#তুমি_বললে_আজ
লেখনীতেঃ #রিধিমা_জান্নাত_রূপা
পর্বঃ ৩০ ( প্রথমাংশ)
.
অনুভূতি গুলো ঠুনকো নয়, ভালোবাসাটাও তো মিথ্যে নয়। তাহলে? তাহলে কি কোন খামতি ছিলো? তাসফি ভাইকে ভালোবাসার গভীরতা কি কম ছিলো আমার? চার বছর আগের মতো কিশোরী বয়সের সেই সদ্য জন্ম নেওয়া অনুভূতির মতোই কি ভালোবাসাটাও সদ্য জন্ম নেওয়া ছিলো?হাঁটুতে মুখ গুঁজে ফুপিয়ে কেঁদে উঠলাম। শব্দ হবার ফলে দু’হাতে মুখ চেপে ধরলাম।
চোখের সামনে ভেসে উঠলো চার বছর আগের সেই স্মৃতি। ইস্! কিভাবে ভুলে গেলাম আমি সেই দিনের কথা, নিজ কানে শোনা ওনার ও কিয়ানা আপুর কিছু কথা। জানি না, সেদিনের ঘটনা ঠিক কতটা সত্যি ছিলো। এতদিন দূরত্বের ব্যাবধানে সেই দিনটাকে কেন্দ্র করে অভিমান করেছি, ইগনোর করে গেছি। দূরত্বের ব্যাবধান ঘুচিয়ে গেলে সবকিছুই ভুলে গেছি, আপন করে নিয়েছি সেই মানুষটাকে।
.
সেদিন বিকেলে স্কুল থেকে বাসায় ফেরার পর যখন জানতে পারি, তাসফি ভাইয়া আমেরিকা চলে যাবেন, তখন স্তম্ভিত হারিয়ে ফেলেছিলাম নিজের। ছুটে গিয়েছিলাম ওনার রুমে। কিন্তু ওনাকে রুমে না পেয়ে নিরাশ হয়ে যাই, হতাশ হয়ে ফিরে আসি রুমে। জানতে পারি বাসায় চলে গিয়েছেন। কয়েকদিনের শত চেষ্টা করেও দেখা করতে পারি নি ওনার সাথে, জানতে পারি নি ওনার হঠাৎ চলে যাবার কারণ।
মনের সাথে হাজারো বোঝাপড়া করে, ওনার সাথে যোগাযোগ করার চেষ্টা করতে করতে কেটে যায় প্রায় দু’সপ্তাহের মতো। এতদিন ওনার সাথে কথা বলার সুযোগ না হলেও ওনার ফ্লাইটের আগের দিন সেই সুযোগটা আসে। সবার চোখের আড়ালে চলে আসি ওনার রুমে। রুমে ঢুকে ওনাকে ব্যাগ গোছাতে দেখে আলগোছে দরজাটা ভিরিয়ে দিয়ে ওনাকে ডেকে উঠি। জবাব দেন না উনি, একমনে জামা কাপড় লাগেজে গুছিয়েই যান। সামনে গিয়ে ওনার হাত টেনে আবারও ডেকে উঠি। উনি মাথা উঠিয়ে হাতটা ছেড়ে নিলেন। নিজের কাজে মনোযোগ দিয়ে গম্ভীর গলায় বলে উঠেন,
“কি চাই?”
“আপনাকে চাই, আপনার সাথে কথা বলতে চাই।”
“বলে ফেল, শুনছি।”
“কেন চলে যাচ্ছেন তাসফি ভাইয়া? আপনার তো যাবার কথা ছিলো না?”
“সবসময় যে একটা কথাতেই আটকে থাকতে হবে এমনটাও তো না।”
“কিন্তু আপনি তো বলেছিলেন যাবেন না, এখানেই পড়াশোনা করবে। তাহলে এখন কেন যাচ্ছেন।”
“বললাম না, সবসময় এক কথাতেই থাকতে হবে নাকি? আমার হচ্ছে হয়েছে তাই যাচ্ছি।”
ওনার খাপছাড়া কথায় মনটা ভার হয়ে উঠলো। তবুও সেদিকে পাত্তা না দিয়ে ওনার কাছে এগিয়ে গেলাম। হাত টেনে আবারও বললাম,
“যাবেন না আপনি। আপনি চলে গেছে আমি কার সাথে সময় কাটাবো তাসফি ভাইয়া?”
“এভাবে ডিস্টার্ব করছিস কেন? বেয়াদব! যা এখান থেকে, কাজ করতে দে আমাকে।”
“প্লিজ তাসফি ভাইয়া আপনি যাবেন না, আপনি চলে গেলে কিছুতেই ভালো থাকতে পারবো না আমি। আপনাকে ছাড়া….”
“তাসফি তোমার প্যাকিং করা হয়েছে? লেট হয়ে যাচ্ছে কিন্তু আমাদের।”
অচেনা মেয়েলী কণ্ঠস্বরে কিছুটা চমকে উঠলাম। দরজার দিকে তাকাতেই একটা অপরিচিত মেয়ে দাঁড়িয়ে আছে দরজা খুলে। কিছুটা এগিয়ে এসে বলে উঠলো,
“এই মেয়েটা কে তাসফি?”
“আ..আমি ওনার…. ”
“ও আমার মামাতো বোন, রূপা।”
আমাকে থামিয়ে দিয়ে চট করে বলে উঠলেন তাসফি ভাই। এবার কিছুটা অভিমান এসে ভীর জমালো মনে। আমাদের তো বিয়েও হয়েছে, তাহলে বিয়ের কথাটা বললেন না কেন? ওনার দিকে তাকাতেই চোখ ফিরিয়ে নিলেন। মেয়েটা এগিয়ে এসে বলে উঠলো,
“অনেক মিষ্টি তো দেখতে। আমি কিয়ানা, তাসফির খুব কাছের ফ্রেন্ড।”
তিন অক্ষরের নামটা মনে মনে আওড়াতে লাগলাম। সাথে ভাবতে লাগলাম খুব কাছের ফ্রেন্ড, কিন্তু উনি তো আগে কখনো বলেন নি। আমার চুপ করে থাকার মাঝেই আবারও বলে উঠলো,
“আমরা একসাথেই আমেরিকা যাচ্ছি। ও তো যেতেই চাচ্ছিলো না, তার নাকি নিজের দেশ ছাড়া মন টিকবে না। কিন্তু হঠাৎ কেন যে রাজি হয়েছে সেটাই বুঝতে পারছি না। তবে অনেক ভালো হয়েছে, বুঝছো রূপা। ওখানে একসাথে সময় তো কাটাতে পারবো।”
কিয়ানা আপুর শেষ কথাটা কানে আসতেই ধুকপুক করে উঠলো বুকে। মনের কোণে উকি দিতে লাগলো নানান কিছু। আমার ভাবনার মাঝে ডুবে থাকতেই তাসফি ভাইয়া লাগেজ হাতে উঠে দাঁড়ালেন, কিয়ানা আপুকে উদ্দেশ্য করে বলে উঠলেন,
“আমার হয়ে গেছে কিয়ানা, চলো এখুনি বের হবো।”
“হ্যাঁ তাসফি চলো। এই যে পিচ্চি, থাকো হ্যাঁ। আবারও দেখা হবে।”
বলেই আর দাঁড়ালো না। রুম ছেড়ে বেড়িয়ে যেতে লাগলো। তাসফি ভাই যাবার জন্য ওনার হাত টেনে ধরলাম। করুন গলায়, ‘প্লিজ যাবেন না’ বলতেই হাত ছেড়ে নিলেন। কিছু না বলে বেরিয়ে গেলেন রুম ছেড়ে। হুট করেই কেমন জানি ফাঁকা ফাঁকা অনুভূতি হতে লাগলো, চিনচিনে ব্যথা অনুভব হলো বুকে। ধপ করে হাঁটু গেড়ে বসে পড়ে ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠলাম। মিনিট দশেক পর ফুপির কান্নার আওয়াজ পেলাম, তারপর যখন নিচ থেকে গাড়ির শব্দ ভেসে উঠলো, তখন আর সামলাতে পারলাম না নিজেকে। কান্নার আওয়াজও দ্বিগুণ হয়ে উঠলো। কিছু সময় যেতেই তাসফি ভাইয়ার রুমে সবাই চলে আসলো আমার কান্নার আওয়াজে। শান্ত করার চেষ্টা করতে লাগলো সবাই, জানতে চাইলো কান্নার কারণ। তাদের প্রশ্নের উত্তর না দিয়ে শুধু কানানা করে গেলাম, অস্পষ্ট সুরে বলে উঠলাম,
“কেন চলে গেলেন উনি? ওনার তো যাবার কথা ছিলো না, তাহলে কেন চলে গেলেন উনি?”
.
সময়ের সাথে পাল্লা দিয়ে নিজেকে শান্ত করে নিলাম কিছুটা। কিন্তু ওনাকে এক নজর দেখার আকাঙ্ক্ষা পূরণ হলো না আমার। ওনার একটুখানি ছোঁয়া কি, কথাটাও শুনতে পেলাম। এভাবেই কেটে গেল প্রায় ছয় মাস। এত এত ফোন কল ও মেসেজের উত্তর না পেয়ে রাগে, অভিমানে তিনদিন ওনাকে ফোন কল ও মেসেজ করা বন্ধ করে দেই। কিন্তু নিজের মনের সাথে না পেরে রিফাপুর ফোন নিয়ে আবারও ফোন দেই ওনার নাম্বারে। ঠিক ফোন কল না, ভিডিও কল। রিং হবার শেষ মুহুর্তে যখন আগের মতোই আশা ছেড়ে দিলাম, ঠিক তখনই অবাক করে দিয়ে রিসিভ হলো। অপর পাশে অন্ধকার ছাড়া তেমন কিছুই নজরে এলো না।
চমকে উঠে দুরুদুরু বুক নিয়ে ‘হ্যালো’ বলার আগেই অপর পাশ থেকে ভেসে উঠলো তাসফি ভাইয়ের চিরচেনা সেই অস্পষ্ট কণ্ঠস্বর।
“পারছি না আমি, কিছুতেই পারছি না আমি তোমাকে ছাড়া থাকতে। তোমাকে এক নজর না দেখে দিনগুলো কাটাতে। পাগল হয়ে যাচ্ছি আমি, এলোমেলো হয়ে হয়ে যাচ্ছে আমার ভাবনাগুলো। তোমাকে ছাড়া আমি ভালো নেই রু….”
“তাসফি ভাইয়া…..”
“তাসফি…. এই তাসফি, এই তো আমি। এমন করছো কেন তুমি?”
নারীকণ্ঠ ভেসে আসতেই থমকে গেলাম আমি। স্তম্ভিত হয়ে তাকিয়ে রইলাম ফোনের স্ক্রিনের দিকে। তাসফি ভাইয়া ডাকটা যেন আমার গলাতেই মিলিয়ে গেল। তাসফি ভাই আবারও বললেন,
“পারলাম না আমি, তোমাকে দূরে ঠেলে তোমার শূন্যতা পূরণ করতে কিছুতেই পারলাম না আমি। তোমাকে ছাড়া যে আমি পুরোটাই ব্যার্থ। একটু স্বস্তি পেতে চাই, তোমাকে কাছে পেয়ে একটু ভালো থাকতে চাই।”
“তাসফি, এই তো আমি। তোমার কাছেই তো আছি, যাবো না তো কোথাও। সারাজীবন তোমার সাথেই থাকবো।”
একটু পর আবারও বলে উঠলো,
“ইস্! এমন করছো কেন? আমি তো তোমার কাছেই আছি। আর কতটা কাছে যাবো?”
তাসফি ভাইয়ের কোন সারা এলো না। নিস্তব্ধ রুমে শুধু কিয়ানা আপুর কথাগুলোই ভেসে উঠলো, আপন মনে বলে গেল নানান কথা। আর শুনতে পেলাম না কথাগুলো। একহাতে মুখ চেপে ধরে অপর হাতে কেটে দিলাম ফোন। বিছানায় ছুড়ে ফেলে চিৎকার করে কেঁদে উঠলাম। বারংবার কানে ভাসতে লাগলো তাসফি ভাই ও কিয়ানা আপুর কথোপকথন গুলো। ভালোবাসা জন্ম নেওয়া মনটা ভেঙে গেল সহসায়, সাথে ভেঙে গেল ওনাকে করা বিশ্বাসটুকুও। আম্মু, বড়মা ও রিফাপু ছুটে এলো রুমে। আমাকে সামলানোর চেষ্টা করে জানতে চাইলো হঠাৎ কি হয়েছে। কিন্তু মুখ ফুটে ওনার কথাটা কিছুতেই বলতে পারলাম না। নিজ মনেই সহ্য করে নিলাম সমস্ত কিছু।
সময়ের সাথে শক্ত করে নিলাম নিজেকে, ভুলে যাবার প্রয়াস চালিয়ে যেতে লাগলাম। ওনাকে ভুলে থাকতে না পারলেও অভিনয় করে যেতে লাগলাম প্রতিনিয়ত। কয়েকদিন পর নিজেকে পুরোপুরি সামলে নিয়ে, হাজারো অভিমান নিয়ে পুরো দমে ইগনোর করে গেলাম ওনাকে। সেই অভিমানের স্থায়িত্বকাল হলো পুরো চার বছর।
.
.
চলবে…..
#তুমি_বললে_আজ
লেখনীতেঃ #রিধিমা_জান্নাত_রূপা
পর্বঃ ৩০ ( শেষাংশ)
.
চার বছর সময়টা কম না, অনেক বেশিই সময়। সময়ের আওতায় থেকে বেরিয়ে গেলে অনুভব করা যায় ঠিক কতটা সময় নিজের জীবন থেকে বেড়িয়ে গিয়েছে, হারিয়ে গেছে কতকিছু।
চার বছরের অপেক্ষার পর অভিমান গুলো দূরে ঠেলে, ওনাকে কাছে টেনে নিয়েছিলাম। সবকিছু ভুলে আবারও নতুন ভাবে বিশ্বাস করেছিলাম ওনাকে। কিন্তু? কিন্তু আবারও একবার হেরে গেলাম নিজের কাছে, নিজের ভালোবাসার কাছে, ওনাকে করা বিশ্বাসের কাছে।
কিছু সময় আগেও তো ভাবতে পারি নি আবারও এভাবে ঠকে যেতে হবে আমাকে, ভেঙে যাবে আমার বিশ্বাসগুলো। সদ্য জোড়া লাগা বিশ্বাসটা আবারও ভেঙে গেল তাসফি ভাইয়ের প্রতি। শুধু বিশ্বাস ভাঙে নি, সেই মানুষটার প্রতি ঘৃণাও জন্ম নিলো নতুন ভাবে।
কিন্তু এখন? এখন কিভাবে নিজ চোখে সত্যিটা দেখার পরও মেনে নিবো সেই মানুষটাকে? চার বছর আগের সেই ঘটনাকে ভুল মনে করে ভুলে গেলেও কিছুক্ষণ আগের এই ঘটনাকে কিভাবে ভুলে যাবো? কথাগুলো নিজের ভাবনাতে আনতেই চোখের দৃশ্যপট হলো কিছু অপ্রিয় সত্য। দু’হাতে মুখ চেপে আবারও ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠলাম।
.
তখন কিয়ানা আপু পাশে বসতেই কেমন জানি ইতস্তত হতে লাগলো আমার মাঝে। মুখ ফুটে কিছু বলতে পারলাম না। গভীর রাতের নিস্তব্ধতায় কিছুটা সময় কেটে যেতেই কিয়ানা আপু আস্তে করে বলে উঠলো,
“জানো রূপা, এখন থেকে প্রায় ১০ বছর আগে তাসফিকে আমি প্রথম দেখি। কলেজের নবীন বরণে।”
চমকে উঠলাম আমি। বুকের টিপটিপ শব্দটা আগের চেয়েও দ্বিগুণ হয়ে উঠলো। এতক্ষণে তাসফি নামক যে ভয়টা মনের কোণে উঁকি দিচ্ছিলো সেই ভয়টায় যেন এক মুহুর্তে সত্যি হয়ে গেল। ঘাড় ঘুরিয়ে কিয়ানা আপুর দিকে তাকালাম, সামনের দিকে তাকিয়ে আছে এক ধ্যানে। মনে হচ্ছে আমি যে তাকিয়েছি তার বিন্দু পরিমাণের আভাস পর্যন্ত নেই। আমি তার দিকে তাকিয়েছি সেটা বুঝতে পেরেই আবারও অদ্ভুত ভাবে হাসলো। বললো,
“তাসফির সাথে আমার ফ্রেন্ডশিপটা হঠাৎই হয়ে যায়। তখন থেকেই আলাদা এক সম্পর্ক গড়ে উঠে আমাদের মাঝে। কোন এক অজানা কারণে আমাকে কাছে টেনে নিয়েও বারবার দূরে ঠেলে দিতো তাসফি। কিন্তু মনের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করে আবারও দিন শেষে আমার কাছে এসেই স্বস্তি পেত। এক সময় বন্ধুত্ব থেকে গভীর সম্পর্কে রুপ নেয় আমাদের। সেই গভীর সম্পর্ক টা যে ঠিক হতে পারে, সেটা নিশ্চয়ই বুঝতে পারছো?”
নিশ্বাসের আনাগোনা যেন হঠাৎই ভারী হয়ে উঠলো আমার, অনেক কষ্টে টেনে টেনে শ্বাস নিতে লাগলাম। একটু থেমে কিয়ানা আপু আবারও বলে উঠলো,
“প্রথম দিকে আমাদের সম্পর্কের মাঝে দূরত্ব থাকলেও চার বছর আগে সবকিছুই ঘুচিয়ে গেছে, বিশাল গভীরতায় চলে গেছে। এই চার বছরে নতুন রুপে, নতুন ভাবে বারবার তাসফিকে কাছে পেয়েছি। কি বিশ্বাস হচ্ছে না আমার কথা?”
বলেই আমার দিকে একবার তাকালো কিয়ানা আপু। হাতে থাকা মোবাইলে কিছু একটা বের করতে লাগলো। আধা মিনিটের মতো সময় নিয়ে ‘তাহলে এগুলো দেখো’ বলেই ফোনটা আমার দিকে ত্যাগ করে ধরলো। কৌতুহলী চোখ দু’টো সাথে সাথে চলে গেল সেদিকে। থমকে গেলাম এক মুহুর্তের জন্য, নিজের স্তম্ভিত হারিয়ে স্তব্ধ হয়ে তাকিয়ে রইলাম মোবাইলের স্ক্রিনের দিকে। দরদর করে ঘামতে লাগলো শরীর। আর এদিকে একের পর এক মোবাইলে স্ক্রিনের ছবিগুলো পাল্টাতে লাগলো কিয়ানা আপু। তাসফি ভাইয়ের সাথে আরও ঘনিষ্ঠ অবস্থায় শেষ ছবিটা দেখিয়েই বন্ধ করে দিলো ফোন। আমার দিকে তাকাতেই আবারও বলে উঠলো,
“এটা তো শুধু এক রাতের কিছু মুহূর্ত দেখালাম। এই চার বছরে প্রতিটা রাতে প্রতিটা মুহুর্তে তাসফির সাথে এমন হাজারো ঘনিষ্ঠ মুহুর্ত আছে, এর থেকেও আরও গভীর ঘনিষ্ঠ মুহুর্ত স্মৃতি হয়ে আছে আমাদের। উঁহু! ঠিক স্মৃতি বলা যায় না। স্মৃতি তো হবে তখন, যখন আমরা আলাদা হয়ে যাবো, আমাদের মাঝে চলে আসবে তৃতীয় কেউ।”
থামলো কিয়ানা আপু। সেকেন্ডের মতো সময় নিয়ে বলে উঠলো,
“পরিবারের খুশি হোক বা তোমার নিজের খুশি, আমাদের মধ্যে তৃতীয় ব্যক্তি হয়ে এসো না রূপা। তাসফির সাথে কখনোই সুখী থাকবে না তুমি, কারণ তাসফি তোমাকে চায় না, ভালোবাসে না তোমাকে। তোমাকে জুড়ে ওর সমস্ত কেয়ার করা, খেয়াল রাখা শুধুই দ্বায়িত্ববোধ। ওর দাদুকে দেওয়া কথা রাখা ছাড়া আর কিছুই না। তাসফির ভালো থাকাটা শুধু আমার কাছেই আছে। তোমাকে যদি ও ভালোই বাসতো তাহলে কখনোই তোমাকে ছেড়ে যেতো না আমার সাথে আমেরিকয়। তোমাকে ভুলে থাকার জন্য উপেক্ষা করতো না, যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন করে রাখতো না তোমার সাথে, রাতের পর রাত কাটাতো না আমার সাথে….”
টপটপ করে অশ্রুকণা গড়িয়ে পড়তে লাগলো চোখ থেকে, কথাগুলো কিছুতেই সহ্য করতে পারলাম না। বারংবার একটু আগের দেখানো ছবিগুলো ভেসে উঠতে লাগলো চোখের সামনে। মৃদু চিৎকার করে থেমে যেতে বললাম কিয়ানা আপুকে। কিন্তু থামলো না সে। বলে উঠলো,
“তাসফির দ্বায়িত্ববোধে ভালোবাসাকে দূরে ঠেলে দিবে কিন্তু নিজের দ্বায়িত্ব কখনোই এড়িয়ে যাবে না রূপা, সেটা তুমি খুব ভালো ভাবেই জানো। আমাকে দূরে ঠেলে তোমাকে ঠিকই কাছে টেনে নিবে, কিন্তু ভালোবাসতে পারবে কি? কখনোই পারবে না, ভালোবেসে আপন করে নিতে পারবে না তোমাকে। তোমার দ্বায়িত্ব থেকে মুক্তি করে নাও নিজেকে, মুক্তি দাও তাসফি কে। ভালো থাকতে দাও ওকে, বাঁধা হয়ে এসো না আমাদের মাঝে।”
উঠে দাঁড়ালো কিয়ানা আপু। আবারও বললো,
“তোমার বয়সটা অনেক কম রূপা, ভালোবাসার চেয়ে আবেগটা প্রাধান্য বেশি পাবে। খুব তারাতাড়ি তাসফির প্রতি তোমার এই আবেগটা মিলিয়ে যাবে, দেখো। শুধু ওর থেকে একটু দূরত্ব বজায় রেখো, তাসফিকে আমার কাছে ফিরিয়ে দিও। আর যদি ওকে ভুলে যেতে না পারো, তবে আমার বলা কথাগুলো আর ওই ছবিগুলোর কথা মনে করো। ব্যাস! এতটুকুই বলার ছিলো তোমাকে, ভালো থেকো।”
.
কিয়ানা আপুর বলা কথার বিপরীতে কোন কথায় বের হয় নি আমার মুখ ফুটে, শুধু চোখের অশ্রুগুলোই বিসর্জন হয়েছে।
ফজরের আজানের শব্দ কানে আসতেই কান্না থামিয়ে দিলাম। এতটা সময় চলে গেল বুঝতেই পারলাম না। দু’ হাতে চোখের ওানি মুছে স্বাভাবিক করার চেষ্টা করলাম। কিন্তু হলো না, বারবার অশ্রুগুলো ঝড়ে পড়ে ভিজিয়ে দিতে লাগলো পুরো মুখ। না…. এভাবে ভেঙে পড়লে তো আমার চলবে না, ওই ঠকবাজ মানুষটার জন্য নিজে এতটা কষ্ট পেলে চলবে না। শক্ত রাখবো নিজেকে, ভুলে যাবো ওনাকে, ফিরিয়ে দিবো ওনার ভালোবাসা, মুক্তি দিবো ওনাকে।
জোরে জোরে নিশ্বাস টেনে অনেক কষ্টে স্বাভাবিক করে নিলাম নিজেকে। গায়ে জড়িয়ে রাখা ওড়না দিয়ে পুরো মুখটা মুছে নিয়ে উঠে দাঁড়ালাম। সারারাত বারান্দায় কাটিয়ে রুমে আসলাম। বিছানার দিকে তাকাতেই তাসফি ভাইয়ের আর দু’টো বান্ধবী সহ কিয়ানা আপুকে চোখে পড়লো। বিষন্নতায় ছেয়ে গেল মন। আবারও বার কয়েক জোরে শ্বাস টেনে নিলাম। সোজা ওয়াশরুমে ঢুকে ওজু করে বেরিয়ে এলাম। রুমের এক কোণায় জায়নামাজ বিছিয়ে নামাজ আদায় করে নিলাম। তারপর বিছানায় এসে এক কোণায় গুটিশুটি হয়ে গা এলিয়ে দিলাম। ক্লান্তিতে ভরা শরীর মিলিয়ে গেল বিছানায়, চোখ দুটো আপনা আপনিই বন্ধ হলে এলো।
.
কারোর হালকা চেঁচিয়ে বলা কথায় কিঞ্চিৎ মাথা ব্যাথায় ঘুমটা আলগা হয়ে এলো। মিটমিট করে চোখ খুলতেই একদল আলো এসে ধাক্কা খেল চোখে। খিঁচে বন্ধ করে নিলাম চোখ দুটো। পাশ ফিরে বালিশ জড়িয়ে আবারও ঘুমানোর চেষ্টা করতেই ভেসে আসলো আম্মুর কর্কশ গলায় বলা কথাগুলো।
“সারারাত কি চুরি করে গেছিলি, যে ঘুমাতে পারিস নি? এত বেলা হয়ে গেল এখনো পড়ে পড়ে ঘুমাচ্ছিস কেন? খাবি কখন? না খেয়ে থেকে থেকে শরীরটার কি হাল বানিয়েছিস দেখ তো। বাড়ি ভর্তি মানুষ, সকলে উঠে গেছে অথচ বাড়ির মানুষ হয়ে এখনো ঘুমাচ্ছিস কি করে? রিফার ওখানে যেতে হবে না? উঠ তাড়াতাড়ি।”
“উফ্! আম্মু, যাও তো তুমি। মাথা ব্যাথা করছে আমার, ঘুমাতে দাও একটু।”
“করবে না মাথা ব্যাথা? খাওয়া দাওয়া ছেড়ে সারাদিন শুয়ে বসে থাক, তাহলেই তো মাথা ব্যাথা করবে না।”
আম্মুর বকবকানিতে নিজেকে আর টিকিয়ে রাখতে পারলাম না বিছানায়। দু’হাতে মাথা চেপে ধরে উঠে বসলাম। সারারাত না ঘুমানোর ফলে প্রচন্ড ভার হয়ে আছে মাথাটা। সেদিকে পাত্তা না দিয়ে আম্মুকে ‘আমি আসছি’ বলে যেতে বললাম। দ্বিমত করলো না আম্মু, বেরিয়ে গেল রুম ছেড়ে।
অলসতা কাটিয়ে বিছানা ছেড়ে উঠে গেলাম। অল্প সময়েই ফ্রেশ হয়ে বেরিয়ে এলাম রুম ছেড়ে। ডাইনিং রুমে আসতেই একে একে সবাইকেই চোখে পরে গেল। শুধু তাসফি ভাইয়া, কিয়ানা আপু সহ তাদের বন্ধু মহল ছাড়া। একটুকুও অবাক হলাম না তাতে। অজানা এক চাপা কষ্টে মন ভারী হয়ে উঠলেও প্রকাশ করলাম না কিছুতেই। শক্ত করতে হবে নিজেকে, খুব করে বোঝাতে হবে অবাধ্য এই অবুঝ মনকে, মুক্তি দিতে হবে ওনাকে ওনার দ্বায়িত্ব গুলো থেকে।
.
সাদিক ভাইয়ার বাসায় যাবার জন্য সবাই রেডি হলেও আমি চুপচাপ বসে রইলাম রুমে, দেখতে থাকলাম একের পর এক সবার প্রসাধনীর সাজ। আমাকে নিয়ে যাবার জন্য সবাই জোড়াজুড়ি করলেও মাথা ব্যাথা ও সেদিনই গিয়েছিলাম বলে বারণ করে দেই। সবাই যাবার জন্য হাজারো বললেও আমার জেদে হার মেনে নেয়। সবাই একে একে রেডি হয়ে বেরিয়ে পরে, আর আম্মু, বড়মা, ফুপি চাচীদের সাথে আমিও বাসায় থেকে যায়।
সবাই চলে যেতেই নিজের রুমে এসে দরজা আঁটকে বিছানায় শুয়ে পরি। বালিশে মুখ গুঁজে ফুপিয়ে কেঁদে উঠলাম। বারবার মনে হতে লাগলো তাসফি ভাইয়ের আমাকে এরিয়ে চলা। কিয়ানা আপুর বলা ‘তোমাকে তাসফি ভালোবাসে না’ কথাটার স্পষ্টতা ফুটে উঠলো যেন। সবাই আমাকে তাদের সাথে যাবার জন্য বললেও তাসফি ভাইয়া একবারও বলেন নি, আমি যেতে না চাইলেও আমার কথায় সায় জানিয়ে বাসাতেই থাকতে বললেন। বলবেন-ই বা কপন? উনি তো আমাকে ভালোবাসেন না, ওনার সবকিছুই তো কিয়ানা আপুর জন্য। আর আমি তো শুধুই দ্বায়িত্ব বোধ।
তাসফি ভাইয়ের সাথে কাটানো প্রতিটি মুহুর্ত গুলো মনে হতেই সমানে ঝড়তে লাগলো চোখের অশ্রুগুলো। বৃষ্টির দিনের সেই রাত থেকে গত কয়েকদিনের প্রতিটি মুহুর্ত মনে হতেই রি রি করে উঠলো পুরো শরীর। ওনার করা প্রতিটি স্পর্শের মুহুর্ত গুলো চোখের দৃশ্যপট হতেই কিয়ানা আপুর দেখেনো সেই ছবিগুলো ভেসে উঠলো চোখে। সাথে সাথে একরাশ ঘৃণা জন্ম নিলো ওনার প্রতি। বালিশে মুখ গুঁজে চিৎকার করে কেঁদে উঠলাম। কান্নার আওয়াজ গুলো সেই আমাতেই এসে আঁটকে গেল শুধু।
.
.
চলবে……