তোমাকে চাই পর্ব-০১

0
118

#তোমাকে_চাই ।০১।
#সাইরা_শেখ

“তালুকদার বাড়ির ছোটমেয়েকে তুলে নিয়ে গিয়ে বিয়ে করেছে চেয়ারম্যানের ছেলে।” খবরটা ছড়িয়ে পড়তেই দুই বাড়ির গণ্ডিতে মানুষের জমায়েত শুরু হয়ে গেল। ঘটনার সত্যতা জানা না গেলেও গতকাল সন্ধ্যা থেকে দুজনেই নিখোঁজ। তাই পরিবারের সদস্যরা বেজায় ক্রুদ্ধ হয়ে আছে। সাঁপেনেউলে সম্পর্ক এই দুই গোষ্ঠীর। কেউ কাউকে দুচোখে সহ্য করতে পারে না। তাই এই ঘটনায় আহ্লাদ দেখানো বা মেনে নেওয়া কারোর পক্ষেই সম্ভব নয়।

তালুকদার বাড়ির ছেলেদের মাথাগরম স্বভাব নেই তবুও আজ রাম’দা নিয়ে বেড়িয়েছে সবাই। চেয়ারম্যানের ছেলের গলা না কে’টে বাড়ি ফিরবে না তারা। গ্রামের সবাই জানে তাদের দ্বন্দ্বের ব্যাপারে। কেউ চাইছে বিয়েটা তাদের দ্বন্দ্ব ঘোচাক। আবার কেউ এই জলন্ত আগুণে ঘি ঢেলে পরিবেশ উত্তেজিত করার তালে আছে। ইউনুস তালুকদার, বংশগত জমিদার বলা চলে তাকে। এই গ্রামের তিন চতুর্থাংশ জমি তার পৈতৃক সম্পতি। বাকি একভাগে মালিকানা না থাকলেও কর্তৃত্ব তার হাতেই।

পাশের গ্রাম চলে চেয়ারম্যান সাফাওয়াত মীর্জার ইশারায়। তাই দুই গ্রাম বেশ উত্তেজিত। সবাই তৈরি যে কোনো মুহূর্তের যুদ্ধের জন্য। আজ খু নো খু নি একটা বাঁধিয়ে ছাড়বে। এমন সময় জানা গেল মীর্জার ছেলেকে পাওয়া গেছে। সঙ্গে তালুকদারের নাতনিও আছে। নাতনির অবস্থা তেমন ভালো না, দেখে মনে হচ্ছে তার ওপর দিয়ে ঝড় বয়ে গেছে। বিধ্বস্ত চেহারা, ছেড়া পোশাক, শরীরে জায়গায় জায়গায় ক্ষত। সবটা শুনে ইউনুস সাহেব দ্রুত বেড়িয়ে আসলেন। বাড়িতে আর কোনো পুরুষ নেই, যদি দাঙ্গাহাঙ্গামা হয় বাড়ির মহিলাদের সুরক্ষার ভার নেবে কে? তাই নিজের বিশ্বস্ত কয়েকজনকে বাড়ি পাহারা দিতে বলে উঠানে পা রাখতেই তার কানে এলো অসংলগ্ন কিছু বাক্য।

– মেয়ে কি আর আস্ত আছে?সারারাত ছিল পোলাডার লগে। মাইয়্যাডার চেহারা দেহনের লাহানও রাহেনাই ওয় পোলা।ওই মাইয়ার জীবন তো শ্যাষ!

ইউনুস সাহেবের বয়স্ক শরীর ও ক্লান্ত হৃদয় বাক্যগুলো মেনে নিতে পারলো না।বুকের ভেতর ঝিলিক দিয়ে ব্যাথা শুরু হয়েছে। শীতল আবহাওয়াতেও দরদর করে ঘামছেন তিনি। চলার শক্তি পাচ্ছেন না। কম্পিত দেহখানা অচিরেই দেহের সকল ভার ছেড়ে দিল। তিনি অবিলম্বে লুটিয়ে পড়লেন শুকনো খড়খড়ে উঠানের ওপর। চিৎকারের রোল পড়ে গেল। কয়েকজন তাকে ধরে বাড়ির ভেতরে নিয়ে গেল।
.
.
মসজিদের সামনে উপস্থিত হয়েছে সবাই। এলাকার সব গণ্যমান্য ব্যক্তিবর্গরাও হাজির হয়েছেন র’ক্তপাত যেন না হয় সে চেষ্টার তাগিদে।তালুকদার বাড়ির ছেলেরা ভীষণ উত্তেজিত। মীর্জা বাড়ির ছেলেকে কয়েকটা চড়, ঘুসি দিলে তারাও ক্ষেপে গণ্ডগোল বাঁধিয়ে বসে। কিন্তু যাকে নিয়ে, যাদের নিয়ে এতকিছু তারা দুজনেই স্থির, নির্বিকার ঠায় দাঁড়িয়ে রয়েছে। মাঝে মধ্যে মেয়েটার দিকে আড়চোখে তাকাচ্ছে নাওফিল।

নিষ্পাপ চেহারার মেয়েটার ওপর দিয়ে যে তা’ণ্ড’বলীলা চলল তার জন্যই মেয়েটা এখনও নিস্তেজ পুতুলের মত দাঁড়িয়ে আছে। কোনো রকম সাড়া-শব্দ নেই। নাওফিল নিজেও কিছু বলার সুযোগ পাচ্ছে না,পরিবেশ কিছুতেই ঠান্ডা হচ্ছে না। নাওফিলের কথাও কেউ শুনছে না, কারণ স্পষ্ট। চেয়ারম্যান সাহেব নিশ্চই হুকুম দিয়েছেন তার ছেলের গায়ে হাত পড়লে সে হাত যেন ভেঙে দেওয়া হয়। এই পরিবারের রে’ষারে’ষি নাওফিল ঘৃণা করে। সর্বক্ষেত্রে তার বাবার কথাই শেষ কথা। হোক সে ভুল বা সঠিক। তাই কেবল মাত্র তার উপস্থিতিতেই সকল জটিলতা খোলসা করা যাবে, তার আগে নয়। সে যত চেষ্টাই করুক না কেন এখন তার হাতের নাগালে কোনো সুযোগ নেই।

নিজের ক্রোধ নিয়ন্ত্রণ করে মেয়েটার ভাইয়ের দু-চারটা থা’প্পড় অনায়াসে সহ্য করে নিয়েছে সে। নিজের এক ছোটভাইয়ের অপকর্মের ফল ভোগ করতে হচ্ছে তাকে। গ্রামের যা পরিবেশ হয়তো মেয়েটাকে বিয়েও করতে হতে পারে ভেবে রাগ তরতর করে বাড়ছে। এমন হলে তার সকল পরিকল্পনা ভেস্তে যাবে। এতবছরের পরিশ্রম এভাবে নষ্ট হতে দিতে পারবে না সে।

শালিসি বসলো স্কুলমাঠের আম গাছতলায়। দুই পরিবারের সবাই হাজির হয়েছে। মীর্জা সাহেব শক্ত চেহারায় বসে আছেন। তালুকদার সাহেব নিশ্চুপ। কিছুসময় পূর্বে তার নাতনির থেকে সবাই জেনেছে যে নাওফিল কিছু করেনি, বরং নাওফিলের এক ফুফুর ছেলে তুলে নিয়ে গিয়েছিল মেহেক তালুকদারকে এবং স্বয়ং নাওফিল তাকে বাঁচিয়েছে। যেহেতু তারা শহরে ছিল, মেহেকের অবস্থা বেশি ভালো ছিল না তাই নাওফিল মেহেককে শান্ত হওয়ার সময় দিয়ে সকালের দিকে রওনা দিয়েছে। আসতে আসতে বেলা বারোটা। এখানে নাওফিলের কোনো দোষ নেই। যে ফুফু বা যে ফুপাতো ভাইয়ের কথা বলা হয়েছে তারাও নাওফিলদের আপন, বা রক্তের সম্পর্কের কেউ নয়। তাদের মীর্জা বাড়ির সবাই স্নেহ করেন এবং ভালোবাসেন। কিন্তু কথা যখন নিজের পরিবার নিয়ে তখন মীর্জা সাহেব বড্ড স্বার্থপর মানুষ হয়ে যান। যত ভালোবাসার মানুষই হোক না কেন, পরিবারের তুলনায় তা তুচ্ছ।

ঘটনা তালুকদারদের নিয়ে হওয়ায় মীর্জা সাহেব খুব একটা চিন্তিত নন। তাদের বাড়ির সমস্যা তারা মেটাক, কিন্তু তার ছেলেকে মা’রধর, এবং তার সম্মানহানির জন্য তিনি সুষ্ঠু বিচার চান, নয়তো এই হাতাহাতির রেশ র’ক্তার’ক্তি পর্যন্ত পৌঁছাবে বলে জানালেন তিনি। তার একমাত্র ছেলের গায়ে হাত তুলেছে, এত সহজে তিনি ছাড় দেবেন না।

তালুকদার সাহেব বিচক্ষণ মানুষ। কিন্তু যে ভুল হয়েছে তা সংশোধনের জন্য মীর্জারা কি চায় সেটা সরাসরি না বললে বোঝার উপায় নেই। পূর্বের ঘটনার প্রতিশোধ সে এবার নেবে, এব্যাপার স্পষ্ট। কিন্তু কি চাইবে? নাওফিল বলল,

– আব্বু, ব্যাপারটা না জেনে হয়েছে। তারা মাফ চেয়ে সমাধান করতে চাইছে, এটাই এনাফ।আপনি এটা নিয়ে আর জলঘোলা করবেন না। মেয়েটা ছোট, ওর ভবিষৎ নিয়ে একবার ভাবুন।

– অবশ্যই ভাবতাম। যদি তালুকদাররা আমার বোনের ভবিষৎ নিয়ে ভাবত। তারা যদি একটাবার তার কথা ভাবত তাহলে আজ আমার বোন জীবিত থাকতো। তারা যখন ভাবেনি, আমারও ভাবার প্রয়োজন নেই। তুমি এখানে থাকতে চেয়েছ, বাঁধা দেইনি তাই আমার কাজেও তুমি বাঁধা দেবে না নাওফিল।

বাবার কথার ধরণ ও ঠান্ডা মেজাজ পরিষ্কারভাবে তার নিয়তের কথা জানান দিল। তিনি কঠিন মানুষ। একবার যা বলবেন,তাই করবেন।নাওফিল চায় তাকে বদলাতে। সে জানে তার বাবাকে সে বদলাতে পারবে কিন্তু এখনও সে সময় আসেনি। তাকে এখন অনুগত ও বাধ্য সন্তান হয়েই থাকতে হবে।

সবাই নিজেদের মধ্যে আলাপ আলোচনা করছেন। এমন সময় মাঠের প্রান্তে একটি বাইক এসে থামে। বাইক থেকে দুজন নেমে আসছে। একটি ছেলে ও একটি মেয়ে। মেয়েটির পরনে সুতির কলাপাতা রঙের থ্রিপিচ। মাথায় কাপড় দেওয়া, সুশ্রী মুখশ্রী তার। পাশের ছেলেটির পরনে প্যান্টশার্ট এবং অবিশ্রান্ত চেহারা। নাওফিল মেয়েটিকে চেনে। তাই দ্রুত নিজেকে খানিকটা দূরত্বে সরিয়ে নিল।মেয়েটি নাওফিল ও তার স্বভাব সম্পর্কে অবগত যা গ্রামে প্রচারের সময় আসেনি। শহরে নাওফিলের কদর কেমন তা বলার সময় আসেনি। কিন্তু মেয়েটি এখানে কেন? তালুকদার বাড়ির কেউ? নাকি পরিচিত? ছেলেটি কে? মেয়েটিকে দেখে ইউনুস তালুকদার তার ছোটছেলেকে আদেশ করলেন,

– ওকে বাড়িতে নিয়ে যাও। এখানে ওর থাকার দরকার নেই।
– দাদু, আমি থাকতে আসিনি। জানতে পেরেছি এখানে কি ঘটেছে তাই নিজের চোখে দেখতে এসেছি। বিকেলে চলে যাবো, আমাকে নিয়ে চিন্তা করোনা।
– যেকোনো সময়, যেকোনো অঘটন ঘটতে পারে। তুমি বাড়ি যাও,বাড়ি ফিরে ঠান্ডা মাথায় কথা বলবো।
– আমি এখানে উপস্থিত থাকলে তালুকদার পরিবার শান্ত থাকবে। তুমি কি এটা চাও না? একপক্ষ শান্ত হলে অপরপক্ষ একা যুদ্ধে নেমে কি করবে? অনুমতি দাও, আমি থাকি।
– গ্রামের দ্বন্দ্ব তুমি বুঝবে না। জেদ করো না।

মেয়েটি শুনলো না। ঠিক করা হলো নাওফিলের সেই ভাইয়ের সঙ্গে মেহেকের বিয়ে দেওয়া হবে।যাতে মেহেক পরবর্তীতে কোনোরকম হেনস্থার শিকার না হয়। বিয়ে হলে ধীরে ধীরে সব ঠিক হয়ে যাবে। সবাই সবটা ভুলে যাবে সময়ের আবর্তনে। তালুকদার সাহেব রায় মেনে নিতে চাইলে মেয়েটি বাঁধা দেয়,
– মেহেকের বিয়ে ওর কাছে না জেনে তুমি ঠিক করতে পারো না দাদু। ও সুখী হবে না।
– আমি যা করছি ওর ভালোর জন্য করছি।
– না।তোমরা যা করছ তা তোমাদের বুনিয়াদি ক্ষমতার জন্য করছ। মেহেক আমার বোন। ওকে এভাবে নরকে পড়তে দেখতে পারবো না আমি।
– মাহমুদ নিজের মেয়েকে এখান থেকে নিয়ে যাও।

মাহমুদ এগিয়ে এসে বললেন,
– আব্বা আরেকটা বার ভেবে দেখুন। এই পরিবারে মেহেককে পাঠালে মেয়েটা ম’রে যাবে। ওরা আমার মেয়েটাকে মে’রে ফেলবে।

– না পাঠালে তোমার মেয়েকে এমনিতেও ম’রতে হবে। সেটা অসম্মান, লাঞ্ছনা, নানা বিশ্রি ভাষার মধ্যে দিয়ে। কে করবে তোমার মেয়েকে বিয়ে? আশেপাশের সকল গ্রামে ছড়িয়ে পড়েছে কথা, কেউ ভালো নজরে দেখছে না। যখন তোমার মেয়ে ঘরের বাইরে বের হবে তখন সমাজ তাকে কি বলবে? কি চোখে দেখবে ভেবেছ? এক মেয়ের সম্মান নষ্ট করেছে ওরা, এখন আরেকমেয়ে সামনে রেখে তাকেও এই পশুদের নজরে ফেলতে চাও? কেমন বাবা হয়েছ?

মাহমুদ এবার কিছু বলতে পারলেন না। মেয়ের পানে তাকিয়ে বললেন,
– বাড়ি চলো প্রিয়তা।

প্রিয়তা শুনলো না। ঠায় দাঁড়িয়ে রইল। পঞ্চায়েত পক্ষ টেনে রায় দিয়েছে। মেহেককে কোনঠাসা করেছে ভারি চতুরতার সঙ্গে। অপপ্রচারও মীর্জাদের কাজ। তারা বেশ খুশি, কিন্তু তাদের খুশির জন্য সে নিজের বোনের ক্ষতি কিছুতেই মানবে না। কর্ণকুহরে আসা সকল তিক্ত বাক্য, অশালীন মন্তব্য শুনে চুপ থাকা জরুরি হতে পারে কিন্তু আবশ্যক নয়। সবার চিন্তা মেহেকের বিয়ে নিয়ে, সকল সমস্যা মেহেককে নিয়ে। সমাধান যখন সঙ্গে নিয়ে এসেছে তখন এসব অপ্রাসঙ্গিক বাক্যের জবাব দেওয়া অন্যায় নয়।

– আসসালামু আলাইকুম। আমি মেহেরীন তালুকদার প্রিয়তা। মাহমুদ তালুকদারের বড়মেয়ে,এবং মেহেকের বড়আপু। আপনারা আমার বোনকে নিয়ে চিন্তিত, তার সুন্দর ভবিষৎ নিয়ে বিচলিত। আপনাদের চিন্তা কমানোর জন্য বলছি মেহেকের জন্য এত চিন্তা করার প্রয়োজন নেই। আমার বোনের বিয়ে এই তুচ্ছ ঝামেলায় আটকাবে না। আমার বোন এতটাও মূল্যহীন নয়। যাই হোক, দাদু এই হলো ইমতিয়াজ, ও আমার সঙ্গে পড়ে। গতবার আমার সাথে মেহেককে দেখে ওর মা মেহেককে পছন্দ করেছিল পুত্রবধু হিসেবে। মেহেক ছোট বলে সময় নিতে চেয়েছিলেন, কিন্তু ঘটনা শুনে ওকে আমার সাথে পাঠিয়েছেন। আজ সন্ধ্যার মধ্যে তারাও চলে আসবেন বিয়ের কথা বলতে। আশা করি মেহেককে নিয়ে, তার চরিত্র নিয়ে, আর কোনো সমস্যা হবে না।

চলবে…

ভুলত্রুটি ক্ষমার দৃষ্টিতে দেখবেন।❤️