তেজস্ক্রিয় রক্তধ্বনি পর্ব-৪৬

0
100

গল্প- তেজস্ক্রিয় রক্তধ্বনি
পর্ব- ৪৬
লেখিকা- রিয়া খান

সে রাত পেরিয়ে ভোর হয়ে যায়, আশেপাশের এলাকায় সব জায়গায় খুঁজতে থাকে। কারো ধারণাই আসছে না কোথায় তীব্র।
ঝলক পুরো পাগল হয়ে গেছে প্রাণের প্রিয় বড় ভাইকে খুঁজে না পেয়ে।বাড়িতে সবাই চিন্তায় পড়ে যাবে বলে, কাউকে কিছু জানায় নি। সব দুশ্চিন্তা কেবল নিজের মাঝেই সীমাবদ্ধ থাকে। তীব্রকে তালাশি দেয়ার কোথাও কোনো কমতি রাখে না।
ঝলক এটা মেলাতে পারছে না, তীব্র স্বয়ং নিজে ঝলককে ঢাকায় যেতে বলে,নিজেই কেনো সন্দীপ এসেছিলো, আর কি হলো ওখান থেকে তাঁর ভাইয়ের সাথে।

মনে মনে কু গায়ছে, তখন যে গুলির আওয়াজ আসছিলো, কোনো ভাবে সেখানে তীব্র..!
মাথায় ঘুরপাক খাচ্ছে”হতে পারে তীব্রকে মেরে ওরা বডিটাকে নদীতে ভাসিয়ে দিয়েছে “কিন্তু এই বাক্য যদি ভুলক্রমেও সত্যি হয়,তবুও মেনে নিতে পারবে না ঝলক।

দুপুরের পরে ঝলকের খেয়ালে এলো,তীব্রর ফোনটা তো ওর কাছেই,যদি কোনো ক্লু মিলে মোবাইল থেকে।

তীব্রর ফোনের কল লিস্ট টা দেখে, সেখানে দেখে ঝলকের নাম্বারে কয়েকবার যোগাযোগ হয়েছে।ঝলকের মনে কিছু আঁচ করায়, কল লিস্ট থেকে কল রেকর্ডারে গিয়ে কথোপকথন শোনে।
কথোপকথন শুনে এক্সাক্টলি কিছু বুঝা গেলো না।শুধু এইটুকুই বুঝলো ভাইয়ের অনেক বিপদ হয়েছে যে বিপদের জন্য ঝলক নিজেই দায়ী।
যদি ফোনটা ঝলক সামলে রাখতে পারতো, তবে ঘটনা এতো দূর গড়াতো না।ঝলকের মিথ্যে কিডন্যাপের নাটকীয় ফাঁদে তীব্র পা রাখতো না,সেখান থেকে বিপদেও পড়তো না।
নিজের উপর খুব রাগ হচ্ছে ঝলকের,আজ যদি তীব্রর কিছু হয়ে যায় নিজেকে ক্ষমা করবে না কখনো। বার বার অনুতাপ করে যাচ্ছে।

লোকটা কথার মধ্যে বেশ কয়েকবার বলছিলো তীব্রকে স্বর্ণদ্বীপের প্রান্তরে যেতে,কিন্তু স্বর্ণদ্বীপ যাওয়ার আগেই সন্দীপ থেকে তীব্র মিসিং।কল রেকর্ডারে এটাও খেয়াল হলো ওখানে ট্রলারের আওয়াজ পাওয়া যাচ্ছিলো, ট্রলারটা যে খুব নিকটে ছিলো সেটা স্পষ্ট।

মনে মনে আশঙ্কা করে ঝলক তীব্রর খোঁজে স্বর্ণদ্বীপের যে বিশাল বনটা আছে যেখানে ঝাউ, কেওড়া,তাল, নারিকেল আরো নানান রকম গাছে ভরপুর। হতে পারে তীরবর্তী অই ঘন বনটাতেই কিছু একটা ক্লু মিলতে পারে।এতো জায়গায় খোঁজা হয়েছে কিন্তু অই একটা জায়গাতেই খোঁজা হয়নি,যেটা কিনা চোখের নাগালের কাছেই।

ঝলক একা একাই দিশেহারা ব্যাকুল হয়ে ওদিকটাতে যায়।
এক প্রান্ত থেকে আরেক প্রান্ত খুঁজতে খুঁজতে ক্লান্ত। বনের মাঝখান দিয়ে যে রাস্তা গিয়েছে সেখানে গাড়ি থামিয়ে ভেতরের দিকে ছুটে ছুটে খুঁজতে থাকে।

বেলা ফুরিয়ে আসছে, বিকেলের ক্লান্ত রূপ ভেসে উঠেছে, সূর্যের তেজ কমে লালচে রূপ নিচ্ছে একটু একটু করে,প্রস্তুতি নিচ্ছে মেঘের আড়ালে মিলিয়ে যাওয়ার।
একটু একটু করে আকাশের এক প্রান্তে চাঁদের অস্তিত্ব দেখা যাচ্ছে। সন্ধ্যা নেমে যাবে যাবে।

তীব্র একটা চেয়ারে হাত পা বাঁধা অবস্থায় আছে, ছোট্ট এক কুটিরের ভেতর।চেহারা পুরো অগোছালো ফ্যাকাসে হয়ে গেছে। গত রাতে তীব্রকে আটকে একটা ইনজেকশন দিয়ে সেন্সলেস করে দেয়। জ্ঞান ফেরার পর থেকেই নিজেকে একটা স্থানে এরকম ভাবে দেখতে পায়। হাত বাঁধা বলতে, হাত পিঠ বরাবর নিয়ে হ্যান্ডকাপ দিয়ে আটকে রেখেছে,ছুটার চেষ্টা করতে করতে হাতের মধ্যে নীলচে দাগ পড়ে গেছে, দড়ি দিয়ে বাঁধলে হয়তো কোনো ভাবে ছুটতে পারতো।যদিও এখন সব সময়কার মতো স্বাভাবিক গায়ের জোর নেই।মাথায় আঘাত করার কারণে ও ইনজেকশন টা দেয়ার কারণে তীব্র গায়ে বল পাচ্ছে না তেমন, চোখ ভালোমতো খুলে তাকালেই মাথা ভনভন করে ঘুরছে। কিছুটা অনুভব করতে পারছে তীব্র এই মুহূর্তে কোথায় আছে।

তীব্রর সামনে পায়ের উপর পা তোলে দুই চেয়ারে দুজন বান্দা বসে আছে,এক জাফর দুই অভিজিৎ,আর কিছু কর্মী।কাদের মোল্লা বা মোনায়েম হক ওরা কেউ আসেনি ।
এই বিজনেসের হেড এই জাফর আর অভিজিৎ।

-তারপর বলো এসপি সাফওয়ান রেজা তীব্র,স্পেশাল ব্রাঞ্চের গর্ব, র‍্যাব ডিপার্টমেন্টের অদমনীয় হাতিয়ার!
তোমার মতামত কি এখনো বদলায়নি?
দেখো রাত পেরিয়ে, বেলা ঘুরিয়ে, সেই কালকের মতো সময় চলে আসছে। তবে হতে পারে আজ রাতটাই তোমার জীবনে শেষ রাত।আমাদের বিজনেসের সমস্ত ডকুমেন্ট আছে দু সেট, একটা তোমার অই স্পেশাল ব্রাঞ্চে,যেটা বর্তমানে এখন আমার কাছে। আর দ্বিতীয়টা হলো তোমার কাছে।ওটা দিয়ে দাও আমাকে, আমি কথা দিচ্ছি, তোমাকে সম্মানের সহিত আমি নিজ দায়িত্বে ঢাকাই দিয়ে আসবো।তুমি আমাকে কথা দেবে আজকের পর তুমিও আমাদের চেনবে না, আমরাও তোমাকে চেনবো না।কেনো লাগছো আমাদের পিছু?
আমরা চাচ্ছিনা এভাবে একটা দেশরত্ন হারিয়ে যাক,তাই বার বার সুযোগ দিচ্ছি। কেনো সুযোগ নিচ্ছো না? একটা সুন্দর সাজানো গোছানো জীবন হবে, তুমি চাইলে তোমাকে আইজির আসনে বসিয়ে দেবো,এরপর তোমার প্রেমিকা দীপ্তিকে বিয়ে করে বাচ্চা জন্ম দিয়ে সুখে শান্তিতে বসবাস করবে।এভাবে বাড়াবাড়ি করলে আমাদের যে লস হয়েছে, সেগুলো আমরা পোষিয়ে নিতে পারবো একটা সময় পর। কিন্তু তোমার যে লসটা হবে তাঁর মাশুল দেয়ার জন্য তুমি থাকবেই না হয়তো।
তাই বলছি, ভালোই ভালোই রাস্তা ছেড়ে নিজের বোঝ বুঝো।কি চাও তুমি? তাজমহলের চেয়েও দামী প্রাসাদ দেবো।

রক্তচক্ষু নিয়ে অগ্নিদৃষ্টিতে তাকিয়ে দাঁত চেপে তীব্র উত্তর দিলো,
-দেশের মানুষের জন্য কিছু করতে না পারলাম,দেশের জন্য কিছু করতে না পারলাম,তাতে আফসোস নেই। আমার দ্বারা দেশ বা মানুষ কখনো ক্ষতিগ্রস্ত হয়নি।
তোদের মতো দেশের মাটিতে অপবিত্রতা ছড়াবো না কখনো।
মরে গেলে মাটির কাছে জবাব দিতে পারবো, এই মাটিকে বিশুদ্ধ করতে গিয়েই আমার মৃত্যুকে বরণ করতে হয়েছে।
মৃত্যুকে তীব্র ভয় পায় না, কিন্তু অর্থ ধন সম্পদ এগুলোকে খুব ভয় পাই,কারণ এগুলো থাকলেই মায়া জন্মাবে এরপর সেগুলো ছেড়ে মরে যেতে হবে ভেবে ভেবে, মরার আগেই মরে যাবো।
আমি একটা কথায় খুব বিশ্বাসী। পৃথিবীতে তীব্র একটা না, আমার মত হাজার হাজার তীব্র আছে, যারা সময়ের কারণে সুপ্ত অবস্তায় আছে,সময় হলেই আত্মপ্রকাশ করবে। সে তীব্র গুলোর মাঝেই আমার আত্মা বাস করবে।নতুন তীব্র নতুন ভাবে জন্ম নিয়ে তোদের বিনাশ করতে আসবে।আমি জানি আমার সময় শেষ,কিন্তু তোদের কাউন্টডাউন শুরু এখান থেকেই।এগুলো তীব্রর ভবিষ্যৎবাণী, মিলিয়ে নিস!

তীব্রর কথা শুনে জাফর টিটকারি হাসি হেসে অভিজিৎকে বললো,
-দেখলে অভিজিৎ, তীব্রর তেজ এখনো কমে নি। ও বুঝাতে চাইছে তীব্র মানেই তেজস্ক্রিয়। যার বিনাশ নেই!একে বিনাশ করার চেষ্টা করলে, নতুন করে বিস্তার লাভ করবে।

তীব্র বাঁকা হাসি দিয়ে জাফরের চোখের দিকে তাকিয়ে ববললো,
-শুধু তেজস্ক্রিয় নই।আই এম কাইন্ড অফ
ফিনিক্স বার্ড ! যে প্রতিটা মৃত্যুতে নতুন করে জন্ম নেয়।
ফিনিক্স বার্ডের স্টোরি টা জানো তো?
যে সব সময় সূর্যের কাছে যেতে চায়,যখন সূর্যের অনেক কাছাকাছি চলে যায়,সূর্যের তাপে ফিনিক্স বার্ড পুড়ে ছাই হয়ে যায়।সেই ছাই হাওয়ায় ভাসতে ভাসতে মাটিতে পড়ার আগেই নতুন করে জন্ম নেয়।এরপরেও ফিনিক্স বার্ড তাঁর লক্ষ্য ভুলে যায় না।

আমি হোলাম তেমনটা,তোদের বিনাশ করতে গিয়ে যতবার আমি ক্ষয় হবো,মিশে যাবো, ঠিক ততোবার ই আমার তেজস্ক্রিয়তার প্রভাবে ফিনিক্স বার্ডের মতো নতুন করে ফিরে আসবো, সেই একই লক্ষ্যে।
তবে এখানে ব্যতিক্রম হলো,ফিনিক্স বার্ড টা তাঁর লক্ষে কখনো সফল না হলেও,তীব্র একদিন না একদিন সফল হবেই।
-এগুলো কেবল রূপক গল্পেই মানায় তীব্র, বাস্তবে মানুষের জন্ম এক, মৃত্যু এক।
-আমি তো বলি নি,আমি মানুষ হয়ে জন্ম নিয়ে ফিরবো।
আমি বুঝিয়েছি, আমি আত্মা হয়ে বাস করবো সেই তীব্রময় মানুষটার মাঝে।যার মাঝে আমার তেজস্ক্রিয়তা বইবে।বিনাশ খেলায় মাতবে তোদের সাথে।বিশুদ্ধ করে দেবে এই বাংলার মাটিকে।অপবিত্রতা দিয়ে যে মাটিকে অভিশপ্ত করেছিস, সেই মাটিতেই হবে তোদের পতন।
ঠিক আমার ই মতো তেজস্ক্রিয় রক্তধ্বনি বইবে তাঁর শরীরে, যে মৃত্যুকে মেনে নিয়ে তোদের বিনাশ করবে । আর এই যে জাফর স্যার, আবারও বলছি।বয়স তো আর কম হলো না, আপনার এক পা চলে গেছে কবরে, এই বয়সে অন্ততো একটু শুধরান।

(জাফর অভিজিৎ দুজনের উদ্দেশ্যে বললো)
তোমরা প্রত্যেকেই জীবনের একটা সময় বুঝবে, না হলেও শেষ নিশ্বাসের আগে বুঝবে, অর্থ সম্পদ কতোটা তুচ্ছ মৃত্যুর কাছে। যেগুলো তোমাদের রক্ষা করবে না। যে মাটির সন্তানদের বিষাক্ত করে মাটিকে অপবিত্র করেছো,সেই মাটিতে গিয়ে কৈফিয়ত দেবে কি?
মানুষের ক্ষতি করে কখনো মানুষ হওয়া যায় না। আর মানুষ না হয়ে মানুষের রূপ নিয়ে থাকা পৃথিবীতে থাকবে কঠিন বিপর্যয়।

অভিজিৎ হেসে হেসে বললো,
-তোমার তেজের সাথে জ্ঞানও আছে প্রচুর দেখি।এই পুলিশের চাকরি ছেড়ে, ফিলোসফার হলেও পারো।দেশ বিদেশ ঘুরবে আর বড় বড় বই লিখবে ফিলোসফি নিয়ে।কুড়িটা দেশের মানুষ তোমার নাম শুনবে , তোমাকে জানবে,হতে পারে নোবেল ও পেলে।
অনেক ভালো ওয়ে আছে তোমার ভবিষ্যতের,তাই বলছি ভালোই ভালোই আমাদের জিনিস গুলো দিয়ে দাও।কোথায় কি রেখেছো মোবাইল দিচ্ছি একজন লোক পাঠিয়ে সেগুলো আনাও,আমাদের হাতে সময়ের বড্ড স্বল্পতা।

ক্লান্ত হাসি দিয়ে তীব্র আস্তে করে উত্তর দিলো।
-ভাঙবো তবুও মচকাবো না।

অভিজিৎ লম্বা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে এক কর্মী কে বললো,
-এই স্যারকে সেকেন্ড ডোজটা দিয়ে দে।
আমাদের আর কিছু বলার নেই।
জাফর ভাই, চলুন উঠি।তীব্র স্যার একটু রেস্ট করুক, আমরা একটু পরে সাক্ষাৎ করি উনার সাথে।
-তাই ই করি অভিজিৎ চলো,তীব্রর একটু ব্রেইন রেস্ট হোক।

জাফর অভিজিৎ দুজনেই বেরিয়ে গেলো, একজন লোক এসে জোর জবরদস্তি করে তীব্রকে আরেকটা ইনজেকশন দিয়ে সবাই চলে যায়।
ইনজেকশন টা দেয়ার পর পর নিমেষেই তীব্রর শরীর নিস্তেজ হয়ে আসে, মাথা আগের চেয়ে দ্বিগুণ হারে ঘুরতে থাকে,প্রচন্ড বমি পায়।
পেটে খাবার না থাকলেও যা ছিলো কিছুক্ষণ বমির ফলে পেট একদম খালি হয়ে যায়। গা ঝিমঝিম করছে প্রচন্ড পরিমাণে,জল তেষ্টায় গলা শুকিয়ে আসছে ভেতর থেকে। এগুলো হয়তো কেবলই মৃত্যু যন্ত্রণা ছিলো।
শরীর এমন লাগছে যেনো পুরো শরীর প্যারালাইজড হয়ে আছে, তবে একটু পানি খেলেই হয়তো শরীরে আবার প্রাণ ফিরে আসবে।

চারদিকে ঘন অন্ধকার নেমে এসেছে। ঝলক লাইট ধরে খুঁজতে খুঁজতে বনের ভেতর একটা কুঁড়েঘর দেখতে পায়,সময় অপচয় না করে সেটার ভেতর প্রবেশ করে।
ঘরটার ভেতর ঢুকতেই অপ্রত্যাশিত ভাবে তীব্রর দেখা পায়, পা দুটো চেয়ারের সাথে বাঁধা, হাত দুটো পেছনে হ্যান্ডকাপ দিয়ে আটকানো,শরীরটাও বাঁধা চেয়ারের কাঠামোর সঙ্গে।ঘাড় টা কাত করে চোখ বন্ধ করে নেতিয়ে আছে।

ভাইয়ের অবস্থা দেখে ঝলকের চোখ ভরে এলো জল।তীব্রর কাছে যাওয়ার সাহস পাচ্ছে না। এক পা দু পা করে তীব্রর কাছে গিয়ে কাঁপা হাতে তীব্রর গা স্পর্শ করে আস্তে করে বলে,
-ভাইয়া!
-………!

ঝলক তীব্রর গায়ে হাল্কা ঝাঁকি দিয়ে আরেকটু জোরে কাঁদোকাঁদো কন্ঠস্বরে বলে,
– এই ভাইয়া!
তীব্র আদো আদো দৃষ্টিতে ঝলকের দিকে তাকিয়ে মলিন হেসে ,আস্তে করে বলে,
-ঝলক!

ঝলক তীব্রকে জড়িয়ে ধরে কাঁদতে কাঁদতে বলে,
-ভাইয়া!তোমার এই হাল কি করে হলো?কে এমন করেছে? জাফর?

তীব্র উত্তর দিলো,
-জাফর,অভিজিৎ সব কিছুর মূল। আর বাকি সব ডাল পালা।
ঝলক রাগান্বিত হয়ে বললো,
-ওদের আমি ছাড়বো না ভাইয়া, মেরে ভাসিয়ে দেবো। আমার ভাইয়ের এই অবস্থা করার শোধ আমি নেবো।
-ঝলক!
-হ্যাঁ ভাইয়া?
-গায়ে জোর পাচ্ছি না, ওরা যেনো কি ইনজেক্ট করেছে আমার গায়ে,আমি গায়ে শক্তি পাচ্ছি না, কথা বলতে কষ্ট হচ্ছে,মাথা ঘুরাচ্ছে,বমি পাচ্ছে।আর খুব তৃষ্ণা পেয়েছে,একটু পানি না পেলে হয়তো এখন মরেই যাবো আমি।ভাই আমাকে একটু পানি পান করা।

-এখনি আনছি ভাইয়া তুমি একটু অপেক্ষা করো,আমার গাড়িতে পানি আছে।

ঝলক ছুটে গিয়ে গাড়ি থেকে পানি নিয়ে আসে, এসেই তীব্রকে পানি খাইয়ে দেয়, তীব্র ঢকঢক করে বোতলের সবটুকু পানি খেয়ে নেয়।তীব্রকে পানি খাওয়ানো শেষে
তীব্রর পা আর শরীরের সাথে যে দড়ির বাঁধন, সেটা খুলে দিয়ে হ্যান্ডকাপ টা খুলতে ব্যর্থ হয়।এদিক ওদিক তাকাতাকি করে দেখে ঘরের ভেতরই উপরে ঝুলছে হ্যান্ডকাপের চাবি। ঝলক হাতকড়া হতে হাত ছাড়াতেই তীব্র ঝলকের দিকে ঝুঁকে পড়ে, ঝলক তীব্রকে ধরে রাখে।
তীব্র একটা মলিন হাসি দিয়ে বলে,
-ঝলক!
-ভাইয়া!
-ভালো থাকিস ভাই।আমার সময়টা শেষ হয়তো। ভাইকে হারিয়ে ভেঙে পড়িস না।মৃত্যু সত্য!তোর আমার রক্ত তো একই, নিজের মাঝেই আমাকে খুঁজে পাবি।
দায়িত্ব পালন করতে গিয়ে কারো সঙ্গে অন্যায় করিস না। যেমনটা আছিস, তেমনটাই থাকিস।
ঝলক কাঁদোকাঁদো স্বরে বললো।
-ভাইয়া তোমার কিছু হবে না।তুমি আমার সাথে এখন ক্যাম্পে যাবে,
ওখানে তোমার প্রাথমিক ট্রিটমেন্ট করে ঢাকায় যাবো।

-তাড়াহুড়ো করিস না ঝলক!যতোই চেষ্টা করিস,বাস্তবটা আমি বুঝতে পারছি।
শেষ সময়ে নাকি মানুষের বাবা মার কথা মনে পড়ে,কিন্তু আমার ক্ষেত্রে ভিন্ন রে, আমার শুধু তোর কথা মনে পড়ছিলো,তোকেই দেখতে…..

পুরোটা বলার আগেই তীব্রর কাশি আসে,কাশি দিতে গিয়ে গলা থেকে রক্ত বেরিয়ে আসে অঝোরে, যেটা দেখে ঝলক ঘাবড়ে যায়।তীব্রর প্রচুর শ্বাসকষ্ট হতে থাকে।গলা দিয়ে, মুখ দিয়ে অনবরত রক্ত পড়েই যাচ্ছে।
ঝলক সময় নষ্ট না করে তীব্রকে কাঁধে তোলে ঘরটা থেকে বেরিয়ে গাড়ির দিকে যেতে থাকে। গাড়ি থেকে কিছুটা দূরে থাকা অবস্থায় হঠাৎ গাড়ি বোম ব্লাস্ট হলো।
চারপাশের আগুনের শিখায় আলোকিত হয়ে গেছে।

ঝলক নির্বাক হয়ে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে তাকিয়ে দেখে।
স্তব্ধ হয়ে ভাইকে কাঁধে নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে।

এদিকে ঝলকের অজান্তেই, ভাইয়ের কাঁধে থেকেই তীব্রর তীব্রর প্রাণটা বেরিয়ে যায়। হুট করেই কেনো জানি তীব্রর ওজন টা অতিমাত্রায় বেশি বেশি অনুভব হতে লাগলো, এক কাঁধে তীব্রর লোড নিতে পারছে না বলে, কাঁধ চেঞ্জ করার জন্য নিচে বসাতে যাবে এমন সময় তীব্রকে ধরার পরেও মাটিতে নেতিয়ে পড়ে যায়।
-ভাইয়া!এই ভাইয়া? ভাইয়া…

ঝলক চিৎকার দিয়ে উঠে বার বার ভাইয়া ভাইয়া করে। মনকে মানাতে পারছে না, ভাই নেই।হাউমাউ করে চিৎকার করে যাচ্ছে ভাই হারিয়ে যাওয়ার আর্তনাদে।
জীবনে অন্ধকার নামার জন্য রাতের প্রয়োজন হয় না।সারাজীবনের জন্য জীবনটাকে অন্ধকারে প্রবেশ করানোর জন্য, এরকম একটা দুঃসময় ই যথেষ্ট। প্রিয়জন চোখের সামনে থেকে হারিয়ে যাওয়ার যন্ত্রণার মতো, যন্ত্রণা নেই কোনো বিষেও।ভাইয়ের চেহারার দিকে তাকাতে পারছে না ঝলক, ভেতর যেনো পঁচে যাচ্ছে এমন করুণ চেহারা দেখে।

মেঘ গর্জন আর্তনাদের সময় হঠাৎ করে
পেছন থেকে কারো বিষ মাখানো শয়তানি হাসির শব্দ পেয়ে ঝলক পেছনে ঘুরে তাকাতেই দেখে ঝলকের খুব নিকটে দাঁড়িয়ে আছে অভিজিৎ, জাফর আর ওদের সাঙ্গ পাঙ্গরা।
-কি ফাঁদ টাই পেতেছিলাম! অপ্রত্যাশিত ভাবে সাকসেস হয়ে গেলাম শুরু থেকে শেষটা! ভাইয়ের হাতে প্রাণপ্রিয় ভাইয়ের মৃত্যু! হা হা হা হা হা!

ঝলক দাঁত কিড়মিড় করতে করতে হাতের পাশে একটা মোটা গাছের ডাল পেয়ে সেটা তুলে নিয়ে আচমকা অভিজিৎয়ের মাথার মধ্যে আঘাত করে,সাথে সাথে ওদের লোক ঝলকে মারতে আসে,ঝলক বেশ কিছুক্ষণ ধরে ওর লোকদের মারতে থাকে ইচ্ছে মতো। ঝলক এখন স্বাভাবিক অবস্থায় নেই, ভাই হারানোর যন্ত্রণা আর ভাইয়ের খুনিদের চোখের সামনে দেখতে পেয়ে রক্ত টগবগ করে উঠে।উদ্যম কেলানো থেকে, ঝলককে থামানো যাচ্ছিলো না কোনো ভাবেই। এমন সময় পেছন থেকে জাফর ঝলককে গুলি করে বসে, অভিজিৎও নিজের পিস্তল দিয়ে ঝলকের বুকে এক নাগাড়ি গুলি করতে থাকে। গুলি খেয়ে ঝলক মাটিতে তীব্রর পাশেই নেতিয়ে পড়ে।

বোম ব্লাস্টের আওয়াজ পেয়ে ক্যাম্প থেকে সেনাবাহিনীরা ঝাঁকে ঝাঁকে ছুটে আসে ওদের দিকে ।
দুই ভাইয়ের নিস্তেজ শরীর মাটিতে পড়ে আছে।একজনের প্রাণ নেই আরেকজনের প্রাণ অনিশ্চিত অবস্থায়।
সময় কখনোই কারো আপন হয় না, ছোট্ট একটা সময়ের বিপর্যয়ে কত পাথর চাপা পড়ে দুই ভাইয়ের জীবন।
পড়ে থাকা রক্তাক্ত নিস্তেজ ঝলক জানতো না, পরের অধ্যায়ে ওর জীবনে কি লিখা ছিলো।কত বড় মাপের ধাক্কা অপেক্ষা করছে সামনে, যে ধাক্কা টা সারাজীবন অপরাধীর বোঝা হয়ে থাকবে ঝলকের জীবনে।খুঁড়ে খুঁড়ে খাবে এই রাত গুলো।

(চলবে)