গল্প- তেজস্ক্রিয় রক্তধ্বনি
পর্ব- ৩৯
লেখিকা- রিয়া খান
গুটিশুটি মেরে বসে মিশান কাবু হয়ে কাঁদছে, নেশা করেও যেনো যন্ত্রণা বুলছে না। ঝলক মিশানের জীবনে কি সেটা কেবল মিশানই জানে।
ভালোবাসার মানুষ বিশ্বাস ঘাতকতা করলে তাকে মন থেকে সরানো যায়। কিন্তু যদি অফুরন্ত ভালোবাসা দিয়ে না চাইতেও পৃথিবীলোক ত্যাগ করতে হয়, তবে তাকে সরানো যায় না।প্রবাদে আছে, প্রথম প্রেম কখনো ভুলা যায় না। মিশানের ক্ষেত্রে এই প্রবাদের চেয়ে বেশি কার্যকর “ভালোবাসার মানুষটা যদি সত্যি হয় তখন পৃথিবীটা মিথ্যে হয়ে যায়।
রাত ফুরানোর আগেই মিশান বাড়ি ফিরে আসে। বিছানায় কিছুক্ষণ পড়ে থাকে, অস্থিরতা যেনো কাটছেই না। অত:পর শাওয়ারের নিচে কিছুক্ষণ চুপচাপ বসে থেকে ফ্রেশ হয়ে লেবু আর আদার রসের চা খায় বেশি করে, এবার মাথা হাল্কা লাগছে।
যন্ত্রণাময় এ রাত গুলো থেকে কবে নিস্তার পাবে জানা নেই মেয়েটার।
অন্ধকারে ঘরে ইজি চেয়ারে বসে সিগারেট টানছে আর ধোঁয়া দিয়ে চারপাশ ভরিয়ে ফেলছে তীব্র, এক হাতে সিগারেট আরেক হাতে একটা ছবি।ছবিটা ঝলকের।
তীব্র ঝলকের ছবিটা দেখে গম্ভীর স্বরে বললো,
-“সত্যি” কি একটা জিনিস তাই না? কখনো চাপা থাকে না,কিন্তু চাপা রাখা যায়!যার যতো প্রভাব প্রতিপত্তি তাঁর সত্যি ততো গভীরে চাপা।
ঝলক! তুমি আমাকে বুঝিয়ে দিয়েছো সিনেমাতে ভিলেনরা হেরে গিয়ে হিরোরা জিতে যায়।কিন্তু বাস্তবে তাঁর উল্টো! দিন শেষে ভিলেনদেরই জয় হয়,যেমনটা আমার হচ্ছে। তোমার মতো হিরোদের মিথ্যে মৃত্যুর তদন্ত বিহীন কাগজের ভীড়ে পড়ে থাকে সমস্ত সত্যি। হেলিকপ্টার ক্র্যাশ! হা হা হা! কত্তবড় জোকস! দেখেছো? তোমার ডিপার্টমেন্টও কেমন অসহায়! জেনেও যেনো কিছু জানে না।মানলাম তাঁরা কিছুটা কম জানে,কিন্তু মেইন টুকু তো জানে।
সত্যিটা কেবল ঝলক আর তীব্রর মাঝেই সীমাবদ্ধ!
এই যে সুপারস্টার ঝলক! দুনিয়া থেকে তোমার নামটা তো সফল ভাবে উচ্ছেদ।
তোমার নামটা মিশানের অন্তর থেকে উচ্ছেদ কি করে করা যায়? সত্যিটা মিশান কোনোদিন জানবে না,মিশান জানবেও না আমাদের দুজনের মাঝে একজন খুনি!
আমিও ওকে জানাতে পারবো না কারণ এতে হিতে বিপরীত হয়ে যাবে, মিশান তীব্রর নাম এমনিতেই অপছন্দ করে, এরপর তো দেখা যাবে রীতিমতো আমাকে ঘৃণা করবে। তাঁর চেয়ে বরং ওর সব কিছু অজানাই থাক।
আমি বরং ওর সাথে ভালোবাসার নাটক,অভিনয় সিনেমা সব চালিয়ে যাই, দেখা গেলো দিন শেষে ও ঝলক নাম মুছে তীব্র নাম বসাতেও পারে। তখন চলবে তীব্র মিশানের লাভ স্টোরি! এভাবেই চলবে মৃত্যুর আগে অব্ধি।ঝলক তো আর হতে পারবো না, তীব্র তীব্রই।
নেগেটিভ চরিত্র গুলো এমনই হয় ঝলক, মুখোশের আড়ালে কে কতো ভয়ংকর বা সাধু সেটা কেবল মুখোশধারীরাই জানে।ঝলক তোমার কি কষ্ট হচ্ছে? মিশানকে তীব্র এতো কষ্ট দেয় বলে?
একদিকে তীব্র মিশানকে মদ খেতে সাহায্য করে, আরেকদিকে ঝলক মিশানকে নেশা থেকে দূরে সরিয়ে রাখতো। তীব্র মিশানকে দিয়ে নিজের রাস্তা পরিষ্কার করে, আর ঝলক মিশানের জন্য নিজেই রাস্তা হয়ে যেতো। তীব্র মিশানকে দিয়ে স্বার্থ সিদ্ধি করে, ঝলক মিশানের জন্য জীবন বিসর্জন দিতো।
ঝলক যদি হয় মিশানের অস্তিত্ব, তীব্র তাহলে ছায়াভূত!
ভাবছি মিশানের সাথে এখন থেকে ভালো ব্যবহার করবো, অনেকটা ঝলকের মতো, এরপর মিশান ঝলকের অস্তিত্ব ভুলে তীব্রকেই চাইবে। তারপর? তারপর মিশান পুরো তীব্রর কনট্রোলে!
সব হিসেব ইকুয়াল ইকুয়াল!
নিজের কাঁধে নিজেই হাত রেখে বললো,
-বেস্ট অফ লাক তীব্র…!
কথা গুলো বলেই তীব্র ডেভিল স্মাইল দিলো।
সকাল হওয়ার পর সাদেক খান উঠে হাঁটতে হাঁটতে নিজের ঘর থেকে ড্রয়িংরুমে আসতেই দেখে মিশান পায়ের উপর পা তুলে বসে চা খাচ্ছে।
-আজকে অনেক তাড়াতাড়ি উঠেছো মনে হচ্ছে।
-ঘুমাই ই নি, কি আর উঠবো!
-ডক্টরের রুটিন ফলো করে কি কোনো ফল আসছে না?
-চা খাবেন মামা?
সোফায় বসতে বসতে সাদেক খান উত্তর দিলেন,
-আনো এক কাপ।
মিশান উঠে গিয়ে মামার জন্য চা করে আনে।মামার হাতে দিতে দিতে আবার বসে পড়ে।
-আপনার সাথে আমার কিছু কথা আছে মামা।
মিশানের কথাটা শোনার পর সাদেক খান ওর দিকে একটু আশ্চর্যান্বিত দৃষ্টিতে তাকালো,উনি আস্তে করে উত্তর দিলেন।
-বলো,
– দু বছর হয় ই,ভুলার কথা না।
মেজর ঝলকের কথা মনে আছে?
-হ্যাঁ থাকবে না কেনো?তোমার আর্মিতে ঢুকার সময় তো অই ছিলো তোমাদের টিমের দায়িত্বে।রাঙামাটি যাওয়ার পর থেকেই তো তোমরা এক ইউনিটের ই ছিলে।
বড্ড ভালো ছেলে ছিলো, কিন্তু ভাগ্য এতো নির্মম, পৃথিবী ছেড়ে চলে যেতে হলো।
-ঝলক স্যারের মৃত্যু কি করে হয়েছিলো মামা?
-ট্রেনিংয়ের সময় হেলিকপ্টার ক্র্যাশ করে।তুমি তো সেবছর ই কুয়েত থেকে এলে।কুয়েত থেকে আসার সাতদিন আগে এক্সিডেন্ট টা হয়,এরপর হসপিটালে এডমিট থাকে তারপর মারা যায়, তুমি আসার আগের দিন রাতে।
-যে দেশে বাতাবিলেবুর বাম্পার ফলনের খবর সরকারী টিভি চ্যানেলে দেখায় সেদেশের রাজধানীর ক্যান্টনমেন্ট থেকে,
একজন মেজর মারা গেলো হেলিকপ্টার ক্র্যাশ করে অথচ কোনো নিউজ চ্যানেল সেটা জানালো না।ক্যান্টনমেন্টের ভেতরেই সব কিছু চাপা রইলো!
আপনারা আর্মি ডিপার্টমেন্ট কি কিছু লুকাচ্ছেন মামা?
-লুকানোর কি আছে এখানে,এটা তো স্বাভাবিক মৃত্যু। কত সৈন্য প্রতিবছর হেলিকপ্টার ক্র্যাশ, গ্রেনেড ব্লাস্ট, আরো নানান রকম এক্সিডেন্টে মারা যাচ্ছে এগুলো তো প্রকাশ করা হয় না মিশান।এগুলো যদি প্রকাশ করা হয় তাহলে আম জনতা ভাববে বাংলাদেশ ডিফেন্সের চাকরিতে কোনো লাইফ সিকিউরিটি নেই। সৈন্যদের জীবন ঝুঁকিপূর্ণ।
এগুলো কি প্রকাশ করা যায়?
মিশান চোখ ঘুরিয়ে সাদেক খানের দিকে তাকিয়ে বললো,
-কেনো জানি মনে হচ্ছে ঝলক স্যার হেলিকপ্টার ক্র্যাশ করে মারা যায় নি। আমরা তো ট্রেনিংয়ের সময় লাইফ জ্যাকেট, বুলেট প্রুভ জ্যাকেট কতকিছু ব্যাবহার করি, আর হেলিকপ্টারে থাকলে প্যারাসুট ও রাখি।
হিসেব এটাই দাঁড়ায় না, হেলিকপ্টারের ত্রুটি যখন দেখা দেয় তখনি আমরা ঝাঁপিয়ে পড়ি প্যারাসুট নিয়ে?ইচ্ছে করে কেউ নিজের প্রাণ রেখে হেলিকপ্টার বাঁচাতে যাবে না।
আর ঝলক স্যার এতোটাও কেয়ারলেস না যে এরকম একটা সেইফটি ইউজ না করার মতো ব্লান্ডার করবে।আমি কনফার্ম, হেলিকপ্টার ক্র্যাশ করেনি।
ঝলক স্যারের মৃত্যুটা অন্যভাবে হয়েছে।
সাদেক খান কিছু একটা বলতে যাবে অমনিই পেছন থেকে মিশানের মামী বলে উঠলো,
-সাত সকালে মামা ভাগ্নীর কি কথোপকথন চলছে শুনি?আমিও কি ভাগীদার হতে পারি?
সাদেক খান হাল্কা হেসে বনিতা বেগমের উদ্দেশ্যে বললো,
-কেনো পারবে না আসো, বসো।তুমিও কি চা খাবে?
-চা কে করে দিলো?বুয়াও তো উঠেনি এখনো।
– মিশান করেছে,তুমি খাবে?
বনিতা বেগম মিশানের পাশে বসতে বসতে উত্তর দিলো,
-নাহ, আমি তোমাদের মতো সকাল বেলা খালি পেটে চা খেতে পারি না।সকালের নাস্তার পরই খাবো চা।
-খেলে বলো মিমি,পাতিলে আরেকটু চা আছে, এক কাপের মতো আছে হয়তো।
-পরে খেয়ে নিবো মা। তুই বল হাল্কা পাতলা কিছু দেবো এখন?
-নাহ!খেয়েছি ফ্রিজে যেনো কি কি ছিলো।
-ভালো করেছিস।
মিশান কাপের চা সম্পূর্ণ খাওয়া শেষে , উঠে দাঁড়িয়ে বললো,
-মামা আমি একটু বের হবো। দ্বীপ, তাপসিন ঘুম থেকে উঠলে ওদের নিয়ে বের হইয়ো।
-তুমি তো রাতে ঘুমাতে পারোনি তাহলে একটু ঘুমানোর চেষ্টা করো।
-নাহ বাইরে হাঁটলে একটু সতেজ লাগবে, ঘুম আসবে না এখন।আমি গেলাম।
মিশান চলে গেলো।ড্রয়িংরুমে বনিতা বেগম আর সাদেক খান বসে রইলো। সাদেক খান একটু হতাশাময় স্বরে বললো,
-বুঝতে পারছি না মেয়েটা সুস্থ হচ্ছে নাকি আরো অসুস্থ। কেনো জানি মনে হচ্ছে মিশানের মনভোলা রোগের সাথে তালগোল হারানোর রোগও হয়েছে।
-কেনো কি হয়েছে?
-তুমি কি খেয়াল করেছো,মিশান আপনি তুমি সম্বোধনের তাল হারিয়ে ফেলছে।ও কখনো আমাকে আপনি করে বলছে,কখনো তুমি।
বনিতা বেগম আশ্চর্যরকম হয়ে উত্তর দিলো,
-এটা তোমার সাথেও হয়েছে? আমার সাথেও বেশ কয়েকদিন ধরে হচ্ছে,মাঝে মাঝে মনে হয় মিশান আমাকে চেনেই না।।কেমন যনো একদৃষ্টিতে অচেনা ভাব নিয়ে তাকায়, কোনো কথা বললে সাড়া দেয় না। আবার কখনো আপনি করে কথা বলে, কখনো তুমি।
মিশান হয়তো নিজেও জানে না ওর এই সমস্যাটা হয়েছে, না হলে ও এটা নিয়ে অনেক বিব্রত থাকতো।
সকাল বেলা পার্কে অন্যমনস্ক হয়ে হাঁটাহাঁটি করে বাড়ি ফিরে আসে,দ্বীপ তাপসিন সারাপথ এতো কথা বলেছে মিশান একটা উত্তরও দেয় নি। ওর মাথায় ঘুরছে ঝলকের মৃত্যু রহস্য উৎঘাটনের চিন্তা।
আদৌ কি ঝলকের মৃত্যু এক্সিডেন্ট নাকি ইন্সিডেন্ট!
মামা অফিসের জন্য বেরিয়ে যাওয়ার পর মিশান দ্বীপের বাইক নিয়ে বেরিয়ে যায়।
মিশানের মামা ক্যান্টনমেন্টে না গিয়ে অন্যদিকে চলে যায় এতে মিশানের সুযোগ ই হলো, মামার সামনে পড়বে না। মিশান বাইক নিয়ে সোজা ক্যান্টনমেন্টে যায়।
বেশ কয়েকজন পরিচিত মুখের সম্মুখীন হতে হয় ভেতরে । হেলমেট খোলার পর অনেকে একদৃষ্টিতে মিশানের দিকে তাকিয়ে থাকে কারণ চাকরি ছাড়ার পর মিশান এই ক্যান্টনমেন্টে পা ও ফেলে নি। অনেকে মিশানকে দেখে ভালোমন্দ জিজ্ঞেস করে, তাদের সাথে কুশল বিনিময়ের পর মিশান ওর ঘনিষ্ঠ এক সিনিয়র ব্রিগেডিয়ার জেনারেল এমদাদ রহমানের অফিসে যায়।
তাঁর কাছে আসার জন্য মিশানের অ্যাপয়েন্টমেন্টের প্রয়োজন নেই।উনার সাথে সেনাবাহিনীতে আসার আগে থেকে পরিচয় মামার মাধ্যমে,বলা চলে ছোটো বেলা থেকেই।মিশানকে অনেক আদর করে।
আর এই ক্যান্টনমেন্টে থাকাকালীন সময় সম্পর্ক আরো ভালো হয়,উনি মিশানকে ছেলের বউ বলে পরিচয় দেন,অফিসিয়াল কাজের বাইরে সব সময় মিশানকে বৌমা বলে ডাকেন।বেশ রসিক মানুষ উনি।
মিশানকে ছোটো বেলা থেকে এতোটা পছন্দ করেন উনি যে, উনি চাইতো উনার কোনো ছেলে থাকলে মিশানকে ছেলের বউ বানাবে,দুর্ভাগ্যবশত উনার ছেলে নেই,চারটা মেয়ে আছে । তাই মিশানকে ছেলের বউ মেনেই তাঁর ভেতর শান্ত্বনা দেয়।
-আসসালামু আলাইকুম স্যার!
-আরে কে এসেছে!আমার বউমা!এতোগুলো দিনে একবারও মনে পড়েনি শ্বশুর বাপটার কথা?
মিশান মুখ শুকনো করে উত্তর দিলো,
-আমার মনভোলা রোগ হয়েছে স্যার, মামার থেকে শুনেছে নিশ্চয়।
-হুম তা তো শুনেছিই,বসো মা ।
মিশান চেয়ার টেনে বসলো,
-তোমার রোগটার কি অবস্থা মা?ইম্প্রুভ কিছু হয়েছে কি? শুনলাম ইন্ডিয়াতেও গিয়েছিলে সাদেক সাহেব বললো তুমি নাকি ইদানীং রাতবিরেত মিসিং হয়ে যাও।
-ও কিছু না স্যার। দম টা একটু বন্ধ হয়ে আসে সেজন্য বাইরে দিয়ে হাঁটাহাঁটি করি,এর বাইরে কিছু নয়।
-হাঁটতে বের হলে ভালো কিন্তু হারিয়ে যেও না আবার সেদিকে খেয়াল রেখো। তারপর বলো কি খাবে এখন?যা গরম পড়েছে ঠান্ডা এক গ্লাস জুস খাও?
-জুস খাবো না, আমাকে একটা ঠান্ডা নিউজ দিন তাহলেই হবে।
-কিসের নিউজ?
-আমাদের ইউনিটের মেজর ঝলক স্যার যে হেলিকপ্টার ক্র্যাশ করে আহত হয়ে হসপিটালে ভর্তি হয়, তাঁর মেডিকেল রিপোর্ট, এবং গুরুতর আহত হওয়ার কারণে যে তাঁর মৃত্যু হয় সেই স্ট্যাম্প বলুন বা রিপোর্ট এগুলোর সব কিছুর ফটোকপি হলেই হবে, এসবের পেপারস কোথায় আছে আপনি জানেন আমার মতে।যদি পারমিশন লাগে আলাদা, তাহলে বলুন আমি জেনারেল স্যারের কাছে যাবো পারমিশনের জন্য।
-কিন্তু এগুলো দিয়ে কি করবে তুমি?
-স্যার ঝলক স্যারকে কি সিএমএইচেই এডমিট করা হয়েছিলো?
-প্রথমে তো সি এম এইচেই আনা হয় এরপর এখান থেকে সিঙ্গাপুর পাঠানো হয়, অবস্থা অনেক জটিল ছিলো।ওর মৃত্যু সিঙ্গাপুরেই ঘোষণা করা হয়।আর ঝলকের কোনো মেডিকেল রিপোর্ট আমার কাছে নেই, যার কাছে আছে আমি তাঁর নাম প্রকাশ করতে পারবো না, তবে এইটুকু বলতে পারি সে আমাদের ডিপার্টমেন্টের ই।
-স্যার আপনারা কিছু একটা লুকাচ্ছেন।ঝলক স্যারের মৃত্যু আদৌ এক্সিডেন্ট তো?
একটা মৃত্যুকে কেনো রহস্য বানাচ্ছেন? আমি শিউর ডিপার্টমেন্ট ঝলকের মৃত্যুর কারণটাকে রহস্য বানিয়ে রেখেছে।
-মিশান!তুমি এতো দিন যাওয়ার পর কেনো এটা নিয়ে উঠে পড়ে লেগেছো?তোমার কি লাভ সত্যি মিথ্যে উৎঘাটন করে?যে মরে গেছে তাকে তো আর ফেরাতে পারবে না।ঝলকের পরিবারের কেউ ও আসেনি এটা নিয়ে কথা উঠাবার।
বাদ দাও,অতীত অতীতেই রাখো।
মিশান কিছু বলতে গিয়েও থেমে যায়, মাথা চেপে কিছুক্ষণ চুপ করে বসে রইলো।
-কি ভাবছো মিশান?
মিশান শান্ত দৃষ্টিতে তাকিয়ে বললো,
– কিছু মনে করবেন না স্যার।আমার মাথায় যেন কিসব হুটহাট উদ্ভট চিন্তাচেতনা আসে,আর কিসব করি,এখানে কেনো এসেছি মনে আসছে না। আপনার কাছে কি কারণে পেপারস গুলো চাইছি তাও মনে পড়ছে না, আপনি যখন বললেন” বাদ দাও,অতীত অতীতেই রাখো” তখন মনে হলো আমি এসব কি কারণে চাইছি। সরি স্যার! আপনার মূল্যবান সময় নষ্ট করলাম এভাবে, আ’ম এক্সট্রিমলি সরি স্যার!
-তোমার অবস্থা বুঝতে পারছি মিশান,শরীরের সাথে ব্রেইনটাকেও বিশ্রাম দিও।একটু সুস্থ হওয়ার চেষ্টা করো। ওষুধ ঠিক মতো খেও।
-শিউর স্যার, ওকে স্যার এখন আসি তাহলে।
-বসো, কিছু খাও।
-না স্যার অন্যদিন, আমি আসি। মিমি বাড়ি চলে যেতে বলেছে ।
মিশান উল্টা পাল্টা আরো কিছু কথা বলে এমদাদ রহমানকে বিব্রত করে চলে গেলো।
এমদাদ রহমান মিশানের যাওয়ার দিকে তাকিয়ে রইলো।
মিশান বেরিয়ে যাওয়ার পর, ল্যান্ড ফোন দিয়ে মিশানের মামাকে ফোন দিলো ,
-সাদেক সাহেব!
-জ্বি স্যার।
-মিশানের অবস্থা আসলেই জটিল রূপ নিয়েছে, ওকে আরো ভালো সাইক্রিয়াটিস্ট দেখানো প্রয়োজন আমার মতে। একটু আগে আমার কাছে এসে ঝলকের মৃত্যুর তদন্ত শুরু করে দিলো পরক্ষণেই ভুলে গেলো ও কেনো করছে এসব।
-মিশান কি আপনার অফিসে এসেছিলো?
-হ্যাঁ, মাত্র চলে গেলো। ওর কথা বার্তার ধরণ খুবই অসুস্থ লাগলো।আগে আমার অফিসে ঢুকেই একটা মিষ্টি হাসি দিয়ে কত হাসিখুশি ভাবে কথা বলতো আর আজ সম্পূর্ণ ভিন্ন!
খুব বেশি কথোপকথন হয় নি ওর সাথে ।তবে যতোটুকু হলো তাতে আমার কেনো জানি মনে হলো, মিশানের বদ্ধ উন্মাদ হতে খুব বেশি দেরি নেই।
একে একে মিশানের মামাকে সবটা খুলে বলতে লাগলো মিশানের সাথে যা যা কথা হয়েছে।সাদেক খান রীতিমত চিন্তিতো হয়ে পড়লো মিশানকে নিয়ে।
মিশান বাইরে বের হয়ে নিজেকে বকতে লাগলো অনবরত,
-মিশান! কি করছিস?পাগলের অভিনয় করতে করতে কি সত্যি সত্যি পাগল হয়ে গেলি? নিজের কাজে নিজেই তাল পাচ্ছিস না! জনে জনে এভাবে ঝলকের কথা জিজ্ঞেস করলে তো সবাই এলার্ট হয়ে যাবে! আর যদি কখনো বের হয় ঝলকের এক্সিডেন্ট না হয়ে পরিকল্পিত মার্ডার হয়েছে,তাহলে তো আমি সব কটাকে গর্ত থেকে টেনে বের করবো।ওরা মরলে তো সবার আগে আমাকেই ধরা হবে! নিশানের খুনিদের নিজের হাতে শাস্তি দেয়ার জন্য যেমন নিশানের মৃত্যুর আসল রহস্য চাপা রেখেছি।ঝলকের ক্ষেত্রেও চুপে চুপে থেকে সব উৎঘাটন করে চুপে চুপেই সব ফিনিশ দিতে হবে।
আচ্ছা তীব্র স্যার ই তো প্রথম এটা বলেছে আমাকে,উনি কি কিছু জানে?উনার কথার ধরণও কেমন সন্দেহ জনক লাগলো।অই শালা ইয়ারফোনের প্যাঁচ, ভালো কথাতেও প্যাঁচ লাগায় , সোজা ভাবে তো কিছু বলবেও না।কোনো ভাবে মাইনক্যা চিপায় ফেলতে পারলে সব কেঁচো গর্ত থেকে বের হতো।
নানান রকম কথা নিজের সাথে বলতে বলতে মিশান বাইক নিয়ে ক্যান্টনমেন্ট থেকে চলে গেলো।
অনেকদূর যাওয়ার পর রাস্তায় লম্বা অনির্দিষ্ট কালের জ্যামে আটকা পড়লো বাইক নিয়ে। কড়া রোদে গায়ের লোম পুড়ে যাওয়ার উপক্রম। হেলমেট থাকা সত্ত্বেও যেনো মনে হচ্ছে তাপ হেলমেট ভেদ করে মাথায় তীর্যকভাবে পড়ছে।
গাড়ি ঘুরানোর মতোও পরিস্থিতি নেই।রোডের সাইডে থাকার কারণে,বাইক স্ট্যান্ড করে রাস্তার দোকান থেকে একটা ঠান্ডা স্প্রাইট কিনে এনে আবার বাইকের উপর বসে। মাথা থেকে হেলমেট খুলে সানগ্লাস পড়ে এদিক ওদিক তাকাতাকি করছে আর স্প্রাইট খাচ্ছে।
মিশানের বাইকের থেকে কয়েক কদম দূরে একটু এংগেলে গাড়ির ভেতর থেকে মিশানকে পর্যবেক্ষণ করছে তীব্রর মা।
প্রথম অবস্থায় না চিনলেও,মিশান যখন এদিক ওদিক তাকাতাকি করছে তখন তাঁর নজরে মিশান আসে।
মিশানকে দেখার পর উনি সিদ্ধান্তহীনতায় ভূগতে লাগলেন এটা ভেবে, গাড়ি থেকে তো এই পরিস্থিতে নামা সম্ভব না,মিশানকে কি গাড়ির ভেতর থেকেই ডাক দেবে নাকি জ্যাম ছুটার অপেক্ষা করবে।চারপাশের গাড়ির হর্নের আওয়াজে ডাক দিলেও
মিশান কিছু শুনবে না।
অনেক সময় অপেক্ষার পর গাড়ির জ্যাম ছুটে, তীব্রর মা এতোক্ষণ ধরে মিশানকে চোখে চোখে রাখছিলো যেনো মিশান উধাও হয়ে না যায়।কিন্তু মিশান বাইক স্টার্ট দিয়ে নিজেত গতিতে এগিয়ে যায়।
(চলবে)