তুমি নামক অনুভূতি পর্ব-৫১+৫২

0
922

#তুমি_নামক_অনুভূতি
#পর্ব:৫১
#Lutful_Mehijabin (লেখা)
[কপি করা নিষেধ]

ঘড়ির কাঁটায় ছুঁই ছুঁই নয়টা। উন্মুক্ত বেলকনিত ভেদ করে একরাশ শুভ্র, স্বচ্ছ আলোক রশ্মির আগমন ঘটেছে মেহেরের ঘরে। সূর্যের প্রখর তাপ ক্রমশ বৃদ্ধি পাচ্ছে। এমন অবস্থায় উষ্ণ চাদরে প্রলেপে ঢেকে রয়েছে মেহেরের আপাদমস্তক! ইতিমধ্যে গরমে মেহেরের নিদ্রা হাল্ক হয়ে এসেছে। একপর্যায়ে উষ্ণ চাদরে মুড়ি হতে নিজেকে উন্মুক্ত করে নিলো সে। অতঃপর ধীর গতিতে চোখ জোড়া খোলার প্রয়াস চালানো। সেকেন্ড পাঁচেক বাদে চোখ যুগল উন্মুক্ত করে নড়েচড়ে উঠলো মেহের। অবশেষে ঘুমের রেশ কাটিয়ে উঠে বসতে প্রচেষ্টা চালালো। কিন্তু চেষ্টা করে ও ব্যর্থ হলো। মুহুর্তেই সে আন্দাজ করলো তার বা হাতটা বেশ অবস হয়ে এসেছে। মেহের অনুভব করতে পারছেনা তার বা হাত কোথায় অবস্থান করছে! তৎক্ষণাৎ মেহের হাতের বাহু অনুসরণ করে দৃষ্টি নিবদ্ধ করলো। সঙ্গে সঙ্গে মেহের স্তম্ভিত হয়ে উঠলো। কারন তার হাতের কব্জি অন্য কারো দখলে! মেহেরের হাত আষ্টেপৃষ্ঠে আবদ্ধ করে গভীর ঘুমে আচ্ছন্ন সমুদ্র।

কাল রাতে মেহেরকে ফেলে রেখে ওয়াশরুমে গিয়ে ঘন্টা তিনেক শাওয়ারের নিচে ডুবে ছিলো সমুদ্র। প্রিয় মানুষটিকে হারানোর ভয় মারাত্মক ভাবে তাকে আহত করেছে। ক্রমশ উন্মাদ পাগলে পরিণত হচ্ছে সে। কাল রাতে নিজের ভেতরে লুকিয়ে থাকা সুপ্ত অনুভূতি দমিয়ে রাখতে ব্যর্থ হয়েছিল। সমুদ্র এতোটাই নিয়ন্ত্রণ হারা হয়ে গিয়েছিল যে, সে কাল রাতে মেহেরের স্ব শরীরের উপস্থিতি অনুভব করতে পারি নি। ভীষণ মাথার যন্ত্রণায় কাতরাচ্ছিল সমুদ্র। অবশেষে সহ্য করতে না পেরে কয়েক ঘণ্টা অবিরাম শাওয়ার নিয়েছে।
____
নিজ হাতের নাজেহাল অবস্থা টের পেয়ে মেহের হাতটা সরিয়ে নেবার প্রয়াস চালালো। তৎক্ষণাৎ সমুদ্রের মুখশ্রীতে তার অবাধ্য চোখ জোড়া স্থির হয়ে এলো। কাল রাতের বেলা সমুদ্রের বলা প্রতিটি বাক্য মেহেরের কানে প্রতিধ্বনি হতে লাগলো। মুহুর্তেই একরাশ লজ্জা ঘিরে ধরলো তাকে। শুধু লজ্জা নয় সমুদ্রের অবস্থা আন্দাজ করতে পেরে তার বুকের ভেতর ধ্বক করে উঠলো। এক অদ্ভুত অনুভুতির স্বীকার হলো সে। কষ্ট, বিষাদ, আনন্দ, ভয়, লজ্জা সংমিশ্রণ তাকে ঘিরে ধরেছে! এক চিলতে আনন্দের মধ্যে কোথায় থেকে যেন একরাশ জল এসে রাজত্ব করলো তার চোখ যুগলে। তৎক্ষণাৎ মেহেরের ভারি নেত্র পল্লব ভিজিয়ে কয়েক ফোঁটা দুর্বোধ্য রহস্য বিসর্জন হলও ধরনীর বুকে । মেহের কি করবে, কীভাবে সমুদ্রের অস্থিরতা দূর করবে কিছুই ভেবে উঠতে পারল না। দিশেহারা হয়ে সমুদ্রের মুখশ্রীতে ফ্যালফ্যাল দৃষ্টি নিক্ষেপ চোখ জল বিসর্জন দিতে লাগল কাল রাতের ন্যায় বিরতিহীন !

হঠাৎ স্বল নড়েচড়ে উঠলো সমুদ্র। সঙ্গে সঙ্গে মেহেরের হাতটা মুক্তি পেলো। মুহূর্তেই সমুদ্রের তিক্ত চোখের দৃষ্টি ভেসে উঠলো মেহেরের নয়নে। সমুদ্র হাত ছাড়ে দিয়েই ফ্লোর থেকে উঠে দাঁড়াল।‌ মেহেরের চোখ জল লক্ষ্য করেও মুখ দিয়ে টু শব্দ ও নির্গত করলো না সমুদ্র। তড়িঘড়ি হাত ঘড়ির দিকে তাকিয়ে বিরক্তি প্রকাশ করে মেহেরের দিকে কঠো দৃষ্টিপাত ফেললো। আজ দিনের আলোয় তার লক্ষ্য হলো তার পুচকির চোখে কোন ভয় নেই।‌ শুধু মাত্র জলে ছলছল করছে মেয়েটা সম্পূর্ণ গাল যুগলে। সমুদ্র মেহেরের কান্নার বস্তুত কারণ খুঁজে পেলো না! মেহেরের প্রতি একরাশ অভিমান নিয়ে দ্রুত রুম ত্যাগ করতে পা জোড়া বাড়াল সে।

— এই যে শুনছেন?

মেহেরের কম্পনিত কন্ঠস্বর কর্ণপাত হতেই সমুদ্রের পা জোড়া আপনা আপনি থেমে গেলো। স্তব্ধ হয়ে মূর্তির ন্যায় দাঁড়িয়ে পড়লো সে। দু পকেট হাত যুগল রেখে ভাববিলাশীন হয়ে অপেক্ষা করতে লাগলো মেহেরের পরবর্তী বানী কর্ণপাত করতে।

সমুদ্রকে স্তম্ভ হয়ে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে দীর্ঘশ্বাস ত্যাগ করলো মেহের। সাদা শার্ট, কালো প্যান্ট, হাত ঘড়ি পরিহিত সুদর্শন পুরুষটার মুখশ্রীতে নিত্যদিনের ন্যায় গম্ভীর্য স্পষ্ট ফুটে উঠেছে! রাতে শাওয়ার নেওয়ার রেশ এখনো অবধি কেটে উঠে নি। ফলে সমুদ্রের ছোট ছোট চুলগুলো সীমান্তে এসে এলোমেলো হয়ে পড়েছে। নিত্যদিনের চেয়েও সমুদ্রকে দ্বিগুণ আকর্ষণীয় লাগছে মেহেরের নিকটবর্তী।
মুহুর্তেই রাতের ঘটনা ভেবে মেহেরের হৃদয় মন বিষন্ন হয়ে উঠলো। সে অবাক না হয়ে পাড়ল না। যে লোকটা রাতের বেলা উম্মাদ হয়ে উঠেছিল! গভীর রাতে যে লোকটা পরিপাটি হয়ে তার রুমে এসে ঘুমে আচ্ছন্ন হয়ে পড়েছিল! যে কিনা একটু আগ অবধি ফ্লোরে বসে বিছানায় মাথা রেখে তার হাত যুগল আষ্টেপৃষ্টে ধরে ঘুমিয়ে ছিলো। সে লোকটা এখন কিনা তাকে দেখেও চিনতে পারছে না! অতঃপর মেহের নিজেকে শক্ত রেখে ফির বলে উঠলো,

— রাতে খেয়েছেন?

মেহেরের অধিকার মিশ্রিত বাক্য সমুদ্রের কর্ণকুহরে পৌঁছতে তার ভ্রূ জোড়া কুঁচকে এলো। মুহূর্তেই কর্কশ কন্ঠ প্রত্যুত্তর করলো,

— আমার কথাও বুঝি আপনার স্মরণ হয়! আপনি তো সারাদিন আপানাতে মত্ত থাকেন।

সমুদ্রের ‘আপনি’ সম্বোধন যেন মেহেরের হৃদয়কে ছিন্ন বিচ্ছিন্ন করে উঠলো। ইতিপূর্বে এই আপনি সম্বোধন তার হৃদয়ে সুপ্ত অনুভূতি জাগ্রত করে তুলেছিল। যতবার সমুদ্র তাকে আপনি বলে সম্বোধন করেছে ঠিক ততোবার শীতল হাওয়াই ভরে উঠেছিল মেহেরের অন্তরাল। তাহলে এখন সহ্য করতে পারছে না কেন? মেহেরের অগোচরে তার চোখ জোড়া হতে অবিরাম বর্ষণ ঝরছে। চোখের জল উপলব্ধি করতে ব্যর্থ সে! মেহের দু হাতের তালু দিয়ে চোখের পানি মুছে নিলো।পুনরায় বলে উঠলো,

— আপনি এমন কেন, হুম? কেন নিজের খেয়াল রাখতে চান না?

মেহেরের কান্নারত কন্ঠস্বর পেয়ে সমুদ্র থতমত হয়ে উঠলো। আজব তো! মেয়েটা কাঁদছে কেন? সে তো কান্না করার মতো কোন কথা বলে নি। মেহেরের কান্নার পেছনের রহস্য আন্দাজ করতে ব্যর্থ হলো সে। তৎক্ষণাৎ তার স্মরণ হলো রাতের ঘটনা। রাতে ভীষণ মাথা ব্যথা আক্রমণ করেছিল তাকে। শোয়াইব খাবার পদক্ষেপ বুঝে উঠতে পারছে না সমুদ্র। এতে বেশ দুশ্চিন্তা গ্রস্ত সে। মেহের যে কাল রাতে স্ব শরীরের বেলকনিতে উপস্থিত হয়েছিল তা এখন অবধি সমুদ্রের ধারণার বাইরে। সমুদ্র দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলে উঠলো,

— আপনাকে চিন্তা করতে হবে না। আপনি শুধু মাত্র চিরকাল আমার সঙ্গে সু্ঃখ, দুঃখ নিবারণের জন্যে প্রস্তুত হোন। এখনো অবধি অনেক সময় বাকি।

বলেই সমুদ্র মেহেরের দিকে ফিরলো। পা জোড়া ধাবিত করে মেহেরের নিকটবর্তী এসে দাঁড়ালো। পকেট থেকে বা হাত বের করে মেহেরের মাথায় আলতো করে ছুয়ে ম্লান হাসির সহিত বলল,

— আপনি যদি আমাকে থেকে দূরে যাবার কথা মস্তিষ্কে এনে থাকেন। তাহলে একটা কথা শুনে রাখুন, আপনি আমার থেকে দূরে গিয়ে ও শান্তি পাবেন না। নয়ন তৃষ্ণায় ছটফট করবেন আমাকে দেখার জন্য। কিন্তু মনে রাখবেন ম্যাম আপনি একটিবার আমার থেকে দূরে সরে দেখুন। আপনি দূরে যাবার পূর্বেই আমি কোন এক নির্জনে হারিয়ে যাব। তখন চেষ্টা করেও আমাকে খুঁজে পাবেন না। আপনি দূরে যাওয়া পূর্বে আপনার সমুদ্র অজানা এক অজানা রাজ্যে পারি জমাবে।

কথাগুলো বলেই রুম থেকে প্রস্থান করলো সমুদ্র। মেহের বাক্যগুলোর অর্থ খুঁজে পেলো না। কোন সারমর্ম দেখা দিলো না তার মস্তিষ্ক। শুধু মাত্র সমুদ্রকে হারিয়ে ফেলার এক অস্থিরতা হানা দিলো তার অন্তরে।
_____________

ঘড়ির কাঁটায় ছুঁই ছুঁই বারো। ক্লাসের মধ্যে উদাসীন হয়ে বসে রয়েছে মেহের। আজ দিশানি এবং তিতাস কেউ আছে নি। এমনকি সমুদ্রের পিরিয়ড অতিবাহিত হয়ে গিয়েছে কিন্তু সমুদ্র ক্লাস নিতে আসে নি। এতে করে বেশ ব্যথিত সে। তাছাড়া স্টুডেন্টরা বলা বলি করছে আজ নাকি সমুদ্র স্যার আসেননি। কিন্তু সমুদ্র সকালে মেহেরকে খাইয়ে দাইয়ে স্কুলে নিয়ে এসেছিল। বর্তমানে মেহের চিন্তা করছে, সমুদ্র কি তাকে স্কুল থেকে নিতে আসবে! কারণ আজ স্কুল কর্তৃপক্ষ তাড়াতাড়ি ছুটি ঘোষণা দিয়েছে।
________________

স্কুল ছুটি দিয়েছে কিৎক্ষণ পূর্বে। পুরো স্কুল জুড়ে শুলশান নিরবতা। প্রধান শিক্ষকের কক্ষে মাথা নিচু করে বসে রয়েছে মেহের। তার পাশ্ববর্তী স্কুলের কয়েক জন স্টাফ শক্ত চাহনি নিক্ষেপ করে বসে রয়েছে। বিষয়টা বেশ সন্দেহ জনক লাগছে মেহেরের নিকট! পুরো কক্ষ জুড়ে মেহের সহ সাত জন মানুষের উপস্থিত। সবাই স্তব্ধতা পালন করতে ব্যস্ত। এ পরিস্থিতিতে মেহেরের গলা শুকিয়ে কাঠ হয়ে এসেছে। তার মুখশ্রীতে ভীত ছাপ স্পষ্ট ফুটে উঠেছে! বারংবার হাত ঘড়ির দিকে দৃষ্টিপাত নিক্ষেপ করছে মেহের। প্রায় আধ ঘন্টা পার হয়ে গিয়েছে কিন্তু এখনো সমুদ্রের আসার নাম গন্ধ নেই। মেহেরের হৃদয় মন অজানা আশঙ্কার আবির্ভাব ঘটেছে। বারবার প্রধান শিক্ষকের দিকে লক্ষ্য করছে সে। স্কুল ছুটির পর সমুদ্র নাকি অফিস রুমে তাকে অপেক্ষা করতে বলেছে। এই প্রস্তাব দিয়ে মেহেরকে টিচার্স রুমে নিয়ে এসেছিন স্কুলের প্রধান শিক্ষক জামাল স্যার। একপ্রকার জোর করে শিক্ষকের মুখের সামনে বসে রয়েছে মেহের। অপেক্ষার প্রহর যেন শেষ হওয়ার নাই নিচ্ছে না। তাই মেহের মনে মনে সিদ্ধান্ত নিলো একাই বাসার চলে যাবে। দরকার পড়লে বাসার ড্রোরের সামনে বসে থাকবে। কিন্তু এখানে থাকতে নারাজ! সিদ্ধান্ত অনুসারে ঠোঁট যুগল প্রসারিত করে নিম্ন কন্ঠে স্যারের উদ্দেশ্যে মেহের বলে উঠলো,

— স্যার, আমি একেই যেতে পারবো। আপনি ফোন করে সমুদ্র স্যারকে একটু বলে দিবেন প্লিজ। আমি আসি স্যার।

কথাগুলো বলেই উঠে দাঁড়ালো মেহের। পা জোড়া দু কদম এগিয়ে নিতেই, জামাল সাহেবের কর্কশ ধ্বনিতে স্তম্ভ হয়ে দাঁড়িয়ে পড়লো সে। তৎক্ষণাৎ জামাল সাহেব মেহেরের নিকটবর্তী এসে পকেটে হাত দিয়ে কিছু একটা বের করে মেহেরের কপালে ঠেকিয়ে কর্কশ উঠলো,

— এই মেয়ে, তোকে কি আমি যাওয়ার অনুমতি দিয়েছি। কি ভাবছিস তুই, তোকে আমি স্নেহ মমতা করে এখানে নিয়ে এসেছি?

জামাল সাহেবের এমন আচরণে চমকে উঠেছে মেহেরের। আচমকা কপালে শক্ত পদার্থের ছোঁয়া পেয়ে তার চোখ জোড়া আপনা আপনি বন্ধ হয়ে এসেছে। তার সঙ্গে কি ঘটতে যাচ্ছে তা আন্দাজ করতে প্রায় মিনিট এক সময় অতিবাহিত হয়েছে! স্যারের পরিস্থিতি বোধগম্য করতে ব্যর্থ সে। প্রিয় একজন স‌্যারের নিকট হতে এমন ব্যবহারে পেয়ে কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে পড়েছে মেহের। অনুভব করছে তার কপালে বন্দুক ঠেকানো! ফলে থরথর করে কাঁপছে সে। আপ্রাণ চেষ্টা ফলে নিজেকে স্বাভাবিক রেখে মেহের কাঁপা কন্ঠে বলল,

— স্যার আপনি এমন বিহেভ করছেন কেন? আমি কি কোন ভুল করেছি?

মেহেরের কম্পমান কন্ঠেস্বর পেয়ে অট্টহাসিতে ফেটে পড়লেন জামাল সাহেব। মুহুর্তেই তার হাসির ঝংকার কক্ষ জুড়ে প্রতিধ্বনি তুলতে লাগলো। হাস্যরত অবস্থায় এক হাত‌ দ্বারা মেহেরের কপালে রিভালবার ঠেকিয়ে অন্য হাত দিয়ে পকেট থেকে মোবাইল ফোনটা বের করলো সে। কাউকে কল দিতেই এক সেকেন্ড কেউ ফোন রিসিভ করলো। অতঃপর ফোন লাউড স্পিকারে রেখে জামাল সাহেব বলতে আরম্ভ করলো,

— তুমি তো কোন অন্যায় করো নি মেহের বুড়ি। অন্যায় তো করেছে তোমার হাজব্যান্ড অর্থাৎ তোমার সমুদ্র স্যার।

আকস্মিক সমুদ্রের নামটা মেহেরের কর্ণকুহরে পৌঁছানো মাত্রই তার চোখ জোড়া জলে ছলছল করে উঠলো। অজানা আশঙ্কা দ্বিগুণ হয়ে আষ্টেপৃষ্ঠে তাকে ঘিরে ধরলো তাকে। শুকনো ঢোক গিলে স্তব্ধ হয়ে ভবিষ্যতে কী ঘটতে যাচ্ছে তা বোধগম্য করতে প্রয়াস করলো।

জামাল সাহেব মেহেরের মুখশ্রীতে পৈশাচিক দৃষ্টিপাত নিক্ষেপ করে ফির বলতে লাগলো,

— আরে বুড়ি। তুমি ভয় পাচ্ছ কেন? চিন্তা করো না তোমার স্বামী সমুদ্র খুব জলদি তোমাকে নিতে আসবে। তুমি শুধু অপেক্ষা করো।

বলেই পৈশাচিক আনন্দে ফেটে পড়লো জামাল সাহেব। লহমায় ফোনের বিপরীত পার্শ্ব হতে ভেসে উঠলো পুরুষালী ভারী কন্ঠস্বর। সমুদ্র উত্তেজিত গলায় বলে উঠলো,

— বিশ্বাস কর তোর জন্যে, আমার জান যদি একটু আঘাত প্রাপ্ত হয় রে জামাল। টাস্ট মি আই কিল্ড ইউ! তুই জানিস তুই কত্ত বড়ো অন্যায় করে ফেলেছিস? এই কাজ মস্তিষ্ক আনার পূর্বে তোর একবার ভেবে নেওয়া উচিত ছিলো তোর পরিস্থিতি কি হতে পারে। তুই তো জানিস না তুই কি নিয়ে খেলায় মত্ত হয়েছিস! তুই আবরার সমুদ্রের জান নিয়ে খেলায় মেতে উঠেছিস। সময় থাকতে ভদ্র হয়ে যা।

সমুদ্রের কথার প্রেক্ষিতে জামাল সাহেব দ্বিগুণ ক্রোধে ফেটে পড়লো। মেহেরের কপালে রিভলবারটা শক্তি দিয়ে চেপে ধরলো। অতঃপর দাঁত দাঁত চেপে বলে উঠলো,

— দেখ সমুদ্র বেশি কথা বলবি না। তোর মুখে এমন কথা একদমই বেমানান। তুই তো এক নম্বরের বিশ্বাস ঘাতক। তুই আমাকে ধোঁকা দিয়েছিস। শিক্ষক হিসেবে আমার বিদ্যালয়ে জয়েন্ট করে অভিনয় করে গিয়েছিস তিন মাস। আমার তো মনে হয় তোর সিআইডি অফিসার না হয়ে অভিনেত্রী হিসেবে নিযুক্ত হওয়া উচিত ছিলো। সেদিন নিরবের অনুষ্ঠানে গেলে জানতে পারতাম না তুই গোয়েন্দা! শুধু তাই নয় তোর বউ যে আমার বিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী তাও জানতে পারতাম না।

বলেই পরপর দুটো ঢোক চেপে জামাল সাহেব বলতে লাগলো,

— এসব কথা বাদ দে সমুদ্র। আমি যা বলছি তাই কর। দ্রুত পেইনড্রাইভ নিয়ে আমার কাছে আয়। নয়তো তোর জানকে আমি পৃথিবীর মায়া ত্যাগ করে চিরকালের জন্য বিদায় নিতে সাহায্য করবো। নাও জলদি কর।
________________
মিনিট দশের মধ্যে অফিস রুমের কক্ষে হাঁফাতে হাঁফাতে উপস্থিত হলো সমুদ্র। সঙ্গে সঙ্গে ছদ্মবেশী স্কুলের স্টাফ গুলো প্রত্যেকে রিভলভার বের করে সমুদ্রের দিকে তাক করলো। সমুদ্র প্রত্যেকে উপেক্ষা করে মেহেরের দিকে দৃষ্টিপাত ফেললো। মেয়েটা ভয়ে চুপসে গিয়েছে। মেহেরের মুখশীতে গভীর দৃষ্টি আকর্ষন করতেই সমুদ্রের বুকের ভেতর ধ্বক করে উঠলো। নিজের প্রেয়সীকে হারানোর এক ভয়ঙ্কর ভয় তার হৃদয় মনে জাগ্রত হয়ে উঠলো।

অন্যদিকে সমুদ্রের অসহায় দৃষ্টি লক্ষ্য করতে কু ডেকে উঠলো মেহেরের অন্তরাল! ইতিমধ্যে তার বক্ষ পিন্জরের হৃদয় স্পন্দন তড়িৎ বেগে ছুটতে আরম্ভ করেছে। ভয়ে তার হাত পা থরথর করে কাঁপছে! সমুদ্রকে দেখা মাত্রই তার চোখ বেয়ে বৃষ্টি গড়িয়ে পড়ছে ধরণীর বুকে। বিশেষ করে লোকগুলো যখন সমুদ্রের দিক রিভলভার তাক অরেছে ঠাক তার পর থেকেই মেহের ভেঙে পড়েছে। অতঃপর কান্না রত অবস্থায় মেহের সমুদ্রকে উদ্দেশ্যে বলে উঠলো,

— আমি বাসায় যাব। আমার বড্ড ভয় করছে। আমাকে বাসায় নিয়ে চলুন।

মেহেরে কথার প্রত্যুত্তরে সমুদ্রে ম্লান হাসির সহিত বলে উঠলো,

— দূর পাগলী! ভয়ের কিছু নেই। আমি আছি তো,,,

সমুদ্রের কথার মধ্যে জামেল সাহেব বলে উঠলো,

— তোদের প্রেম আলাপ পরে। আগে আমার পেইনড্রাইভ দে। নয়তো তোর বউকে তোর সামনে ছটফট করে মারবো। তোর জানের রক্তে রঞ্জিত করবো তোকে।

জামাল সাহেবের কথার প্রেক্ষিতে সমুদ্রের একটা ছোট পেইন ড্রাইড জামেল সাহেবের সামনে ধরলো। ফির কাতার কন্ঠে বলে উঠলো,

— আগে মেহেরকে ছেড়ে দে। ওর কপাল থেকে গান সরা।

তৎক্ষণাৎ মেহেরের কপাল হতে রিভলভার সরিয়ে সমুদ্রের নিকটবর্তী হাজির হলো জামাল সাহেব। এক গাল হেসে সমুদ্রের হাত হতে পেইনড্রইভ নেওয়া জন্য হাত জোড়া প্রসারিত করতেই গুলির বর্ষণে কেঁপে উঠলো ধরনী! লহমায় মেহের কানে হাত দিয়ে সমুদ্রের দিকে ফ্যালফ্যাল দৃষ্টিতে তাকিয়ে ঢুকরে কেঁদে উঠলো। ইতিমধ্যে সমুদ্রের টিমের সঙ্গে বন্ধুত্ব যুদ্ধে মেতে উঠেছে জামেল সাহেব এবং তার দলবল! সমুদ্র রিক্স নিয়ে পুরো টিম সহ উপস্থিত হয়েছে। যা জামাল সাহেবের নিকট অজানা ছিলো।

চারপাশে গুলির শব্দে ভরে উঠেছে। সমুদ্র রিভলভার হাতে করে গুলি বর্ষণের সহিত মেহেরের উপর লক্ষ্য রাখলো। হঠাৎ মেহেরের অবস্থান পরিলক্ষিত করে সমুদ্র বলে উঠলো,

— হেই সস্টুপিড, এখনো দাঁড়িয়ে রয়েছে কেন! বাইরে যাও। আই সেইড গেট আউট। প্লিজ পুচকি।

সমুদ্রের কথায় প্রত্যুত্তরে মেহের মলিন কন্ঠে বলে উঠলো,

— আমি আপনাকে ছাড়া বের হবো না।

মেহেরের কথা শুনে মাথার চুলগুলো স্বল্প টেনে ধরলো সমুদ্র। কি পদক্ষেপ নেওয়া উচিত বুঝে উঠতে পারছে না সে। মুহূর্তেই রিভলভার পকেটে ঢুকিয়ে জামাল সাহেবের দৃষ্টির অগোচরে মেহেরের নিকটবর্তী হাজির হলো। দ্রুত মেহেরের হাত আলতো স্পর্শে টেনে ধরলো। অবশেষে অতি দ্রুত মেহেরের হাত মুঠো বন্ধি করে পা জোড়া ধাবিত করলো সদর দরজার উদ্দেশ্য।

কিন্তু বিষয়টা জামাল সাহেবের চক্ষু এড়ালো না। কিছুদূর এগুতেই জামাল সাহেব চিৎকার করে বলে উঠলো,

— সমুদ্র স্টপ। এর শাস্তি তোকে পেতেই হবে। আমি মরলে মরবো তাও পৃথিবীতে তোর সবচাইতে দুর্বল স্থানে আঘাত না করে আমি কিছুতেই মরবো না।

বলেই জামাল সাহেব মেহেরের উদ্দেশ্য গুলি নিক্ষেপ করে অট্টহাসিতে ফেটে পড়লো। গুলির পরিস্থিতি বুঝে উঠতে পেরে তৎক্ষণাৎ মেহেরকে নিজের বুকের আড়ালে মেহেরকে আবদ্ধ করে ফেললো সমুদ্র।

সঙ্গে সঙ্গে একটা সুক্ষ্ম গুলি সমুদ্রের শার্ট ভেদ করে ছুঁয়ে দিলো তার দেহ। মুহূর্তেই সমুদ্রের শুভ্র, স্বচ্ছ শার্ট রক্তে রঞ্জিত হয়ে উঠলো। সমুদ্র তখনও স্থির দৃষ্টিতে মেহেরের দিকে তাকিয়ে। রক্ত ভেজা সাদা শার্ট খাঁমচে ধরে সমুদ্র ব্যথিত কন্ঠে বলল,

— ভয় পেয় না পুচকি। আই,, ম,,, ওকে,,

সমুদ্রের কন্ঠস্বর শুনেই মেহেরের হৃদয় গহীন ক্ষত বিক্ষত হয়ে উঠলো। লোকটা প্রতিটি বাক্যে ব্যথাতুর ভাব স্পষ্ট! মেহের সইতে পারলো সমুদ্ররে বলা শব্দগুচ্ছ। লোকটা বুঝি খুব কষ্ট হচ্ছে? কিৎক্ষণে সমুদ্রের রক্তাক্ত দেহের দিকে তাকাতেই মেহেরের চোখের দৃষ্টি ঝাপসা হয়ে এলো। আকস্মিক এমন পরিস্থিতি স্তব্ধ হয়ে উঠেছে পরিবেশ। সমুদ্রের টিমের সবাই হতবম্ব হয়ে নিজ নিজ অবস্থান দাঁড়িয়ে রইলো। শুধু মাত্র মেহের কান্না বেগ বৃদ্ধি করে হুমড়ি খেয়ে পড়লো সমুদ্রের উপর।

(চলবে)

[রিচেক দিতে পারি নি। তাই ভুলগুলো ক্ষমার দৃষ্টিতে দেখবেন।]

#তুমি_নামক_অনুভূতি
#পর্ব:৫২
#Lutful_Mehijabin (লেখা)
[কপি করা নিষেধ]

হাসপাতালের করিডোরে বসে অনবরত কেঁদে যাচ্ছে মেহের। তার ক্রন্দনের গুমোট ধ্বনিতে সম্পূর্ণ কক্ষে বিষন্নতা আবির্ভাব ঘটেছে। ঘন্টা খানিক পূর্বে সমুদ্রের ইমার্জেন্সিতে নেওয়া হয়েছে সমুদ্রকে। গুলি নির্গত হয়নি সমুদ্রের দেহ হতে। তাই প্রচুর রক্তপাত ঘটেছে! তখন থেকেই উন্মাদের ন্যায় কেঁদে চলেছে মেহের। ভীষণ করুণ পরিণতি ঘটেছে মেয়েটি। সমুদ্রের টিমের মেম্বারগন মেহেরের পার্শ্ববতী হওয়া সত্ত্বেও মেহেরের কোন হেলদোল নেই! যে মেয়েটা সর্বদা নিজের অনুভূতি দমিয়ে রাখতে ব্যাস্ত থাকে, বর্তমানে সেই মেয়েটি বহু লোকের সম্মুখে কেঁদে চলছে অবিরাম!
__
মিনিট পাঁচেক পূর্বে নিজ কর্ম সেরে হাসপাতালে উপস্থিত হয়েছেন শোয়াইব খান। দরজার নিকটবর্তী দাঁড়িয়ে মেয়ের দিকে পলকহীন দৃষ্টিতে তাকিয়ে রয়েছেন তিনি। মেয়েটার কান্না রত মুখ তাকে ক্ষত বিক্ষত করে তুলেছে বারংবার! কয়েক ঘন্টার ব্যবধানে মেয়েটার এমন বেগতিক পরিস্থিতি মোটেও প্রত্যাশা করেন নি তিনি। মেহেরের মুখশ্রীতে ক্লান্তির গাঢ় ছাপ স্পষ্ট! চোখের জলে তার মুখশ্রী ভিজে উঠেছে। অতিরিক্ত ক্রন্দনের ফলে মেহেরের গাল যুগল কিঞ্চিৎ রক্তিম আভা ধারন করছে ইতিপূর্বে। মেয়েটার চোখের জল সহ্য করতে পারছেন না শোয়াইব খান।

মেহেরের দু পাশে বসে ছিলো আকাশ এবং রিয়া। মেহেরের শান্ত করার প্রয়াস চালাচ্ছে তারা। কিন্তু মেয়েটাকে থামাতে ব্যর্থ তাঁরা। ধীর গতিতে মেহেরের পাশে গিয়ে বসলেন শোয়াইব খান। আচমকা মেহেরের হাত দুটো আঁকড়ে ধরলেন। অতঃপর আকাশকে উদ্দেশ্যে করে ধমক স্বরে বললেন,

— আকাশ! তোমার মধ্যে কি বিন্দু পরিমান কমনসেন্স নেই? তুমি এখানে বসে লুডু খেলছো? আশ্চর্য, আমার মেয়েটার শরীর নেতিয়ে পড়েছে তাও ওকে কেবিনে নিচ্ছো না! গো, দ্রুত একটা কেবিনের ব্যাবস্থা করো।

বিষন্ন হৃদয়ের ফলে শোয়াইব খানের কথা ঠিক মতো লক্ষ্য করে নি আকাশ। স্যারের অনুমতি পেয়ে এক মুহূর্তও নষ্ট করে নি সে। দ্রুত পদে রুম থেকে প্রস্থান করেছে কেবিন বুক করার উদ্দেশ্যে।

ইতিমধ্যে শোয়াইব খানকে সম্মান জানিয়ে দাঁড়িয়ে পড়েছে সকলে। হঠাৎ স্যারের গর্জনে মুখ নিচু করে রয়েছে সবাই। শোয়াইব খান মেহেরের হাত আঁকড়ে ধরে মেয়েটার নিকটবর্তী বসে রয়েছেন। টিমের সকলের উপস্থিতি তাকে ভীষণ বিরক্ত করছে। ফলে অত্যধিক ফুসছেন তিনি! শান্ত পরিবেশ হওয়া সত্ত্বেও একপর্যায়ে তিনি সবাইকে উদ্দেশ্যে করে কর্কশ গলায় বলে উঠলেন,

— ইডিয়েস্ট! তোমরা এখানে মূর্তির মতো দাঁড়িয়ে আছো কেন? দেখছো মেয়েটা কাঁদছে, তাহলে অযথা রুমের মধ্যে ট্রাফিক জ্যাম সৃষ্টি করছো কেন?

শোয়াইব খানের কথার অর্থ বুঝতে পেরে এক মুহূর্তও দেরি করেন নি কেউ। শুধু মাত্র কক্ষ হতে বিদায় নেওয়ার পূর্বে রিয়া সাহস সঞ্চয় করে বলেছিল,

— স্যার আমি কী থাকতে পারি। মেয়েটাকে তো কিছু খাইয়ে দিতে হবে। তাছাড়া আমি থাকলে ওর সাহায্য সহযোগিতা করতে পারবো।

রিয়ার মলিন কন্ঠস্বর শুনেই গরম চাহনি নিক্ষেপ করেছেন শোয়াইব খান। বর্তমানে কাউকে সহ্য করতে পারছেন না তিনি। অবশেষে রিয়ার প্রত্যুত্তরে উপেক্ষা কৃত কন্ঠে বলে,

— তোমার সাহস হয় কি করে আমার সঙ্গে উঁচু গলায় অথা বলার! ওকে খাইয়ে দেবার জন্যে আমি আছি। তোমার চিন্তা করতে হবে না। এখন জাস্ট এক সেকেন্ডের মধ্যেই ঘর ফাঁকা করো। নাহলে,,

শোয়াইব খানের সম্পূর্ণ বাক্য শেষ করার আগেই প্রস্থান করেছে রিয়া। পরক্ষণেই শোয়াইব খান হাফ ছেড়ে বেঁচেছে! তার মেয়েটা এখন অবধি মাথা কাত করে পলকহীন নয়নে বিরতিহীন কেঁদে যাচ্ছে। সন্তানের বিষাদগ্রস্ত চেহারা বোধহয় কোন পিতা সহ্য করতে পারেন না। শোয়াইব খানের ক্ষেত্রে ও ব্যাতিক্রম কিছু পরিলক্ষিত হয় নি। মেয়েটা এমন ক্লান্ত চেহারা তিনিও সহ্য করতে পারছেন না। সমুদ্রের আহত হবার কথা শুনে ব্যাপক আনন্দিত হয়েছিলেন তিনি। মনে মনে প্রার্থনা করেছিলেন সমুদ্রের মৃত্যুর সুসংবাদ কর্ণপাত করতে। এমনকি গাড়িতে পরিবহন রত অবস্থায়ও তিনি নিজ স্বার্থে তার প্রাণ প্রিয় অফিসার সমুদ্রের মৃত্যু কামনা করে এসেছেন। নির্দয় নির্মম পিতার ন্যায় নিজ মেয়েকে বিধবা রূপে দেখতে তৃষ্ণার্ত হয়ে পড়েছেন। সমুদ্রের অনুপস্থিতিতে জামাল সাহেব এবং তার দলবলের সকালকে কারাগারে বন্দি করার দায়িত্ব তার উপর ভূষিত। দীর্ঘ কয়েক বছর ব্যাপি চলমান কেস সমাধান করতে পেরে ভীষণ আনন্দিত ছিলেন শোয়াইব খান। সমুদ্রের কঠোর পরিশ্রমের ফল হিসেবে তারা জামাল সাহেবের ন্যায় নারী পাচারকারী এবং ড্রাগস ব্যবসায়ীকে আটক করতে পেরেছেন। প্রায় বছর পাঁচ যাবত এই অপরাধের নিযুক্ত ছিল জামাল সাহেব। একজন আদর্শ শিক্ষকের আড়ালে তার মুখোশ উন্মোচন করার ফলে এতোক্ষণে তা খবরে হেডলাইন স্থান নিয়েছে! সমুদ্রের তথ্য মতে জানা গিয়েছে জামাল সাহেব এসব কর্মসূচি বিদ্যালয়ের সংঘটিত করতো। বেসরকারি বিদ্যালয় হওয়ার ফলে বিষয়টা সাধারণত জনতা আন্দাজ করতে ব্যর্থ হয়েছে। এককথায় জামাল সাহেব শিক্ষক নামের কলঙ্ক! তিনি তার বিদ্যালয়ের অসহায়, নিম্ন শ্রেণীর পরিবারের ছাত্রীদের পাচার করতেও পিছু পা হন নি। কেসটা সমুদ্রের কাছে হস্তক্ষেপ হতেই সমুদ্র জামাল সাহেবের বিরুদ্ধে তথ্য কালেক্ট করতে তার বিদ্যালয়ের শিক্ষক হিসেবে নিযুক্ত হয়। সমুদ্রের সন্দেহের পিছনের রহস্য হচ্ছে সকিনা বেগমের স্বামী। তার থেকেই জামাল সাহেবের সন্ধান পায় সে।
সকিনা বেগমের স্বামীও জামাল সাহেবের অপকর্মের সঙ্গে জড়িত ছিলেন। একটা সময় তিনি কোন এক অজানা কারণে অনুতপ্ত হন। এরপর বিষয়টা সমুদ্রকে জানান এবং নিজ অপরাধ স্বীকার করে। স্বীকারোক্তির বিষয়টা জামাল সাহেব আন্দাজ করতে পেরে সকিনা বেগমের স্বামীকে পৃথিবী থেকে আজীবনের জন্য বিলুপ্ত করে দেন।
অতঃপর দ্বিগুণ ক্ষোভ নিয়ে সমুদ্র চতুরতার সঙ্গে কেসটা তদন্ত করে। জামাল সাহেবের বিরুদ্ধে সম্পূর্ণ তথ্য কালেক্ট করে একটা পেইনড্রাইভে তা সংরক্ষণ করে। কেসটার শুরু থেকে শেষ অবধি সকল তথ্য পেইনড্রাইভের মধ্যে সংরক্ষিত ছিলো। জামাল সাহেব সমুদ্রের আসল পরিচয় না জানলেও পেইনড্রাইভের সম্পর্কে তথ্য ঠিকই পেয়ে যায়। অতঃপর নিজের লোক লাগিয়ে সিআইডি অফিসার সমুদ্রের বাসা থেকে পেইনড্রাইভ চুড়ি করতে উঠে পড়ে লাগে। এই কাজটা জামাল সাহেব তার নিম্ন শ্রেণীর কর্মচারীদের উপর অর্পিত করেন। তাই সিআইডি অফিসার সমুদ্র সম্পর্কে আগা গোড়া সম্পূর্ণ তথ্য তার অজানা ছিলো।
____
মেয়েকে এমন মূর্তি ধারণ কৃত অবস্থা দেখে ইতিমধ্যে শোয়াইব খানের হৃদয় হীন তোলপাড় আরম্ভ করে দিয়েছে। মেয়েটা যেন এক নির্বাক ম্লানিমার ছায়ায় পরিনত হয়েছে। চোখ যুগল বেয়ে ঠিকই জল বিসর্জন হচ্ছে কিন্তু মেয়েটার মুখে কোন টু শব্দ নেই! মেয়ের অশ্রুকণা শোয়াইব খান সহ্য করতে পারছেন না। তার বুকের বা পাশটা জ্বলে পুড়ে ছারখার! শোয়াইব খান নিজেকে সংযত রেখ মেহেরের দু গালে হাত দ্বারা আবদ্ধ করে নিলেন। তখন অবধি মেহের নিরবে কেঁদে চলছে। শোয়াইব খান ধীর গতিতে মেয়ের অশ্রু মুছে যাচ্ছেন। কিন্তু আশ্চর্যে বিষয় হচ্ছে মেহের থামাতে নারাজ। অশ্রুকণার বিন্দু বিন্দু ফোঁটা ইলশেগুঁড়ি বৃষ্টির ন্যায় মেয়েটার গাল যুগল ভিজিয়ে চলছে বারংবার! একপর্যায়ে নিজেকে ধাতস্ত রেখে শোয়াইব খান নরম স্বরে বলে উঠলেন,

— ইশ, আমার লক্ষি আম্মুটা কাঁদছে কেন? ভয় পেয়েছো বুঝি?

শোয়াইব খানেক প্রত্যুত্তর মেহের নিরব ভঙ্গিমায় পূর্বের অবস্থায় রয়েছে। বিষয়টা পরিলক্ষিত করে এক গভীর,লম্বা দীর্ঘশ্বাস ত্যাগ করলে তিনি। অতঃপর মেহেরের থুতনি উঁচু করে বলে উঠলেন,

— আম্মু তাকাও আমার দিকে। তুমি তো ব্রেভ গ্যাল! তোমাকে এভাবে মানায় না আম্মু। দেখো, এই অবস্থায় তোমাকে দেখলে যে তোমার বাবার ভীষণ যন্ত্রণা হয়। কি হয়েছে তোমার আমাকে বলো?

তখন মেহের নিশ্চুপ হয়ে ঘাপটি মেরে বসে রয়েছে। উত্তর অপেক্ষায় শোয়াইব খান পুনরায় বললেন,

— তুমি বুঝি সমুদ্রের রক্তাক্ত দেহ দেখে ভয় পেয়েছো?

মুহূর্তেই মেহের শোয়াইব খানের মুখশ্রীতে সজল চোখের দৃষ্টিপাত ফেললো। অতঃপর ঠোঁট কামড়ে ধরে ক্রন্দন থামানোর প্রয়াস করলো। কিন্তু ব্যর্থ হয়ে কান্না রত কন্ঠ অস্কুটস্বরে তুতলে তুতলে বলে উঠলো,

— স্যা র উননার কিছু হবেএ না তো? আমি কিন্তু উনাকে ছড়া এক মুহূর্তেই থাকতে পারব। আমার যে ভীষণ ভয় হচ্ছে। আমি একটিবার উনাকে দেখতে চাই। আমাকে নিয়ে যাবেন তো!

মেয়ের প্রত্যুত্তরে শোয়াইব খান মুচকি হেসে বুকে পাথর চেপে বলে উঠলেন,

— টাস্ট মি আম্মু! সমুদ্রের কিছু হবে না। কিন্তু তুমি এভাবে কান্না করলে তুমি অসুস্থ হয়ে পড়বে। এভাবে কেঁদো না মামুনি। এভাবে কী কেউ কাঁদে? কান্না থামাও বলছি।

মেহের ফির ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে অস্কুটস্বরে বলে উঠলো,

— আমার যে খুবই কষ্ট হচ্ছে স্যার! আমার চোখের পাতায় বারবার তার রক্ত ভরপুর শরীর ভেসে ওঠছে। ক্রমশ আমার নিশ্বাস বন্ধ হয়ে আসছে। আপনি তো জানেন না, উনি ব্যতীত এই পৃথিবীতে আমার যে আর কোন আপন মানুষ নেই। উনি যে আমার আশ্রয় স্থল, আমার সুখে থাকার একমাত্র রহস্য, আমার বেঁচে থাকার অবলম্বন। আমার শ্বসন ক্রিয়ার প্রতিটি ধাপ যে তাকে ঘিরেই। আমি যে তাকে হীনা বেঁচে থাকাতে পারবো না। সে তো আমার নিঃশ্বাসের সঙ্গে জড়িত। জানেন স্যার আমার খুব কষ্ট হচ্ছে একদম হাঁপানি রোগীদের মতো।

কথাগুলো বলেই ব্যাপক পরিমাণে হেচকি তুলতে লাগলো মেহের। অতঃপর শোয়াইব খানের হাত খামচে ধরে পূর্বের ন্যায় বলে লাগলো,

— বিশ্বাস করুন, উনার কষ্ট আমি সইতে পারছি না। জানেন উনার সাদা শার্টটা একদম লাল টুকটুকে হয়ে গিয়েছিল! আচ্ছা উনার কি খুব কষ্ট হচ্ছে? স্যার বলুন তো গুলিটা কেন আমার দেহ ছিন্ন বিচ্ছিন্ন করে রক্তাক্ত দেয় নি? তখন কেন উনি আমার সামনে এসে দাঁড়িয়ে পড়েছিলেন? উনি কী বুঝেন না উনার ব্যাথায় যে আমি ব্যথাতুর হয়ে উঠছি প্রতিনিয়ত!

শোয়াইব খান মেয়ের পরিস্থিতি দেখে অবাকের সপ্তম আকাশে! তিনি সঙ্গে সঙ্গে মেহেরের মাথা নিজ বুকের মাঝে আবদ্ধ করে বলে উঠলেন,

— কিছু হবে না সমুদ্রের। তুমি নিশ্চিন্তে থাকো মা। কিন্তু এভাবে বলো না। তুমিই যে আমার বেঁচে থাকার একমাত্র কারণ। তুমি মরে গেলে আমি বাঁচব কী করে বলো তো! তাই আর কখনোই এমন পচা কথা বলবে না। কেমন?

মেয়েটার কান অবধি শোয়াইব খানের বাগযন্ত্র হতে নির্গত অভিমান বাক্য গুলো পৌঁছিয়েছে কী সন্দেহ! মেয়েটা শোয়াইব খানের বুকের উপর মাথা গুঁজে ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদছে অনবরত! শুধু তাই হয় বারংবার আর্তনাদ তুলছে শেয়াইব খানকে জাপটে ধরে! মেয়েটার কেঁপে কেঁপে উঠা আর্তনাদ সহ্য করতে পারছে না তিনি। মিনিট পাঁচেক পরেই মেয়েটা শোয়াইব খানের বুকে অচেতন হয়ে ঢলে পড়ল। মেহেরের এমন পরিস্থিতির দেখে ইতিমধ্যে তার চোখ জোড়া সহজ হয়ে উঠেছে। তার অন্তরালে অতিরিক্ত জটিল প্রশ্নের উৎপত্তি ঘটেছে।

মেয়েটা যে সমুদ্র হীনা কয়েক ঘণ্টায় অবরুদ্ধে হাঁফিয়ে উঠেছে। বন্দি খাঁচার পাখির ন্যায় সমুদ্র হীনা বেঁচে থাকার প্রতি অনিহা সৃষ্টি হয়েছে মেহেরের হৃদয় মনে! শোয়াইব খান গভীর প্রত্যাশায় ছিলেন মেয়েটাকে সমুদ্রের থেকে বিচ্ছেদ করতে। কিন্তু মেয়েটা যে সমুদ্র নামক প্রাণীর প্রতি আবেগে আপ্লুত। সমুদ্রের প্রতি সৃষ্টি কি মেহেরের বয়সের দোষ! নাকি পবিত্র বন্ধনের মায়াজাল? কই কল্পনার সঙ্গেও তো শোয়াইব খান পবিত্র বন্ধনে গেঁথে ছিলো। সেও তো কল্পনাকে ছুঁয়ে দুজন একসঙ্গে আষ্টেপৃষ্ঠে ঘিরে থাকার প্রতিজ্ঞা করেছিল। কিন্তু সেই মায়াজাল তো শোয়াইব খানের বুকে বিন্দু পরিমাণের অনুশোচনা সৃষ্টি করে নি। সে কল্পনা হীনা দিব্বি প্রশান্তিতে সময় অতিবাহিত করে এসেছে প্রতিনিয়ত। কই তার মনে তো কোনকালেই কোন অনুভূতি উদ্ভট হয় নি অর্ধাঙ্গিনীকে ঘিরে। কিন্তু তার মেয়েটা সম্পূর্ণ বিপরীত। মেহেরের অনুভূতি গুলো তো মিথ্যা নয়, বিষয়টা মেহেরের আচরণে প্রকাশ পাচ্ছে! এ যেন কৈশোরের দোষ নয়। মেহেরের হৃদয় গহীনে উৎপত্ত অদ্ভুত এক অনুভূতি স্পষ্ট ফুটে উঠেছে! মেয়েটা যে গভীর হতে গভীরতর ভাবে সমুদ্র নামক অনুভূতিতে আক্রান্ত হয়ে পড়ছে! যে অনুভূতি দমিয়ে রাখতে শুধু মাত্র তার সমুদ্রকে প্রয়োজন। শুধু মাত্র সমুদ্রকে!
__________________

ঘড়ির কাঁটাতে ছুঁই ছঁই ছয়। এই অবেলায় ইসরাত বেগমের কোলে মাথা রেখে চোখ যুগল বুঁজে শুয়ে রয়েছে জারা। ক্লান্তির ছাপ স্পষ্ট মেয়েটার মুখশ্রীতে! নিজ বিক্ষিপ্ত মনকে ব্যস্ত রাখার প্রয়াসে কয়েক দিন যাবত টিউশনি করাতে আরম্ভ করেছে সে। পাশের ফ্লাটের বসবাসরত তৃতীয় শ্রেণির দুটো ছেলেকে পড়াচ্ছে সে। বাচ্চা দুটির সঙ্গে সময় অবিবাহিত করে বেশ আনন্দিত জারা। বর্ষণকে মস্তিষ্ক হতে চিরন্তন মুছে ফেলার সিদ্ধান্ত অটল সে। বর্তমানে ইয়াদ নামক ব্যাক্তিকে দেখার অভিপ্রায় জেগেছে তার হৃদয় গহীনে। তার চোখ জোড়া ভীষণ তৃষ্ণার্ত হয়ে উঠেছে একটি বারের জন্য ইয়াদকে দেখাতে। ইতিপূর্বে জারার সঙ্গে সাংঘাতিক ঘটনা ঘটে গিয়েছে। দিন দুয়েক পূর্বে কোন এক অজ্ঞাত ব্যক্তি তাকে শত বারের অধিক তার মোবাইল ফোনে কল করেছিল! অজ্ঞাত ব্যক্তি বললে ভুল হবে জারার নিকট সেই ব্যক্তিটা বর্ষণ ছাড়া অন্য কেউ নয়! বারংবার কল করাতে একপর্যায়ে অতিষ্ঠ হয়ে ফোন বন্ধ করে দেই জারা। দুই দিন যাবত ফোন আর চালু করার প্রয়োজন বোধ করে নি সে।

কিন্তু ইসরাত বেগমের প্রতীক্ষার কাছে হার মানতে হয়েছে তাকে। বর্তমানে বন্ধ মুঠোফোন হাতে নিয়ে চালু করার উদ্দেশ্যে তা দু হাতের মধ্য বতী নিয়েছে জারা। আজ হয়তো খোলা হতো না। কিন্তু ইসরাত বেগমের বিষাদগ্রস্ত হৃদয় পুলকিত করার লক্ষ্যে এই উদ্যোগ নিয়েছে সে। ইসরাত বেগম কয়েক দিন যাবত তার বড়ো ছেলে সমুদ্রের কন্ঠস্বর কর্ণপাত করতে পাগল হয়ে উঠেছেন! ছেলের জন্যে আজ নাকি তার হৃদয় অশান্ত হয়ে উঠেছে। বেকে বসছেন তিনি। আজ যে করেই হোক দু জন ছেলের কন্ঠস্বর কর্ণপাত করেই ছাড়বেন। বিশেষ করে সমুদ্রের জন্য আজ তার অন্তরাল তোলপাড় আরম্ভ করে দিয়েছে! সমুদ্রের কথা চিন্তা করে বারংবার তার বুক কেঁপে উঠছেন তিনি। অদ্ভুত অস্থিরতা তাকে ঘিরে ধরছে। একেই বোধ হয় নাড়ের টান বলে। সন্তানের বিপদের আভাস পূর্বে থেকেই যায়ের মনে সজাগ হয়ে উঠে।

ফোন খুলতেই জারার লক্ষ্যে হলো ইয়াদ নামক ব্যক্তিটা বারবার কল করছে। এমনকি মিনিট পাঁচেক পূর্বে ও ইয়াদের নম্বর থেকে কল এসেছি। বিয়ের এতোদিন অতিক্রম হয়েছে কিন্তু এখন অবধি ইয়াদের সঙ্গে ফোনে যোগাযোগ হয়নি জারা! তৎক্ষণাৎ পুনরায় ইয়াদের নম্বর থেকে কল এলো। ইতিমধ্যে জারার হৃদয় স্পন্দন তড়িৎ বেগ নিয়েছে! জারার পরিস্থিতি খানিকটা আচ করতে সক্ষম ইসরাত বেগম। অতঃপর কাঁপা কাঁপা হাতে ফোন রিসিভ করলো জারা। মূহুর্তেই বিপরীত পার্শ্ববর্তী হতে ভেসে এক চিনা পরিচিত কন্ঠস্বর,

— জেবু!

লহমায় বিদ্যুৎ গতিতে চমকে উঠলো জারা। এই জেবু নামটা শুনে জারার অস্থিরতা বৃদ্ধি পেয়েছে দ্বিগুন হারে! কিন্তু জারা কিছু বুঝে উঠার পূর্বে ইয়াদ ফির বলে উঠলো,

— জেবু ভয়ের কিছু নেই! শোন, সমুদ্র ভাইয়া হাসপাতালে ভর্তি। ভাইয়ার গায়ে গুলি লেগেছে! তাই ভীষণ অসুস্থ সে। জানি না আমার ভাইয়াটা কেমন আছে?

কথাগুলো বলেই দলা পাকিয়ে কান্না আসলো ইয়াদের। শত প্রচেষ্টা করে নিজেকে ধাতস্ত রেখে ফির বলে উঠলো,

— আম্মু যেন বিষয়টা জানতে না পারে। তোমাকে একটা বড় দায়িত্ব দিচ্ছি, জেবু। খানিকের মধ্যে এপোটমেন্টের সামনে একটা গাড়ি আসবে। তুমি দেরি না করে আম্মুকে নিয়ে অতি জলদি ঢাকার উদ্দেশ্যে বেরিয়ে পড়বে। আর হ্যাঁ, আম্মুকে ভুলেও ভাইয়ার কথাটা বলবে না।

কথাগুলো জারার কণকুহরে পৌঁছানো মাত্রই স্তব্ধ হয়ে উঠলো সে। তৎক্ষণাৎ ছোট বোনের কথা ভেবেই অজানা আশঙ্কায় তার বুকটা কেঁপে উঠছে। জারা ইয়াদের প্রত্যুত্তরে কাঁপা কন্ঠে বলে উঠলো,

— মেহের কোথায়? ও ঠিক আছে তো?

ইয়াদ দীর্ঘশ্বাস ত্যাগ করে বললো,

— উহু! ভাইয়ার কলিগ ফোন দিয়েছিলো বলেছে মেহের নাকি কাঁদতে কাঁদতে জ্ঞান হারিয়ে ফেলেছে। তুমি চিন্তা করো না। আমি এক্ষুনি পৌঁছে যাবো। তুমি শুধু মাকে কিছু একটা বুঝিয়ে রেডি করো।

বলেই সেকেন্ড পাঁচেক নিরব থেকে ইয়ার বলে উঠলো,

— আই আম সরি। প্লিজ, জেবু আমার ভাইয়ের জন্য দোয়া করো।

বাক্যগুলো বলেই গটগট করে ইয়াদ ফোন কেটে দিলো। অনাকাঙ্খিত এমন ঘটনায় বেশ চিন্তিত জারা। সে দিশেহারা হয়ে পড়েছে যে ইয়াদের মুখ হতে নির্গত জেবু ডাকটাও লক্ষ্য করেনি সে। লহমায় জারা দীর্ঘ শ্বাস ত্যাগ করে শাশুড়ি মায়ের দিকে তাকালো। ইশরাত বেগম অসহায় দৃষ্টিতে তাকিয়ে রয়েছে। এবং ঠোঁট জোড়া সংকুচিত করে কথা বলার প্রচেষ্টা চালাচ্ছে। তৎক্ষণাৎ জারা নিজের ভুল বুঝতে পেরে ঠোঁট জোড়া সংকুচিত করে মিন মিন কন্ঠে মিথ্যা বুঝ দিলো ইসরাত বেগমকে,

— আম্মু তুমি চিন্তা করো না। মেহেরের কিছু হয় নি। সমুদ্র ভাইয়া ফোন করেছিল।

তাও যেন ইসরাত বেগম শান্ত হবার নাম নিচ্ছেন না। এক পর্যায়ে জারা তাকে শান্ত করতে ছলনাময়ী তীর্যক হাসির রেখা টেনে বলে উঠলো,

— তোমার বড়ো বউ অজ্ঞান হয়ে গিয়েছিল। তাই হাসপাতালে ভর্তি করানো হয়েছে। তুমি ও দেখেছো মেয়েটা খেতে চাই না। তাছাড়া জান না মা আমি রহস্যের গন্ধ পাচ্ছি! মনে হচ্ছে তোমার প্রত্যাশা পূরণ হবে খুবই শীঘ্রই। ভাইয়া বলেছে আমরা যেন আজ রওনা দেই। তার ফেন্ডের গাড়ির পাঠিয়ে দিবেন খানিকের মধ্যে। তাড়াতাড়ি রেডি হও মেহের থুক্কু বড়ো ভাবিকে দেখতে যাবো। আমি খুবই এক্সাইটেড!

জারার কথা শুনে মুচকি হাসির স্পষ্ট ফুটে উঠেলো ইসরাত বেগমের ঠোঁটের কোণে। জারা কথায় ব্যহিক আনন্দিত হলেও অন্তর থেকে আনন্দিত হতে ব্যর্থ হচ্ছেন তিনি। তার ভেতরে অনাকাঙ্খিত দুর্ঘটনার আশঙ্কার আবির্ভাব ঘটেছে। সমুদ্রের জন্য তার বুকের ভেতর দুমড়ে মোচড়ে উঠছে। ছেলেটাকে চিরন্তন হারিয়ে ফেলার ভয় হচ্ছে তার! অন্তরাল তাকে বলছে, ছেলের মুখ হতে নির্গত প্রশান্তি ময় ‘মা’ ডাকটা আর কোনদিনই শুনতে পাবেন না তিনি।

(চলবে)