#তেজস্ক্রিয়_রক্তধ্বনি
#লেখিকা_রিয়া_খান
#পর্ব_২
কাজের লোক গেট খুলতেই ইরফান শেখ ভেতরে ঢুকে লক্ষ্য করল তাঁর স্ত্রীর চেহারার মধ্যে একটা হিংস্রতা কাজ করছে। আবহাওয়া কিছুটা আন্দাজ করতে পেরেছে। কোনো প্রশ্ন না করে ফ্রেশ হয়ে ইরফান শেখ ডিনারের জন্য টেবিলে বসে গেল, ডাইনিংয়ে বসতেই চোখ কপালে উঠে যাওয়ার মতো উপক্রম! তীব্র যা যা বলেছিলো ঠিক তাই তাই রান্না করেছে, করলা ভর্তা,করলা ভাজি, আর মাছ বিহীন করলার ঝোল তরকারি। এটা দেখে একদমই নিজের চোখকে বিশ্বাস করতে পারছে না! তীব্র হয়তো একটা ব্যাপার বলতে ভুলে গেছে করলার রেসিপির সাথে ভাতটাও আজকে রেশনের মোটা চাল দিয়ে রান্না করেছে।এই খাবারের দৃশ্য দেখে নিজেকে জেল খানার কয়েদি মনে হচ্ছে, কয়েদিদেরও এর থেকে ভালো খাবার দেয়া হয় বলে মনে হচ্ছে। কাজের লোকের দিকে তাকিয়ে ইরফান শেখ জিজ্ঞেস করলো,
“আমরা তো কেনা চালের ভাত খাই তাই না?”
“জে ছার”
“তাহলে এই রেশনের চাল কোথায় পেলো?”
“মেডামে জোগাড় করছে, আই ন জানি।”
“আজকে বাড়িতে কি কেউ এসেছিলো?দেখতে শ্যাম বর্ণের গায়ের রঙ, লম্বা চওড়া ইয়াং দেখতে সুন্দর কিন্তু চোখের দিকে তাকালে ভয়ংকর লাগে এই রকম?”
“কই না তো কাউরেই দেহি নাইক্কা। কেউ আহে নাই ছার!”
“তুমি শিউর?”
“জে ছার।”
“ছেলে মেয়েরাও কি এই খাবার ই খেয়েছে?”
“না ছার, হেতেরা ব্যাকেই বাইরেত্তন খাইয়া আইছে।”
খাবার না খেয়েই উঠে গেলেন ইরফান শেখ, নিজের রুমে যেতেই দেখলো স্ত্রী গাল ফুলিয়ে বসে আছে। তীব্রর কথা শুনে আবহাওয়া আন্দাজ করেছিল ইরফান শেখ, তীব্রকে অপছন্দ করলেও ওর কথা গুলো না চাইতেও বিশ্বাস করে ফেলে।
এসবির সিনিয়ররা তীব্রকে নিয়ে একটু বেশি মাতামাতি করে, আর ও কখনো বেয়াদবি করলেও সবাই স্বাভাবিক ভাবে নেয়, এই ব্যাপারটা ইরফান শেখ মেনে নিতে পারে না, যার জন্য সারাপথ তীব্রর সাথে নিজেকে নিয়ে কম্পিটিশন করতে থাকে,আর তীব্রর কাছে হেরে যায় বার বার। এই কারণেই তীব্রকে বিষের কাঁটার মতো লাগে।
একটা জুয়েলারি বক্স বউয়ের দিকে এগিয়ে দিয়ে বললো,
“সরি, কাজের চাপে ছিলাম অনেক।দেশের অবস্থা ভালো না, তাই তোমার বার্থডে সেলিব্রেট তো দূরে থাক উইশ করার টাইম হয় নি। এতো খাটাখাটনির পর এসব কথা মাথায়ও থাকে না।এবারের মতো সরি!”
রাত মাঝরাত থেকে অনেকটা পেরিয়ে গেছে।
রিফাত খনিক সময়ের জন্য চুপ থেকে আবারও জিজ্ঞেস করল,
“স্যার কোথায় যাচ্ছি আমরা?”
তীব্র চোখ বন্ধ করে উত্তর দিলো,
“বলেছি না একবার বিয়ের জন্য পাত্রী দেখতে যাচ্ছি।”
রিফাত আবার নিরব হয়ে গেল,
তীব্র গম্ভীর স্বরে রিফাতকে ডাক দিলো,
“রিফাত!”
“বলুন স্যার।”
“সরকার থেকে তোমাকে আমার সাথে দেয়া হয়েছে কেনো?”
“আপনাকে প্রোটেক্ট করার জন্য স্যার।”
“কয়বার প্রোটেক্ট করেছো?”
তীব্রর প্রশ্ন বিভ্রান্তিতে ফেলে দিল রিফাতকে, ঢোক গিলে উত্তর দিলো,
“স্যার একবারও না।”
“আলাদা বডিগার্ড দিয়ে সরকার খামোখা টাকা নষ্ট করেছে, গাড়িটা ঠিক আছে, সরকারি গাড়ি দেখে মানুষ খুব সম্মান দেয়, বিশেষ করে ট্রাফিক পুলিশ গুলো। কিন্তু বডিগার্ড দেয়ার কোনো মানেই হয় না, মৃত্যু যদি থাকে ললাটের লিখনে সুচের ভেতর লুকিয়ে থাকলেও মৃত্যু সেখানেই উপস্থিত হবে।”
“জি স্যার।”
“পুলিশের চাকরী নিয়ে তোমার কি অনুভুতি?”
“ভালোই স্যার।”
“পুলিশের চাকরী টা আমার একদম ই পছন্দ না, কিন্তু আমার দুর্ভাগ্য সেই পুলিশের চাকরীই করে খেতে হচ্ছে। বাপ দাদার পুরো খানদান পুলিশ পেশাটাই বেছে নিয়ে এসেছে। আমার বাবা ছিলো পুলিশ, আমার দাদা ছিল পুলিশ সাথে ছিলো খাটি বাঙালী এবং একজন মুক্তিযোদ্ধাও বটে কিন্তু দাদার বাবা ছিলেন খাটি রাজাকার, কতোটা সত্যি এটা জানি না, ইতিহাস ঘেটে এইটুকুই জেনেছি।
কি আজব তাই না? বাপ রাজাকার ছেলে মুক্তিযোদ্ধা। কিন্তু আমাদের বাপ বেটাদের মধ্যে মিল আছে, যোদ্ধা -শহীদ! নিজের জীবন বিলীন করে দেশের জন্য ছুটছি, মাঝ পথে আপনজন হারাচ্ছি, পুলিশের চাকরী পছন্দ না হওয়া স্বত্তেও দায়ীত্ব পালন করে যাচ্ছি, এটাকে কি বলে রিফাত?”
“আত্ম বিসর্জন স্যার!”
“হুম রাইট! আমার কথা গুলো তুমি খুব ভালো মতো বুঝো বলেই তোমাকে আমি পোস্টিং দেই নি এখনো। এভাবেই কাজে লেগে থাকো সন্তুষ্ট হয়ে একদিন প্রমোশনের ব্যাবস্থা করে দিবো। তুমি কি প্রমোশনের জন্য পরিক্ষা দিয়েছো?”
“না স্যার, সামনের বছর দেয়ার নিয়ত আছে।”
“কাজটা ঠিক করো নি,পরিক্ষা দেয়া উচিৎ ছিল। ছয়টা মাস কষ্ট করে ট্রেনিং করে পরিক্ষা দিও।”
“ওকে স্যার।”
দুই হাত ঘাড়ের পেছনে দিয়ে চোখ বন্ধ করে নিরবতা পালন করছে তীব্র।
কিছুক্ষণ পর ড্রাইভারকে গাড়ি থামাতে বললো, গাড়ি থামতেই তীব্র গাড়ি থেকে নেমে এলো, রিফাত নামতে যাবে তখন তীব্র বলে উঠলো,
“গাড়িটা নিয়ে বাড়ি চলে যাও রিফাত।”
“কিন্তু স্যার!”
“কোনো কিন্তু নয়। যা বলছি করো।”
“স্যার আপনার মা বাবা টেনশন করবেন।”
“বাবা টেনশন করবে না, আর মাকে আমি ফোন করে বলে দিবো। তুমি যাও।”
না চাইতেও মাঝ রাস্তায় তীব্রকে ছেড়ে দিয়ে রিফাতের চলে যেতে হলো।
তীব্র উল্টো দিকে ঘুরে আনমনে ছন্নছাড়া গতিতে হেঁটে যাচ্ছে। কিছু একটা কারণে তীব্রর ভেতরটা বড্ড অশান্ত। ল্যাম্পপোস্টের নিচে বসে বসে সিগারেটের পর সিগারেট শেষ করে যাচ্ছে। আরেক হাতে পিস্তল নিয়ে ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে পর্যবেক্ষণ করছে।
তীব্রর বাবা সেলিম রেজা একজন উচ্চপদস্থ পুলিশ অফিসার ছিলেন, বর্তমানে রিটায়ার্ড অফিসার। তীব্রর মা একজন হাউজ ওয়াইফ। একটা বোন আছে তার নাম তৃপ্তি রেজা, বিয়ে হয়েছে মেয়েও আছে দুটো।
তৃপ্তির বিয়ে কোনো সরকারি চাকুরীজীবীর কাছে নয়, ইনসেপ্টা ওষুধ কোম্পানিতে উচ্চপদে চাকরী করে তৃপ্তির হাজবেন্ড। লাভ ম্যারিজ বলে এমনটা হয়েছে, এরেঞ্জ ম্যারিজ হলে ওকেও হয়তো কোনো পুলিশের কাছেই বিয়ে দিতো। এই টুকুই তীব্রর পরিবার।
তীব্রর বিয়ের বয়স হলেও ওকে বিয়ের কথা বলার সাহস কেউ পায় না। বাড়ির লোকদের সাথে তীব্রর সম্পর্ক তেমন ভালো না, আবার খারাপও না। শুধু খাবার টেবিলে বসে সবার মুখ একবার করে দেখতে পায়, কিন্তু স্ব -ইচ্ছায় কাউকে দেখে না, কথাও খুব কম বলে। কেউ কিছু জিজ্ঞেস করলে উত্তর দেয় ভালো মতো এইটুকুই ওর কথাবার্তা।
একটা ঝাপসা প্রতিচ্ছবি প্রতিবিম্বের ন্যায় দেখা যাচ্ছে। একজন যুবতী বয়সী নারী ছোটো ছোটো দুটো বাচ্চা নিয়ে ছুটছে একজন কোলে আরেকজনকে ডান হাতটা ধরে এগুচ্ছে। আর এই তিনজনের পেছন থেকে একটা নারী কণ্ঠী শব্দ আসছে,
“নিশান! …. নিশান! ……”
হঠাৎ করেই অন্ধকারে মিলিয়ে গেলো এদের অস্তিত্ব। কিছুক্ষণ পর আবার দেখতে পাওয়া গেল অন্য একটা তরুণী বয়সী কিশোরী মেয়ে, হাঁপাতে হাঁপাতে দৌড়াচ্ছে আর জোরে জোরে বলছে
“আপিইইই! ………আপিইইই! …..আপিইইই!.. মৃ!..”
পুরোটা বলার আগেই চোখ খোলে চিৎকার দিয়ে উঠলো মিশান।
হাঁপাতে হাঁপাতে শুধু একটা নামই উচ্চারণ করছে,
“নিশান! …… নিশান! …… নিশান!”
মিশানের চিৎকার চেঁচামেচি শুনে তাপসিন আর ওর মা বনিতা বেগম ছুটে এলো মিশানের রুমে, বনিতা বেগম মিশানকে জড়িয়ে ধরলো সাথে সাথে।
“মিশান মা কি হয়েছে মা? কি হয়েছে সোনা?”
মিশান কান্নাস্বরে ঢোক গিলতে গিলতে বলতে লাগলো,
“মিমি মিমিহ! মিমিহ! নিশান? নিশান?নিশান কোথায়?”
তাপসিন মিশানকে পানির বোতল এগিয়ে দিতে দিতে বলল,
“মিশান আপি শান্ত হও, নিশান আছে, ও তো আমার রুমে ছিল, ও আসছে তুমি পানিটা খাও, খাও।”
“নিশান তোর রুমে তাই না?”
“হুম।”
“ওকে আসতে বল, আমি ওকে দেখবো।দেখতে ইচ্ছে করছে খুব।”
মিশান অস্থিরতার সাথে ছটফট করতে করতে জোরে ডাকতে লাগলো,
“নিশান! নিশান! …”
তাপসিন হাতের চোলে পানি নিয়ে মিশানের মুখে ফিকে মারলো, মিশান পানির ঝাপটা খেয়ে চোখ বন্ধ করে নিলো।
চোখ খোলে পানির বোতল হাতে নিয়ে ঢকঢক করে পানি গিলে নিল, অত:পর আপনা আপনিই চুপ হয়ে গেল কি মনে করে যেনো। হয়তো স্বাভাবিক অবস্থায় ফিরে এসেছে। এতোক্ষণ দুঃস্বপ্ন দেখে অস্থির হয়ে গিয়েছিলো। স্বপ্নের ঘোরে মিশান কান্নাও করেছে, চোখ দুটো ভেজা টলমলে।
মিশান চুপ হওয়ার পর তাপসিন আর বনিতা বেগম বুঝতে পারলেন মিশানের দুঃস্বপ্নের ঘোর কেটে গেছে। তাপসিন লাইটটা অফ করে মাকে নিয়ে বেরিয়ে গেলো। বনিতা বেগমের চোখ দুটো ছলছল করছে, ভেজা গলায় বলতে লাগলো,
“আর কতকাল মিশানের এই যন্ত্রণা দেখতে হবে? মাঝে মাঝে মনে হয়, ওর এই রূপ না দেখতে চাইলে পৃথিবীলোক ত্যাগ করতে হবে আমার।”
“মা, কি আর করার যা হবার তা তো হবেই। আমাদের উচিৎ শক্ত হওয়া।”
তাপসিনের বাবার সামনে গিয়ে কান্না স্বরে বনিতা বেগম বলতে লাগলেন,
“টাকা পয়সার কি অভাব আছে? কত করে বলছি দেশের বাইরে নিয়ে মেয়েটার চিকিৎসা করাও তোমরা!”
“আহাঃ তুমি কেনো বুঝতে পারছো না?মিশানের ডক্টরদের ট্রিটমেন্টের থেকে আমাদের পাশে থাকা জরুরী। দেশে তো ওকে সাইক্রিয়াটিস্ট দেখাচ্ছিই রেগুলার।”
বনিতা বেগম তুচ্ছার্থক ভাবে বলল,
“কি জরুরী? আমাদের পাশে থাকা জরুরী? কি বুঝাতে চাস তোরা সবাই মিলে?মিশানের তো এই যন্ত্রণা রাতে গর্জে উঠে, যে সময় ওর পাশে ও কাউকে ভীড়তে দেয় না, একা একা থাকবে, আবার চিৎকারও করবে!
তাহলে আমরা কাছে থাকা বা না থাকায় কি যায় আসে? আর দেশের সাইক্রিয়াটিস্ট দেখিয়ে নূন্যতম পরিমাণেও যদি উপকার হতো তাহলে মেনে নিতাম, কোনো লাভ হচ্ছে কি?আরো ভয়াবহ হয়ে যাচ্ছে ওর অবস্থা!”
কথাগুলো বলতে বলতেই কেঁদে দিলেন বনিতা বেগম।
এদিকে মিশান দেয়ালের সাথে গুঁটিশুঁটি মেরে বসে আছে, হুঁশ ফেরার পর মনে পড়েছে নিশান আসলে নেই, নিশান কেবলি মিশানের কল্পনাতে সীমাবদ্ধ। চাইলেও নিশানের অস্তিত্বকে পাবে না, কেবলই ওর কবরের মাটি ছাড়া আর কোনো অস্তিত্ব নেই!
পাথরের মতো নিরব হয়ে চোখের পানি ফেলে যাচ্ছে মিশান। এরকম বিষন্ন প্রহর শুধু আজই নয়, এটা মিশানের মস্তিষ্কের বিশেষ অংশ জুড়ে আছে।
“স্বপ্ন!সেটা কি?
একজন মানুষ বছরে গড়ে ১,৪৬০ টা স্বপ্ন দেখে। মানে প্রতিরাতে গড়ে ১০ টা স্বপ্ন। আর যদি এই দশটা স্বপ্ন একই রূপে আসে দুঃস্বপ্ন হয়ে?
একটা ঘন অন্ধকার নিরিবিলি কনকনে রাত আর দুঃস্বপ্ন, নয় কি ঘুমটাকে ছিকেই তোলা আর রাতটাকে বিষাক্ত করে দেয়ার জন্য যথেষ্ট? সাধারণ মানুষের স্বপ্নের স্থায়িত্বকাল ৩-৫ সেকেন্ড, শক্তিশালী মানুষের স্বপ্নের স্থায়িত্বকাল ৭ সেকেন্ড। ঘুম থেকে উঠার পর ব্রেইন সেই ৩-৫/৭ সেকেন্ডকে ঘন্টা ব্যাপি স্টোরি বানিয়ে দেয়। যার রেশ ঘুম থেকে উঠার পরও থেকে যায়। দশটা দুঃস্বপ্নের রেশ থেকে যায় সারাটি রাত!
এই ঘটনা যদি হয় প্রতিরাতের তবে রেশ থেকে যায় সারাজীবন!
আর এই রেশ গুলোই একটু একটু করে খুঁড়ে খুঁড়ে খাচ্ছে আমার মস্তিষ্ক! স্বপ্ন গুলো কেনো আমার পিছু নিয়েছে সে প্রশ্নের খুঁজে আমি উদগ্রীব!
কি আছে এই স্বপ্নের আড়ালে! কিছু ইংগিত দিচ্ছে কি আমায়?”
তাপসিন এসে মিশানের পাশে চুপচাপ বসলো, মিশান তাপসিনকে শান্ত স্বরে জিজ্ঞেস করলো,
“কয়টা বাজে?”
“১ টা।”
“মামা ফিরেছে?”
“হুম।”
“দ্বীপ কবে ফিরবে?”
“ঠিক নেই।”
“সকাল হতে অনেক দেরি তাই না?”
“হ্যাঁ”
মিশান দীর্ঘশ্বাস ফেললো,
“বাইরে যাবে আপি?”
“হুম।”
“দাঁড়াও আমি রেডি হয়ে আসছি।”
“তুই থাক আমি একাই যাবো।”
“না, একা যেতে দেবো না। ভাইয়া একা ছাড়তে বারণ করেছে।”
তাপসিন উঠে নিজের রুমে গেল। মিশান উঠে দাঁড়ালো, টিশার্টের উপর একটা শার্ট পড়ে মাথায় কালো রঙের একটা স্পোর্টস ক্যাপ পড়ল,
মিশান আর তাপসিন চুপচাপ বেরিয়ে পড়লো বাড়ি থেকে।
গাড়ি নিয়ে বের না হয়ে, পায়ে হেঁটে দুজনে বেরিয়ে পড়লো।
মিশান ওর মামা মামীর সাথে থাকে, তাপসিন দ্বীপ দুইজন মামাতো ভাই।মিশানের বাবা-মা আছে কি নেই সেটা সঠিক জানে না। বয়স আর মস্তিষ্কের কিছু ত্রুটির জন্য মনে নেই। মিশানের মনভোলা রোগ টা প্রখর, শুধু একটা ব্যাপারে মিশানের মনভোলা রোগ নেই, যেটা ওর মস্তিষ্কের মধ্যে সেট করা থাকে।
মিশানের মনভোলা রোগটা অনিচ্ছাকৃত নয়, এটা ওর নিজের তৈরি একটা অভ্যেস। ইচ্ছে করেই অপ্রয়োজনীয় জিনিস ভুলে যেতে পছন্দ করে, আর সফলও হয়। ব্যাপারটা আজব হলেও ঘটনা সত্যি।
তীব্র হাতের পিস্তলটা ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে পর্যবেক্ষণ শেষ করে একটা রুমাল দিয়ে পিস্তলটা মুছলো। মুছা শেষ করে রুমালটা পাশেই বিছিয়ে রাখলো অত:পর সেই রুমালের উপর পিস্তল রেখে তীব্র উঠে চলে গেল।
আস্তে আস্তে হাল্কা কুয়াশাচ্ছন্ন অন্ধকারে মিলিয়ে গেলো।
একটা জুসের প্যাকেট হাতে নিয়ে স্ট্র মুখে দিয়ে জুস চুষে চুষে খাচ্ছে আর সামনের দিকে হাঁটছে মিশান,পাশেই তাপসিন। মিশানের হাঁটার সঙ্গী হয়ে আছে,আর কোল্ড ড্রিঙ্কস খাচ্ছে।
“আপি পা ব্যাথা করছে চলো কোথাও বসি।”
“কেমন ছেলে তুই এই টুকু পথ হেঁটে হাঁপিয়ে গেলি! চল ফুটপাতেই বসি।”
“চলো।”
এদিক ওদিক তাকাতাকি করে একটা ল্যাম্পপোস্টের নিচে বসলো দুজন, বসে বসে কথা বলছে এমন সময় মিশান খেয়াল করলো ওর বাম পাশে একটা রুমালের উপর পিস্তল। কোনো প্রকার বিব্রতবোধ না করে কিছু না ভেবেই পিস্তলটা হাতে নিলো, মিশান ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে দেখে বলে উঠলো,
“বাহ জোস তো!”
মিশানের হাতে পিস্তল দেখে তাপসিন খানিকটা হকচকিয়ে গেল,
“আপি পিস্তল কোথায় পেলে?”
“আরে এটা এখানে ছিলো।”
“দেখে তো মনে হচ্ছে না এটা খেলনা! ”
“খেলনা পিস্তল না অরজিনাল,Golck19! ”
“এতো রাতে এটা এখানে কে ফেলে গেলো!”
“যেই ফেলুক প্ল্যানিংয়ের সাথে ফেলেছে ভুলে ফেলে যায় নি।”
“কি করে বুঝলে?”
পিস্তলের নিচে থাকা রুমালটা মিশান হাতে তুলে নিয়ে তাপসিনকে দেখালো,
“দেখ এই রুমালটা সুন্দর করে বিছানো ছিলো এখানে, আর তার উপর পিস্তলটা।
এটা একদম নতুন পিস্তল, ইউজ করা হয়নি, তার উপর ফুল লোড করা!”
“তুমি তো এটা খুলে দেখো নি, বুঝলে কি করে ফুল লোড?”
“আরে হাতের অনুমান আছে না একটা, উইদাউট ম্যাগাজিন এটার ওজন হতো 21 আউন্স বা 1.31 পাউন্ডস। এন্ড উইথ লোডেড 15 ম্যাগাজিন 30 আউন্স বা 1.785 পাউন্ডস। হাতে নেয়ার পর ওজন যা আন্দাজ করতে পারছি এটার ওজন 1. 785 পাউন্ডস ই হবে, এতেই স্পষ্ট বুঝা যাচ্ছে ফুল লোড করা।”
“জায়গারটা জায়গায় রেখে দাও, আবার ফেঁসে যাব কোন ঝামেলায়।”
“এটা রেখে দিলে আরো বেশি ঝামেলাতে পড়বো, আমার আঙুলের ছাপ পাওয়া যাবে, বেখেয়ালে খালি হাতে ধরে ফেলেছি পাশে রুমালটা থাকা সত্ত্বেও।”
“এখন কি করবে তাহলে? একটা স্প্রে কিনে আনি? মুছে রেখে চলে যাই!”
“শান্ত হ, কিছু হবে না। এটা সাথে করে নিয়ে যাই, দিনের বেলা থানায় জমা দিয়ে দেবো। এটা এখানে এভাবে রেখে গেলে কার না কার হাতে পড়বে আর ঝামেলা হয়ে যাবে।”
“আমার ভয় লাগছে আপি কেনো জানি মনে হচ্ছে এটা নিয়ে প্রবলেম হবে। কেউ জেনে বুঝে ফাঁসাচ্ছে না তো?”
মিশান ভেংচি মেরে বলল,
“আরে কিছু হবে না, সব কিছু এতো সিরিয়াসলি নিস কেনো? স্বাভাবিক হ! কিচ্ছু হবে না। খালি নেগেটিভ চিন্তা মাথা ভর্তি। এই জন্যই তোকে নিয়ে বের হতে ইচ্ছে করে না, দ্বীপ আমার মন মতো আছে, তোর মতো ভীতু না দ্বীপ। বড় ভাইকে দেখে শেখ। গর্ধব কোথাকার।”
তাপসিন ভয়ে চুপ হয়ে রইলো।মিশান এবার শান্তস্বরে বললো,
“এটা দিয়ে তো আজ রাতে মার্ডার হবে না, আমার কাছেই থাকবে। আমার কাছে মানে সেফ থাকবে। এটা এখনে রেখে যাবো তারপর উপরওয়ালা না করুক, যদি কোনো বাচ্চার হাতে পড়ে যায়, খেলনা ভেবে অকারেন্স করে ফেলবে।”
-দেশের যা অবস্থা আতংকে থাকি, পুলিশ ই সাধারণ মানুষের পকেটে গাঁজা ঢুকিয়ে দিয়ে আসামী বানায়, আর সেখানে এটা তো একটা মৃত্যু যন্ত্র! থানায় নিয়ে গেলেও একশো একটা জেরা করবে।”
“তোর চিন্তা করতে হবে না, এটা আমি বুঝবো। আমি থানায় একাই যাবো,জেল দিলেও সমস্যা নেই আমার।”
কথার মাঝেই মিশানের ফোনে আন নোওন নাম্বার থেকে কল এলো।
রিসিভ করে কানে নিল,
“হ্যালো!”
ফোনের ওপাশ থেকে কোনো শব্দ নেই,মিশান পুনঃরায় বলল,
“হ্যালোওও!”
এবারও কোনো শব্দ এলো না।
কোনো শব্দ আসছে না ওপাশ থেকে কেবলই এক দল বিক্ষিপ্ত বাতাসের প্রকট আওয়াজ আসছে।
মিশান অনেক্ষণ হ্যালো হ্যালো করল, ওপাশ থেকে কোনো মানুষের অস্তিত্ব অনুভব হলো না।
“কি শালা কবর থেকে কল দিয়েছিস নাকি? নেট কম? কথা বুঝা যায় না? বাবা কি নতুন ফোন কিনে দিয়েছে? কল দিয়ে কথা বলছিস না কেনো?”
বকতে বকতেই ওপাশ থেকে কল কেটে গেলো। ফোন কান থেকে সরিয়ে পকেটে রাখলো,
“কিসব মানুষরে এরা!”
“কি হয়েছে আপি?”
“আরে নিজেও বুঝতে পারছি না, প্রতি রাতে একেকটা আননোওন নাম্বার থেকে কল আসে, কিন্তু ওপাশের আওয়াজ একই রকম প্রকন্ড বাতাসের মতো তীব্র প্রকট আওয়াজ কানের পর্দাতে বিঁধে পড়ে। কোনো মানুষ কথা বলে না।আমি শিউর এসব গুলো নাম্বারের মালিক একজনই হবে, কিন্তু কে সে সেটাই বুঝতে পারছি না!”
অসহায় ভঙ্গীতে তাপসিন বলল,
“আপিইই”
“বল”
“আমার কাছে কেমন জানি রহস্যময় লাগছে ব্যাপারটা! কোনো বিপদে ফেঁসে যাবো না তো আমরা?”
চলবে…………