তোমাকে নিয়েই গল্প পর্ব-১১

0
1108

#তোমাকে_নিয়েই_গল্প
#পর্ব:১১
#জুনাইনাহ_তাসনিম_অরহা

একটু যে ঘটনা ঘটেছে তারপরেও অভ্র ভাই এতোটা স্বাভাবিক আছে কি করে সেটাই তো বুঝতে পারছি না।সবার সাথে কি সুন্দর কথা বলছে কিন্তু আমিই চুপ করে আছি।

রাত ৮টার দিকে আপু আর আকাশ ভাইয়ের এংগেজমেন্ট হলো।দুজন দুজনকে আংটি পরিয়ে দিলেন।আর দাদি দিলেন আপুকে সোনার একজোড়া বালা।
–এই বালাটা আমার মেজো নাতির বউ এর জন্যে তোলা ছিলো তাই তোকে এখনি দিলাম।আর তোর ভাগেরটা তোর বিয়ের সময় দেবো ইনশাআল্লাহ।(নানি হেসে হেসে বল।নানির কথার পরপরই অভ্র ভাই ও ফট করে ওনার বউ এর কথা বলে)

–দাদি আমার বউ এর জন্যে কিছু রেখেছো তো?

–হ্যা?তোমার বউ এর কথা এখনি আসছে কেন ছোট কর্তা?তোমার বউ এর তো দেরি আছে।

–দেরি আর কই?মেডিকেল শেষ হতে তো আর দেরি নেই আমার ৬-৭ মাস বাকি।আর একবার পাশ করে গেলে চাকরি তো পেয়েই যাবো তাই তাড়াতাড়ি বিয়েটাও করে নেবো।তারপর তিন ভাইয়ের তিন বউ মিলে সারাদিন ঝগড়া করবে।
(ওনার কথা শুনে সবাই হেসে ফেলে কিন্তু আমি তো শকড।বাড়ির সবার সামনে এসব কথা বলছে।সত্যিই সাদা বাদরটার লজ্জা নেই একটুও)

রাতে সবাই খেতে বসেছি,হটাত বাইরে খুব বৃষ্টি শুরু হয়ে গেলো।এই বৃষ্টির মধ্যে মামা আর নানি আমাদের যেতে দিতে চাইলেন না।আর আমরা তো কোনদিন এই বাসাতে আসিওনি তাই আরো বেশি জোর করলো মামা।আমরাও সুযোগটা হাত ছাড়া করলাম না।আমি আর সৌরভ মিলে মা বাবাকে রাজি করিয়ে ফেললাম।রাতে খাওয়া দাওয়া শেষে আমরা তিন ভাইবোন,আকাশ ভাইরা তিন ভাই আর স্নিগ্ধা ভাবি সবাই মিলে গেলাম নানির ঘরে।নানি বিছানায় শুয়ে আছে।অভ্র ভাই নানির পাশে বসে বললেন,
–কি ব্যাপার দাদি হটাত জরুরি তলব পড়লো সবার।কিছু বলবা??

–হ্যা বলবোই তো সবাই বসো তো আমার পাশে একটুক্ষানি(নানি অভ্র ভাইয়ের হাত ধরে উঠে বসতে বসতে বল)
(আমরা কেউ নানির খাটের ওপর বসি আবার কেউ চেয়ার টেনে বসে।এইভাবে সবাই বসি নানির কথা শুনতে।)

–হ্যা দাদি এবার বলো কি বলবা?(অন্তু ভাইয়া বলে)

–তোদের সবার সাথে বসে তো গল্প করা হয়নি কোনদিন তাই ডাকলাম।সমস্যা নেই তো কোন??

–না না কিসের সমস্যা কোন সমস্যা নেই।

সবাই মিলে নানারকম গল্প করতে লাগলাম।এর মাঝে হটাত অন্তু ভাইয়ের কল এলো।উনি বাইরে চলে গেলেন।কিছুক্ষন পর ফিরে এসে আকাশ ভাইকেও সাথে নিয়ে গেলেন কি সব কথা বলতে।

রাত ১১টা ২৫,
আকাশ আর অন্তু ভাই দুজনেই ব্যাগপত্র নিয়ে রেডি।অফিসের ইমার্জেন্সি কাজে দুইজনকেই এখন চিটাগং যেতে হবে।এই রাত আবার এতো বৃষ্টি বাইরে মামি তো কান্নাকাটি শুরু করে দিলেন।কিন্তু মামা মামিকে অনেক ধমক দিলো।
–ছেলেরা কাজে যাচ্ছে আর উনি কান্নাকাটি করে বাড়ি মাথায় করছে।ছেলেরা কি একেবারের জন্যে যাচ্ছে।আর অফিসের কাজ পড়লে তারা কি করবে??শোন অন্তুর মা তুমি ভালো করেই জানো আমার কাছে কাজটা অনেক আগে।তাই আমার ছেলেদেরও নিজের কাজটা ভালো মতো করতে হবে সে যেই পরিস্থিতিই হোক না কেন।আর একদম কাঁদবে না।
মামি কাঁদতে কাঁদতে কি যেন বলতে চেয়েছিলো কিন্তু মামার ঝাড়ি খেয়ে আর বলতে পারিনি।অন্তু ভাইয়া আর আকাশ ভাই দুজন সবার দোয়া নিয়ে বিদায় নিলো।আমরা যে যার ঘরে এসে শুলাম।হটাত রাত ৩টার দিকে আমার খুব পানি পিপাসা লাগলো।উঠে দেখলাম ঘরে পানি নেই।পানি খেতে গেলে এখন ডাইনিং এ যেতে হবে।একা একা কেন যেন সাহস পেলাম না।তাই আপুকে ডাকা শুরু করলাম,
–আপু,এই আপু ওঠ না।
–হুউম(ঘুম জাড়ানো কন্ঠে)
–ওঠ না একটু।
–কেন??
–পানি খাবো।
–তা খা না।আমাকে জ্বালাচ্ছিস কেন?(ঘুমের মধ্যে)
–আমার একা ভয় লাগে।প্লিজ প্লিজ ওঠ।
আপু উঠতে চায়নি তাও আমি জোর করে আপুকে উঠিয়ে নিয়ে পানি খেতে গেলাম।আমি জগ থেকে পানি ঢালছি আর আপু দাড়িয়ে দাড়িয়ে ঘোড়ার মতো ঝিমোচ্ছে।আপুকে এই অবস্থায় দেখে আমার বেশ হাসি পেল।পানি খাওয়া শেষে দুজন আবার রুমে আসবো হটাত স্নিগ্ধা ভাবির কান্নার আওয়াজ পেলাম যেন।আমার আর আপুর দুজনেরি ঘুম কেটে গেল।তাড়াতাড়ি স্নিগ্ধা ভাবির ঘরে গিয়ে দেখি ওনার লেবার পেইন উঠেছে।আমি আর আপু তো বেশ ভয় পেয়ে গেলাম।আপু আমাই বললো বাসার সবাইকে ডাকতে।আমি তাড়াতাড়ি বাসার সবাইকে ডেকে আনলাম।

১০ মিনিট পর,
ভাবি তো এখনো ব্যাথায় ছটফট করছে।মা,মামি,নানি কান্নাকাটি করছে আর আল্লাহর কাছে একাধারে দোয়া করছে।আমি আর আপু ভাবির হাত পায়ের তালু ডলছি।অভ্র ভাই তো এম্বুলেন্স কল করছে কিন্তু বাইরে এতোটাই বৃষ্টি যে কোন হাসপাতাল থেকেই এম্বুলেন্স পাঠানো পসিবল।এসব দেখে মামার প্রেশার বেড়ে গেছে।মামাকে নিয়ে তো আরেক টেনশন।অভ্র ভাই না পেরে বলে উঠলেন,
–বাবা ৪ কিলোমিটার পরে যে ক্লিনিকটা আছে ভাবিকে ওখানে নিয়ে যাবো।
–কি ওখানে??কিন্তু ওইটা তো….
–জানি কিন্তু ভাবিকে তো এইভাবে মরতে দিতে পারিনা।সুমনা গেইট খোলো।
(আপু তাড়াতাড়ি মেইন গেইট খুলে দেই।অভ্র ভাই স্নিগ্ধা ভাবিকে কোলে তুলে নেই)
–আমি যাই?
–না বাবা তোমার শরীর ভালো না তুমি থাকো।আমি সুমনা,সূচী তো আছিই।

আমরা তিন জন মিলে ভাবিকে নিয়ে ক্লিনিকে নিয়ে যাওয়ার জন্যে বের হলাম।কিন্তু বাইরে এতো বৃষ্টি যে গাড়িই নিয়ে যাওয়া যাচ্ছে না।খুব কষ্টে ভাবিকে ক্লিনিক পর্যন্ত নিয়ে গেলাম।ভাবিকে অপারেশন থিয়েটারে নিয়ে যাওয়া হলো আর আমরা ৩ জন বাইরে বসে আল্লাহকে ডাকতে লাগলাম।কিছুক্ষন পরই ভিতর থেকে এক ডাক্তার বের হয়ে এলেন আমরা ছুটে ডাক্তারের কাছে গেলাম।
–ডক্টর সাহেব ভাবি?ভাবি কেমন আছে?
–দেখুন আপনার ভাবির অনেকটা ব্লিডিং হচ্ছে।ওনার অবস্থা খুবই খারাপ।এক্ষুনি ওনাকে রক্ত দেয়া লাগবে।কিন্তু ওনার ব্লাড আমাদের হাসপাতালে নেই।
–কোন গ্রুপ লাগবে ডক্টর?
–AB+
–আমার তো AB+ না।আমি এখন কি করবো? এই অবস্থায় কোথায় পাবো রক্ত?(অভ্র ভাই মাথায় হাত দিয়ে বলেন)
–আমার তো AB+ আমি রক্ত দিতে পারি তো(পাশ থেকে হটাত আপু বলে ওঠে।আপু বলার পর আমারও মনে পড়ে যে আসলেই তো আপুর AB+)
–আপনি শিউর?(ডাক্তার জিজ্ঞেস করে)
–ইয়েস ডক্টর
–ওকে আপনি নার্সের সাথে যান তাহলে।

আপু নার্সের সাথে চলে যায়।আমি একটা চেয়ারে বসি আর অভ্র ভাই পায়চারি করতে থাকে।দু মিনিট পর আবার একজন নার্স আসেন।নার্সকে আমি দাড়িয়ে পড়ি আর অভ্র ভাই ও আমার পাশে দাড়িয়ে পড়ে।নার্স অভ্র ভাইয়ের কাছে এসে একটা কাগজ এগিয়ে দেই।উনি অবাক হয়ে বলেন,
–এটা?
–এটা এগ্রিমেন্ট পেপার।আপনার পেশেন্টের অবস্থা খুবই ক্রিটিকাল।কখন কি হয়ে যায় বলা যায় না।তাই এখানে আপনার সিগনেচার লাগবে।এখানে লেখা আছে ডেলিভারির সময় যদি মা বা বাচ্চার কোন ক্ষতি হয় তার দায় হাসপাতাল কতৃপক্ষের নয়।তাড়াতাড়ি এখানে সিগনেচার করে দিন তা ছাড়া ট্রিটমেন্ট শুরু করা যাচ্ছে না।

অভ্র ভাই কাগজটা হাতে নিয়ে কিছুক্ষন তাকিয়ে থেকে ধপ করে চেয়ারে বসে পরে।উনি মাথায় হাত দিয়ে বিচলিত হতে থাকে।আমিও ওনার পাশে বসে পড়ি।
–ভাইয়া নেই এখানে।বাড়ির বড়োরাও নেই।কি করবো আমি এখন??এমনিতেই প্রেগন্যান্সিতে প্রবলেম ছিলো আর এখন তো।কি করবো আমি।(অভ্র ভাইয়ের গলা ধরে আসে।এক্ষুনি বুঝি কেঁদে ফেলবে।ওনাকে দেখেয় বোঝা যাচ্ছে খুবি দোটনায় আছে।এদিকে সময়ও পেরিয়ে যাচ্ছে।না পেরে উনি কিছুক্ষনের জন্যে চোখ বন্ধ করে ফেলেন।কয়েক সেকেন্ড পর চোখ খুলে সই করে দেন।সই করার সাথে সাথে ওনার চোখ দিয়ে এক ফোটা পানি কাগজটার ওপর পড়ে।এতোক্ষনের কষ্ট,ভয়,টেনশন টা চোখের পানি হয়ে বের হয়ে যায়।উনি কাগজটা নিয়ে বসেয় আছে।ওনাকে এইভাবে দেখে আমিই ওনার হাত থেকে কাগজটা নিয়ে নার্সকে দিয়ে দিই।নার্স চলে যায়।উনি এবার কান্নায় ভেঙে পড়েন।ছেলেদেরকে আমি কখনো এইভাবে কাঁদতে দেখিনি।উনি মুখে হাত দিয়ে হাওমাও করে কাঁদছে।আমি কয়েকবার ওনার কাধে হাত রাখতে গেলাম কিন্তু পেরে উঠলাম না।)

৩০ মিনিট মতো পার হয়ে গেছে।এখনো আপুও আসিনি আর স্নিগ্ধা ভাবিরওও কোন খোজ পাইনি।অভ্র ভাই এখন আর কাঁদছে না কিন্তু অনেক টেনশনে আছে।এদিকে বাড়ি থেকেও বারবার কল আসছে।ওদিকেও তো সবাই চিন্তায় আছে।হটাত ও.টি. থেকে একজন মহিলা ডাক্তার বের হয়ে এলেন।অভ্র ভাইয়ের কাছে এসে বললেন,
–পেশেন্ট আপনার কি হয়??
–জী ভাবি হয় আমার।
–যান মিষ্টি আনুন
–মানে?(অভ্র ভাই অবাক হয়ে বলে)
–আপনি চাচা হয়েছেন।আপনার ভাবির মেয়ে বাবু হয়েছে।কংগ্রাচুলেশনস।
ডাক্তার কথাটা বলেই হাসতে হাসতে চলে যায়।আর অভ্র ভাই বোকার মতো দাড়িয়ে থাকে।আমি ওনাকে ডাকতে ওনার হুশ ফেরে আর আমার নাম ধরে জোরে চিতকার করে আমাকে কোলে নিয়ে ঘুরতে থাকে।আমি তো ফ্রিজড হয়ে যায় ওনার এই কান্ডে।হটাত ওনার কি হলো কিছুই মাথায় ঢোকে না।আমাকে কোলে নিয়ে ঘুরাতে ঘুরাতে যখন ওনার হটাত মনে পড়ে,উনি আমাই নামিয়ে দেয়।তারপর জিহ্বায় কামড় দিয়ে লজ্জা পেয়ে যায়।আমি এখনো স্ট্যাচুর মতোই দাড়িয়ে আছি।উনি যে এরকম কিছু করবেন তা আমি কল্পনাও করিনি।এর মধ্যেয় আপু চলে আসে।
–সূচী ভাবির মেয়ে হয়ছে তাই না??আল্লাহর অশেষ রহমত বল??
ভাবির বাচ্চাটাও আমাদের দেখিয়ে নিয়ে যায় নার্স এসে।প্রথমে কোলে নেয় অভ্র ভাই তারপর আমরা দুজন।বাড়ির লোক তো মহাখুশি ওদিকে অন্তু ভাইয়াও মেয়ের বাবা হওয়ায় খুবি খুশি।

৪ দিন পর ভাবিকে বাড়িতে নিয়ে যাওয়া হয়।অন্তু ভাইরাও এসে গেছে।মা আর সৌরভ এই কয়দিন মামার বাড়িতেই ছিলো।আমি,আপু আর বাবা বাসায় চলে এসেছিলাম।কিন্তু বাবু নিয়ে ভাবি বাসায় পর আমরা আবার দেখতে আসি।

চলবে………