তুমি বললে আজ পর্ব-২৯

0
460

#তুমি_বললে_আজ
লেখনীতেঃ #রিধিমা_জান্নাত_রূপা
পর্বঃ ২৯.

.
বিয়ে বাড়ির এতএত হৈচৈ হাসি মজার মাঝেও নির্জীব হয়ে আছি, এতক্ষণের লেগে থাকা ঠোঁটের হাসিটা হঠাৎই বিলীন হয়ে গেছে। কিয়ানা নামক মানবীকে দেখার পর চোখের দৃশ্যপটে ভেসে উঠছে চার বছর আগের কিছু অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনা। মনের কোণে বারংবার উঁকি দিচ্ছে একঝাঁক অভিমান নিয়ে আবারও বিচ্ছেদের সূচনা। কেঁপে উঠলো বুক, কান্নাগুলো দলা পাকিয়ে বেরিয়ে আসতে চাইছে ভেতর থেকে, চোখ থেকে টুপ করে গড়িয়ে পড়তে চাইছে অশ্রুধারা।
চার বছরের প্রতিটি দিন, প্রতিটি ক্ষণ তাসফি ভাইকে মনে করা, ওনাকে একটু দেখার আকাঙ্ক্ষা করা, ওনার ছোঁয়া পাবার আশা করা, ওনার একটুখানি সঙ্গ পাবার জন্য ছটফট করার সেই দিন গুলো মনে পড়তেই চিনচিনে ব্যথা অনুভব হলে বুকে। ওই মানুষটাকে যদি আবারও হারিয়ে ফেলি তাহলে কিভাবে থাকবো আমি? কিভাবে নিজের জায়গায় অন্য কাউকে মেনে নিবো? না… এবার কিছুতেই পারবো না আবারও ওনাকে হারিয়ে ফেলতে, দূরে থাকতে পারবো না ওনার থেকে। কিছুদিন আগে হলেও নিজেকে সামলে দিতাম। কিন্তু এখন? এখন নিজেকে সামলাবো কি ভাবে আমি?

বিকেল গড়িয়ে এখন প্রায় সন্ধ্যা রাত। বেশ কিছু সময় আগে নিজের রুমে এসে চুপটি করে বসে আছি। রিফাপুর বিয়েটা অনেক আগেই পড়ানো হয়েছে। বেশ হাসি মজা করেই সাদিক ভাইয়াকে নিয়ে বাকি কার্যক্রম শেষ করা হয়েছে। সবার সাথে থাকলেও নির্জীব হয়ে ছিলাম যেন। ঘুরেফিরে মনটা শুধু ওই একটা জায়গাতেই আঁটকে যাচ্ছিলো।

.
তখন তাসফি ভাইয়ের হাত ধরে কিয়ানা আপুকে হেঁসে কথা বলতে দেখে সামলাতে পারি নি নিজেকে। না সেখানে দাঁড়িয়ে থাকতে পারছিলাম, আর না চলে আসতে। পা দু’টো যেন থমকে গিয়েছিলো সেখানে। অবুঝ মনটাকে বুঝিয়ে তাসফি ভাই ও কিয়ানা আপুর বন্ধুত্বের কথাটা স্বরণ করে চলে আসতে চাইলাম সেখান থেকে। কিন্তু তখনই হঠাৎ সাদিক ভাইয়া ডেকে উঠে, আর সাথে সাথে তাসফি ভাই সহ ওনার বন্ধু মহলের সবার দৃষ্টি নিবদ্ধ হয় আমার দিকে। চাইলেও আর উপেক্ষা করে চলে আসতে পারি নি তখন, এক প্রকার বাধ্য হয়েই যেতে হয়েছিলো। সকলের সামনে গিয়ে দাঁড়াতেই সাদিক ভাইয়া ‘এই তো আমার একমাত্র ছোট শালিকা’ বলে সবার সাথে আমার পরিচয় করে দেয়। টুকটাক কথা বলতে শুরু করে সবাই। ইচ্ছে না থাকা সত্ত্বেও ঠোঁটের কোণে হাসি ফুটিয়ে সবার সাথে কথা বলতে বাধ্য হই। ভাইয়ার বন্ধুরাও বেয়াইন বেয়াইন বলে হাসি মজা করতে লাগলো।
তাসফি ভাইয়ার বন্ধুদের এর আগে কখনো দেখা হয় নি। আজকেই সবার সাথে কিছুটা পরিচিত হওয়া। কিন্তু কিয়ানা আপু…. তাকে চার বছর আগে শুধু একবারই দেখেছি।

সবার সাথে টুকটাক কথা বলার মাঝেই আড় চোখে কিয়ানা আপুর দিকে তাকালাম। এতক্ষণের সেই হাসিটা নেই, কেমন জানি অদ্ভুত চোখে তাকিয়ে আছে আমার দিকে। আমার তাকানো দেখে সেও কথা বলতে লাগলো আমার সাথে, আমিও জবাব দিয়ে গেলাম।
কিছুটা সময় পর চোখ ফিরিয়ে তাসফি ভাইয়ের দিকে তাকালাম। ওনার ঠোঁটে লেগে থাকা এতক্ষণের সেই হাসিটা আর নেই, গম্ভীর মুখে অদ্ভুত চোখে তাকিয়ে আছেন আমার দিকে। আবারও ওনার পাশে কিয়ানা আপুর দিকে চোখ পড়তেই ফিরিয়ে নিয়ে সাদিক ভাইয়ার দিকে তাকালাম। সেখান থেকে চলে আসার জন্য ভাইয়াকে বলতে চাইলাম, কিন্তু তার আগে তাসফি ভাই গম্ভীর গলায় বলে উঠলেন,

“এখানে কি করছিলি তুই? তোকে না বললাম রিফার সাথে থাকতে। এখানে কেন এসেছিস?”

ওনার চাপা ধমকে আবারও তাকালাম ওনার দিকে। চোখে মুখে কিছুটা রাগের আভাসও ভেসে উঠেছে যেন। ঠিক ধরতে পারলাম না ওনার এই রাগের কারণটা। সাদিক ভাইয়া ওনাকে থামিয়ে দিলেন। বললেন,
“আরে, ওকে ধমক দিচ্ছিস কেন তাসফি? ছোট মানুষ, ওর তো ঘুরাঘুরিই কাজ।”

“ছোট মানুষ ছোটদের সাথে থাকবে, বড়দের এখানে ওর কি কাজ?”

“তুই এমন রেগে….”

সাদিক ভাইয়ার কথাটা শেষ হবার আগেই সেখান থেকে আমার হাত ধরে টেনে নিয়ে এলেন তাসফি ভাইয়া। কিছুটা এগিয়ে নিয়ে আসতে আসতে বলে উঠলেন,
“তোকে না বলছিলাম এদিকটায় আসবি না, রিফার সাথে থাকবি, তাহলে কেন এসেছিস বেয়াদব?”

কিছুটা ধমক দিয়ে বললেও প্রতিত্তোরে কিছু বললাম না আমি। ওনার দিকে তাকিয়ে কথাগুলো শুনতে লাগলাম শুধু। বোঝার চেষ্টা করলাম ওনার এই চাপা রাগের কারণটা।

“এখানে আর এক মুহুর্তও থাকবি না, সোজা রিফার কাছে যাবি আর না হয়তো উপরে যাবি। আমি যেন আর এখানে তোকে একা একা আসতে না দেখি।”

কথাটা বলে আমাকে দাঁড়ানোর সুযোগ দিলেন না উনি। টেনে নিয়ে এগিয়ে দিলেন কিছুটা। ওনার দিকে একবার তাকিয়ে নিজেও দাঁড়াতে চাইলাম না সেখানে। বড় বড় পা ফেলে চলে আসলাম সেখান থেকে। সাথে অভিমানী সত্বাটা জাগ্রত হয়ে উঠলো যেন। গত রাতেও তো কতটা ভালোবাসা দেখালেন। কিন্তু এখন? এখন তো একবার ভালোভাবে খেয়ালও করলেন না। সারাদিন পর দেখা হবার পর একটাবার আদুরে গলায় ‘রুপু’ বলেও ডাকলেন না।

.
“এ্যাই পেতনী, এখানে কি করিস? তখন থেকে খুঁজছি তোকে। রিফাকে নিয়ে যাবে তো, নিচে চল।”

হঠাৎ মাথায় টোকা দিয়ে রাহাতের বলা কথায় চমকে উঠলাম। সহসায় তাসফি ভাইয়ের ভাবনা থেকে বেড়িয়ে এলাম যেন। নিজেকে দ্রুত স্বাভাবিক করে নিলাম। পিছন ফিরে তাকিয়ে হালকা হেঁসে বললাম,
“চল যাচ্ছি।”

কিছুটা অবাক হলো রাহাত। রেগে না গিয়ে আমার ঠান্ডা স্বরে কথাটা যেন ঠিক হজম হলো না ওর। আমার কপালে ও গালে হাত দিয়ে বলে উঠলো,

“তোর শরীর টরীর ঠিক আছে তো রূপা? নাকি তাসফি ভাইয়ের ভালোবাসা পেয়ে তোর মাঝে অন্য কেউ ভর করেছে? ”

“সবসময় ফাজলামি করা ছাড়তে পারিস না?”

“কি হয়েছে তোর? ঠিক আছিস তো?”

গলার স্বর পরিবর্তন করে বলে উঠলো। কিছুটা হাসার চেষ্টা করে বললাম,
“হু! কি হবে আমার?”

“তোকে দেখে কেমন জানি লাগছে, সত্যিই ঠিক আছিস তো, নাকি শরীর খারাপ লাগছে? তাসফি ভাইকে ডাকবো?”

“উফ্! বললাম তো রাহাত, ঠিক আছি আমি।”

কিছুটা চেচিয়ে কথাটা বলায় আবারও অবাক হলো রাহাত। আমার দিকে তাকিয়ে বোঝার চেষ্টা করতে লাগলো, ঠিক কি হয়েছে আমার। মুহুর্তেই নিজেকে স্বাভাবিক করে নিলাম। আস্তে করে বললাম,
“তুই চল, আমি আসছি।”

একটু সময় নিয়ে আমাকে পরখ করলো রাহাত। ‘তাড়াতাড়ি আয়’ বলে আর দাঁড়ালো না। রাহাতের চলে যাওয়ায় কিছুটা হাফ ছেড়ে বাঁচলাম যেন। এই ছেলেটা সারাক্ষণ ফাজলামোর মুডে থাকলেও আমার মন খারাপটা সহসায় ধরে ফেলে।

নিজেকে একবার আয়নায় ভালোভাবে দেখে নিয়ে আর দাঁড়ালাম না রুমে। পা বাড়ালাম নিচে আসার জন্য। মনে মনে ভেবে নিলাম, এবার আর কিছুতেই তাসফি ভাইকে ছাড়তে পারবো না আমি, ওনার থেকে দূরত্ব বজায় রাখতে কিছুতেই পারবো না। গত চার বছরের মতো এবার হয়তো আর কিছুতেই সামলাতে পারবো না আমি।

নিচে আসতেই সবার ভীর জমানো চোখে পড়লো, ভেসে আসলো বড়মার কান্নার গলা। রিফাপুর বিদায়ের জন্যই হয়তো বড়মা কান্নাকাটি করছেন। সবার ভীর ঠেলে এগিয়ে যেতেই রিফাপু তাকালো আমার দিকে। একটু এগিয়ে এসে জড়িয়ে ধরলো আমায়, আস্তে করে চাপা স্বরে বললো,
“যাচ্ছি, ভালো থাকিস বনু, তাসফি ভাইকে ভালো রাখিস।”

ধুক করে উঠলো বুকে, রিফাপুর কথায় এতক্ষণের দমিয়ে রাখা চাপা কান্নাটা বেরিয়ে এলো। বেশ শব্দ করে কেঁদে উঠলাম। সবসময়ের জন্য পাশে পাওয়া মানুষটার হঠাৎ পর হয়ে চলে যাওয়া, সাথে তাসফি ভাইয়ের প্রতি অভিমানটা মাথাচাড়া দিয়ে উঠতেই ভেঙে পরলাম। রিফাপুকে শক্ত করে জড়িয়ে হু হু করে।
মিনিট দুয়েক পর হাত ধরে টানতে লাগলো কেউ। রিফাপুকে ছাড়তে না চাইলেও শক্তপোক্ত হাতে আমাকে টেনে নিয়ে আলাদা করলো। মানুষটাকে দেখতে মাথা তুলে তাকাতেই ঝাপসা চোখে তাসফি ভাইয়ের চেহারা ভেসে উঠলো। সারাদিন পর ওনাকে এতটা কাছে পেয়ে, ওনার হাতের বাঁধনে বাধা পরে আর সামলাতে পারলাম না। উপস্থিত মানুষগুলো কথা ভুলে গিয়ে শক্ত করে জড়িয়ে ধরলাম ওনাকে। আগের চেয়েও জোরে কেঁদে উঠলাম। ওনাকে হঠাৎ জড়িয়ে ধরায় অপ্রস্তুত হয়ে গেলেন হয়তো। চাপা স্বরে ওনাকে ছাড়ার জন্য বলতে লাগলেন।

“রুপু… এ্যাই রুপু, কি করছিস? শান্ত হু, সবাই দেখছে তো।”

ছাড়লাম না ওনাকে, আর না ওনার বাকি কথাগুলো শোনার চেষ্টা করলাম, শুধু শক্ত করে ওনাকে জড়িয়ে বুকে মুখ গুঁজে ফুপিয়ে কেঁদে গেলাম।

.
নিশুতি রাতের শুনশান অন্ধকারে সোডিয়ামের হলদেটে আলো ভেসে আসছে। অর্ধ চাঁদের আলোও মিলেমিশে আবছায়া আলোয় পরিণত হয়েছে বারান্দায়। দূর দূর থেকেও মৃদু আলোর রেখা তীক্ষ্ণ হয়ে ভেসে আসছে। রাতের ঠিক কতটা জানা নেই, হয়তো মধ্য রাত পেরিয়ে গেছে অনেক আগেই। তবুও রুমে না গিয়ে বিগত আধা ঘন্টা এভাবেই বসে আছি বারান্দায়। কেন জানি নিজের রুমে যেতেই হাজারো জড়তা এসে ভীর জমাচ্ছে। তার একমাত্র কারণ কিয়ানা নামক মানবী।

রিফাপুর বিদায়ের সময় আমাকে জড়িয়ে নিয়ে রুমে আসেন তাসফি ভাই। নানান কিছু বুঝিয়ে শান্ত করেন আমাকে। সারাদিন পর ওনাকে একটুখানি কাছে পেয়েই যেন শান্ত হয়েছিলাম। নতুন সৃষ্ট হওয়া অভিমান গুলো দূরে ঠেলে দিয়ে বেশ কিছু সময় জড়িয়ে রাখি ওনাকে।
আমারে স্বাভাবিক করে চলে যান উনি, কিয়ানা আপুর কথা ভুলে স্বাভাবিকও হয়ে যাই। তাকে নিয়ে মনের ভয়টাও কেটে যায়। কিন্তু ঘন্টা খানিক পর রুম ছেড়ে বেড়িয়ে যখন কিয়ানা আপু সহ তাসফি ভাইয়ের বাকি বন্ধুবান্ধবদের উপস্থিতি দেখি তখন কিছুটা অবাক হয়ে যাই। পরক্ষণেই জানতে পারি আজকে রাতটা এখানেই থাকবে সবাই। কালকে এখান থেকেই সাদিক ভাইয়ার বাসায় যাবে। তবুও মনকে সায় জানালাম। বোঝালাম, তারা তো সবাই তাসফি ভাইয়ার বন্ধু, তাহলেও তো থাকতেই পারে। মনটাকে বোঝাতে চাইলেও কিয়ানা আপুর উপস্থিতিতে মন মানতে চাইলো না, বুকে চিনচিনে ব্যথা অনুভব হলো যেন। আমার সেই ব্যথাটাকে আরও বাড়িয়ে দিয়ে কিয়ানা আপু সহ আরও দুই আপুর রাতে ঘুমানোর জন্য জায়গা হলো আমার রুমে। টুকটাক কথা বলে আপুরা শুয়ে পড়তেই চলে আসি বারান্দায়। নিশুতি রাতের আবছায়া অন্ধকারে বিলিয়ে দিতে থাকি নিজের মন খারাপটা, ভাবতে থাকি তাসফি নামক বজ্জাত লোকটার কথা।

“আরে রূপা, এখানে কি করছো তুমি? ঘুমাও নি কেন? আমিও তো রুমে খেয়ালও করি নি।”

হঠাৎ মেয়েলী কণ্ঠস্বরে চমকে উঠলাম কিছুটা, বেরিয়ে আসলাম নিজের ভাবনা থেকে। মাথা ঘুরিয়ে তাকাতেই নজরে এলো কিয়ানা আপুর চেহারা। এত রাতে বারান্দায় দেখে অবাক হলেও সেটা প্রকাশ করলাম না। আস্তে করে বললাম,

“না…মানে, ঘুম লাগছিলো না তো, তাই।”

“ওও তাই বলো, আমি ভাবলাম কিছু হয়তো হয়েছে তোমার। তাছাড়া রিফার জন্য মন খারাপ হচ্ছে হয়তো, এটা কিন্তু স্বাভাবিক।”

“হু! ওই একটু।”

“বসবো এখানে?”

মাথা ঝাঁকালাম আমি, বোঝালাম বসতে এখানে। কিন্তু বুঝতে পারলাম না হঠাৎ এত রাতে আমার পাশে কেনই বা বসতে চাইছে।
“না মানে আমারও ঘুম লাগছে না, তাই উঠে এলাম। যাক ভালোই হয়ছে তোমাকে এখানে পেয়ে, একটু গল্প করা যাবে।”

আবারও অবাক হলাম আমি, বোঝার চেষ্টা করলাম হঠাৎ এত রাতে আমার পাশে বসে কিই-বা গল্প থাকতে পারে কিয়ানা আপুর? চোখে মুখে অবাকের রেশ ধরে তাকিয়ে রইলাম। আমাকে এভাবে তাকিয়ে থাকতে দেখে অদ্ভুত ভাবে হেঁসে উঠলো কিয়ানা আপু। এতক্ষণে বুকের টিপটিপ শব্দের প্রতিধ্বনি যেন দ্বিগুণ হয়ে উঠলো। অজানা আতঙ্কের অজানা এক ভয় এসে জেঁকে ধরলো মনের কোণে।

.
.
চলবে…..