তেইশতম বসন্ত
পরিসংখ্যা ৮
লেখনীতে – Azyah(সূচনা)
-“তাহলে আরো ভালো খুশবু।বিশেষ কিছুতে মাতোয়ারা হয় সর্বকুল। বিনা কারণে নির্বিশেষে যেহেতু মন মজেছে তাহলে বুঝে নিন গল্প অনেক দূর এগোবে”
মুখে লাজের ছোঁয়া লাগে।যেখানে লজ্জা জিনিসটার অর্থ সবসময খুঁজে বেড়ায় খুশবু।নিজের চক্ষু নামিয়ে হাঁসির প্রতি অবাক হলো।এমন করার কি আছে?অন্যদিকে আফতাব সোজা হয়ে দাঁড়ালো।গাড়ীর জানালা দিয়ে একটি নীল রঙের পুঁটলি বের করলো। খুশবুর দিকে এগিয়ে দিয়ে ইশারা করে খুলতে। সুতো ছাড়িয়ে খুশবু খুলে দেখলো এর মধ্যে কয়েক রঙের পাথর।অন্যান্য পাথরের চেয়ে অনেক ভিন্ন আর সুন্দর।হাতে নিলেই শীতল অনুভব হচ্ছে।কয়েকটা একদম কাচের মতন স্বচ্ছ।হরেক রঙের।
অবাক চোখে আফতাব এর দিকে চাইলে আফতাব বলে উঠে,
“সত্যিই আমি নির্বিশেষে আকৃষ্ট।এই পাথরগুলো জমিয়েছি আমি অনেকদিন যাবৎ।কিছু আমাদের দেশের আর কিছু পাশের দেশ থেকে এসেছে। বোঝাইকৃত ট্রাকগুলো সীমান্ত পাড় করার সময় ঝাঁকুনিতে পড়ে যেতো।সেখান থেকেই বাছাই করে নেওয়া।এগুলো আপনার জন্মদিনের উপহার।”
বারবার এই লোকটা খুশবুকে অবাকের চূড়ান্ত পর্যায়ে নিয়ে দাঁড় করিয়ে দেয়।ভালো অনুভূতিতে ভরিয়ে তোলে চিত্ত।এক দৃষ্টিতে প্রতিক্রিয়াহীন চেয়ে রইলো খুশবু।ধীরেধীরে নিজের জায়গা বানানোর আপ্রাণ চেষ্টা।কোনো কমতি রাখছে না এই চেষ্টায়।বিনয়ী হাঁসি মুখটা ছেড়ে যায় না কখনো।ডিউটি ফেলে দৌড়ে এলো?
খুশবুকে চেয়ে থাকতে দেখে আফতাব প্রশ্ন করে,
-“ভালো লাগেনি?”
পলক ঝাঁপটায় খুশবু।বলে,
-“আপনার মাথাটা খারাপ ক্যাপ্টেন আফতাব মির্জা”
খুশবুর সম্মুখে এসে দাঁড়ালো আফতাব। দূর থেকে তৃষ্ণা মিটছিলো না।তাকে চোখে ধারণ করার ব্যাকুলতা বাড়ছে।কে জানে কয়েকদিনের দূরত্ব কি করে মানবে অস্থির চিত্ত?হারিয়ে যাবে খুশবু এই কিছুদিনে?নাকি অপেক্ষায় থাকবে?
চোখে চোখ রেখে মলিন সুরে আওড়ায়,
-“আমি হার্ট সার্জনকে দেখেছি তার রমণীর জন্য হার্ট পেশেন্ট হয়ে ঘুরতে। প্রকৌশলী একজন যান্ত্রিক পুরুষকে দেখেছি আবেগে পুড়ে ছাই হতে।দক্ষ একজন পাইলট এর হাত কাপতে দেখেছি যখন তার ওড়ানো প্লেনে বসে ছিলো তারই প্রিয় কেউ।পুরুষের মাথা, মন সবটাই এলোমেলো হয় বিশেষ…..নাহ নির্বিশেষ কোনো ব্যক্তিত্বে।”
-“আমার জন্য চলে এলেন?”
-“এসেছি….কারণ দূরত্বের পূর্বে সাক্ষাৎটা জরুরি হয়ে উঠেছিল।”
শুষ্ক ঠোঁট ভেজায় খুশবু।এলোমেলো উড়ে চলা চুলগুলো বিরক্ত করছে।তবে ঠিক করার ইচ্ছে জাগলো না।মাথার কাপড় পড়ে আছে ঘাড়ের কিছুটা উপরে।জ্বলজ্বল করা জিজ্ঞাসু দৃষ্টি জানতে চাইলো,
-“দূরত্ব?”
-“আগামীকাল পাহাড় গহীনে হারাতে হবে।যেখানে কোনো নেটওয়ার্ক পাওয়া যায় না। উচ্চতায় চোখ ফিরিয়ে শুধু দীপ্ত সূর্য আর শুভ্র চাঁদকে ভীষন কাছে মনে হয়।”
-“পাহাড়ে যাচ্ছেন?”
-“হ্যাঁ”
কথার ঘোর ছড়াচ্ছে খুশবুর মাঝে।আপনাআপনি মুখ থেকে বেরিয়ে এলো,
-“ফিরবেন কবে?”
-“জানি না খুশবু।অপেক্ষা করবেন?নাকি নিজের শহরের ব্যস্ততায় হারিয়ে যাবেন?”
চোখ নামিয়ে ঠোঁট কামড়ে ধরলো খুশবু।কোনো জবাব দিলো না।বিষণ্ণ হচ্ছে মন ধীরেধীরে। সেনাবাহিনীর সদস্যদের জীবন সহজ হয়না।পরিবার পরিজন কারোরই আটকানোর ক্ষমতা নেই।জবাবের আশায় নেই আফতাব।শুভ্রতা ঘেরা মুখে উত্তর আছে।যা খুঁজে নিয়েছে আফতাব।
-“আমি জানি অপেক্ষা করবেন।আসি”
একটি পাথর বের করে আফতাব এর দিকে এগিয়ে দিলো।হলুদ রঙের।আফতাব অবাক চোখে গ্রহণ করে।খুশবু বললো,
-“এটা আপনার।খোদা হাফেজ।”
-“বাবা – মায়ের সাথে দেখা করে যাবো।আপনি ঘরে চলে যান।”
খুশবু মাথা দুলিয়ে উল্টো ঘুরে পা বাড়ায়।কিছু পথ এগিয়ে ফিরেও চেয়েছে।দরজাটা খোলাই রাখলো। জিপটা তাদের বাড়ির কাছেই দাঁড় করানো।পায়ে হেঁটে নিজের বাড়ির দিকে গিয়েছে।অবশ্যই রওনা হলে এখানে আবার দেখা মিলবে।অন্যদিকে আফতাব ভাবছে কি বাহানা দিবে বাবা মাকে?কি কারণে এসেছে?বাড়ির কাছে এসে বাবা মায়ের সাথে দেখা না করলেওতো অন্যায়! অধিকারতো তাদেরই প্রথম।মাথার মধ্যে মিথ্যে বুদ্ধি এটে হাঁটা ধরলো।
কলিং বেল চাপতেই রুমানা মির্জা এসে দরজা খুলে দেন।সম্মুখে ছেলেকে দেখতে পেয়ে আশ্চর্য্যচকিত! হঠাৎ না জানিয়ে তার আগমন।ছেলের বাহুতে হাত রেখে প্রশ্ন করলেন,
-“কিরে বাবা?”
-“কিছু জরুরি জিনিস ফেলে রেখে গিয়েছিলাম।নিতে এসেছি।আগামীকাল থেকেতো পাহাড়ি এলাকায় ডিউটি।সাথে তোমাদের সাথে দেখাও হলো”
পেছন থেকে রফিকুজ্জামান এসে প্রশ্ন করলেন, -“আজ আখতার এলো না যে?তুমি এসেছো”
আফতাব হেঁসে বললো, -“কেনো আমার আসা তোমার পছন্দ হয়নি বাবা?”
-“আহহা সেটা বলিনি। প্রতিবারতো আখতার আসে।”
আফতাব ঘরে ঢুকতে ঢুকতে বললো, -“আধ ঘন্টা সময় আছে।কিছু খেতে দাও।”
রুমানা মির্জা তাড়াহুড়ো শুরু করলেন।দ্রুত ছেলের জন্য হালকা নাস্তা বসিয়েছেন।যতবার যতটুকু সময়ের জন্যেই আসুক না কেনো তার মধ্যে তাড়াহুড়ো দেখা যায়।কি রেখে কি করবেন!মাঝেমধ্যে রেগে যান স্বামীর উপর।কি দরকার ছিলো একটা মাত্র ছেলের সেনাবাহিনীর ভূত চাপানোর?দূরে থাকলেই দুশ্চিন্তা শুরু হয়।
রফিকুজ্জামান পায়ের উপর পা তুলে বসেছেন।আফতাব টিভি অন করে দেখতে লাগলো।সময় সুযোগ পেয়ে প্রশ্ন করলেন,
-“কি খবর তোমার?”
আফতাব দৃষ্টি ঘোরায় রফিকুজ্জামান এর দিকে।জবাব দেয়,
-“ভালো”
কিছু সময়ের নীরবতার পর আকস্মিক আবারো বলে উঠলেন,
-“শোনো আমি তোমার বাবা!আমি জানি তুমি এমনে এমনেই আসোনি।তোমার আসার পেছনে কারণ আছে একটা।” তীক্ষ্ম দৃষ্টি ছুঁড়ে বললেন রফিকুজ্জামান।
আলগোছে হেঁসে আফতাব জবাব দেয়,
-“অবশ্যই কারণ আছে। বললামইতো দরকারি কিছু ফেলে রেখে গিয়েছিলাম।আর তোমাদের সাথে দেখা করার ইচ্ছে হলো যাওয়ার আগে। সেখানে নেটওয়ার্ক নেই।কল করতে পারবো না।”
-“আর কোনো কারণ নেই?”
কোনো জবাব দেওয়ার আগেই নাস্তা নিয়ে হাজির রুমানা মির্জা। তাড়াতাড়ি যা পেরেছেন তৈরি করে আনলেন ছেলের জন্য।সর্বপ্রথম চায়ের কাপটা তুলে দিলো আফতাব।বাবার চায়ের কাপটা অন্যহাতে তার দিকে এগিয়ে দেয়।
নত কণ্ঠে বললো, -“বাড়ি ফিরে কথা বলি এই বিষয়ে বাবা?”
-“ঠিকতো?” রফিকুজ্জামান ফিরতি প্রশ্ন করলেন।
-“হ্যাঁ ঠিক”
কোনো জবাব দিলেন না।কঠোরতা শিখেছেন এই পেশা থেকেই।অন্তরের মধ্যে জমানো দুর্বলতা নিজের পরিবারের কাছেই প্রকাশ পায় না।তবে তার ছেলেটা তেমন নয়।যেখানে যেমন অনুভূতি প্রকাশ প্রয়োজন সে ঠিক তেমনভাবেই নিজেকে আত্মপ্রকাশ করে।কোনো দ্বিধা নেই তার মধ্যে;কোনো বাঁধা নেই।এই মুহূর্তে কথা বাড়াননি।সময়ের স্বল্পতা। তাড়া আছে আফতাব এর। ঘর থেকে কিছু জিনিস নিয়ে বেরিয়ে পড়লো।যাওয়ার পথে আরো একবার মিষ্টি হাঁসি ছুঁড়েছে খুশবুর দিকে।উঠোনে দরজার দিকে মুখ ঘুরিয়ে বসে আছে এখনও।বিশ্বাস আরো দৃঢ় হয়।সে নিশ্চয়ই অপেক্ষা করবে।
___
কলেজ পড়ুয়া মেয়েদের মধ্যে বাচ্চামো স্বভাবটা প্রায়ই পরিলক্ষিত হয়। খুশবুকেও দেখেছে ফাহাদ।সেই সময়টা ছিলো বেশ আবেগ প্রবন।ধীরেধীরে ঠিক হয়ে গিয়েছে।ভুল-সঠিক ধরতে পারার জ্ঞানটা দেরিতে আসে। আধুনিকতায় অভ্যস্ত অনেকবার ভুল করেই ফেলে।নেহার সঙ্গে আলোচনার এক পর্যায়ে ফাহাদ বুঝতে পারলো তার মন খারাপ।তার বন্ধুদের দল যাচ্ছে ট্যুরে।সবার বাড়িতে অনুমতি আছে তবে তার নেই।এই নিয়ে সরাসরি দুঃখ প্রকাশ না করলেও কথার ধাঁচে ঠিক আন্দাজ করেছে ফাহাদ।বারবার বলেই যাচ্ছে সে বড় হয়েছে।কেনো তাকে তার বড় ভাইয়ের মতন স্বাধীনতা প্রদান করা হচ্ছে না।
কথার এক পর্যায়ে নেহা বললো,
-“আমি কি উশৃঙ্খল মেয়ে?আমি আমার লিমিট জানি।আমি সেখানে গিয়ে এমন কিছুই করবো না।আমাদের সাথে সব মেয়েরা যাচ্ছে।বড় আপুরাও যাচ্ছে।আমি গেলে কি সমস্যা আপনিই বলুন?”
ফাহাদ এর ইচ্ছে হলো বলে ফেলতে।সে গেলে অনেক সমস্যা। তারপরও বললো না।এখানে কাটকাট কথায় কোনো লাভ হবেনা।প্রয়োজন ঠান্ডা মস্তিষ্কে বোঝানোর।ফাহাদ জবাব দিলো,
-“তুমি উশৃঙ্খল মেয়ে নয়।যেমন সব মেয়ে ভালো হয়না তেমন সব পুরুষ ভালো হয়না।”
নেহা জবাবে লিখলো,
-“আমরা সাবধানে থাকলেই হবে।”
-“বিপদ আসলে সাবধানতা দেখে আসেনা।আমরা খুশবুকে কখনো একা বাহিরে যাওয়ার অনুমতি দেইনি।যেখানেই গিয়েছি হয়তো বাবা মা সাথে ছিলো নয়তো আমি।”
দুঃখ প্রকাশ করে নেহা বললো,
-“ভাইয়ার কি সময় আছে আমার জন্য?সে আর বাবা সবসময় থাকে নিজেদের রাজনীতি নিয়ে।আমার ভালো লাগেনা।”
-“পরিবারকে সময় না দেওয়া অবশ্যই ভুল।চিন্তা করবে না।আমি নোমানকে বোঝাবো যেনো তোমাকে নিয়ে ঘুরতে যায়।”
-“শুনবে না।”
-“সিলেটের মতন একটা জায়গায় থেকে ঘুরতে যেতে চাও বোকা মেয়ে।আমি হলে কখনো এই শহর থেকে বাহিরে কদম রাখতাম না।”
নেহা ফটাফট জবাব দিলো,
-“আমাদের ক্ষেত্রে জিনিসটা অন্যরকম।এখানে থেকে অভ্যস্ত। সিলেটের খুঁটিনাটি সব জায়গা ঘুরে দেখা হয়েছে।তাই আর মন টানে না।”
-“কিন্তু তোমার এটাও মাথায় রাখতে হবে সমাজে এমন পুরুষ আছে যারা সবসময় নারীর ক্ষতি করার চিন্তায় থাকে।কিছু সময় বড়দের কথা শুনো।ভবিষ্যতে ঠিক ইচ্ছে পূরণ হবে।”
-“যদি না হয়?”
-“হবে ইনশাল্লাহ!”
টুকটাক প্রতিদিন তাদের মধ্যে টুকটাক আলাপ চলে।বন্ধুর বোন হিসেবে কথাবার্তা বলে ফাহাদ।তবে নেহার মনে এসেছে ভিন্ন অনুভূতি।ফাহাদের প্রতি ক্ষুদ্র পরিমাণ ভালো লাগা কাজ করছে তার।প্রতিদিন বিভিন্ন বাহানায় কথা বলার জন্য প্রস্তুত থাকে।মাঝেমধ্যে মনে হয় বেহায়াপনা করছে।আবার কখনো এই বেহায়াপনাকে প্রশ্রয় দিয়ে ভালো লাগাকে নিজের মধ্যেই আবদ্ধ করতে থাকে নিজের মধ্যে। সুপ্ত অনুভূতি আড়ালেই রাখলো।বেশি প্রকাশ করলেই বিপদ।
দরজায় সাদা কাপড়ে কাউকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে আত্মা কেঁপে উঠতে চাইলো।পরপর ভালোভাবে লক্ষ্য করে ফাহাদ।এটা আর কেউ নয় তারই খবিশ ছোট বোন।সাদা রঙের সেলওয়ার কামিজ পড়ে অতৃপ্ত আত্মার মতন দরজার একদিকে ড্রিম লাইটের আলোয় দাঁড়িয়ে আছে। নিশ্চয়ই উদ্দেশ্যে ভয় দেখানো?
একহাতে সুইচ টিপে লাইট জ্বালায় ফাহাদ।বলে,
-“লাভ নেই”
-“আমি কি ভয় দেখাতে এসেছি নাকি?” খুশবু বললো।
ফাহাদ ঠোঁট টিপে হাঁসে।ঠাট্টার সুরে বলল,
-“ঠাকুর ঘরে কে রে?আমি কলা খাইনি”
আসলেই ছোট মস্তিষ্ক তার।যে কথার অর্থ ঠাস করে ধরে ফেলার কথা সেটা বুঝতে সময় নিলো মিনিট কয়েক।নিজের কথার যোগসূত্র মেলাতে পারেনি।অর্থ বোধগম্য হলে তপ্ত নিঃশ্বাস ফেলে খুশবু।হৃদয় মাঝারে অদ্ভুত অস্থিরতা কাজ করছে।যা নিরর্থক।শান্তি পাচ্ছে না কোনো জায়গায় বসে।তাই মাথায় ভূত চেপেছিলো ভূত সাজার। একমাত্র এই মানুষটাকে বিরক্ত করে শান্তি মেলে।
ফাহাদ বললো, -“এদিকে আয়।আমারও ঘুম আসছে না। লুডু খেলবি?”
দ্রুত গতিতে মাথা উপর নিচ দুলিয়ে বিছানায় এসে বসে।পা গুটিয়ে।হাতের কাছে লুডোর বোর্ড নেই।আধুনিক লুডো খেলতে হবে।সেলফোনে। খুশবু এক দৌড়ে যায় আরেক দৌড়ে ফোন নিয়ে ফিরে আসে।
লুডো খেলায় খুশবুকে টক্কর দেওয়া অনেকটা কষ্টের।তারপরও আশা নিয়ে খেলতে বসে ফাহাদ।এক না একবারতো জিতবেই।সেটা আর হয়না।আজও মনের মধ্যে প্রবল আকাঙ্ক্ষা নিয়ে বসেছে।প্রথমবারে হেরে গেলো। দ্বিতীয়বার লুডো খেলা শুরু করে ফাহাদ প্রশ্ন করলো,
-“ওই অসভ্যটা তোকে কল করে?”
খুশবু ভাইয়ের দিকে চেয়ে প্রশ্ন করলো, -“কে সাহির?”
-“হুম?”
মুখশ্রী কালো হয়ে গেলো খুশবুর।চোখ নামিয়ে জবাবে বলে উঠলো,
-“কেনো করবে কল?তার আমার প্রতি কোনো মায়া আছে নাকি?”
ফাহাদ খুশবুর দিকে চেয়ে আবার চোখ নামিয়ে ফেলে। বাঁকা হাসলো।সুবুদ্ধি উদয় হচ্ছে তাহলে।ভারী গলায় বলে উঠলো,
-“এতদিনে এটা উপলব্ধি করলি?”
-“ঠিক সময়েই করেছি।তুমি ওর সম্পর্কে সব বলার পর থেকে আমার আর ওর মধ্যে বাঁধা দৃষ্টি হয়েছে একটা।যা আমার মনে হয় মঙ্গলজনক।”
ভ্রু নাচিয়ে ফাহাদ বলে, -“বাবাহ্!এত কথা কোথায় শিখলি খুশবু?”
-“এইতো আজকে থেকে বাইশ থেকে তেইশ বছর হয়েছে।বড় হয়েছি আরো এক বছর।কথা শিখতে হবে না? তাছাড়াও আমিই বোকা ছিলাম।যেখানে কদর নেই সেখানেই বারবার যাচ্ছিলাম নির্লজ্জের মতন।তোমাকে আগে জানিয়ে দিলে আগেই ওর কাছ থেকে সরে আসতে পারতাম।ভুল করেছি শিক্ষা হয়েছে।দ্বিতীয়বার এই ভুল হবেনা।”
বিস্ময়াভিভূত হয় ফাহাদ। ভ্যাভ্যা করে কেঁদে ফেলার মেয়ে সপূষ সংলাপ বলছে।এই শক্ত খুশবু এগোতে পারবে অনেকদূর।কোনো আঘাতে ভেঙে পড়বে না।তাই বড় ভাইয়ের মতন কটূক্তি করে আর কোনো কথা বললো না।
খুশবু প্রশ্ন করলো, -“তুমি বিয়ে করবে না?”
-“মাত্র মাস্টার্স শেষ করলাম।শিক্ষিত বেকার আমি।কোন বাবা আমাকে মেয়ে দিবে এখন?”
-“এটা হচ্ছে আরেকটা আজাইরা কথা!”
খুশবু এর জোড়ালো আওয়াজের বিপরীতে ফাহাদ প্রশ্ন করলো,
-“কেনো? কেনো?”
-“তোমার বউ আমাদের বাড়ির বউ।বাবা মা না খাইয়ে রাখবে ভাবিকে?আমরা যত্ন করবো না?”
-“ওসব তোর মাথায় ঢুকবে নারে।ছেলে মানুষের সমস্যাগুলো শুধু তারাই বুঝে।যত সহজে বলে ফেললি তত সহজ না।সব বাবা মা মেয়ের সচ্ছল সুস্থ ভবিষ্যৎ চায়।যেমন আমরা তোরটা চাই।”
-“আমি অতশত সমস্যা বুঝতে চাইনা।বাবাকে কল করে বলবো ভাইয়া বিয়ে করতে চায়।শেষ!”
ফাহাদ রেগে গিয়ে বলল, -“থাপড়ে গাল লাল করে ফেলবো।তুই কর বিয়ে।ঘরে অবিবাহিত বোন থাকতে ভাইরা বিয়ে করেনা। সো তোর আগে বিয়ে হবে।”
-“দিয়ে দাও একটা বিয়ে।দেখি বিয়ে করার পর জীবন কেমন হয়?আমি ইন্টারেস্টেড!”
খুশবুর এই কথায় থম মেরে বসে রইলো ফাহাদ। নিষ্পলক চোখে চেয়ে আছে।মেয়েটার লজ্জা আসলেই নেই নাকি ব্যর্থ প্রেমের শোকে লাজ হারিয়েছে।বড় ভাইয়ের সামনে বসে বলছে আমি বিয়ে করতে ইন্টারেস্টেড!ফাহাদের লজ্জা বেশি নাকি খুশবুর কম এই হিসেবটা মেলাতে হবে।
-“বাবাকে বলছি দাঁড়া”
খুশবু খানিক ঘাবড়ে উঠলো।অধরে মিথ্যে হাঁসি টেনে মিনমিন করে বললো,
-“আরেহ আমিতো মজা করলাম।তুমিও সিরিয়াসলি নাও সব কথা।ঠিক বাহিরের মুরগিগুলোর মতন!”
কথার আগা মাথা গোড়া কোনোটাই বুঝতে পারলো না ফাহাদ।কোন মুরগি?কিসের মুরগি?তাকে উল্টো প্রশ্ন করার আগেই বেরিয়ে গেছে ঘর থেকে।বোনের মাথায় নিশ্চয়ই কোনো তালগোল পেকেছে।আজকাল হেয়ালিপনা মাত্রাতিরিক্ত দেখা যাচ্ছে তার মধ্যে।
__
পাহাড় গহীনে নীরবতা কাটলো একাধিক বুট জুতোর খচখচ আওয়াজে। তমসাচ্ছন্ন ভয়ানক প্রকৃতিতে এক চাঁদ আর টর্চ লাইটের আলো।সীমান্তের একাংশে টহল পড়েছে।কয়েকদিন এখানেই অতিবাহিত করতে হবে। সুবিধাজনক জায়গা পেলে ঘাটি স্থাপন করবে। দশ মিনিটের বিশ্রাম নিয়ে নিয়ে অনেক পথ পাড়ি দিয়েছে।দিক নির্দেশনা দিচ্ছে খোদ আফতাব।সাথেই চব্বিশ জনের সেনাদল।রাত তিনটে নাগাদ লক্ষ্যে এসে পৌঁছালো।জায়গা খুঁজে নিয়েছে ক্যাম্প বসানোর জন্য।গাছের আড়াল থেকে আকাশের দিকে চাইলে বোঝা গেলো বৃষ্টি হতে পারে।
আরিফ এর দিকে আদেশ ছুড়লো, -“বৃষ্টি হবে বোধহয়।বিশেষ সেফটি মেইনটেইন করতে বলো বাকিদের।আমি সামনের দিকে এগোচ্ছি।”
কয়েকজন ক্যাম্প স্থাপন করছে।আর বাকিরা আফতাব এর আদেশমত ছড়িয়ে ছিটিয়ে গেলো চারিদিকে।দুর্গম এলাকা।অনেকটা পিচ্ছিলও।বৃষ্টি হলে ভোগান্তিতে পড়তে হবে তাদের।দায়িত্বে ঠায় দাঁড়িয়ে থাকা আফতাব এর কদম থামে উচুঁ এই পাহাড়ের বাঁকে। আধাঁরে দূরবর্তী শহরের আলো মিটিমিটি দেখা যাচ্ছে।যা খুবই তুচ্ছ।আগেও আসা হয়েছে এসব জায়গায়।তবে এবার মন টিকছে না। অস্থির লাগতে শুরু করে আফতাবের।মুখ লটকে যায়।হাতে থাকা রাইফেলতার দিকে একপলক চেয়ে আবার মুখ তুললো।শোনা যাচ্ছে ভয়ঙ্কর পাহাড়ের ডাক।আকাশে বিদ্যুতের ঝলকানি।হওয়ার বেগ তুলনায় বেশি। দীর্ঘশ্বাস ফেলে আনমনে বলে উঠলো,
-“আমি আকাশের অনেকটা কাছাকাছি আর জমিন থেকে অনেকটা দুরত্বে।আপনাকে একদিন এই ভয়ঙ্কর সৌন্দর্য্য উপভোগ করাবো খুশবু”
পরপর আরো চারদিন কেটে গেছে।যেমনটা ভেবেছিলো।কোনো প্রকার নেটওয়ার্ক নেই সেখানে। সৌভাগ্যক্রমে বৃষ্টির কালো মেঘ কেটে গিয়েছিল। খুশবু বারবারে ফোনটা হাতে নেয়।আবার রেখে দেয়।কবে যেনো তারও ডাক পড়ে। সিলেটেতো আর সবসময় থাকা হবে না।ফিরে যেতে হবে ঢাকায়।আচ্ছা এরপর আফতাব এর সাথে কি আর দেখা হবে না?সে তার কাজে ব্যস্ত হয়ে যাবে?তাকে নিয়ে যে এত পাগলামি করলো?ভুলে যাবে?তাদের কোনো ঠিকানা নেই।এদিক ওদিক ঘুরে বেড়ায় নিজের পরিবার থেকেও দূরে।এই ভেবে খুশবু ফোন আবার হাতে নিলো। আফতাব এর নাম্বারে ডায়াল করতেই এক ভদ্রমহিলা জানিয়ে দিলেন সংযোগ প্রদান করা সম্ভব হচ্ছে না।
দুপুরের কড়া রোদে দাঁড়িয়ে থাকা আফতাব এর মন উসখুস করতে শুরু করলো ব্যাপক মাত্রায়।এদিক ওদিক ফোন নিয়ে নেটওয়ার্ক খোঁজার চেষ্টায় লেগে পড়ে। হাঁটতে হাঁটতে একটু নিচে নেমে গেছে।এক দাগ নেটওয়ার্ক পাওয়ার সাথেসাথে বাবার নাম্বারে মেসেজ করে জানিয়ে দেয় সে ঠিক আছে।চিন্তা না করতে।নিজেদের খেয়াল রাখতে।কে জানে এই মেসেজ সেন্ড হতে কতসময় নিবে।পরপর খুশবুর উদ্দেশ্যে লম্বা একটা মেসেজ টাইপ করলো।লিখেও মুছে ফেলে।
শেষ একটা লাইন লিখলো,
-“আমার মন-মস্তিষ্ক আপনাকে অবিশ্রান্তভাবে স্মরণ করে যাচ্ছে খুশবু।আপনারও কি তাই?”
চলবে…