#তৃষিত_তরঙ্গ —১৫ (অন্তিমপর্ব)
#প্রানেশা_আহসান_শীতল
[ভা′য়োলেন্স]
মাঝ থেকে কেটে গেছে দিন সাতেক। বাসার পরিবেশ যেন রমরমা হয়ে আছে। আজকে বাসায় সাবরিহার মা সুমি বেগম ও সুবাইতা এসেছে। পরিবেশ এখন উৎসব মুখোর। মুসাওয়াদকে কিছু রান্না সামগ্রী আনতে সুপারশপে পাঠিয়েছে আমেনা বেগম। আর রান্নাঘরে সুমি বেগম আর আমেনা বেগম রান্না-বান্না করছিল আর গল্প করতে করতে, মাছ রান্না করবে বলে তা নামিয়ে রাখতেই সাবরিহা শাড়ির আঁচল কোমড়ে গুঁজে রান্না ঘরে এসে বলল—– “আম্মু আমি মাছ টা ধুঁয়ে দেই?”
আমেনা বেগম সরল দৃষ্টি ফেলে সাবরিহার দিকে তারপর নরম গলায় বলে—– “পারবি? আচ্ছা কর।”
সুমি বেগম মেয়ের এইদিক দেখে খুশি হলেন। তবে কিছু না বলে মন ভরে দোয়া করে দিল। সাবরিহাও খুশি মনে মাছ ধরতেই পেট মোচর দিয়ে উঠল সাথে কেমন একটা আষ্টে গন্ধে দৌঁড়ে ড্রইংরুমের বেসিনে মুখ ভরে বমি করে দিল। সুমি বেগম হুট করে এমন দেখে দৌড়ে মেয়েকে ধরে সামলায়। আমেনা বেগমও এসে সাবরিহাকে দেখে ধরে সোফা নিয়ে বসাল তারপর রান্না ঘরের চুলো বন্ধ করে এসে ড্রাইনিং টেবিল থেকে পানির গ্লাসে পানি এনে সাবরিহাকে দিলে সাবরিহা বড়ো বড়ো শ্বাস ফেলে পানিটা নিয়ে ঢকঢক করে খেলো। আমেনা বেগম কিছু বলার আগে সুমি বেগম জহুরি চোখে মেয়ের আগাগোড়া খুঁটিয়ে দেখে বলে—– “ সাবরিহা পিরিয়ড মিস করেছিস?”
চমকে উঠে সাবরিহা। মুহুর্তেই যেনো সব চোখের সামনে ভেসে উঠল। সাইন্স থেকে ইন্টার কমপ্লিট করে এখন মেডিক্যাল ভার্সিটির স্টুডেন্ট সাবরিহা। তাহলে এতো বড় বোকামি করলো কিভাবে সে? আমেনা বেগমও চমকাল। মৃদুস্বরে লজ্জা ভেঙে বলে—–
“প্রথম দিনই?”
সাবরিহার শ্যামলা মুখটার রং পরিবর্তন এল। মাথা নাড়িয়ে সম্মতিসূচক মাথা নাড়িয়ে মাথা নিচু করে ফেলল। আমেনা বেগম ধপ করে সোফায় বসে পড়ল। সুমি বেগমও এতটা লাগাম ছাড়া মুসাওয়াদকে ভাবে নি। সাবরিহা নাহয় অবুজ, বয়সের দিক থেকে অপরিপক্ক তাই বলে মুসাওয়াদও এই কাজ করবে? সুমি বেগম এগিয়ে এসে আরেকটু ছোট গলায় সাবরিহাকে বলে—– “পিল নিস নি?”
“মনে ছিলো না আম্মু, আমি বুঝতে পারিনি।”
মিনমিন স্বরে উত্তর দিতেই আমেনা বেগম অতিদ্রত অধৈর্য গলায় বলে—– “কায়ান জানে? টেস্ট করেছিস?”
“না!” ——- এক কথায় উত্তর দিলো সাবরিহা। আমেনা বেগম রাগান্বিত হয়ে উঠে গেলো সোফা থেকে। তারপর সুমি বেগমকে বলে—– “আপা আপনি ওকে রুমে নিয়ে যান। কায়ান এলে ওর সাথে কথা বলব। সুবাইতা কি এখনো ঘুমাচ্ছে?”
সুমি বেগম মাথা নাড়িয়ে সাবরিহাকে টেনে তুলে বলে—– “হ্যাঁ। আপনার রুমেই, ওঠে নি।”
“আচ্ছা, তাহলে ওকে ওর রুমে নিয়ে যান।”
সাবরিহার মনে হচ্ছে লজ্জায় মাটিতে মিশে যেতে। তবুও মায়ের হাত ধরে রুমে এসে বিছানায় উঠে বসে। সুমি বেগম কথা বলছে না। সাবরিহা অপরাধী মুখে চুপ হয়ে বসে আছে। তার একটু কনসার্ন হওয়া উচিত ছিল। মুসাওয়াদ তো চলে গেছিল। আর সে মুসাওয়াদের শোকে এসব ভুলে গিলে ফেলেছে। কি একটা লজ্জাজনক ব্যপার।
মাত্রই রান্নাঘরে এসেছিলো আমেনা বেগম আর তখনি বাসায় কলিংবেলটা বাজালো। আমেনা বেগম ভাবলেন মুসাওয়াদ এসেছে তাই ভীষণ রাগান্বিত মুখে এসে দরজা খুলে অপরিচিত কয়েকজন লোককে দেখে একটু ভরকালো। তবুও মুখে হাসি ফুটিয়ে বলে—– “আপনারা কারা? ঠিক চিনলাম না তো!”
সামনের মধ্যবয়স্ক একলোক হাসলো তারপর বলে—– “আমায় চিনবেন না আপা। আপনার ছেলের সাথে আমার কিছু হিসাব ছিলো; কিন্তু শুনলাম সে বিয়ে করেছে তাই ভাবলাম, ভাতিঝিকে দেখে যাই।”
আমেনা বেগম ঠিক বুঝলো না তাই অবাক ও সরল গলায় বলে—– “কায়ান তো বাসায় নেই। আপনারা নাহয় পড়ে আসুন।”
কথাটা বলেই দরজা লাগানোর আগেই আরেকজন দরজা ধরে ফেলল তারপর মধ্যবয়স্ক লোকটা বলে—– “তা কি করে হয়? বউমাকে দেখবো না? এটা কোনো কথা বললেন?”
এদের বাড়াবাড়ি দেখে আমেনা বেগম একটু ভরকালেন। তবুও নিজেকে শান্ত রেখে কিছু বলার আগেই সাবরিহার রুম থেকে সুমি বেগম বেড়িয়ে এসে বলে—– “কায়ান এসেছে আ…”
কথা সম্পূর্ণ করার আগেই এক সাইলেন্সার লাগানো শব্দহীন বুলেট এসে লাগল সুমি বেগমের মাথায়! আমেনা বেগম নিজের চোখকে বিশ্বাস করতে পারল না যেন ঠিক কি হলো তার চোখের সামনে। মুহুর্তেই ধপ করে মেঝেতে পড়ে গেলো সুমি বেগম। সাদা মেঝে রক্তে রঞ্জিত হয়ে এলো। আমেনা বেগম হতভম্ব চোখে তাকিয়ে রইলো। মনে হলো তার অক্ষিকোটরের থেকে নিজের চোখ বেড়িয়ে আসবে। মধ্যবয়স্ক লোকটা নিজের সাথের লোকটাকে ধমকি দিয়ে বলে—– “দিলি তো সব নষ্ট করে। কথাও বলতে দিস না।”
তারপর আমেনা বেগম দিকে তাকিয়ে ফের বলে—– “তো আপা যা বলছিলাম!”
আমেনা বেগম হতবাক ও ভীত গলায় প্রশ্ন করে—– “কারা আপনারা?”
“আহ! আপা। অধৈর্য হবেন না। আপনাদের পুরো পরিবারকে জাহান্নামে পাঠাতে এসেছি৷ একটু ধৈর্য ধরুন।”
আমেনা বেগম চকিতে রুমের দিকে দৌড় দিতে চাইলো তবে তার আগেই আবারো একটা শব্দহীন বুলেট এসে লাগলো তার কোমড়ে। ধপাশ করে পড়ে গেলো আমেনা বেগম। লোকটা হেঁটে এগিয়ে এসে পা ভাজ করে বসে তারপর আমেনা বেগমের মুখের দিকে তাকায়। আমেনা বেগমের চোখ থেকে ততক্ষণে জল গড়িয়ে পড়ছে। তা দেখে মুখ থেকে চুক-চুক করে আফসোসের শব্দ করলো লোকটা। তারপর দাপট দেখিয়ে বলে—– “আমাকে চেনেন নি? আমি অত্র চট্রগ্রামে কালোবাজারি ব্যবসা করি, নাম মিজান মোল্ল্যা। কিসের ব্যবসা তা নিশ্চয়ই বলা লাগবে না আপনাদের; শিক্ষিত পরিবার তো।”
তারপর হেসে মিজান আবারো বলে—– “আপনার ছেলে আমার ব্যবসায় লাল বাত্তি জ্বালিয়েছে। এতো বড় লস আমার চৌদ্দ পুরুষও খায় নাই। তাহলে আপনার ছেলেকে ছেড়ে দেই কি করে? কিন্তু আপনার ছেলে এখন বাসায় নাই তাও আমি জানি। তাই তো এলাম তাকেও কষ্টের বদলে কষ্ট দিতে… উপরে ভালো থাকবেন আপা। বাকি সবাইকেও আপনার সাথে পাঠানোর ব্যবস্থা করছি…!”
কথাটা বলতেই পরপর দুটো বুলেট এসে লাগে আমেনা বেগমের হৃৎপিণ্ড বরাবর। আমেনা বেগম কেশে উঠে নিজের নিঃশ্বাস ত্যাগ করলো। সাবরিহা নিজের দরজার সামনে থেকে এমন এক দৃশ্য দেখে ভরকে ভয়ে চেঁচিয়ে উঠে —– “ আম্মা…”
সাথে সাথেই সবাই সাবরিহার দিকে তাকালো। সাবরিহাও নিজের বিপদ ঠাহর করতে পেয়ে দরজা বন্ধ করতে নেবে তবে তার আগেই এক তীক্ষ্ম বুলেট এসে লাগল সাবরিহা তলপেটের দিকে। সাবরিহা দরজা ধরে থাকায় নিজেকে সামলাতে পারলেও। কাশি এসে মুখ থেকে রক্ত ছিটকে পড়ল সাদা ফকফকে পরিস্কার মেঝেতে। সাবরিহা অবাক চোখে নিজের পেটের দিকে তালায়। গলগল করে সেখান থেকে রক্ত বেড়িয়ে পড়ছে। সাবরিহা কাঁপা হাতে নিজের পেটের দিকটা চেপে ধরে রক্ত বন্ধ করতে চাইল। এটা লেফটেন্যান্ট কমান্ডার মুসাওয়াদ কায়ান এর হকের রক্তপিন্ড হয়তো; অথচ সে জানলো। জানলো বাবা হবার আনন্দ; ভাগ করতে পারলো না সবার সাথে! তার আগেই সব শেষ… সব শেষ! সাবরিহা লম্বা শ্বাস টানলো। হাত দিয়ে রক্ত থামানোর প্রচেষ্টায় সাবরিহা ব্যর্থ, তরল লহু কি আর বন্ধ হয়?হাত থেকেই উপচে পড়ছে উষ্ণ লহুর নহর। চোখ-মুখ শক্ত হয়ে আসছে সাবরিহার সাথে দমবন্ধ হয়ে আসছে। চোখ তুলে সামনে তাকিয়ে কিছু বলার আগেই দরজা থেকে আরেকটা সুন্দর দেখতে মেয়ে ঢুকল। সাবরিহার চোখ আশার আলোয় চকচকে দেখলো। কাঁপা গলায় বলে—– “সিলিন আপা বাঁচা।”
সিলিন তেমন একটা প্রতিক্রিয়া না করে এগিয়ে এসে সাবরিহার সামনে দাঁড়িয়ে তাকে পরক্ষ করে। তারপর হুট করে একটা শক্ত থাপ্পড় দিয়ে বসে—– “তোকে বাঁচানো ইজ মাই ফুট…!”
থাপ্পড়ের বেগ সামলাতে না পেরে সাবরিহা মেঝেতে পড়ে গেল। সিলিনও হাটু ভাজ করে সাবরিহার দিকে তাকায়। তারপর মুখ তুলে সাবরিহাদের রুম দেখে উঠে এসে একটা ভারী ফুলদানি নিয়ে আবারো সাবরিহার সামনে বসে। সাবরিহার মাথায় যেন সব পরিষ্কার হয়ে এল; এতো বড় বিশ্বাসঘাতকতা? সিলিন তো তার বোন! চাচাতো বোন হলেও কি বোন নয়? কাঁপা গলায় বলে—– “আমি তোর বোন সিলিন আপা।”
সিলিন তাচ্ছিল্য করে হাসলো তারপর বলে—– “আগে ছিলি, এখন নাই!”
চমকায় সাবরিহা তা দেখে সিলিন আবারো হাসে তারপর বলে—– “তোর আগে আমি মুসাওয়াদকে দেখেছিলাম। আর সবকিছুর মতো তুই-ই জিতে গিয়ে, ওকে-ও সব কিছুর মতো কেড়ে নিলি আমার থেকে।”
সাবরিহার যেনো বিশ্বাস হচ্ছে না। কই সিলিন তো তাকে কিছু বলেনি তাহলে এখন এতো নিকৃষ্টদের মতো আচারণ করছে? সাবরিহার যেন বিশ্বাস হচ্ছে না। তবুও কোনো মতে দম টেনে বলে—– “এ-এখানে আ-আমার দো-ষ ক-কি সিলিন আপা!”
সিলিন দীর্ঘশ্বাস ফেলে এগিয়ে এসে সাবরিহার চুল খাঁমছে ধরলো৷ সাবরিহার চোখ থেকে পানি পড়ছে সিলিন দেখলো৷ মায়া হলো না তবে এক মুহুর্তের জন্য কিভাবে আগলে রেখে সাবরিহাকে সিলিন দেখে রেখেছে তা মনে পড়ল। ধীরে মনে পড়ল, সাবরিহা যখন মুসাওয়াদকে দেখেছে তখন সিলিন এইচএসসি পরীক্ষার্থী। সে সেদিন বারান্দায় দাঁড়িয়েছিলো তার পিছনে সাবরিহা এসে দাড়িয়েছিলো। সেদিন সাবরিহার এসএসসি পরীক্ষার জন্য শেষ ক্লাস ছিলো। তাহলে তো সেই আগে মুসাওয়াদকে দেখেছে! কিন্তু শেষে কিনা পেলো সাবরিহা? সে এতো দিন দেশে ছিলো না। সাবরিহার বিয়ের ব্যপারে কেউ জানায় নি। এসেই এসব শুনে যেন প্রতিহিংসায় জা-নোয়ারে পরিনত হয়েছিলো সিলিন। মুহূর্তেই নিজের চোয়াল শক্ত করে দাতে দাত পিষে সাবরিহার মাথা ধরে পাশের দেয়ালে পরপর দুইবার ঠুকে দিয়ে আঘাত করলো। সাবরিহার যেনো দুনিয়া দুলে উঠলো৷ সিলিন চিবিয়ে চিবিয়ে বলে—– “আফসোস তুই আমার বোনই না হতি৷ তাহলে হয়তো—হয়তো তোকে আমার নিজের হাতে মারতে হতো না, আর মুসাওয়াদও আমার হতো।”
মাথা থেতলে সেখান থেকে রক্ত গড়িয়ে পড়লো। চোখের সামনে অন্ধকার নামছে সাবরিহার। সিলিন নিজের রাগ নিয়ন্ত্রণ না করতে পেরে আগে থেকে এনে রাখা ফুলদানিটাও সাবরিহার মাথায় আঘাত প্রাপ্ত একই স্থানে আঘাত করতেই তা ভেঙ্গে গেলো সাথে সাবরিহার চোখেও নেমে এলো নিকষকালো অমানিশা।
সিলিন সাবরিহাকে দেখে তাকে ছেড়ে দিলো। মেঝেতে মাথাটা শব্দ করে পড়ে গেলো। সারা মেঝে তিনজনের রক্তে ভেসে যাচ্ছে। সিলিন উঠে দাঁড়ালো। তারপর মিজানের দিকে তাকিয়ে বলে—– “আমাদের যা ডিল হয়েছিলো। তা হয়ে গেছে। আমি গেলাম।”
মিজান সাহেব হাসলো তারপর বলে—– “আরেকটা বিচ্ছু আছে সেটা কোথায়?”
সিলিন চোখ ছোট করে জিজ্ঞেস করে—– “কার কথা বলছেন?”
“তোমার চাচীর লগে যে ঢুকলো!”
“সুবাইতা?”
“মনে হয়!”
সিলিন শীতল চোখে তাকিয়ে বলে—– “মেরে দেন নাহলে বড় হয়ে মা আর বোনের মতো কালসাপ হবে…আর এই এতিম পালবে কে! পেলে বড় করবো আর যেই থালে খাবে ওই থালই ফুটো করবে এর থেকে না থাকাই ভালো।”
কথাটা বলতেই সাথের একজন লোক এগিয়ে এসে সাবরিহার রুম দেখলো খালি দেখে আমেনা বেগমের রুম চেক করলো তারপর সুবাইতাকে ঘুমন্ত অবস্থায় পেয়ে হৃৎপিণ্ড বরাবর গুলি করে বেড়িয়ে এলো। তারপর বলে—– “বস কাম শেষ!”
সিলিন সবাইকে পরক্ষ করে বলে—– “বাসার সব জানলা দরজা বন্ধ করে সব কারেন্টর সুইচ অন করে দেন। ফ্যান, লাইট জ্বালিয়ে দিন, ফ্রিজ খুলে দিন, মাইকোওভেন ও অন করে, হিট বাড়িয়ে, রুম গুলোর হিটার ও এসি অন করে দিয়ে রান্না ঘরে চুলোর গ্যাস অন করে দিন। আর সিলিন্ডারও লিক করে দিন।”
মিজান সাহেব সিলিনকে দেখে বলে—– “এতো কেনো? কি করতে চাইছো?”
সিলিন হাসি মুখে বলে—– “তেমন কিছু না। লেফটেন্যান্ট কমান্ডার মুসাওয়াদ কায়ানের পরিবার অগ্নিকাণ্ড দূর্ঘটনায় মারা গেছে… এমন একটা হেডলাইন দেখতে চাইছি! যাতে সাপও মরে লাঠিও না ভাঙ্গে!”
সিলিনের যা হবে না। তা কারোর হবে না। সিলিন হতে দেবেনা। কখনোই না। মিজান সাহেবের মুখে বিশ্বজয়ী শয়তানি হাসি ফুটলো। তারপর দুইজনের দিকে তাকাতেই তারা চলে গেলো। সব কাজ করে এসে সবাই এপার্টমেন্ট থেকে বেড়িয়ে দরজা বন্ধ করে দেয়। তারপর নিজেদের মতো কথা বলতে বলতে স্বাভাবিক ভাবে লিফটে ওঠে যেনো এতো সময় কিছুই হয় নি।
*
লিফট নামতেই সবাই আলাদা হয়ে বিভিন্ন দিকে চলে যায়। সিলিন যায় পার্কিংলটের দিকে; সাথে সাথেই মুসাওয়াদও সিলিনকে পাশ কাটিয়ে লিফটের দিকে চলে গেলো। মুসাওয়াদ সিলিনকে খেয়াল করেনি। সিলিন মুসাওয়াদকে দেখে থমকে ফিরে তাকায়। তারপর হেসে আবারো শিষ বাজাতে বাজাতে নিজের চকচকে মার্সিডিজ গাড়িতে উঠে বসে। মুসাওয়াদ বিল্ডিংয়ের ভেতরে ঢুকতেই মুখে হাসি ফুটিয়ে গাড়ি স্টার্ট দেয় সিলিন তারপর বিরবির করে বলে—– “নতুন জীবনের জন্য শুভ কামনা মি. কায়ান…”
————
লিফট থেকে বেড়িয়ে বাসার দরজায় কলিংবেল বাজায়। তবে কোনো সাড়াশব্দ না পেয়ে দরজার মবে হাত রাখতেই তা আলতো ভাবে খুলে যায়। ঢোক গিলল মুসাওয়াদ। মনের মধ্যে কি একটা উচাটন করে উঠলো। ধীরে ধাক্কা দিয়ে দরজা খুলতেই পায়ের কাছে রক্তের ঢল দেখে থমকে সামনে থাকায়। দম আটকে এল মুসাওয়াদের। শরীর ভেঙ্গে এল তবুও টেনে এগিয়ে এসে মায়ের পাশে হাঁটু গেড়ে বসে। তারপর ডাকে—– “আম্মা? এই মা? কি হয়েছে? কথা বলছেন না কেনো?”
কোনো সারাশব্দ ফেরত এলো না। মুসাওয়াদ ঢোক গিলল তারপর নিজের আঙ্গুল রেখে শ্বাস-প্রশ্বাস দেখে। তবে তার থেকে কোনো প্রতিক্রিয়া না দেখে তার আর বুঝতে বাকি নেই। পুরো শরীর ছেড়ে মেঝেতেই বসে পড়ে চোখ পড়ে নিজের রুমের সামনে আমেনা বেগমের দিকে। নিজের শরীর টেনে উঠতেই নাকে কেমন এক উৎকট গন্ধ এলো। ঢোক গিলল তার আর বুঝতে বাকি নেই। দৌড়ে এসে আমেনা বেগমকে টেনে গলার রগ দেখে, না কোনো রেসস্পন্স নেই। ঢোল গিলে নিজের রুমের দিকে তাকায়। দরজায় রক্ত দেখে শরীরে একটা শিরশির শতীল কিছু মেরুদণ্ড বেয়ে নেমে গেলো। নিজেকে শক্ত করে ঘরের দিকে পা বাড়িয়ে এসে সাবরিহাকে পড়ে থাকতে দেখে যেনো সবটা ভেঙ্গে এলো। ধপ করে বসে পড়লো মুসাওয়াদ। তারপর হুট করেই চেঁচিয়ে চিৎকার করে উঠলো—– “ওওও সাবরিহা… আপনিও কি আমার সাথে কথা বলবেন না… আম্মা…”
থেমে যেয়ে আবারো সাবরিহাকে টেনে নিজের সাথে মিশিয়ে নেয়, এতোটা সব গুমট হয়ে থাকলেও এবার গলা ছেড়ে চিৎকার করে কান্না করতে করতে বিলাপ করে মুসাওয়াদ —– “এই সাবরিহা এই? তাকান! এই র°ক্ত কিসের? কে এসেছিলো? কথা বলুন। আম্মা কথা বলছে না। আপনিও কথা বলবেন না? বলুন আমায়…”
কথা বলে কাঁদতে কাঁদতে পাগলের মতো চুমু খায় মুসাওয়াদ। পাগল লাগছে মুসাওয়াদের। শেষে যখন গলায় হাত রাখে। মস্তিষ্ক টনক নারে মুসাওয়াদের। দ্রুত নিজেকে থামিয়ে সাবরিহার হাতের পাল্স চেক করে, ঢোক গিলে আবারো গলায় দেখে নাকে হাত রেখে আবারো নিজেকে অবিশ্বাস করে সাবরিহার হৃৎপিণ্ডের উপর হাত রাখে মস্তিষ্ক টনক নাড়ে। সাবরিহার শ্বাস চলছে, তাকে দ্রুত হসপিটালে নিতে হবে। উঠে দাঁড়িয়ে কি একটা ভেবে রুমের দিকে তাকায়। মস্তিষ্কের স্নায়ুকোষে ভাবনা এলো সুবাইতার কথা। নিজের রুমে নেই তাহলে? দৌড়ে মায়ের রুমে এলো সেখানেও রক্তের ঢল বইছে। তার বুঝতে বাকি নেই। বিরবির করে গালি দিলো কিছু। তারপর এগিয়ে এসে সুবাইতাকে ধরে। কিন্তু তার শরীর একদম শীতল হয়ে আছে তাই ঢোক গিলে, উল্টো পায়ে রুম থেকে বেড়িয়ে দ্রুত সাবরিহাকে কোলে তুলে দৌড়ে রুম থেকে বেড়িয়ে যায়। লিফটে উঠে, গ্রাউন্ড ফ্লোরের বোতাম টিপে দেয়, সময় লাগেনি। মিনিট তিনের মাথায় নিচে এসে থামে। মুসাওয়াদ পিছনের দিকে থাকা নিজপর পুরণো গাড়িতে সাবরিহাকে তুলে নেয়। তারপর নিজেও সেই কালো গাড়িতে উঠে গাড়ি স্টার্ট দিয়ে পিছনের গেট থেকে বেড়িয়ে যায়। মুসাওয়াদ যখন সোসাইটির মেইন গেট পার হয় ঠিক তখনিই অগ্নিসংযোগ ব্লাস্ট হয় — “সি-২১তম বিল্ডিং এর ৮ তলার ইউনিট বি” তে। মুহুর্তেই দাউদাউ করে জ্বলে উঠে সেই এপার্টমেন্টস। মুসাওয়াদ গাড়ি ড্রাইভ করতে করতে আয়নায় তা দেখে চোখ মুছে ঠোঁট কামড়ে নিজেকে নিযন্ত্রণ করতে চাইছে৷ পাড়ছে না। চোখেরজলে ঝাপসা দেখছে। কে যেনো বলেছিলো পুরুষ কাঁদে না। এই যে মুসাওয়াদ এতো বড় শক্তপোক্ত পুরুষ হয়েও এখন পাগলের মতো কাঁদছে। গাড়ি ড্রাইভ করে নিজের পরিচিত এক নম্বর ঘেটে কাউকে কল দিলো। বিপরীত থেকে কল রিসিভ হয়। মুসাওয়াদ তড়িঘড়ি করে বলে—– “ ডক্টর. সাইফান, আমার কিছু ইমার্জেন্সি চিকিৎসা লাগতো।”
সাইফান বিপরীত থেকে শ্বাস ফেলে বলে—– “ টেনসড লাগছে আপনাকে, কিন্তু দুঃখিত আমি হসপিটালে ও এড়িয়াতে নেই লেফটেন্যান্ট। তবে ডক্টর নুজহাত হৃদিতা হসপিটালে আছে। আমি তাকে আপনার কথা বলে দিচ্ছি। যা লাগে তাকে বললেই হয়ে যাবে।”
মুসাওয়াদ নিজেকে শান্ত রেখে বলে—– “সিকিউরড তো?”
সাইফান ধীরে আস্বস্ত করে বলে—– “১০০% শিউর। কিন্তু আপনার কি কিছু হয়েছে? কণ্ঠ কেমন যেনো লাগছে…”
মুসাওয়াদ শ্বাস ফেলে সাবরিহাকে দেখে আবারো ফোনে বলে—– “সিরিয়াস কিছু৷ দেখা হলে বলবো। আপতত সিকিওর দিন।”
“ডান; আপনি যান। আমি ঠিকানা টেক্সট দিচ্ছি।”
কলটা বিচ্ছিন্ন হতেই মেসেজ আসার বিপবিপ টোন হয়। ঠিকানা দেখেই গাড়ির স্পিড ৮০/১৬০ এ উঠে আসে। দশ মিনিটের মধ্যেই তারা হসপিটালের সামনেই যায়। সেখানে আগে থেকে যেনো সব ব্যবস্থা করা ছিলো। নুজহাত ওয়ার্ডবয়দের বলতেই স্ট্রেচারে সাবরিহাকে তুলে নেয়। তারপর অপারেশন থিয়েটার। নুজহাত এচোখা চোখে একবার মুসাওয়াদকে দেখে নিজেও অপারেশন থিয়েটারের ভেতরে চলে যায়। এর আগে এতো অসহায় মুসাওয়াদের কখনোই মনে হয় নি৷ আজকে কি হয়েছে মুসাওয়াদের মাথায় আসছে না তবে তার দেখা সকালের সেই হাসিখুশি পরিবার আর নেই। মেডিকেলের ওয়েটিং চেয়ারে মাথা নিচু করে বসে রইলো সাথে কানে এলো টিভিতে নিউজ প্রেজেন্ট করা ব্রেকিং নিউজ —— “ব্রেকিং নিউজ, বাংলাদেশ নেভী অফিসার এর চট্রগ্রাম ক্যাম্পের নৌবাহিনীর কর্মরত সেনাসদস্য – লেফটেন্যান্ট কমান্ডার মুসাওয়াদ কায়ানসহ তার পুরো পরিবার অগ্নিকাণ্ডের নিহত হয়েছে। ইন্না-লিল্লাহি ওয়াইনাইহি রজিউন!”
চমকে টিভির দিকে তাকিয়ে আছে মুসাওয়াদ। টিভিতে বারবার অগ্নিদগ্ধ তাদের এপার্টমেন্টস সহ তার ছবি ও তার মায়ের ছবি ভেসে উঠছে। অনেকেই জানে না মুসাওয়াদ বিবাহিত কিনা তাই সেভাবে কারো ছবি দেখানো হচ্ছে না। মুসাওয়াদের আর বুঝতে বাকি নেই ঠিক কি হয়েছে। কতটা প্রি-প্লেন্টেড এই হত্যা-কান্ড। শ্বাস ফেলে উঠে ওয়াশরুমে যেয়ে মুখে পানি দেয়। এখন যেমন খবর আসুক তাকে শক্ত থাকতে হবে। যে এই কাজটা করেছে সে খুব সুক্ষ্মভাবে সব কিছুর ওপর নজর রেখে করেছে। মুখে পানি দিতে দিতে সব হিসাব কষে দ্রুত পকেট থেকে ফোন বের করে নিজের ফোনের সীম ভেঙে ডাস্টবিনে ফেলে দেয়। তারপর বুক ভরে শ্বাস টেনে ওয়াশরুম থেকে বেড়িয়ে আসার সময় টিস্যু দিয়ে মুখ পেঁচিয়ে কাউন্টার থেকে মাস্ক নিয়ে মুখে পড়ে আবারো নিজের সিটে বসে মাথা ঝুঁকিয়ে বসে থাকে। সময় কতটা গড়ায় মুসাওয়াদ জানে না। তবে তার জীবনের কঠিন সময়ের মতোই ধৈর্য ধরাটাও যেনো তার কাছে কঠিন ঠেকলো। তবুও একই ভঙ্গিতে বসে রইলো। কানে বারবার নিজের মৃত্যুর কথা শুনছে। আর ততবার শরীরের শিরা উপশিরা ও উষ্ণ লহু গুলো ছলকে, টগবগ করে ফুটে উঠছে। দীর্ঘ-তিন ঘন্টা অপারেশন থিয়েটার থেকে বেড়িয়ে আসে ডক্টর. নুজহাত হৃদিতা। নিজের সামনে কোনো নারী অবয়ব দাঁড়াতে দেখে মুখ তুলে তাকাতেই নুজহাতের মুখ ফুটে উঠলো। নুজহাত মুসাওয়াদকে দেখলো। সাইফান শুধু বলেছে এমার্জেন্সি কোনো প্রেসেন্ট আসবে তবে এভাবে… ঢোক গিলে প্রস্তুতি নিয়ে শক্ত গলায় বলে—– “ মিস্টার…
তবে কথা সম্পূর্ণ করার আগেই আবারো টিভির ব্রেকিং নিউজ শুনে নুজহাত অবাক চোখে টিভির দিকে তাকায়। একই হেড লাইন দিয়ে বারবার করে একই খবর প্রচার হচ্ছে সাথে এতোটুকুই যুক্ত হয়েছে যে আগুন নিয়ন্ত্রণে এনেছে ফায়ার-সার্ভিস। নুজহাত একবার মুসাওয়াদের দিকে তাকায়। মুসাওয়াদ একটা বারের জন্যও উপরে তাকাচ্ছে না। নুজহাতের খানিকটা খটকা লাগল কিছু একটা তো হয়েছে। তবুও মানুষের ব্যক্তিগত বিষয নিয়ে না ভাবাটাই ভালো। তাই ভাবে মুসাওয়াদকে তার অপেক্ষাকৃত খবরটি জানিয়ে দেবে। তাই কেশে গলা পরিষ্কার করে বলে—– “মিস্টার. কায়ান~ উই আর সরি, আপনার ওয়াইফ –”
কথা সম্পূর্ণ শেষ না হতেই চকিতে মুসাওয়াদ উঠে দাঁড়িয়ে পাগলাটে গলায় জিজ্ঞেস করে—– “সাবরিহা? সাবরিহা ঠিক আছে?”
ঢোক গিললো নুজহাত তারপর বলে—– “রিলাক্স। শী ইজ এলাইভ…”
কথাটা শুনে স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলতেই পরের কথায় যেনো কলিজা ছেড়া বেদনাদৃত ছিলো। নুজহাত শীতল গলায় ফের বলে—– “মিসেস কায়ান থ্রি মান্স’স প্রেগন্যান্ট আই মিন থার্টিন উইক্স। আর~”
ধপ করে চেয়ারে বসে নিজের মাথার চুল খাঁচছে ধরে মুসাওয়াদ হিসাব মিলালো। ইট’স মিন ফার্স্ট…! কই সাবরিহা তো তাকে বলেনি? নাকি সাবরিহা জানতো না? দমবন্ধ হয়ে আসলো। কলিজা ছিঁড়ে মনে হচ্ছে পেটের সব পেচিয়ে তাকে কেউ গলা টিপে ধরলো। চোখ থেকে আপনাআপনি পানি পড়তে রইলো। অথচ সে মাথা নিচু হয়ে নীরব হয়ে বসে আছে! নুজহাতের কেনো যেনো মায়া হলো। একদিকে খবরের এমন নিউজ আরেকদিকে বাচ্চা হারানো।আরেকটা নিউজ? আরেকটা নিউজ কি করে নেবে সে? ঢোক গিলে আবারো মুসাওয়াদকে উদ্দেশ্য করে বলে—– “মিস্টার কায়ান?”
মাথা তুলে অস্পষ্ট ভাবে জবাব করে—– “হু?”
মুসাওয়াদের চোখ মুখের অবস্থা খুব একটা স্বাভাবিক লাগছে না। তবে না লাগারই কথা। এতোটা এক সাথে সহ্য করা অথবা হযম করা যেনো খুবই কঠিন ব্যাপার! তবুও নির্জীব গলায় বলে—– “মিসেস কায়ান; হ্যাড এ্য ডিপ হিট অন হার হেড এন্ড সে ওয়েন্ট টু এ্য কোমা ফর আনলাকি টাইম। উই কান্ট সে এক্সজেক্টলি হোয়েন হার নলেজ উইল রিটার্ন।”
আর কোনো দুঃসংবাদ বাদ আছে? একদিন আর কত সহ্য করবে? সে তো আর পারছে না। চিৎকার করে কান্না পাচ্ছে। ঢোক গিলে নিজেকে সামলে নিয়ে আবারো চেয়ারে বসে শরীর ছেড়ে দিলো। নুজহাত এখনো বোকার মতো তাকিয়ে আছে৷ এই প্রথম বোধহয় সে এমন মানুষ দেখছে। এর মধ্যে ওয়ার্ড থেকে এক মেয়ে এসে নুজহাতকে নিজের ফোন দিয়ে যায় আর বলে —– “সাইফান স্যার কল দিয়েছে।”
নুজহাত মাথা নাড়িয়ে ফোন তুলে কানি দিতেই বিপরীতে থেকে সাইফান গম্ভীর গলায় বলে—– “আপডেট কি নুজহাত?”
“আমি একটু পর জানাচ্ছি স্যার!”
“আচ্ছা। আর খবর দেখেছো? এসব কি কায়ান তো…”
“স্যার…”
“হ্যাঁ, রহস্য তো আছে। তবে আশা রাখবো আপনি উনাদের সাহায্য করুন। নাম্বার বন্ধ বলছে উনাকে ফোনটা দিন!”
“জ্বি স্যার!” —–কথাটা বলেই নিজের থেকে ফোনটা এগিয়ে এলো নুজহাত তারপর বলে—- “ডক্টর সাইফান ইয়াজিদ আপনার সাথে কথা বলতে চায়…!”
নির্জীব চোখে তাকিয়ে ফোনটা নিয়ে কানে ধরে হ্যালো বলতেই সাইফান গড়গড় করে বলে—– “টিভিতে কি সব সংবাদ দেখাচ্ছে। আপনি তো… তাহলো মৃত্যু?”
“সারা বাংলাদেশের কাছে আমরা মরে গেছি। এই ব্যপারে না হয় পড়ে বলবো? আপতত আমার বউ এবং আমার একটা থাকার ব্যাবস্থা করতে পারবেন? আর্জেন্ট…!”
সাইফান কিছু একটা ভাবলো। তারপর বলে—– “ তা নাহয় করা যাবে, ফোন কোথায় আপনার, নম্বর বন্ধ কেনে?”
“ সীম ভেঙে ফেলেছি।ট্রাক করার সম্ভবনা ১০০%, তাই সব বন্ধ করা। যদিও পাবলিকটা অনেক আগেই বাসায় ফেলে এসেছিলাম। আপনাকে প্রাইভেট নম্বর থেকে কল দিয়েছিলাম। তবুও রিস্ক নিতে চাইনি তাই ভেঙ্গে ফেলে দিয়েছি।”
সাইফান হাসলো তারপর বলে—– “ব্যাপার না। বেনি একটু অপেক্ষা করুন। আমি নুজহাতের সাথে আলোচনা করে আপনায় সব জানাচ্ছি। উনাকে দিন!”
ফোন এগিয়ে দিলো মুসাওয়াদ। নুজহাত ধীরে ফোন হাতে নিয়ে নিজের কেবিনে যাওয়ার আগে মুসাওয়াদকে উদ্দেশ্য করে বলে—– “টেনশন করবেন না৷ তাকে চব্বিশ ঘণ্টা পর্যবেক্ষণ করেই কেবিনে হস্তান্তর করা হবে; তখন দেখা করতে পারবেন।”
মুসাওয়াদ জবাব না দিয়ে অপারেশন থিয়েটারের দিকে নির্জীব দৃষ্টি নিয়ে তাকিয়ে রইলো। তার সব কিছু এখন ওই একটা রুমে… বাকি সব থেমে গেছে, নিঃশেষ হয়ে গেছে, তার কিছুই আর অবশিষ্ট নেই।
—-
মাঝে থেকে কেটে গেছে দুটি-বছর। সাবরিহার মাঝে কোনো পরিবর্তন হয় নি। সে সব শুনতেমপারে তবে তার শরীরে কোনো নড়চড় পরিলক্ষিত হয় নি। মাঝে মাঝে মুসাওয়াদ সাবরিহার পাশে বসে এটা সেটা নিয়ে কথা বলে, গল্প করে মাথায় হাত বুলিয়ে দেয় তখন মেয়েটার চোখের কোল ছুঁয়ে জল গড়িয়ে পড়ে। মুসাওয়াদ দেখে তবে কি করবে? সাবরিহা সবই অনুভব করতে পারে শুধু সে জাগতিক ভাবে সুস্থ নয়। নুজহাত গাইনি ডক্টর বিধায় মুসাওয়াদের তেমন সমস্যা পোহাতে হয় নি। আর সাইফান নিজেও এসে মাঝে মাঝে সাবরিহার চেক আপ করে যায়। এই বাড়িটা সাইফান দিয়েছে। শহরের কোলাহল থেকে অপরিচিত জায়গা যেখানে মুসাওয়াদ বা সাবরিহাকে কেউ চিনবে না। এটি খাগড়াছড়ি জেলার দীঘিনালাতে উপস্থিত। দীঘিনালা বাংলাদেশের খাগড়াছড়ি জেলার অন্তর্গত একটি উপজেলা। আয়তনে এটি খাগড়াছড়ি জেলার সবচেয়ে বড় উপজেলা। দর্শনীয় স্থান এর মধ্য আছে — তকবাক হাকর, তুষার ফ্রুটস ভ্যালি, তৈদুছড়া ঝর্ণা, তৈছামা ঝর্ণা, দিঘীনালা বনবিহার। চোখ ধাঁধানো সৌন্দর্যের প্রতীক যেনো দীঘিনালা।
ভোরের দিকে মুসাওয়াদ সাবরিহার পাশেই ঘুমিয়েছিল। সাবরিহার ঘুম ভাঙ্গল, ধীরে ধীরে চোখে মেলে তাকাল। তারপর আবারো ধপ করে চোখের ঝাপটা নামিয়ে আবারো তিরতির পল্লব মেলে চাইল। সারারুমে চোখ বিলিয়ে যেনো ধীরে ধীরে শাক্তি পাচ্ছে এমন মনে হয়ে পায়ের পাতা ও আঙ্গুল নাড়াতেই তা অনায়াসে নড়ল। সাবরিহার যেন বিশ্বাস হচ্ছে না। ধীরে হাতের আঙ্গুল গুলোও নাড়াল, তাও নড়তেই বিস্মিত মুখে মুসাওয়াদকে ডাকলো—– “মুসাওয়াদ? এই যে শুনছেন?”
মুসাওয়াদ নড়েচড়ে বলে—– “উমম!”
কথাটা বলতেই মস্তিষ্ক টনক নড়ে। ধপ করে চোখ মেলে সাবরিহার দিকে তাকিয়ে অবাক ও বিস্ময় নিয়ে কথাই বন্ধ হয়ে এল। তবুও এলোমেলো করে বলে—– “আ-পনি? এটা কি সত্যি?”
“ হ্যাঁ, সত্যি।”
মুহুর্তেই সাবরিহাকে জড়িয়ে ধরে চুমুতে চুমুতে ভরিয়ে ফেলে মুসাওয়াদ। সাবরিহাও চুপ করে সব হযম নেয়। সময় অনেকটা কাটে। মুসাওয়াদ সাবরিহাকে জড়িয়ে ধরেই সাইফান ও নুজহাতকে সব জানাতেই ওরে জানায়—– “ নিজেদের মধ্যে ভালো সময় কাটান। আর উনার দিকে খেয়াল রাখুন।”
“ জ্বি; এবার আর কোনো ভুল হবে না!”
তারপর কল রেখে এতোদিনের সব আলোচনা করতে ব্যস্ত হয় দুজন৷ মুসাওয়াদ অবশ্য বোকা হয়েছে তাই সাবরিহাকে ক্ষানিক বাদে বাদে এসে জড়িয়ে ধরছে আর কান্না করে বলছে —– “ আপনি না থাকলে হয়তো সেদিন… আমিও…” ঠোঁটের আগায় আঙ্গুল রেখে প্রতিবারই থামিয়ে দেয় সাবরিহা তারপর আশ্রয় নেয় মুসাওয়াদের পুরুষালি বক্ষে। মুসাওয়াদও খুব আদুরে ভঙ্গিতে তাকে নিজের সাথে জড়িয়ে নিয়ে নেয়। সাবরিহা চুপটি করে আছে, মুসাওয়াদ ধীরে স্বরে ডাকে—– “ সাব…রিহা?”
“হুম?”
“সেদিন ঠিক কি হয়েছিলো বলতে পারবেন?”
কেঁপে উঠল মেয়েটা। তা বুঝতে পেরে হাতের বাঁধন শক্ত করে মুসাওয়াদ তারপর বলে—– “ভয় পাবেন না। আমি আছি!”
সাবরিহা ঢোক গিলল তারপর সব বলতে শুরু করল। মাথার মধ্যে কিছু একটা ধপধপ করছে। তা নিযন্ত্রণে আনে। সাবরিহা সব বলে আবারো বলে—– “আমাদের বাবু…!”
মুসাওয়াদ সাবরিহাকে থামিয়ে দিয়ো তার মাথায় হাত বুলাতে বুলাতে বলল—– “আম্মু, আপনার আম্মু আর সুবাইতার কাছে সে ভালো আছে!”
মুহুর্তেই সারা শরীর ঝনঝন করে কেঁপে উঠল। মুসাওয়াদ টের পেলো তারপর ধীরে মাথায় হাত বুলাতে বুলাতে বলল—– “আমার একটু গ্রামের বাজারে যেতে হবে সাবরিহা, আমায় একটু ছাড়বেন?”
সাবরিহা ঝাপ্টে খামচপ ধরে বলে—– “না, ওরা তাহলে আবার আসবে…!”
“কেউ আসবে না! আমি চলে আসবো!”
“সত্যি?”
“হু!”
———–
মুসাওয়াদের এই সব কারনে নিয়ে তার কারণও জানতে ইচ্ছে হচ্ছে না, কেনো তার পরিবারকে কেউ মারলো। তবে প্রতিশোধ তো সে নেবেই। সে আধাঘন্টার জন্য উপজেলার বাহিরে এসেছে, এখন একটা বড় বাড়ির সামনে দাড়ায়ি আছে। পাহাড়ি বাড়ি; একটা ম্যাচের কাঠি পড়লেই ছাই হয়ে যাবে। সেখানে যদি একটা আত বড় গ্যাস লাইট মারা হয় কেমন হবে? কথাটা ভেবেই নিজের কালো হুডি থেকে গ্যাস-লাইটটা বের করে আগুন জালিয়ে তা ওই বাড়ির দিকে ছুড়ে মারে। গ্যাস লাইটটা জায়গা মতো পড়তেই তা দাউ দাউ করে জ্বলে উঠে। ওই আগুনে মুসাওয়াদ কায়ান এর পুরো পরিবার পুরে ছাই হয়েছে, এই আগুনে মুসাওয়াদ কায়ান এর প্রতিশোধ পরিপূর্ণ করে সব ছাই হচ্ছে। ভেবেই দীর্ঘশ্বাস ফেলে বাসার দিকে রওনা হতেই চোখে পড়ে এক দূর্ঘটনা। গাড়িটা দুমড়ে মুচড়ে পঠে আছে। প্রথমে তা আমলে না নিলেও বাসায় এসে টিভিতে খবরে জানা যায়, চট্টগ্রাম বিভাগের নাম করা জলদস্যুর মিজান মোল্ল্যা নিজের ব্যবসা সমেত তার সহযোগী সবাই আগুনে দগ্ধ হয়ে মারা গেছে। এমনকি লাশটাও পায়নি। পর পর ভেসে উঠলো, সিলিন নামে এক তরুনি আজ হাইওয়ে রোডে খুব বাজে ভাবে নিহত হয়েছে৷ গাড়ি দুমড়েমুচড়ে গেছে সাথে তার শরীরও খন্ড খন্ড হয়ে গেছে। খবর দেখে দীর্ঘশ্বাস ফেলল মুসাওয়াদ। সে শুধু মিজানকে সায়েস্তা করেছে সিলিনের ব্যাপারটা সে পড়ে ভেবে দেখবে তবে তার আগেই তার শাস্তি সে পেয়ে গেছে। পাপ বাপ কেও ছাড়ে না!
সাবরিহা এসে মুসাওয়াদের পাশে দাঁড়ালো। মুসাওয়াদ আকাশ থেকে সাবরিহার পানে তাকায়। সাবরিহা সুস্থ হয়েছে আজ প্রায় পাঁচ থেকে ছদিনের বেশি। মুসাওয়াদ সাবরিহার মুখটা দেখে ধীরে বলে—– “লিটল ওয়েভ?”
“হু?”
“লেটস ডু সামথিং নিউ?”
সাবরিহা বুঝতে না পেরে বলে—– “বুঝলাম না?”
মুসাওয়াদ সাবরিহাকে কোলে তুলে রুমের দিকে নিয়ে যেতে যেতে বলে—– “কথা ছিলো মিশন থেকে এলে আমরা দুই থেকে তিন হবে; কিন্তু এখন আমি চার হতে চাচ্ছি। তাই ভাবলাম বয়স হচ্ছে প্রসেসিং অন করে ফেলি।”
সাবরিহা প্রথমে বুঝতে না পেরে হাবার মতো তাকিয়ে থেকে কথার অর্থ বুঝতেই বলে—– “ছি, অসভ্য!”
“ সভ্য হলে আর এই চৌত্রিশ বছর বয়স পার করেও জুনিয়র থেকে পাপা ডাক শুনতে পারবো না মিসেস মুসাওয়াদ কায়ান; দোহাই লাগে, এই অসহায় বান্দার ওপর একটু রহম করুন!”
———
“সমাপ্ত!”
[ নোট নাই; দোয়া রাখবেন। রিচেক দেইনি। আল্লাহ হাফেজ ❤️]