তুমি নামক অনুভূতি পর্ব-১৯+২০

0
1009

#তুমি_নামক_অনুভূতি
#পর্ব:১৯
#Lutful_Mehijabin (লেখা)
[কপি করা নিষিদ্ধ]

–ব্যাপার কী! আমাকে তাড়িয়ে দিচ্ছিস কেন?

রাফুর কথার প্রত্যুত্তর ইয়াদ ধমক স্বরে বলে উঠল,

–যাবি, নাকি অন্য ব্যবস্থা করব?

রাফু খানিকটা ভয় পেয়ে সোফা হতে উঠে দাঁড়াল।ইয়াদের ভয়ঙ্কর রাগ সম্পর্কে সে ভালো করেই অবগত। তাই অযথা ঝামেলায় জড়াতে চাইছে না সে। লহমায় চোখ যুগল কিঞ্চিৎ ছোট ছোট করে সন্দেহ দৃষ্টিতে ইয়াদের মুখশ্রীতে তাকাল। কপালে সুক্ষ্ম ভাজ ফেলে, ঠোঁটের কোণে বাঁকা হাসি ঝুলিয়ে বিরবির করে বলে উঠল,

–রাগিস কেন? যাচ্ছি তো।

বাক্যটা বলেই রাফু ড্রইং রুম হতে প্রস্থান করল। রাফু চলে যেতেই ইয়াদ পরাপর দুটো স্বস্তির নিঃশ্বাস ত্যাগ করে, সোফার উপর অবস্থিত জারার মুখশ্রীতে দৃষ্টিপাত নিক্ষেপ করল। ঠোঁট যুগল স্বল্প সংকুচিত করে বলে উঠল,

— আমার সাথে ছাদে চলো।

ইয়াদের কথা কর্ণপাত হতেই জারা সোফা থেকে দ্রুত উঠে দাঁড়াল। চোখ জোড়া সংকুচিত করে অনুরোধ স্বরে মিনমিন করে বলে উঠল,

–আমি যাব না। শীত লাগে তো।

জারার প্রত্যুত্তর শুনে ইয়াদের হৃদয় গহীনে বিষণ্ণতার আবির্ভাব ঘটল। অভিমানের ভান্ডার যেন অভিমান নামক অনুভূতিতে অষ্টেপৃষ্টে ভরে উঠলো অন্তরালে। ইয়াদ তার অন্তরের অভিমান গুলো বহিঃপ্রকাশ করল না জারার কাছে। কেন জারা ছাদে যেতে চাইছে না, বিষয়টা সে একটি বারের জন্যও যাচাই করার প্রয়োজন বোধ মনে করল না। তার রাগ হচ্ছে প্রচুর। মুহূর্তে ক্রোধের বসে মাথা তপ্ত হয়ে উঠতে আরম্ভ করল। পরিশেষে মস্তিষ্ক শীতল করার প্রয়াসে প্রায় সেকেন্ড পাঁচেক চোখ যুগল বন্ধ করে, স্নিগ্ধ হাওয়া নিশ্বাসের সহিত টেনে নিলো ইয়াদ। অতঃপর অসহায় বিপন্নের মতো জারার চোখ যুগলে দৃঢ় দৃষ্টিপাত নিক্ষেপ করে মৃদু স্বরে বলে উঠল,

–ওকে। তোমাকে যেতে হবে না। আমি রুমে যাচ্ছি। যাও গিয়ে তাড়াতাড়ি ঘুমিয়ে পড়।

তৎক্ষণাৎ ইয়াদ দ্রুত পদে পা যুগল সংকুচিত করে ড্রইং রুম প্রস্থান করল। জারা ফ্যালফ্যাল নয়নে ইয়াদের চলমান পদের দিকে তাকিয়ে রইল। দৃষ্টি তার অনুভুতিহীন নির্বাক! এই মুহূর্তে ইয়াদের চাউনি বারংবার তার মস্তিষ্কে ভেসে উঠছে। ক্রমশ ক্ষত বিক্ষিত করে তুলছে তার হৃদয় মনকে। নিজেকে একরাশ ঘৃণা ভরা ধিক্কার জানল সে। ছিঃ লোকটা কতোটা অদম্য আগ্রহের তাকে সঙ্গে করে ছাদে নিতে চেয়েছিল রাত্রির স্নিগ্ধ প্রকৃতি বিলাস করবে বলে। হয়তো চেয়েছিল এই জোৎস্না ভরা শীতল রাত স্মরণীয় করে রাখতে। কিন্তু সে কি করল। ইয়াদের প্রস্তাবকে উপেক্ষা করে তাকে কষ্ট দিয়ে মুখের উপর না বলে দিলো? অতঃপর সে অসীম বিরক্তিকর দৃষ্টিপাত নিক্ষেপ করল নিজের শাড়ির আড়ালে লুকিয়ে থাকা পায়ের দিকে। বিষণ্ণ মনে মুখ দিয়ে অস্কুটস্বরে বিরবির করে হাজার গালি দিল তার পায়ের পার্শ্ববর্তী এক কোণে অবস্থিত একটা অতিসুক্ষ্ম আলপিনকে। আজ তার নিকট এই ছোট্ট আলপিনটাকে জীবনের সবচেয়ে বড় শত্রু মনে হচ্ছে। এই পিনটার জন্যই তাকে ইয়াদের মুখের উপর না বলতে হয়েছে। কারণ অত্যন্ত অসময়ে এই পিনটা তার পায়ের তালুতে বাজে ভাবে ছিদ্র করে ফেলছে। খানিক পূর্বে যখন ইয়াদ তার মাকে রুমে দিতে গিয়েছিল ঠিক তখন জারা সোফা থেকে উঠার জন্য পা বাড়াতেই আলপিনটা তার বাম পায়ের তালু ক্ষত করে তুলে। তাই সে বাধ্য হয়ে ইয়াদের সঙ্গে ছাদে যেতে রাজি হয় নি। বর্তমানে এই পিনটাকে তার কাছে বিষধর সাপের ন্যায় মারাত্নক মনে হচ্ছে। শুধু মাত্র এই পিনটার জন্যই সে ইয়াদকে না চাইতেই কষ্ট দিয়ে ফেলেছে। জারা তপ্ত শ্বাস ফেলে সোফা থেকে উঠে দাঁড়াল। নিজ রুমে যাবার জন্য পা যুগল হাল্কা ধাবিত করতেই, ক্ষত পায়ে ব্যথা অনুভব করল। পায়ের ব্যথার অসহ্যনীযয় যন্ত্রণা! অবশেষে তার বোধগম্য হলো পিনটা তার পায়ে এতোটাই ক্ষত করছে যে প্রচুর রক্ত ঝরেছে তার রক্ত গ্রন্থি হতে। স্বচ্ছ, শুভ্র রঙের ফ্লোরে রক্তের লাল দাগ পরিষ্কার ভাবে স্পষ্ট। রক্তের দাগ দৃশ্যমান হতেই চিন্তিত হয়ে পড়ল সে। এখন যে তাকে এই দাগ মুছে তারপর রুমে যেতে হবে। নতুবা এই রক্তের দাগ সহজে পরিস্কার করা যাবে কি সন্দেহ। তার এই সম্বন্ধে কোন ধারণা নেই। পরে যদি রক্তিম বর্ণ ফ্লোর হতে না উঠে তাহলে তো তার শাশুড়ি আম্মু তাকে হাজরটা বকুনি শুনাবে। মহিলাটা এতোটাই খারাপ যে সামান্য ব্যথা পেলেই ইশারাতে হাজারটা বকুনি শুনাই তাকে। জারা স্মরণ করতে পারছে না যে শেষ কবে তার মাকে তাকে ব্যথা পাবার জন্য বকুনি দিয়েছিল। বিষয়টা ভেবেও জারা এই ঠান্ডার মধ্য ক্ষত পা নিয়ে ফ্লোর মুছতে ব্যর্থ হলো। অসহ্যনীযয় ব্যথার সঙ্গে লড়াই করতে না পেরে এক পা উঁচু করে ধীরে ধীরে নিজের রুমে উদ্দেশ্য ধাবিত হলো।
__________
দেয়াল ঘরির কাটাতে রাত একটা ছুঁইছুঁই। উষ্ণ চাদর গায়ে জড়িয়ে গভীর ঘুমে আচ্ছন্ন মেহের। আজ রাত্রি প্রায় বারোটা পর্যন্ত সে ঘুমের সঙ্গে যুদ্ধে নেমেছিল। অবশেষে সারাদিনের অক্লান্ত পরিশ্রমের ফলে যুদ্ধে পরাজিত হয়েছে সে। শত চেষ্টা করেও চোখ যুগল উন্মুক্ত রাখতে পারেনি। দরজার জানাল ভালো করে লক করে ঘুমিয়েছে। অজ্ঞাত ব্যক্তির ভয়ে মেহের ঘুমের মাঝে কেঁপে কেঁপে উঠছে। সমুদ্র বাসায় আছে বিষয়টা খানিক স্বস্তির হলেও তার নিকট নিরাপত্তাহীন। কারণটা অজানা নয়। সমুদ্র থাকা আর না থাকা একই কথা। সে তো এ কয়েক দিনে একটি বারের জন্যও অকারণে মেহেরের রুমে উপস্থিত হয়নি। মেহের সমুদ্রের উপর ভরসা রেখে ঘুমে আচ্ছন্ন হয়ে পড়েছে ঠিকি। সমুদ্রে যে তাকে আজও এই এত্ত বড়ো ফ্লাটে একা রেখে গিয়েছে তা তার নিকট অজানা।
____________

একটা ভাঙা দোতলা বাড়িতে এক রুমে অবস্থান করছে সমুদ্র। রাত দুটো ছুঁইছুঁই। প্রায় মিনিট পাঁচেক বাদেই ঘরির কাটা রাত দুটোটে পা রাখবে। পরিবেশ কুয়াশার চাদরে ঢেকে থাকা সত্ত্বেও বাড়ির ভেতরে অবস্থিত মানুষগুলো এই কনকনে শীত উপেক্ষা করে কোন এক বিষয়ে আলোচনা করতে ব্যস্ত ছিল। খানিক পূর্বে মিটিং শেষ হয়ে গিয়েছে। প্রায় বিশ জন ব্যক্তি এই মিটিং সভাতে উপস্থিত ছিল। সবাই প্রস্থান করলেই কয়েকজন ব্যক্তি এখনো বাড়িটা ত্যাগ করেনি। তার মধ্য সমুদ্র বিদ্যমান । বর্তমান একটা চেয়ারে নতজানু হয়ে বসে রয়েছে সমুদ্র। মিটিংটা মূলত তাকে কেন্দ্র করে হয়েছে। সমুদ্রহীনা এই আলোচনা সভা যেন অসম্পূর্ণ। তার নিকটবর্তী বসে রয়েছে এসিপি শোয়াইব খান। তার চোখে মুখে উপচে পড়া আনন্দ ভেসে উঠেছে। সমুদ্র তার কর্মে সাফল্যর পথে। তার জন্যই কেসটা খুব শীঘ্রই সফল ভাবে সমাপ্ত হতে চলেছে। তাই শোয়াইব খানের যেন খুশির শেষ নেই। সে সমুদ্রকে আকাশের সঙ্গে যেতে দেয় নি। সবাই গাড়ি করে চলে গেলেই তিনি সমুদ্রকে বিদায় দেননি। তার নাকি গুরুত্বপূর্ণ আলোচনা রয়েছে সমুদ্রের সঙ্গে। স্যারের আদর্শ পেয়ে সমুদ্র ইচ্ছে থাকা সত্ত্বেও বাসায় ব্যাক করতে পারে নি। কিছুটা হলেও তার মেহেরের জন্য চিন্তা হচ্ছে। না চাইতেই সে বারংবার মেহেরকে নিয়ে ভাবনায় বিভোর থাকছে। বিষয়টা সমুদ্র কিছুতেই মস্তিষ্ক হতে বের করতে সফল হচ্ছে না। যতোই হোক মেহের তার একমাত্র দায়িত্ব। তার জন্য মেয়েটা যদি কোন বিপদের সম্মুখে পড়ে তাহলে সে তার মা ইসরাত বেগমের মুখশ্রীর সম্মুখীন হতে পারবে না। সমুদ্র যখন চিন্তায় বিভোর ঠিক তখনি এসিপি বলে উঠলেন,

–সমুদ্র হুয়াট আর ইউ থিংকিং?

এসিপির কথার প্রত্যুত্তরে সমুদ্র হাল্কা হেসে বলে উঠল,

–কিছু না স্যার। রাত তো অনেক হলো এখন আমি আসি?

___________
ঘরির কাটাতে রাত দুটো বেজে পাঁচ মিনিট অতিবাহিত হয়েছে। গভীর হতে গভীরতর ঘুমে আচ্ছন্ন মেহের। আজও তার ঘুমের মধ্যে অস্বাভাবিক অনুভূতি হচ্ছে। অর্থাৎ কাল রাতের অজ্ঞাত ব্যক্তির আগমন ঘটছে। মেহেরের অস্বস্তি হচ্ছে খুব। ঘুমের মধ্যে মনে হচ্ছে কেউ তার মুখশ্রীতে গভীর দৃষ্টিপাত নিক্ষেপ করে রয়েছে। গভীর ঘুমে আচ্ছন্ন হওয়া সত্ত্বেও মেহের বিষয়টা আন্দাজ করতে সক্ষম। মেহের চেষ্টা করেও চোখ যুগল উন্মুক্ত করতে ব্যর্থ হচ্ছ।
অতঃপর আকস্মিক কোন একটা কাঁচের বস্তু ভেঙে বিটক আওয়াজ হওয়াতে মেহেরের অস্বস্তি মাখা নিদ্রা বিদায় নিল। তৎক্ষণাৎ চোখ যুগল উন্মুক্ত করে উঠে বসল সে। ভয়ে হাঁফিতে হাঁফিতে সামনের দিকে দৃষ্টি নিক্ষেপ করতেই বুঝে উঠল অজ্ঞাত ব্যক্তি দ্রুত পদে বিদায় নিচ্ছে। মেহের ভয়ে শিউরে উঠল। লোকটার ছায়ার দিকে দৃষ্টি পরখ করতেই টের পেল ব্যক্তিটার আবছা অবয়ব। মুহূর্তেই আবছা ছায়া অন্ধকারে মিশে গেল। মেহের বুঝতে পারল লোকটা অতিরিক্ত খাটো।

(চলবে)

#তুমি_নামক_অনুভূতি
#পর্ব:২০
#Lutful_Mehijabin

অতঃপর আকস্মিক কোন একটা কাঁচের বস্তু ভেঙে বিটক আওয়াজ হওয়াতে মেহেরের অস্বস্তি মাখা নিদ্রা বিদায় নিল। তৎক্ষণাৎ চোখ যুগল উন্মুক্ত করে উঠে বসল সে। ভয়ে হাঁফিয়ে হাঁফিয়ে সামনের দিকে দৃষ্টি নিক্ষেপ করতেই বুঝে উঠল অজ্ঞাত ব্যক্তি তার রুম হতে দ্রুত পদে বিদায় নিচ্ছে। মেহের ভয়ে শিউরে উঠল। লোকটার ছায়ার দিকে দৃষ্টি পরখ করতেই টের পেল ব্যক্তিটার আবছা অবয়ব। মুহূর্তেই আবছা ছায়া অন্ধকারে মিশে গেল। মেহের বুঝতে পারল লোকটা অতিরিক্ত খাটো। মেহেরের মুখশ্রীতে ভয়ের আবির্ভাব গভীর হতে গভীরতর হয়ে উঠল। অত্যধিক হারে তার হাত পা কাঁপতে আরম্ভ করল। সে স্তম্ভিত নয়নে আবছা ছায়ার বিলিন হওয়ার দৃশ্যের দিকে অপলক দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইল। মেহের স্তম্ভিত, বাকরুদ্ধ হয়ে খানিকটা সময় অতিবাহিত করল। অবশেষে সজ্ঞান হতেই মেহের লাফ দিয়ে বিছানা থেকে উঠে দাঁড়াল। সঙ্গে সঙ্গে এলোমেলো পায়ে সমুদ্রের রুমের দিকে দ্রুত ধাবিত হতে আরম্ভ করল। জড়ে জড়ে নিশ্বাস ত্যাগ করতে করতে, মুখ দিয়ে অস্কুটস্বরে বিরবির করে বলতে লাগল,

–আ পি নি কোথায়? আমার যে ভয় হচ্ছে খুব। আমাকে,,,,,,

মুখ দিয়ে আর টু শব্দ ও নির্গত করতে পারল না মেহের। অতিরিক্ত ভয়ে তার নেত্রযুগল ভারি হয়ে আসতে আরম্ভ করল। অবশেষে দু এক পা এগুতেই সেন্স লেস হয়ে ফ্লোরের উপর ধপাস করে পড়ে গেল সে।
___________

তার তিনটা বাজতে চলছে অথচ এসিপি শোয়াইব খান এখনো অবধি সমুদ্রকে যেতে দেয় নি। একের পর এক প্রশ্ন জিজ্ঞেস করছে সমুদ্রকে। খানিকক্ষণ ধরে সমুদ্রের মুখশ্রীতে চিন্তার ভাব স্পষ্ট ফুটে উঠেছে। এই নিয়ে সাত বার তাকে ফোন করেছে আকাশ। কিন্তু সমুদ্র শোয়াইব খানের সামনে অবস্থান করার ফলে, কল রিসিভ করার প্রয়োজন বোধ মনে করেনি। ভেবেছে হয়তো বিনা কারণে আকাশ তাকে বিভ্রান্ত করতে কল করছে। একপর্যায়ে আর ফোনের বাজে ধ্বনি শোয়াইব খান কান এড়িয়ে যেতে পারল না। এসিপি শোয়ইব খান সমুদ্রের জড়তা বুঝে উঠতে সক্ষম হলেন। চোখ জোড়া সংকুচিত করে, কপালে সুক্ষ্ম ভাজ ফেলে প্রশ্ন সূচক দৃষ্টিতে বলে উঠল,

–এতো বার বার কে তোমাকে কল করছে?

এসিপি স্যারের প্রশ্নের প্রত্যুত্তরে সমুদ্র স্বাভাবিক গলায় বলল,

–স্যার আকাশ কল করেছে।

সমুদ্রের জবাব পেয়ে এসিপি তিক্ত কন্ঠে বলে উঠলেন,

–এই বাচ্চাদের মতো স্বভাবের জন্য আমার আকাশকে একদম পছন্দ না। একজন সিআইডি অফিসার যে কতোটা কেয়ারলেস হতে পারে আকাশকে না দেখলে কখনোই জানতাম না। নিশ্চয়ই ও তোমাকে বিরক্ত করতে কল করছে।

এসিপি স্যারের কথা শুনে সমুদ্রের অন্তরালে কিঞ্চিৎ বিরক্তির আবির্ভাব ঘটল। এসিপির কথার জবাবে সে বলে উঠল,

–হয়তো আরজেন্ট হবে। স্যার আমি এখন আসি? আর একটা অনুমতি নেওয়ার ছিল আপনার কাছ থেকে।

সমুদ্রের কথা শুনে এসিপি কঠিন স্বরে বলে উঠল,

–হ্যাঁ বলো।

সমুদ্র খানিক ইতস্তত বোধের সহিত বলল,

–আসলে স্যার আমাকে একটু গ্রামের বাড়িতে যেতে হবে। একটু পারিবারিক সমস্যার জন্য।

সমুদ্রের কথাই এসিপি চোয়াল শক্ত করে বলে উঠল,

–কেন?

মূলত মেহেরকে তার বাসায় রেখে আসতে যাবে সমুদ্র । আর মেহেরের যাবতীয় সব খরচ তার বাবা মাকে বুঝিয়ে দিয়ে আসবে। অর্থাৎ তার দায়িত্ব পালন করতে যাবে। তাই সে এসিপির কাছে থেকে অনুমতি নেওয়ার জন্য ছুটি চাইছে। সে স্বল্প চিন্তা ভাবনা করে বলল,

–ওইতো একজনের সঙ্গে দেখা করতে যেতে হবে।

সমুদ্রের বলা বাক্যটা কর্ণপাত হতেই এসিপি তার আঁখি যুগল ছোট ছোট করে ফেললেন। কন্ঠস্বরে তিক্ততা এসে ভর্ৎসনার সহিত বললেন,

–তুমি কী আসলেই সমুদ্র! আই কান্ট বিলিভ? তুমি কিনা এমন ভাবে কথা বলছে। আমি তো জানতাম তুমি একজন স্টোং বয়। আর সেই তুমি কিনা কথার মাঝে ফ্যামিলি টেনে আনলে। তোমার কী মনে নেই সমুদ্র তুমি একজন সিআইডি অফিসার। অথচ দিন যত অতিবাহিত হচ্ছে তুমি ততো ধীরে ধীরে দুর্বল হয়ে পড়ছ! মায়া মহব্বত একটু বেশি উদায় হচ্ছে তোমার মধ্যে?

আকস্মিক এসিপির ক্রোধের কারণ সমুদ্রের নিকট অজানা। হঠাৎ এসিপির রাগান্বিত মুখশ্রী দেখে সমুদ্র নিশ্চুপ হয়ে বসে রইল। এসিপি কথাগুলো বলে বার কয়েক ভারি নিশ্বাস ত্যাগ করে পুনরায় বলে উঠলেন,

–সত্যি করে বল সমুদ্র তুমি কী কোন মেয়ের সঙ্গে রিলেশনে গিয়েছ?

সমুদ্র নতজানু দৃষ্টি সরিয়ে থতমত নয়নে এসিপির দিকে তাকাল। আসলে কী তার মাঝে পরিবর্তন এসেছে! বিষয়টা তার নিকট আশ্চর্যজনক লাগছে। অতঃপর বিহ্বল হয়ে বলল,

–না স্যার। আপনি ভুল বুঝছেন।

এসিপি সমুদ্রের উত্তর পেয়ে স্বল্প শান্ত হয়ে উঠলেন। জিহ্বা দিয়ে ঠোঁট যুগল ভিজিয়ে দীর্ঘশ্বাস ত্যগ করে বলে উঠলেন,

–দেখ সমুদ্র আমি তোমাকে রিলেশনে জড়াতে নিষেধ করছি একটা বিশেষ কারনে। যদি কোন দিন সম্ভব হয় তাহলে তোমাকে কারণটা অবশ্যই বলব। তাছাড়া আমি চাই তোমাকে আমার নিজ ছেলের স্থান দিতে। তাই তো আমি তোমার বিয়ে আমার বন্ধুর মেয়ে সাকিলার সঙ্গে ঠিক করেছি। তার একমাত্র কারণ হচ্ছে সাকিলাও তোমার মতো একজন সিআইডি অফিসার।

কথাগুলো একাধারে বলে কিছুটা থেমে গেলেন এসিপি। প্রায় মিনিট পাঁচেক নিরবতা পালন করলেন। কিঞ্চিৎ সময় পর তিনি সমুদ্রের নেত্র যুগলে তার স্থির দৃষ্টিপাত নিক্ষেপ করে বললেন,

–সমুদ্র আমি চাইছি এই কেসটি সল্ভ হওয়ার পর তোমার আর সাকিলার একটা ব্যবস্থা করে দিতে। তাই যত দ্রুত সম্ভব কেসটা সল্ভ দেখতে চাই।

এসিপির কথা শুনেও সমুদ্র মেহেরের কথা চেপে গেল। মনে মনে মেহেরকে উপেক্ষা করে বলে উঠল,

–জী স্যার। আপনি আমার উপর ভরসা রাখুন।
____________

সমুদ্রের এপার্টমেন্টের সামনে গাড়ি পার্কিং করে গাড়িতে বসে রয়েছে আকাশ। এখন আর রাত্রি গভীর নেই। ঘরির কাটাতে রাত চারটা বাজতে খানিক বাকি। আকাশের চোখে মুখে উপচে পড়া চিন্তার ভাঁজ স্পষ্ট। তার দৃষ্টি জানালার স্বচ্ছ কাঁচ ভেদ করে বাইরের দিকে পরখ করছে। সে বারংবার তার হাত ঘরির দিকে দৃষ্টি নিক্ষেপ করছে। প্রায় এক ঘন্টা পার হয়ে গেল এখনো পর্যন্ত সমুদ্রের আসার নামগন্ধ নেই। তৎক্ষণাৎ কোন গাড়ির আলো দৃশ্যমান হতেই আকাশের হৃদয় মনে একরাশ আশার আলো ঝিলিক দিয়ে উঠল। তার মনে হলো সমুদ্র এসে পড়েছে। মুহূর্তেই আকাশ গাড়ি থেকে নেমে পড়ল।

আকাশের ধারণা সত্যি করে দিয়েছে সমুদ্র। মাত্রই সে গাড়ির পার্কিং করে লিফ্টের যাবার উদ্দেশ্য পা যুগল চলন্ত করেছে। কেমন যেন অজানা আশঙ্কায় অস্থির হয়ে উঠছে তার অন্তরাল। অকারণে তার মস্তিষ্কে চিন্তার উৎপত্তি ঘটেছে। তাই সে দ্রুত পদে পা চালাচ্ছে। তার শরীর কুয়াশার বিন্দু বিন্দু জলে স্বল্প ভিজে গিয়েছে। মোবাইল ফোনের লাইট অন করে চললেও, তার চোখ যুগলে পরিষ্কার ভাবে কিছুই দৃশ্যমান হচ্ছে না। ঘন কুয়াশায় দুই হাত দূরের জিনিসও দেখা দুষ্কর। সবকিছু যেন কুয়াশার শুভ্র চাদরে ঢাকা পড়েছে। কিছুটা পা এগুতেই সমুদ্রের লক্ষ্য হয় তার সামনে কোন মানুষ দাঁড়িয়ে আছে। তৎক্ষণাৎ সমুদ্র তার ফোনের লাইট লোকটার মুখশ্রীর দিকে নিক্ষেপ করল। সঙ্গে সঙ্গে আকাশকে দৃশ্যমান হতেই খানিকটা স্তম্ভিত হয়ে পড়ল সে। ঠোঁট যুগল হাল্কা সংকুচিত নিম্ন স্বরে বলে উঠল,

–তুই এখানে? আর এত বার বার আমাকে কল দিয়ে বিরক্ত করলি কেন?

সমুদ্রের কথা শুনে আকাশ অট্টসরে হেসে উঠল। কন্ঠে কিছুটা কঠোরতা এনে বলল,

–ওহ সরি, স্যার আপনাকে বিরক্ত করার জন্য। আগে তোর ফ্লাটে চল। তারপর না হয় বলি কেন তোকে বিরক্ত করেছি।

আকাশ কথা আগাগোড়া কিছুই বোধগম্য হলো না সমুদ্রের। অতঃপর আকাশের সঙ্গে লিফটে উঠে পড়ল সে।

___________
মেইন ড্রোর খুলে ড্রইং রুমে প্রবেশ করতেই সমুদ্র বিহ্বল হয়ে পড়ল। কারণ সে তো ড্রইং রুমের লাইট অফ রেখে গিয়েছিল, তাহলে অন করছে কে! আকাশ সমুদ্রের মুখশ্রীতে দৃষ্টিপাত নিক্ষেপ করে বলল,

–আমি যা চিন্তা করেছিলাম তাই হয়েছে।

আকাশের বলা বাক্য কর্ণপাত হতেই সমুদ্র দ্রুত ধাবিত হলো মেহেরের রুমে। আকাশও তার পিছু অনুসরণ করে পা জোড়া সংকুচিত করল।

মেহেরের রুমে পা রাখতেই সমুদ্রের মস্তিষ্ক স্বল্প সময়ের জন্য কার্যক্রম বন্ধ করে দিল। এলোমেলো হয়ে মেহের স্বচ্ছ ফ্লোরে উপুড় হয়ে পড়ে রয়েছে! সাথে সাথেই সমুদ্রের হাত পা শীতল হয়ে আসতে আরম্ভ করল। তার হৃদয় স্পন্দন নিমিষেই বন্ধ হয়ে আসার উপক্রম হয়ে উঠল। মুহূর্তেই তার উজ্জ্বল মুখশ্রী ঘন কালো মেঘের ন্যায় পাণ্ডর হয়ে উঠল। বক্ষ পিন্জরে ধক্ক করে উঠল। তৎক্ষণাৎ সে উম্মাতের ন্যায় হাটু ভেঙে মেহেরের দেহের নিকটবর্তী বসে পড়ল। দু হাতে মেহেরের মুখশ্রী আবদ্ধে করে হাল্কা ঝাকিয়ে বলতে লাগল,

–এই পুঁচকি,,,, এই পুঁচকি কী হয়েছে তোমার? পড়ে গিয়েছ কীভাবে?

সমুদ্রের পরিস্থিতি দেখে আকাশ বিরক্তির সঙ্গে বলে উঠল,

–এই ঢং বাদ দে। আর হ্যাঁ মেয়েটার হাত পা মেবি ঠান্ডা হয়ে রয়েছে। সো ওকে আর ফ্লোরে রাখিস না।

আকাশের কথা শুনে এক মুহূর্তের জন্যও সমুদ্র সময় নষ্ট করল না। লহমায় মেহেরকে বিছানার উপর উষ্ণ চাদরে নিবদ্ধ করে,নিজে বিছানার এক কণে বসে মেহেরের গাল যুগল বারংবার আস্তে আস্তে থাপ্পড়াতে লাগল আর অস্কুটস্বরে বলতে লাগল,

–মেহের ওপের ইউর আইস। প্লিজ চোখ খুলো। সরি তোমাকে আর একা রেখে যাব না। ভয় পেয়েছ পুঁচকি? আকাশ একটু পানি নিয়ে আয় তো।

সমুদ্রের কথা অনুযায়ী আকাশ দ্রুত পানি ভর্তি গ্লাস এনে সমুদ্রের হাতে দিল। তৎক্ষণাৎ আকাশের হাত হতে দ্রুত গ্লাস নিয়ে, মেহেরের মুখশ্রীতে ছিটিয়ে দিতে লাগল।

–পুঁচকি ,,,, সরি তো। ওপের ইউর আইস।

লহমায় নেত্র যুগলে পানির স্পর্শ পেয়েই পিপিপি করে চোখ খুলল মেহের। তার ঘন নেত্রপলব বারংবার বুজে যাচ্ছে। কিন্তু একপলক সমুদ্রের দেখা পেতেই তার হৃদয় গহীন তৃপ্ত হয়ে উঠল। তার ঠোঁটের কোণে মুচকি হাসির দেখা মিলল। পরক্ষণেই ভয়ঙ্কর ঘটনার কথার স্মরণ করেই কেঁপে উঠল সে। মেহেরের সেন্স ফিরতেই সমুদ্র স্বস্তির নিঃশ্বাস ত্যাগ করল। মেহেরের দিকে দৃঢ় দৃষ্টি নিক্ষেপ করে নিম্ন কন্ঠে বলল,

–আর ইউ ওকে পুঁচকি?

সমুদ্রের কথা কর্ণপাত হতেই মাথা ডানে নাড়িয়ে মেহের অস্কুটস্বরে বলল,

–হুম।

সমুদ্র আকস্মিক মেহেরের বিছানা থেকে উঠে দাঁড়াল। আকাশেকে সঙ্গে করে বেলকনিতে নিয়ে যাওয়া জন্য পা যুগল চলমান করে, পুনরায় মেহেরের মুখশ্রীতে দৃষ্টিপাত ফেলে শান্ত কন্ঠে বলল,

–রেস্ট নেও তুমি। ভয় পাবার মতো কিছুই নেই, হুম?

বলেই সমুদ্র আকাশকে নিয়ে বেলকণিতে চলে এলো। প্রায় মিনিট পাঁচেক নিরবতা পালন করে পরিবেশন স্তব্ধ রাখতে সক্ষম হলেন তারা। অতঃপর নিরাবতা ভেঙে আকাশ সমুদ্রকে উদ্দেশ্য করে বলল,

–কিছু কী আন্দাজ করতে পেরেছিস?

সমুদ্র নেত্রযুগল বন্ধ রেখে খানিকক্ষণ লম্বা, দীর্ঘ শ্বাস টেনে নিয়ে বলল,

–হুম, বুঝতে পেরেছি। যেই এসেছিল সে নিশ্চয়ই আমার রুম থেকে কেসটার ডকোমেন্ট পেইন ড্রাইভ খুঁজতে এসেছিল। যাইহোক আমি খুব শীঘ্রই মেহেরকে ওর বাড়িতে পাঠানোর ব্যবস্থা করব। এখানে ওকে রাখা একদমই ঠিক হবে না।

সমুদ্রের কথা কর্ণপাত হতেই আকাশ তাচ্ছিল্য মিশ্রিত হাসি হেসে বলল,

–ভাবিকা নিয়ে হুটহাট সিদ্ধান্ত নেওয়া তোর একদমই ঠিক হচ্ছে না। বলে রাখছি তুই কিন্তু পরে আফসোস করবি।

সমুদ্র মুখে গম্ভীরতা টেনে বলল,

–কতবার বলল ডোন্ট কল হার ভাবি। আমি কখনোই প্রস্তাব না। আন্ডারইস্টান্ড?

আকাশ নিমিষেই তার মুখের হাসির সমাপ্ত ঘটাল। পরিশেষে সমুদ্রকে সতর্কতার সহিত বলল,

–ওকে, দেখা যাবে। ওহহ তোকে তো একটা গুরুত্বপূর্ণ তথ্য বলা হয়নি।

–কী তথ্য?

–জানিস আজকে তোর ফ্লাইটে কে এসেছিল?

সমুদ্র আকাশের কথার প্রত্যুত্তরে বলল,

–কে এসেছিল? যারা সকিনা খালাকে হুমকি দিয়ে তাকে শহর ত্যাগ করিয়েছে, তারা!

আকাশ নিজ পকেট হতে ফোন বের করে সমুদ্রের সামনে উপস্থাপন করল। অতঃপর বলল,

–দেখ কে এসেছিল। আমি ছবি তুলে রেখেছি।

(চলবে)

[রিচেক দেই নি, ভুলগুলো ক্ষমার দৃষ্টিতে দেখবেন।]