#তুলির_সংসার
#পর্ব_৪
তুলিকে দেখে প্রায় ভূত দেখার মতো চমকে গেলো শুভ্র
আপনি এখানে এতো রাতে
হঠাৎ ঘুম ভেঙ্গে গেলো দেখলাম রুমে আপনি নেই আমারো আর ঘুম আসছিলো না।আপনি যে এতো ভালো গাইতে পারেন সেটাতো জানতাম না।
আপনি বুঝি চুপি চুপি আমার গান শুনছিলেন?
চিলেকোঠায় আসার পর গানের শব্দ শুনতে পেলাম। একবার মনে হয়েছিলো আপনার সাথে অন্য কেউ আছে। অসাধারন গানের গলা আপনার। আপনি গান গাইতে পারেন আমাকে বলেন নি কেনো।
এটা বলার মতো তেমন কিছু নয়।
ছোটবেলায় আম্মা খুব ঘটা করে ওস্তাদ রেখে আমাকে গান শিখিয়েছিলেন। সাথে একজন তবলচিও আসতো। সে এক এলাহী কারবার।
তাহলে বন্ধ করলেন কেনো।
আমার বাবা পছন্দ করতেন না তাই। উনার ধারনা গান বাজনা মেয়েরা করে এজন্যে আমার গান শেখা ওনার পছন্দ ছিলোনা।
শুধু কি গান, আমি আর্ট কলেজে পড়তে চেয়েছিলাম।ভর্তি পরীক্ষায় চান্স ও পেয়েছি। পরে ভর্তি হতে যেয়ে দেখি আমি নাকি চান্স পাইনি ওটা প্রিন্টিং মিসটেক ছিলো। ততোদিনে আমি অনেক বড় হয়ে গিয়েছি আমি জানি আমার ক্ষমতাবান বাবা তার ক্ষমতা দিয়ে সব কিছু করতে পারে। আমি তার একমাত্র ছেলে আমি আর্ট কলেজে পড়লে তার ব্যবসা কি করে সামলাবো। তাই আমাকে বিবিএ পড়তে হলো।
মজার একটা ব্যাপার কি জানেন তুলি,
বাবা ভাবেন আমি খুব বোকা, ওনার এসব চাল গুলো ধরতে পারিনা।
শুভ্র সাহেব
আপনার হাসির পেছনে তো দেখি অনেক কষ্ট লুকিয়ে আছে। যা আপনি কাউকে বুঝতে দেন না।
বুঝতে দেয়ার মতো কেউ এতোদিন ছিলোনা।
আমাকে কি বলা যায়।
নাহ
কেনো, আমরা বন্ধু হতে পারিনা..?
বন্ধুত্বের খাতিরে পরিচয় হয়নি আমাদের। এখন আর সেটা সম্ভব নয়।
#
মতিন সাহেব আপনাকে একটা কাজ দিয়েছিলাম।
জ্বী স্যার
কোনো খবর বের করতে পেরেছেন
পেরেছি স্যার
সেই ছেলে গ্রামের স্কুলের সাবেক হেড মাস্টারের ছেলে।গ্রামে তার ভালই সুনাম। কারো বিপদে সবার আগে দৌড়ে যায়। নিজেই অভাবী তবু দুনিয়ার মানুষের উপকার করে বেড়াত।
আপনার কাছে কি আমি তার গুন জানতে চেয়েছি।দোষ কি আছে তাই বলুন।
স্যার দোষতো কিছু শুনলাম না গ্রামের সবাই শুধু প্রশংসাই করলো।ঢাকায় এতোদিন কোনো চাকরি না পেয়ে গ্রামের প্রাইমারি স্কুলে ঢুকেছে কিছুদিন হলো দপ্তরী হিসাবে।
কি যেনো ছেলেটার নাম?
জহিরুল আলম
ওকে ঢাকা আনার ব্যবস্থা করেন।
ওকে স্যার
আজকাল মন্ত্রনালয়ের কাজে ব্যস্ত থাকতে হয় বলে নিজের ব্যবসা দেখার একদমই সুযোগ পান না তোবারক হোসেন। উনি মন্ত্রী হওয়ার পর থেকে শুভ্রই সামালাচ্ছে সব। এবং বেশ ভালই সামলাচ্ছে। সপ্তাহে একদিন মতিন সাহেব এসে সব রিপোর্ট করে যান। তোবারক হোসেনের অনেক পুরোনো বিশ্বস্ত কর্মচারী সে। তোবারক হোসেনের গোপন কাজ গুলোও তাই ওকে দিয়েই করান।
মতিন বেরিয়ে যেতেই রেহানাকে ফোন করলেন।
কেমন চলছে তোমার জীবন ছেলের বউকে নিয়ে
খুব ভালো… খুব লক্ষ্মী মেয়ে
শুভ্র নাকি ইদানিং অফিসে খুব হাসি খুশি থাকে। মতিন বললো সেদিন ড্রাইভারও বলছিলো।
হ্যাঁ আমাদের শুভ্র অনেক বদলে গেছে। আজকাল মাঝে মাঝে ছাদে যেয়ে গানও গায়।
তাহলেতো বউমার সাথে দেখা করতেই হয়। রেহানা তুমি এক কাজ করো কাল দুপুরে বউমার পরিবারের সবাইকে নিমন্ত্রন করো। পরিচিত হই বিয়াই বিয়াইনদের সাথে।
সত্যি… সত্যি আপনি ওনাদের দাওয়াত করতে বলছেন
ফোন রাখার পরও বিশ্বাস হচ্ছেনা রেহানার।
খুশিতে তড়িঘড়ি করে ফোন দিলেন নিলুফার বেগমকে…
#
শুভ্রর এলার্ম বাজছে কখন থেকে।তুলি মোবাইলটা হাতে নিয়ে সময় দেখলো। ছয়টা দশ বাজে। এতো সকালে এলার্ম কেনো দিয়েছিলো শুভ্র। ও মনে হয় গভীর ঘুমে। কি করবে তুলি ওকে ডেকে উঠাবে। শুভ্র একদম বাচ্চাদের মতো গুটুলি পাকিয়ে ঘুমোচ্ছে। তুলির খুব মায়া হচ্ছে। থাক না আরেকটু ঘুমাক। খুব কাজের চাপ যায় ওর উপর, সারাদিন অফিস, বাড়িতে আসার পরও ফোন আসতেই থাকে। সব কাজই হাসিমুখে করে। বাড়ির বৃদ্ধ কাজের বুয়ার ওষুধ শেষ হয়ে গিয়েছি কিনা সে খোঁজ ও রাখে। শুভ্রকে কাছ থেকে দেখে তুলি প্রতিদিনই নতুন করে বিস্মিত হয়। ওর নিজেকে তখন খুব স্বার্থপর মনে হয়। তুলি বোধ হয় নিজের ভালবাসায় অন্ধ হয়ে, বাকী পৃথিবীটাকে একটু বেশীই অবহেলা করে ফেলছে।
আপনার কিছু লাগবে।
চোখ খুলে তুলিকে শুভ্রর দিকে ঝুঁকে থাকতে দেখে অবাক হলো শুভ্র
আপনার এলার্ম বাজছিলো।
হ্যা শুনেছি
শুনেও চোখ বন্ধ করে ছিলেন, জরুরী কিছু না?
জরুরি তবে এক ঘন্টা পর একটা অনলাইন মিটিং আছে জাপানের একটি কোম্পানীর সাথে
তাহলে এতো আগে এলার্ম কেনো দিয়েছেন
টোটাল তিনটা এলার্ম দিয়েছি। প্রথমটাতে ঘুম ভাঙ্গতে চাইবে না, দ্বিতীয়টাতে ঘুম ভাঙ্গবে তবু শুয়ে থাকবো আর তৃতীয়টিতে উঠে যাবো।
ওয়াও অসাধারন আর আপনার প্রথম এলার্মই আমার ঘুমের বারোটা বেজে গেছে।
সরি
এক হিসেবে ভালো হয়েছে আজকে তোয়াদের আসার কথা। ঘরটা গোছানো শুরু করবো। মা বলেছেন আমাকে কোনো একটা পদও রান্না করতে।
হুম সেটাই ভাবছি
কি
বাবা আপনার বাবা মাকে ইনভাইট করলো কেনো। উনিতো বিয়েতে রাজী ছিলেন না। ওনার মতলব টা আসলে কি? আমার মনে হচ্ছে খুব সম্ভবত উনি আপনার পরিবারের কোনো খুঁত বের করতে চান।
আপনি শুধু শুধু ভাবছেন আমার মনে হয়না সেরকম কিছু
আপনি আমার বাবাকে চেনেন না। হেরে যাওয়া তার স্বভাবে নেই, উনি যা চান না তা কখনই হতে দেন না।
তাহলে উনি বিয়েটা হতে দিলেন কেনো?
সাময়িক ভাবে আমাকে এবং আম্মাকে খুশি করার জন্যে। যখন উনি বাধা দেননি আমি জানি তখন থেকেই উনি বিয়ে ভাঙ্গার প্ল্যান করছেন। উনি উনার উদ্দেশ্য এমন ভাবে হাসিল করবেন যে আমাদের মনে হবে যা হয়েছে সেটা স্বাভাবিক ভাবেই হয়েছে।
শোনেন তুলি আমার মিটিংয়ের পর আমি একটা ব্রিফিং দিবো আপনাকে কি করে আমার বাবার সামনে এ্যাক্ট করতে হবে সে ব্যাপারে।
আপনার কথা শুনে মনে হচ্ছে আমরা একটি রনক্ষেত্রে আছি
রনক্ষেত্র তো বটেই
এবার সম্মুখ যুদ্ধ হবে। সারাজীবন আমার সব কিছুতো তার ইচ্ছায় চালিয়েছে কিন্তু এখন আর পারবেনা।
#
শোনো বউমা এমনিতেতো বিয়ের কোনো আনুষ্ঠানিকতাই আমরা করতে পারিনি।সেজন্যে তুমি কষ্ট পেয়োনা। তোমার শশুর যখন একবার মেনে গেছেন এখন আর চিন্তা নেই। আজ তোমার বাবা মা আসলে আমরা একটা রিসিপশনের দিন ধার্য়্য করবো। কি বলো..?
জ্বী মা আপনারা যা ভালো মনে করেন
আমাকে বলেছিলেন একটা পদ বানাতে, আমি কি বানাবো।
মিষ্টি কিছু বানাও মা, তোমার শশুরের আবার মিষ্টি জাতীয় জিনিষ খুব পছন্দ। শেষ পাতে শশুরকে বেড়ে দিবে। একবার খেয়ে মজা পেলে দেখবে সারাদিন শুধু বৌমা বৌমা করবে।
তুলি ফ্রিজ থেকে দুধ বের করে চুলায় বসালো। ভাবছে শাহী টুকরা বানাবে। ওর এই রান্নাটা বাবা আর জহির মামার খুব পছন্দ। প্রথম যেদিন উনি খেয়েছিলেন তুলির ঘরের সামনে এসে দরজায় টোকা দিলেন।
তুলি ঘরে আছেন
তুলি চোখ বন্ধ করে কল্পনা করছিলো। বিয়ের পর প্রথমবার জহিরদের গ্রামের রান্নাঘরে লাকড়ির চুলায় রান্না বসিয়েছে। ধোয়ায় ওর চোখ জ্বলছে। জহির এসে বলছে, কি করছো কে বললো তোমাকে এসব করতে। দেখি এদিকে ঘুরো চোখ খুলো আমি ফুঁ দিয়ে দিই।কল্পনাতে জহির তখনও ফুঁ দিতে পারেনি অমনি বাস্তবে জহির মামার ডাক শুনলো।
ধরমর করে বিছানায় উঠে বসলো তুলি। ওর বুক এতো জোড়ে ধুকপুক করছিলো, মনে হচ্ছিলো বাইরে থেকেও শব্দ শোনা যাচ্ছে। ভুল করে ওড়না না নিয়েই দরজার যেয়ে দাঁড়ালো, জহির ওকে দেখেই চোখ নামিয়ে নেয়।
জ্বী বলেন
আপনার বানানো রাজকীয় টুকরা খেলাম।
শাহী টুকরা
নামটা মনে ছিলোনা। এতো সুখাদ্য আমি জীবনে খাইনি।আল্লাহ তায়ালা আপনার হাতে যাদু দিয়েছেন, রান্নার যাদু।
সেরকম কিছুনা আমি ঐ একটা জিনিসই ভালো বানাতে পারি।
আমার সেরকম মনে হয় না। আপনি যা রাঁধবেন তাই মজা হবে। কিছু কিছু মানুষের গলায় যেমন আল্লাহ সুর দিয়ে দেন তারা যেকোনো কথা নিয়ে গীত বাধলেই অনেক সুন্দর গীত হয়। আপনের হাতেও সেরকম রান্নার গুন আছে।
আপনার স্বামী খুবই ভাগ্যবান একজন মানুষ হবেন।
হঠাৎ তুলির খেয়াল হলো ওর গায়ে ওড়না নেই আর এজন্যেই জহির চোখ নামিয়ে রেখেছে
তুলির মাথায় দুষ্ট বুদ্ধি খেলে গেলো। জহির তো ভাবে সে খুব ভদ্রলোক। সেটাই যাচাই করার ইচ্ছা জাগলো ওর।
আপনি যতই প্রশংসা করেন সেটা আমি বিশ্বাস করবো না যতক্ষন না আপনি আমার দিকে তাকিয়ে কথা বলবেন
মুচকি মুচকি হাসছিলো তুলি কেমন যেনো একটা নিষ্ঠুর আনন্দ হচ্ছিলো। তুলিকে এভাবে দেখলে কি একটু হলেও জহিরের ভেতর তোলপাড় হবে না..!
তুলির চালাকি জহির ধরতে পেরেছিলো তাই হঠাৎ বলে উঠলো। আমার একটা টিউশনি আছে দেরি হয়ে যাচ্ছে।
আপনার ঐ টুকরার জন্যে অনেক ধন্যবাদ।
চোখে পানি নিয়ে তুলি দরজার সামনেই ধপ করে বসে পরেছিলো। কিভাবে মুখের উপর তিরস্কৃত হলো ও তবু কেনো ভুলতে পারেনা।
তুলির ঝাপসা হওয়া চোখের পানি ওর গাল বেয়ে পরার ছোঁয়া পেয়েই চমকে উঠলো পেছনে শুভ্রর মা দাঁড়িয়ে উনি ওকে কাঁদতে দেখলে আবার কি না মনে করেন। গলার দলা পাকানো কষ্ট গেলার মতোই চোখের পানি আটকানোর চেষ্টা করলো তুলি।
#
তোমার নাম যেনো কি?
তুলি
ভালো নাম
ফাহমিদা তুলি
এটা আবার কেমন নাম।
তোমার বাবার নাম কি?
জামান আহমেদ
তোমার নামতো হওয়া উচিত ছিলো ফাহমিদা আহমেদ তুলি
সেটাই আমার নাম ছিলো কিন্তু আমি ম্যাট্রিকের রেজিস্ট্রেশনের সময় চেন্জ করে দিয়েছিলাম।
কেনো জানতে পারি।
আমি ভেবেছিলাম যদি আমি বড় হয়ে বিখ্যাত হই, ওই নামটা মানাতো না।
বড় হয়ে তুমি বিখ্যাত কিছু হলে নামটা মানাবে না, তার জন্যে তুমি তোমার বাবা মার দেয়া নাম তাদের জিজ্ঞেস না করেই চেন্জ করে ফেললে?
জ্বী
অসাধারন
তোমাকে একটা কথা বলি বউমা তোমার কথা শুনেই বোঝা যাচ্ছে তুমি খুব সাহসী মেয়ে। আমাদের চৌধুরী পরিবারের বউরা সাধারনত ভীতু প্রকৃতির হয়। তবে এক হিসাবে ভালো হয়েছে তুমি যাকে বিয়ে করে এ বাড়িতে এসেছো। আমার একমাত্র ছেলে শুভ্র সে অত্যান্ত ভীরু প্রকৃতির তার জন্যে তোমার মতো সাহসী বউয়েরই দরকার ছিলো।
আপনার ধারনা ভুল শুভ্র অত্যান্ত সাহসী এবং বুদ্ধিমান একটি ছেলে।
আমার ছেলেকে তুমি আমাকে চেনাচ্ছো।
কেউ সাহসী আর বুদ্ধিমান হলে কি, নিজের বউয়ের পর পুরুষের প্রেমে মজে থাকা এতো শান্ত ভাবে মেনে নেয়।
ছিঃ আপনি এগুলো কি বলছেন?
সত্যি কথা স্পষ্ট করে শুনলে এমনই লাগে বউমা।
কিছুক্ষন আগে বাড়িতে এসেছেন তোবারক হোসেন চৌধুরী। খুব শখ করে রেহানা তুলিকে দিয়ে ওনার জন্যে চা নাস্তা পাঠিয়েছিলেন। সেটা দিতে এসেই এতো গুলো কথা শুনতে হলো তুলিকে।
এতো ধুরন্ধর আর চতুর লোকের ছেলে শুভ্র তুলির বিশ্বাসই হচ্ছেনা…
চলবে…