব বলতে পারতো নাহ! মাঝে মাঝে অতীতে গিয়ে সময়ও স্তব্ধ হয়ে যায় তার কাছে। আজও হচ্ছে। সুন্দরী কনকচাপা এক কণ্যাসহ বিধবা হলে তাকে বিয়ে করার জন্য উঠেপড়ে লেগে যায় জহির শেখ। এলাকায় বিশিষ্ট ব্যবসায়ী ও শিল্পপতি হিসেবে তার খ্যাতি। সেই সাথে খ্যাতি তার আজব শখের জন্য। সেই শখের নাম হলো, বিয়ে করা।
ঘন ঘন বিয়ে করে তালাক দেওয়া তার একটা শখ। তার মোট কতখানা স্ত্রী আছে তার কোনো স্পষ্ট হিসেব কেউ জানে না। হয়তো সে ও জানে কিনা ঠিকঠাক! তার বেশির ভাগ স্ত্রীকেই সে তালাক দিয়ে দিয়ে দিয়েছিলো। শুধু প্রথম স্ত্রী সড়ক দুর্ঘটনায় মারা যায় আর কনকচাপা তার সকল অন্যায় অত্যাচার মুখ বুজে সহ্য করেও দাঁত মুখ আঁকড়ে এ বাড়িতে পড়ে রয়েছে। স্বামী, শাশুড়ী ও ননদদের সেবা করে আসছে। সেই সাথে প্রতিনিয়ত করা অপমান ও অত্যাচার সহ্য করে আসছে। আর করবেই না কেনো? বিয়ের সময় তার গরীব বাপ ভাই জামিলের কাছ থেকে নগদ পঞ্চাশ লক্ষ টাকা সুদ যে নিয়েছিলো। আজ যদি সে জামিলের কাছ থেকে তালাক নিয়ে চলে যায় তবে সেই টাকা সুদে আসলে শোধ করতে হবে। আর এটা তার সাধ্যের বাইরে। আর সেজন্যই সে মুখ বুজে জামিলের বাড়িতে মেয়ে ত্রিশাকে নিয়ে পড়ে আছে।

কনকচাপা এসব ভাবতে ভাবতে অনেক সময় গড়িয়ে গিয়েছে। ততক্ষণে ত্রিশা শুয়ে ঘুমিয়ে গিয়েছে।

নিজেই মনের অজান্তে বলে উঠলো, “বাহ! কি সুন্দর দেখতে হয়েছে মেয়েটা আমার! লাল লেহেঙ্গাটায় একদম পরীর মত লাগছে!”

(চলবে)