তুমি নামক অনুভূতি পর্ব-৫৯

0
1045

#তুমি_নামক_অনুভূতি
#পর্ব :৫৯
#Lutful_Mehijabin (লেখা)
[কপি করা নিষেধ।]

সমুদ্রের কথা শুনে অদ্ভুত অনুভূতি বয়য়ে গেল মেহেরের অন্তরালে! তৎক্ষণাৎ চোখ জোড়া বুজে, একরাশ সাহস যুটিয়ে বলে উঠলো,

— ছাড়ু্ন, আমি যাব না।

মুহূর্তেই সমুদ্রের চোয়াল শক্ত হয়ে এলো। পরিশেষে ভ্রূ যুগল কুঁচকে সে বলে উঠলো,

— যাবেন না তাই তো? ওকে নো প্রবলেম, আমার আবার বাচ্চাদের কোলে নিতে কোন সমস্যা নেই। তাছাড়া আগে থেকেই অভ্যস্ত হওয়াই বেটার!

সমুদ্রের বাকযন্ত্র হতে নির্গত বাক্যেগুলো কর্ণপাত হতেই স্তম্ভিত হয়ে পড়ল মেহের। সে কিংকর্তব্যবিমূঢ়! মুহূর্তেই সমুদ্রের মুখশ্রীতে আশ্চর্যান্বিত দৃষ্টিপাত নিক্ষেপ করল। লোকটার অধর যুগলে তীর্যক হাসির রেখা স্পষ্ট! তৎক্ষণাৎ শুকনো ঢোক গিললো মেহের। তার সমস্ত দেহ অযথাই কাঁপতে আরম্ভ করছে। অতঃপর ঠোঁট জোড়া সংকুচিত করে, বিষ্ময়ের সহিত মিনমিন করে বলল,

— কী,, বলছেন! আপনি তো অসুস্থ! এই পরিস্থিতিতে আপনার মস্তিষ্ক এমন উদ্ভট চিন্তা উদয় হয় কী করে?

মেহেরের কথার প্রেক্ষিতে সমুদ্রের অধর কোণে উপস্থিত হাসির প্রখরতা স্বল্প বৃদ্ধি পেল! সমুদ্র খানিক অগ্রসর হলো মেহের নিকটে। ঈষৎ ঝুঁকে ভ্রূ যুগল কুঁচকে অধর জোড়া প্রসারিত করে বলল,

— বাহ্ পুচকি! এর মানে তুমি আমার কোলে আসতে চাইছো?

সমুদ্রের সংকোচ হীন বাক্য মেহেরের কর্ণগোচর হওয়া মাত্রই তার গাল যুগল কিঞ্চিৎ লালাভ বর্ণ ধারণ করে উঠলো। অতি দ্রুত সমুদ্রের অচঞ্চল প্রাপ্ত চোখ যুগল হতে দৃষ্টি সরিয়ে নিলো সে। বাকরুদ্ধ মেহের! এই মুহূর্তে সমুদ্র কে প্রত্যুত্তর দেবার মতো ভাষা খুঁজে পেল না।

মেহেরের অস্বাভাবিক পরিস্থিতি লক্ষ্য করতেই ঠোঁট চেপে হাসল সমুদ্র। অতঃপর স্বাভাবিক কন্ঠে বলল,

— দেখ পুচকি, তোমার ভাব চক্কর সুবিধা জনক লাগছে না আমার কাছে!

সমুদ্রের কথার প্রত্যুত্তরে মেহের বিরবির করে বলল,

— মানে?

সমুদ্র চোখ যুগল ছোট আকৃতি করে সন্দেহজনক কন্ঠে বলল,

— আই থিংক তুমি জেলাস!

সমুদ্রের কথা শ্রবণ করে মেহের পূর্বের ন্যায় আকাশ পানে দৃষ্টি নিবন্ধ করল। দৃষ্টি স্থির রেখে অতঃপর বিনা দ্বিধায় নিম্ন কন্ঠে বলে উঠল,

— আপনাকে একটা প্রশ্ন করি?

সমুদ্র মুচকি হাসির সহিত বলল,

— হু, অবশ্যই।

তৎক্ষণাৎ মেহের দীর্ঘশ্বাস ত্যাগ করে, ক্রন্দন মাখা কন্ঠে বলল,

— আপনার কী সারা আপুর সঙ্গে রিলেশন ছিলো?

মেহেরের বাকযন্ত্র হতে নির্গত অদ্ভুত বাক্য শুনে সমুদ্র চোয়াল শক্ত হয়ে এলো নিমিষেই! ক্রোধের আবির্ভাব ঘটল সমুদ্রের চোখ যুগল। তার মস্তিষ্ক বর্তমানে অত্যধিক উত্তেজিত হয়ে উঠেছে! ক্রোধ নিয়ন্ত্রণের প্রয়াসে চোখ যুগল বন্ধ করে ফেলল সে। বার কয়েক স্নিগ্ধ, শীতল বায়ু টেনে নিলো। আকস্মিক দাঁতে দাঁত চেপে কঠিন স্বরে বলল,

— হ্যাঁ, ওকে আমি ভালোবাসি। খুব শীঘ্রই তোমাকে ডিভোর্স দিয়ে ওকে বিয়ে করব।

মুহূর্তেই মেহেরের অন্তরালে কালববৈশাখী ঝড় আরম্ভ হলো। আকাশ পান হতে দৃষ্টি সরিয়ে সমুদ্রের মুখশ্রীতে ফ্যালফ্যাল দৃষ্টিপাত ফেলল সে। বর্তমান পরিস্থিতিতে মেহেরের অবস্থা বেগতিক! সমুদ্র থেকে এমন নেগেটিভ বাক্য মোটেও প্রত্যাশা করে নি সে। ক্রন্দন যেন দলা পাকিয়ে কোথাও আটকে গিয়েছে! হঠাৎ কাঁপা কাঁপা কন্ঠে সে বলে উঠলো,

— আমি যে আপনাকে ছাড়া বাঁচব না। আপনি সত্যিই কী আমাকে ছেড়ে সারা আপুর কাছে চলে যাবেন?

তৎক্ষণাৎ সমুদ্র নিজেকে শান্ত করে বলে উঠলো,

— just shut up!

ইতোমধ্যে মেহেরের গাল যুগল অশ্রু সিক্ত হয়ে উঠেছে! বাচ্চাদের ন্যায় ক্রন্দনে মত্ত হয়ে উঠেছে সে। সমুদ্র মেহেরের অশ্রু সহ্য করতে ব্যর্থ হলো। লহমায় খানিকটা ক্ষান্ত হলো। অতঃপর দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল,

— দেখো মেহের, এতোটা অবুঝ হওয়ার কোন মানেই হয় না। ইউ নো দ্যাট, তোমার বয়সী মেয়েরা দু তিন বাচ্চার মা হয়ে গিয়েছে। আর তুমি?

সমুদ্রের কথার ভিত্তিতে মেহেরের ক্রন্দনের তীব্রতা দ্বিগুণ হারে বৃদ্ধি পেলো। সমুদ্র ফির গম্ভীর কন্ঠে বলল,

— ওয়েট, তোমার কি মনে হয় আমি বিয়ের আগে রিলেশন করেছি?

মেহেরের পূর্বের ন্যায় বলল,

— হুম!

— Why?

তৎক্ষণাৎ মেহের ক্রন্দনের বেগ কমিয়ে বলল,

— কারণ আপনি ভীষণ সুন্দর! আপনার মতো লোকেরা অনেক গুলো রিলেশন করে। আপনি তো বলেছেন, ইয়াদ ভাইয়া ও করেছে। আমি শিউর আপনি কারো মোহে পড়ে রয়েছেন। এরপর ডিপরেশন থেকে এমন গম্ভীর হয়ে গিয়েছেন। তাই কখনোই হাসতে চান না।

মেহেরের বলা বাক্যগুলো সমাপ্ত হওয়া মাত্রই অট্টহাসিটে ফেটে পড়ল সমুদ্র। প্রচন্ড হাসি পাচ্ছে তার! মেয়েটা এতকাল বেশ বুদ্ধিমান ভেবেছিল সে। আজ সমুদ্রের ভুল ধারণা ধুলোয় মিশে গেলো। সত্যিই মানুষ বড়ই অদ্ভুত! পরিবেশ পরিস্থিতির সাপেক্ষে মানুষের মস্তিষ্কের বয়স বৃদ্ধি পেলেও কোথাও না কোথাও এক চিলতে বাচ্চাম থেকেই যায়। সঠিক সুযোগ পেলেই যেন শক্ত মানুষটার সত্যিকার রূপ খোলশা থেকে নির্গত হয়। প্রিয় মানুষের সান্নিধ্য পেলে আবেগের বশে তারা বাচ্চাদের ন্যায় আচরণে লিপ্ত হয়ে উঠে! মেহেরের ক্ষেত্রেও ব্যতিক্রম হয় নি।

আকস্মিক সমুদ্রের হাসি দৃশ্যমান হতেই মেহেরের ক্রন্দন আপনা আপনি থেমে গেলো। মেহের অপলক দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলো সমুদ্রের মুখশ্রীতে। মানুষ কী এতো সুন্দর করে হাসতে পারে! এই প্রথম সমুদ্রের হাসি দৃশ্যমান হলো মেহেরের। লহমায় তার শান্ত হৃদয়ে অশান্ততার আবির্ভাব ঘটলো। নির্লজ্জ হয়ে উঠলো তার দৃষ্টি!

সমুদ্র হাসি নিয়ন্ত্রণে ব্যর্থ হলো। যথেষ্ট প্রচেষ্টা করে অবশেষে হাস্যরত অবস্থায় বলে উঠলো,

— Like Seriously! ইয়াদ রিলেশন করেছে বলে আমিও করব? বিশ্বাস করো মেহের, তুমি আসলেই একটা বাচ্চা! এখন উপলব্ধি করতে পারিছি আমার ভবিষ্যৎ অন্ধকার।

মেহেরের দৃষ্টি সমুদ্রের মুখশ্রীতে আবদ্ধ! মিনিট খানিক যাবত পলকহীন নয়নে সমুদ্রের চোখ যুগলে দৃষ্টি আকর্ষণ রেখেছে সে। এই প্রথম সমুদ্র কে খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখতে ব্যস্ত মেহের! তার চোখ যুগল অবাধ্য হয়ে উঠেছে। খানিক স্বাভাবিক হতেই, সমুদ্রের কথাগুলোর প্রেক্ষিতে মেহেরের ভ্রূ যুগল কুঁচকে এলো। নিরবতা ভেঙে হঠাৎ আনমনে মেহের বলে উঠলো,

— সত্যি আপনি কখনো রিলেশন করেন নি?

সমুদ্র বা হাত দিয়ে রেলিং আঁকড়ে ধরল। মেহেরের কথার প্রত্যুত্তরে, আকাশ পানে দৃষ্টি নিবন্ধ করে বলল,

— হুম সত্যি।

মেহের নির্বোধের ন্যায় তড়িৎ গতিতে সমুদ্র উদ্দেশ্যে প্রশ্ন ছুঁড়ে দিলো। কম্পানিত কন্ঠে বলল,

— কেন? কেন আপনি রিলেশন করেন নি?

মেহেরের প্রশ্ন শুনে সমুদ্র খানিকটা হেসে উঠলো। রেলিং এর সঙ্গে গা ঘেঁষে দাঁড়াল। অতঃপর দীর্ঘশ্বাস ত্যাগ করে স্বাভাবিক ভাবে বলল,

— শুনতে চাও?

মেহের দ্রুত উত্তর দিলো,

— জী, বলুন।

সমুদ্র অধর জোড়া জিহ্বা দ্বারা ভিজিয়ে নিলো। অতঃপর বলতে আরম্ভ করল।

— কারণ আমি বিশ্বাস করতাম আমার মন মানসিকতা যতটুকু পরিস্কার থাকবে আমার ভবিষ্যতে কাঙ্ক্ষিত মানবীর অন্তরাল ঠিক তেমনি স্বচ্ছ থাকবে। অর্থাৎ আমি যদি কোন নারীর সঙ্গে প্রেম নামক সম্পর্কে আবদ্ধ হতাম। তাহলে নিশ্চয়ই আমার সেই মানবীও কোন না কোন এক পুরুষের মায়াজালে ফেঁসে যেত। আমি কখনোই তাকে পরপুরুষের সঙ্গে সহ্য করতে পারব না। আমি চাইতাম না আমি ব্যতীত অন্য কোন ব্যক্তির কুদৃষ্টি আমার সেই মানবীর দেহ পরশ করুক! চাইতাম না তার বক্ষ পিন্জরে অন্য কেউ আশ্রয়স্থল আবিষ্কার করুক। ছোট বেলা হতেই অভিপ্রায় ছিলো আমার ভবিষ্যতের মানবী যেন একান্ত আমার থাকে। তাই কোন নারীকে হৃদয়ে প্রবেশ করতে দেই নি। আমি যেমন পর পুরুষের সান্নিধ্যে তাকে সহ্য করার দৃশ্য কল্পনাও করতে পারি না। ঠিক সে মানবী ও অবশ্যই ব্যতিক্রম হবে না! অন্য কোন নারীর সংকটে তিনিও আমাকে সহ্য করতে ব্যর্থ হবে।

কথাগুলো বলেই বার কয়েক নিশ্বাস ত্যাগ করলো সমুদ্র। মেহের মুগ্ধতার সহিত সমুদ্রের কথাগুলো মনোযোগ সহকারে শুনছে। এক ভিন্ন শান্তির আবির্ভাব ঘটেছে তার অন্তরালে! এক কথায় সমুদ্রের প্রতি প্রেম নামক রহস্য পূর্ণ অনুভূতিতে ডুবে গিয়েছে সে। মেহের কৌতূহল বশত ফির প্রশ্ন করল,

— আচ্ছা, যদি আপনার হৃদয়ে বিয়ের পূর্বে অনাকাঙ্খিত প্রেম নামক বসন্তের আগমন ঘটতো! তাহলে আপনি কী করতেন?

মেহেরের প্রশ্নের উত্তরে সমুদ্র মুচকি হাসির সহিত প্রত্যুত্তর দিলো,

— আমাদের সৃষ্টিকর্তা বিয়ের পূর্বের সম্পর্ক অপছন্দ করেন। তাই হৃদয়ে বসন্ত এলে অতি দ্রুত তাকে পবিত্র বন্ধের মায়াজালে আবদ্ধ করে ফেলতাম। বর্তমানে সে আর আমি প্রশান্তিতে সংসার করতাম। আহ! কতোই না ভালো হতো। আজ কমপক্ষে দুটো বাচ্চা আমাদের সংসার আলোকিত করে পৃথিবীতে এসে পড়তো। এমনকি তোমার মতো স্টুপিড গ্যাল আমার কাঙ্ক্ষিত মানবীর স্থান পেতো না।

সমুদ্র শেষোক্ত বাক্যটা রসিকতার সহিত বলে উঠলো। মেহের লজ্জা পেয়ে বলে উঠলো,

— এভাবে বলবেন না প্লিজ। সরি তো! আপনার মন মানসিকতা সত্যিই অমায়িক। বিশ্বাস করুন অন্য কারো সঙ্গে আপনাকে আমি সহ্য করতে পারব না।

সমুদ্র হৃদয়ে বসন্তের হাওয়া বইলো মুহূর্তেই! সে তৎক্ষণাৎ হাত ঘড়ির দিকে দৃষ্টিপাত নিক্ষেপ করল। অতঃপর চোখে মুখে গম্ভীরতা স্পষ্ট রেখে বলে উঠলো,

— এই মেয়ে তুমি এতো পেকেছো কীভাবে? ধীরে ধীরে আমার অর্ধাঙ্গীতে সম্পূর্ণ রুপে পরিণত হতে চাইছো!

সমুদ্রের কথাগুলো মেহেরের কোর্ণগোচর হওয়ার মাত্রই একরাশ সংকোচ এসে আষ্টেপৃষ্টে ঘিরে ধরলো তাকে। মাথা নিচু করে ফেলল সে।

সমুদ্র মেহেরের পরিস্থিতি লক্ষ্য করে গম্ভীর কন্ঠে বলল,

–এভাবে আমার বউ হয়ে উঠো না পুচকি , নয়তো তোমার ভবিষ্যৎ অন্ধকার হয়ে যাবে। আর হ্যাঁ, এসব আজগুবি চিন্তা মাথা থেকে ঝেড়ে ফেলো। পুচকি পুচকির মতো থাকবে। Understand!

মেহের বাকরুদ্ধ হয়ে দাঁড়িয়ে রইলো। আশ্চর্যের বিষয় হচ্ছে আকাশ পরিষ্কার হয়ে উঠেছে! বর্ষণে ভর্তি মেঘ দ্বয় বিলুপ্ত হয়ে গিয়েছে। এক চিলতে রোদ্দুরে এসে লুটোপুটি খাচ্ছে ছাদ বরাবর!

সমুদ্র আকস্মিক বলে উঠলো,

— অনেক হলো পুচকি! অনেক বড় অন্যায় করে ফেলেছো তুমি। তোমাকে শাস্তি দিতে হবে। নতুবা তোমার উচিত শিক্ষা হবে না।

শাস্তির কথা শুকনো ঢোক গিললো মেহের। সমুদ্র লহমায় গম্ভীর কন্ঠে বলল,

— আজ থেকে বিগত তিন মাস আমাকে প্রতি বেলা খাইয়ে দিবে তুমি। খুব তো ইচ্ছে করে আম্মু কে দিয়ে খাবার পাঠিয়েছো!

কথাগুলো বলে সমুদ্র দীর্ঘশ্বাস ত্যাগ করে ফির বলল,

— নাও, এক মিনিটের মধ্যে ঘরে উপস্থিত হবে।

কথাগুলো বলেই দ্রুত পদে ছাদ প্রস্থান করলো সমুদ্র। মেহের কিংকর্তব্যবিমূঢ়! লোকটার আচরণ বারংবার তাকে বাকরুদ্ধ করে তোলে। লোকটা গিরগিটির ন্যায় বহুরূপী!
____________

সমুদ্রের ফ্লাটে রাফুর আগমন ঘটেছে মিনিট কয়েক পূর্বে। সোফার উপর বসে রয়েছে সে। তার নিকটবর্তী বসে রয়েছে আলেকা বেগম। বেশ কয়েক দিন বাদে তার অপেক্ষার প্রহরের সমাপ্তি ঘটেছে। ছেলেকে দেখে অশ্রু বিসর্জন দিচ্ছেন তিনি। পক্ষান্তরে জারা রাফুকে আপ্যায়ন করতে ব্যস্ত! রাফুর সঙ্গে খোশগল্পে ব্যস্ত আলেয়া বেগম। কিন্তু রাফু আশেপাশে পর্যবেক্ষণ করে কাউকে খুঁজে চলছে অনবরত! এককথায় ছটফট করছে রাফু।

— ভাইয়া কাউকে খুঁজছেন।

জারা কথার প্রেক্ষিতে রাফু একগাল হেসে বলল,

— সমুদ্র কোথায়?

— ভাইয়া তো বাসায় নেই। ঘন্টা খানিক পূর্বে বেরিয়েছেন।

জারার উত্তর পেয়ে হাফ ছেড়ে বাঁচল রাফু। তার ললাটে বিন্দু বিন্দু ঘাম স্পষ্ট! এসির বায়ু তার দেহ শীতল করতে ব্যর্থ। সমুদ্রের অনুপস্থিতির কথা ভেবেই পুলকিত হয়ে রাফুর অন্তরাল! মুচকি হেসে বলে উঠলো,

— জারা, বড়ো ভাবিকে তো দেখছি না।

আলেকা বেগম ছেলের কথার প্রত্যুত্তরে কর্কশ কন্ঠে বলল,

— ওই মেয়ের তো দেখাই মিলে না! সারাদিন দোর বন্ধ করে ঘরে পড়ে থাকে। তুই বস, আমি ডেকে আনছি।

তৎক্ষণাৎ রাফু মায়ের হাত জোড়া আঁকড়ে ধরে বলল,

— সমস্যা নেই মা। আমি যাচ্ছি ভাবির সঙ্গে দেখা করতে।

— সেকি তুই কেন যাবি?

— আহ মা, আমিই যাচ্ছি। ভাইয়ার রুম কোনদিকে বলো তো।

ছেলের সঙ্গে পেরে উঠলেন না আলেকা বেগম। অবশেষে বাধ্য হয়ে সমুদ্র ঘরের রাস্তা বর্ণনা করলেন। রাফু টিশার্টের হাতা গুটিয়ে পদাচারণ করলো সমুদ্রের রুমের উদ্দেশ্যে। তার বুকের ভেতর একরাশ প্রশান্তির হওয়ার বইছে। ক্রোধের আগুনে দাউদাউ করে জ্বলছে এক না পাওয়া নেশা! কোন এক রমণীর সৌন্দর্য তাকে আকৃষ্ট করছে অবিরাম! প্রতিশোধ নামক অস্ত্র তাকে উৎসাহিত করে তুলছে পৃথিবীর সবচেয়ে নিষ্ঠুর চরিত্রে পা দেওয়ার উদ্যোগে। রাফুর ঠোঁটের কোণে ফুটে উঠেছে সুক্ষ্ম হাসির রেখা। একেই বলে বোধহয় পৈশাচিক হাসি!
______________

ঘড়ির কাঁটায় ছুঁই ছুঁই চারটা। আসরের আযান দিয়েছে কিৎক্ষণ পূর্বে। সালাত আদায় করে আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে রয়েছে মেহের। সমুদ্র এই দুর্বল শরীর নিয়ে পরিপাটি হয়ে বাইরে বেরিয়েছে মেহের কে সারপ্রাইজ দেওয়ার জন্যে। ছোট্ট মিষ্টি বউয়ের জন্য ব্যাপক আয়োজন তার মস্তিষ্ক জুড়ে। আজ মেহেরের খিলখিল হাসি যে করেও হোক সে দর্শন করবে। মেহেরের হাসির শব্দে প্রশান্তিময় করে তুলবে হৃদয়! সেই উদ্দেশ্যে বের যাওয়ার পূর্বে, মেহের কে ঘুমানোর জন্যে আদেশ করে গিয়েছে সমুদ্র। কিন্তু মেহের আদেশ ভঙ্গ করে আয়নার নিকটবর্তী দাঁড়িয়ে রয়েছে।

আয়নাতে নিজের প্রতিবিম্বের দিকে গভীর দৃষ্টিপাত আকর্ষণ করেছে মেহের। ইশ, সমুদ্র তার থেকে হাজার গুণ সুন্দর! তাকে তো সমুদ্রের পার্শ্ববর্তী একদমই বেমানান। এসব উদ্ভট চিন্তা ভাবনা হানা দিয়েছে মেহেরের মস্তিষ্কে। নিজেকে কুৎসিৎ ভেবে অযথাই হীনমন্যতা ভুগছে সে!

মেহের যখন গভীর চিন্তায় মগ্ন ঠিক তখনই দরজা চাপনোর মৃদু আওয়াজ মেহেরের কর্ণকুহুরে এসে প্রতিধ্বনি তুলতো। জারার আগমন ভেবে নিজেকে অপ্রস্তুত রেখে পূর্বের ন্যায় দাঁড়িয়ে রইলো সে। ওড়ানা দ্বারা মাথা আবৃত করার প্রয়োজন বোধ করল না।

আকস্মিক আয়নাতে এক অজ্ঞাত পুরুষের প্রতিচ্ছবি ভেসে উঠতেই আঁতকে উঠলো মেহের। মনের ভুল ভেবে পিছন বরাবর ঘুরতেই স্তম্ভিত হয়ে পড়ল সে। তৎক্ষণাৎ তার মাথা ঘুরে উঠলো! লোকটা আর কেউ না, তার জীবন নরকে পরিনত করা চির পরিচিত সেই ব্যক্তি! রাফি চৌধুরী, যে কিনা তাকে বিয়ে করার জন্য মরিয়া উঠেছিল! রাফির কুদৃষ্টি লক্ষ্য করতেই মেহেরের শরীর ঘিন ঘিন করে উঠলো। অতীতের ভয় পুনরায় এসে উপস্থিত হলো তার হৃদয় গহীনে। মুহূর্তেই মেহেরের হাত পা আড়াস হয়ে উঠলো। শরীরের সমস্ত শক্তি বিলুপ্ত হয়ে গেলো নিমিষেই। একটি বার সমুদ্রকে দর্শন করার জন্যে মরিয়া হয়ে উঠলো তার আঁখি যুগল! এখন যে তার একমাত্র সমুদ্রকে প্রয়োজন। কিন্তু সমুদ্র তো নেই! নিজেকে পৃথিবীর সবচেয়ে অসহায় মানবী বলে মনে করলো মেহের। ইতোমধ্যে ভয়ে তার দু চোখ যুগল হতে বৃষ্টি নামছে অনবরত!

রাফু পৈশাচিক হাসির সহিক মেহেরের নিকটবর্তী ক্রমশ এগিয়ে আসতে লাগলো। চলমান পদে রাফু অদ্ভুত কন্ঠে বলে উঠলো,

— ভয় পাচ্ছে কেন পাখি? ভয়ের কিছু নেই। আজ যদি তোমার মা চালাকি না করতো তাহলে সমুদ্রের জায়গায় আমি থাকতাম। আই নো আজ নাহয় কাল ইয়াদ নিশ্চিত আমাকে আ্যরেস্ট করবে। এতে আমার কোন সমস্যা নেই। জানো পাখি, হাজার চেষ্টা করেও ইয়াদের সঙ্গে প্রতিশোধ নিতে পারি নি আমি। বারবার ব্যর্থ হয়েছি। কিন্তু আজ আমি বিজয়ী হবোই। এমন কাজ করবো যে তোমার স্বামী এবং পরিবারের সবাই লজ্জায় বাইরে যেতে পারবে না। তোমাকে খুব ভালোবাসবো। বিশ্বাস করো পাখি, তোমার রূপের তুলনা হয় না। তোমাকে দেখার পর থেকেই আমার মাথা নষ্ট হয়ে গেছে। আমি আর অপেক্ষা করতে পারব না। ভীষণ চাই তোমাকে!

বলেই অট্টহাসিটে ফেটে পড়ল রাফু। দরজা বন্ধ, রুম সাউন্ড প্রভ হওয়ার ফলে ভেতরের আওয়াজ শত প্রচেষ্টা করেও কেউ কর্ণপাত করতে পারবে না। রাফু প্রতিশোধের আগুনে উন্মাদ হয়ে উঠছে। তার হিংস্রতা দেখে মেহের কাঁপছে! রাফু মেহেরের পরিস্থিতি লক্ষ্যে করে ফির বিশ্রী ভাবে হেসে উঠলো। এক পর্যায়ে মেহেরের নিকটবর্তী উপস্থিত হলো সে।

মেহের এবং রাফুর মধ্যবর্তী দূরত্ব নিত্যন্ত স্বল্প! রাফুর মুখশ্রী হতে দৃষ্টিপাত সরিয়ে নিলো মেহের। তৎক্ষণাৎ চোখ জোড়া খিঁচে বন্ধ করে ফেলল। লোকটার ঠোঁটের কোণে বিশ্রী হাসির রেখা স্পষ্ট! যা দৃশ্যমান হতেই মেহেরের গা কাঁটা দিয়ে উঠলো। রাফু আর এক মুহূর্তেও অপেক্ষা করলো না। মেহেরের হাত যুগল চেপে ধরলো নিজ বলিষ্ঠ হাতের সাহায্যে। রাফুর ছোঁয়া পেতেই মেহেরের হৃদয় অজানা আশঙ্কায় তড়িৎ বেগে ছুটতে আরম্ভ করলো। মেহের চিৎকার করলো। এতেও রাফু নিভল না, বিষাক্ত ছোঁয়ায় কলোষিত করে তুললো মেহেরের দেহ! মেহের গলা ফাটিয়ে আর্তনাদ করে উঠলো। কিন্তু আফসোস রাফু ব্যতীত ধরণীর অন্য কোন ব্যক্তির কর্ণকুহুরে তার কন্ঠস্বর পৌঁছালো না। চার দেয়ালের অবরুদ্ধে তার আর্তনাদ প্রতিধ্বনি তুললো বারংবার!
(চলবে)