তেইশতম বসন্ত
পরিসংখ্যা ১
লেখনীতে – Azyah(সূচনা)
-“অফিসার আমার ফোন!আমার ফোন পানিতে ভেসে যাচ্ছে!”
গলা ফাটিয়ে চিৎকার তোলে খুশবু।সাদা পাথরের উত্তাল জলরাশিতে তার হৃদয়ের একাংশকে ডুবতে দেখে বিরাট কান্ড ঘটিয়েছে।যাহাকে ভয়ানক বললেও ভুল হবে।বড় ভাই ফাহাদ,মামা জিতু আর মামী রূপার চক্ষু ছানাবড়া।নিজের ফোনকে বাঁচাতে আর্মি অফিসার এর বুকে ধাক্কা দিয়ে এগিয়ে যাচ্ছে মেয়েটি।ইচ্ছেকৃত ধাক্কা দেয়নি।ফোনের চিন্তায় এলোমেলো হাতের চলন গিয়ে ঠিক আর্মি অফিসারের বক্ষস্থলে আঘাত হানে। খুশবুর আচরণে তার পরিজন ছাড়াও উপস্থিত পাঁচজন অফিসার কিংকর্তব্যবিমূঢ়।এমন ঘটনা বুঝি তাদের জন্য এই প্রথম। ভিজিটিং টাইম শেষ হওয়ায় সব পর্যটকদের স্থান ত্যাগের নির্দেশ দিতে এসে নিজেদের ইজ্জত নড়বড়ে হয়ে যাবে কে জানতো?তবে নিজেদের সভ্য আচরণ বজায় রেখে অফিসারগণ কোনো প্রতিক্রিয়া দিলেন না। সুদূরে পানির মধ্যে হাত রেখে ফোন উদ্ধার করা মেয়ের দিকে সকলে আপাতদৃষ্টিতে চেয়ে।
খুশবু ফিরে এলো।আর্মি অফিসারদের উদ্দেশ্যে বললো,
– “সরি।আমি ইচ্ছে করে ধাক্কা দেইনি।আসলে কি বলেনতো আমার ফোনটা আমার ভীষণ প্রিয়।ত্রিশ হাজার টাকা দিয়ে কিনেছি। টাকাটা বড় নয় এই ফোন পাওয়ার জন্য আমার ৩ বছর অপেক্ষা করতে হয়েছে।…সরি অফিসার্স হ্যা?আপনাদের কাজে বাধা দিলাম কিছু মনে করবেন না।”
মহীয়সী নারী সে।যেখানে আর্মি,পুলিশ দেখলে মানুষ ভয় পায় সেখানে এই মেয়ে বন্ধুর মতন আচরণ করছে তাদের সাথে।আর্মি অফিসাররা একে অপরের দিকে চাওয়াচাওয়ি করে খুশবু ও তার সাথের তিনজনের উদ্দেশ্যে বললো,
– “স্পট খালি করার আদেশ দেওয়া হয়েছে।প্লিজ কো অপারেট”
ফোন হাতে পেয়েছে যেনো জীবনটাও ফিরে পেয়েছে। ভাগ্য ভালো ফোনটা ওয়াটার প্রটেকশন ব্যাগে ছিলো।নাহয় আজ এই প্রিয় ফোনের অন্তিম লগ্ন এসে দুয়ারে কড়া নাড়ছিলো।বোনের চরম সাহসিকতা দেখে চমকিত ফাহাদ।বললো,
– “মেয়ের সাহস কত বড় দেখেছেন?আর্মির গায়ে!লাইক সিরিয়াসলি আর্মির গায়ে ধাক্কা দিয়ে ও ফোন উদ্ধার করতে গিয়েছে?যদি তারা মাইন্ড করতো-রে খুশবু!তোকে মিসাইল বানিয়ে বর্ডারের ঐপার লঞ্চ করে দিতো”
খুশবু ফাহাদের কথায় বিরক্তবোধ করে।বলে,
– “হয়ে যেতাম লঞ্চ তারপরও আমার ফোনের কিছু হতে দিতাম না।”
সিলেটমুখী হয়েছে আজ তিনদিন।পরিবারসহ ‘শান্তি নগরীতে‘ পদার্পণ।ছুটি কাটাতে এসে এদিক ওদিক ঘুরাফেরা চলছে জম্পেশ।লোকমান চৌধুরী আর নায়লা বেগমের ঘোরাফেরার চেয়ে বেশি সিলেটে আত্মীয়দের সাথে আড্ডা দেওয়াকে বেশি ভালো বলে মনে করেন।দু ছেলে মেয়েকে ছেড়ে দিয়েছেন মামা মামীর সাথে।সিলেটি মামার সাথে মিলে পুরো সিলেট শহর চড়ে বেড়াবে।
খুশবু এর মন মেজাজ ভালো না।প্রটেকশন থাকার পরও ফোনে পানি ঢুকেছে।তাকে ফোন হাতে নিয়ে হাঁসফাঁস করতে দেখে তার নানী এসে বললেন,
– “এই বেটি ফোনটা চালের ড্রামে রাখ।পানি টেনে নিবে।”
খুশবু এই ‘বেটি’ ডাককে অপছন্দ করে।নানীর ফোকলা দাঁতের দিকে চেয়ে উত্তর দিল,
– “নিজে বুড়ি হয়েছো বলে আমাকে বেটি মহিলা বানাচ্ছ কেনো? অ্যাম ইয়াং!”
জরিনা বেগম কথার অর্থ না বুঝে প্রশ্ন করলেন,
– “ইয়াং কিতা রে?”
– “তুমি বুঝবে না বুড়ি।যাও আমার ফোন তোমার পুরানো চালের ড্রামে রেখে এসো”
হাসতে হাসতে চলে গেলেন জরিনা।পুরো বংশে নাতি নাতনী এরা দুজনই।তার সৌভাগ্য হয়নি মা হওয়ার।বোনের নাতি নাতনীকে নিয়েই তার যত আনন্দ।বোন চলে যাওয়ার পর বোনের ছেলেকে নিজের কাছে এনে রেখেছেন।নিজের সন্তানের মতন।বিয়ে দিয়েছেন।কিন্তু বেচারা আজ পর্যন্ত বাবা ডাক শুনতে পেলো না।আজ অনেক বছর পর সিলেট এলো ফাহাদ, খুশবু আর তার পরিবার।
________
-“তুমি আর আমাকে ভালোবাসো না সাহির?”
খুশবু এর এরূপ কথায় বিরক্তির ছাপ ফুটে উঠে সাহির এর মুখে।মেয়েটি অনেক নির্লজ্জ হয়ে উঠেছে।তার কথাবার্তা এখন আর সহ্য হয়না। তেতো হয়েছে সম্পর্ক।
– “আমার কথাবার্তায় বুঝো না?আমি তোমার প্রতি আর ইন্টারেস্টেড নয়” জবাবে বলে সাহির।
ক্রন্দনরত মুখে খুশবু বলে উঠে,
-“আমাদের সম্পর্কটাও কি টাইমপাস হয়ে উঠলো সাহির?আমি কিন্তু এমন চাইনি।সারাজীবন পাশে থাকতে চেয়েছি আমি তোমার।”
-“সারাজীবন ডাল ভাত মজা লাগেনা খুশবু।”
-“ আমরা কি আরো একটাবার সব ঠিক করার চেষ্টা করতে পারি?এসো নতুনভাবে দুজন দুজনকে ভালোবাসি।নতুন কোনো স্বভাবের প্রেমে পড়ি।”
চোখ বুজে বিরক্তির নিঃশ্বাস ফেলে। স্পিকারে রাখা ফোনটা হাতে তুললো।বললো,
-“চেষ্টা করবো খুশবু।আমাকে আমার ক্যারিয়ার গোছাতে হবে।তুমি যেহেতু বলছো তোমার কথার সম্মান দিয়ে সিদ্ধান্ত নিলাম তুমি শুধু সপ্তাহে একদিন কল করবে।সেটা শুক্রবার।আমাদের আলাপ সময়ের দৈর্ঘ্য হবে দশ মিনিট।যদি আমার এই শর্ত তোমার ভালো লাগে তাহলেই এই সম্পর্ক এগোবে।”
বুক ভরা আর্তনাদ নিয়ে খুশবু বললো,
-“মাত্র একদিন সাহির?”
গলা খাঁকারি দিয়ে সাহির বলে উঠে,
– “হ্যাঁ একদিন”
বয়সটা কুড়ির উপরে।বাইশ বছর চলছে।তারপরও মনটা কেমন যেনো ছেলে মানুষী করে ফেলে।হাত পা ছড়িয়ে বায়না করতে ইচ্ছে হয়।যা চাই সেটা পেতে ইচ্ছে হয়। খুশবুর ইচ্ছেগুলোও ঠিক এমনি। সাহিরকে চিৎকার করে বলতে ইচ্ছে হচ্ছে।তবে এই শর্ত মানতে রাজি হয় সে।তাকে চায় খুশবু প্রতি মুহূর্তে।প্রতি সেকেন্ডে। পারছে না!পারবে না।মনের বাচ্চামোটাকে মনের মধ্যেই চেপে রাখলো।বেহায়া মন অন্তত একদিনতো পেয়েছে?চলবে।দিব্যি চলবে তার।
চোখ মুখ ফুলে গেছে।লাল আভা ছড়িয়েছে কপোলে।সাদা চক্ষু অংশও রক্তিম।হৃদয় ক্ষত বিক্ষত।সেটা ফুটে উঠবে না চোখ মুখে?ফোন পাশে রেখে চোখে মুখে পানির ঝাপটা দিয়ে চলে গেলো ওয়াশরুমে। স্বাভাবিক হয়েই বাবা আর ভাইয়ের সামনে যেতে হবে। ধুরন্দর চোখ তাদের।একবার দেখেই বুঝে ফেলবে কেঁদেছে সে।
দরজা খুলতেই আত্মা কেঁপে উঠলো।বুকে হাত ভাজ করে দাড়িয়ে আছে আর কেউ নয় তারই আপন বড়ো ভাই ফাহাদ।চোখ মুখে গম্ভিরতার ছোঁয়া।কুচকানো কপাল ছেড়ে দিয়ে বললো,
“তোর চোখের পানি যে ঝরিয়েছে?তার বড্ড সাহস।”
ফাহাদের কথায় আতকে উঠে খুশবু।হাত বুলিয়ে নিজের কান্নায় ভার হওয়া মুখকে ঠিক করার চেষ্টা।ইত:পূর্বে ফাহাদ ঘরে এসে উপস্থিত।বিছানায় পা তুলে বসেছে আয়েশে।আঙ্গুল উচু করে ডাকলো খুশবুকে।ভাইয়ের ডাকে কয়েক সেকেন্ডের ব্যবধানে এসে সামনে বসলো।নত মাথায়।
ফাহাদ বললো,
“ছেলেটা ভালো না খুশবু।”
ফ্যালফ্যাল নয়নে চাইলো খুশবু।তার ভাই কি জানে সাহিরের ব্যাপারে?নাকি আন্দাজে ঢিল ছুঁড়ছে?
“কোন ছেলের কথা বলছো ভাইয়া?”
“সাহির!তোর প্রেমিক।…নাহ।সে তোর প্রেমিক না।হতেই পারে না।যে পুরুষ দিনের পর দিন কোনো নারীকে কাঁদায় সে পুরুষ কারো প্রেমিক হতে পারে না।”
“এক সময়তো ভালোবাসতো ভাইয়া? হঠাৎ কি যেনো হলো!”
ভরসার জায়গা তার ভাই।বাবা- মাকে খুব ভালোবাসলেও ভয়টাও আছে প্রকট।সাহস হয়নি কোনোদিন গলা উচু করে কথা বলার। সমস্ত জেদ,অভিমান মাথা পেতে নেওয়া মানুষ তার ভাই।
ফাহাদ উত্তর দিলো,
“আগেও ভালোবাসতো না।আগে পছন্দ করতো তোকে।এখন আর পছন্দ করে না।আমি সাহির সম্পর্কে সব খবরাখবর নিয়েছি।তোর পেছনে আমার মানুষ লাগানো তুই নিজেও জানিস না।বারবার বলবো ওই ছেলেটা তোকে ভালোবাসে না।টাইমপাস করছে তোর সাথে।একদিন হঠাৎ করে ছেড়ে চলে যাবে।আর তোর অবস্থা দেখে মনে হচ্ছে ছেড়ে যাওয়ার সময় খুব কাছে।কষ্ট পাবি না আমার কথায়।তোর ভালোর জন্য বলছি।আমি সাহির সম্পর্কে বিস্তারিত বলতে ইচ্ছুক নই।আমি চাই না ঘুরতে এসে তোর মুড খারাপ হোক।তুই কষ্ট পাস”
খুশবু ফাহাদ এর হাত চেপে ধরলো।বললো,
“আমি জানতে চাই ভাইয়া?প্লিজ বলো”
“বাদ দে খুশবু”
“না ভাইয়া।যদি সাহির সম্পর্ক বিপরীত কিছু শুনে তাকে মন থেকে চিরতরে বের করতে পারি ক্ষতি কিসে?”
“বের করে দিবি মন থেকে?”
খুশবু কাঁদো মুখে বলতে লাগলো,
“তুমিই না বললে ছেড়ে দেওয়ার সময় কাছাকাছি?তাকে ভুলে যদি নিজের জীবনটা নতুন করে শুরু করতে পারি?খারাপ হবে ভাইয়া?”
বাবার পরে চির ভরসার স্থান এই মানুষটি।তার ভাই তার বন্ধু।ছোটবড় সব কথাই শেয়ার করা হয় তার সাথে।শুধু প্রেমের বিষয়টাই লুকিয়ে গিয়েছিলো খুশবু।কেমন দেখায় বড় ভাইকে প্রেমজনিত কথাবার্তা বলতে।চক্ষু লজ্জায় আড়াল করে গেলেও বিশেষ লাভ হলো না। রগেরগে চেনে ফাহাদ তাকে।ধরে ফেলেছে।
ফাহাদ খুশবুর মাথায় হাত রেখে বলল,
“নারীজনিত ঘটনা আছে ওই ছেলের।একের অধিক সম্পর্কে জড়ানোকে একটা খেল হিসেবে পেয়েছে।”
পায়ের তলা থেকে জমিন সরে যাওয়ার মতন অবস্থা খুশবুর।এতটা দিন যাকে কল্পনায় নিয়ে স্বপ্ন সাজিয়েছে তার সন্বন্ধে এরূপ মন্তব্য বিশ্বাস হচ্ছে না।কিন্তু সামনে থাকা মানুষটি যে অবিশ্বাসের পাত্র নয়।আপন ভাই হয় তার।রক্তের বাঁধন।খারাপ চাইবে না কখনো নাই কোনোদিন কষ্ট দিতে চাইবে।
কম্পিত গলায় জানতে চাইলো,
“তুমি সত্যি ঠিক খবরটা নিয়েছোতো?ভুল নেইতো ভাইয়া?”
“আমাকে বিশ্বাস করিস না?”
“নিজের চেয়েও বেশি বিশ্বাস করি।”
“আমি সত্যি বলছি খুশবু।আর তাছাড়া সাহির যদি ভালো ছেলেও হতো বাবা কোনোদিন তোকে ওর কাছে বিয়ে দিতো না।”
এক পরিশ্রান্ত হৃদয় নিয়ে ভাইয়ের সাথে বেরিয়েছে। সিলেটের সৌন্দর্য উপভোগ করার জন্য।আজ কোনো ট্যুরিস্ট স্পট নয়।সিলেটের অলি গলি ঘুরে বেড়াবে।হেঁটে হেঁটে উঁচু নিচু পাহাড়ের দৃশ্য ধারণ করবে নেত্রে। তবে খুশবুর নেত্রজোড়া যে ভার।অবসন্ন এক বিকেলে মনোমুগ্ধকর পরিবেশ তাকে স্বস্তিদায়ক অনুভূতি দিতে পারছে না।ভাইকে দেখানোর জন্য ঠোঁটের কোনে এক টুকরো হাসি শুধুই ভনিতা মাত্র। হৃদপিণ্ডের মাঝে বিশাল দোটানা।ভাইয়ের কথা শুনে সাহিরকে মন থেকে ঝেড়ে দিবে?নাকি একবার প্রশ্নবিদ্ধ করবে সেই পুরুষটিকে।যাকে ভালোবাসার ইচ্ছে ছিল অনন্তকাল?সে উত্তর দিবে?নাকি এড়িয়ে যাবে। মিথ্যেও বলতে পারে।
শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের কাছে এসে থামলো তারা।ফাহাদ পকেট থেকে ফোন বের করে কাউকে কল মেলালো।পাশেই চতুর্দিকে চোখ বোলাচ্ছে খুশবু।দেখছে চেয়ে চেয়ে।
কয়েক সেকেন্ড পর ফোন রিসিভ হলে ফাহাদ বললো,
“নোমান কোথায় আছিস?আমি ক্যাম্পাসের বাইরে দাঁড়িয়ে আছি।”
শেষ শব্দ ‘আচ্ছা’ উচ্চারণ করে ফাহাদ ফোন রেখে দেয়।হয়তো অন্যপাশ থেকে উত্তর এসেছে ‘আসছি’।ধরে নিলো খুশবু।মিনিট পাঁচেক অপেক্ষা করিয়ে তারই ভাইয়ের বয়সের একজন পুরুষ বেরিয়ে এলো হন্তদন্ত পায়ে।এসেই জড়িয়ে ধরে ফাহাদকে।
বললো,
“কত্তদিন পর ব্রো!কেমন আছিস?”
ফাহাদ উত্তর দেয়,
“আলহাদুলিল্লাহ।তোর কি খবর?রাজনীতি করে আর ক্যাম্পাস ছাড়িস নি?”
নোমান হেঁসে উত্তর দেয়,
“এই আরকি।রাজনীতি রগে রক্তের সাথে দৌড়ায়।বাপ চাচাদের পথেই চলছি।”
“ক্যাম্পাস ঘুরে দেখাবি না?আজ কিন্তু সভাপতির গেস্ট হিসেবে পুরো ক্যাম্পাসে স্পেশাল ট্রিটমেন্ট চাই।”
নোমান বুক ফুলিয়ে বললো,
“তুই এসেই দেখ একবার।সবাই উঠতে বসতে সালাম দিবে তোকে।”
তাদের কথাবার্তা চুপচাপ মনোযোগ দিয়ে শুনলো।ফাহাদের বন্ধুদের তালিকা বিশাল।তবে কখনো সচক্ষে দেখার সৌভাগ্য হয়নি।বন্ধুদের বাড়িতে এনে আড্ডা দেওয়া পছন্দ ছিলো না ফাহাদের কোনো কালেই।সেই সূত্রে চেনা নেই নোমানকেও।ফাহাদ এবং নোমান দুজনেই একত্রে চাইলো খুশবুর দিকে।
ফাহাদ এগিয়ে এসে খুশবুর কাঁধে হাত রেখে বলল,
“এটা আমার ওয়ান অ্যান্ড ওনলি ছোটবোন।”
নোমান বললো, “খুশবু না?”
ফাহাদ জবাব দেয়, “হ্যাঁ”
“আরেহ বাবাহ!মেয়েটার ছবি দেখেছিলাম তোর প্রোফাইলে।অনেক বছর আগে।কত বড় হয়ে গেছে।”
খুশবু মন ভালো করতে দুষ্টুমির ছলে বলে,
“বছর বছর মানুষের একধাপ বয়স বাড়ে ভাইয়া।এটাই নিয়ম।ওই নিয়ম ধরে আমিও বড় হয়ে গেছি”
নোমান খুশবুর কথা ধরেই বললো,
“তুমি একদম ঠিক বলেছো। দশে দশ দিলাম তোমাকে”
নোমানের কথায় হেসে উঠে তারা তিনজন। শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় এর ভেতরে প্রবেশ করে পুরো ক্যাম্পাসে পদচারণ তাদের।ঘন্টাখানেক ঘুরে ফিরে অন্তত কিছুটা মনের ব্যথা উপশম হয়েছে।পুরোপুরি না হলেও ভালো লাগছে।ঢাকায় নিজের ক্যাম্পাসেই যাওয়া হয়না।ছোটোবেলা থেকেই চঞ্চল হলেও কেমন জেনো ঘরমুখো খুশবু।আরাম আয়েশে নিজের ঘরে পড়ে থাকার মধ্যেই তার যত আনন্দ।কিসের ক্লাস কিসের স্মৃতি জমানো ক্যাম্পাসে।নিজের ফোন আর বিছানার সাথে স্মৃতি জমালেই চলবে।
ক্যাম্পাসে একটা সুন্দর সময় কাটিয়ে রওনা হয় খুশবু আর ফাহাদ।বাড়ি থেকে ফোন আসছে।রাত আটটা বাজতে চললো।বাবা কল করে তাড়া করতে লাগলো দ্রুত ফেরার জন্য। নোমানকে বিদায় জানিয়ে ফিরে আসে।
_____________
রাতের সময়টা অদ্ভুত।নির্জন কালো আধাঁরে ঢাকা সমস্ত শহরে আরো এক অদৃশ্য ছায়া নামে। বিষাদের ছায়া। ভঙ্গুর হৃদয়েরা সুর তোলে।শূন্যতার,হাহাকারের। ব্যক্তিভেদে অনুভূতি হয় ভিন্ন।কেউ পারিবারিক কহলে জর্জরিত হয়ে আধাঁরে সস্তি খুঁজে।কেউ কাজের চাপ কমানোর পাঁয়তারা।কেউ প্রিয় মানুষের সাথে দিব্যি সময় কাটাচ্ছে।আর কেউ প্রিয় মানুষ হারানোর বেদনায় কাতর। খুশবুও এদের থেকে আলাদা কেউ নয়।
প্রশ্ন করলো নিজেকে,
“আচ্ছা?আমি কি সাহিরকে সত্যিই হারিয়ে ফেলেছি?”
মস্তিষ্ক উত্তর দেয়,
“হারিয়ে ফেলাই শ্রেয়”
আর হৃদপিণ্ড দোটানায় বক্ষস্থলের একদিকে পা গুটিয়ে বসে আছে।কোনো মন্তব্য দিচ্ছে না।ইচ্ছুক নয়।কষ্টের বোঝা বইছে।এবার খুশবু মস্তিষ্ককে গুরুত্ব দিয়ে হুঁশিয়ার করলো হৃদয়কে।এভাবে থাকা যাবে না।দিনের পর দিন অবহেলা কেনো সহ্য করবে সে?একটা মানুষইতো সাহির।হারিয়ে গেলে কি খুব বেশি ক্ষতি হয়ে যাবে?কি তার অবদান খুশবুর জীবনে। অতিরিক্ত ভালোবাসা দিয়ে মাথায় তুলে আছড়ে ফেলেছে। ঔষধে এই বিশেষ ধরনের হৃদরোগটাও সেরে যাবে।
চেতনায় ব্যাঘাত ঘটায় এক ফোন কল।পাশে রাখা কালো স্ক্রিনে বাতি জ্বলে উঠলো। ভাইব্রেট করছে অনবরত।এক মন চট করে জেগে উঠেছে। সাহির কল করলো নাতো?একলাফে উঠে বসে খুশবু।ফোন হাতে নেয়।দেখলো অপরিচিত ল্যান্ড লাইন নাম্বার।
ফোন ধরবে কি ধরবে না এই দ্বিধা দ্বন্দ্বে পড়ে যায়।তবে ফোনটা থামছে না।বেজেই চলেছে।লম্বা নিঃশ্বাস ফেলে খুশবু ফোন রিসিভ করে।
“হ্যালো”
“আসসালামু আলাইকুম”
গম্ভীর পুরুষালি গলায় মস্তিষ্ক জ্বলে উঠে।এটা সাহিরের আওয়াজ নয়।খুশবু কয়েক সেকেন্ডের বিরতি নিয়ে উত্তর দেয়,
“ওয়ালাইকুম আসসালাম।কে বলছেন?”
“আপনি আমায় চিনবেন না।”
“তাহলে কল করেছেন কেনো চিনবো না যেহেতু?আশ্চর্য্য!”
“রেগে যাবেন না ম্যাম”
“সরি রং নাম্বার!”
অন্যপাশে গলার আওয়াজ দ্রুত কানে আসে। হন্তদন্ত হয়ে পুরুষটি বললো,
“রং নয় রাইট নাম্বার।আমি আপনাকেই কল করেছি খুশবু”
অপরিচিত লোকটির মুখে নিজের নাম শুনে খুশবুর মস্তিষ্ক জ্বলে উঠে।পা গুটিয়ে বসলো।খানিকটা রাগও হচ্ছে।
বলে উঠে,
“রাত বিরাতে মেয়েদের কল করে ডিস্টার্ব করেন।আপনাদের ছেলে মানুষের কি নূন্যতম লজ্জাবোধ নেই?”
হন্তদন্ত গলাটা আকস্মিক আবার গম্ভীর হয়ে উঠে।নিচু শব্দে উত্তর দেয়,
“বখাটে নয় আমি।আর আপনাকে কল করেছি এটাও আমার ব্যক্তিত্ব বিরোধী।তবে করছি!অজানা এক কারণে।লজ্জাহীন এর মতন নিজের ব্যক্তিত্বের বিরুদ্ধে আপনাকে কল করেছি।আপনার সাথে যোগাযোগের এটা ছাড়া আর কোনো উপায় ছিলো না।সকল পুরুষ ডিস্টার্ব করার উদ্দেশ্যে কল করেনা।”
“তাহলে আপনি কেনো কল করেছেন সেটা শুনি?”
“আপনি আগে আমার সম্পর্কে ধারণা বদলান তারপর নাহয় বলবো?”
“কেনো বদলাবো?আপনি বখাটে ছেলেও হতে পারেন।”
“পরিচয় জানলেই বুঝবেন।বখাটে নাকি অন্যকিছু”
বলে মৃদু হাসে লোকটি।ঝংকার ফোন বেয়ে খুশবুর কান অব্দি এসে পৌঁছেছে। খুশবু বললো,
“বলেন আপনার পরিচয়।”
“যদি না বলি?”
“তাহলে আমি ফোনটা ঠাস করে কেটে দিবো”
“আচ্ছা কেটে দিন।আজ নাহয় এতটুকুই।রাখছি…”
“আরেহ..শুনুন…হ্যালো”
চলবে…