তুমি রবে নীরবে পর্ব-১৩+১৪

0
23
তুমি রবে নীরবে

#তুমি_রবে_নীরবে (১৩)
~নাদিয়া সাউদ

আচমকা কুহুর মুখে এরুপ কথা শুনে হতবুদ্ধি হয়ে তাকিয়ে রইল রওনক!একটা মানুষ এতটা নির্বোধ কথাবার্তা বলে কি করে?কুহুর চোখের দিকে গভীর দৃষ্টি রেখে বলল রওনক,
“হ্যাঁ চেঁচাও,দেখি তোমার গলায় কত জোড় আছে!বাহিরে যারা আছে সবাই নিশ্চিত হয়ে যাক এখানে তোমার বাসর সুসম্পন্ন হচ্ছে!

কুহুর টনক নড়লো!সম্মুখে থাকা পুরুষটি যে তার স্বামী কথাটা বেমালুম ভুলে গিয়েছিল।রওনকের ঠোঁটকাটা জবাবে একরকম লজ্জায় পরে গেল কুহু।রওনকের তখনও শীতল দৃষ্টি নিবদ্ধ কুহুর মুখাবয়বে!চোখদুটো শান্ত দিঘির জলের মতো লাগছে!এতটা নমনীয় ভাব আগে খেয়াল করেনি কুহু।উত্তপ্ত প্রগাঢ় শ্বাসপ্রশ্বাস ছুঁয়ে দিচ্ছে মুখশ্রী!চোখের মণি ঘুরিয়ে দেখে যাচ্ছিল কুহু।হঠাৎই বোধহয় খেয়াল হলো রওনকের একখানা হাত তার শাড়ি গলিয়ে উন্মুক্ত কোমড় ছুঁয়েছে!মুহূর্তে অসস্থিতে পায়ের তলা শিরশির করে উঠল।রওনককে ধাক্কা দিয়ে সরিয়ে দিতে চাইল কুহু।একটুখানিও হেলাতে পারল না শক্তপোক্ত শরীর টা!রওনকের ওষ্ঠকোণে ধরা দিল ঈষৎ হাসি।কুহু চোখেমুখে রাগ টেনে বলল,
” বিদ্যুতের খাম্বার মতো শরীর টা দয়া করে সরান।চাপা পরে মরা ছাড়া উপায় থাকবে না।

গায়ের ভার সম্পূর্ণ আলগা করে দিল রওনক।ওভাবেই আঁটকে রাখল কুহুকে।মতিগতি কিছুই ঠাওর হচ্ছে না কুহুর।বিয়ে করে নিয়েছে বলে কি যা খুশি করবে নাকি?যে চোখে সর্বদা রাগের বাস সেখানে তো হুট করে ভালবাসার উদয় হতে পারে না!আচমকা রওনকের খেয়াল হলো কুহুর এক কানের জিনিস এখনো খোলা হয়নি।ভ্রুকুঞ্চন করে কয়েক সেকেন্ড তাকিয়ে থেকে,খানিকটা ঝুঁকে খুলে দেওয়ার জন্য উদ্যেত হলো সে।অজানা ভয়ে কুহুর অন্তর আত্না কেঁপে উঠলো!দিকবিদিকশুন্য হয়ে রওনকের লোমশ বক্ষস্থলে কামড় বসিয়ে দিল!মৃদু আর্তনাদ করে একপাশে সরে গেল রওনক।এলোমেলো শাড়ি নিয়ে দ্রুত উঠে দাঁড়াল কুহু।মনে হচ্ছে জোড় বাঁচা বেঁচে গেছে!বুকের বা পাশে হাত চেপে ধরে উঠে বসল রওনক।চোখমুখ শক্ত করে বলল,
“এটা কি রকম অসভ্যতা?আমাকে নিষেধ করে এখন নিজেই অসভ্যতা শুরু করেছ?একটা হ্যান্ডসাম,হট ছেলেকে একা রুমে পেয়ে যা খুশি তো করতে পার না তুমি!

রওনকের কথায় যেন মাথায় বাজ পরলো কুহুর!নিজের অপরাধ অন্যের ঘাড়ে চাপাতে ভালই জানে।নাকের পাটা ফুলিয়ে বলল কুহু,
” একটু আগে কি করতে গিয়েছিলেন আপনি?অসভ্য পুরুষ!এখন আমার ফুলের মতো চরিত্রে দাগ লাগাচ্ছে।

উঠে দাঁড়িয়ে কুহুর দিকে তীক্ষ্ণ দৃষ্টি ফেলল রওনক।তপ্ত শ্বাস ফেলে বলল,
“হ্যাঁ,তোমার ফুলের মতো পবিত্র চরিত্র সম্পর্কে জানা আছে আমার।হ্যান্ডসাম,হট,ড্যাশিং ছেলে দেখলে তো চোখদুটো সামলাতে পার না।একেবারে কামড়ে খেয়ে ফেলতে চাইছ!দেখ কি অবস্থা করেছ!এখন যদি পাল্টা আমি শোধবোধ নেই তখন কি হবে ভেবেছ?

রওনকের কথায় থতমত খেল কুহু।সেদিন কোন কুলক্ষণে যে রওনকের সামনে আশফিককে ওসব বলেছিল!তাও কুহু কি জানতো নাকি বদমায়েশ টা পেছনে দাঁড়িয়ে ছিল!কোনোরকম তুতলে বলল,
” পা…পাল্টা শোধবোধ নিবেন মানে?আর আপনি নিজেকে কোন দিক দিয়ে হট,হ্যান্ডসাম মনে করেন?বয়েই গেছে আপনার দিকে তাকাতে!

কুহুর কথা শুনে কালবিলম্ব করল না রওনক।একটানে গা থেকে পাঞ্জাবী খুলে নিল।আশ্চর্য হয়ে গেল কুহু!তৎক্ষনাৎ চোখ ঢেকে নিল দুহাতে!

“ভাল করে তাকিয়ে দেখ নির্বোধ মেয়ে!তোমার হাসবেন্ডও কিন্তু হ্যান্ডসাম,হট,ড্যাশিং!

ভরাট পুরুষালি কন্ঠস্বর শুনে কান ঝাঝা করে উঠল কুহুর।ঘুরে ওয়াশরুমের দিকে যেতে যেতে বলল সে,
” নির্লজ্জ পুরুষ!

খানিক শব্দ করে হাসল রওনক।স্বগোতক্তি করলো,
“পৃথিবীর সমস্ত বিবাহিত পুরুষ তার স্ত্রীর কাছেই নির্লজ্জ,অসভ্য হয়, নির্বোধ মেয়ে!

২১.
ঘড়িতে সকাল আটটা।সকালের খাবার তৈরিতে ব্যস্ত শারমিন বেগম।খানিকক্ষণ বাদেই রাশেদ জামাল বের হবেন।অন্যদিনের তুলনায় আজকে স্ত্রীর মেজাজ খুব একটা ভাল নয়।কাল থেকেই লক্ষ্য করছেন তিনি।কুহুদের বাড়ি থেকে ফেরার পর ভাল করে কথা অব্দি বলেনি।টেবিলের উপর চায়ের কাপ রাখলেন শারমিন বেগম।প্রতিদিন খুব যত্ন নিয়েই স্বামীর হাতে তুলে দেয়।চোখ থেকে চশমা খুলে নিয়ে চা’য়ের কাপ হাতে তুলে নিলেন রাশেদ জামাল।তপ্ত শ্বাস ফেলে গম্ভীর স্বরে স্ত্রীকে ডাকলেন।প্রথমে না শোনার ভান করলেও দুই-তিনটা ডাকের পর সাড়া দিলেন শারমিন বেগম।স্বামীর সামনে এসে দাঁড়ালেন।দৃষ্টি নিচু।ব্যস্ত স্বরে জানালেন জরুরি কাজ আছে তার।চা’য়ে চুমুক রেখে বললেন রাশেদ জামাল,
“এসব অযথা রাগের কোনো মানে হয় না শারমিন।ছেলে তো ইচ্ছে করে যেচে বিয়ে করেনি।রওনক যখন প্রথমে কুহুর কথা বলেছিল আমি নিষেধ করেছিলাম।তখন কিন্তু সে বলেছে ঠিক আছে বাবা যেটা তোমার ইচ্ছে।যখন আমি দেখলাম পরিস্থিতি সত্যিই খারাপের পর্যায়ে।লোকে মেয়েটাকে নিয়ে কতরকম কথা বলছে।এতসব আয়োজন করে বিয়েটা না হলে তার পরিবারের খুব খারাপ লাগবে।হয়তো এই ধাক্কাটা কুহু কোনোদিন সামলাতে পারবে না।ছেলেকে বিয়ে করানোর সিদ্ধান্ত যখন নিয়েছি,তখন ভাবলাম কুহুকে বিয়ে করালে সমস্যা কোথায়?ছোট থেকে চিনি মেয়েটাকে।খুব ভদ্র স্বভাবের।এটাও জানি তোমার খুব ইচ্ছে ছিল নিজে পছন্দ করে পুত্রবধূ আনবে।ছেলে তো আর প্রেম করে নিজের ইচ্ছেতে বিয়ে করেনি।আমি বলেছি বলেছি বলেই বিয়ে করেছে।মন খারাপ করো না।মানিয়ে নাও সব।

“বিয়ে ভাঙ্গার দায় আমার ছেলে কেন নেবে?সব জায়গায় মহান সাজা মানায় না।রওনকের বিয়ে নিয়ে কত কিছু ভেবে রেখেছিলাম।কুহুকে আমি অপছন্দ করি এমন নয়।রিশার মতোই দেখি।কিন্তু আমার রওনকের বউ হিসেবে পছন্দ নয়।

“ব্যাপারটা মহান সাজার বিষয় না শারমিন।সে মুহূর্তে আমার যেটা সঠিক মনে হয়েছে আমি সেটাই করেছি।রওনকের অনিচ্ছায়ও হয়নি বিয়েটা।নয়তো তোমার ছেলে প্রথমেই কুহুর কথা বলতো না।আমরা কি কখনো ভেবেছিলাম কুহু এ বাড়ির বউ হবে?এরকম মন খারাপ করে থাকলে মনোমালিন্য হবে।

স্বামীর কথার পাল্টা জবাব দিতে পারলেন না শারমিন বেগম।মনকে কিছুতেই বোঝাতে পারছেন না।সরাসরি ছেলেকেও দোষারোপ করতে পারবেন না।

,

জানালা গলিয়ে তীব্র আলোকরশ্মি চোখমুখ ছুঁয়ে দিল কুহুর।ঘুম ছুটে যেতে সেকেন্ড সময় লাগল না।চোখ ডলে তাকাতে চেষ্টা করল।চোখমুখ বিশ্রিরকম কুঁচকে গেল আলোর দাপটে।উঠে বসার চেষ্টা করতেই চুলে প্রখর টান অনুভব হলো।ফের ঠাস করে শুয়ে পরলো কুহু।পাশ ফিরতেই দেখল বেঘোরে ঘুমাচ্ছে রওনক।কুহুর অর্ধেকটা চুল রওনকের শরীরের নিচে চাপা পরেছে!একেবারে গায়ের সঙ্গে লেপ্টে এসে শুয়ে আছে!মাঝখান বরাবর দৃষ্টি পরতেই চমকে উঠলো কুহু!কাল রাতে তো এখানটায় কোলবালিশ ছিল!টানা আধঘন্টা জগড়া করার পর এই বর্ডার দিয়েছিল কুহু!আর ঘুমিয়ে পরার সুযোগ নিয়েই কি সেটা সরিয়ে নিলেন রওনক ভাই?রাগে ফোঁস ফোঁস করল কুহু।ঘুমন্ত রওনককে ধাক্কা দিয়ে চুল ছাড়িয়ে নিয়ে উঠে বসল।সাড়া খাটে কোথাও কোলবালিশ নেই!আশ্চর্য!গুম করে দিল নাকি?ঘাড় ঘুরিয়ে তাকাতেই খেয়াল করলো কুহু যে পাশটায় শুয়েছে ঠিক তার মেঝেতেই কোলবালিশ পরে আছে!চক্ষু চড়কগাছ কুহুর!সর্বনাশ!ঘুমের ঘোরে কোলবালিশ সে সরিয়ে দিল?

“ঝগড়াঝাটি করে বর্ডার স্থাপন করলে!তারপর নিজেই গায়েব করে দিলে!না জানি আমার ঘুমের সুযোগ নিয়ে আর কি কি করেছো তুমি!নিজেকে নিরাপদ মনে হচ্ছে না তোমার সঙ্গে এক রুমে!

ঘুম জড়ানো ভরাট স্বরে তৎক্ষনাৎ ঘাড় ঘুরিয়ে তাকাল কুহু।সকাল সকাল তার রাগ চরমে ওঠে গেল!দাঁত চিবিয়ে বলল,
” ঘুমের মধ্যে মানুষের হুশ থাকে নাকি?স্বজ্ঞানে কি সরাতাম এটা?এতই যখন ভয় তাহলে কাল থেকে আমার সঙ্গে এক রুমে থাকবেন না।

কথাটুকু বলেই খাট থেকে নেমে গেল কুহু।রওনকের ঠোঁটের কোণে মৃদু দুষ্ট হাসি লেপ্টে আছে।অগোছালো চুলে,এলোমেলো ওড়না গায়ে মেয়েটাকে নেহায়েত মন্দ লাগছে না!ঘুমন্ত ফোলা চোখদুটোতে অবলীলায় চুমু খেতে ইচ্ছে করছিল!কালকে রাতের কথা ভাবতেই আপন মনে হেঁসে ফেলল রওনক।মাঝ রাতে খুব সাবধানে বালিশটা কুহুর দিকে ফেলে দিয়েছে সে।ঘুমন্ত মুখশ্রী জুড়ে অধরোষ্ঠের আদুরে ছোঁয়া দিয়েছিল শ’খানেক।খুব করে ইচ্ছে করছিল বক্ষস্থলে জড়িয়ে নিতে।ঘুম ভেঙ্গে যাওয়ার ভয়ে সেটুকু সাহস করে উঠতে পারেনি।ঘড়ির দিকে দৃষ্টি পরতেই হকচকিয়ে উঠলো রওনক।দশটায় ভার্সিটিতে যেতে হবে।অলরেডি নয়টার উপর বেজে গেছে!দ্রুত খাট থেকে নেমে গিয়ে কুহুকে ওয়াশরুম থেকে বেরোবার জন্য তাড়া দিল।

২২.
ঘুম থেকে জেগে খানিকক্ষণ থ মেরে বসে থাকতে হয় রিশার নয়তো সারাদিনের জন্য মস্তিষ্ক সচল থাকে না।কাল রাত থেকে একটা হিসেব কিছুতেই মেলাতে পারছে না সে।মানে কুহুর বিয়েতে ভাইয়ার কোনো প্রতিক্রিয়া ছিল না!অথচ শেষ মুহূর্তে মিরাকল হলো!এটা কিভাবে সম্ভব?মনে হচ্ছে সব প্রশ্নের উত্তর জানতে পারবে ভাইয়ার কাছেই!কিছু তো একটা গন্ডগোল পাকিয়েছে সে!

“রিশা জানু?

কুহুর ডাকে ভাবনার ঘোর কাটলো রিশার।সাদা আর হলুদ রঙা মিশ্রিত থ্রিপিস পরে আছে কুহু।মাথায় ঘোমটা টেনে দেওয়া।কেমন স্নিগ্ধ লাগছে দেখতে!নাকে ফুল।দু’হাতে চুড়ি!সম্পূর্ণ রূপটাই বদল করে দিয়েছে যেন!আগের তুলনায় কুহুর রূপ যেন বেড়েছে বহুগুণ!প্রায় অনেক্ক্ষণ যাবৎ খুঁটিয়ে কুহুকে দেখল রিশা।ততক্ষণে রিশার পাশে এসে বসেছে কুহু।ঘাড় ঘুরিয়ে তাকিয়ে একটুখানি হাসল রিশা।খাট থেকে নেমে দাঁড়িয়ে বলল,
” কিরে তোর আকস্মিক বাসর কেমন কাটল?ঝগড়া বাঁধলো?

লম্বা এক শ্বাস ফেলল কুহু।চোখেমুখে আঁধার টেনে বলল,
“জীবনে কি এমন অন্যায় করেছিলাম জানি না।যার জন্য এরকম দিন আসলো আমার জীবনে।সবচেয়ে অপছন্দের মানুষটাকে স্বামী হিসেবে গ্রহণ করতে হলো।

কুহুর কথায় ভুরু কুঁচকে গেল রিশার।মেয়েটা হয়তো জানেও না কত সৌভাগ্যবতী সে!এরমন ভালবাসা কয়জন পায়?অথচ রিশা মনেপ্রাণে একজনকে চেয়েও পেল না!নিয়তি বড্ড অদ্ভুত!ভালবাসার মানুষকে পাওয়ার ভাগ্য নিয়ে জন্ম হয় না সবার।তপ্ত শ্বাস ফেলে বলল রিশা,
” এমন ভাবে বলছিস যেন আগুনে ফেলে দেওয়া হয়েছে তোকে!বিয়ে খুব পবিত্র বন্ধন কুহু!বিয়ের আগে হয়তো তোদের সম্পর্ক ভিন্ন ছিল এখন অন্যরকম।

“ছাই!তোর ভাই কি শুধরে যাওয়ার মতো লোক?কাল রাতে কি অসভ্যতা করেছে জানিস?

কথাটুকু বলতে গিয়েও গিলে ফেলল কুহু।বিস্ফোরিত দৃষ্টি ফেলে তাকিয়ে আছে রিশা!অপ্রস্তুত হাসার চেষ্টা করে বার কয়েক চোখের পাতা ঝাপটালো কুহু!রিশার সঙ্গে সব কিছু শেয়ার করতে করতে এখন মুখ ফসকে এটাও বলে ফেলেছে!অবশ্য দোষ তো ষোলআনা তাঁর!কামড়ে দিয়েছে সে।শারমিন বেগম এসে জানালেন কুহুর মা আর ভাবী এসেছে।প্রচন্ড খুশিমনে বসা থেকে উঠে দাঁড়াল কুহু।এই প্রথম পরিবার ছাড়া থেকেছে সে।কি যে মন খারাপ করছিল!এক ছুটে বেরিয়ে চলে গেল সে।রিশা দীর্ঘশ্বাস ফেলল।কুহুর মন ভীষণ সরল।মাঝেমধ্যে মেয়েটা অবুঝ আচরণ করে ফেলে বড্ড!এই বাচ্চাসুলভ মেয়েটাকে সামলাবে কি করে তার ভাই?নাকানিচুবানি খাইয়ে ছাড়বে।

,

বসার ঘরে আফসানা বেগম আর তোহা বসে আছে।হাসিমুখেই কথা বলছেন শারমিন বেগম।এবার নিয়ে মাত্র দুইবার এই বাড়িতে এসেছেন আফসানা বেগম।তবে তোহা এই প্রথম।আশেপাশে দৃষ্টি বুলিয়ে দেখছিল সে।ছয় রুমের ফ্ল্যাট।বেশ গোছানো আর পরিপাটি!শৌখিন জিনিসের ছড়াছড়ি!মায়ের পাশে বসে আছে কুহু।শারমিন বেগম হাসিমুখে কুহুকে বললেন মিষ্টির প্যাকেট গুলো যেন কিচেনে নিয়ে যায়।আর অতিথিদের জন্য খাবারের ব্যবস্থা করে।কুহু একটু আৎকে উঠলো!দু’দিন আগেও এটা কেবল বন্ধুর বাড়ি মনে করলেও,আজ যেন নিজের সংসার মনে হচ্ছে!মাথা কাত করে সায় জানিয়ে মিষ্টির প্যাকেট নিয়ে চলে এলো কুহু।অন্যদিনের তুলনায় আজকে অনুভূতি ভিন্ন!ভয়ও হচ্ছে কিঞ্চিৎ!কি খাবার দিবে বুঝতে পারল না কুহু।ঘাবড়ে গেল।মিষ্টিগুলো কেবল প্লেটে সাজিয়ে নিল।আর কি দেবে?মনে হচ্ছে রিশাকে ডাকতে হবে।ঘুরে হাটা ধরতেই কিছুর সঙ্গে ধাক্কা খেল।সম্মুখে তাকাতেই দেখল রওনক দাঁড়িয়ে আছে।একেবারে ফর্মাল স্টাইলে!আদেশের সুরে বলল,
“ইতিউতি না তাকিয়ে,স্বামীকে নাশতা দাও জলদি।এক্ষুনি বেরোবো আমি।

কথাটুকু বলেই হাত ঘড়ি দেখল রওনক।এমনিতে চিন্তায় অস্থির হয়ে আছে কুহু।নিজেরই তো খাওয়া হয়নি সকাল থেকে।এখন আবার আরেক উটকো ঝামেলা।পাশ থেকে মিষ্টির প্লেট থেকে একটা মিষ্টি তুলে নিল কুহু।রওনক মাথা তুলে তাকাতেই সোজা তার মুখে পুরে দিল সেটা!হতভম্ব হয়ে মিষ্টি মুখে নিয়ে দাঁড়িয়ে রইল রওনক!মিষ্টির সিরা তার পুরো ঠোঁট মাখিয়ে গেছে একেবারে!

” বাহ!আমরা ওদিকে অপেক্ষা করছি,এদিকে ননদী রান্নাঘরে দাঁড়িয়ে স্বামীকে মিষ্টি খাইয়ে দিচ্ছে!সঠিক সময়ে আসার কারণে রোমান্টিক দৃশ্যটা চোখে পরলো।

ভাবীর কথায় অপ্রস্তুত হলো কুহু।বাঁকা দৃষ্টিতে কুহুর দিকে তাকিয়ে মিষ্টি চিবুতে চিবুতে উত্তর দিল রওনক,
“কাল থেকে আপনার ননদী রোমান্টিক অত্যাচার করেই যাচ্ছে আমাকে।

চোখ গরম করে রওনকের দিকে তাকাল কুহু।তোহা হাসতে হাসতে প্রস্থান করল।যাবার জন্য পা বাড়াল কুহু।খপ করে হাত ধরে ফেলল রওনক।রসহ্যময় দৃষ্টি ফেলে তাকিয়ে রইল কুহুর পানে।হাতের দিকে তাকিয়ে বলল কুহু,
” কি হলো?মিষ্টি খেয়ে পেট ভরেনি?ভাবীর সামনে কি বললেন এটা?নির্লজ্জ!

কুহুকে টেনে নিজের কাছাকাছি নিয়ে আসল রওনক।কপালে পরে থাকা চুলগুলো ফু দিয়ে বলল,
“বউ এত আদর করে খাইয়ে দিল!পেট না ভরে উপায় আছে?কিন্তু মুখে যে সিরা লেগে আছে এটা?

” আশ্চর্য!ধুঁয়ে ফেলুন!আর ইচ্ছে না করলে এমনি চলে যেতে পারেন ভার্সিটিতে।

“উহুম!বউ আমাকে মিষ্টি খাইয়ে দিল!আমার একটা দায়িত্ব আছে না?আমাকেও তো খাইয়ে দিতে হবে।

” আপনার আধিখ্যেতা রেখে সরুন।আমি নিজেই মিষ্টি খেয়ে নিব।

“না খাইয়ে তো ছাড়ছি না বউ!আজকের এই মিষ্টি খাওয়া তোমার স্বরণে ইতিহাস হয়ে থাকবে!

চলবে……

#তুমি_রবে_নীরবে (১৪)
~নাদিয়া সাউদ

বাইরের ঘরে নিশ্চয়ই সবার কুহুর অপেক্ষায় আছে?এদিকে রওনকের কান্ডকারখানা বিরক্ত ধরাচ্ছে কুহুকে।মুখের রাগটুকু ধরে রেখেই বলল,
“আমি ব্যবসায় শিক্ষার ছাত্রী,আমাকে ইতিহাস শেখাতে হবে না,আপনার।সরুন তো!

রওনক একবার চোখ তুলে দরজার কাছটা দেখে নিল ভাল ভাবে।পরক্ষণে কুহুর ডান হাত ধরে হ্যাচকা টানে ফ্রিজের আড়ালে নিয়ে গেল।আকস্মিক ঘটনায় বিমূঢ় হয়ে তাকিয়ে রইল কুহু!পিঠ ঠেকেছে সফেদ রঙা দেওয়ালে।একহাত কুহুর পাশে দেওয়ালে রেখে আবদ্ধ করে রাখল রওনক।চোখদুটো জুড়ে রহস্য খেলা করছে!কুহুর রাগ মাত্রা ছাড়াচ্ছে।একে তো কি খাবার নিয়ে যাবে ভেবে পাচ্ছে না!এদিকে রওনক ভাই মেজাজ বিগড়ে দিচ্ছে!ভয়ানক রাগ নিয়ে কিছু একটা বলতে গেল কুহু,পুরো কথা আর শেষ করতে পারলো না।রওনকের মিষ্টি মাখা অধরোষ্ঠ তার ঠোঁট জোড়া দখল করে নিল ক্ষিপ্র গতিতে।হঠাৎ রাগ সামাল দিতে না পেরে শ্বাস রোধ হয়ে গেল কুহুর!এরুপ কিছুর জন্য মোটেও প্রস্তুত ছিল না তার মস্তিষ্ক!সটান হয়ে দেওয়ালের সঙ্গে লেগে রইল সে!গালে খোঁচা খোঁচা দাঁড়ির স্পর্শ পেতেই ভয়ানক শিউরে উঠলো!চিন্তা,ভয়,রাগ মিলেমিশে অনুভূতিরা তালগোল পাকাল।জিভে স্পষ্ট মিষ্টির স্বাদ অনুভব করল কুহু।সবকিছু বুঝে উঠতেই চওড়া বক্ষস্থল ঠেলে সরিয়ে দিতে চাইল।রওনকের দৃষ্টি কুহুর গোল গোল হয়ে যাওয়া আশ্চর্যান্বিত চোখে!সামনে থাকা পুরুষের হৃৎস্পন্দন স্পষ্ট শুনতে পাচ্ছে কুহু!

বাহির থেকে রিশার ডাক আসল।দ্রুত ছেড়ে দাঁড়াল রওনক।একটুখানি বাঁকা হাসি ছুঁড়ে দিয়ে প্রস্থান করল।কুহু নড়তে পারল না।ঠায় দাঁড়িয়ে রইল বরফের মতো।কিরুপ প্রতিক্রিয়া জানাবে তার মস্তিষ্ক সংকেত দিল না!খেয়াল হতেই দেখল তার শরীর মৃদু কাঁপছে!এটা কি আতঙ্ক,নাকি অদ্ভুত অনুভূতি?মিনিট একের মধ্যে রিশা এসে দাঁড়াল কুহুর মুখোমুখি।পরিস্থিতি তখনও সামলে উঠতে পারেনি কুহু।খানিকক্ষণ আগে কি ঘটে গেল তার সাথে?রাগী রওনক ভাইয়ের দ্বারা এমন কিছু ঘটতে পারে ভাবেনি কুহু!হতভম্ব কুহুকে দেখে নিয়ে কাজে মনোযোগী হলো রিশা।মা তাকে ডেকে পাঠিয়েছে কুহুকে সাহায্য করার জন্য।নিজেকে ধাতস্থ করে এগিয়ে আসল কুহু।রিশার সঙ্গে হাসিমুখে কথা বলার চেষ্টা করলো।ঘরে থাকা বেশ কয়েক পদের খাবার প্লেটে সাজিয়ে নিল রিশা।তবে কেমন সন্দিহান দৃষ্টিতে কুহুকে দেখছিল!এরকম শান্ত স্বভাবের মেয়ে তো কুহু নয়!একটা কথাও বলছে না কেমন!কাজে মনোযোগ ধরে রাখতে পারছে না কুহু।খানিকক্ষণ আগের মিষ্টি চুম্বনের ঘটনা মস্তিষ্কে জোঁকের মতো বসে আছে!ভীষণ রাগ লাগছে কুহুর।দিন দিন অসভ্যতার মাত্রা ছাড়াচ্ছে রওনক ভাইয়ের।রিশা ডাক দিতেই ভাবনার ঘোর কাটল কুহুর।ট্রে ভর্তি খাবার কুহুর হাতে ধরিয়ে দিয়ে চা তৈরির জন্য চুলায় গরম পানি বসাল রিশা।ছোট্ট একটা হাসি ফিরিয়ে দিয়ে চলে গেল কুহু।

২৩.
কালকে খুব বাজে পরিস্থিতিতেই কুহুর বিয়েটা সুসম্পন্ন হয়েছে।অবশ্য এর জন্য শারমিন বেগমের কাছে বারবার কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করছেন আফসানা বেগম।দুপুরে খাবারের আয়োজন করবেন জানালেন শারমিন বেগম।তোহা আর আফসানা বেগমকে থেকে যেতে বললেন।বেশ বিনয়ের সহিত আফসানা বেগম বললেন,অন্যদিন আসবেন।এই বিয়ের যখন কোনোরকম বৌভাত হয়নি,সেক্ষেত্রে নিয়ম অনুযায়ী রওনক আর কুহুকে নিজের বাড়িতে আমন্ত্রণ জানাতে এসেছেন তিনি।শারমিন বেগম বললেন,রওনক চাইলে যাবে।উনার কোনো আপত্তি নেই।

“তাহলে মা আর ভাবীর সঙ্গে এখনই বাড়িতে চলে যাই আমি?রওনক ভাই বিকেলে ফিরলে না হয় তখন যাবেন।

হাত ভর্তি খাবার নিয়ে এগিয়ে আসতে আসতে কথাগুলো বলল কুহু।উপস্থিত সবাই কুহুর দিকে তাকাল।আফসানা বেগম খানিক বিব্রত হলেন।বিয়ের পরেও স্বামীকে বোকার মতো ভাই সম্মোধন করে যাচ্ছে মেয়েটা!দুষ্টু হাসি তোহার ঠোঁটের কোণে।কুহুর চলনবলন আর কথাবার্তা খুব একটা ভাল লাগে না শারমিন বেগমের।চুপ করে রইলেন তিনি।সেন্টার টেবিলে খাবারের ট্রে রাখল কুহু।তোহা তক্ষুনি বসা থেকে দাঁড়িয়ে তাড়া দিল কুহুকে।তার ঘরটা দেখবে।অগত্যা রওনক ভাইয়ের রুমের দিকে হাঁটা ধরলো কুহু।ছেলে আয়াশকে কোলে নিয়ে অনুসরণ করল তোহা।ঘরটা খানিক এলোমেলো হয়ে আছে।সকালে গোছায়নি কুহু।এরকম অবস্থা দেখে ননদী’কে খানিক শাসাল তোহা।ভাবীর কথা কুহুর কর্ণ পর্যন্ত বুঝি পৌছায়নি।স্তব্ধ হয়ে দাঁড়িয়ে আছে সে।সাড়া কক্ষ জুড়ে মিষ্ট এক পারফিউমের সুভাস ছড়িয়ে আছে।যেটা খানিকক্ষণ আগে রওনক ভাইয়ের গা থেকে পেয়েছিল কুহু!আবারও সেই ভয়ানক ক্ষন টা মানস্পটে ভেসে উঠলো!চোখ খিচিয়ে নিল কুহু।মাথা দু’দিকে ঝাকিয়ে ভাবনা খানা মাথা থেকে ঝেড়ে ফেলতে চাইল।তোহা ততক্ষণে ঘুরে ঘুরে দেখছিল সম্পূর্ণ কক্ষ।রুমে সকল আসবাবপত্র’ই সাদা রঙা!দেওয়ালে অনেক রকম ওয়ালমেট আর বড়োসরো একটা ঘড়ি।অন্যান্য জানালার তুলনায় এই রুমের জানালাটা বেশ বড়ো!বাতাসে শুভ্র রঙা পর্দা দুলছে।খাটে রোদ পরেছে আড়াআড়িভাবে।কোণায় ড্রেসিরুম আর ওয়াশরুম।জানালার সামনে দাঁড়িয়ে কুহুর দিকে তাকাল তোহা।কোনো কল্প জগতে যেন ভাসছে মেয়েটা!বেশ জোড়ালো স্বরে ডাকল তোহা।চমকে উঠল কুহু!হাসিমুখে ভাবীর সামনে এসে দাঁড়াল।

“বিয়ের আগের জীবন আর পরের জীবনের মধ্যে অনেক তফাত হয় কুহু।এখন অনেক কিছু হিসেব করে চলতে হবে তোমাকে।তখন বসার ঘরে অকপটে ওভাবে কথা বলা তোমার উচিত হয়নি।রওনক তোমার স্বামী।হতে পারে আগে রিশার ভাই ছিল তাই তুমিও তাই ডাকতে।তাছাড়া শাশুড়ির সামনে বললে তুমি একাই চলে যাবে বাড়িতে!এটা বলাটা কি সমীচীন হয়েছে?তুমি চলে গেলে রওনক একা যাবে?এরপর থেকে কথা বলতে গেলে একটু ভেবেচিন্তে বলবে।

ভাবীর বেদবাক্য নত মস্তকে শুনল কুহু।পরক্ষণে বলল,
” সব না হয় বুঝলাম।কিন্তু রওনক ভাইকে কি ডাকব তাহলে?ওগো,হ্যা গো এসব?উনি যে আমার হাসবেন্ড এটা এখনো মানতে পারছি না।আমার যে বিয়ে হয়ে গেছে এটা ফিলই হচ্ছে না ভাবী।

তোহা উত্তর দেওয়ার সময় রিশা আসল।রিনরিনে গলায় কুহুর উদ্দেশ্য বলল,
“বিয়ের ফিল পাবি কি করে?আমার ভাইকে কি তুই ভালবাসিস নাকি?সারাক্ষণ রাগ দেখাস!

পাশ থেকে তোহা জবাব দিল,
“এটা তুমি ভুল বললে রিশা।আমার ননদী যে তার জামাইকে কতখানি ভালবাসে সেটা নিজ চোখে দেখেছি আমি।

মুখ ফুলিয়ে বলল রিশা,
” যতই হোক ভাবী।তুমি তো আর তোমার ননদের দোষ দেখবে না।আমি যতই গলা ফাটিয়ে বলি।পর তো পর’ই হয়!

দুজনের মাঝে কুহু বলে উঠল,
“বয়েই গেছে তোর ভাইকে ভালবাসতে!অসভ্য একটা!

কুহুর কথায় তোহা আর রিশার কথা থেমে গেল।তোহা একটা চোরা দীর্ঘশ্বাস ফেলল।মেয়েটাকে কত করে বোঝাল,কথা একটু হিসেব করে বলতে।রিশার আফসোস হতে লাগল ভাইয়ের জন্য।ইহজনমে তার ভাই ভালবাসার দর্শন পাবে কি না কে জানে!আফসানা বেগম এসে ছেলের বউকে তাড়া দিলেন।এক্ষুনি চলে যাবেন তারা।বিকেলে মেয়ের জামাই যাবে।খাবারের আয়োজন করতে হবে।হাসিমুখে রিশাকে বিদায় দিয়ে চলে গেল তোহা।অসহায় দৃষ্টিতে মা আর ভাবীর যাওয়ার পানে তাকিয়ে রইল কুহু।ইচ্ছে করলেও তাদের সঙ্গে চলে যেতে পারবে না সে।

২৪.
দুপুরের পর থেকে পুরোটা সময় রিশার সঙ্গে গল্প করেছে কুহু।একটুও মন খারাপ লাগছে না তার।অচেনা,নতুন পরিবেশে আছে মনে হচ্ছে না।বেলা গড়িয়েছে বিকেলে।কুহু অপেক্ষা করছে রওনকের আসার জন্য।একটু আগে ব্যাগপত্র গুছিয়ে নিয়েছে সে।রওনক ভাই আসলেই তাকে নিয়ে বাড়িতে যাবে।কলিং বেলের শব্দ হতেই আধো শোয়া থেকে উঠে বসল কুহু।পরক্ষণে খাট থেকে নেমে ছুট লাগাল বাইরে।রিশা হতবাক হয়ে তাকিয়ে আছে!কুহু এতক্ষণ তার ভাইয়ের অপেক্ষাতে প্রহর গুনছিল?এটা ঠিক মানা যাচ্ছে না।বিয়ে হলে বোধহয় দায়িত্ব এমনি বুঝে এসে যায়।

,

দরজা খুলতেই কুহুর হাসিমুখ খানা চোখে পরল রওনকের।ভ্রু কুঁচকে কিয়ৎক্ষণ চুপ করে নববধূকে পর্যবেক্ষণ করল।এইটুকু মুহূর্তে যেন তার সারাদিনের ক্লান্তি বিলীন করে দিল।আজকে সারাদিন ক্লাসে কুহুকে বড্ড বেশিই মিস করছিল!মেয়েটা বউ হতে না হতেই তার আশা,আকাঙ্খা একেবারে ডালপালা মেলছে যেন!কুহুকে কিছুটা এড়িয়ে রুমে চলে গেল রওনক।মেয়েটা নিজ থেকেই কিছু বলবে মনে হচ্ছে।রুমে আসতেই রওনক আশ্চর্যের শেষ সীমানায় পৌছে গেল!কুহু তার জন্য জামা বের করে খাটে সাজিয়ে রেখেছে!রওনক তো ভেবেছিল সকালের ঘটনার জন্য কুহু তার সঙ্গে আজ নির্ঘাত তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধে লাগিয়ে দিবে!অথচ পরিস্থিতি নীরব!কৌশলে কোনো চাল চালছে না তো আবার নির্বোধ মেয়েটা?মাথায় আকাশসম ভাবনা নিয়ে ড্রেসিরুমে চলে গেল রওনক।ফ্রেশ হয়ে বেরিয়ে আসল মিনিট বিশের মাঝে।হালকা বেগুনির মাঝে কালো রঙা শাড়ি পরেছে কুহু।খানিক্ষন আগে রিশার কাছ থেকে কিছুটা সাহায্য নিয়ে পরে এসেছে।আয়নায় দাঁড়িয়ে হালকা করে সাজছে।মন মেজাজ ফুরফুরে হয়ে আছে।কপালে সুক্ষ্ম ভাজ পরলো রওনকের।শাড়ি পরা রমনীর থেকে দৃষ্টি সরতে চাইছে না।আবার হাবভাবও ভাল ঠেকছে না!কয়েক পা এগিয়ে কুহুর সামনে এসে দাঁড়িয়ে বলল রওনক,
“স্বামীর মন জয় করা শিখে নিচ্ছ তাহলে!তোমাকে এই মুহূর্তে সত্যি সত্যি আমার বউ মনে হচ্ছে কুহু।

হাসিমুখে ঘুরে তাকাল কুহু।

” আপনিও তৈরি হয়ে গেছেন দেখছি।তাহলে এক্ষুনি বেরিয়ে পরি আমরা।

“মানে?কোথায় যাব?

” কোথায় আবার!আমাদের বাসায়।মা আর ভাবী এসেছিল।আজকে আমাকে আর আপনাকে যেতে হবে।এটা নিয়ম।আর আমি কিন্তু এক সপ্তাহ থাকব।

এতক্ষণে কুহুর রহস্য উদঘাটন করতে সক্ষম হলো রওনক।অথচ সে কিনা আকাশকুসুম ভেবে বসে আছে।কুহুর হাত ধরে জানালার কাছে চলে আসল রওনক।অপর হাত দিয়ে দূরে ইশারা করে দেখিয়ে বলল,
“ওই যে এখান থেকেই তোমার বাড়ি দেখা যাচ্ছে!অযথা যাওয়ার কি প্রয়োজন?আর এক সপ্তাহ থাকার তো প্রশ্নই আসে না।সুতরাং আমরা যাচ্ছি না।

রওনকের কথায় মাথায় বাজ পড়ল কুহুর!চরম রাগ উঠলেও নিজেকে সামলে নেওয়ার চেষ্টা করল।বেশি কথা বললে রওনক ভাই বেঁকে বসলে অবশেষে যাওয়া হবে না।দাঁত চিবিয়ে হেসে বলল কুহু,
” হ্যাঁ চোখে তো দেখাই যাচ্ছে বাড়ি।কিন্তু আমার মা যে এত করে বলে গেল?

“তা না হয় যাব।কিন্তু সাতদিন থাকার কথা আসছে কেন?

” আপনার ইচ্ছে হলে একদিন থেকে চলে আসবেন।

“আমার জিনিসও আমি সাথে করে নিয়ে আসব।রেখে আসব নাকি?

” আপনার জিনিস মানে?

“পাঁচ লক্ষ টাকা দেনমোহর দিয়ে নিয়ে এসেছি তোমাকে।সুতরাং তুমি এখন আমার জিনিসই।

রওনকের যুক্তি দেখে মাথা ঘুরে উঠল কুহুর!দাঁত কিরমিরিয়ে বলল,
” আমি কি দোকানের পন্য?

“নাহ!তুমি আমার মিষ্টি বউ।

” এখন কি আপনি যাচ্ছেন না?

“হ্যা যাব,কিন্তু বড়োজোর একদিন থাকার সুযোগ পাবে।রাজি থাকলে চলো নয়তো থাক বসে।

কুহু রাগ দেখাতে গিয়েও দমে গেল।আগে বাড়ি পৌছাক।তারপর দেখা যাবে কয়দিন থাকবে।সেখানে গেলে কুহুর মর্জি মতোই হবে সব।মাথা ঠান্ডা করে রওনককে বলল,সে একদিনই থাকবে।তীর্যক দৃষ্টিতে কুহুকে দেখে নিয়ে বলল রওনক,
” কোনোরকম চিটিং চলবে না।যদি ভাবো চালাকি করবে,তাহলে উল্টো ফেঁসে যাবে।আমাকে চেনো না তুমি।

কথাটুকু বলেই ড্রেসিং টেবিলের সামনে থেকে চিরুনি তুলে নিয়ে চুল আঁচড়ে নিল রওনক।ভেংচি কাটল কুহু।একটা না একটা বাহানা দিয়ে তো অবশ্যই থাকবেই সে।কালো রঙের শার্ট পরেছে রওনক।সঙ্গে হোয়াইট প্যান্ট।কয়েক সেকেন্ডে জন্য দৃষ্টি থমকে গেল কুহুর।পরোয়া না করে বেরিয়ে গেল সে।শারমিন বেগম আর রাশেদ জামালের থেকে বিদায় নিতে।

,

ঘড়িতে রাত বারোটা।ফোন হাতে বসে আছে রিশা।ক্রিনে আশফিকের ছবি।নিত্য দিনের অভ্যেস এটা।আইডিটা একবার হলেও ঘুরে দেখে প্রতিদিন।দুদিন আগেই কানাডা চলে গেছে আশফিক ভাই।এয়ারপোর্টে ছবি তুলে পোস্ট করেছে।সেখানে সুন্দর করে একটা মন্তব্য করল রিশা।তবে আজ বহুদিন বাদে।অবশ্য আগে প্রায় সব ছবিতেই মন্তব্য করতো।মাঝেসাঝে রিপ্লাই পেতো সৌভাগ্যক্রমে।ফোন বেজে উঠতেই ভাবনার অবসান ঘটলো রিশার।স্ক্রিনে তাকাতেই চমকে উঠলো!আশফিক ভাইয়ের কল!মুহুর্তে বুক ধ্বক করে উঠল।হাত মৃদু কাঁপল।এই ফোনকলের জন্য প্রস্তুত ছিল না রিশা।কখনও আশফিক ভাই তাকে ফোন করেনি।প্রলম্বিত শ্বাস নিয়ে ফোন রিসিভ করলো সে।কন্ঠনালী কাঁপছে তার।কি বলবেন আশফিক ভাই?এখনো যে পথ চেয়ে বসে আছে রিশা।মন মানতে চায় না।বেহানা মনকে কিছুতেই বোঝাতে পারে না।

“হ্যালো রিশ!হাউ আর ইউ?

ভরাট পুরুষসুলভ কন্ঠস্বর গমগম করে বেজে উঠলো কানে।শুকনো ঢোক গিলে উত্তর দিল রিশা,
” ভাল আছি।আপনি কেমন আছেন আশফিক ভাই?

“এই তো আছি।মিস ইউ ডিয়ার!আচ্ছা এবার আমার সঙ্গে বেশি কথা বলিসনি কেন তুই?কেমন একটা জড়তা খেয়াল করেছিলাম।ছোট বেলার ভয়টা কি এখনো আছে?

চলবে……