#তুলির_সংসার
পর্ব-৭
গ্রামের নাম রাধা সুন্দরী, সূবর্নপুরের এক প্রত্যন্ত গ্রাম।আধুনিক সুযোগ সুবিধা থেকে বন্চিত গ্রামটি প্রত্যন্ত হলেও প্রকৃতি তাকে উজার করে সাজিয়েছে। একপাশে তার সুউচ্চ গারো পাহাড় প্রাচীর হয়ে দাড়িয়ে আছে শত সহস্র শতাব্দী ধরে অন্য পাশে সীমানা ছুয়ে বয়ে চলেছে পাহারী সুন্দরী নদী সোমেশ্বরী।পাহাড়ী এলাকা হওয়াতেই বৃষ্টিটা বেশী হয় আর তাই চারিদিকে ঝকঝকে সবুজ গাছপালা। দেখলে মনে হয় কেউ বুঝি এই মাত্র সব ঝেড়ে মুছে পরিষ্কার করে দিয়েছে। জহিরের টেবিলের পাশেই বিশাল জানালা যার পুরোটা জুড়েই গারো পাহাড়ের দর্শন মেলে। মাষ্টার্স পাশ করার পরও গ্রামের স্কুলের দপ্তরীর কাজ করতে হচ্ছে সেই কষ্টটা ওর ঘুচে যায় শুধু এই অপার প্রকৃতি দেখতে পাওয়ার সুযোগে।এটি একটি এন জি ও চালিত স্কুল। বেশির ভাগ বাচ্চারা আশেপাশের উপজাতিদের বাচ্চা। তারা বহু দুর পাহার বেয়ে বিদ্যালয়ে পড়তে আসে। কিছু বাঙ্গালীর ছেলেমেয়েরাও আছে। স্কুলের প্রধান শিক্ষক রডরিজ গোমেজ। উনি জহিরের কাজে খুব খুশি, আশা দিয়েছেন। কোনো টিচারের পদ খালি হলেই জহিরকে শিক্ষক হিসাবে নিয়োগ দিবেন। দপ্তরির কাজ যে খুব খারাপ লাগছে তা নয়। তবে মাঝে মাঝে ঐ সুউচ্চ গারো পাহাড়ের দিকে তাকিয়ে আনমনা হয়ে যায়। বুক চিরে নিজের অজান্তে বেরিয়ে আসে দীর্ঘশ্বাস।
সেদিন সেই ঝুম বৃষ্টিতে প্রথমবার দেখেছিলো তাকে। হ্যা, মিথ্যা বলেছিলো জহির। তুলিরা গ্রামে বেড়াতে এসেছিলো এটা ওর বাবার কাছে শোনা। তখন একটা কাজে ময়মনসিংহ সদরে গিয়েছিলো। গ্রামে এসে শুনে সবার মুখে মুখে এক কথা, ঢাকা শহর থেকে দুই রুপবতী মেয়ে নিয়ে ঘুরতে এসেছিলো, মধ্যপাড়ার নওয়াব আলীর ছোট-বোন নিলুফার। শহরের মেয়ে তাও কোনো ভয় ডর নাই গ্রামের মেয়েদের মতোই ঘুরে বেরিয়েছে। ছোট গ্রাম শহর থেকে কেউ আসলে তাদের কান্ড কারখানায়, মানুষ সার্কাস দেখার মতনই আনন্দ পায়। হঠাৎ কাঁদায় তাদের পা পরে গেলে, গ্রামের মানুষ হেসে গড়াগড়ি খায়। শখ করে টিউব ওয়েল চাপতে গেলে, গ্রামের মানুষ এতো আগ্রহ নিয়ে শেখায় যেনো টিউব ওয়েল চেপেই তাদের সারা জীবন চলতে লাগবে। এমনই টুকটাক কথা শুনতে পায় জহির ময়মনসিংহ থেকে ফিরে এসে। ওর তখন সেগুলো নিয়ে মাথা ঘামানোর সময় নেই একটা চাকরির বড্ড প্রয়োজন সেই খোজেই ময়মনসিংহ গিয়েছিলো বাবার এক পুরোনো ছাত্র, ওনার কোম্পানিতে মার্কেটিংয়ের জব দিবেন বলেছিলেন। কোনো কাজ হয়নি আশা দিয়ে বিদায় করে দিয়েছেন।
তুলির মা যখন পরিবার নিয়ে পাড়া বেড়াতে বেরিয়েছিলেন। জহিরের বাবার সাথে দেখা হয়ে যায়। ওনার ছোটবেলার স্কুলের হেড মাষ্টারকে দেখে, স্বামী মেয়েদের সাথে পরিচয় করিয়ে দেন। তখনই জহিরের কথা শুনে তুলির বাবা বলেছিলেন জহিরকে বলেন ঢাকা আসতে। আমাদের বাসায় থেকে চাকরির খোঁজ করবে। আর আমিও চেষ্টা করবো পরিচিত মহলে সবাইকে বলে একটা চাকরির বন্দোবস্ত করা যায় কিনা। সেই সুবাদেই জহিরের ঢাকা যাওয়া।
কাক ভেজা শব্দটা জহিরের খুব অপছন্দ,
না বৃষ্টিতে ভেজা তুলিকে দেখে ওর মনে হয়নি কাক ভেজা কেউ, মনে হয়েছিলো স্বর্গের সরোবরে জলকেলি করে স্নান করছিলো কোনো অপ্সরা। আর তার আনন্দ অবগাহনে বাঁধ সেধে হাজির হয়েছিলো জহির নামের এক গ্রাম্য যুবক। যে এক দেখাতেই মন দিয়ে বসেছিলো সেই বৃষ্টিস্নাতা কিশোরীকে।
আহা কি ল্জ্জাই না পেয়েছিলো, প্রচন্ড জ্বরে কাঁপতে কাঁপতে তুলির সেবা পেয়ে। জীবনে প্রথম বারের মতো নারীর ছোঁয়া… জন্মের সময় মা মরা জহিরের জীবনে বৃদ্ধ বাবা ছাড়া কেউ নেই। সেদিনের আগেও জহিরের কতো বার জ্বর হয়েছে অমন করে কেউ ওর খেয়াল করেনি। কেউ না। নারী জাতি সে যে রুপেই হোক তার মমতা, তার ভালবাসা, তার সেবার তুলনা হয়না। কিশোরী তুলির যে নারী রুপ, ও দেখেছিলো সে কিছুতেই ভুলার নয়। কথা ছিলো তিন মাসের মতো থেকে চাকরির চেষ্টা করবে না হলে গ্রামে এসে স্কুলেই চাকরিতে লেগে যাবে। কিন্তু সতেরদিনের তুলির ছোঁয়া আর কিছুতেই জহিরকে সাহস দেয়নি তুলির থেকে বেশি দূরে যাওয়ার।
ভালবাসাটা ওর এক তরফা ছিলো অন্তত সেরকমটাই ভেবেছিলো ও। যার বাড়িতে আশ্রিত তার মেয়েকে ভালবাসাই ভয়ংকর অপরাধ। সেই ভালবাসাকে চূড়ান্ত করে পাবার আস্পর্ধা করা চরম বেইমানের কাজ। ছোটবেলা থেকে শিক্ষক বাবার আদর্শে বড় হওয়া জহির তা কিছুতেই করতে পারেনা। যখন বুঝতে শুরু করলো তুলিও ওকে ভালবাসে, প্রচন্ড আনন্দের সাথে ভয় আর অস্বস্তিও হচ্ছিলো। এরই মধ্যে তুলির কিছু স্বভাবজাত কিশোরী চান্চনল্যতা জহিরকে অপ্রস্তুত করে দিতো প্রায়শই।
ইন্টার পরীক্ষা শেষে তুলির তিনমাসের লম্বা ছুটি। ওর বাবা সারাদিন অফিসের কাজে বাইরে। তোয়া স্কুলে আর তুলির মা এদিক ওদিক ঘুরাঘুরিতেই থাকতেন। ঐ সময়টায় একলা বাসায় জহিরকে নিয়ে তুলির কৈশোরের ছেলেমানুষি কান্ড কারখানা। কখনো চা নিয়ে আসছে তো, কখনো ঘর গুছিয়ে দিয়ে যাচ্ছে। ছোট্ট মেয়ে সালোয়ার কামিজ রেখে ঘরে নতুন বউদের মতো শাড়ী পরে ঘুরে বেড়াচ্ছে। জহির যতোই এড়ানোর চেষ্টা করছিলো, দেখেও না দেখার, বুঝেও না বোঝার ভান করছিলো ততই বেপরোয়া হয়ে উঠছিলো তুলি। তুলিকে ভাগ্নির মতো ট্রিট করা, তুলির সামনে তোয়ার প্রশংসা করা। হাজার রকম ভাবে জহির চেষ্টা চালিয়েছিলো তুলিকে বোঝানোর যে জহির ওকে অন্য কোনো ভাবে কখনোই দেখে নি। জহিরের জন্য সেটা ছিলো বর্ণনাতীত কষ্টের কাজ।
তুমি যাকে ভালবাসো আর যাকে পাবার জন্যে,
ভাদ্র মাসের দুপুরে অনেক পথ পারি দেয়া তৃষ্ণার্ত পথিকের নিকট এক ফোঁটা পানির মতো, আকুল হয়ে থাকো,
তাকেই যদি তোমার চূড়ান্ত অবহেলা করতে হয় তাও এটা জেনে যে সেও তোমাকে ভালবাসে। সে কাজ যে কি কঠিন আর কষ্টের,ভাষায় প্রকাশ করার মতন নয়।
এমন কঠিন পরিস্থিতে আল্লাহ যেনো চরম শত্রুকেও না ফেলেন।
হঠাৎ মেঘের গর্জনে ভাবনার জগৎ থেকে ফিরে এলো জহির। পাহাড়ী এলাকা প্রকৃতির মন বোঝা দায় কিছুক্ষন আগেও রোদ ঝকঝকে পরিবেশ ছিলো আর এখন মেঘ ডাকছে। প্রকৃতি তার বাদ্য যন্ত্র নিয়ে তৈরি হচ্ছে কিছুক্ষনের মধ্যেই বৃষ্টি সংগীত শুরু হবে। চিন্তায় পরে গেলো জহির বাড়ি যাবে কি করে। প্রায় এক মাইলের মতো রাস্তা হাটতে হয়। গ্রামে প্রচলিত আছে বিনা মৌসুমের বৃষ্টিতে ভিজলে তৎক্ষনাত তাপ উঠে যায়। এবার সেরকমটা হলে কে দেখবে জহিরকে। তুলি যে আর ওর জগতে নেই। একটি বার সাহস করলেই যাকে নিজের করে পেতো তাকেই আজ শুধু আত্মসম্মানের জন্যে তিরস্কার করে চিরদিনের মতো হারিয়ে ফেলেছে।
#
এক মাইল পথ খুব একটা দীর্ঘ না হলেও ঝড় বৃষ্টির মধ্যে সেটাকেই পাঁচ মাইল বলে মনে হলো। ছাতা নিয়ে সাহস করে বের হয়ে পরেছিলো জহির। কিন্তু কিসের কি ছাতা সব ঝড়ের বাতাসে উড়ে একেবারে লন্ড ভন্ড। এতো ভালো ছাতাটা নষ্ট হয়ে গেলো ভেবে খারাপ লাগছে। এখন হাতেও অনেক টানাটানি খুব অল্প আয়ে চলতে হচ্ছে। যদিও জহির খুবই আশাবাদী এমন অবস্থা বেশিদিন থাকবে না।
কানাঘুসা শুনেছে স্কুলের অংক আপার নাকি বিয়ের কথা চলছে, যেকোনো মূহুর্তে বিয়ে হয়ে যেতে পারে। ওনার বিয়ে হলেই রডরিজ স্যার ওই পোস্টটা জহিরকে দিবেন। তাহলে আর বেশি চিন্তা নাই। ওর আর খরচ কি, বৃদ্ধ বাবা আর জহির। বাড়িতে দুজন মাত্র মানুষ।
জহির এখন দিন রাত সেই অংক আপার বিয়ের জন্যে দোয়া করছে। আজও ঝড় বৃষ্টির মধ্যে বার বার এই দোয়া করছিলো। ছোটবেলায় বাবার কাছে শুনেছে যেকোনো দূর্যোগের সময় করা দোয়া তাড়াতাড়ি কবুল হয়।
প্রায় বাড়ির কাছাকাছি এসে কি যেনো ভাবতে ভাবতে কাদা পানিতে ধপাস করে পরে গেলো জহির। জামা কাপড় সব কাঁদায় মাখামাখি হয়ে গেলো। কোনো মতো উঠে বাড়ির উঠোনে এসে দাঁড়াতেই ভূত দেখার মতো চমকে গেলো।
তুমি এখানে..?
আসসালামু আলাইকুম মামা
ওয়ালাইকুম আসসালাম
তোমরা গ্রামে আসবে জানতাম নাতো
আমরা না আমি
মানে
জ্বী মামা আমি চলে এসেছি আপনার কাছে কয়েকটা দিন থাকবো
জহিরের বুক জোড়ে জোড়ে ধক ধক করছে ভয়ে,
তোয়া বলে কি এসব, এই মেয়ে এখানে চলে এসেছে..!
ওর কাছে থাকবে মানে..?
মামা কল চেপে দেই আপনি তাড়াতাড়ি গোসল করেন কাদায় তো আপনার চেহারা চেনা যাচ্ছেনা।আগের বার এসে টিউবওয়েল চাপার উপর শর্ট কোর্স করে গিয়েছিলাম। এখন এক চাপেই অনেক পানি পরে। দেখবেন মামা…
তোয়া খুব আগ্রহ নিয়ে জহিরকে দেখাচ্ছে কি করে টিউবওয়েলে এক চাপ দিতেই অনেক পানি পরছে
আসেন মামা গোসল না করেন হাত মুখটা ধুয়ে নেন
তুলি জহিরকে বলেছিলো যে আমার মনে হয় তোয়া আপনার প্রেমে হাবুডুবু খাচ্ছে। জহির কখনো সেটা বিশ্বাস করেনি। তুলি কি তাহলে সত্যি বলেছিলো। যদি তাই হয় জহির এখন কি করবে। তোয়া তুলির মতো নরম মেয়ে নয়। খুব জীদি আর এক রোখা টাইপের মেয়ে। যে কাউকে কিছু না বলে সরাসরি জহিরের কাছে চলে এসেছে। জহির না করলে সে নির্ঘাত আত্মহত্যা করে বসবে।
হে আল্লাহ তুমি আমাকে এ কোন বিপদে ফেললে।
জহির মনে মনে দোয়া ইউনুস পড়তে লাগলো।
গোসল করে কাপড় বদলে গামছা দিয়ে চুল মুছতে মুছতে বের হলো জহির।
তোয়া তুমি কাজটা ঠিক করোনি।
আমি তোমাকে অত্যান্ত স্নেহ করি
আমি জানি মামা, এজন্যেই আপনার কাছে এসেছি। আপনি ছাড়া আমার আর যাওয়ার জায়গা ছিলোনা। আমি একটা ছেলেকে ভালবাসি। আপার বিয়ের পর মা আমার বিয়ে দেয়ার জন্যে পাগল হয়ে গিয়েছে। কালকে আমাকে দেখতে আসার কথা কোনো এক শিল্পপতির ছেলের। সব ঠিক থাকলে কালই নিকাহ পড়ানো হবে।
মন্ত্রীর ছেলের শালী বলে তারা আমাদের সাথে সম্পর্ক করতে চায়। চিন্তা করেছেন মামা, আমি কেমন মেয়ে, ভালো কি মন্দ তাতে তাদের কিছু যায় আসেনা। আমার বোনের শশুর মন্ত্রী এটাই তাদের জন্যে যথেষ্ট।
এজন্যে আমরা চুপি চুপি বিয়ে করে ফেলেছি।
জহির বুঝতে পারছে না ও স্বস্তি পাবে, এটা জেনে যে তোয়া আসলে ওর জন্যে আসেনি নাকি রাগ করবে কাল বিয়ে আজ মেয়েটা বাড়ি থেকে পালিয়ে ওর বাড়িতে এসে হাজির।
তুমি একজনকে পছন্দ করো তোমার বাবা মাকে বলোনি কেনো
বলে লাভ নেই, আমি যাকে বিয়ে করেছি ওরা বেশি বড়লোক নয়। একচুয়ালি খুবই গরিব। মা কিছুতেই মানবে না। শুনলে হার্ট এ্যাটাক ও করতে পারে।
কোথায় সেই ছেলে?
আপনার বাবার সাথে বাজারে গিয়েছে।
তুমি ঐ ছেলেকে নিয়ে এসেছো?
কি যে বলেন না মামা জামাই ছাড়া কি কেউ পালিয়ে বিয়ে করে..?
কথাটা বলে হাসছে তোয়া।
মজার কথা কি জানেন, আপা ভাবে আমি আপনাকে ভালবাসি। আমিও না করিনি। আমি পালিয়েছি শুনলে ও নির্ঘাত বুঝবে আমি আপনার কাছেই এসেছি।
মিথ্যা কথা বলেছো কেনো..?
আপার উপর থেকে আপনার মোহ কাটানোর জন্যে। বিয়ে হয়ে গেলেও আপা কিছুতেই শুভ্র ভাইকে একসেপ্ট করতে পারছিলো না।
তুলির প্রসঙ্গ উঠতেই জহির চুপসে গেলো।
তোয়া তোমার মাকে ফোন দিয়ে বলি তোমরা এখানে আছো নাহলে অনেক চিন্তা করবেন।
করুক চিন্তা কয়েকদিন। আমরা এক সপ্তাহ থেকে চলে যাবো। এর মধ্যে খবরদার আপনি কাউকে ফোন দিবেন না বলছি। নাহলে কিন্তু আমি পেছনের পুকুরে ঝাঁপ দিয়ে আত্মহত্যা করবো।
আচ্ছা থাক থাক দিবোনা ফোন।……
চলবে…