#তুমি_বললে_আজ_২
লেখনীতেঃ #রিধিমা_জান্নাত_রূপা
পর্বঃ ৩৯.
.
বিকেলে মি. বজ্জাত লোকটার কথা অনুযায়ী হসপিটালে যাবার জন্য রেডি হতে হলো আমাকে। সকালের চেয়ে শরীর বেশ কিছুটা সুস্থ থাকায় আর ফুপির সাহায্য নিতে হলো না। রেডি হয়ে নিচে নামতেই আমাকে নিয়ে বেড়িয়ে পড়লেন তাসফি ভাই। পুরো রাস্তায় শক্ত করে আমার হাত ধরে রাখলেন উনি। হসপিটালে আসার পর ডক্টরের চেম্বারে ঢোকার পর পর্যন্তও একই ভাবে আমার হাতটা ধরে রাখলেন।
গত কয়েকদিনের শরীরের কন্ডিশন জানতে চাইলো ডক্টর। আমি কিছুটা বলতেই তাসফি ভাই বলে উঠলেন গত রাত এবং আজকে শরীর দূর্বল হওয়ার কথাটা। ওনার কথা শুনে কয়েকটা টেস্ট করতে দিলেন। বেশ বিরক্ত হয়ে তাকালাম ওনার দিকে। এখন তো ঠিক আছি, অযথা বলার মানে টা কি? পর মুহুর্তেই ভাবলাম, এগুলো তো আর আমার জন্য করছেন না। এত কেয়ার, এত ভালোবাসা সবটাই তো শুধু বাচ্চাটার জন্য। আমার জন্য তো ওনার কোন ভালোবাসায় অবশিষ্ট নেই। হতাশার নিশ্বাস ছাড়লাম। না…. আর কিছুতেই থাকবো না ওনার কাছে। কালকে যে করেই হোক ফুপা ফুপির সাথে কথা বলতে হবে।
ঘন্টা খানিকের মতো সময় নিয়ে টেস্টের রিপোর্ট নিয়ে আবারও এসে বসলাম ডক্টরের চেম্বারে। কিছুটা সময় নিয়ে টেস্টের রিপোর্টটা দেখলেন ডক্টর। একটু হতাশ হয়ে বলে উঠলেন,
“মি. তাসরিফ, আপনার ওয়াইফের শরীরে হিমোগ্লোবিনের মাত্রা অনেক কম। র*ক্তের উৎপাদনও অনেকটা কমে গেছে। এমন হলে কিন্তু ডেলিভারির সময় অনেকটা প্রবলেম হবে।”
মাথা ঘুরিয়ে আমার দিকে তাকালেন তাসফি ভাই। ওনার চোখে মুখে ফুটে উঠলো চিন্তার আভাস। তাসফি ভাইয়ের এই চিন্তিত মুখখানা দেখে হঠাৎ মনে হলো, এই চিন্তাটা কি আমার জন্য? না-কি শুধু মাত্র আমাদের বাচ্চাটার জন্য? ঠিক বুঝতে পারলাম না আমি। ডক্টর আবারও বললেন,
“মিসেস রামিয়াত, আপনার কন্ডিশন কিন্তু একদম ভালো নেই। এই সময় শরীরে র*ক্ত থাকাটা খুবই প্রয়োজন। খাওয়া দাওয়ার মাত্রাটা একটু বাড়িয়ে দিন। আর আমি কিছু মেডিসিন লিখে দিচ্ছি সেগুলো নিয়ম করে খান। এক সপ্তাহের মধ্যে যদি শরীরে হিমোগ্লোবিনের মাত্রা বৃদ্ধি না পায়, তহলে কিন্তু ব্লাড দিতে হবে।”
বলেই প্রেসক্রিপশনে লিখতে লাগলো। তাসফি ভাই একটু চুপ থেকে কথা বলতে লাগলেন ডক্টরের সাথে। সবকিছু বুঝিয়ে নিয়ে চিন্তিত মুখে বেরিয়ে এলেন আমাকে নিয়ে। ওনার চোখে মুখে কিছুটা রাগের আভা ফুটে থাকলেও কোন বাক্য ব্যায় করলেন না আমার সাথে। হাতটা শক্ত করে চেপে ধরে বেরিয়ে এলেন হসপিটাল থেকে।
হসপিটাল থেকে বেড়িয়ে গাড়ির জন্য রাস্তার পাশে দাঁড়ালাম। গাড়ির জন্য অপেক্ষা করতেই হঠাৎ নজরে এলো রাস্তার পাশে ছোট্ট একটা আচারের দোকান। মুহুর্তেই খাওয়ার লোভটা আর সামলাতে পারলাম না। বরাবরই আচারের প্রতি আমার লোভ টা একটু বেশিই। প্রেগ্ন্যাসির পর সেই লোভের মাত্রাটা যেন দ্বিগুণ হয়ে উঠেছে। ঢাকায় আসার সময় বড়মা কয়েক রকমের আচার বানিয়ে দিয়েছিলো, এক মাস না যেতেই সেগুলো সব একাই সাবার করে ফেলেছি। আজকে আচারের দোকান দেখে খাওয়ার বাসনা ব্যাপকভাবে জাগ্রত হয়ে উঠলো।
“কথা কানে যাচ্ছে না? এভাবে দাঁড়িয়ে আছিস কেন? বেয়াদব! রিকশায় উঠ।”
তাসফি ভাইয়ের ধমকে ফিরে তাকালাম ওনার দিকে। আচারের দোকান দেখে এতটাই মগ্ন ছিলাম যে, ওনার কথাগুলোও আমার কান পর্যন্ত পৌঁছায় নি। ওনার কথা শুনলেও রিকশায় না উঠে দাঁড়িয়ে রইলাম। আবারও রিকশায় ওঠার জন্য ধমক দিলে বিরক্ত হয়ে কপাল কুঁচকে একবার তাকালাম ওনার দিকে, চোখ ফিরিয়ে মুখটা গোমড়া করে আচারের দোকানের দিকে তাকালাম। তাসফি ভাই কিছু বলতে গিয়ে থেমে গেলেন। এবার হয়তো বুঝতে পারলেন আমার দাঁড়িয়ে থাকার কারণ। জোরে শ্বাস টেনে নিলেন। কিছুটা ধমকের সুরে বলে উঠলেন,
“রাস্তার টই ফালতু জিনিস গুলো খাওয়ার জন্য দাঁড়িয়ে আছিস? মামী এতগুলো আচার বানিয়ে দিলো, সেগুলো খেয়ে স্বাদ মিটে নি? ওঠে বস রিকশায়।”
“ওগুলো তো অনেক আগেই শেষ।”
“শেষ হয়েছে বলে খোলা রাস্তার এই ফালতু জিনিস গুলো খেতে হবে? উঠে বস বলছি।”
ওনার কথায় বিরক্তির সাথে সাথে রাগও এসে জমা হলো। কিছু বলতে চাইলে চুপ করে দিলেন আমাকে। হাত টেনে ধরে রিকশায় উঠতে বললেন। কিছু বলতে পারলাম না ওনাকে। হাজারো রাগ দিয়ে উঠে বসলাম। বজ্জাত লোক একটা। একটু কিনে দিলে কি এমন হতো? মনে মনে হাজারো বকা দিতে লাগলাম। রিকশাও চলতে লাগলো তার আপন গতিতে। বেশ কিছুটা পথ যেতেই হঠাৎ থেমে গেল রিকশাটা। নিজের ব্যালেন্স ধরে রাখতে না পেরে পড়ে যেতে নিলাম, সাথে সাথে ধরে ফেললেন তাসফি ভাই। কিছুটা চেঁচিয়ে বলে উঠলেন,
“সামলাতে পারিস না নিজেকে? এখনি তো পড়ে যেতি।”
হঠাৎ মনে পড়ে গেল কয়েক মাস আগের সেই রাতের কথা। এই মানুষটা ছাড়া সত্যিই আমি নিজেকে কখনো সামলাতে পারবো না। ওনার দিকে তাকিয়েই মাথা ঝাঁকালাম। বোঝালাম ‘আপনাকে ছাড়া একদমই সামলাতে পারবো না নিজেকে।’ সরে গেলেন উনি। আমাকে ছেড়ে দিয়ে বললেন,
“বসে থাক, একদম কোথাও যাবি না। আমি এখনি আসছি।”
বলেই নেমে গেলেন উনি। বুঝতে পারলাম না, এই মাঝ রাস্তায় মেনে হঠাৎ কোথায় গেলেন। সন্ধ্যা পেরিয়েছে সবে। রাস্তার ল্যাম্পপোস্টের আলোও জ্বলে উঠেছে। আশেপাশে ভীর খুব একটা না থাকলেও মোটামুটি বলা চলে। সন্ধ্যার খোলা আকাশের নিচে রিকশায় বসে নানান কিছু ভাবতে লাগলাম। আমার ভাবনার মাঝেই হুট করে চলে আসলেন তাসফি ভাই। কিছু না বলে হাতের বেশ বড়সড় ব্যাগটা আমার হাতে ধরিয়ে দিলেন। তারপর বসে পড়লেন রিকশায়।
ওনার করা এই কান্ডে হাজারো বিরক্ত নিয়ে ব্যাগের দিকে তাকাতেই অবাক হয়ে গেলাম। মুহুর্তেই মন খারাপ কাটিয়ে হাসি ফুটে উঠলো ঠোঁটের কোণে। এক গাদা আচার আর চকলেট দেখে হালকা চেঁচিয়ে উঠলাম।
“আহ্! এগুলো আমার জন্য? থ্যাঙ্কিউ তাসফি….”
এক হাতে ওনার হাতের বাহু জড়িয়ে, জড়িয়ে ধরতেই থেমে গেলেই। মাঝ রাস্তায় ওনাকে জড়ি ধরতে চাইছিলাম ভেবেই হাজারো লজ্জায় ঘিরে ধরলো। ইস্! রুপা, তুই আসলেই একটা গাধী। এই বজ্জাত লোকটার প্রতি রাগ না হলে এতো ভালোবাসা দেখাচ্ছিস কেন? মুখ ফুটে কিছু না বললেও তখন তো বুঝিয়েছিস ওনাকে, আচার খেতে চাস। ধমক দিয়ে চুপ করিয়ে দিয়ে এখন না হয় এনে দিয়েছে। তাতে এত খুশি হওয়ারই বা কি আছে?
চুপ হয়ে গেলাম একেবারে। হাত ছাড়িয়ে নিয়ে সোজা হয়ে বসলাম। আপন গতিতে রিকশা চলতে শুরু করলো। রাস্তার মাঝেই ব্যাগ থেকে একটা চকলেটের প্যাকেট বের করে খেতে লাগলাম। তাসফি ভাই কপাল কুঁচকে তাকালেন আমার দিকে। কিছু বললেন না। বমিও ওনাকে পাত্তা না দিয়ে চকলেট খাওয়ায় পুরো মন দিলাম।
.
মাঝ রাতে আজকেও হঠাৎই ঘুমটা ভেঙে গেল। অনুভব হলো নিজের শরীরের সাথে ভারী কিছুর অস্তিত্ব। ঘুমটা আরও আলগা হয়ে গেল আমার। দু’হাতে সরানোর চেষ্টা করে একটু নড়েচড়ে উঠতেই ভারী ভাবটা ছেড়ে দিলো কিছুটা। ওঠার চেষ্টা করতেই আমাকে টেনে জড়িয়ে নিলো। ঘুমটা পুরোপুরি ভাবে ছুটে গেল আমার। এতক্ষণে বুঝতে পারলাম এটা তাসফি নামক বজ্জাত লোকটার কাজ। আবারও ওনাকে ছাড়িয়ে ওঠার চেষ্টা করতেই টেনে নিলেন নিজের বুকে। শক্ত করে জড়িয়ে ধরে ঘুম ঘুম কণ্ঠে অস্পষ্ট সুরে বলে উঠলেন,
“পেঙ্গুইনের মতো এত লাফালাফি না করলে হয় না? একটু চুপচাপ থাকতে পারো না? সারাদিন তো একটুও কাছে পাই না, রাতে একটু কাছে পাই তখনও লাফালাফি শেষ হচ্ছে না রুপুসোনা?”
প্রচন্ড গতিতে টিপটিপ শব্দ করে উঠলো বুকে। নিশ্বাসের মাত্রাটা বেড়ে গেল কিছুটা। এত মাস পর ওনাকে এতটা কাছে পেয়ে সবকিছুর তাল হারিয়ে গেল যেন আমার। ওনার ঘুমের ঘোরে বলা কথা গুলো হাজারো স্বস্তির দেখা দিলো আমার মনে। কোন কথা বললাম না। ওনার বুকে মুখ গুঁজে চুপ করে রইলাম।
কতটা সময় পেরিয়ে গেল জানা নেই আমার। এতক্ষণেও চোখে ঘুমের রেশ পর্যন্ত ধরা দিলো না। এতগুলো মাস পর ওনার বুকে একটুখানি জায়গা পেয়ে সরে যেতে মন সায় দিলো না। সেভাবেই ঘুমহীন চোখে কাটিয়ে দিলাম রাতের অর্ধেকটা। ভেবে গেলাম নানাম কিছু।
দিন শেষে আমার আড়ালে সেই ঠিকই তো কাছে টেনে নিলেন আমাকে। তাহলে এতটা অবহেলা কিসের জন্য। এতবার ক্ষমা চাওয়ার পরেও কেন একটু বোঝার চেষ্টা করলো না আমাকে? অন্যের কথায় একটু না হয় ভুলই বুঝেছি, পরবর্তীতে বারবার ক্ষমাও তো চেয়েছি ওনার কাছে। তাহলে? তাহলে কেন এতটা অবহেলা করছেন উনি আমাকে? অপরাধটাই বা কি ছিলো আমার? এখন এতটা কেয়ার করা, এতটা কাছে আসা সবকিছুই তো আমাদের সন্তানের জন্য। তাহলে বাচ্চাটা যদি না আসতো, তাহলে কি উনি আমায় কখনোই মেনে নিতেন না? এতটা কেয়ার করা, এতটা কাছে আসা, তার কোনটাই কি করতেন না উনি? ধপ করে মাথায় আগুন জ্বলে উঠলো যেন। প্রয়োজন নেই ওনার এই দেখানো ভালোবাসার। মা হয়ে আমার বাচ্চাকে আমি নিজেই সামলাবো। সকালেই ফুপা ফুপিকে বলে বাসায় যাবার ব্যাবস্থা করতে হবে।
দু’হাতে ছাড়িয়ে নিলাম ওনাকে। আগের মতোই
এবারও টেনে নিতে লাগলেন। ওনাকে সুযোগ না দিয়ে ছাড়িয়ে নিলাম নিজেকে। ছুটে গেল ওনার গাড়ো ঘুমটা। উত্তেজিত হয়ে বলে উঠলেন,
“কি হয়েছে? এই রুপু। আজকেও সমস্যা হচ্ছে?”
বলেই দ্রুত উঠে রুমের লাইট জ্বালিয়ে দিলেন। ওনার কথার জবাব না দিয়ে চুপ করে খাটের এক কোণায় উঠে বসে রইলাম। উনি একটু থামলেন। কাছে এগিয়ে এসে কিছু বলতে চাইলেন। আমি সুযোগ দিলাম না ওনাকে। কিছু বলার আগেই আমি বলে উঠলাম,
“প্রতি রাতে এভাবে জড়িয়ে রাখেন কেন আমাকে? না-কি এটাও আপনার দেখানো, বাচ্চার জন্য দেখানো ভালোবাসা?”
“কি বলছিস তুই এগুলো? আমি কেন তোকে জড়িয়ে রাখবো….”
“ওও তাই তো, আপনি কেন আমায় জড়িয়ে রাখবেন? কে হন আপনি আমার? কেউ তো নয়।”
বলেই নামতে লাগলাম বিছানা ছেড়ে। আমাকে নামতে দেখেই উনি বলে উঠলেন,
“কি হলো? কোথায় যাচ্ছিস এত রাতে?”
মাথা ঘুরিয়ে তাকালাম ওনার দিকে। চোখে মুখে হাজারো বিরক্তির রেশ ফুটিয়ে বললাম,
“যেখানেই যাই না কেন, আপনাকে কেন বলতে হবে? তবে হ্যাঁ, কালকে আপনার এই বাসা ছেড়ে যাবার সময় ঠিকই জানিয়ে দিবো।”
“বাসা ছেড়ে যাবি মানে? কেথায় যাবি তুই?”
“চলে যাবো আমি এখান থেকে, আপনার এত এত অবহেলা সহ্য করে আর কিছুতেই থাকবো না আমি এখানে। আমার বাচ্চাকেও আমি সামলে নিবো। কারোর দ্বায়িত্ব দিতে হবে না আপনার।”
.
.
চলবে…..
#তুমি_বললে_আজ
লেখনীতেঃ #রিধিমা_জান্নাত_রূপা
পর্বঃ ৪০.
.
“কি সমস্যা তোর? তখন থেকে এসব ছাইপাস কেন খাচ্ছিস?”
কোন টু শব্দটি করলাম না তাসফি ভাইয়ের কথায়। ওনার কিনে দেওয়া আচার গুলো মনোযোগ দিয়ে সাবার করতে লাগলাম। মাঝ রাতে ওনার সাথে ঝগড়া করার মুডটা হঠাৎই চেঞ্জ হয়ে গেছে। রুম ছেড়ে চলে যাবার উদ্যোগ হতেই সন্ধ্যায় ওনার কিনে দেওয়া আচার ও চকলেটের দিকে নজর পড়ে। ঠিক তখনই একটা আচারের বোয়াম নিয়ে বসে পড়ি বিছানায়। প্রথমে কিছু না বললেও যখন বোয়ামের অর্ধেকটায় আচার চলে আসতে লাগলো, ঠিক তখন থেকেই খাওয়ার জন্য বারণ করে গেলেন উনি। কয়েকবার বলার পরও পাত্তা দিলাম না ওনার কথায়।
“কথা কানে যাচ্ছে না? বেয়াদব! এখনি রাখ বলছি। একসাথে এতগুলো আচার খেলে শরীর খারাপ করবে না?”
মাথা তুলে তাকালাম ওনার দিকে। প্রচন্ড রাগী রাগী চোখে তাকিয়ে আছেন। ওনার এই রাগী চেহারাটা ভীষণ কিউট লাগলো এই মুহুর্তে। কেন জানি এনার এই রাগী ফেস দেখে জাড়িয়ে ধরতে ইচ্ছে হলো, সাথে ওনার বলা কথার মতো টপাটপ চুমু খেতে ইচ্ছে জাগ্রত হলো। মুহুর্তেই ভাবনার ছেদ কাটলো। নিজের করা ইচ্ছেই নিজেই অবাক হলাম ভীষণ। সামনে নিলাম নিজেকে। হঠাৎ এই মুড সুইংয়ের ব্যাপারটা নিজেই বুঝতে পারলাম না। একটু আগেই তো ওনার সাথে ঝগড়া করলাম, রাগারাগি করলাম ওনার সাথে। তাহলে এখন আবার এতটা আদর আদর পাচ্ছে কেন ওনাকে দেখে? উফ্! রূপা তুই আসলেই একটা গাধী।
তাসফি ভাইয়ের দিকে তাকিয়ে কপাল কুঁচকে ফেললাম, ওনার থেকেও দ্বিগুণ রাগ নিয়ে আসলাম চোখে মুখে। অনেক গুলো আচার হাতে নিয়ে একসাথে মুখে ঢুকিয়ে দিলাম। কিন্তু বলার জন্য চেঁচিয়ে উঠলেন উনি, ওনার কথা কানে না নিয়ে দ্রুত বিছানা ছেড়ে নেমে গেলাম। আচারের বোয়ামটা টেবিলে রেখে ওয়াশরুমে গিয়ে হাতটা ধয়ে নিলাম। রুমে এসে কিছু না বলে শুয়ে পড়লাম বিছানায়। এবার শুয়ে শুয়ে মুখ নাড়াতে লাগলাম, শেষ করতে লাগলাম মুখের আচারটুকু।
“বাচ্চাদের মতো কি শুরু করেছিস? কিনে দেওয়াটাই আমার ভুল হয়ে গেছে। ডক্টর কি বলেছে শুনিস নি? হিমোগ্লোবিনের মাত্রা কম, এগুলো খেয়ে আরও কমাতে চাস? বেয়াদব! এগুলো তে আর হাত দিয়ে যেন না দেখি।”
ওনার কথার উত্তরে বলতে চাইলাম, ‘আপনার কথা আমি কেন শুনতে যাবো মি. বজ্জাত লোক? আমার শরীর, ‘আমার শরীরের কন্ডিশন আমি দেখে নিবো, আপনি মোটেও নজর দিবেন না আমার দিকে।’ কিন্তু কিছুতেই মুখ ফুটে কোন কথা ইচ্ছে হলো না। এতক্ষণে মুখের আচারটাও শেষ হয়ে গেছে। ইস্! হাতের কাছে কয়েকটা চকলেট রাখলে সেগুলো খেতে পারতাম এখন। ভীষণ আফসোস হলে লাগলো, সাথে দুঃখ দুঃখ ফিল। বিরবির করে কিছু একটা বলতে বলতে রুমের লাইট অফ করো দিলেন তাসফি ভাই, শুয়ে পড়লেন বিছানায়। আবছা অন্ধকারে ওনার দিকে তাকালাম, উনিও তাকালেন। সাথে সাথে মাথা ঘুরিয়ে চোখ বন্ধ করে ফেললাম, চেষ্টা করলাম ঘুমানোর।
.
“তোমরা কবে বগুড়া যাবা ফুপি?”
দুপুরের খাবারের মাঝে ফুপিকে উদ্দেশ্য করে বলে উঠলাম কথাটা। খাবার মাঝেই আমার দিকে তাকালো ফুপি। বলে উঠলো,
“কেন রে? আমরা এসে কি খুব অসুবিধা করে ফেললাম? তোদের প্রেমটা কি ঠিকভাবে হচ্ছে না?”
বলেই হালকা হেঁসে উঠলো ফুপি। হঠাৎ এমন কথায় ভীষণ লজ্জা পেলাম। ফুপিকে বলতে ইচ্ছে হলো, ‘তোমার ছেলে তো আমাকেই চায় না ফুপি, প্রেম ভালোবাসা আর কি চাইবে।’ কিন্তু বলতে পারলাম না। আস্তে করে বলে উঠলাম,
“ছি্ঃ এসব কি বলছো ফুপি? অসুবিধা হবে কেন? আমি তো যেতে চাচ্ছিলাম।”
“কোথায় যেতে চাও মামনী?”
“আসলে ফুপা, আমি বগুড়া যেতে চাচ্ছিলাম আপনাদের সাথে।”
এবার খাওয়া ছেড়ে সম্পন্ন মনোযোগ আমার দিকে দিলো সবাই। ফুপি বলে উঠলো,
“বগুড়া যবি মানে? কি হয়েছে হঠাৎ?”
“না.. মানে, অনেক দিন তো হলো এখানে আসছি। বাসার সবাইকে খুব মনে পড়ছে।”
“কিন্তু মামনী তোমার শরীর তো ঠিক নেই। এই শরীরে জার্নি করা তো ঠিক নয়।”
“প্লিজ! ফুপা, এখানে আমার একদম ভালো লাগে না, দম বন্ধ হয়ে আসে শুধু। আমি বাসায় যাবো।”
ফুপি বলে উঠলো,
“এখন তো আমরা আছি। বাড়ির কথা খুব বেশি মনে পড়লে ভাবিদের ফোনে জানিয়ে দেই, এসে কিছুদিন থেকে যাবে।”
“ না না, তার কোন প্রয়োজন নেই। আসলে ফুপি, ভালো লাগে না এখানে।”
“কেন মা, কি হয়েছে? বল আমাকে।”
মাথা নিচু করে ফেললাম। কি জবাব দিবো এখন? ওনার থেকে দূরে থাকার জন্যই যে চলে যেতে চাই, সেটা কিভাবে জানাবো সবাই কে? কিন্তু যে করেই হোক, মানাতে হবে সবাইকে। আর কিছুতেই এখানে থাকবো না আমি।
মাথা উঠিয়ে তাসফি ভাইয়ের দিকে আড়চোখে তাকালাম। ওনার পুরে মনোযোগ যে আমাদের কথোপকথনের প্রতিই, সেটা বুঝতে অসুবিধা হলো না আমার। আস্তে করে বলে উঠলাম,
“প্লিজ! ফুপি, এখানে সত্যিই আমার ভালো লাগে না। ফুপা, তুমি তো একটু বুঝো। বাসার কথা খুব করে মনে পরে আমার। এখানে কিছুতেই থাকবো না আমি।”
“মামনী, তোমার শরীরটা তো….”
“ঠিক আছি তো আমি। বাসায় গেলে একদম সুস্থ হয়ে যাবো, নিজের অনেক যত্ন নিবো। প্লিজ! প্লিজ! আর না করো না।”
“আচ্ছা, আচ্ছা! ঠিক আছে, এই কয়েকদিন এখানে কাটিয়ে সামনের সপ্তাহে যাবো।”
“না… না, সামনের সপ্তাহে নয়, কালকে…. কালকেই চলো প্লিজ! এখানে একটুও থাকতে ইচ্ছে হয় না আমার।”
সহসায় কেউ কোন কথা বললো না। জানি, আমার কথায় প্রচন্ড অবাক হয়েছে সবাই। এটা ছাড়া আর কোন উপায়ও নেই। এখানে, এই বজ্জাত লোকটার সাথে আর থাকতে চাই না আমি। অনেক হয়েছে ওনার দ্বায়িত্ব পালন, বাচ্চার জন্য ভালোবাসা। এর পর থেকে আমার বাচ্চাকে আমিই সামলে নিবো। ওনার জীবনে আমার প্রয়োজন না থাকলে, আমারও আর ওনাকে প্রয়োজন নেই। বেশ কিছুক্ষণ নীরবতায় থাকার পর ফুপা বলে উঠলো,
“ঠিক আছে! তুমি যখন থাকতে চাইছো না, তখন আর কি করার। কালকেই যাবো। এই সময় সবার সাথে সময় কাটালে তোমারও কিছুটা ভালো লাগবে।”
ফুপার কথায় হাসি ফুটে উঠলো আমার ঠোঁটে। ওনার থেকে জিতে যাবার হাসি, অবহেলার অবসান ঘটিয়ে নিজেকে সামলানোর দ্বায়িত্ব নিজের নেবার হাসি। হ্যাঁ! চার বছর আগের মতোই দূরে সরে যাবো ওনার থেকে। সামলে নিবো নিজেকে আর আমার বাচ্চাকে। ফুপি কিছু বলতে চাইলেও থামিয়ে দিলেন ফুপা। জানিয়ে দিলো, আগামীকালই চলে যাবেন। আর কথা না বাড়িয়ে খাওয়ায় মনোযোগ দিলো সবাই। আমিও মনোযোগ স্থির করলাম খাওয়ার প্রতি। এক লোকমা মুখে দেওয়ার আগেই উঠে দাঁড়ালেন তাসফি ভাই। কিছুটা জোরে করেই বলে উঠলেন,
“তোমাদের যেতে ইচ্ছে হচ্ছে যাও আব্বু, কিন্তু ও যেন এক পা ও বাসার বাইরে না রাখে। তাহলে কিন্তু খুব খারাপ হয়ে যাবে।”
একটু থামলেন। জোরে শ্বাস টেনে সেকেন্ডের মতো সময় নিয়ে আবারও বললেন,
“ডাক্তার কি বলেছে, শুনে নি তোমাদের মেয়ে? তবুও কেন জেদ করছে যাবার জন্য? জার্নি করলে ওর শরীর কতটা খারাপ হয়, জানে না ও? আম্মু, তোমার ভাতিজী কে ভালো ভাবে বলে দাও, ওর জন্য আমার বাচ্চার কিছু হলে আমি কিন্তু ওকে ছেড়ে কথা বলবো না।”
বলেই আর দাঁড়ালেন না উনি, হাতটা ধুয়ে হনহন করে চলে গেলেন সিঁড়ি বেয়ে। ওনার শেষ কথাটা শুনে একদল রাগ এসে জমা হলো। বাচ্চাটা কি ওনার একার? আমি মা হয়ে ওর ক্ষতি চাইবো? ওকে সামলাতে পারবো না সেটা উনি ভাবলেন কি করে? এবার তো আর কিছুতেই থাকবো না আমি, আমার বাচ্চাকে সুস্থ ভাবে পৃথিবীতে এনে দেখিয়ে দিবো আমি।
তাসফি ভাইয়ের বলা কথায় হতভম্বের মতো তাকিয়ে আছে ফুপা ফুপি। হয়তো বুঝতে পারছে না উনি হঠাৎ রেখে গেলেন কেন। আমি আস্তে করে বলে উঠলাম,
“ফুপি….”
“তাসফির সাথে কি তোর কোন ঝামেলা হয়েছে মা?”
ফুপির প্রশ্নে খুব একটা অবাক হলাম না। এই মানুষটা মনে হয় একটু বেশিই বোঝে আমাকে। সত্যিটা এটাই হলেও মিথ্যে বলতে হলো আমায়। বললাম,
“না… কি হবে ওনার সাথে আবার। যেতে চাচ্ছি বলে হয়তো কিছুটা রেগে গেছেন, তাছাড়া কিছু না। আমি কথা বলবো ওনার সাথে। ফুপা, তুমি কালকেই যাবার ব্যবস্থা করো।”
মাথা ঝাঁকিয়ে সায় জানাতেই উঠে দাঁড়ালাম চেয়ার ছেড়ে। আমাকে উঠতে দেখে ফুপি বলো উঠলো,
“উঠছিস কেন? শেষ কর খাবারটা।”
“এখন আর খেতে ইচ্ছে হচ্ছে না, পরে খেয়ে নিবো।”
“কিন্তু….
“প্লিজ! ফুপি, এখন আর খেতে বলো না।”
হতাশার নিশ্বাস ছাড়লো ফুপি। আমি আর দাঁড়ালাম না সেখানে। হাতটা ভালোভাবে ধুয়ে চলে আসলাম সেখান থেকে।
.
নিজের যাবতীয় জিনিস গোছানোর চেষ্টায় আছি। জামা কাপড় কিছু ব্যাগেও উঠিয়ে নিয়েছি। সামনেই দাঁড়িয়ে আছেন বজ্জাত তাসফি। কথা বললেও আমি কানে নিচ্ছি না।
দুপুরের ঘটনার পর বাসা থেকে বেড়িয়ে যান উনি। বাসায় ফিরেন রাতে। বাসায় যাবার ব্যাপারে ওনার সাথে কোন কথা না হলেও রাতে ফুপা ফুপিকে বলি উনি রাজি হয়েছে। তারাও আর কিছু বলেন না। রুমে এসে জামাকাপড় গোছানো দেখেই জিজ্ঞেস করেন কেন গোছাচ্ছি। কয়েকবার জানতে চাইলেও কোন কথা বললাম না ওনার সাথে। মূলত কোন কথায় বলতে ইচ্ছে হলো না আমার। ওনাকে সামনে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখেই ভীষণ রকমের মেজাজ খারাপ হতে শুরু করলো। আমার উত্তর না পেয়ে কিছুটা ধমকে উঠলেন। বললেন,
“কথা কানে যাচ্ছে না? কিছু জিজ্ঞেস করছি, শুনতে পারছিস না? বেয়াদব! ব্যাগ গোছাচ্ছিস কেন?”
ওনার কথায় রাগের মাত্রটা বেড়ে গেল। সবকিছু ছেড়ে হুট করে উঠে দাঁড়াতেই কেমন জানি মাথা ঘুরে উঠলো। চোখ দুটো বন্ধ করে খাটের এক কোণা ধরে সামলে নিলাম। ওনার মতো করেই কিছুটা চেঁচিয়ে বলে উঠলাম,
“বাপের বাড়ি, বাপের বাড়ি যাবো আমি। তাই ব্যাগ গোছাচ্ছি।”
“বললাম না তখন, কোথায় যাওয়া হবে না তোর। কথা কানে যায় নি?”
“না… যায় নি। আর আপনার কথা কেনই বা শুনতে যাবো আমি?”
“কেন শুনতে যাবি? কেন শুনতে যাবি সেটা খুব ভালো করেই জানিস তুই।”
“হু! আমার বাচ্চার বাবা আপনি, এটাই বলবেন তো? ভুলে যাবেন না, আমিও ওর মা। আর একজন মায়ের থেকে বড় দ্বায়িত্ব শীল মানুষ কখনো কেউ হতে পারে না।”
সহসায় কিছু বললেন না উনি। একটু সময় নিয়ে বলে উঠলেন,
“ওর ক্ষতি করে মায়ের দ্বায়িত্ব পালন করতে চাইছিস?”
“তাসফিই… মা হই আমি ওর। ভাবলেন কি করে, আমি ওর ক্ষতি চাইবো? সেই প্রথম থেকেই এই একটা কথায় শুনে চলেছি আপনার মুখে। কি বোঝাতে চাইছেন আপনি, আমার জন্য ওর ক্ষতি হবে এটাই তো?”
রাগটা অতি মাত্রায় বেড়ে গেল। জোরে জোরে শ্বাস টেনে নিয়েও রাগটাকে কন্ট্রোলে আনতে পারলাম না। আবার হঠাৎ মাথাটা কেমন জানি ঘুরে উঠলো, সাথে চোখের সামনে কেমন জানি ঝাপসায় ছেয়ে যেতে লাগলো। উনি বলে উঠলেন,
“হ্যাঁ! চাইছি, যদি বুঝতে পারতি তাইলে যেতে চাইতি না। এতটা পথ জার্নি করে ওর ক্ষতি করার জন্যই তো যেতে চাইছিস। তোর জন্য যদি ওর কোন….”
“আমি আমার বাচ্চার ক্ষতি করতে যেতে চাইছি না তাসফি, আমি আপনার থেকে চিরতরে দূরে যাবার জন্য যেতে চাইছি। আপনার এত এত অবহেলা সহ্য না করতে পেরে চলে যেতে যাচ্ছি, আমার দ্বায়িত্ব থেকে মুক্তি দিতে চলে যেতে চাচ্ছি আমি….”
এতক্ষণে নিজেকে সামলানোর চেষ্টা করে শেষ মুহুর্তে আর কিছুতেই পারলাম না। আগের চেয়ে অধিক ভাবে মাথা ঘুরিয়ে উঠলো, চোখের সামনে ঝাপসা হওয়া রূপটা অন্ধকারে পরিণত হতে লাগলো। হাত বাড়িয়ে কিছু একটা ধরার চেষ্টা চালিয়ে গেলাম। আস্তে করে বলে উঠলাম,
“আপনি খুব খারাপ, আপনার মতো খারাপ, বজ্জাত একটা মানুষের সাথে কিছুতেই থাকবো না আমি। চলে যাবো আমি এখান থেকে, চলে যাবো….”
কথাটা শেষ করার আগেই লুটিয়ে পড়লাম নিচে। সাথে সাথে কানে ভেসে আসলো তাসফি ভাইয়ের ডাক। ওনার এই রুপু ডাকটা বেশ আদুরে বলে মনে হলো আমার কাছে। এই মুহুর্তে ওনার মুখে ‘রুপুসোনা’ ডাকটা শোনার অদম্য ইচ্ছে জাগ্রত হলো। মিটমিটিয়ে চোখ খোলার চেষ্টা করে অন্ধকার ছাড়া কিছুই দেখতে পেলাম না। ওনাকে এক নজর দেখার চেষ্টা করেও সফল হতে পারলাম না। কিন্তু ভেসে উঠতে লাগলো ওনার সাথে কাটানো কিছু সুখময় মুহুর্ত গুলো।
.
.
চলবে…..
ভুলত্রুটি ক্ষমার দৃষ্টিতে দেখবেন।🖤