তোমাকে নিয়েই গল্প পর্ব-১৮

0
986

#তোমাকে_নিয়েই_গল্প
#পর্ব:১৮
#জুনাইনাহ_তাসনিম_অরহা

২৭.
মামার বন্ধু আসলাম সাহেবের বাড়ি দাওয়াত খাওয়ার পর এবার বাড়ি ফিরার পালা।সৌরভ,আপু,আকাশ ভাই আর অন্তু ভাইয়া এক গাড়ি দখল করে নিলো।বাকি আছি আমি,মারিয়া,আয়ান আর অভ্র ভাই।অন্তু ভাইয়ের গাড়ি আগেই বের হয়ে গেছে।যাওয়ার সময় বলেছে আমাদের চারজনকে চলে আসতে।ওনার অদ্ভুত ব্যবহারের জন্যে তো আমার এখন ওনার সাথে থাকতেও কেমন কেমন লাগছে।যাই হোক এখন তো আর উপাইও নেই।আয়ান আগে ভাগেই গাড়ির পিছনে উঠে পড়েছে।মারিয়াও পিছনে বসলো।আমিও তাই পিছনে উঠার জন্যে গাড়ির দরজা খুলতে যাচ্ছিলাম কিন্তু অভ্র ভাই ক্ষপ করে আমার হাত ধরে ফেলে।আমি আড়চোখে ওনার দিকে তাকাই,উনি বেশ চোখ ছোট ছোট করে তাকিয়ে আছে।
–কি সমস্যা?হাত ধরলেন কেন?
–তুমি ওখানে বসতে যাচ্ছো কেন?
–তো কোথায় বসবো?
–সামনে বসবে।আমি কি তোমার ড্রাইভার নাকি যে পিছনে বসবে?যাও সামনে বসো।
–মানে টা কি?মারিয়া আর আয়ানও তো পিছনে বসেছে।তাহলে?
–এই পিচ্চি মাথায় আর তাহলের মানে খুজতে যেও না।যা বলছি চুপচাপ শোন(হালকা ধমক দিয়ে)

আমার খুব রাগ হলো।কিন্তু কি আর করার অসভ্য সাদা বাদরটারে কিছু বললে তো আরো বেশি ঝামেলা বাধাবে তাই চুপ থাকাই ভালো।আমি সামনের সীটে গিয়ে বসে খুব জোরে দরজা লাগিয়ে দিলাম।বাইরে থেকে অভ্র ভাই বলে উঠলো,
–আমার গাড়িটা ভেঙে ছাড়বে তো এই মেয়ে।মেয়ে তো না যেন……..
উনি গাড়িতে এসে বসলেন।গাড়িতে এসে বসার পর উনি আমার দিকে ঝুকে আসে।আমি তাকাতেই দেখি উনি ঠিক আমার সামনে চলে এসেছে ঝুকে।ওনার মুখটা আমার মুখের ঠিক সামনে।এইভাবে হটাত চলে আসাতে আমার খুব ভয় লেগে গেলো।সেকেন্ডেই আমার হার্টবিট বেড়ে গেলো।এতো কাছে এসে যাওয়ায় ওনার শরীরের স্মেল আসছে,আর ওনার চোখ দুটো,আমি সাথে সাথে চোখ বন্ধ করে ফেলি।কিন্তু উনি এরকম করছে কেন,হুশ ফিরতেই আমি চিল্লিয়ে উঠি,
–কি হচ্ছে এটা?
–………..
–কি করছেন এসব?
–সীট বেল্ট বাধছি রে বাবা
(মুচকি হেসে সীট বেল্ট বাধতে বাধতে বলে)
–এসবের কোন দরকার ছিলো না।আর আমি নিজেও পারি সীট বেল্ট বাধতে।
–তুমি তো পিচ্চি মেয়ে পাখি,পারবা না একা?

উনি সীট বেল্ট বেধে নিজের জায়গায় গিয়ে বসেন।কিন্তু ওনার আবার আমাকে পাখি ডাকা শুনে আমার হার্টবিট যেন আরো বেড়ে গেল।আমি যে কি বলবো বুঝতে পারছিলাম না।আমার মুখ দিয়ে একটা কথাও বের হচ্ছে না।ঠোটে কেউ যেন আঠা লাগিয়ে দিয়েছে।উনি তো মুচকি মুচকি হেসেই যাচ্ছে।ওদিকে পিছনের সীটে বসে আয়ান মোবাইলে গেম খেলে আর মারিয়া হা করে আমাদের দিকে তাকিয়ে আছে।অভ্র ভাই গাড়ির মধ্যের লুকিং গ্লাস ঠিক করার সময়,
–আমার ভাইপোর কার বান্ধবী এভাবে হা করে থেকো না,গালে মাছি ঢুকে যাবে তো।

ওনার কথা শুনে মারিয়া তাড়াতাড়ি গাল বন্ধ করে ফেলে।তারপর অন্যদিকে তাকিয়ে পড়ে।পরে অবশ্য ওনার দিকে আরেকবার আমার দিকে এইভাবে তাকাতে থাকে মারে।আর আমার অবস্থা তো কি আর বলি!সব মাথার উপর দিয়ে যাচ্ছে।আমি ওনার দিকেই তাকিয়ে ছিলাম বোকার মতো।উনি সামনের দিকে তাকিয়ে ড্রাইভ করার সময় মুচকি হেসে বলে,
–এতো তাকিয়ে থেকো না,প্রেমে পড়ে যাবে তো।

ওনার কথা শুনেই আমি অন্যদিকে ঘুরে যাই,কিন্তু ওনার এসব কান্ড আমার মাথায় কিছুতেই ঢুকছে না।এসবই ভাবছিলাম কানে ওনার আওয়াজ এলো যে আমরা পৌছে গেছি।উনি আবার আমার সীটবেল্ট খুলতে এগিয়ে আসছিলো কিন্তু তার আগেই আমি প্রায় চিল্লিয়েই বলে ফেলি,
–আমি পারি।
উনি আর এগিয়ে আসেন না।হেসে ফেলেন।তারপর গাড়ি থেকে বের হয়ে যান।আমিও তাড়াতাড়ি বের হয়ে যাই।

*ঘরে ঢুকার পর দেখি মারিয়া দুই কোমরে দুই হাত বেধে দাড়িয়ে আছে।চশমা পরা তাও চোখ দুটো ছোট করে গোয়েন্দা স্টাইলে দাড়িয়ে।আমার জন্যেই যেন দাড়িয়ে আছে এইভাবে গোয়েন্দাগিরি করার জন্যে।আমাকে দেখেই ওর চশমাটা ঠিক করে নিয়ে আমার কাছে চলে এলো।
–কি চলছে রে তোদের মধ্যে?
–কাদের মধ্যে?
–তোর আর অভ্র ভাইয়ের মধ্যে।উনি আবার তোরে পাখি বলে ডাকলো।সূচী আমার গোয়েন্দাগিরির অভিজ্ঞতা কিন্তু এটাই বলছে যে উনি তোর প্রেমে পড়েছেন।
–উনি আমার প্রেমে পড়েছে?হাও ফানি!আর তুই আবার কবে গোয়েন্দাগিরি করলি যে অভিজ্ঞতা থেকে বলছিস?
–করেছি করেছি।তুই জানিস না।আর তাছাড়া এসব কথা বাদ দে।অভ্র ভাইয়ের কথা বল।
–ওনার কথা আবার কি বলবো?ঘুম পাই,ঘুমাবো।

আমি মারিয়াকে এড়িয়ে যাই।মারিয়া কিছুক্ষন ঘ্যান ঘ্যান করার পর চুপ করে যাই।কিন্তু আমার মনের মধ্যে ঘুরপাক খাচ্ছে।উনি তো আগে কখনো এরকম করতেন না।তাহলে হটাত করে এরকম কেন করছে?আর ওনার সাথে লিফটের মধ্যেও তো একটা মেয়েকে খুব ক্লোজ দেখেছিলাম।দেখে তো জিএফই মনে হচ্ছিলো।তাহলে?ধুর এসব ভেবে মাথা ব্যাথা শুরু হয়ে গেলো।আমি আর কিছু না ভেবে ঘুমানোর চেষ্টা করলাম।মারিয়াও ঘুমিয়ে গেছে এতোক্ষনে।আমিও চোখ বন্ধ করে প্রায় ঘুমিয়ে গেছি হটাত দরজা ধাক্কানোর আওয়াজ এলো।এতো রাতে দরজা ধাক্কানোর আওয়াজে আমার বুক কেঁপে ওঠে।এতো রাতে কে দরজা ধাক্কাচ্ছে এভাবে??দরজা একাধারে ধাক্কাচ্ছে কেউ একজন।আমি মারিয়াকে ডাকতে যেয়েও ডাকলাম না।নিজেই বিছানা থেকে নেমে গায়ে ওড়না জড়িয়ে আস্তে আস্তে এক পা দু পা করে এগচ্ছি দরজার ওপাশে থাকা মানুষটা কে আর এতো রাতে কিই বা বলতে চায় তা জানার জন্যে।খুব ভয়ে ভয়ে দরজা খুললাম।কিন্তু দরজা খুলেই বড় রকমের শকড।দরজার সামনে অভ্র ভাই দাড়িয়ে।আমি দরজা খোলার সাথে সাথে ঘরে ঢুকে গেলো।
–আরে আরে কি করছেন?এতো রাতে এখানে কি আপনার?
–তোমার কাছে একটা জিনিস রয়ে গেছে আমার।সেটাই নিতে এলাম(বিছানার এক পাশে বসতে বসতে বলে)
–আমার কাছে আবার আপনার কোন জিনিস আছে?
–মন
–কি?মন মানে?
–কিসের মন?কানে বেশি শুনতেছো না কি আজকাল?বললাম ফোন।আমার ফোওওওওন রয়ে গেছে তোমার কাছে।
–কিন্তু আপনি তো প্রথমে….হোয়াটেভার আমার কাছে আপনার ফোন থাকতে যাবে কেন??
–কারন তুমি আমার ফোনটাকে নিজের ভেবে নিয়ে এসেছো আর তোমার ফোনটা গাড়িতে ফেলে এসেছ।
(ওনার কথা শুনে আমি তাড়াতাড়ি আমার ফোন চেক করি।সত্যিই তো আমি নিজের ফোনের বদলে ওনার ফোন নিয়ে চলে এসেছি।আমি তাড়াতাড়ি ওনার ফোনটা দিয়ে নিজের ফোনটা ওনার হাত থেকে নিয়ে নিই)
–আমি ইচ্ছা করে এটা করিনি।নিজের ফোন পেয়ে গেছেন এবার যান এখান থেকে।
–হ্যা চলেই যাবো।আমি তোমার ঘরে সারারাত থাকতে আসিনি।

উনি উঠে চলে যান।আমি আবার দরজা দিতে লাগাতে যাই তখন হটাত সামনে চলে আসে।এইভাবে হটাত করে সামনে আসার কারনে আমি ভয় পেয়ে যাই।
–আবার কি চায়?
–তোমার বফ নায়?কোন কল বা মেসেজ আসলো না যে।
(ওনার কথা শুনে খুব বিরক্ত লাগে)
–না নেই।(বিরক্তির সূরে বলি)
–হুউউউম।পিচ্চি মেয়ে তো।যাক ব্যাপার না।ঘুমাও,গুড নাইট।

আমি আর কোন কথা না বলে ওনার মুখের ওপরেই দরজা লাগিয়ে দিয়ে,বিছানাই এসে বসে পড়ি।এই লোকটা যে কি করছে কিছুই মাথাই ঢুকছে না কিন্তু যাই করছে খুবই বিরক্তিকর।আমি চোখমুখ শক্ত করে বসে রইলাম।পাশ থেকে মারিয়া কাথার ভিতর থেকে মুখ বের করে বলে,
–আমি আগেই বলেছিলাম উনি তোকে……..
ও কথা শেষ করতে পারলো না।আমি এমনভাবে চোখ পাকালাম যে ও ভয়ে আবার কাথা মুড়ি দিয়ে শুয়ে পড়লো।

*সকালে ঘুম থেকে উঠে ফ্রেশ হয়ে নিচে গেলাম।কিন্তু কেউ নেই।সারা বাড়িতে যেন আমি আর মারিয়া আর কেউ নেই।রান্নাঘর,রুম সব খুজলাম কাউকে দেখছি না।বাইরে থেকে কিছু আওয়াজ পেলাম।আমি আর মারিয়া আওয়াজটা পেয়ে বাড়ির বাইরে এসে দেখি ১০-১২ জন লোক বাশ,ফুল,সামিয়ানা নিয়ে কাজ করছে মানে প্যান্ডেল বানানো শুরু করেছে।বাড়ির সবাই আছে বেশ আগ্রহ নিয়ে।মামা,বাবা,অন্তু ভাই ওসব লোকদের সাথে কি সব আলোচনা করছে।আমাকে আর মারিয়াকে দেখে মা ডাক দেই।আমরাও সবার সাথে গিয়ে দাড়াই।
–সেই কোন সকাল থেকে বিয়ে বাড়ির কাজ শুরু হয়ে গেছে।আর তোরা এতো দেরি করলি??(মা বলে)
আমি মায়ের উত্তর দিয়ার আগেই অভ্র ভাই বলে ওঠে,
–ফুপি তোমার মেয়ের যে ঘুম তা কি আর এতো সকালে ভাঙে??
(আমি ওনার দিকে আড়চোখে চোখ গরম করে তাকাই।উনি চুপ করে যায়)

বাড়ির সামনে যে ফাকা জায়গা বা উঠান সেখানেই বিয়ের সব আয়োজন করা হচ্ছে।গ্রামের অনেক মানুষ আসছে বিয়ে বাড়িতে।আমি আগে কোনদিন গ্রামের বিয়ে দেখিনি।তাই এই নতুন পরিবেশে খুব ভালো লাগছে।শহুরে বিয়ের একদম অপোজিট।গ্রামের সহজ সরল মানুষরা এতো মজা করছে কি বলবো।কিন্তু এর মাঝেও আমার একটু খারাপ লাগছে।আপুর বিয়ে হয়ে যাবে।ছোট বেলা থেকে যার সাথে বেড়ে উঠেছি সেই মানুষটা পরশুদিন কারোর বাড়ির বৌমা,কারো স্ত্রী হয়ে যাবে।তার জীবনটা পাল্টে যাবে।আমার খারাপ লাগলেও কাউকে বুঝতে দিলাম না।বিকাল হয়ে গেছে।আর দু-তিন ঘন্টা পরই মেহেদি অনুষ্ঠান।যদিও নিজেরা নিজেরাই বড় কোন আয়োজন ন।আমি আর মারিয়া মিলে আপুকে রেডি করে দিলাম।ডার্ক গ্রীন লেহেঙ্গা,হিজাব,হালকা মেকাপ আর ব্রাইডাল জার্মান সিলভার গহনা পরেছে আপু।আমরাও লাইট গ্রীন শারারা,হিজাব আর জার্মান সিলভার কিছু অর্নামেন্টস পরে নিলাম মেয়েরা।মা,মামি মানে বড়রা পরেছে গ্রীন শাড়ি।আর বাড়ির ছোট বড় সব ছেলেরা পরেছে সাদা পাঞ্জাবি।ব্যাস সবাই রেডি এবার অনুষ্ঠান শুরু করার পালা।আপুকে সবাই মিলে স্টেজে নিয়ে গেলাম।মেহেদি পরাবো আপুকে।কিন্তু স্টেজে এসে খেয়াল হলো মেহেদিই তো আনা হয়নি।আমি তাড়াতাড়ি রুমে এলাম মেহেদি নিয়ে আসতে।কিন্তু কোথাও মেহেদি খুজে পাচ্ছি না।আমি পুরো ঘরটা তন্ন তন্ন করে মেহেদির বক্স খুজা শুরু করলাম।অনেকক্ষন পর মেহেদি খুজে পেয়ে বুকে হাত দিয়ে স্বস্তির নিশ্বাস নিলাম।কিন্তু সেই মুহুর্তেই কে যেন আমার কাধে হাত রাখলো আর আমার বুক ধক করে কেঁপে উঠলো।আমি সাথে সাথে পিছু ঘুরে দেখি অভ্র ভাই।
–এখনো মেকাপ শেষ হয়নি তোমার?সবাই প্যান্ডেলে চলে গেছে আর তুমি এখনো মুখে আটা ময়দা মাখছো?গায়ের রং তো আল্লাহ দিলে ভালোই আছে তাও এতো আটা ময়দা মাখার কি দরকার?
–…………
–কি হলো চুপ করে আছো কেন?
–আপনি এখানে কি করছেন?(বিরক্ত হয়েই বলি,কারন এইভাবে হটাত আমার কাধে হাত রাখাতে আমি ভয় পেয়েছি হালকা)
–ফুপি তোমাকে ডাকতে পাঠিয়েছে।তাই এসেছি।হাহ!
–হ্যা তো ডাকতে এসেছেন সেটা বললেই হয়।আমি মেকাপ করছি কি অন্য কিছু করছি তা নিয়ে আপনার এতো মাথা খারাপ করার কোন দরকার নেই তো।সরুন..
আমি ওনাকে সরিয়ে প্যান্ডেলে চলে যাই।

চলবে……
(গল্পটা কেমন হচ্ছে জানাবেন.কোন ভূলত্রুটি হলে ক্ষমা করবেন
ধন্যবাদ)