তোমাকে নিয়েই গল্প পর্ব-১৩

0
1104

#তোমাকে_নিয়েই_গল্প
#পর্ব:১৩
#জুনাইনাহ_তাসনিম_অরহা

মায়ের জন্যে বাধ্য হয়ে আমার অভ্র ভাইয়ের সাথে যাওয়া লাগলো ভার্সিটি।আমি ওনার গাড়িতে বসে আছি পাশের সীটে।উনি খুব চিল মোডে গাড়ি চালাচ্ছে।
–গাড়ির টায়ার লিক হলো কিভাবে?

–হুম কিছু বললে?

–গাড়ির টায়ার লিক হলো কিভাবেএএ?(এবার বেশ মেজাজ খারাপ করেই বলি)

–আমি কিভাবে জানবো?তোমাদের গাড়ি,তোমাদের গ্যারেজে ছিলো,তোমাদের ড্রাইভার এসে বলেছে তাই তোমরা জানবে।আমাকে জিজ্ঞেস করছো কেন??

–গাড়ি আমাদের,গ্যারেজ আমাদের,ড্রাইভার ও আমাদের।কিন্তু গাড়ির টায়ার লিক তো আপনি করেছেন।কেন করলেন এমন??(আমি বেশ গম্ভীর ভাবেই কথা বলছি)

–মানে?আমি কেন এসব করবো?আজব!আমি কিছু জানি না।

–একদম মিথ্যা বলবেন না।আমি দেখেছি সব।

এবার আর উনি মিথ্যে বলতে পারলেন না।কারন আমি সত্যিই সব দেখে ফেলেছিলাম।সকালে সাওয়ার নিয়ে এসে আমি জানালার কাছে দাড়িয়ে যখন চুল আঁচড়াচ্ছিলাম তখন গার্ডেনে মেরুন টি-শার্ট পরা একজনকে গাড়ির আশে পাশে ঘুরতে দেখি।বাইরে বেশ কুয়াশা থাকাই মুখ দেখতে পারিনি।ভেবেছিলাম সৌরভ হয়তোবা।কিন্তু নিচে এসে দেখি অভ্র ভাই মেরুন টি-শার্টে।আর যখন ড্রাইভার কাকু এসে টায়ার লিক এর কথা বললেন আমি তখনই বুঝে গেছিলাম যে কাজ টা ওনারই।কিন্তু কেন করলেন এমন??সেটাই তো জানার বিষয়।
–কেন করলেন এমন?

–সূচী আসলে সেদিন রাতের পর তুমি আমাকে ভুল বুঝেছিলে সেই জন্যেই আমি অনেকবার তোমার সাথে কথা বলতে চেয়েছি।কিন্তু পারিনি।আমি আসলে…

–প্লিজ এখন আর সরি বলা লাগবে না।আপনি যেটা করেছেন সেটার পর কোন সরিতেই আমার কষ্টটা,খারাপ লাগাটা কুমবে না।

–আমি জানি সেদিন…..

(আমি ওনার কথা শেষ করতে দিই না)
–কি জানেন আপনি?কিচ্ছু জানেন না।জানেন একটা মেয়ের কাছে ওইভাবে হ্যারাসমেন্টের শিকার হওয়াটা কতোটা যন্ত্রনার?রাস্তার মাঝখানে সেদিন ওরা আমার সাথে….(আমি কেঁদে ফেললাম।কিছুক্ষন পর নিজেকে সামলিয়ে আবার কথা শুরু করলাম)আপনি না খুব শক্তিশালী তাহলে সেদিন কোথায় ছিলো আপনার হিরোগিরি??ওহ সরি,সরি।আমি তো আবার ভুলেই গেছিলাম অন্যদের কে কি বললো তাতে তো আবার আপনার কিছু যায় আসে না।আপনাকে যদি ওরা কিছু বলতো তাহলে প্রতিবাদ করতেন আপনি।আবরার না সেদিন ঠিকই বলেছিলো।আপনি কাপুরুষ।আপনার সামনে যদি কোন মেয়ের ইজ্জত ও চলে যায় আপনি চুপচাপ দাড়িয়ে থাকবেন।

–সূচীইই

–চিল্লাবেন না মিষ্টার ইশরাক এহসান।আমিও কিন্তু চিল্লাতে পারি।আমিও কিন্তু চিল্লিয়ে সবাইকে সেদিনের কথা বলতে পারি।কিন্তু আমি যদি সেটা করি আপনার সম্মানটা থাকবে তো আপনার ম বাবার কাছে?একটা মেয়েকে ইভটিজিং করা হচ্ছে দেখেও যে ছেলে চুপ থাকে তার তো বাড়িতে চুড়ি পরে বসে থাকা উচিত।আপনিও গিয়ে সেটাই করুন।

ওনার ওপর এতোদিন যতো রাগ ছিলো সব বের হয়ে যায় আমার কথার ভিতর দিয়ে।অবশ্য আমি যে ওনাকে ক্ষমা করে দিয়েছি তা একেবারেই না।

১৮.
দেখতে দেখতে আমার পরীক্ষা শেষ হয়ে যাই।এর মাঝে আমার আর অভ্র ভাইয়ের সাথে কোন কথা হয়নি।অবশ্য আমি চাইও না ওনার সাথে কোন কথা বলতে।এদিকে আপুর ও পরীক্ষা শেষ।আপুর পরীক্ষা শেষ হওয়ার পরের দিনই খুব সকাল সকাল মা আমার ঘরের দরজা ধাক্কাতে লাগলো।
–সূচী।এই সূচী দরজা খোল।
মা এতো জোরে জোরে দরজা ধাকাচ্ছে আর চিলাচ্ছে যে ঘুমিয়ে থাকা আর সম্ভব হলো না।বাধ্য হয়ে হাই তুলতে তুলতে দরজা খুলতে গেলাম।ঘুম ঘুম কন্ঠে জিজ্ঞেস করলাম,
–কি হয়েছে মা?এভাবে দরজা ধাকাচ্ছো কেন?
–সূচী জানিস কি হয়েছে?
–কি হয়েছে??
–তুই তাড়াতাড়ি ফ্রেশ হয়ে নিচে আয়।
মা কথাটা বলেই নিচে চলে গেল।আমার বেশ রাগ হলো।এমনিই সকাল সকাল আমার ঘুমের বারোটা বাজিয়ে দিলো।পরীক্ষা শেষ কোথায় একটু আরাম করে ঘুমাবো তারও উপায় নেই।আবার ঘুম ভাঙালো কি কারনে সেটাও বলে গেলো না।কিছু না বলে হুট করে মায়ের চলে যাওয়া এই স্বভাবটা খুবই বিরক্তিকর।আমি আর ঘুমাতে গেলাম না কারন মা আবার আসবে আমি যদি এখন আবার ঘুমাই তো।ফ্রেশ হয়ে নিচে গিয়ে দেখি বাবা ডাইনিং এ বসে কি সব লিস্ট বানাচ্ছে।মা বলে বলে দিচ্ছে আর বাবা লিখছে।পাশে আপু আর সৌরভ ও বসে আছে।আমাকে দেখে সৌরভ বলে উঠলো,
–মহারানী আপনার ঘুম ভেঙেছে তাহলে??খুব কষ্ট হয়ে গেলো না এতো তাড়াতাড়ি আপনাকে উঠিয়ে দেয়া হলো??আসুন আসুন আপনার আসন গ্রহন করুন।
(সৌরভ একটা চেয়ার টেনে দিতে দিতে বলে।এমনিই মা ওইভাবে ডেকে দিয়েছে এখন আবার সৌরভের খোচা মারা কথা।মেজাজ আরো খারাপ হলো কিন্তু কিছু বললাম না।ওর টেনে দিয়া চেয়ারটাতে না বসে অন্য একটা চেয়ার টেনে বসলাম।)
–বাবা তুমি আজ অফিস যাও নি?আজ তো তোমার অফ ডে না।
–না রে মা আজ তো অফিস ছুটি নিয়েছি।ভাইজানরা আসবে তো।
–ভাইজান!মানে মামা?কেন মামা কেন আসবে??
–মামা কেন আসবে মানে?তোর মা তোকে কিছু বলিনি?
(আমার মুখ দেখে বাবা ভালোমতোনই বুঝতে পারলো যে মা কিছুই বলিনি।বাবা মায়ের দিকে তাকিয়ে মাথায় হাত দিলো)
–আজকে তো সুমনা আর আকাশের বিয়ের কথা ফাইনাল করতে আসবে।
–মানে??বাবা তুমি সত্যি বলছো??
–হ্যা রে মা।

আমি তো আনন্দে লাফিয়ে উঠলাম।আর আপু তো লজ্জা পাচ্ছে শুধু।দুপুর হওয়ার আগে আগেই মামা,মামি,স্নিগ্ধা ভাবি,আয়ান,পিচ্চি অহনা আর মামার কাছের একজন বন্ধু এলেন।আমি আপুকে নিচে নিয়ে এলাম।দুই পরিবারের সম্মতিতে ২ সপ্তাহ পর বিয়ে ঠিক হলো।কিন্তু বিয়েটা ঢাকায় হবে না।আমার নানীর খুব ইচ্ছা বিয়েটা আমার নানাবাড়ির গ্রামে হবে।নানীর কথার বিরুদ্ধে তো আর যাওয়া যায়না।তাই সবাই রাজি হয়ে গেলো নানীর প্রস্তাবে।

রাতে আমি আর আপু আপুর ঘরে বসে আড্ডা দিচ্ছি।মূলত আমি আপুর পিছনে লাগছি।ছোটবেলা থেকেই আমরা দুই বোন খুব ক্লোজ তাই বেশ ভালো মতোনই ওর পিছনে লাগছি আকাশ ভাইকে নিয়ে।ও তো বেশ লজ্জা পাচ্ছে,মাঝে মাঝে আমাকে থামতে বলছে।এর মাঝে হটাত মা চলে এলো।আমাদের জন্যে গ্লাস ভর্তি গরম দুধ এনেছে।
–কি নিয়ে এতো গল্প হচ্ছে দু বোনের??
–কিছু না মা।
–কিছু তো বটেই।আমাকে বলবি না তাই বল।
–সেরকম সিরিয়াস কোন ম্যাটার না মা।(আপু হেসে বলে ওঠে)
–ঠিক আছে।এই নে দুধ খা দুজন।গরম করে এনেছি।
–দুধ?না মা প্লিজ আমি খাবো না।আমার বমি আসে।
–না বললে তো হবে না সূচী।সবটা খেতে হবে।
–নাআআআআআ….

আমি নাকি কান্না শুরু করলাম।মা বাধ্য হয়ে আর জোর করলো না।আপু গ্লাসের সবটুকু দুধ শেষ করে মাকে দেয়।মা চলে যাওয়ার সময় বলে,
–আচ্ছা সুমনা শোন।স্নিগ্ধা বলছিলো ছোট বাবু নিয়ে ও সব দিন যেতে পারবে না শপিং এ।তুই আর আকাশ সুমনাকে নিয়েই যাস।আর ওউ যাবে কোনকোন দিন।
–আচ্ছা মা।
মা চলে যায়।আমি আপুর খাটে শুয়ে পড়ি।
–আপু
–হুম
–আকাশ ভাইরে বলবি বিয়েতে আমাকেও যেন বেনারসি শাড়ি কিনে দেই।তা না হলে কিন্তু,,,
–কিন্তু?
–তোর বাসর ঘরে সি.সি. টিভি ক্যামেরা লাগিয়ে দিয়ে তোদের রোমান্স টেলিকাস্ট করবো।
–কি??তবে রে…

আপু আমার দিকে তেড়ে আসে।আমি তাড়াতাড়ি উঠে পালাই।কারন বেশিক্ষন থাকলে আপুর হাতে মার খাওয়া লাগতো।

১৯.
পরেরদিন বিকালে রেডি হচ্ছি।উদ্দেশ্য আপুর বিয়ের ফার্স্ট ডে শপিং এ যাওয়া।আমি ব্লাক এন্ড হোয়াইট লং কুর্তির সাথে ম্যাচিং ব্লাক হিজাব আর ব্লাক হাতের কাজের চাদর পরে নিলাম।বেশ পার্ফেক্টলি চোখে আইলাইনার দিলাম আর ঠোটে ডার্ক রেড লিপস্টিক।রেডিই হচ্ছি তার মাঝখানে হটাত আপু চলে এলো,
–কি রে তোর হলো??
–হ্যা হয়েই গেছে যাস্ট একটু পারফিউম দেয়া বাকি।
–আচ্ছা আচ্ছা তাড়াতাড়ি আয়।আজ কিন্তু গাড়ি নেই।রিক্সাই যাওয়া লাগবে।

আপু কথা বলতে বলতে চলে গেলো।আমিও ফটাফট পারফিউম লাগিয়ে ব্যাগটা নিয়ে নিচে চলে এলাম।নিচে গিয়ে দেখি আপু অলরেডি বাইরে চলে গেছে।মা তাড়াতাড়ি আমাকে বাইরে যেতে বললো আমিও দৌড় দিলাম।বাইরে গিয়ে দেখি আকাশ ভাই দাড়িয়ে।
–এই তো আমার ছোট বোনটি এসে গেছে।
–বোন কি হ্যা??শালি বলেন,শালি।জানেন না শালি হলো আধিঘরওয়ালি।
–ওহ সরি সরি।ভুল হয়ে গেছে শালি সাহেবা।
–তা দুলাভাই পকেটে টাকা পয়সা বেশি বেশি আছে তো??
–হ্যা ভালোই তো নিয়ে এসেছি।কিন্তু কেন বলোতো?
–এ মা!এটুকুও বুঝতে পারছেন না।সবই ডিটেলসে বুঝিয়ে দেয়া লাগবে না কি?
–আচ্ছা আচ্ছা।আই গেইজ বুঝেছি।
–বুঝলেই ভালো।
–চিন্তা নেই শালি সাহেবা।ঘরওয়ালির ব্যবস্থা করতে পারলে আপনারটাও হবে।
–ঠিক আছে দেখা যাবে।
–আচ্ছা এবার যাওয়া যাক?
–হ্যা।
–ওকে।তাহলে আমি আর তোমার বোন এক রিক্সা আর তুমি আর অভ্র আরেক রিক্সাই যাবো।
–আমি আর অভ্র মানে??
–হ্যা অভ্র…

আকাশ ভাই বাম দিকে তাকালো।আমিও তাকালাম।ব্লাক জিন্স,হোয়াইট টি শার্ট আর ব্লাক জ্যাকেটে জনাব দাড়িয়ে।আমি তো এতোক্ষন ওনাকে খেয়ালই করিনি।ওনার সাথে যেতে আমি একদম রাজি হলাম না।কিন্তু আপুর কথার জন্যে আর উপায় নেই।আপু আর আকাশ ভাই একটা রিক্সা নিয়ে আগে চলে গেলো।আর আমরা দুজন যাবো পরের রিক্সাই।প্রথমে আমি উঠলাম তারপর উনি।আমি শুকনা হলেও উনি তো ৬ফিট লম্বা মোটামুটি ভালো স্বাস্থ্য এর অধিকারী।তাই দুজনের গা একে অপরের সাথে লেগে গেছিলো প্রায়।আমি সাথে সাথে সরে গেলাম বেশখানিকটা।আর এক ইঞ্চি সরলেই হয়তো নিচে গিয়ে পড়বো।আমাকে একদম ধারে বসা দেখে উনি বললেন,
–পড়ে যাবে তো।
আমি কোন কথা বললাম না ওভাবেই বসে রইলাম।কারন আমি এখনো ওই রাতের জন্যে ওনাকে ক্ষমা করতে পারিনা।ওনার মুখ দেখলেই আমার ওসব মনে পড়ে।উনি হয়তো বুঝলেন তাই আমাকে আর কিছু বললেন না।উনি রিক্সাওয়ালাকে ডেকে বললেন,
–মামা আপনি রিক্সার হুড তুলে দেন।
–আইচ্চা মামা।
(রিক্সা ওয়ালা হুড তুলতে আসলো।আমি চিল্লিয়ে উঠলাম)
–না হবে না হুড তোলা।
–কিন্তু…
–কোন কিন্তু না আপনি রিক্সা চালান যান।
–হুড না তুললে তুমি পড়ে যাবে।(অভ্র ভাই বললো)
–যাই পড়ে তাতে আপনার কি??মামা যান আপনি রিক্সা চালান।হুড তোলা লাগবে না।

রিক্সা ওয়ালা অভ্র ভাইয়ের দিকে তাকায়।অভ্র ভাই ইশারা করে ওনাকে হুড তুলতে মানা করে।রিক্সা ওয়ালা চালানো শুরু করে।আমি অন্যদিকে তাকিয়ে বসে থাকি।বেশ খানিকক্ষন পর অভ্র ভাই বলে ওঠেন,
–আমাকে কি ক্ষমা করা যায় না সূচী?
–……….
–সূচী..
(আমি ওনার দিকে তাকিয়ে বেশ জোরেই কথা বলে উঠি)
–কি সূচী সূচী করে যাচ্ছেন?আমি আগেও বলেছি এখনও বলছি আপনাকে ক্ষমা করা যায়না।আপনি যেটা করেছেন তা ক্ষমার অযোগ্য।তাও কেন বারবার….
–আচ্ছা আচ্ছা আমি আর বলছি না।তুমি প্লিজ এইভাবে রাস্তার মাঝে চিল্লাচিল্লা করো না।প্লিজ ফর গড সেক।

আমি আর কিছু বলি না।শপিং মলে পৌছে যাই।কিন্তু আপুদের দেখছি না।অভ্র ভাই রিক্সাওয়ালাকে ভাড়া দেই আর আমি এদিকে আপুকে কল দিচ্ছি।আপু কল রিসিভ করে বলে শপিং মলের ভিতরে চলে যেতে।আমি অভ্র ভাইকে না বলেই হাটা দিই।
ওদিকে,,
–মামা এক্ষান কথা জিগাই?
–হুম জিগাও
–মামি বড্ড রাগি।তাই না??
অভ্র ভাই আসে কোন উত্তর দেই না।রিক্সাওয়ালা আবার বলে,
–তবে মামিরে দেইখ্যায় বুঝা যায় মন ডা ভালা।
–হুম।

অভ্র ভাই আমার পিছন পিছন মলের ভিতরে চলে আসে।

চলবে……
(গল্পটা কেমন হচ্ছে জানাবেন.কোন ভূলত্রুটি হলে ক্ষমা করবেন
ধন্যবাদ)